আল্লাহ-রাসূলের উপর ঈমানই নাজাতের নিশ্চিত অবলম্বন

আল্লাহ-রাসূলের উপর ঈমানই নাজাতের নিশ্চিত অবলম্বন

অধ্যক্ষ হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী

بسم الله الرحمن الرحيم

وَّفَجَّرْنَا الْاَرْضَ عُیُوْنًا فَالْتَقَى الْمَآءُ عَلٰۤى اَمْرٍ قَدْ قُدِرَ(12 ) وَ حَمَلْنٰهُ عَلٰى ذَاتِ اَلْوَاحٍ وَّدُسُرٍ(13)  تَجْرِیْ بِاَعْیُنِنَاۚ-جَزَآءً لِّمَنْ كَانَ كُفِرَ(14 )وَ لَقَدْ تَّرَكْنٰهَاۤ اٰیَةً فَهَلْ مِنْ مُّدَّكِرٍ(15) فَكَیْفَ كَانَ عَذَابِیْ وَنُذُرِ (16( وَلَقَدْ یَسَّرْنَا الْقُرْاٰنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُّدَّكِرٍ(17) كَذَّبَتْ عَادٌ فَكَیْفَ كَانَ عَذَابِیْ وَنُذُرِ (18) اِنَّاۤ اَرْسَلْنَا عَلَیْهِمْ رِیْحًا صَرْصَرًا فِیْ یَوْمِ نَحْسٍ مُّسْتَمِرٍّ (19)

তরজমা: এবং আমি জমীনকে প্রস্রবণ করে প্রবাহিত করে দিলাম। সুতরাং উভয় পানি মিলিত হয়েছে ওই পরিমাণে যা নির্ধারিত ছিল। এবং আমি নূহ আলায়হিস্ সালামকে আরোহন করালাম তক্তা ও পেরেক নির্মিত জলযানে যা আমার দৃষ্টিরই সামনাসামনি চলমান। তাঁরই পক্ষ হতে পুরষ্কার স্বরূপ, যাঁর সাথে কুফরি করা হয়েছিল। এবং আমি সেটাকে নিদর্শন স্বরূপ রেখেছি, সুতরাং কেউ আছে কি ধ্যানকারী? অতএব কেমন হলো আমার শাস্তি ও আমার সতর্ক বাণীগুলো? এবং নিশ্চয় আমি কুরআনকে স্মরণ রাখার জন্য সহজ করে দিয়েছি। সুতরাং কেউ আছে কি ধ্যানকারী? “আদ” জাতি অস্বীকার করেছে। সুতরাং কেমন হলো আমার শাস্তি ও সতর্কবাণী। নিশ্চয় আমি তাদের উপর এক প্রবল ঝঞ্চাবায়ু প্রেরণ করলাম এমন দিনে যার অমঙ্গল তাদের উপর স্থায়ী হয়ে রইলো। তা মানুষদেরকে উৎখাত করছিল যেন তারা উৎপাঠিত খেজুর বৃক্ষের কা-। সুতরাং কেমন হলো আমার শাস্তি ও সতর্কবাণী? এবং নিশ্চয় আমি সহজ করেছি কুরআনকে স্মরণ রাখার জন্য। সুতরাং কেউ আছে কি ধ্যানকারী? সামুদ সম্প্রদায় সতর্ককারীদের মিথ্যারোপ করেছিল। সুতরাং তারা বললো আমরা কি নিজেদের মধ্য থেকে একজন মানুষের অনুসরণ করবো? তখন তো আমরা অবশ্য পথভ্রষ্ট ও উন্মাদ হবো। (সূরা আল-ক্বামার, ১২ -২৪ নং আয়াত)

আনুষঙ্গিক আলোচনা
وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِن مُّدَّكِرٍ
উদ্ধৃত আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন ذِّكْر মানে স্মরণ করা। মুখস্ত করা এবং উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহন করা। আলোচ্য আয়াতে উভয় অর্থই উদ্দেশ্য হতে পারে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কুরআনে করিমকে মুখস্ত করার জন্যই সহজ করে দিয়েছেন। ইতিপূর্বে অবতীর্ণ অন্য কোন ঐশী মহাগ্রন্থের এরূপ কোন অবস্থা ছিলনা। তাওরাত, ইঞ্জিল ও যবুর শরীফের কোন হাফেজ ছিলনা। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সহজ করণের ফলশ্রুতিতেই কচিকাচা বালক-বালিকারাও সমগ্র কুরআনে করিম হেফজ করতে সক্ষম হয় এবং তাতে একটি যের, যবরেরও পার্থক্য হয় না। বিগত প্রায় দেড় সহ¯্র বছর ধরে প্রতি স্তরে প্রতি ভূখন্ডে লক্ষ লক্ষ হাফেজে কুরআনের বুকে আল্লাহর কুরআন সংরক্ষিত আছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে। এদিকে, ইঙ্গিত করেই মহান আল্লাহ কুরআনে এরশাদ করেছেন- انانحن نزلنا الذكر وانا له لحافظون অর্থাৎ অবশ্যই কুরআনে করিম (আমি) আল্লাহ অবতীর্ণ করেছি। এবং আমিই এর হেফাজতকারী অনন্তকাল অবধী।
এছাড়া কুরআনে করীম তার উপদেশ ও শিক্ষার বিষয়বস্তুকে খুবই সহজ করে বর্ণনা করেছে। ফলে বড় বড় আলেম, বিশেষজ্ঞ ও দার্শনিক যেমন এর দ্বারা উপকৃত হয়, তেমনি গন্ডমূর্খ ব্যক্তিরাও এর শিক্ষা ও উপদেশমূলক বিষয়বস্তু দ্বারা প্রভাবিত হয়।

