কাদিয়ানীরা অমুসলিম

কাদিয়ানীরা অমুসলিম

ড. মুহাম্মদ ইছমাইল নোমানী-

রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামার ওফাতের পর হতে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র চক্রান্ত চলে আসছে। বহু হতভাগা ভন্ড নবী দাবি করে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করে আসছিল। ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত সিদ্দিকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এরূপ বহু চক্রান্ত মুকাবেলা করেছেন এবং যুগে যুগে ঈমানদার মুসলমানগণ এসব ভ্রান্ত মতবাদীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে। এমন এক ভয়ঙ্কর ফিতনার নাম কাদিয়ানি ফিতনা। যুগে যুগে এ ভ্রান্ত ও ভন্ডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ করেছেন।
সাম্প্রতিককালে কাদিয়ানীদেরকে নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক তুলকালামকা- ঘটেছে। গত ৭ মার্চ ২০২৩ তারিখে পঞ্চগড়ে আহমদিয়া মুসলিম জামাতের উদ্যোগে আয়োজিত সমাবেশকে কেন্দ্র করে সেখানে এক লংকাকা- ঘটে যায়। হতাহতের পর সে স্থানের বাসিন্দারা জেল-জুলুমের শিকার হয়। কারণ এলাকার মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল ওই নামধারী আহমদিয়া মুসলিম জামাতের মাহফিল বন্ধ করার জন্য। এ প্রবন্ধে কাদিয়ানীদের ভ্রান্ত আক্বিদা তুলে ধরা হলোঃ যাতে সে কাদিয়ানী আহমদিয়া জামাতকে সবাই চিনে আর বুঝে যে, তারা কত ভয়ঙ্কর! মুসলিম জামাত নামধারী হলেও প্রকৃতপক্ষে তারা অমুসলিম।

কাদিয়ানীদের আকীদাসমূহ
১. মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (১৮৪০-১৯০৮ খ্রি.)এর বক্তব্যঃ ‘‘আমি পূর্ববর্তী নবীদের মত একজন নবী।’’
২. তার উপর ওহী নাযিল হয়।
৩. তার মতে, সে রাসূলের সমমর্যাদা সম্পন্ন।
৪. ياتي من بعدي اسمه احمد আয়াত দ্বারা দলিল গ্রহণ করে অর্থ বিকৃত করে বলেছে- এখানে আহমদ বলতে গোলাম আহমদ কাদিয়ানী উদ্দেশ্য।
৫. ১৯৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের সময় সে ৫০টি ঘোড়া ক্রয় করে ৫০জন অশ^ারোহী দিয়ে বৃটিশ সরকারকে সাহায্য করেছিল।
৬. কাদিয়ানীদের ভ্রান্ত বিশ^াস মতে, গোলাম আহমদ কাদিয়ানী যেহেতু নবী, তার পরিবার নুসরত জাহান উম্মুল মুমিনীন। সে গোলাম আহমদকে যারা দেখেছে তারাও সাহাবী।
৭. কাদিয়ানীদের জলসা হজে¦র সমতুল্য।
৮. সে নিজের এলাকা কাদিয়ানকে রাসুলের রাজধানী বলেছে। সুতরাং তার এসব কুফরী কথাবার্তার ভিত্তিতে বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও আদালত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (মৃত্যু. ১৯০৮ খ্রি) ও তার অনুসারীদের কাফির ও অমুসলিম ঘোষণা করেছে। তন্মধ্যে কয়েকটা হলোঃ
১. ইসলামি সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) ১৯৮৫ সালে ২২-২৮ ডিসেম্বর ছয়দিন ব্যাপি সৌদি আরবের এক সম্মেলনে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে ও তার মতবাদের অনুসারীদেরকে কাফির ঘোষণা করে।
২. রাবেতাতুল আলম আল-ইসলামী ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ এপ্রিল ১৪৫টি ইসলামী সংগঠনের এক আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলনে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে কাফির ঘোষণা করে।
৩. জামিয়া আল আযহার, আফগান সরকার ১৯১৯ সালে, আরব আমিরাত, সৌদি সরকার ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে, সিরিয়া ১৯৫৭ সালে, মালয়েশিয়া ১৯৮২ সালে, গাম্বিয়া ১৯৯০ সালে, তুরস্ক ১৯৩৫ সালে, পাকিস্তান ১৯৭৪ সালে কাদিয়ানীদেরকে কাফির ও অমুসলিম ঘোষণা করেন।
আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সহ সকল নবীকে বিশ^াস করা ফরয। সকল নবীর সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। তাঁর পর আর কোনো নবী পৃথিবীতে আগমন করবে না। এটুকু বিশ্বাস রাখা সমস্ত ঈমানদারদের উপর ফরয বা অকাট্যভাবে আবশ্যক।
আল্লাহ তাআলা বলেন-
ماكان محمد ابا احد من رجالكم
ولكن رسول الله وخاتم النبيين
মুহাম্মদ তোমাদের কোনো পুরুষের পিতা নন, বরং তিনি আল্লাহর রাসুল ও শেষ নবী।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সর্বশেষ নবী বিশ^াস করা ফরয। যা উক্ত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। তাঁর পরে কোনো নবী, উপনবী, যিল্লুন্নবী বা নবীর সহকারী কেউ আসতে পারে না। যদি কেউ দাবী করে সে দাজ্জাল, মিথ্যাবাদী ও মুরতাদ। তাদের সাথে ধর্মীয় ও সামাজিক কোনো সম্পর্ক বজায় রাখা মুসলমানদের জন্য জায়িয নয়। এটাই হলো খতমে নবুয়তকে বিশ্বাস করা। আর আকীদা জরুরিয়্যাতে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত। যারা নবীকে শেষ নবী মানে না তারা কাফির। যেমন আহমদিয়া মুসলিম জামাতের প্রতিষ্ঠাতা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী।

