Anjuman-E Rahmania Ahmadia Sunnia Trust

যাকাত

যাকাত

যাকাত প্রসঙ্গ
‘যাকাত’ আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ ১. পবিত্রতা বা পরিচ্ছন্নতা এবং ২. বৃদ্ধি।
এ গুণ দুটির পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামী পরিভাষায় যাকাত এমন একটি ইবাদতকে বলা হয়, যা প্রত্যেক নিসাবের অধিকারী মুসলমানদের উপর ফরয।
এটা এ উদ্দেশ্যে ফরয করা হয়েছে, যেন বান্দা খোদা ও বান্দার হক্ব আদায় করে। যাকাত আদায়কারীর অর্থ-সম্পদ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হলে তার মধ্যকার কার্পণ্য, স্বার্থান্ধতা, হিংসা-বিদ্বেষ প্রভৃতি কুপ্রবৃত্তি দূর হবে। অন্যদিকে তার মধ্যে প্রেম, ভালোবাসা, উদারতা, কল্যাণ কামনা, পারস্পরিক সহযোগিতা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতার গুণাবলী বৃদ্ধি পাবে।
ফক্বীহগণ যাকাতের সংজ্ঞায় উল্লেখ করেছেন, অর্থ সম্পদের মধ্য থেকে গরীবের এ প্রাপ্য আদায় করা ফরয। যাকাতের নিসাব ও পরিমাণ আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত। যে কোন সময় ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাতে হ্রাস-বৃদ্ধি করার অধিকার কারো নেই।
আধুনিক রাষ্ট্রসমূহ যেরূপ কর নির্ধারণ ও আদায় করে থাকে যাকাত তদ্রুপ কর নয় বরং এটি একটি ইবাদত ও সাদক্বা, যা মানুষকে পাপ-পঙ্কিলতা, অর্থনৈতিক দুর্দশা ও সামাজিক অসমতা মুক্ত করার উদ্দেশ্যে এই ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছে। যাকাত আদায় করলে ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে দ্বিবিধ মঙ্গল সাধিত হয়। প্রথমত- যাকাত আদায়কারী ধনী ব্যক্তি ধন লিপ্সা ও ধনের প্রতি আসক্তি হতে উদ্ভূত বিভিন্ন চারিত্রিক দোষ ও পাপ থেকে মুক্ত থাকে। দ্বিতীয়ত- দরিদ্র, ইয়াতীম, বিধবা নারী, বিকলাঙ্গ, উপার্জন অক্ষম নর-নারী, নিঃস্ব ও অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিগণ যাকাত দ্বারা লালিত-পালিত বা উপকৃত হয়ে থাকে; এটি তাদের প্রতি দয়া নয়, এটি তাদের প্রাপ্য।

কার উপর যাকাত ফরয
বিবেক সম্পন্ন ও প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান নারী-পুরুষ যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী হয়ে থাকে, তাহলে তাদের উপর যাকাত দেয়া বাধ্যতামূলক এবং এটা আদায়ের ব্যাপারে তারা নিজেরাই দায়িত্বশীল। নিসাবের অধিকারী ইয়াতীমের সম্পদের উপর যাকাত আদায় করা ফরয এবং তা আদায় করার দায়িত্ব তার অভিভাবকের। নিসাবের অধিকারী যে কোন প্রতিবন্ধীর অর্থ সম্পদের উপর যাকাত আদায় করা ফরয। এটি আদায় করার দায়িত্বও তার অভিভাবকের উপর। অনুরূপ কয়েদীর উপরেও, যে ব্যক্তি তার অবর্তমানে ব্যবসা বা অর্থ সম্পদের অভিভাবক হবে, সে ব্যক্তি তার পক্ষ থেকে যাকাত আদায় করবে।
বাংলাদেশের কোন মুসলমান যদি বিদেশে থাকে এবং বাংলাদেশে তার সম্পত্তি বা ব্যবসায়ে নিয়োজিত অর্থ নিসাব পরিমাণ মওজুদ থাকে তাহলে তার উপর যাকাত আদায় করা বাধ্যতামূলক। উৎপাদন বৃদ্ধিতে সক্ষম ধন-সম্পদের নির্ধারিত ন্যূন্যতম পরিমাণ (নিসাব) এক বৎসরকাল কারো মালেকানা বা অধিকারে থাকলে এর যাকাত তার উপর ফরয হয়ে থাকে। নিছক ধনই যাকাতের কারণ নয়; বরং ধন বৃদ্ধির (উৎস) ক্ষমতাই যাকাতের মূল কারণ। ধন বৃদ্ধি করার ক্ষমতা থাকলেই পূর্ণ নিসাবের উপর যাকাত ফরয হয়ে থাকে।

