হাদিস শাস্ত্রে ইমাম আযম আবু হানিফার অসাধারণ ব্যুৎপত্তি

হাদিস শাস্ত্রে ইমাম আযম আবু হানিফার অসাধারণ ব্যুৎপত্তি

মুফতি মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান আল কাদেরী

বর্তমান মুসলিম বিশ্বে মাযহাব বিরোধী তথাকথিত আহলে হাদিস নামে কিছু লোক সহীহ হাদিস ও বুখারী শরিফের জিগির তোলে প্রতিনিয়ত সরলপ্রাণ মুসলিম সমাজকে বিভ্রন্ত করছে পথভ্রষ্ট্র, বাতিল গোষ্ঠি সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন, বুজুর্গানে দ্বীন, হকপন্থি ইসলামি চিন্তাবীদ, মুজতাহিদ ওলামায়ে কেরামের ব্যপারে বিরূপ মন্তব্য ও নেতিবাচক ধারণা প্রচারে নির্লজ্জভাবে লিপ্ত। ওইসব পথভ্রষ্টের দল মুসলিম জাহানের সর্বমান্য ইমাম, বিশ্ববিখ্যাত ও সমাদৃত ইসলামি আইন ও ইলমে ফিকহ এর রূপকার, কুরআন-সুন্নাহর সঠিক ব্যাখ্যাদাতা ইমাম আযম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর শানে যে জঘন্য উক্তি ও কুরুচিপূর্ণ শব্দ ব্যবহার এবং হানাফী মাযহাব নিয়ে অবান্তর কথা বলে তা রীতিমতো বিষ্ময়কর।
হাদিস শাস্ত্রের সকল শাখা প্রশাখায় বিচরণকারী ও নজিরবিহীন পারদর্শী ইলমে দ্বীনের মৌলিক উৎস কুরআন-সুন্নাহ ও অন্যান্য বিষয়ের ওপর অনুসন্ধানকারী প্রিয় নবীজির সুসংবাদে ধন্য, বহু আসহাবে রাসুলের চাক্ষুষ দ্রষ্টা, নবুয়তী ইলমের ধারক ও বাহক, আমিরুল মুমিনিন ফিল হাদিস ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক রহমাতুল্লাহি আলায়হি এর সরাসরি উস্তাদ, যুগশ্রেষ্ঠ হাদিস বিশারদ ইমাম বুখারির সম্মানিত দাদা উস্তাদ, পূর্ব ও পরবর্তী যুগের সকল বিদ্বান সমাজ কর্তৃক ইমাম আযম উপাধিতে ভূষিত, ইমামুল আইম্মা ইমাম আযম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলায়হি এর সম্পর্কে লা-মাযহাবীদের উদ্ভট অভিযোগ ইমাম আযম অল্পসংখ্যক হাদিসের অধিকারী কিংবা তিনি নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস নন অথবা যঈফ হাদিসের ওপর আমলকারী।
ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলায়হি ফিকহ শাস্ত্রে ও মাসআলা উদঘাটনে সর্বজন ও সর্বমহলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে অকল্পনীয় জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। ইলমে ফিকহের হলো কুরআন-হাদিস, কুরআন-হাদিসের গভীর জ্ঞান অর্জন ব্যতিত ফিকহের ইমাম হতে পারেন না কখনো। কাজেই ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলায়হি ফিকহ শাস্ত্রের অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী স্বীকৃতিই প্রমাণ করে হাদিস শাস্ত্রে তাঁর ব্যুৎপত্তি রয়েছে বিষ্ময়কর। প্রশংসামূলক বাক্য ইমাম আযমের শানে তুলে ধরার প্রয়োজন মনে করি না, কারণ এমন ব্যক্তিত্বের গুনাগুণ ও স্তুতি করার মানে সূর্যকে দলিল দিয়ে প্রমাণ করা। তারপরও অভিযোগ ও বিভ্রান্তি নিরসন কল্পে ইতিহাস সংরক্ষিত যুগশ্রেষ্ঠ ইসলামি স্কলারগণের অগনিত বাণী থেকে কিছুটা সংক্ষেপে আলোকপাত করার চেষ্টা করব, যাতে সহজে উপলদ্ধি হবে যে, ইমাম আযম ছিলেন অতুলনীয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী শ্রেষ্ঠ হাদিস বিশারদ।

ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন রহমাতুল্লাহি আলায়হির অভিমত
হাদিস বিশারদগণের সুবিজ্ঞ শ্রেষ্ঠ পর্যবেক্ষক, শ্রেষ্ঠ নিরীক্ষক বিখ্যাত ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলায়হি হাদিস শাস্ত্রে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি আরও ব্যক্ত করেন যে, আমি ইয়াহইয়া ইবনে সাঈফ আল কাত্তানকে বলতে শুনেছি, আমরা ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলায়হি এর অধিকাংশ মহামতের উপর আমল করি। ইমাম ইবনে মাঈনকে প্রশ্ন করা হলে উত্তরে বলেন, ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন নির্ভরযোগ্য। ইমাম আযম সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলায়হি নির্ভরযোগ্য রাবী ছিলেন, তিনি মুখস্থ বিহীন হাদিস বর্ণনা করতেন না। ইমাম ইবনে মাঈন রহমাতুল্লাহি আলায়হি সম্পর্কে ইমাম ইজলী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বর্ণনা করেন, আল্লাহ তায়ালা হাদিস শাস্ত্রে ইবনে মাঈন রহমাতুল্লাহি আলায়হি থেকে বড় কোন ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি করেননি। ইমাম ইবনে মাঈন রহমাতুল্লাহি আলায়হি থেকে অপর বর্ণনায় রয়েছে, আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলায়হি হাদিস শাস্ত্রে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও সর্বাপেক্ষা সত্যবাদী এবং ধর্মীয় সকল ক্ষেত্রে ছিলেন আস্থাবাজন।

