হাদীস শরীফের আলোকে সাদ্‌ক্বাহ

হাদীস শরীফের আলোকে সাদ্‌ক্বাহ

= সাদ্‌ক্বাহঃ হাদীসের আলোকে =

১.সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- হুযূর রাসূলে মাক্ববূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমাচ্ছেন, মানুষ ‘আমার সম্পদ’ ‘আমার সম্পদ’ বলে চিৎকার করে; অথচ তার নিজের সম্পদ বলতে সেগুলোই বুঝায় যেগুলো থেকে সে তিন প্রকারে উপকৃত হয়ঃ

এক. খেয়ে-দেয়ে যা শেষ করে, দুই. পরিধান করে যা পুরোনো করে এবং তিন. আল্লাহর পথে দান করে যা সঞ্চয় করে। বাকী যা ছেড়ে সে মৃত্যুবরণ করে তাতো অন্যের হয়ে যায়।

২. বুখারী ও নাসায়ী শরীফে হযরত ইবনে মাস’ঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর বর্ণনা, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান- তোমাদের মাঝে নিজের মালের চাইতেও ওয়ারিশদের মাল বেশী পছন্দ করে এমন কে আছো? সবাই আরয করলেন, এয়া রাসূলাল্লাহ! সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়কা ওয়াসাল্লাম, এমন বোকা কে হবে, যে নিজের মাল পছন্দ করবে না? রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘দেখ- নিজের মালতো ওটাই, যেগুলো আল্লাহর পথে ব্যয় করেছো। আর যা রয়ে গেছে তাতো ওয়ারিশদের সম্পদ।’

৩. প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ পেলেও আমি চাইনা তা তিনটি রজনী পর্যন্তও আমার কাছে থাকুক। কর্জ শোধ করার ব্যবস্থা ছাড়া কোন সম্পদই আমার কাছে পছন্দনীয় নয়।

৪.রোজই প্রত্যুষে দু’জন ফিরিশ্‌তা দানবীরের পক্ষে আর কৃপণের বিপক্ষে দো’আ করতে অবতীর্ণ হয়। একজন বলে, ‘‘হে আল্লাহ! তোমার দানশীল বান্দাকে প্রতিদান দাও।’’ আর অন্যজন বলে, ‘‘কৃপণের মাল ধ্বংস করে দাও।’’

৫.হযরত আসমা বিন্‌তে আবী বকরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘সাধ্যমত হিসেব না করেই আল্লাহর পথে ব্যয় করে ‘‘যাও! ফলে আল্লাহ পাকও তোমাকে বে-হিসাব দান করতে থাকবেন।’’

৬.হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান, হে আদম সন্তানরা! তোমরা আমার পথে সাদক্বাহ করে যাও, আমি তোমাদের জন্য খরচ করে যাব।’’ সাদক্বাহর বদৌলতে আল্লাহ তা’আলা বান্দাকে কীভাবে সাহায্য করে থাকবেন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিম্নলিখিত হাদীস শরীফ থেকে এর একটি সুন্দর উপমা প্রত্যক্ষ করুন-

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ফরমাচ্ছেন- একদা এক ব্যক্তি জঙ্গলে ঘুরছিল। হঠাৎ করে আকাশে এক টুকরো কালো মেঘ দেখতে পেলো। আর কে যেন ওই মেঘের টুকরোকে মেঘের মধ্যে থেকেই বলছিল, যাও ওদিকে অমুক ব্যক্তির বাগানটি সিক্ত করে দাও।’’ মেঘটি ওদিকে পরিচালিত হলো। দেখতে দেখতে এক পাথুরে উচুঁ ভূমিতে গিয়ে বৃষ্টি বর্ষণ করলো। সেখানকার ছোট ছোট নালা দিয়ে পানিগুলো একটি বড় নালায় এসে জমা হয়ে এক দিকে নামতে লাগলো এবং একটি ফসলের বাগনের দিকে ধাবিত হলো। দেখতে পেলেন একজন শ্মশ্রুমণ্ডিত মানুষ ওই পানি কোদাল দিয়ে ক্ষেতের মধ্যে এদিক ওদিক ফিরিয়ে দিচ্ছেন। লোকটি গিয়ে তাঁর কাছে নাম জানতে চাইলেন। লোকটির নাম শুনে তিনি আর্শ্চাযন্বিত হলেন. কারণ মেঘে উচ্চারিত সে নামের লোকটিই ইনি! বাগানের মালিক নাম জিজ্ঞেস করার কারণ জানতে চাইলেন। লোকটি সব কথা খুলে বললেন এবং জানতে চাইলেন, ভাই এমন কী কাজ আপনি করেন যার বদৌলগ্ধত আল্লাহর এভাবে গায়বী সাহায্য পান। বাগানের মালিক বললেন, তাহলে শুনুন! আমি এ বাগানে উৎপাদিত ফসলের এক তৃতীয়াংশ প্রথমে সাদ্‌ক্বাহ করে দেই। বাকীটুকু থেকে অর্ধেক খাওয়ার জন্যে এবং অর্ধেক বীজ হিসেবে পুনরায় যমীনে বপন করি।’’ প্রতীয়মান হলো সাদক্বাহ দ্বারা গায়বী সাহায্য পাওয়া যায়।

