সচ্চরিত্র

সচ্চরিত্র

সচ্চরিত্র >
اَخْلاَق (আখলাক্ব) শব্দটি বহুবচন। একবচনে خُلُقٌ (খুলুক্বুন)। শাব্দিক অর্থ স্বভাব, চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি। আর حَسَنَة (হাসানাহ্‌) শব্দের অর্থ সুন্দর, সৎ, উত্তম ইত্যাদি। সুতরাং  اَخْلاَقِ حَسَنَة (আখলাক্বে হাসানাহ্‌) অর্থ হল সচ্চরিত্র ও উত্তম স্বভাব। একে আবার اَخْلاَقِ حَمِيْدَة  (আখলাক্বে হামীদাহ্‌) বা ‘প্রশংসনীয় স্বভাব’ও বলা হয়। এর বিপরীত হচ্ছে اَخْلاَقِ شَنِيْعَة (আখলাক্বে শানী’আহ্‌) বা    اَخْلاَقِ ذَمِيْمهْ (আখ্‌লাক্ব-ই যমীমাহ্‌) অর্থাৎ ‘মন্দ স্বভাব’।
ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়, মানুষের পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্য সংশ্লিষ্ট আচার-আচরণ ও কার্যাবলী সুল্ড।, সুন্দর ও যথার্থভাবে ভারসাম্য বজায় রেখে পালন ও সম্পাদন করাকে ‘আখ্‌লাক্বে হাসানাহ্‌’ বলা হয়। অন্যভাবে বলা হয় যে, ইসলামী চরিত্রে বিভূষিত হওয়া এবং শয়তানী চরিত্র থেকে বিরত থাকার নামই ‘আখ্‌লাক্বে হাসানাহ্‌’ বা উত্তম চরিত্র।
মানব জীবনে চরিত্র অমূল্য সম্পদ। চরিত্রহীন মানুষ পশুর সমান। اَخْلاَقِ حَسَنَة বা اَخْلاَقِ حَمِيْدَة (উত্তম চরিত্র) এমন একটি মহৎ গুণ, যা প্রতিটি মানুষের মধ্যে উপস্থিত থাকা একান্ত প্রয়োজন। কেউ উত্তম চরিত্রের অধিকারী না হলে সে সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধনে কখনোই সক্ষম হয় না। উত্তম চরিত্রের কারণেই মানুষ মর্যাদার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করে। এমনকি সে সর্বত্র স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকে। মহাকালের গর্ভে বিলীন হয় না তাদের ইতিহাস। ইসলামের ধারক ও বাহক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রসূল বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, সকল নবী ও রসূল আলায়হিমুস্‌ সালাম ও সাহাবায়ে কেরাম সচ্চরিত্রেরই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাই মানবেতিহাসের উষালগ্ন থেকেই সর্বকালে সর্বদেশে এর গুরুত্ব, মর্যাদা এবং উপকারিতা সর্বজন স্বীকৃত।
উত্তম চরিত্রের গুরুত্ব
মানব জীবনে সৎ স্বভাব বা উত্তম চরিত্রের বিরাট গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। প্রশংসনীয় ও সচ্চরিত্র ছাড়া কখনো প্রকৃত মানুষ বরং প্রকৃত মু’মিন হওয়া যায় না। রাসুল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ওই উত্তম চরিত্রের প্রশংসায় পবিত্র ক্বোরআনে এরশাদ হয়েছে-
اِنَّکَ لَعَلٰی خُلُقٍ عَظِیْمٍ  (ইন্নাকা লা’আলা- খুলুক্বিন ‘আযী-ম) অর্থাৎ- হে রসূল! নিঃসন্দেহে আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী। আল্লাহ তা’আলা স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে মানুষের সচ্চরিত্রের পরিপূর্ণতা প্রদানের লক্ষ্যে পাঠিয়েছেন। খোদ নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা بُعِثْتُ لِاُتَمِّمَ مَکَارِمَ الْاَخْلَاقِ  অর্থাৎ- ‘‘আমি উত্তম চরিত্রগুলোকে পরিপূর্ণতাদানের লক্ষ্যে প্রেরিত হয়েছি।’’ তিনি আরো বলেন-  تَخَلَّقُوْا بِاَخْلَاقِ اللّٰہِ  (তাখাল্লাক্বূ-বি আখ্‌লাক্বিল্লা-হি) অর্থাৎ- ‘‘তোমরা আল্লাহ্‌র চরিত্রে চরিত্রবান হও।’’
