বৈষম্যহীন প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে

বৈষম্যহীন প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে

মুহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত-

শিক্ষা মানুষের মৌলিক ও জন্মগত অধিকার। যে কোন মানুষের বুদ্ধি ভিত্তিক বিকাশের জন্য শিক্ষা একটি অপরিহার্য বিষয়। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ যাবৎ শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্বিন্যাসের জন্য বিভিন্ন শিক্ষা কমিশন গঠন করা হলেও কোনো কমিশনই পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি এবং শিক্ষাক্ষেত্রে কাঙ্খিত কোন সংস্কার আসেনি। এখন দেখার বিষয় হলো নতুন শিক্ষাক্রম ২০২৩ কীভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তন আনবে। এন সি টি বি বলছে, নতুন শিক্ষাক্রম হব অভিজ্ঞতা ভিত্তিক শিখন পদ্ধতি। যার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাবেন এবং আনন্দের সাথে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে তার মেধার বিকাশ ঘটাবে। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ম ও ২য় শ্রেণি ও ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হবে। ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সব শিক্ষার্থীকে এই শিক্ষাক্রমে নিয়ে আসা হবে। নতুন শিক্ষাক্রম ২০২৩ এর শিক্ষা উপকরণ শুধু মাত্র বই নয়। তার সাথে আরও যুক্ত হবে ভিডিও, পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন, ইউটিউব, গুগল, ভ্রমণ, লাইব্রেরি, শিক্ষক, পিতামাতা, বড় ভাই বোন সহ বিভিন্ন যায়গা, পরিস্থিতি ও বিভিন্ন ব্যক্তিই হবে নতুন শিক্ষাক্রম ২০২৩ এর শিক্ষা উপকরণ। শিক্ষায় এত কম বাজেটের দেশে এই ধরনের শিক্ষাক্রম কতটুকু সফল হবে তা দেখার বিষয়। নতুন শিক্ষাক্রম উপযোগী ভৌত অবকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, উপযুক্ত শিক্ষক, শিক্ষা উপকরণ সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিদা আমাদের কতটুকু আছে তা যথেষ্ট প্রশ্ন সাপেক্ষ।