মাক্কী ইবনে ইব্রাহিম রহমাতুল্লাহি আলায়হির অভিমত
মাক্কী ইবনে ইব্রাহিম ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলায়হি এর এমন ওস্তাদ যাঁর সনদেই ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলায়হি অধিকাংশ সুলাসিয়্যাত বর্ণনা করেন। ইমাম আযম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলায়হি এর সম্পর্কে এই বরেণ্য ইমাম মন্তব্য পেশ করেন, ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলায়হি স্বীয় যুগে শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন। উল্লেখ্য, তৎকালীন সময়ে ইলম বলতে কুরআন হাদিসের জ্ঞান বিবেচিত হত। কাজেই মাক্কী ইবনে ইব্রাহিমের বিবৃতি দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ইমাম আযম তাঁর যুগে কুরআন হাদিসের জ্ঞানে সবার শীর্ষে ছিলেন।

আলী ইবনে মাদিনী রহমাতুল্লাহি আলায়হির অভিমত
ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ’র উস্তাদ আলী ইবনে মাদিনী থেকে ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বুখারী শরীফে এত বেশি পরিমাণ হাদিস উল্লেখ করেছেন যার ফলে অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন, ইমাম বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে আলী ইবনে মাদিনীর হাদিস দ্বারা পূর্ণ করেছেন। ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রকাশ্যে বলতেন, আমি এই ওস্তাদের সম্মুখে নিজেকে খুবই ছোট মনে করতাম। ইমাম নাসায়ী গর্ব করে বলতেন এই প্রখ্যাত ইমামকে ইলমে হাদিসের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। ইমাম আযম এর শানে আলী ইবনে মাদিনীর উক্তি হল ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলায়হি থেকে ইমাম সাওরী ও ইবনুল মোবারক হাদিস বর্ণনা করেছেন এবং তিনি নির্ভরযোগ্য, তাঁর থেকে হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা নেই।

ইমাম শুবা রহমাতুল্লাহি আলায়হির অভিমত
হাদিস জগতের শীর্ষ ইমাম হযরত শুবা রহমাতুল্লাহি আলায়হি ইমাম আযমের ব্যাপারে এভাবে মতামত ব্যক্ত করেন যে, আল্লাহর কসম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলায়হি উত্তম বোধশক্তি ও প্রখর ধীশক্তির অধিকারী। ইমাম আযমের ইন্তেকালের সংবাদ শুনে মনের অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, কুফা নগরী ইলম শুন্য হয়ে গেল। তাঁর সমপর্যায়ের কোন আলেম তারা আর দেখবেনা। ইমাম আযমের প্রশংসায় দীপ্তমান ইমাম শুবা রহমাতুল্লাহি আলায়হি এর অবস্থান তুলে ধরে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমাতুল্লাহি আলায়হি বর্ণনা করেন, তিনি হাদিস গবেষকদের মধ্যে জাতীয় প্রতীক।

ইমাম আমাশ রহমাতুল্লাহি আলায়হির অভিমত
হাদিস জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র, বিশ্ব বরেণ্য মুহাদ্দিস ইমাম আযমকে হাদিসের প্রকৃত সর্বোচ্চ গবেষকের সার্টিফিকেট দান করত: অভিপ্রায় পেশ করেন যে, সত্যিই তোমরা ডাক্তার আমরা ওষুদ বিক্রেতা। অর্থাৎ বিজ্ঞ ডাক্তাররা জানেন কোন ঔষুধ কোন রোগের অনুরূপ, তোমরা জান কোন হাদীসের কোন বিধান রয়েছে। আমরা যারা নিছক হাদিস বর্ণনাকরী তারা ঔষধ বিক্রেতার মত। তারা যেমন জানেনা কোন ঔষধে কোন রোগটি ভাল হয়, আমরাও জানিনা কোন হাদিস আমল যোগ্য আর কোনটি আমল যোগ্য নয়।

