সুন্নী জামা‘আত

সুন্নী জামা‘আত

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত তথা
সুন্নী জামা‘আতের পরিচয়

=============
আজ থেকে চৌদ্দশ’ বছরাধিক কাল পূর্বে একদিন হুযূর পূরনূর বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরাত সাহাবা-ই কেরামের এক জনাকীর্ণ পরিবেশে এরশাদ করলেন-

اِنَّ بَنِیْ اِسْرَآءِیْلَ تَفَرَّقَتْ عَلٰی ثِنْتَیْنِ وَسَبْعِیْنَ مِلَّۃً وَّ تَفْتَرِقُ اُمَّتِیْ عَلٰی ثَلٰثٍ وَّ سَبْعِیْنَ مِلَّۃً کُلُّہُمْ فِی النَّارِ اِلاَّ مِلَّۃً وَّاحِدَۃً [مشکوۃ ص ۳۰] অর্থাৎ বনী ইস্রাঈল ৭২ ফিরক্বা বা দলে বিভক্ত হয়েছিলো, আমার উম্মতের লোকেরা ৭৩ ফিরক্বায় বিভক্ত হবে। তাদের মধ্যে একটি দল বাদ দিয়ে অবশিষ্ট সব ফিরক্বা দোযখী হবে। হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এ বাণী মুবারক শুনে সাহাবা-ই কেরাম আরয করলেন, ‘‘হে আল্লাহর রাসূল! ওই ফিরক্বার পরিচয় কি হবে?’’ হুযূর জবাবে এরশাদ করলেন- مَا اَنَا عَلَیْہِ وَاَصْحَابِیْ অর্থাৎ যে আক্বীদার উপর আমি এবং আমার সাহাবীগণ রয়েছে ওই আক্বীদার উপর ওই দলটি থাকবে। [মিশকাত শরীফ পৃ. ৩০]

হুযূর-ই পাকের উপরোক্ত হাদীস শরীফ দ্বারা চারটি বিষয় প্রমাণিত হয়ঃ ১. মুসলমান নামধারী লোকেরা বহুদলে বিভক্ত হবে, ২. মুসলমানদের শুধু একটি দল সত্যের উপর থাকবে। অবশিষ্ট সব দল পথভ্রষ্ট ও দোযখী হবে, ৩. ওই সত্য দলের আক্বীদা সুন্নাত-ই মোস্তফা ও জামা‘আত-ই সাহাবার অনুরূপ হবে এবং ৪. হুযূর মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণ সত্যের মাপকাঠি। যারা তাঁদের পথে থাকবে তারা সত্যের উপর রয়েছে বলে সাব্যস্ত হবে। যারা তাদের পথ পরিহার করবে তারা পথভ্রষ্ট।

আল্লাহ্ তা‘আলার দানক্রমে যা কছিু বিশ্বে হয়েছে ও যা কিছু ক্বিয়ামত পর্যন্ত হতে থাকবে সব কিছু হুযূরের দৃষ্টি মোবারকের সামনে ছিলো। হুযূর ভালভাবে জানতেন যে, তাঁর উম্মতের লোকেরা অদূর ভবিষ্যতে এ পথের উপর অটল থাকবে না বরং বিভিন্ন পথ ও মত অবলম্বন করবে। অনুরূপ, তাদের কয়েকটি দল হবে, যাদের মধ্যে শুধু একটি দলই সত্যের উপর থাকবে। অন্য সব দল পথভ্রষ্ট ও দোযখীদের। অতঃপর হুযূর-ই আকরাম এসব বিষয় সম্মানিত সাহাবীদেরকে বলে দিয়েছেন, যাতে সাহাবীগণ নিজেরাও সচেতন থাকেন, পরবর্তীতে আগমনকারী মুসলমানদেরকেও সতর্ক রাখেন। বলা বাহুল্য, হুযূর যা বলেছেন তাই বাস্তবে ঘটেছে।

খোদ্ সাহাবা-ই কেরামের যুগের শেষ ভাগ থেকে পথভ্রষ্ট ফিরক্বাগুলোর জন্ম হতে থাকে; কিন্তু সাহাবীদের নিষ্ঠা ও তাঁদের শানিত তরবারিগুলোর ঝঙ্কারে ওইসব বাতিল ফির্কা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। অতঃপর সম্মানিত সাহাবীদের যুগ সমাপ্ত হলো। তারপর পুরানা দমিত উক্ত বাতিল ফির্কাগুলোর অবশিষ্ট উত্তরসূরীরা পুনরায় মাথাচাড়া দিলো। তাদের সাথে দু/একটি নতুন নতুন ফিরক্বাও পয়দা হতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত ৭২ দোযখী ফির্কার সংখ্যা পূর্ণ হয়ে গেলো।