নিসাব
নিসাব হলো সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ কিংবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য কিংবা সমপরিমাণ মালামাল বা অর্থ সঞ্চিত থাকা। কারো নিকট নিসাবের কম স্বর্ণ বা রৌপ্য থাকলে উভয়ের মূল্য একত্রে যদি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্যের মূল্যের সমান হয়, তবে মোট মূল্যের উপর যাকাত ফরয হবে। স্বর্ণ ও রৌপ্য উভয় বস্তু নিসাব পরিমাণ থাকলে এগুলোর মূল্য একত্রে হিসাব করার দরকার নেই; বরং উভয়ের যাকাত পৃথক পৃথকভাবে আদায় করতে হবে।

নগদ মুদ্রার যাকাত
ফক্বীহগণের সর্বসম্মতিতে, নগদ মুদ্রার যাকাত ফরয। যদিও মুদ্রাগুলো খাদ্য মিশ্রিত হয়। কারণ তা দেশে প্রচলিত মূল্য স্বরূপ এবং লেন-দেনের উদ্দেশ্যেই এর উদ্ভব হয়েছে। সুতরাং কারো নিকট সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের মূল্যের সমান নগদ টাকা থাকলে, স্বর্ণ ও রৌপ্য কিছুই না থাকলেও তার উপর যাকাত ফরয হবে। [ফতোয়ায়ে শামী] উদাহরণ স্বরূপ, এক তোলা রৌপ্যের মূল্য ২৫০ টাকা। সুতরাং কারো নিকট সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্যের হিসাবে $ ১৩, ১২৫ থাকলে এর যাকাত ফরয। কেননা তা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্যের সমান। নগদ টাকার যাকাতও ৪০ ভাগের এক ভাগ। ব্যাঙ্কে যে সমস্ত টাকা রক্ষিত আছে সেগুলির উপরও যাকাত ওয়াজিব।
বন্ধকী সম্পত্তি যার আওতাধীনে থাকবে তার নিকট থেকে তার যাকাত আদায় করা হবে। বন্ধকী জমি যদি মহাজনের আওতাধীনে থাকে তাহলে মহাজনের নিকট থেকেই তার উৎপন্ন দ্রব্যের ওশর বা দশমাংশ আদায় করতে হবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে জমির খাজনা দিতে হয়, তার কোন ওশর বা দশমাংশ দিতে হবে না। কারখানার যন্ত্রপাতির উপর যাকাত বাধ্যতামূলক নয়। কেবল বছরের শেষভাগে যে কাঁচা মাল বা শিল্পদ্রব্য কারখানায় থাকবে, তার দাম ও নগদ অর্থের দামের উপর যাকাত দিতে হবে। অনুরূপ ব্যবসায়ীদের আসবাবপত্র, স্টেশনারী দোকান বা গৃহ এবং এ ধরনের অন্যান্য বস্তুর উপর যাকাত দিতে হবে না। কেবল বছরের শেষে তাদের দোকানে যে মালপত্র থাকবে তার দামও তাদের তহবিলে সঞ্চিত নগদ অর্থের উপর যাকাত ফরয হবে।
যে সমস্ত বস্তু ও যন্ত্রপাতিকে উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা হয় সেগুলোর উপর যাকাত ফরয নয়। মণি-মুক্তা বা মূল্যবান পাথর অলঙ্কারের গায়ে বসানো থাকুক বা পৃথক থাকুক তার উপর কোন যাকাত নেই, তবে যদি কেউ মূল্যবান পাথরের ব্যবসা করে তবে অন্যান্য পণ্যদ্রব্যের ন্যায় তার উপরও যাকাত ওয়াজিব হবে। অর্থাৎ নিসাব পরিমাণ থাকলে তার মূল্যের শতকরা আড়াই ভাগের হিসাবে যাকাত ওয়াজিব হবে।
খনিজ দ্রব্য, গুপ্তধন ও কৃষি উৎপাদন ছাড়া বাকী যাবতীয় দ্রব্যের যাকাতের জন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে নিসাব পরিমাণ বা তার চাইতে অধিক দ্রব্যের উপর একটি বছর অতিবাহিত হতে হবে। কিন্তু খনিজ দ্রব্য, গুপ্তধন ও কৃষি উৎপাদনের এক বছর অতিবাহিত হওয়া পূর্বশর্ত নয়।
অন্যদিকে ফসল কাটার সাথে সাথেই কৃষি উৎপাদনের উপর যাকাত বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। বছরে দুবার বা তার চেয়েও অধিকবার ফসল হলেও প্রতিবারেই ফসল কাটার পর প্রাপ্ত ফসলের উপর যাকাত দিতে হবে, যদি ওই জমির খাজনা দিতে না হয়।