আলোচ্য আয়াতে يسرنا এর সাথে للذكر সংযুক্ত করে আরো বলা হয়েছে-মুখস্ত করা ও উপদেশ গ্রহণ করার সীমা পর্যন্ত কুরআনকে সহজ করা হয়েছে। ফলে প্রত্যেক আলিম-জাহিল, ছোট-বড় সমভাবে এর দ্বারা উপকৃত হতে পারে। এতে এ বিষয় জরুরী হয় না যে, কুরাআনে করীম থেকে বিধানাবলী চয়ন করা ও তেমনি সহজ হবে। বলা বাহুল্য, এটা একটা স্বতন্ত্র ও কঠিন শাস্ত্র। যে সব বিজ্ঞ আলিম এই শাস্ত্রের গবেষণায় জীবনপাত করেন, কেবল তারাই এই শাস্ত্রে বুৎপত্তি অর্জন করতে পারেন। এটা প্রত্যেকের বিচরণ ক্ষেত্র নয়।
কোন কোন মহল উপরোক্ত আয়াতকে সম্বল করে কুরআনের মূলনীতি ও ধারাসমূহ পূর্ণরূপে আয়ত্ত না করেই মুজতাহিদ (ধর্মের গবেষক) হতে চায় এবং বিধানাবলী চয়ন করতে চায়। উপরোক্ত বক্তব্য দ্বারা তাদের ভ্রান্তি ফুটে উঠেছে। বলা বাহুল্য, এটা পরিষ্কার পথ ভ্রষ্টতা।

وفَجَّرْنَا الْأَرْضَ عُيُونًا فَالْتَقَى الْمَاءُ عَلَىٰ أَمْرٍ قَدْ قُدِر
উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন সুরা আল-ক্বামার কেয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার আলোচান দ্বারা শুরু করা হয়েছে, যাতে পার্থিব জগতের লোভ-লালসায় পতিত এবং পরকাল বিমুখ কাফির-মুশরিকদের চৈতন্য ফিরে আসে। প্রথমে কেয়ামতের আযাব বর্ননা করা হয়েছে। অতএব তাদের পার্থিব মন্দ পরিণাম ব্যক্ত করার জন্য পাঁচটি বিশ^বিশ্রুত জাতির অবস্থা, আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসূলদের বিরোধীতার কারণে তাদের অশুভ পরিণতি ও ইহকালেও নানা আযাবে পতিত হওয়ার কথা বিধৃত হয়েছে।
উদ্ধৃত আয়াতে সর্বপ্রথম সাইয়্যেদুনা হযরত নুহ আলায়হিস সালামের সম্প্রদায়ের উপর অবতীর্ণ আযাবের বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। কারণ, তারাই বিশে^র সর্বপ্রথম জাতি। যাদেরকে আল্লাহর আযাব ধ্বংস করে দেয়।
কুরআনে করিমের তাফসির বিশারদগণ বর্ণনা করেছেন-মহান আল্লাহ সাইয়্যেদুনা হযরত নুহ আলাইহিস সালামকে দীর্ঘ সাড়ে নয়শত বছরের জীবন দান করেছিলেন। সাথে সাথে আল্লাহর প্রতি দাওয়াত দেয়া ও দেশবাসীকে সুপথে পরিচালিত করার চিন্তা-ভাবনা এবং পয়গম্বরসূলভ উৎসাহ-উদ্দীপনা এতদূর দান করেছিলেন যে, সারাজীবন তিনি অক্লান্তভাবে নিজ জাতিকে তাওহীদ ও সত্য ধর্মের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। নিজ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে তিনি কঠিন নির্যাতন-নীপিড়নের সম্মুখীন হন, তাঁর উপর প্রস্তর বর্ষণ করা হয়। এমনকি তিনি অনেক সময় রক্তাক্ত হয়ে বেহুশ হয়ে পড়তেন। অত:পর হুশ হলে পরে দোয়া করতেন- হে আল্লাহ! আমার জাতিকে ক্ষমা করুন, তারা অজ্ঞ-মুর্খ, তারা জানে না, বোঝে না। তিনি এক পুরুষের পর দ্বিতীয় পুুরুষকে, অত:পর তৃতীয় পুরুষকে শুধু এ আশায় দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছিলেন যে, হয়তো তারা ঈমান আনবে, কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবত প্রাণপন চেষ্টা করা সত্ত্বেও তারা ঈমান গ্রহণ করল না। অবশেষে আল্লাহ রব্বুল আলামিন ওহীর মারফত তাঁকে জানিয়ে দিলেন- أنه لن يؤمن من قومك إلا من قد آمن فلا تبتئس بما كانوا يفعلون অর্থাৎ যারা ইতিমধ্যেই ঈমান আনয়ন করেছে তাদের ছাড়া আপনার জাতির অন্য কেউ ঈমান আনয়ন করবেনা। অতএব তাদের কার্যকলাপে আপনি বিমর্ষ হবেন না।
আত:পর সাইয়্যেদুনা হযরত নূহ আলায়হিস সালাম আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন – لا تذر على الأرض من الكافرين ديارا إنك إن تذرهم يضلوا عبادك ولا يلدوا إلا فاجرا كفارا
অর্থাৎ হে আমার প্রতিপালক! এখন এই কাফিরদের মধ্যে পৃথিবীর বুকে বসবাসকারী কাউকে রাখবেন না। যদি তাদের রাখেন তবে তারা আপনার বান্দাগণকে গোমরাহ করবে আর অবাধ্য কাফির সন্তানই জন্ম দান করবে। (সূরা নূহ)