ইমাম আবু ইউসুফ রহমাতুল্লাহি আলায়হির মন্তব্য
ইমাম ইবনে হাযর হায়তামী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তদ্বীয় কিতাবে উল্লেখ করেন, শরিয়তের কোন মাসআলা বা বিধান নিয়ে ইমাম আযমের সাথে আমার ভিন্নমত হলে গভীর গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত ও স্পষ্ট হত পরকালীন জীবনে মুক্তিদাতা তাঁর মতামত তথা মাযহাব। হাদিসের প্রতি অধিক জ্ঞান ছিল আমার চেয়েও বেশি ইমাম আযমের। ইমাম আবু ইউসুফ রহমাতুল্লাহি আলায়হি আরও ব্যক্ত করেন, শরিয়তের কোন বিষয়ে তিনি যখন সিদ্ধান্ত দিতেন কুফার শায়খদের নিকট এর স্বপক্ষে কোন হাদিস আছে কিনা এ উদ্দেশ্যে আমি তাঁদের নিকট গমন করতাম এবং অনেক সময় এ সংক্রান্ত দুই-তিনটা হাদিস পেয়ে যেতাম। অনুসন্ধানকৃত হাদিস নিয়ে ইমাম আযমের নিকট গেলে তিনি বলতেন, এই হাদিস সহীহ নয় অথবা বলতেন প্রসিদ্ধ নয়, তখন আমি আরয করতাম এটা আপনি কিভাবে জানেন অথচ এই হাদিসতো আপনার ফতওয়ার অনুকুলে। সেই সময় ইমাম আযম কেতাবী ঢঙে বলেন, কুফাবাসীদের ইলমে আমি আলেম হয়েছি। [আল খায়রাতুল হিসান, পৃ: ১৪৩।]
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে প্রদীপ্ত সূর্যরশ্নির মতো স্পষ্ট যে হাদিসশাস্ত্রে ইমাম আযম অনন্য শ্রেষ্ঠ। কেননা ইমাম আবু ইউসুফ রহমাতুল্লাহি আলায়হি হলেন হাফিযুল হাদিস, যা ইমাম যাহাবীর কলমেও প্রকাশ পেয়েছে। হাফিযুল হাদিস ইমাম আবু ইউসুফ রহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রত্যয়দ্বীপ্তে স্বীকার করেছেন ইমাম আযম অনেক বেশি হাদিস জানতেন উনার চেয়ে, এমনকি ইমাম আযমের হাদিস জ্ঞানের ব্যপ্তি এত বেশি, যা ইমাম আবু ইউসুফের ধারনার বাহিরে। কাজেই হাদিস শাস্ত্রে ইমাম আযম ছিলেন পাকা জহুরি। লা-মাযহাবীরা ইমাম আযম সম্বন্ধে জানার কী সাধ্য আছে! ওরাতো চোখে শরষে ফুল দেখছে।

সম্মানিত পাঠক! এমনি করে আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক, ইমাম আবু দাউদ, ইমামাইল ইবনে ইউনুস, ইমাম শাফেয়ী ইবনে আদম, হাসনা ইবনে সালেহ প্রমুখ প্রথিতযশা ইমামগণ ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলায়হি কে হাদিসের ক্ষেত্রে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত এবং হাদিস, ফিকহের অনুপম যোগ্যতার অধিকারী বলেছেন। বলেছেন ইমাম আযম বিষ্ময়কর স্মরণশক্তির অধিকারী আস্থাভাজন ন্যায় নিষ্ঠাবান হাদিস নিরীক্ষক মুজতাহিদগণের ইমাম এবং যুগশ্রেষ্ঠ বরেণ্য মুহাদ্দিস। উল্লেখিত ইমামগণ ছিলেন ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলায়হি এর সমকালীন বা নিকটবর্তী যুগের। কাজেই তাঁদের অভিমত ও মন্তব্য সর্বাপেক্ষা গৃহীত ও নির্ভরযোগ্য।

উল্লিখিত বিজ্ঞ ইমামগণের বাস্তব অভিজ্ঞতাপূর্ণ অভিমতের বিপরীতে ইমাম আযম ও তার মাযহাব নিয়ে বর্তমানে লা-মাযহাবী তথাকথিত আহলে হাদিস সম্প্রদায়ের অভিযোগ নিছক ভিত্তিহীন, অবান্তরই শুধু নয় বরং জঘন্যতম ন্যাক্কারজনক, সাংঘাতিক বিদ্বেষপূর্ণ ও নোংরামি অপকর্ম এবং পাগলের প্রলাপ মাত্র। বলা বাহুল্য দুষ্ট ও বিদ্বেষীদের চক্রান্ত এবং মনগড়া অভিযোগ থেকে নবী রাসুল এবং সাহাবীগণও মুক্ত ছিলেননা। এমনি করে ইমাম যুহলী ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলায়হি কে মুতাযিলা ও কাফির আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু এসকল কুরুচিপূর্ণ ও ভদ্রতাবর্জিত বেঁফাস মন্তব্য দ্বারা ইমাম বুখারীর যেমন মানহানী হয়নি তেমনিকরে ইমাম আযমেরও কোন ক্ষতি হয়নি। ক্ষতি হচ্ছে মুসলিম মিল্লাতের ঈমান ও আমলের। অতএব মাযহাব বিরোধী চক্র থেকে দূরত্ব বজায় রাখা দ্বীনের জন্য নিরাপদ।

লেখক: প্রধান ফকিহ, কাদেরিয়া তৈয়্যেবিয়া আলিয়া কামিল মাদ্রাসা, ঢাকা।

Share:

Leave Your Comment