খতমে নবুয়ত
কুরআনের দলীল: ولكن رسول الله وخاتم النبيين এবং তিনি আল্লাহর রাসূল ও সর্বশেষ নবী।
হাদিসের দলীল: প্রায় দু’শতাধিক হাদিস দ্বারা খতমে নবুয়ত প্রমাণিত। বিশেষ করে অর্থগত ভাবে মুতাওয়াতির পর্যায়ে বর্ণিত একটি হাদিস হলো –
لا نبي بعدي ولا امة بعد امتي আমার পরে কোনো নবী নেই, আমার উম্মতের পরে আর কোনো উম্মত নেই।

ইজমার ভিত্তিতে খতমে নবুয়ত
রাসূলের ওফাতের পর সম্মানিত সাহাবীগণ খতমে নবুয়তের ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর আর কোনো নবী হতে পারে না। তাই মুসায়লামাতুল কায্যাবের বিরুদ্ধে খলিফাতুর রাসূল হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু খালিদ বিন ওয়ালিদকে জিহাদ করার জন্য প্রেরণ করেন। মুসায়লামার ৪০ হাজার সৈন্য ছিল। সে যুদ্ধে ৭শত হাফিযসহ ১২ হাজার মুসলমান শহীদ হন। সিদ্দীকে আকবর সবেমাত্র দায়িত্ব নিয়ে ভ-নবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। মুসালামাকেও ওই যুদ্ধে হযরত ওয়াইশী হত্যা করে জাহান্নামে পাঠিয়েছিলেন।

ইমামগণের মত
আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর কোনো নবী আগমন করবেন বলে বিশ^াস করলে সেও কাফির। এমন কি কেউ প্রমাণ তলব করলে সেও কাফির। তাই ইমাম আবু হানিফার কাছে একদল আলিম এসে বললেন- শেষনবী যারা মানে না তাদের বিরুদ্ধে আমরা একটা মুনাযারা (তর্ক যুদ্ধ)এর ডাক দিয়েছি। তিনি তা শুনে বললেন- তোমরা যারা মুনাযারায় সম্মতি দিয়েছো সবাই কাফির। কেননা এটা একটা মিমাংসিত বিষয় যে, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পরে কোনো নবী আগমন করবেন না।

মহানবীর যমানায়
আসওয়াদ আনাসী নবুয়ত দাবী করলে ফিরোয দায়লামী তাকে হত্যা করে ফেলে। ওই সংবাদ নবীকে জানালে নবীজি সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন।