সচ্চরিত্র ছাড়া ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তির আশা করা যায় না। একমাত্র সৎ স্বভাব দ্বারাই সমাজে শান্তি আনয়ন করা সম্ভব। কেননা, চরিত্রহীন লোক অন্যায়, ব্যভিচার, অত্যাচার, সংঘাত, কলহ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজ জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে। পক্ষান্তরে, সচ্চরিত্রবান লোক নিজ চরিত্রগুণে সমাজ-চরিত্রকেও সংশোধনের চেষ্টা করে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আরো এরশাদ করেছেন- اِنَّ مِنْ اَحَبِّکُمْ اِلَیَّ اَحْسَنُکُمْ اَخْلاقًا (ইন্না মিন আহাব্বিকুম ইলায়্যা আহসানুকুম আখ্‌লাকান)। অর্থাৎ আমার কাছে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী প্রিয় হচ্ছে ওই ব্যক্তি, যে চরিত্রের দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ। রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আরো এরশাদ করেছেন- اِنَّ مِنْ خِیَارِکُمْ اَحْسَنُکُمْ اَخْلًاقًا  (ইন্না মিন খিয়ারিকুম আহসানুকুম আখ্‌লাক্বান) অর্থাৎ নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি হচ্ছে ওই ব্যক্তি, তোমাদের মধ্যে যার চরিত্র অধিক সুন্দর।
বিখ্যাত ইংরেজ কবি Anon বলেন-
When wealth is lost, nothing is lost
When health is lost someting is lost
When character is lost everything is lost.
অর্থঃ যখন সম্পদ হারালো, তখন কিছুই হারালোনা, যখন স্বাস্থ্য হারালেৎ, তখন কিছুটা হারালো, আর যখন চরিত্র হারালো তখন সবকিছুই হারালো।
উত্তম চরিত্রের বিভিন্ন দিক
اَخْلاَقِ حَسَنَةِ (আখলাক্বে হাসানাহ) বা উত্তম চরিত্রের বিভিন্ন দিক ও বিষয়ে ইসলামে বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। উক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে তাক্বওয়া, যিক্‌র, শোক্‌র, সবর, ইনসাফ, সহানুভূতি, পারোপকার, জনসেবা, সহনশীলতা, বিনয় ও অল্পে তুষ্টি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সমাজে এসব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠার জন্য পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজন। মহান আল্লাহ এরশাদ ফরমায়েছেন- وَتَعَاوَنُوْا عَلٰی الْبِرِّ وَالتَّقْوٰی وَلاَ تَعَاوَنُوْا عَلٰی الْاِثْمِ وَالْعُدْوَانِ  ‘‘ওয়া তা’আ’-ওয়ানূ- আলাল্‌ বির্‌রি ওয়াত্‌ তাক্বওয়া-ওয়ালা-তা’আ ওয়ানূ ‘আলাল্‌ ইস্‌মি ওয়াল ‘উদ্‌ওয়া-ন।’’
তরজমা : এবং তোমরা সৎকাজ এবং খোদাভীরুতার কাজে একে অপরকে সাহায্য করো আর পরস্পরকে পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে সহযোগিতা করো না। [সূরা মা-ইদাহ, আয়াত- ২]
আদ্‌ল বা ইন্‌সাফ
