মিসওয়াকের ফযীলত ও উপকারিতা

মিসওয়াকের ফযীলত ও উপকারিতা

মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস আলকাদেরী

নিয়মিত মিসওয়াক করা বড় পূণ্যময় ইবাদত। মিসওয়াক করে নামায পড়লে সত্তর গুণ সওয়াব বেড়ে যায়। এটি সকল নবী-রাসূলের সুন্নাত। এর অনেক ফযীলত ও উপকারিতা রয়েছে। নিন্মে মিসওয়াকের হুকুম, ফযীলত ও উপকারিতা তুলে ধরার প্রয়াস পাব-ইনশাআল্লাহ।

মিসওয়াকের পরিচয়
মিশকাতুল মাসাবীহ্ গ্রন্থের ব্যাখ্যাকার মোল্লা আলী ক্বারী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কুদ্দিসা র্সিরহু মিরকাত গ্রন্থে বলেন- মিসওয়াক হলো সে কাঠ যা দ্বারা দাঁতসমূহ পরিষ্কার করা হয়। বাহারে শরীয়ত কিতাবের রচয়িতা মুফতি আমজাদ আলী উক্ত কিতাবে বলেন, মিসওয়াক হবে তিক্ত জাতীয় বৃক্ষের। যেমন নিম গাছ, যয়তুন গাছ ও পীলু নামক এক জাতীয় গাছ। এ মিসওয়াক কোন সুগন্ধময় ও ফুল গাছের হবে না। মিসওয়াক হতে হবে কনিষ্ঠাঙ্গুলি বরাবর মোটা এবং এক বিঘত লম্বা। এত ছোট হবে না- যা দ্বারা মিসওয়াক করতে অসুবিধা হয়। যে মিসওয়াক এক বিঘত হতে লম্বা হয় তাতে শয়তান বসে। মিসওয়াক ব্যবহার করতে করতে ছোট হয়ে যায় এবং ব্যবহারে অনুপযোগী হয়ে যায় তা মাটিতে দাফন করে ফেলতে হবে কিংবা কোন নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণ করবেন। কোন অপবিত্র স্থানে ফেলে দেবেন না। কেননা এটা সুন্নাত আদায়ের মাধ্যম। তাই এটার সম্মান করা আবশ্যক। দ্বিতীয়ত মু’মিনের মুখের পানি নাপাক স্থানে ফেলা হতে বিরত থাকতে হবে। তাই পায়খানার স্থানে থুথু ফেলা নিষেধ বলেছেন ওলামায়ে কেরাম। মিসওয়াকের কাঠটি বেশি শক্ত না হয়, অনুরূপ বেশি নরম হতে পারবে না।

মিসওয়াক ব্যবহারের নিয়ম
মিসওয়াক ডান হাতে ব্যবহার করতে হবে। মিসওয়াকের কাঠটি এভাবে হাতে নেবেন, যেন হাতের কনিষ্ঠাঙ্গুলি মিসওয়াকের উপরে থাকে এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি মিসওয়াকের মাথার নিচে থাকে। হাতের মুষ্টি বাঁধবেন না। কমপক্ষে তিনবার তিনবার করে মুখের ডানে-বামে উপরে ও নিচের দাঁত সমূহে মিসওয়াক করবেন। যদি কেউ দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ দু’দিক হতে শুধু এক দিক মিসওয়াক করে, তাহলে দাঁতের প্রস্থে মিসওয়াক করবেন। বিশেষ করে কুলি করার সময় মিসওয়াক করবেন। এর উপর অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম মত দিয়েছেন। কেউ কেউ বলেন, ওযূর পূর্বে মিসওয়াক ব্যবহার করবেন। কারো দাঁত না থাকলে দাঁতের মাড়িতে ডান হাতের আঙ্গুল বুলাবেন। অনুরূপ কারো নিকট মিসওয়াকের কাঠ না থাকলে ডান হাতের আঙ্গুলি দ্বারা দাঁত মাজবেন এতে মিসওয়াকের ফযীলত অর্জন হবে। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তাসবিহ্ পাঠকারী (শাহাদত) আঙ্গুলি দ্বারা দাঁত মাজা ও ঘষা হলো মিসওয়াক।

