মাহে রমজানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মাহে রমজানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মাওলানা মুহাম্মদ বোরহান উদ্দীন-

মাহে রমযান আরবী সনের নবম (৯ম) মাস। এ মাসেই রয়েছে বছরের শ্রেষ্ঠতম অনন্য রজনী লাইলাতুল ক্বদর। সামগ্রিকভাবে এ মাস বিশেষ তাৎর্পয পূর্ণ। এ মাসে মহান রাব্বুল আলামীন তাঁর বান্দার প্রতি করুণাধার হয়ে অসংখ্য রহমত দান;বান্দার অসংখ্য গুনাহ্ ক্ষমা করে তাকে মাগফিরাত দান এবং অজস্র গুনাগার বান্দাকে জাহান্নামের আজাব হতে নাজাত বা মুক্তি দেন। হাকীমুল উম্মত মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাফসীরে নঈমীতে উল্লেখ করেছেন “রমযান” শব্দটি “রহমান” শব্দটির মতো আল্লাহর একটি নাম। যেহেতু এ মাসে দিনরাত আল্লাহর ইবাদত করা হয় তাই এ মাসকে আল্লাহর মাস বলা হয়। রোযা রাখা অবস্থায় কেউ যদি বৈধ চাকুরী, হালাল ব্যবসা ইত্যাদি করে তাও আল্লাহর ইবাদত বলে গণ্য হবে অর্থাৎ আল্লাহ যেমন বলেছেন, আস-সাওমু লি” অর্থাৎ রোযা হলো শুধুমাত্র আমারই জন্যে। সুতরাং রোযাবস্থায় শরীয়তে বৈধ যা কিছু করা হবে তা ইবাদত বলেই গণ্য হবে। রমযান শব্দটি “রামদ্ধুন” হতে নির্গত যার অর্থ উষ্ণতা বা জ্বলে যাওয়া, দগ্ধ করা ইত্যাদি। যেহেতু এ মাসে মুসলমান রোযাদারগণ ক্ষুধা ও পিপাসার তাপ সহ্য করে নিজকে আত্মশুদ্ধি করার প্রায়াস চালায়। হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন” রোযা পাপগুলোকে জ্বালিয়ে ফেলে, তাই রমযানকে ‘রমদ্বান’ করে নাম রাখা হয়েছে। (কানযুল উম্মাল)

গাউসূল আজম বড়পীর শায়খ মুহিউদ্দীন আব্দুল কাদের জিলানী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রামাদ্বান’ আরবি পাঁচটি হরফ দ্বারা গঠিত যেমন রা, মীম, দোয়াদ, আলিফ ও নুন। এদের এক একটি হরফ এক-একটি নেয়ামতের প্রতি ইঙ্গিত করে। যেমন রা-দ্বারা ‘রিদওয়ানিল্লাহ’ আল্লাহর সন্তুষ্টি বা রাহমাতুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর রহমত (২) “মীম” দ্বারা মুহাব্বত বা আল্লাহর ভালবাসা (৩) ”দোয়াদ” দ্বারা ‘দেমানীল্লাহ’ তথা আল্লাহর জিম্মাদারী ৪) আলিফ দ্বারা ’উলফাতিল্লাহ তথা আকৃষ্ট-আকর্ষণ বা আমানিল্লাহ তথা আল্লাহর আমানত বা নিরাপত্তা (৫) নুন দ্বারা নুরুল্লাহ তথা আল্লাহ তা‘আলার নূর প্রকাশ করে বা বুঝানো হয়েছে।
অতএব একথা প্রতীয়মান হয় যে, মাহে রমযান আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জন, ভালবাসা পাওয়া, তারই জিম্মাদারীতে যাওয়া ও তারই ইবাদতের দিকে আকৃষ্ট হওয়ার এবং তাঁর নূর বা জ্যোতি দ্বারা নিজকে আলোকিত করার এক মহান মাস।
মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনুল করীমে ইরশাদ করেছেন- হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যেন তোমরা তাকওয়া বা খোদাভীরু হতে পার। (সূরা বাকারা)
অত্র আয়াতে ‘তোমাদের পূর্ববর্তী’ বলে মহান আল্লাহ তা‘আলা মুসলমানদের সান্তনা দিয়ে এটাই বুঝিয়েছেন রোযা একটি কষ্টকর শারীরিক ইবাদত তবে এটা শুধুমাত্র তোমাদের ওপর ফরজ এমনটা নয় বরং উম্মতে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্ববর্তী জাতিগুলোর উপরও ফরজ করা হয়েছিল। এই বিধান হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম পর্যন্ত সকল নবীর উম্মতের উপর শরীয়ত কর্তৃক ফরজ ছিল। রোযার মাধ্যমে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তির তাড়না নিয়ন্ত্রণ করে তাকওয়া বা পরহেযগারীর শক্তি ও গুণাবলী অর্জন করে। ফলে বান্দার সকল ইবাদত তাঁর প্রতিপালকের নিকট অতি সহজে কবুল হয় ও বান্দা তার নামায, দোয়া ও ইবাদতে মজা খুঁজে পায় ও একাগ্র চিত্তে সকল ইবাদাতে মনোনিবেশ করে।
আর তাকওয়ার গুণে মানুষের মধ্যে নৈতিকতার বিকাশ ঘটে ফলে লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা, ক্রোধ, নেশা, মিথ্যা বুলি, প্রতারণা, অশ্লিলতার চর্চা ইত্যাদি থেকে পবিত্রতা অর্জন করে।
হযরত আবু হোরায়রা রদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-“যখন পবিত্র রমযান মাস আগমন করে তখন আকাশের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয়। অপর এক বর্ণনায় এসেছে, জান্নাতের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয়। অথবা রহমতের দরজা খুলে দেয়া হয়, আর জাহান্নামের দরজা সমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং (বিতাড়িত ও অভিশপ্ত) শয়তান গুলোকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। (সহিহ বুখারী ও মুসলিম শরীফ)