বিচার ও মীমাংসায় ন্যায়-পরায়ণতা প্রসঙ্গে আল্লাহ এরশাদ  وَاللّّٰہُ یَقْضِی الْحَقَّ  (আল্লাহ তা’আলা সঠিক ও যথার্থ মীমাংসা করেন)।
ন্যায় বিচার এমন একটি অপরিহার্য ও প্রশংসিত গুণ, যা ব্যতিরেকে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে শান্তি, শৃঙ্খলা, উন্নতি, সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বহাল থাকতে পারে না।
মানবজাতির সার্বিক উন্নতি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার জন্য عدل বা ‘ইনসাফ’ না থাকার কারণে মানব জীবনের সর্বস্তরে অন্যায়-অবিচার সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় চতুর্দিকে এমনিতে ছড়াতে শুরু করে। মানুষের স্বভাবে স্বার্থপরতা, হিংসা-বিদ্বেষ, যে কোন মূল্যেই নিজ স্বার্থ হাসিল করার প্রবনতা থাকে। এ কুপ্রবৃত্তির কারণেই মানুষ লোভ-লালসায় পতিত হয়, আর এ লোভ-লালসা হতে মানব মনে হিংসা-বিদ্বেষ চরম পর্যায়ে পৌঁছে শত্রুতার জন্ম দেয়। পক্ষান্তরে, মানুষ যখন ব্যক্তিগত জীবন হতে আন্তর্জাতিক জীবন পর্যন্ত সর্বস্তরে عدل বা ন্যায় বিচার কায়েম করতে পারে। তখন কেউ কারো প্রতি অন্যায়-অবিচার করে না। কেউ কারো অধিকার নষ্ট করে না। শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে না; বরং মানুষের মাঝে মিল মহব্বত, সৌন্দর্য ও সম্প্রীতি বজায় থাকে। মহান আল্লাহ মানুষকে এ কারণেই عدل বা ন্যায় বিচার অবলম্বথের নির্দেশ দিয়েছেন। আর এ প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন- اِنَّ اللّٰہَ یَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْاِحْسَانِ وَاِیْتَآءِ ذِی الْقُرْبٰی وَیَنْہٰی عَنِ الْفَحْشَآءِ وَالْمُنْکَرِ
তরজমা : নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে ন্যায় বিচার, সদ্যবহার এবং আত্মীয়দেরকে দান করার নির্দেশ দেন। আর অশ্লীলতা ও খারাপ কাজ হতে নিষেধ করেন।  [সূরা নাহ্‌লঃ আয়াত- ৯০]
আরো এরশাদ করেন- وَاِذَا حَکَمْتُمْ بَیْنَ النَّاسِ اَنْ تَحْکُمُوْا بِالْعَدْلِ  তরজমা: যখন তোমরা মানুষের মধ্যে মীমাংসা করবে, তখন তোমরা ইনসাফের সাথে বিচার ও মীমাংসা করবে। [সূরা-নিসা, আয়াত- ৫৮]
আল্লাহ  তা’আলা আরো এরশাদ করেন- وَاِنْ حَکَمْتَ فَاحْکُمْ بَیْنَہُمْ بِالْقِسْطٍ اِنَّ اللّٰہَ یُحِبُّ الْمُقْسِطِیْنَ
তরজমা :  যদি তুমি মীমাংসা করো, তবে তাদের মধ্যে ইনসাফের সাথে মীমাংসা করো, নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদের ভালবাসেন।
ন্যায় বিচার কার্যের সাক্ষীগণকেও সঠিক এবং সত্য সাক্ষী দানের বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে-  وَاِذْ قُلْتُمْ فَاعْدِلُوْا وَلَوْ کَانَ ذَاقُرْبٰی
তরজমা : তোমরা যখন বিচার কার্য সম্পাদন অথবা বিচারের ক্ষেত্রে সাক্ষ্যদানকল্পে কথা বলো, তখন ইনসাফ সহকারে কথা বলো, যদিও তাতে কোন পক্ষ তোমার নিকটআত্মীয় হয়।  [সূরা আন-আম, আয়াত-১৫৩]
