যাকাত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠনে সহায়ক

যাকাত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠনে সহায়ক

মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ্ আল-মাসুম-

আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন পবিত্র ক্বোরআনে এরশাদ করেছেন- নিশ্চয়ই যারা সত্যে বিশ্বাস করে, সৎকর্ম করে, নামাজ কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, তাদের প্রতিফল তাদের প্রতিপালকের কাছে সংরক্ষিত। তাদের কোনো ভয় বা পেরেশানি থাকবে না। যাকাত শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত ঐ সম্পদকে বলে, যা নিজের চাহিদাদি পূরণ করার পর আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য কোন ফকিরকে দিয়ে দেওয়া। যাকাত স্বয়ং হাশেমী বংশীয়, হাশেমী বংশের আযাদকৃত গোলামের জন্য হালাল নয়। যাকাত ২য় হিজরীতে রোযার পূর্বে ফরয হয়েছিলো। অনেকর ধারণা যাকাত দিলে গচ্ছিত সম্পদ কমে যায়, বস্তুত যাকাত প্রদানে সম্পদ কমে না বরং সম্পদ পূর্বের চেয়েও বৃদ্ধি পায়। তাই যাকাত প্রদানকারীর এই বিশ্বাস রেখে সন্তুষ্টি চিত্তে যাকাত প্রদান করা উচিৎ যে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে উত্তম প্রতিদান দান করবেন। এ প্রসঙ্গে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, সদকা দ্বারা সম্পদ কমে না। যদিওবা প্রকাশ্যভাবে সম্পদ কমে যায় বলে মনে হয়, কিন্তু আসলে বৃদ্ধি পায়। যেমন গাছের পঁচে যাওয়া ডাল-পালা কাটার ফলে প্রকাশ্যভাবে গাছকে দেখতে ছোট মনে হয়, কিন্তু এই কর্তন তার ক্রম-বিকাশের অন্যতম উপায়। বক্ষমান নিবন্ধে এ প্রসঙ্গে বিশদ আলোচনার প্রয়াস পেলাম।
যাকাত কাদের উপর ফরয: সাবালক সজ্ঞান মুসলমান নেসাব পরিমাণ (সাড়ে সাত তোলা বা ৮৭ গ্রাম স্বর্ণ অথবা সাড়ে ৫২ তোলা রৌপ্য বা ৬১২.৩৫ গ্রাম কিংবা তার সমপরিমাণ সম্পদের টাকা অথবা ঐ পরিমাণ টাকার ব্যবসায়িক মাল) সম্পদের মালিক হওয়ার পর চান্দ্র মাস হিসেবে এক বছর অতিবাহিত হলে তার উপর যাকাত আদায় করা ফরয হয়। আর তা তার মৌলিক চাহিদা (তথা জীবন অতিবাহিত করার প্রয়োজনিয় বিষয়াবলী) হতে অতিরিক্ত হতে হবে। তাছাড়া এরূপ ঋণও না থাকে যে, যদি সেই ঋণ আদায় করে, তবে তার নিসাব পরিমাণ সম্পদ অবশিষ্ট থাকবে না। নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার দিন থেকে এক বছর পুর্তির পর যাকাতযোগ্য মালের বর্তমান বাজার দর হিসেবে ঐ সম্পদের ৪০ ভাগের একভাগ (অর্থাৎ ২.৫%) যাকাত হিসেবে নির্দিষ্ট শ্রেণির ব্যক্তিবর্গের মাঝে বন্টন করা ফরয।
যাকাতের ‘নিসাবের পরিমাণ’ বিভিন্ন দ্রব্যাদির ক্ষেত্রে বিভিন্ন হয়। নিচে এ সংক্রাস্ত বিস্তারিত দেয়া হলো-

উল্লেখ্য যে, কোন প্রকার সম্পদ স্বতন্ত্রভাবে নেসাব পরিমাণ না হয়ে একাধিক প্রকারের অল্প অল্প হয়ে সমষ্টিগতভাবে মূল্য হিসাবে ৫২.৫ তোলা রৌপ্যের মূল্য সমপরিমাণ হলেও যাকাত প্রযোজ্য হবে। একই পরিবারে একাধিক ব্যক্তি (যেমন, স্বামী, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে) নেসাবের মালিক হলে প্রত্যেককেই স্বতন্ত্রভাবে যাকাত আদায় করতে হবে। স্ত্রীর যাকাত স্বামীর উপর বর্তায় না, তেমনিভাবে সস্তানদের যাকাত পিতার উপর বর্তায় না। তবে কেউ যদি অন্যের অনুমতিক্রমে তার পক্ষ থেকে যাকাত দিয়ে দেয় তাহলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে।