আল্লাহর নবী হযরত নূহ আলায়হিস সালামের এই বদদোয়া কবুল হলো। অত:পর আল্লাহ বললেন-অচিরেই আমি এই জাতির উপর মহাপ্লাবন আকারে আযাব অবতীর্ণ করব। কাজেই আপনি একখানা নৌকা তৈরী করুন যার মধ্যে আপনার পরিবারবর্গ, অনুসারীবৃন্দ ও প্রয়োজনীয় রসদপত্র ও উপকরণাদি সহ স্থান সংকুলান হয়। যেন তাতে আরোহন করে প্লাবনের দিনগুলো নিরাপদে অতিবাহিত করতে পারেন। সাইয়্যেদুনা হযরত নূহ আ. নৌকা তৈরী করলেন। অত:পর প্লাবনের প্রাথমিক আলামত হিসাবে ভূমি হতে পানি উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠতে লাগল। হযরত নূহ আলায়হিস্ সালামকে নির্দেশ দেয়া হলো যে, ইমানদারগণকে নৌকায় আরোহন করবার জন্য। আর মানুষের প্রয়োজনীয় ঘোড়া, গাধা, গরু-ছাগল, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি সর্বপ্রকার প্রাণীর এক-এক জোড়া নৌকায় তুলে নেওয়ার আদেশ দেয়া হল। তিনি উক্ত আদেশ পালন করলেন।

তাফসীরে ইবনে জরীর তাবারী ও তাফসীরে বগভী শরীফে বর্ণিত আছে যে, সাইয়্যেদুনা হযরত নূহ আলায়হিস্ সালাম ১০ রজব কিশতীতে আরোহন করে ছিলেন। দীর্ঘ ৬মাস উক্ত কিশতী তুফানের মধ্যে চলছিল। যখন কাবা শরিফের পার্শে¦ পৌছাল, তখন সাত বার কাবা শরিফের তাওয়াফ করল। মহান আল্লাহ তাআলা বাইতুল্লাহ শরিফকে পানির উপর তুলে রক্ষা করেছিলেন। পরিশেষে ১০ মর্হরম আশুরার দিন জুদি পাহাড়ে কিশতি ভিড়ল। হযরত নূহ আলায়হিস্ সালাম সেদিন স্বয়ং শোকরানার রোজা রাখলেন এবং সহযাত্রী সবাইকে রোজা পালনের নির্দেশ দিলেন। কোন কোন রেওয়ায়তে আছে যে, কিশতীতে আবস্থানরত যাবতীয় প্রাণীও সেদিন রোজা পালন করেছিল।

ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায় যে, হযরত নূহ আলায়হিস্ সালাম-এর তুফানের সময় এক একটি ঢেউ বড় বড় পাহাড়ের চূড়া হতে ১৫ গজ এবং কোন কোন বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, ৪০ গজ উচ্চতা বিশিষ্ট ছিল। এই মহাপ্লাবনে কাফের-মুশরিক সবাই চিরতরে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো। সাইয়্যেদুনা হযরত নূহ আলায়হিস্ সালাম সহ কিশতীতে আরোহীরা রক্ষা পেল। এতে প্রমাণিত হলো যে, আল্লাহর প্রেরিত রাসূলগণের অনুসরণ-অনুকরণ একমাত্র নাজাতের নিশ্চিত অবলম্বন। মহান আল্লাহ এ সত্য অনুধাবন করার সৌভাগ্য নসীব করূন। আুমীন

লেখক: অধ্যক্ষ, কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা, মুহাম্মদপুর, এফ ব্লক, ঢাকা।

 

Share:

Leave Your Comment