হযরত আবু বকরের যমানায়
হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু খলিফা হওয়ার সাথে সাথে বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও তিনি মুুসায়লামার বিরুদ্ধে ইয়ামামার যুদ্ধ ঘোষণা করেন। খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে যুদ্ধে ওয়াহাশী তাকে হত্যা করেন এবং আবু দুজানা তলোয়ার চালায়।
তুলায়হা নামক এক ব্যক্তি নবুয়ত দাবী করলে আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তার বিরুদ্ধে খালিদ বিন ওয়ালিদকে পাঠান। তখন তুলায়হা প্রাণের ভয়ে সিরিয়া পালিয়ে যায়। পরে মুসলমান হয়েছিলেন।

খলিফা আব্দুল মালিক ইব্ন মারওয়ানের যমানায়
উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিকের খিলাফতকালে ‘হারিস’ নামক এক ব্যক্তি নবুয়ত দাবী করলে তিনি আলিমদের পরামর্শ নিয়ে তাকে গ্রেফতার পূর্বক হত্যা করেন।

খলিফা হারুনুর রশিদের সময়কালে
আব্বাসিয় খলিফা হারুনুর রশিদের খেলাফতকালে এক ব্যক্তি নবুয়ত দাবী করে বলে- আমি হলাম হযরত নূহ আলায়হিস্ সালাম। কেননা তার হায়াত ৫০ বছর বাকী ছিল। সে ৫০ বছর পূর্ণ করার জন্য আল্লাহ আমাকে নবী বানিয়ে পাঠিয়েছেন। তার প্রমাণ দিয়েছে-
فلبث فيهم الف سنة الا خمسين عاما অর্থাৎ হযরত নুহ আলায়হিস্ সালাম তাদের মধ্যে একহাজার বছর অবস্থান করেছেন, ৫০ বছর ব্যতীত। [সূরা আল-আনকাবুত:১৪।]
খলিফা হারুনুর রশিদ আলিমদের ফতওয়া মতে তাকে হত্যা করেন এবং শূলীতে তার লাশ ঝুলিয়ে দেন। [ফাতওয়া ও মাসাইল, খ. ১, পৃ. ৩০৩]

ইমাম জাফর বিন যুবায়র’র আমলে
ফাযাযী নামক এক ব্যক্তি নবুয়ত দাবী করে বসে। সে কিছু অলৌকিক ঘটনা দেখায়। সেগুলোকে সাধারণ মুসলমানেরা মুজিযা মনে করতে থাকে। এর ফলে কিছু মানুষ তার ভক্ত হয়ে যায়। [শাত্বিবী, ইতিসাম] 
তৎকালীন বুযুর্গ আলিম ইমাম জাফর ইব্ন যুবায়রের ফাতওয়ার ভিত্তিতে তাকে ও তার ভক্তদেরকে হত্যা করা হয়।

বৃটিশদের ষড়যন্ত্র
মুসলামানদের দ্বিধা বিভক্ত করার জন্য বৃটিশ সরকার মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে মাঠে নামায়। সে নবুয়ত দাবী করলে আলিমরা তার বিরোধিতা করে সমাবেশ করেন ও লেখালেখি করেন। ১৯৫৩ সালে পাকিস্তানের রাজধানী লাহোর রাজপথে আন্দোলন করতে গিয়ে ১০ হাজার মুসলমান শহীদ হন।
[ফাতওয়া ও মাসাইল, খ. ১, পৃ. ৩০৪, খতমে নবুয়ত, পৃ.৪১২]

পরিশেষে বলব- কাদিয়ানীরা কাফির, অমুসলিম। তারা এদেশে কোনো প্রচার, প্রসার কিংবা দাওয়াতী কার্যক্রম করার অধিকার রাখে না। তাদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করা সময়ের দাবী। তাই সরকারকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়ে নবীপ্রেমিকদের অন্তরে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জোর দাবী জানাচ্ছি। বৃটিশদের সেই ষড়যন্ত্র আজো চলমান। মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ-বিভক্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে ইসলামের শত্রুরা মাঠে-ময়দানে গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর দোসরদের লেলিয়ে দিচ্ছে। অতএব, মুসলমানদের সতর্ক থাকতে হবে।

লেখক : অধ্যক্ষ-আল আমিন বারীয়া কামিল মডেল মাদরাসা।

Share:

Leave Your Comment