যাকাত বন্টনের খাত
যাকাত সঠিকভাবে বন্টনের উপর গুরুত্বারোপ করে মহান আল্লাহ তা‘আলা যাকাত বন্টনের খাতসমূহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে- যাকাত তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও যাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য, যাদের মনোরঞ্জন উদ্দেশ্য তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফিরের জন্য। এ আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। উপর্যুক্ত আয়াতে করিমার আলোকে ইসলামী আইন শাস্ত্রবিদদের মতে, আট শ্রেণির মানুষকে যাকাত প্রদান করা যাবে। যথা:
১. ফকীর: যে দরিদ্র ব্যক্তির কাছে অতি সামান্য মাল আছে, অথবা কিছুই নেই, এমনকি একদিনের খোরাকীও নেই এমন লোক শরীয়তের দৃষ্টিতে গরীব। তাকে যাকাত দেওয়া যাবে।
২. নিঃস্ব: অভাবগ্রস্ত যার কিছুই নেই। এমনকি থাকার জায়গাও নেই। তাকে যাকাত দেওয়া যাবে।
৩. যাকাত সংগ্রহকারী কর্মচারী: ইসলামী সরকারের পক্ষে লোকদের নিকট থেকে যাকাত, উশর প্রভৃতি আদায় করে বায়তুল মালে জমা প্রদান, সংরক্ষণ ও বন্টন কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ।
৪. মুয়াল্লাফাতুল কুলুব: নব মুসলিম যার ঈমান এখনও পরিপক্ক হয়নি অথবা ইসলাম গ্রহণে ইচ্ছুক অমুসলিম।
৫. ক্রীতদাস/ বন্দী মুক্তি: ক্রীতদাস কিংবা অন্যায়ভাবে কোন নিঃস্ব ও অসহায় ব্যক্তি বন্দী হলে তাকে মুক্ত করার জন্য যাকাতের সম্পদ ব্যয় করা যাবে।
৬. ঋণগ্রস্ত: ঐ ব্যক্তি যার ঋণ পরিশোধের সম্পদ নেই কিংবা যে ব্যক্তি এমন ঋণগ্রস্ত যে, ঋণ পরিশোধ করার পর মৌলিক চাহিদা মেটানোর সম্পদ থাকে না তাকে যাকাত দেওয়া যাবে।
৭. আল্লাহর পথে: সম্বলহীন মুজাহিদ, অসহায় গরীব দ্বীনি শিক্ষারত শিক্ষার্থী এবং ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত অসচ্ছল ব্যক্তিবর্গ।
৮. মুসাফির: এমন মুসাফির যিনি অর্থ কষ্টে নিপতিত। কোনো ব্যক্তি নিজ বাড়িতে নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী, কিন্তু সফরে এসে অভাবে পড়ে গেছে বা মাল-সামান চুরি হয়ে গেছে এমন ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া যাবে। তবে এ ব্যক্তির জন্য শুধু প্রয়োজন পরিমাণ গ্রহণ করাই জায়েয, এর বেশি নয়।
উল্লেখ্য যে, গরীব আত্মীয়-স্বজনকেও যাকাতের মাল দেয়া যায় বরং তাদেরকেই আগে দেওয়া উচিত। অবশ্য তাদেরকে হাদিয়া বলে দেয়া ভালো যাতে তারা মনে কষ্ট না পায়। তবে তালিবে ইলমের কথা ভুলে গেলে চলবে না। তাদেরকে যাকাতের বড় অংশ দেয়া উচিৎ তাতে যাকাত তো আদায় হবেই সেই সাথে কুরআনী তা‘লীমের সহযোগিতা করার দরুণ সদকায়ে জারিয়ার সাওয়াবও অর্জিত হবে। যাকাতের টাকা এমন দরিদ্রকে দেওয়া উত্তম যে দ্বীনদার। তবে দ্বীনদার নয় এমন লোক যদি যাকাতের উপযুক্ত হয় তাহলে তাকেও যাকাত দেওয়া যাবে। বর্তমানে যাকাত শুধু মুসলমানদেরকেই দেওয়া যাবে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান বা অন্য কোনো অমুসলিমকে যাকাত দেওয়া হলে যাকাত আদায় হবে না। যাকাত দেওয়ার পর যদি জানা যায় যে, যাকাত-গ্রহীতা অমুসলিম ছিল তাহলে যাকাত আদায় হবে না। পুনরায় যাকাত দিতে হবে। তবে নফল দান-খায়রাত অমুসলিমকেও করা যায়। কোনো লোককে যাকাতের উপযুক্ত মনে হওয়ায় তাকে যাকাত দেওয়া হল, কিন্তু পরবর্তীতে প্রকাশ পেল যে, লোকটির নিসাব পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তাহলেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে। পুনরায় যাকাত দিতে হবে না। তবে যাকে যাকাত দেওয়া হয়েছে সে যদি জানতে পারে যে, এটা যাকাতের টাকা ছিল সেক্ষেত্রে তার ওপর তা ফেরৎ দেওয়া ওয়াজিব।

