এক মহা ভ্রান্তধারণা ‘পুনর্জন্মবাদ’ বা ‘জন্মান্তরবাদ’

এক মহা ভ্রান্তধারণা ‘পুনর্জন্মবাদ’ বা ‘জন্মান্তরবাদ’

এক মহা ভ্রান্তধারণা ‘পুনর্জন্মবাদ’ বা ‘জন্মান্তরবাদ’ [Transmigration of Souls]

এক শ্রেণীর অমুসলিমের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় যে, তারা বলে- ‘জনমে জনমে’, ‘কোন্‌ জনমে’, ‘প্রত্যেক জনমে’ ইত্যাদি। এটা একটা জঘন্য ভ্রান্ত ও শিরকী আক্বীদা। তাদের এ ভ্রান্ত আক্বীদা বা বিশ্বাসের নাম تناسخ (তানাসুখ) বা পুনর্জন্মবাদ কিংবা জন্মান্তরবাদ। এর অর্থ হচ্ছে জীবাত্মা এক শরীর থেকে অন্য শরীরে পৃথিবীতে স্থানান্তরিত হয় বলে বিশ্বাস করা। [শরহে মাওয়াক্বিফ, আল-মু’জামুল ওয়াসীত্ব, শরহে আক্বাঈদে নাসাফী, ক্বাওয়াইদুল ফিক্বহ]

এমন বিশ্বাস কালের বিবর্তনের এক পর্যায়ে এসে প্রাচীন জাতিপুঞ্জের হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে প্রসার লাভ করেছে।             [প্রাগুক্ত]

এমন আক্বীদায় বিশ্বাসীরা হলো ওইসব সম্প্রদায়, যারা ধারণা করে যে, মৃত্যুর পর মানবাত্মা পূর্ববর্তী জীবদেহের চাইতে যথাক্রমে উঁচু কিংবা নিম্ন পর্যায়ের জীব দেহে স্থানান্তরিত হয়। দার্শনিকদের মতে, জন্মান্তরবাদে বিশ্ববাসীরা হচ্ছে এমন এক সম্প্রদায়, যাদের ধারণা হচ্ছে- মানুষ তার জীবদ্দশায় ‘পূর্ণাঙ্গ আত্মা’ (نفوس كامله) অর্জনে সক্ষম হয় কিংবা সক্ষম হয় না। তাতে সক্ষম না হলে আত্মা অসম্পূর্ণ (نفس ناقصه) থেকে যায়।

যদি ‘নাফ্‌স-ই কামিলাহ’ (পূর্ণাঙ্গ আত্মা) অর্জিত হয়, তবে তা ব্যক্তির মধ্যে সর্বগুণে পূর্ণাঙ্গতা লাভের পর তার তিরোধানের সাথে সাথে তা দেহ থেকে বের হয়ে عالم قدس (পবিত্রাত্মার জগতে) এ দেহের সংমিশ্রণ ছাড়াই বাস করে। তখন দেহের সংমিশ্রণের কোন প্রয়োজনীয়তা তার থাকে না। এ মতবাদকে ‘নির্বানবাদ’ اَلْحُجَرَّدُ عَنِ الْعَلاَئِقِ الْجِسْمَانِيَّةِ বলে। আর মানুষের ‘অসম্পূর্ণ আত্মা’ نفوس ناقصه)), যা দেহে থাকাকালীন সময়ে পূর্ণতায় পৌঁছতে পারে নি,  সেগুলোও বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তিরোধানের পর পূর্ণতা লাভের জন্য প্রচেষ্টারত থাকে। প্রাচীন হিন্দু সম্প্রদায় এ ‘জন্মান্তরবাদ’-এ বিশ্বাসী। যেমন কবি জীবনানন্দদাস তার এমন বিশ্বাসকে নিম্নলিখিত কবিতায় প্রকাশ করেছেন-

আবার আসিব ফিরে, ধান সিঁড়িটির তীরে।

এই বাংলায়; হয়ত বা মানুষ নয়

শঙ্খ ছিল, শালিকের বেশে।

উক্ত কবির ধারণা- মানুষ বক, শালিক, শঙ্খ, চিল হয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসবে। উল্লেখ্য যে, এসব কুধারণা ইসলামী শাস্ত্রবিদদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এখানে আরো উল্লেখ্য যে, নবী, ওলী, গাউস, কুত্বব, আবদাল ও শহীদগণ ইন্‌তিকালের পর আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ ক্ষমতা বলে সৃষ্টি জগতের কল্যাণ সাধন করতে সক্ষম। অন্য কোন আকৃতি ধারণ করে পৃথিবীতে পুনর্জন্ম লাভ করার তাঁদের কোন প্রয়োজন নেই। এমন কোন নিয়মও ইসলামে স্বীকৃত নয়।