যখন কোন কোন ধূর্ত পথভ্রষ্ট দল আপন-আপন দলের সুন্দর সুন্দর নাম দিয়ে ওইগুলোকে প্রসিদ্ধ করেছে এবং সরলপ্রাণ মুসলমানদেরকে পথভ্রষ্ট করে নিজ নিজ দলের অন্তর্ভুক্ত করতে লাগলো, তখন সাহাবা-ই কেরামের পদাঙ্ক অনুসরণকারী মুসলমানদের উপর অপরিহার্য হয়ে পড়লো আপন দলেরও একটি বিশেষ ও স্বতন্ত্র নাম নির্ধারণ করা। সুতরাং তাঁরা এর নাম ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ সাব্যস্ত করলেন। সংক্ষেপে এর নাম ‘সুন্নী’ রেখেছেন। ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’-এর অর্থ হচ্ছে- ‘সুন্নাত-ই মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও জামা‘আত-ই সাহাবাকে মান্যকারী লোকেরা’। দেখুন, যখন সাহাবীগণ হুযূর-ই আক্বদাস সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সত্যপন্থী দলের পরিচয় জানতে চাইলেন, তখন হুযূর জবাবে এরশাদ করেছেন- مَا اَنَا عَلَیْہِ وَاَصْحَابِیْ যার সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে- সুন্নাত-ই রাসূল ও জামা‘আত-ই সাহাবাকে মান্যকারী দলই হচ্ছে সত্যপন্থী দল। হুযূরের এ জবাবকে সামনে রেখে সত্যপন্থী মুসলমানগণ নিজেদের স্বতন্ত্র নাম ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ সাব্যস্ত করেছেন। এ নামেই তাঁরা আজ পর্যন্ত সারা বিশ্বে প্রসিদ্ধ।

আহলে সুন্নাত ওয়া জামা‘আত (সুন্নী জামা‘আত)-এ বড় বড় প্রসিদ্ধ ইমাম, মুহাদ্দিস, আউলিয়া-ই কেরাম, গাউস, কুতুব, ওলামা ও বাদশাহ্ পয়দা হয়েছেন, যাঁরা সাহাবা-ই কেরামের পথে চলে দ্বীন-ই ইসলামের খুব প্রচারনা ও প্রসারের কাজ করে গেছেন। হযরত ইমাম-ই আ’যম আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত ইমাম মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত ইমাম শাফে‘ঈ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু প্রমুখ সাহাবা-ই কেরামের পথে গোটা দুনিয়ার সুন্নী মুসলমানদের পেশোয়া হিসেবে পরিগণিত হন।

হযরত সাইয়্যেদুনা ইমাম যায়নুল আবেদীন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত সাইয়্যেদুনা ইমাম বাক্বের রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত সাইয়্যেদুনা ইমাম মূসা কাযেম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত সাইয়্যেদুনা ইমাম আলী রেযা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু প্রমুখ আহলে বায়ত-ই রাসূল সাহাবাই কেরামের পথে ও মতে চলে ইসলামের ঝাণ্ডাকে বুলন্দ করেছেন। আর তাঁদের রূহানী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দ্বারা লাখো সুন্নী মুসলমানদের হৃদয়কে আলোকদীপ্ত করেছেন।

হযরত ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বোখারী, হযরত ইমাম মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ নিশাপুরী, হযরত ইমাম আবু দাউদ সাজিস্তানী, হযরত ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ঈসা তিরমিযী, হযরত ইমাম নাসাঈ, হযরত ইমাম ইবনে মাজাহ্, হযরত ইমাম ক্বাযী আয়ায আন্দালূসী, হযরত ইমাম ইবনে হুম্মাম, হযরত ইমাম গায্যালী, হযরত ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূতী প্রমুখ মুহাদ্দিস রিদ্বওয়ানুল্লাহি তা‘আলা আন্হুম আজমা‘ঈন আপন আপন যুগে সাহাবা-ই কেরামের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইসলামী শিক্ষার প্রসার ঘটান। আর সুন্নী মুসলমানদের পথ-প্রদর্শনের গুরু দায়িত্ব পালন করেন।