যে সব খাতে যাকাত দেয়া যাবে না
১. যে ব্যক্তির কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদ অর্থাৎ সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা, বাণিজ্যদ্রব্য ইত্যাদি নিসাব পরিমাণ আছে সে শরীয়তের দৃষ্টিতে ধনী। তাকে যাকাত দেওয়া যাবে না।
২. যে ব্যক্তির কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদ নিসাব পরিমাণ নেই, কিন্তু অন্য ধরনের সম্পদ যাতে যাকাত আসে না যেমন ঘরের আসবাবপত্র, পরিধেয় বস্ত্র, জুতা, গার্হস্থ সামগ্রী ইত্যাদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত এবং নিসাব পরিমাণ আছে তাকেও যাকাত দেওয়া যাবে না। এই ব্যক্তির উপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব।
৩. যে গরিব ব্যক্তির ব্যাপারে প্রবল ধারণা হয় যে, যাকাতের টাকা দেওয়া হলে লোকটি সে টাকা গুনাহের কাজে ব্যয় করবে তবে তাকে যাকাত দেওয়া জায়েয নয়।
৪.যাকাতের টাকা যাকাতের হক্বদারদের নিকট পৌঁছে দিতে হবে। যাকাতের নির্ধারিত খাতে ব্যয় না করে অন্য কোনো জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হলে যাকাত আদায় হবে না। যেমন রাস্তা-ঘাট, ব্রীজ নির্মাণ করা, কুপ খনন করা, বিদ্যুৎ-পানি ইত্যাদির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
৫. যাকাতের টাকা দ্বারা মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ করা, ইসলাম প্রচার, ইমাম-মুয়াজ্জিনের বেতন-ভাতা দেওয়া, ওয়াজ মাহফিল করা, দ্বীনি বই-পুস্তক ছাপানো, ইসলামী মিডিয়া তথা রেডিও, টিভির চ্যানেল করা ইত্যাদিও জায়েয নেই।
৬. নিজ পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, পরদাদা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ যারা যাকাত দাতার জন্মের উৎস তাদেরকে নিজের যাকাত দেওয়া জায়েয নেই। এমনিভাবে নিজের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতিন এবং তাদের অধঃস্তনকে নিজ সম্পদের যাকাত দেওয়া জায়েয নেই। স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে যাকাত দেওয়া জায়েয নেই।
৭. বাড়ির কাজের ছেলে বা কাজের মেয়েকে যাকাত দেওয়া জায়েয, যদি তারা যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হয়। তবে কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে যাকাতের অর্থ দিলে যাকাত আদায় হবে না। কেউ যদি কাজের লোক রাখার সময় বলে, মাসে এত টাকা করে পাবে আর ঈদে একটা বড় অংক পাবে। এক্ষেত্রে ঈদের সময় দেওয়া টাকা যাকাত হিসাবে প্রদান করা যাবে না। কেননা, সেটা তার পারিশ্রমিকের অংশ বলেই ধর্তব্য হবে। মোটকথা, যাকাতের টাকা এর হক্বদারকেই দিতে হবে। অন্য কোনো ভালো খাতে ব্যয় করলেও যাকাত আদায় হবে না।

যাকাত আদায় হওয়ার জন্য শর্ত
উপর্যুক্ত ব্যক্তিবর্গকে উক্ত সম্পদের মালিক বানিয়ে দেওয়া। যেন সে আনন্দচিত্তে তার প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। এরূপ না করে যদি যাকাতদাতা নিজের খুশি মতো দরিদ্র লোকের কোন প্রয়োজনে যাকাতের টাকা খরচ করে, যেমন-তার ঘর সংস্কার করে দিল, টয়লেট স্থাপন করে দিল কিংবা পানি বা বিদ্যুৎ এর ব্যবস্থা করল তবে যাকাত আদায় হবে না। নিয়ম হল, যাকাতের টাকা দরিদ্র ব্যক্তির মালিকানায় দিয়ে দেওয়া। এরপর যদি সে নিজের খুশি মতো এসব কাজেই ব্যয় করে তাহলেও যাকাতদাতার যাকাত আদায় হয়ে যাবে।