মিসওয়াক করার সময় ও কারণ
পাঁচ সময়ে মিসওয়াক করা মোস্তাহাব। যথা: ১. দাঁত হলুদ হলে, ২. মুখ হতে দুর্গন্ধ বের হলে, ৩. ঘুম থেকে জাগ্রত হলে, ৪. নামাযের জন্য দাঁড়ালে এবং ৫. ওযূর সময়।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম রাস্তায় দীর্ঘক্ষণ কারো সাথে কথা বলতেন না। বরং কথা বলার পূর্বে তিনি মিসওয়াক করতেন। এ কাজটি করতেন উম্মতকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য। সুতরাং যে ব্যক্তি দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকার পর কথা বলে তিনি যেন আগে মিসওয়াক করে মুখের দুর্গন্ধ দূর করেন। যেন তার মুখের দুর্গন্ধে যার সাথে কথা বলে তিনি যেন কষ্ট না পান। হযরত সুরায়হ্ বিন হানী বলেন, আমি হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে জিজ্ঞাসা করলাম। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন ঘরে প্রবেশ করতেন তখন প্রথমে কোন কাজ করতেন? তিনি উত্তর দেন, মিসওয়াক। অর্থাৎ রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ঘরে প্রবেশ করে প্রথম মিসওয়াক করতেন। [মিশকাত ও মুসলিম শরীফ]
হযরত হুযায়ফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন-
كان النبى صلى الله عليه وسلم اذا قام للتهجد من الليل يشوص فاه بالسواك-
অর্থাৎ নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন রাতে তাহাজ্জুদের নামাযের জন্য জাগ্রত হতেন, তিনি দাঁত মাজতেন এবং তা মিসওয়াকের মাধ্যমে পরিষ্কার করতেন। [বুখারী, মুসলিম ও মিশকাত]

মিসওয়াকের হুকুম
মিসওয়াক নামাযের সুন্নাত নয় বরং ওযূর সুন্নাত। সুতরাং মিসওয়াক করার পর ওযূ করে কয়েক ওয়াক্ত নামায পড়লে- সে মিসওয়াক সকল ওয়াক্তের জন্য যথেষ্ট। ওযূ ব্যতীত শুধু নামাযের জন্য মিসওয়াক করা জরুরি নয়। হ্যাঁ, তবে দীর্ঘক্ষণ ওযূ না করার কারণে মুখ দিয়ে দুর্গন্ধ বের হলে স্বতন্ত্র মিসওয়াক করবেন। কেউ ওযূর সময় মিসওয়াক না করলে- নামাযের নিয়ত করার পূর্বে মিসওয়াক করবেন। এ মিসওয়াক হবে শুধু দাঁত ও জিহবার উপর হালকাভাবে। দাঁতের মাড়িতে এ মিসওয়াক করা যাবে না। কেননা, এতে রক্ত বের হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর রক্ত বের হলে ওযূ ভেঙ্গে যাবে। আর ওযূ ব্যতীত নামায পড়লে নামায পুনরায় পড়তে হবে।

মিসওয়াক সম্পর্কিত জরুরি মাসআলা
মাসআলা:১. দাঁতের প্রস্থে মিসওয়াক করবেন দৈর্ঘে নহে। চিৎ হয়ে শুয়ে মিসওয়াক করবেন না।
মাসআলা: ২. মিসওয়াক করার পূর্বে মিসওয়াকের কাঠটি ধুয়ে নেবেন। মিসওয়াক সমাপ্ত হলে পুনরায় ধুয়ে নেবেন। ভূমিতে উপুড় কিংবা লম্বালম্বি করে রাখবেন এবং যে দিকে দাঁত মাজবেন সে দিকটা উপরে করে রাখবেন।
মাসআলা: ৩. যদি মিসওয়াকের কাঠ না থাকে, তাহলে আঙ্গুলি কিংবা ভারী ও শক্ত টুকরা কাপড় দ্বারা মিসওয়াক করবেন। দাঁত না থাকলে মিসওয়াকের কাঠ কিংবা কাপড় দাঁতের মাড়িতে ফেরাবেন।
মাসআলা: ৪. দাঁতের ডানে-বামে উপরে নিচে কমপক্ষে তিনবার করে মিসওয়াক করবেন এবং প্রতিবার মিসওয়াকের কাঠ ধুয়ে নেবেন।

মিসওয়াকের ফযীলত
মিসওয়াকের অনেক ফযীলত রয়েছে। মিসওয়াকের ফযীলতের উপর নিম্নে কয়েকটি হাদীস শরীফ তুলে ধরছি।
১. ইমাম আহমদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন-মিসওয়াক সহকারে নামায মিসওয়াক বিহীন হতে সত্তরগুণ উত্তম।
২. হযরত আবূ আয়্যূব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন-
اربع من سنن المرسلين الحياء ويروى الختان والتعطر والسواك والنكاح-
চারটি বিষয় রাসূলগণ (আলায়হিমুস্ সালাম)এর সুন্নাত। ১. লজ্জাশীলতা, ২. আতর ব্যবহার করা, ৩. মিসওয়াক করা, ৪. বিয়ে করা। [তিরমিযী ও মিশকাত শরীফ]
৩. হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, বান্দা মিসওয়াক করে নামাযে দাঁড়ালে ফেরেশতা তার পেছনে দাঁড়িয়ে তার ক্বেরাত শুনেন। এরপর ফেরেশতা সে মুসল্লির নিকটবর্তী হতে হতে তাঁর (ফেরেশতার) মুখ ওই মুসল্লির মুখের কাছাকাছি করেন।