হাদীস শরীফের বর্ণনা মতে, যে সব বস্তুর উপর যাকাত ফরয সেগুলোর হার নিম্নরূপ-
বৃষ্টির পানিতে চাষাবাদ হলে শতকরা ১০ভাগ এবং কৃত্রিম সেচ ব্যবস্থায় চাষাবাদ হলে শতকরা ৫ভাগ। নগদ টাকা ও সোনা-রূপা শতকরা আড়াই ভাগ। কারখানার উৎপাদিত দ্রব্যাদির উপর শতকরা আড়াই ভাগ।
যে ব্যক্তি অন্যের মুখাপেক্ষী। যেমন বার্ধক্য বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ত্র“টির কারণে যারা সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয় এবং কিছু সাহায্য লাভ করে আত্মনির্ভরশীল হতে পারে এমন শ্রেণির লোক এর অন্তর্ভুক্ত যেমন ছেলে-মেয়ে, বিধবা মহিলা, বেকার ও উপার্জনে অক্ষম এবং দুর্ঘটনা কবলিত ব্যক্তিবর্গ।
‘মিসকীন’ শব্দের ব্যাখ্যা হাদীস শরীফে এমনভাবে দেয়া হয়েছে- যে ব্যক্তি নিজের প্রয়োজন পরিমাণ সামগ্রী লাভ বা উপার্জন করে না। মানুষ যাকে সাহায্য করে বলে বুঝা যায় না এবং সে মানুষের সামনেও হাত পাতেন না।
এ প্রেক্ষিতে মিসকীন এমন ভদ্র ও শরীফ ব্যক্তিকে বলা হয় যে নিজের প্রয়োজন পরিমাণ রুজি অর্জনে সক্ষম নয়। অন্যদিকে নিজের শরাফতের কারণে সে কারো কাছে হাত পাততেও পারেন না।
যাকাত আদায়কারী কর্মচারী বলতে বুঝায়, যারা যাকাত উসূল, বন্টন, ও তার হিসাব-নিকেশে রত থাকে। তারা নিসাবের মালিক হোক বা না হোক সর্বাবস্থায় যাকাতের অর্থ থেকে তারা পারিশ্রমিক লাভ করবে।
যাকাতের টাকা উল্লিখিত ব্যয় ক্ষেত্রের প্রত্যেকটিতে একই সঙ্গে ব্যয় অপরিহার্য নয়। প্রয়োজন ও পরিস্থিতি অনুযায়ী যে ব্যয় যে পরিমাণ সঙ্গত মনে করবে সে পরিমাণ ব্যয় করতে পারবে। এমনকি প্রয়োজন দেখা দিলে একই ব্যয়ক্ষেত্রে সমস্ত টাকাও ব্যয় করা যেতে পারে।