যাকাত, সাদাকা ও করের মধ্যকার পার্থক্য
যাকাত ও সাদাকার মাঝে একটু পার্থক্য আছে। কোনো সম্পদশালী ব্যক্তি তার মালের যাকাত আদায় করে দিলেই ইসলাম তাকে যাবতীয় সামাজিক ও জাতীয় দায়িত্ব থেকে মুক্ত বলে মনে করে না; বরং সম্পদশালীদের জন্য জাতীয় ও সামাজিক প্রয়োজনে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কিংবা বাধ্যতামূলকভাবে অর্থ সম্পদ ব্যয়ের অন্য একটি দায়িত্ব মুমিনদের ওপর অর্পণ করা হয়েছে, যাকে পরিভাষায় সাদাকা বলা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে এসব দায়িত্ব পালন ইসলাম ফরয বা বাধ্যতামূলক বলে সাব্যস্ত করেছে। আবার কোন কোন পরিস্থিতিতে এটাকে নফল সাদাকা বলেছে। যাকাতের সঙ্গে প্রচলিত অন্যান্য সকল ধরনের করের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। কারণ ইসলামের এ মৌলিক দানের মধ্যে একাধারে নৈতিক ঈমান ও সামাজিক মূল্যবোধ অন্তর্নিহিত রয়েছে। কিন্তু করের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো নৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক সহমর্মিতা ও সৌজন্যবোধের অস্তিত্ব নেই। সর্বোপরি যাকাত হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশিত বাধ্যতামূলক প্রদেয় অর্থ। সদকা হচ্ছে আল্লাহ নির্দেশিত ঐচ্ছিক প্রদেয় অর্থ। আর কর হচ্ছে সরকার কর্তৃক আরোপিত বাধ্যতামূলক প্রদেয় অর্থ। যাকাত শুধু দরিদ্রদের হক পক্ষান্তরে কর থেকে অর্জিত সম্পদ থেকে দেশের সকল নাগরিকের স্বার্থে ব্যয় করা হয়।
যাকাত মুসলিম ঐক্যের সোপান: যাকাত আদায়ের মাধ্যমে মুসলিম ঐক্য সুদৃঢ় হয়। এমনকি এটি সমগ্র মুসলিম জাতিকে একটি পরিবারে রূপান্তরিত করে। ধনীরা যখন গরীবদেরকে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে সহযোগিতা করে তখন গরীবরাও তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ধনীদের উপর সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে। ফলে তারা পরস্পরে ভাই ভাই হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,‘তুমি অনুগ্রহ কর যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন’
যাকাত মানুষকে অর্থনৈতিক পাপ থেকে রক্ষা করে: চুরি, ডাকাতিসহ অর্থ সম্পর্কিত অন্যান্য পাপ সমূহ থেকে মানুষকে রক্ষা করার অন্যতম মাধ্যম হল যাকাত। কেননা অর্থ সংকটের কারণেই মানুষ বাধ্য হয়ে চুরি-ডাকাতির মত জঘন্যতম অপরাধ করতে বাধ্য হয়। ধনীরা তাদের সম্পদ থেকে যাকাতের নির্দিষ্ট অংশ দ্বারা যখন গরীবদেরকে সহযোগিতা করবে ও তাদের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে, তখন তারা অবশ্যই উল্লিখিত অপরাধ থেকে বিরত থাকবে।
যাকাত আদায় করলে সম্পদ বৃদ্ধি পায়: ইরশাদ হচ্ছে,‘আল্লাহ সূদকে ধ্বংস করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ কোন অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালবাসেন না’। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,‘দান সম্পদ কমায় না; ক্ষমা দ্বারা আল্লাহ কোন বান্দার সম্মান বৃদ্ধি ছাড়া হ্রাস করেন না এবং যে কেউ আল্লাহর ওয়াস্তে বিনয় প্রকাশ করে, আল্লাহ তাকে উন্নত করেন’।