হুযূর গাউসে আ’যম আব্দুল ক্বাদের (মুহি-উদ্দীন) জীলানী বাগদাদী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত খাজা গরীব নওয়ায শায়খ মু‘ঈন উদ্দীন চিশতী আজমীরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত ইমামূল আরেফীন শায়খ শেহাব উদ্দীন সোহ্রাওয়ার্দী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত খাজা-ই খাজেগান বাহাউদ্দীন নক্বশবন্দী বোখারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু প্রমুখ সম্মানিত ওলী সম্মানিত সাহাবীগণের অনুসরণে আহলে সুন্নাতের ঝাণ্ডাকে উড্ডীন করেছেন এবং হাজার হাজার মুসলমানের আত্মার পরিশুদ্ধি ও বিভিন্ন দ্বীনী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে ওলী ও মুত্তাক্বী-পরহেযগার করে দিয়েছেন।

হযরত সাইয়্যেদ সালার-ই মাস‘ঊদ, গাযী সরকার-ই বাহরাইচ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত খাজা নেযাম উদ্দীন সুলতানুল আউলিয়া সরকার-ই দিল্লী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু,্ হযরত মাখদূম আশরাফ জাহাঙ্গীর সরকার-ই কচওয়াচাহ্ ফয়যাবাদী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, মা’আরিফ-ই লাদুন্নিয়ার প্রস্রবণ ও উলূম-ই ইলাহিয়্যার ধারক হযরত আব্দুর রহমান চৌহরভী, কুত্ববুল আউলিয়া হযরত সাইয়্যেদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটী, গাউসে যামান হযরত সাইয়্যেদ মুহাম্মদ তাইয়্যেব শাহ্ সিরিকোটি পেশোয়ারী প্রমুখ রদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম সুন্নী মুসলমানদের ওইসব পেশোয়া, যাঁরা, পাক-বাংলা-ভারত উপমহাদেশে স্থায়ীভাবে ইসলামের ঝাণ্ডাকে স্থাপন করেছেন।

খলীফা ও বাদশাহদের মধ্যে হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত গাযী সুলতান নূর উদ্দীন যঙ্গী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, হযরত গাযী সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, হযরত গাযী সুলতান মাহমুদ গযনভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, হযরত গাযী সুলতান আওরঙ্গযেব আলমগীর শাহানশাহে হিন্দ আলায়হির রাহমাহ্ প্রমুখ হলেন ওইসব সুন্নী শাসক, যাঁরা আপন আপন যুগে ইসলামের ভিত্তিকে মজবুত করে গেছেন এবং দ্বীনের ঝাণ্ডাকে উড্ডীন করেছেন।

ভারতের বিজ্ঞ আলিমদের মধ্যে হযরত শায়খ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী, হযরত মীর সাইয়্যেদ মাওলানা আবদুল ওয়াহিদ বলগ্রামী, হযরত শায়খ মুজাদ্দিদ আহমদ ফারূক্বী সেরহিন্দী, হযরত মাওলানা শাহ্ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী, হযরত মাওলানা শাহ্ ফদ্বলে রসূল ওসমানী বদায়ূনী, হযরত মাওলানা আব্দুল আলী ফিরিঙ্গী-মহল্লী লক্ষেèৗভী, হযরত মাওলানা শাহ্ সাইয়্যেদ আবুল হোসাইন আহমদ নূরী বরকাতী মারহারাভী, আ’লা হযরত মুজাদ্দিদে মিল্লাত শাহ্ আহমদ রেযা বেরলভী, বাংলাদেশে আল্লামা গাযী আযীযুল হক শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রমুখ হলেন সুন্নী মুসলমানদের এমনসব পেশোয়া, যাঁরা একদিকে দ্বীন ও মাযহাবের হিফাযতের কর্তব্য পালন করেছেন, অন্যদিকে আক্বাইদে আহলে সুন্নাতের শত্র“ দলগুলোর ধ্বজা উড়িয়ে দিয়েছেন। সুতরাং ইসলামের এ মূল ধারায় যারা নিষ্ঠার সাথে আক্বীদা ও আমলে প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন তাঁরাই প্রকৃত ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ (সুন্নী মুসলমান)