জন্মান্তরবাদীরা আরো বলে থাকে-

এক. মানবাত্মা নিঃশেষ হয় না। কারণ তাদের মতে, নিঃশেষ হবার জন্য তা দেহের সাথে সংমিশ্রিত থাকা অপরিহার্য। যেহেতু মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে, তখন আত্মা দেহ থেকে পৃথক হয়ে যায়; সংমিশ্রিত থাকে না, সেহেতু তাই তা আর ফানা বা নিঃশেষঐ হয় না। (এখানে দেহের সাথে আত্মার সংমিশ্রণের শর্তটি ইসলামী আক্বীদার বিরোধী।)

দুই. তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলে, আত্মা ও দেহের পুনরুত্থান (البعث) হবে না। (নাঊযুবিল্লাহ!) কেননা, তাদের ধারণা মতে- কোন বস্তুর পুনঃসৃষ্টি হবার জন্য এর অংশ বিশেষ اجزاء অবশিষ্ট থাকা প্রয়োজন। অথচ بسيط (একক বস্তু) তথা আত্মা ফানা হবার পর অবশিষ্ট থাকে না। দেহও বিলীন হয়ে যায়। সুতরাং তাদের মতে আত্মা ও দেহ কোনটাই পুনরুত্থিত হবে না।

তিন. তারা বলে, মানবাত্মা পূর্ণতা লাভের জন্য দেহ বর্জিত হয়ে অন্যান্য আকৃতি ধারণ করে।

খণ্ডন

ওইসব ক’টি মতবাদই মনগড়া ও ভ্রান্ত; বরং আল্লাহ ও তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ সম্পর্কে যা বলেছেন তা-ই বাস্তব ও সত্য। ইসলাম বলে- পবিত্র ক্বোরআনের ভাষায়,  রূহ যেহেতু আল্লাহ্‌র হুকুম امر رب)), সেহেতু রূহের মৃত্যু হয় না, বিলুপ্তও হয় না। কিন্তু মানব দেহ, এমনকি সব কিছুই ধ্বংসপ্রাপ্তও হতে পারে (অবশ্য, কারো কারো দেহও অবিকৃত থাকে।) মহান স্রষ্টার কুদরতে ক্বিয়ামতে পুনরায় সবাই সৃষ্টিও হবে সৃষ্টিও হবে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর জন্য কোন উপায়-উপকরণের প্রয়োজন হয় না। এ প্রথমোক্ত বিষয়ের প্রমাণ হচ্ছে এ আয়াতগুলো-

১.আল্লাহ তাজ্ঞআলা এরশাদ ফরমায়েছেন-كُلُّ شَئٍ هَالِكٌ اِلاَّ وَجْهُه

তরজমাঃ  সব কিছু ধ্বংস হবে, কিন্তু ধ্বংস হবে না আল্লাহর পবিত্র সত্তা।

২. অন্য আয়াতে এরশাদ হচ্ছে-كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ وَّ يَبْقى وَجْهُ رَبِّكَ ذُوْ الْجَلاَلِ وَالْاِكْرَامِ

তরজমাঃ  অর্থাৎ ভূ-পৃষ্ঠের উপর যতকিছু আছে সবই নশ্বর এবং চিরস্থায়ী স্থায়ী হবেন আপনার প্রতিপালকের সত্তা, যিনি মহামহিম ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। [৫৫:২৬-২৭]

এবার শেষোক্ত বক্তব্যের (পূনরুত্থান) পক্ষে প্রমাণ হচ্ছে নিম্নলিখিত আয়াতগুলো-ثُمَّ اَنَّكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ تَبْعَثُوْنَ

তরজমাঃ আপনি বলে দিন, আপনি বলে দিন, সেগুলো তিনিই জীবিত করবেন, যিনি প্রথমবারে তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। [৩৬:৭৯]