যাকাত বর্জনকারীর হুকুম
কেউ যদি যাকাত ফরয হওয়াকে অস্বীকার করে তাহলে সে মুরতাদ হয়ে যাবে। কেননা তা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা ফরয সাব্যস্ত হয়েছে। পক্ষান্তরে কেউ যদি যাকাত ফরয হওয়াকে স্বীকার করে কিন্তু অজ্ঞতাবশত অথবা কৃপণতার কারণে তা আদায় না করে তবে সে কবীরা গুনাহগার হবে। এমতাবস্থায় তার থেকে জোরপূর্বক যাকাত আদায় করা রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

যাকাত না দেয়ার কুফল
যারা কৃপণতাবশত যাকাত ফরয হওয়া সত্ত্বেও আদায় করে না তাদের জন্য রয়েছে দু’ধরনের শাস্তি। যথা- (ক) যাকাত অনাদায়কারীর পরকালীন শাস্তি : যাকাত অনাদায়ের ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে মহান আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন,
وَالَّذِيْنَ يَكْنِزُوْنَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُوْنَهَا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيْمٍ، يَوْمَ يُحْمَى عَلَيْهَا فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوْبُهُمْ وَظُهُوْرُهُمْ هَذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوْقُوْا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُوْنَ-
অর্থাৎ ‘যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় না করে তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও। যেদিন জাহান্নামের অগ্নিতে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে। আর বলা হবে, এটাই তা, যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে। সুতরাং তোমরা যা পুঞ্জীভূত করেছিলে তা আস্বাদন কর’। উপর্যুক্ত আয়াতে যাকাত আদায় না করার ভয়ংকর পরিণতির বর্ণনা উঠে এসেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে এর যাকাত আদায় করেনি, ক্বিয়ামতের দিন তার সম্পদকে টেকো (বিষের তীব্রতার কারণে) মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার মুখের দু’পার্শ্বে কামড়ে ধরে বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার জমাকৃত মাল।
যাকাত অনাদায়ের ভয়াবহ পরিণতি প্রসঙ্গে অপর হাদিসে এভাবেই এসেছে, “যেসকল স্বর্ণ ও রৌপ্যের মালিক তার হক (যাকাত) আদায় করে না, কিয়ামতের দিন তার জন্য আগুনের বহু পাত তৈরি করা হবে এবং সেগুলোকে জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে। এরপর তার পাঁজর, কপাল ও পিঠে তা দিয়ে দাগ দেয়া হবে। যখনই তা ঠা-ঠা হয়ে যাবে, সাথে সাথে তা পুনরায় উত্তপ্ত করা হবে। সেদিন, যার পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। যতদিন বান্দাদের বিচার নিষ্পত্তি না হয়, তার শাস্তি ততদিন চলমান থাকবে। অতঃপর সে তার পথ ধরবে, হয়ত জান্নাতের দিকে, নয়ত জাহান্নামের দিকে”। উপর্যুক্ত হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি, আমাদের জান্নাত-জাহান্নাম নির্ধারণে যাকাতই যথেষ্ট।
(খ) যাকাত ত্যাগকারীর দুনিয়াবী শাস্তি : আল্লাহ তা‘আলা পরকালে যেমন যাকাত ত্যাগকারীর জন্য কঠিন শাস্তি নির্ধারণ করেছেন। তেমনিভাবে দুনিয়াতেও তাদের রয়েছে কঠিন পরিনতি। যারা যাকাত আদায় করে না, আল্লাহ তা‘আলা তাদের অভাবে লিপ্ত করে দিবেন। জলে ও স্থলে যে সম্পদ নষ্ট হয়, তা যাকাত না দেয়ার ফলেই নষ্ট হয়। হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-
وَلاَ مَنَعَ قَوْمٌ الزَّكَاةَ إِلاَّ حَبَسَ اللهُ عَنْهُمُ الْقَطْرَ ‘
অর্থাৎ যে জাতি যাকাত দেয় না, আল্লাহ তাদের উপর বৃষ্টিপাত বন্ধ করে দেন’।