মিসওয়াকের গুরুত্ব
১. ইমাম তাবরানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন-
لولا اشق على امتى لامرتهم بالسواك عند كل وضوء-
‘‘যদি আমার উম্মতের উপর কষ্ট পতিত হওয়ার ভয় না হত তাহলে তাদেরকে প্রত্যেক ওযূর সময় মিসওয়াকের আদেশ দিতাম। অর্থাৎ তাদের উপর মিসওয়াক করা ফরয করে দিতাম।
২. তাবরানী শরীফে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মিসওয়াক না করে কোন নামাযে তাশরীফ নিতেন না।
৩. হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- ‘‘নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম রাতে কিংবা দিনে ঘুম হতে জাগ্রত হয়ে ওযূর পূর্বে মিসওয়াক করতেন। [ইমাম আহমদ, ইমাম আবূ দাঊদ ও মিশকাত]
৪. রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন- لقد اكثرت عليكم فى السواك-
অর্থাৎ আমি মিসওয়াকের ব্যাপারে তোমাদের উপর আদেশ ও ওসিয়ত বেশি করেছি। [বুখারী শরীফ]
৫. রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ওফাতের পূর্ব মুহূর্তে মিসওয়াক করে উম্মতকে মিসওয়াকের গুরুত্ব শিক্ষা দিয়েছেন।
৬. রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন- ما جاء فى جبرائيل قطّ الا امرنى بسواك لقد خخستُ ان اُحْفِىَ مقدم حىّ-
অর্থাৎ হযরত জিবরাঈল আলায়হিস্ সালাম যখনই আমার কাছে আসতেন তখনই আমাকে মিসওয়াকের নির্দেশ দিতেন। আল্লাহ্র শপথ এতে আমি ভয় করতাম যে, জিব্রাঈল-এর ওসিয়ত এবং এর উপর আমার সার্বক্ষণিক মিসওয়াক বেশি ব্যবহারের ফলে আমার মুখের মাড়ি গোড়া হতে উপড়ে ফেলব। [মিশকাতুল মাসাবীহ: পৃষ্ঠা-৪৫]

মিসওয়াকের উপকারিতা
১. মোল্লা আলী ক্বারী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ‘মিরকাত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, মিসওয়াক করার মধ্যে সত্তরটি উপকার রয়েছে। সর্বনিন্ম উপকার হলো মৃত্যুর সময় শাহাদাত তথা কালেমা স্মরণ হওয়া এবং আফিম তথা মাদক সেবনে সত্তরটি ক্ষতি রয়েছে। সর্বনিন্ম ক্ষতি হলো মৃত্যুর সময় কালেমা ভুলে যওয়া।
২. হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন-
السواك مطهرة للفم مرضاة للربّ-
অর্থাৎ মিসওয়াক মুখমন্ডলকে পবিত্রকারী রব তথা আল্লাহ্ তা‘আলার সন্তুষ্টি দানকারী অথবা مرضاة للربّ অর্থাৎ- মিসওয়াক প্রভুর নিকট পছন্দনীয়। মুহাদ্দেসীন কেরাম হাদীসে পাকের এ অর্থও করেছেন যে, মিসওয়াক মুখের পবিত্রতা ও পরিষ্কার এবং প্রভুর রেজামন্দির মাধ্যম।
যে মু’মিন নর-নারী মিসওয়াকের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত এ ফেতনার যুগে আকড়ে ধরবে, অর্থাৎ রাসূলে পাকের একটি সুন্নাত পালনের নিয়তে নিয়মিত ব্যবহার করবেন, তিনি হাদীসে পাকের ঘোষণা মত একশত শহীদের সওয়াব পাবেন।

মিওয়াকের সুফল
১. মিসওয়াক করলে দাঁত পরিষ্কার থাকে। ফলে তাকে লোকে পছন্দ করে।
২. মিসওয়াক করলে মুখের দুর্গন্ধ থাকে না। ফলে মানুষ তার সাথে কথা বলতে চাই।
৩. মিসওয়াক হলো নবী-রাসূলগণের সুন্নত। তা পালন করে নিজেকে তাদের চরিত্রে চরিত্রবান করা যায়।
৪. নিয়তিম মিসওয়াক করলে দাঁতের রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
৫. নিয়মিত মিসওয়াক করলে পেটের হজম শক্তি বাড়ে।
৬. মিসওয়াকে অভ্যস্থ হলে মৃত্যুর সময় কালেমা নসিব হয়।
৭. মিসওয়াক ব্যবহারের মধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ভালবাসাা অর্জন হয়।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া, চট্টগ্রাম।

 

 

 

Share:

Leave Your Comment