অনুরূপ, কোন ধনী প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির ব্যাপারে কোন প্রকার পক্ষপাতিত্ব কিংবা অবিচার না করার সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তাজ্ঞআলা এরশাদ করেন-
یٰٓاَیُّہَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا کُوْنُوْا قَوَّامِیْنَ بِالْقِسْطِ شُہَدَآءَ لِلّٰہِ وَلَوْ عَلٰٓی اَنْفُسِکُمْ اَوِالْوَالِدَیْنِ وَالْاَقْرَبِیْنَج اِنْ یَّکُنْ غَیِنًّا اَوْ فَقِیْرًا فَاللّٰہُ اَوْلٰی بِہِمَاقف فَلاَ تَتَّبِعُوا الْہَوٰٓی اَنْ تَعْدِلُوْاج وَاِنْ تَلْوٗآ اَوْتُعْرِضُوْا فَاِنَّ اللّٰہَ کَانَ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِیْرًا O
তরজমা : হে ঈমানদারগণ! ন্যায় বিচারের উপর দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও আল্লাহর উদ্দেশ্যে সাক্ষ্য প্রদানকারী অবস্থায়, যদিও তাতে তোমাদের নিজেদের ক্ষতি হয়। অথবা মাতাপিতার কিংবা আত্মীয়-স্বজনের; যার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দাও, সে বিত্তবান হোক কিংবা বিত্তহীন, সর্বাবস্থায় আল্লাহরই সেটার সর্বাধিক ইখতিয়ার রয়েছে। সুতরাং প্রবৃত্তির অনুগামী হয়ো না, যাতে সত্য থেকে আলাদা হয়ে পড়ো; এবং যদি তোমরা হেরফের করো অথবা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে আল্লাহর নিকট তোমাদের কর্মসমূহের খবর রয়েছে। [সূরা নিসা, আয়াত- ১৩৫]
অনুরূপ, বিচারকাজে কোন প্রকার উপঢৌকন বা উৎকোচ দিয়ে বিচারকের রায় নিজের কিংবা নিজ পক্ষের কারো অনুকূলে আনার চেষ্টার বিরুদ্ধে পবিত্র ক্বোরআনে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন-
وَتُدْلُوْا بِہَا اِلَی الْحُکَّامِ لِتَأْکُلُوْا فَرِیْقًا مِّنْ اَمْوَالِ النَّاسِ بِالْاِثْمِ وَاَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ
তরজমাঃ এবং না বিচারকদের নিকট তাদের মুকাদ্দমা এজন্য পৌঁছাবে যে, লোকজনের কিছু ধন-সম্পদ অবৈধভাবে গ্রাস করে নেবে, জেনে বুঝে।       [২:১৮৮]
এইভাবে দু’পক্ষের মধ্যে সম্পাদিত লেন-দেন সংক্রান্ত চুক্তিপত্র লিখার ব্যাপারেও লিখককে عدل বা ন্যায় অবলম্বন করতে হবে। এই চুক্তিপত্র লিখার ক্ষেত্রে ‘আদল’ এর তাকিদ দিয়ে আল্লাহ তাজ্ঞআলা এরশাদ করেন- وَلْیَکْتُبْ بَیْنَکُمْ کَاتِبٌ بِالْعَدْلِ  তরজমাঃ এবং উচিত যেন তোমাদের মধ্যে কোন লিখক ঠিক ঠিক লিখে।   [২:২৮২] অনুরূপ, বৈবাহিক জীবনে একাধিক বিবাহের ব্যাপারে عدل বা ন্যায় বিচার করারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাই এ ক্ষেত্রে অর্থাৎ একাধিক স্ত্রী বিবাহ করলে তাদের মধ্যে عدل বা সুবিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অপরাগতার আশংকা থাকলে শরীয়ত একাধিক বিবাহের অনুমতি দেয় নি।
আল্লাহ তাজ্ঞআলা এরশাদ করেন- فَاِنْ خِفْتُمْ اَنْ لاَ تَعْدِلُوْا فَوَاحِدَۃً
তরজমাঃ অতঃপর যদি তোমরা আশঙ্কা করো যে, দু’জন স্ত্রীকে সমানভাবে রাখতে পারবে না, তবে একজনকেই বিবাহ করো।          [৪ঃ৩]
সালাম বা অভিভাদন