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র গঠনে যাকাত ব্যবস্থাপনার সুফল
ইসলাম যাকাত নীতির মাধ্যমে সম্পদের লাগামহীন সঞ্চয়কে নিয়ন্ত্রণ করে পুঁজিবাদের ধ্বংসাত্মক প্রভাব থেকে সমাজকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আবার হালাল-হারামের শর্ত, বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থা, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করে যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে সুবিচার ও ভারসাম্যমূলক অর্থনীতি উপহার দিয়েছে। যাকাতের আর্থ-সামাজিক প্রভাব সংক্ষেপে নি¤েœ তুলে ধরা হলো:
১. দারিদ্র বিমোচন: আমরা জানি, দারিদ্র দু’প্রকার: ক) কর্মহীন দরিদ্র: কর্মহীন দরিদ্র তারাই যারা আসলেই বেকার, তাদের করার মত কিছুই নেই। সাহায্য সহযোগিতার ফলে তারা সামান্য দ্রব্যসামগ্রী কিনতে সক্ষম হবে যা তাদের শুধু বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে। এদের জন্য অতিরিক্ত কোনো পদক্ষেপ গৃহীত না হলে কোনোভাবেই এরা দারিদ্রসীমার উপর উঠে আসতে পারবে না।
খ)কর্মরত দরিদ্র: অপরপক্ষে কর্মরত দরিদ্র হল তারা যারা কোনো না কোনো কাজে নিযুক্ত রয়েছে। যেমন, কৃষিপণ্য উৎপাদন, ছোট দোকান, ক্ষুদে ব্যবসা পরিচালনা কিংবা হাতের কাজ ইত্যাদি। যে কোনো কারণেই হোক তারা তাদের বর্তমান অবস্থান হতে কোনোক্রমেই আর সামনে এগুতে পারছে না। এসব লোকের জন্য চাই বিশেষ ধরনের সাহায্য সহযোগিতা, যাতে তারা স্ব স্ব পেশায় উৎপাদনের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। এদেরকে প্রয়োজনীয় উকরণ সরবরাহ, উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ে সাহায্য এবং প্রয়োজনীয় মূলধন যোগান দিতে হবে। যাকাতের অর্থের পরিকল্পিত ও যথাযথ ব্যবহার করা হলে উল্লেখিত সমস্যা সমাধানের ইতিবাচক ভূমিকা পড়বেই।
২. স্থিতিশীলতা: যাকাতের মাধ্যমে যদি পর্যাপ্ত অর্থ পাওয়া যায় তাহলে তা মুদ্রাস্ফীতি নিরোধক কৌশল হিসেবে অধিকতর কার্যকর হবে যদি উপযুক্ত বণ্টননীতি গৃহীত হয়। ইসলামী বিশেষজ্ঞদের মতে, মুদ্রাস্ফীতি চাপের সময়ে যাকাতের অর্থের বৃহত্তম অংশ মূলধনী পণ্য আকারে বিতরণ এবং মুদ্রা সংকোচনের সময়ে ভোগ্য দ্রব্য বা নগদ আকারেই তা বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ। অবশ্য এটা এক এক বার এক এক কৌশল হিসেবে বিবেচিত হবে।
৩. উৎপাদন মিশ্রণ: সমাজের বিত্তশালী শ্রেণির নিকট হতে দরিদ্র শ্রেণীর কাছে যাকাতের মাধ্যমে স্বল্প হলেও ক্রয় ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটে। যেহেতু দরিদ্রদের ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেশি সেহেতু এর ফলে দেশের সার্বিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এর সুপ্রভাব পড়বে বলে আশা করা যায়। যদি বিত্তবানরা পরিকল্পিতভাবে এলাকার দুস্থ, বিধবা, সহায়-সম্বলহীন পরিবারের মধ্যে বাছাই করে প্রতি বছর অন্ততঃ তিন-চারটি পরিবারকে নিজের পায়ে দাঁড়াবার জন্য রিক্সা, ভ্যান, নৌকা, সেলাইমেশিন কিংবা কয়েকটি ছাগল ইত্যাদি কিনে দেন তবে দেখা যাবে তাদের একার প্রচেষ্টাতেই পাঁচ বছরে তার এলাকায় অন্ততঃ ১০টি পরিবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে। অপরদিকে ভিক্ষুক ও অভাবী পরিবারের সংখ্যাও কমে আসবে। সুপরিকল্পিতভাবে যাকাত আদায় করলে আগামী ১৫ বছরের ভেতরেই সম্ভব এই দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্য অর্জন করা। আসুন, বিত্তবানরা প্রতিজ্ঞা করি পরিকল্পিতভাবে যথাযথভাবে যাকাত পরিশোধ করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলবো। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের তাওফিক দান করুন আমীন বিজাহিন নবিয়্যিল আমিন সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম।

লেখক: আরবী প্রভাষক, তাজুশ শরী‘আহ মাদরাসা, ষোলশহর,চট্টগ্রাম।

 

Share:

Leave Your Comment