যাকাতের স্বত্বদান
যাকাত প্রদানকারী ব্যক্তি যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তিকে স্বীয় সত্ব ত্যাগ করে যাকাত প্রদান করতে হবে। অন্যথায় যাকাত আদায় হবে না। মালিকানা স্বত্বে দখল না নিয়ে যাকাত গ্রহীতা মঙ্গলজনক কাজে ব্যয় করলে যাকাত আদায় হবে না। তাই মসজিদ, মাদ্রাসা, হাসপাতাল ও ইয়াতিমখানা নির্মাণ, পুল নির্মাণ, নদী-নালা, কূপ ও খাল খনন, সড়ক ও রাস্তা-ঘাট নির্মাণ বা মেরামত, মৃত ব্যক্তির কাফন দান, অতিথি ভোজন ইত্যাদি কার্যে যাকাতের মাল ব্যয় করা জায়েয নাই।
যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তি যদি এ সমস্ত হতে উপকার গ্রহণ করে থাকে তবুও দুরস্ত হবে না। এ গুলির উপর তাদের মালিকানা স্বার্থ না থাকার কারণেই যাকাত আদায় হয় না। কিন্তু এতিমখানায় যদি এতিমদেরকে মালিকানা স্বত্বে আহার, বস্ত্র ও মাদ্রাসার মিসকীনফাণ্ড থাকে এবং ঐ ফাণ্ড হতে গরীব ছাত্রদের খরচ নির্বাহ হয়ে থাকে তাহলে জায়েয হবে। তদ্রুপ উত্তরাধিকারী বিহীন মৃত ব্যক্তির কাফন-দাফনের ব্যয় নির্বাহে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা দুরস্ত নয়। কারণ মৃত ব্যক্তির মালিক হওয়ার যোগ্যতা নেই। কিন্তু যাকাত পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিকে যাকাত দিলে, সে যদি স্বেচ্ছায় উক্ত মৃত ব্যক্তির কাফনে তা ব্যয় করে তবে জায়েয হবে। সেরূপ মৃত ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত থাকলে যাকাতের অর্থ দ্বারা সোজাসুজি এটা পরিশোধ করা জায়েয নহে। কিন্তু মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকার যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত হলে তাকে মালিকা স্বত্বে যাকাত দেয়া যেতে পারে সে তার মালিকানায় হতে স্বীয় সন্তুষ্টিতে মৃত ব্যক্তির পক্ষে ঋণ পরিশোধ করলে জায়েয হবে।

যাকাতের নিয়্যত
যাকাত আদায়ের সময় এর নিয়্যত করা ফরয। যাকাত আদায়ের নিয়্যত ব্যতীত শুধু দান করলে যাকাত আদায় হবে না। নিয়্যত মনে মনে করলে চলবে, মুখে বলা জরুরি নয়। উপযুক্ত পাত্র পাওয়া গেলে যাকাত দেয়া হবে এ উদ্দেশ্যে যাকাতের মাল পৃথক করে রাখা ভাল। যাকাতের মাল পৃথক করার সময় অথবা উপযুক্ত পাত্রকে দেয়ার সময় যাকাতের নিয়্যত করলে চলবে। কিন্তু কোন অবস্থাতেই নিয়্যত না করলে যাকাত আদায় হবে না।[হেদায়া] যাকাত দেওয়ার সময় যাকাত গ্রহীতাকে যাকাতের মাল দেয়া হচ্ছে এ বিষয় জানাবার প্রয়োজন নেই; বরং যদি সে যাকাত গ্রহণের উপযোগী হয়।