অন্য এক হাদীস পাকে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যখন রমযানের প্রথম রাত আগমন করে তখন শয়তানসমূহ ও অবাধ্য জিনদেরকে শিকলাবদ্ধ করা হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়, অত:পর জাহান্নামের একটি দরজাও খোলা হয় না, জান্নাতের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয় এবং একটি দরজাও বন্ধ করা হয় না। এসময় একজন আহ্বানকারী আহ্বান করতে থাকেন এ বলে “হে পূণ্যের অন্বেষণকারী! সামনে অগ্রসর হও! “হে মন্দের অন্বেষণকারী থেমে যাও। আর আল্লাহ গাফুরুর রাহীম রমযানের প্রতিটি রাতেই অসংখ্য বান্দাকে জাহান্নাম হতে মুক্তি দেন। (তিরামিজি ও ইবনে মাজাহ শরীফ)

পবিত্র মাহে রমযান রহমতের এক পরিপূর্ণ মহাসাগর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন তোমাদের নিকট বরকতময় রমযান এসেছে। আর আল্লাহর বিশেষ রহমত পাওয়ার জন্য এতে এমন একটি বিশেষ রাত রয়েছে যা হাজার মাস (৮৩ বছর ৪ মাস) অপেক্ষা উত্তম। এ রজনীতে যে কল্যাণ, রহমত-মাগফিরাত ও নাজাত হতে বঞ্চিত হয়েছে/হবে বস্তু:ত সে সর্বপ্রকার আল্লাহর কল্যাণ/রহমত সমূহ হতে বঞ্চিত হয়েছে। (ইমাম আহমদ ও নাসায়ী (রহ.)
এভাবে অসংখ্য হাদীসে পাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের বরকত ও ফজিলত বর্ণনা করেছেন।
রাসলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-“আদম সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের বিনিময় দশ-গুণ হতে সাতশগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন তবে রোযা এর ব্যতিক্রম! কেননা এ রোযা একমাত্র আমার জন্যই (বান্দা) পালন করে। সুতরাং আমিই এর (রোযার) প্রতিদান প্রদান করব। ইবাদত সমূহের মধ্যে রোযাই একমাত্র ইবাদত যার প্রতিদান আল্লাহ পাক নিজ হাতে নিজেই প্রদান করবেন বলে পৃথিবী বাসীকে সুসংবাদ দিয়েছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন “বিচার দিবসে (কিয়ামতের দিন) রোযা সুপারিশ করবে রোযাদারের জন্য। রোযা বলেবে ‘হে আমার রব দিনের বেলায় আমি তাকে (তোমার এ বান্দাকে) পানাহার ও প্রবৃত্তির বাসনা হতে বাধা দিয়েছি’ সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। অত:পর রোযার সুপারিশ কবুল করা হয়। (বায়হাকী শুয়াবুল ঈমান, মিশকাত শরিফ-১৮৬৬)
রোযাদারের ফজিলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- নিশ্চয়ই রোযাদারের সুখের দূর্গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশক আস্বরের সুগন্ধ হতে ও উত্তম বা প্রিয়। (বুখারী ও মুসলিম শরিফ)
আল্লামা ইমাম বাগাবী (রহ.) বলেন” এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর রোযাদারের প্রশংসা করা এবং বান্দার প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্ট থাকার ইঙ্গিত করে। আল্লামা মারুযী বলেন ‘এখানে রূপকভাবে এ উক্তিটি করা হয়েছে “অর্থাৎ সুগন্ধিকে মানুষ যেভাবে কাছে টেনে নেয়, তদ্রুপ রোযাদারকে আল্লাহ তাআলা নৈকট্য দানের মাধ্যমে নেয়ামত দান করবেন। তাছাড়া রোযাদারের জন্য ২ টি খুশি রয়েছে (১) ইফতার করার সময় (২) আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়। অন্য এক হাদীসে পাকে এসেছে “যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশায় পবিত্র রমযানের রোযা রাখে, রাতে ইবাদতে কাটাবে ও কদর রাতে ইবাদত করবে আল্লাহ তায়ালা তাঁর পূর্বের সমুদয় (সগীরাহ) গুনাহ ক্ষমা করে দেন”। (সহিহ বুখারী ও মুসলিম শরিফ)