সালাম (سلام)  আখলাক্বে হামীদাহ বা সচ্চরিত্রের অন্যতম একটি দিক, আবার এটা মহান  রাব্বুল আলামীনের একটি গুণবাচক নামও। এর শব্দগত অর্থ দোষত্রুটি হতে মুক্ত থাকা। শান্তি  ও নিরাপত্তা কামনা করা। পবিত্র ক্বোরআনে সালাম শব্দটি শান্তি ও নিরাপত্তা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন-
سَلَامٌ عَلٰی مُوْسٰی وَہَارُوْنَ سَلاَمٌ عَلٰی نُوْحٍ فِیْ الْعَالَمِیْنَ  তরজমাঃ শান্তি বর্ষিত হোক মূসা ও হারূনের উপর, শান্তি বর্ষিত হোক নূশেভ উপর সমগ্র বিশ্বের মধ্যে।
সালামের ফযীলত
سلام বা ‘আস্‌ সালামু আলাইকুম’ ইসলামী শরীয়তে একটি দো’আ, যা মুসলমানদের পরস্পরের সাক্ষাতের সময় পেশ করা হয়। সালাম দেয়া সুন্নত এবং এর উত্তর দেয়া ওয়াজিব। ‘আসসালামু আলাইকুম’ অর্থ হচ্ছে- ‘আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।’ ‘আমার পক্ষ হতে আপনাকে/আপনাদেরকে নিরাপত্তা দেয়া হলো। আপনি আমাকে/আমাদেরকে নিরাপত্তা দান করুন।’ ক্বোরআন মজীদে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন-
اِذَا حُیِِّیْتُمْ بِتَحِیَّۃٍ فَحَیُّوْا بِاَحْسَنَ مِنْہَا اَوْرُدُّوْہَا  তরজমাঃ এবং যখন তোমাদেরকে কেউ কোন বচন দ্বারা সালাম করে, তবে তোমরা তা অপেক্ষা উত্তম বচন তার জবাবে বলো, কিংবা অনুরূপই বলে দাও। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ প্রত্যেক কিছুর হিসাব গ্রহণকারী।          [৪:৮৬]
সুতরাং সালাম প্রদানকারী السلام عليكم (আস্‌সালামু আলাইকুম) বলবে। আর এর সাথে ورحمة الله (ওয়া রাহমাতুল্লাহি) অংশটুকু বৃদ্ধি করাও অতি উত্তম। সুতরাং যদি সালামদাতা শুধু ‘আস্‌সালামু আলাইকুম’ বলে, তবে উত্তরদাতা জবাবে ورحمة الله (ওয়ারাহমাতুল্লাহি) বৃদ্ধি করবে। আর যদি সালামদাতা اَلسَلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ বলে তাহলে জবাবদাতা وَبَرَكَاتَه  (ওয়া বরাকাতুহু) অংশটুকুও বৃদ্ধি করবে। আর যদি সালামদাতা ‘আস্‌সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি  ওয়াবারাকাতুহ’ বলে তবে উত্তরদাতা ‘ওয়া আলাইকুমুস্‌ সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি  ওয়া বারাক্বাতুহুর সাথে ‘ওয়া মাগফিরাতুহূও সংযোজন করতে পারবে। এর থেকে বেশী বলার নিয়ম নেই। অবশ্য পানাহার, মল-মূত্র ত্যাগ, তা’লীম দেয়া, ক্বোরআন তিলাওয়াত করা ও নামায রত অবস্থায় সালাম দেয়াও সালামের জবাব দেয়া মাকরূহ-ই তাহরীমী। অমুসলিম তথা কাফির-মুশরিককে সালাম দেয়া হারাম। যদি কোথাও মুসলমান ও কাফির একত্রিত থাকে, তবে سَلاَمٌ عَلى مَنِ اتَّبَعَ الْهُدى (সালামুন ‘আলা মানিত্তাবা’আল হুদা) বলে সালাম দেবে এবং মনে মনে মুসলমানদের নিয়্যত করবে। সালাম দেয়ার সময় হাত উত্তোলন করা জরুরী নয়; তবে কোন দূরবর্তী লোককে সালাম বলার সময় হাত দ্বারা ইশারাও করতে পারে। অবশ্য মুখে সালাম না বলে শুধু হাত দ্বারা ইশারা করা, মাথা নাড়া ইসলামী শরীয়তের পরিপন্থী; বরং ইহুদী, খ্রিস্টানদের কু-প্রথা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরূপ করতে নিষেধ করেছেন। এবং অভিভাদনের জন্য ‘সালাম’ প্রথাকেই সুন্দর বিকল্প হিসেবে স্থির করেছেন। [মিশ্‌কাত শরীফ ও মিরক্বাত শরীফ-সালাম অধ্যায়]