স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি দেশে পরীক্ষায় পাশের হার বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষার গুনগত মানের তেমন উন্নতি ঘটেনি বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যপকহারে অবনতি ঘটেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে বিরাজমান শিশু শিক্ষার অবস্থা নাজুক এবং বৈষম্যমূলক। মানব জীবনের প্রাথমিক স্তর হলো শিশুকাল। এই শিশুকালই হলো প্রকৃত শিক্ষার সোপান। এদেশের মোট জনসংখ্যার বিশাল অংশ হলো শিশু। এদের উপর নির্ভর করছে দেশের আগামী। শিশুর সুন্দর ও উপযুক্ত পরিচর্যা এবং প্রকৃত শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে না পারলে ভবিষ্যতে তাদেরকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা দূরুহ হয়ে উঠবে। আজকের শিশুকে আগামী দিনের উপযুক্ত এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তাদেরকে আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষা দিয়ে সৃজনশীলতা বিকাশের পথকে সাবলীল ও সহজ করতে হবে নতুবা উন্নত ও দক্ষ মানব সম্পদ তৈরিতে আমরা দিন দিন পিছিয়ে পড়বো। ১৯২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত `Convention of league of Nation’ যাকে আমরা জেনেভা ঘোষণা বলি সেখানে বলা হয়েছে- ”মানব জগতে সর্বোত্তম যা কিছু দেয়ার আছে তা শিশুরাই পাওয়ার যোগ্য”। কিন্তু আমরা কি শিশুকে তার ন্যায্য পাওনা দিচ্ছি ? শিক্ষা জন্মগত ও মৌলিক অধিকার হওয়া সত্বেও আমরা শিশুদের জন্য উপযুক্ত ও সার্বজনীন শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারিনি বরং শিক্ষা ক্ষেত্রে তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন বিভাজন যার ফলে জীবনের শুরুতেই শিশুদেরকে বিরাট বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে। যেখানে সকল শিশু সমভাবে শিক্ষার সুযোগ পাওয়ার কথা সেখানে বাংলাদেশে প্রাথমিক স্তরে বর্তমানে ১০-১২ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। যেমন- সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, নিবন্ধনকৃত বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, নিবন্ধনহীন বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, কমিউনিটি বিদ্যালয়, এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয়, এবতেদায়ী মাদ্রাসা, স্যটেলাইট স্কুল ও কিন্ডারগার্টেন ইত্যাদি। প্রাথমিক পর্যায়ে এতো ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা-ই বলে দেয় আমাদের শিক্ষার হযবরল অবস্থা। দেশে একটি একক এবং সমন্বিত শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে দ্বিধাবিভক্ত ও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা আমাদের মেধা ও সৃজনশীলতাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দিচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা হলো একজন শিশুর বুনিয়াদি শিক্ষা যা শিশুর ভবিষ্যৎ জীবনের গতিমুখ নির্ধারণ করে দেয়ার পথকে সুগম করে। প্রত্যেক শিশুর এই বুনিয়াদি শিক্ষা সমভাবে নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু বাংলাদেশে প্রচলিত এত ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা আজকের শিশুকে শিক্ষা জীবনের শুরুতেই ঠেলে দিচ্ছে বৈষম্যের সমুদ্রে। উল্লেখিত প্রতিটি শিক্ষা ব্যবস্থা একটির সাথে আরেকটির রয়েছে ব্যপক ব্যবধান। আবার একই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থায়ও নগর এবং গ্রামের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে গুনগত ফারাক। অর্থনৈতিক বৈষম্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে আমাদের দেশের এই বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা। ধনাঢ্য শ্রেণির জন্য কিন্ডারগার্টেন স্কুল বা বিভিন্ন ইংরেজী মাধ্যম স্কুল আর গরীব ও প্রান্তিক শ্রেণির জন্য গড়ে উঠেছে সরকারী-বেসরকারী প্রাথমিক স্কুল থেকে শুরু করে অন্যান্য স্কুল গুলো। ধনীক শ্রেণি তাদের সন্তানদের কিন্ডারগার্টেন বা অন্যান্য ইংরেজী মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করিয়ে তাদের উন্নত শিক্ষার ভিত্তি মজবুত নিশ্চিত করছে আর গ্রামের সাধারণ জনসাধারণ তাদের সন্তানদের উপযুক্ত প্রাথমিক শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এমতাবস্থায়, সমাজের নিম্ন-মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এবং প্রান্তিক শ্রেণির শ্রমজীবি মানুষের সন্তানরা প্রাথমিক স্তরেই শিক্ষার মানের দিক থেকে পিছিয়ে পড়ছে যা তাদের উন্নততর ভবিষ্যতের স্বপ্নকে ম্লান করে দিচ্ছে। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষার গুনগত মান অনেকাংশে পরিবর্তন হলেও দেশের সব শিশুদেরকে একীভুত শিক্ষা ব্যবস্থায় নিয়ে আসার মতো ব্যবস্থা সরকার গড়ে তুলতে পারেনি। তাছাড়াও গ্রামীণ অবকাঠামোগত অবস্থা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার অসুবিধার কারণে অপেক্ষাকৃত গ্রামীণ জনপদের স্কুলগুলোতে ভালো শিক্ষকগণ অবস্থান করতে চান না। তাঁরা সব সময় থানা/উপজেলা সদরে কিংবা তার আশেপাশে স্কুলগুলোতে থাকতে পছন্দ করেন আর তাতে একশ্রেণির দূর্নীতিবাজ শিক্ষা অফিসার বা উর্ধ্বতন কতৃপক্ষ মোটা অংকের লেনদেনের বিনিময়ে এসব শিক্ষকদেরকে তাদের পছন্দানুযায়ী স্কুল গুলোতে বদলীর ব্যবস্থা করে দেন। ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলগুলোতে পড়া লেখার মান দিন দিন ক্রমাবনতি হতে থাকে। তার সাথে রয়েছে প্রাইভেট টিউশানির দৌরাত্ম্য। যদিও সরকার এখন সব প্রকারের প্রাইভেট টিউশানি নিষিদ্ধ করেছেন। তবুও নামে বেনামে বিভিন্ন উপায়ে এই টিউশানি চলছে। দরিদ্র পরিবারের শিশুরা কখনো একজন ভালো শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ার সামর্থ রাখে না আর শিক্ষকগণ টিউশানির লোভে কিংবা ছাত্র-ছাত্রীর তুলনায় শিক্ষকের অপ্রতুলতা, শ্রেণিকক্ষের অভাব সহ নানান ধরনের সীমাবদ্ধতার কারনে যথাযথ পাঠদান সম্ভব হয়ে উঠে না ফলে গ্রামের দরিদ্র পরিবারের শিশুটি বঞ্চিত হয় উপযুক্ত শিক্ষা পাওয়ার সুযোগ থেকে। যদিও বর্তমান সরকার প্রাক প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া সহ বিরাজমান বৈষম্য রোধ, ঝরে পড়া সমাস্যার সমাধান, পরিবেশ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ৩০:১, শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কাজ করছেন বলে আমরা প্রায়শ শুনে থাকি। কিন্তু আমাদের জিডিপিতে শিক্ষা খাতের বরাদ্দের দিকে তাকালে বুঝা যায় আমরা শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত ও যুগোপযোগী করতে কতটুকু আন্তরিক! জিডিপিতে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের দিক দিয়ে বিশ্বের ১৬১টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১৫৫ তম। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন শিক্ষা খাতে ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা মোট বাজেটের ১২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। বিদায়ী বছরে তা ছিল বাজেটের ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান থেকে বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের প্রস্তাবকে গতানুগতিক বলেছেন শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা। গুণগত শিক্ষার জন্য বরাদ্দের হার আরও বাড়ানোর দাবি করেছেন তাঁরা। এই বরাদ্দ দিয়ে উন্নততর, আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষার ব্যবস্থা করা মোটেও সম্ভব নয়।