পবিত্র মাহে রমযান প্রকৃত পক্ষে মাগফিরাত ও গুনাহ্ ক্ষমা পাওয়ার মাস। প্রখ্যাত সাহাবী হযরত সাহল ইবনে সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বার্ণিত তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন “জান্নাতে আটটি দরজা রয়েছে। তন্মধ্যে-একটি দরজার নাম ‘রাইয়ান’ আর ঐ দরজা দিয়ে রোযাদার ব্যতীত কাউকে প্রবেশ করার অধিকার দেয়া হবেনা। (মিশকাত শরিফ -১৮৬১)

হাদীসে পাকে এও এসেছে ‘এ মাসে আল্লাহ তা‘অলা দিনে ও রাতে অসংখ্য জাহান্নামীদের মুক্তি তথা নাজাত দান করেন’। অতএব রমযানে অবতীর্ণ কুরআনুল কারীমের শাশ্বত বিধানকে মানুষের সামগ্রিক জীবন ধারায় বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমাজে উদারতা-ক্ষমা, ধৈর্য-মহত্ত্ব, দানশীলতা-কষ্ট সহিষ্ণুতা প্রভৃতি-মহৎ মানবীয় গুণাবলিকে বিকশিত করে তোলা এবং অন্যায়-অবিচার, কু-প্রবৃত্তি-কলুষমুক্ত অনাবিল ও নির্মল সমাজ-রাষ্ট্র গড়ে তোলা রমাযানের প্রকৃত আহ্বান। তাছাড়া বছর ঘুরে রমযান শরীফ আসে আর যায়। আমরা সাহরী ও ইফাতারের নানা উন্নতমানের খাবার সামগ্রী আহার করি। কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজ হতে যদি পাপ-পষ্কিলতা-পৈশাচিকতা, অন্যায়-অত্যাচার, সুদ-ঘুষ, হত্যা-রাহাজানি, ব্যবসায় অসৎ উপার্জন বন্ধ করতে, অন্যের অধিকার বুঝিয়ে দিতে না পারি তবে আমাদের জন্য রমযান হবে নাম সর্বস্ব আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বান্দেগী, কোরআন তেলায়াত, যিকির-আজ্কার, দান-খায়রাত এর মাধ্যমে তা মুমিনের জন্য অনন্য-উপহার রহমত-মাগফিরাত ও নাজাতের তথা রমযানের শিক্ষা লাভ করার মধ্য দিয়ে আমাদের সকলকে আল্লাহর রঙ্গে রঙ্গিত হওয়ার তাওফীক দান করুক। আমীন।

লেখক: মুদাররিস-জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মহিলা ফাযিল মাদরাসা, চট্টগ্রাম।

Share:

Leave Your Comment