সালাম বিনিময় প্রসঙ্গে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তাজ্ঞআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
۱.عَنْ اَبِیْ اُمَامَۃَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰہِ صَلَّی اللّٰہُ عَلَیْہِ وَسَلَّمَ اِنَّ اَوْلَی النَّاسِ بِاللّٰہِ مَنْ بَدَأَ بِالسَّلاَمِ وَرَوَاہُ اَبُوْدَاوٗدَ وَاَحْمَدُ وَالتِّرْمِذِیُّ
অর্থাৎ: হযরত আবূ উমামাহ্‌ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা’আলার নিকট অধিকতর উত্তম ব্যক্তি হচ্ছে যে প্রথমে সালাম দেয়। [আবু দাউদ, আহমদ, তিরমিযী শরীফ]
۲.عَنْ جَابِرٍ رَضِیَ اللّٰہُ تَعَالٰی عَنْہُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰہِ صَلَّی اللّٰہُ عَلَیْہِ وَسَلَّمَ اَلسَّلاَمُ قَبْلَ الْکَلاَمِ رَوَاہُ التِّرْمِذِیُّ
অর্থাৎ: হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, কথাবার্তা বলার পূর্বেই সালাম।                                                                         [তিরমিযী]
۳. عَنْ عَبْدِ اللّٰہِ بْنِ عَمْرٍو اَنَّ رَجُلاً سَأَلَ رَسُوْلَ اللّٰہِ اَیُّّ الْاِسْلاَمِ خَیْرٌ؟ قَالَ تُطْعِمُ الطَّعَامَ وَتُقْرِئُ السَّلاَمَ عَلٰی مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَمْ تَعْرِفْ مُتَّفَقٌ عَلَیْہِ
অর্থাৎ : হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র দরবারে আরয করলেন, ‘‘ইসলামের কোন্‌ রীতিই উত্তম?’’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, তুমি (অপরকে) খানা খাওয়াবে এবং পরিচিত ও অপরিচিত উভয় প্রকার (মুসলমানকে) সালাম করবে। [বুখারী ও মুসলিম]
۴.وَعَنْہُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰہِ صَلَّی اللّٰہُ عَلَیْہِ وَسَلَّمَ لاَ تَدْخُلُوْنَ الْجَنَّۃَ حَتّٰی تُؤْمِنُوْا وَلَاتُؤْمِنُوْنَ حَتّٰی تَحَابُّوْا اَوَلاَ اَدُلُّکُمْ عَلٰی شَئٍ اِذَا فَعَلْتُمُوْہُ تَحَابَبْتُمْ اَفْشُوا السَّلاَمَ بَیْنَکُمْ رَوَاہُ مُسْلِمٌ
অর্থাৎ: হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা ঈমান গ্রহণ করবে, আর ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হবে না যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরকে ভালবাসবে। আমি কি তোমাদেরকে এমন কথা বলে দেবো না, যার উপর আমল করলে তোমরা পরস্পরকে ভালবাসতে থাকবে? তোমরা পরস্পরের মধ্যে সালামের প্রচলন করো [মুসলিম]
۵.عَنْ اَنَسٍ رَضِیَ اللّٰہُ عَنْہُ قَالَ اِنَّ رَسُوْلَ اللّٰہِ صَلَّی اللّٰہُ عَلَیْہِ وَسَلَّمَ مَرَّ عَلٰی غِلْمَانٍ فَسَلَمَّ عَلَیْہِمْ مُتَّفَقٌ عَلَیْہِ  অর্থাৎ হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম একদল বালকের পার্শ্ব দিয়ে গমন করলেন এবং তাদেরকে সালাম বললেন।  [বুখারী ও মুসলিম]