প্রাথমিক শিক্ষাকে একক মান সম্পন্ন, যুগোপযোগী এবং আধুনিক শিক্ষায় রূপান্তরিত করার সাংবিধানিক অঙ্গীকারকে (সংবিধানের ১৭ নং ধারা) প্রাতিষ্ঠিানিক রূপ দিতে হবে। সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মানোন্নয়ন হলেও এখনো কাঙ্খিত লক্ষে পৌঁছুতে অনেক বাকী। ভৌত অবকাঠামো সহ নানান ধরনের সীমাবদ্ধতার কারনে এখনো সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো দেশের সকল শ্রেণির শিশুদের জন্য উপযুক্ত পাঠদান নিশ্চিত করতে পারেনি। প্রশিক্ষিত শিক্ষক থাকলেও তা এখনো ছাত্র-ছাত্রীর আনুপাতিক হারের তুলনায় অপ্রতুল। অন্যান্য যে ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে তার অবস্থা আরো নাজুক। বিশেষ করে এবতেদায়ী মাদ্রাসা ও কওমী মাদ্রাসাগুলোতে বিরাজমান প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা ও দেশে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে রয়েছে বিস্তর ফারাক। অপরদিকে দেশে ৭০ হাজারের অধিক কিন্ডারগার্টেনের জন্য সরকারের তেমন কোন নীতিমালা না থাকায় প্রত্যেকে নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে এবং পাঠ্যসূচী নির্ধারণ করছে। এরকম বৈষম্যমূলক প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে সকল শিশুদের একই পদ্ধতির ও সমমান সম্পন্ন শিক্ষা পাওয়ার অধিকার।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সৌদি আরব প্রবাসী।

Share:

Leave Your Comment