كَمَا بَدَأْنَا اَوَّلَ خَلْقٍ نُّعِيْدُه

তরজমাঃ যেভাবে আমি প্রথমবার সৃষ্টি করেছি তেমনিভাবে তাকে পুনরায় সৃষ্টি করবো।

মৃত্যুর পর রূহ অন্য শরীরে মানুষের হোক, কিংবা পশুর হোক, স্থানান্তরিত হয়ে পুনরায় দুনিয়ায় আসে বলে বিশ্বাস করা, যাকে ‘পুনর্জন্মবাদ’ বা ‘জন্মান্তরবাদ’ বলা হয়, সম্পূর্ণ ভুল। এমন বিশ্বাস কুফর।

বস্তুত মৃত্যুর পর রূহ অন্য কোন শরীরে যায় না বরং সেটার পূর্ববর্তী শরীরের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে, যদিও মৃত্যুর কারণে তা শরীর থেকে পৃথক হয়ে যায়, তবুও ‘বরযখ’ বা কবর জগতে শরীরের উপর যা ঘটে তা রূহ বা আত্মা অনুভব করে।

মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির মর্যাদানুসারে তার রূহ ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় থাকে। মুসলমানের রূহ তার মর্যাদানুসারে বিভিন্ন জায়গায় থাকে। কতেক থাকে কবরে, কতেক ঝমঝম কুপের নিকট, কতেক আসমান-যমীনের মধ্যখানে, কতেক বিভিন্ন আসমানে; এমনকি কতেক সপ্তম আসমানেও স্থান পায়। কতগুলো আবার আসমানগুলোর উপরেও। কারো কারো রূহ আরশের নীচে আলোকবর্তিকার মধ্যে, করো কারো ‘আঞ্চলা-ই ইল্লীয়্যীন’-এর মধ্যে অবস্থান করে। তবে যেখানেই থাকুক না কেন, তার শরীরের সাথে সম্পর্ক যথারীতি বজায় থাকে। কবরের পাশে কেউ আসলে তাকে চিনে, তার কথা শুনে, অথচ রূহ কবরের পাশে থাকার বা যাবার দরকার নেই। রূহের জন্য নিকটে ও দূরে এক সমান। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে- মুসলমানের রূহ তার জীবদ্দশায় পাখীর মতো দেহের পিঞ্জরায় আবদ্ধ ছিলো। মৃত্যুর পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

পক্ষান্তরে, কাফিরদের দুষ্ট আত্মাগুলোর কিছু সংখ্যক থাকে কবরে, চিতা বা শশ্মানে, আর কিছু থাকে ইয়েমেনের বরহুত নামক নালায়। আর কতেক থাকে যমীনের বিভিন্ন স্তরে। কতেক থাকে সর্বনিম্নস্থান সিজ্জীনে। সেগুলো ও তাদের কবর, চিতা বা শশ্মানের পার্শদিয়ে যাতায়তকারীদেরকে দেখে, চিনে ও কথা শুনতে পায়। কিন্তু তার ভক্টহ মৃত্যুর পরও পাখীর মতো পিঞ্জরাবদ্ধই থেকে যায়, কোথাও যাবার ক্ষমতা রাখে না।

আরো উল্লেখ্য যে, মৃত্যু মানে শরীর থেকে রূহ পৃথক হয়ে যাওয়া। অবশ্য রূহের মৃত্যু হয় না, রূহ বিলুপ্ত হয়ে যায় বলে ধারণাকারী বদ-আক্বীদাসম্পন্ন।

আরো উল্লেখ থাকে যে, আল্লাহর ইচ্ছাক্রমে দেহের সাথে রূহ একত্রিত হয়ে দুনিয়ায় পয়দা হয়ে প্রকাশ্যভাবে আমল করার সুযোগ শুধু একবারই হয়। পুনরায় কখনো হয় না। বরযখের আমলের যেমন সাওয়াব নেই, তেমনি সেটা দুনিয়াবী আমল হিসেবেও গণ্য নয়। অবশ্য, কেউ দুনিয়ার মতো কোন নেক কাজের সুযোগ লাভ করলে তা দ্বারা তিনি ইবাদতের তৃপ্তি পান। আল্লাহ প্রতিটি মানুষকে পুনরায় জীবিত করে ক্বিয়ামতে পুনরুত্থিত করবেন। এটাই ইসলামী আক্বিদা, এটাই সত্য। এতদ্ব্যতীত ‘জন্মান্তরবাদ’ ইত্যাদি হিন্দুয়ানী কুফরী ধারণা, বাতিল ও মনগড়া।

[গাউসিয়া তরবিয়াতী নেসাব, পৃ.৩৯-৪২]