৭.   হযরত আবূ যর গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, একদিন আল্লাহর প্রিয়তম রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কা’বা-ই মু’আয্‌যামার ছায়ায় বসে এরশাদ করলেন, ‘‘এ পবিত্র কা’বার রবের ক্বসম, ওরা বড়ই ক্ষতিগ্রস্ত!’’ আমি বিনীতভাবে আরয করলাম, ‘‘হে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়কা ওয়াসাল্লাম! আমার মা-বাবা আপনার পদতলে উৎসর্গীত। দয়া করে বলুন এ ক্ষতিগ্রস্ত লোক কারা?’’ প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘ওরা ধনাঢ্য শ্রেণীর লোক। অবশ্য যদি এভাবে-সেভাবে, অর্থাৎ ডানে-বামে, সামনে-পেছনে,এতিম-মিসকীন,আত্মীয়- স্বজন যখন যেখানে থাকে প্রয়োজনে দান-সদক্বা করে যায়, তাহলে ক্ষতির হাত থেকে তারাই বাঁচবে। তবে এ ধনীর সংখ্যা খুবই নগণ্য।’’

আসুন, প্রিয়তম রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অমীয় নূরানী বাণী থেকে কয়েকজন ধনাঢ্য ব্যক্তি সম্পর্কে অতি আকর্ষণীয় কাহিনী আলোচনা করি। যেখানে বখীল তথা কৃপণ লোকের করুণ পরিণতি এবং দানশীল ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ পাকের মহা পুরস্কারের বিবরণ দেওয়া হয়েছে।

৮.   বোখারী ও মুসলিম শরীফে প্রখ্যাত সাহাবী হযরত সাইয়্যেদুনা আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত আছে, হুযূরে আকরাম নূরে মুজাস্‌সাম গায়বের সংবাদদাতা নবীয়ে মু’আয্‌যম এরশাদ ফরমাচ্ছেন-

বনী ইসরাঈলের তিনজন লোক ছিলো। একজন কুষ্ঠ রোগী, অপরজন টেকো মাথা এবং অন্যজন অন্ধ। আল্লাহ পাক চাইলেন তাদের পরীক্ষা নিতে। একজন ফিরিশতা পাঠিয়ে দিলেন। ফিরিশতা সর্বপ্রথম কুষ্ঠ রোগীর নিকট আসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা বলতো তুমি কোন জিনিসটা বেশী পছন্দ করো? সে বললো, ‘‘দেখুন, একে তো আমি গরীব। তদুপরি আমার কুষ্ঠরোগ। এ খসখসে চামড়া আর অসুন্দর রূপটির জন্যে কেউই আমাকে ভালবাসে না, সবাই ঘৃণা করে। তাই একটা সুন্দর চামড়া আর সুস্থ দেহই আমার কাম্য।’’ ফিরিশতাটি তাকে হাত বুলিয়ে দিলেন। সাথে সাথে তার কুষ্ঠ রোগ চলে গেলো। সে পেল এক আকর্ষণীয় চামড়া বিশিষ্ট সুস্থ শরীর। অতঃপর ফিরিশতা জানতে চাইলেন, ‘‘তুমি কোন ধরনের সম্পদ চাও?’’ সে বললো, ‘‘আমি উটের মালিক হতে চাই।’’ ফিরিশতা তাকে একটা দশ মাসের পূর্ণ গর্ভবর্তী উষ্ট্রী দান করলেন এবং দো’আ করলেন-আল্লাহ পাক তোমার এ সম্পদে বরকত দান করুন!শশ

এরপর আল্লাহ্‌র হুকুমে ফিরিশতাটি টেকো মাথার নিকট গেলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন- বলতো তোমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কি? সে বললো, ‘‘কী আর চাইবো? গরীবতো আছিই, তদুপরি মাথায় টাক্‌। সবাই ঘৃণা করে। লোকলজ্জায় কারো সামনে যেতে পারি না। তাই মাথাভরা সুন্দর চুল হোক-এটাই চাই।’’ ফিরিশতা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আকর্ষণীয় চুলে তার মাথা ভরে গেল। ফিরিশতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কোন ধরনের সম্পদ তোমার বেশী ভাল লাগে?’’ সে বললো, ‘‘আমার কাছে গাভী খুবই পছন্দনীয়।’’ ফিরিশতা তাকে একটা পূর্ণ গর্ভবতী গাভী দিয়ে দো’আ করলেন, ‘‘আল্লাহ তোমার সম্পদে অনেক বরকত দিন।’’ এই বলে ফিরিশতা চলে গেলেন।

প্রিয় নবী বলেন, ফিরিশতাটি এবার আল্লাহর হুকুমে গেলেন অন্ধ লোকটির কাছে। জিজ্ঞেস করলেন- বলতো, তোমার কাছে জীবনে সবচেয়ে পছন্দের জিনিষ কোনটি? সে বললো, কী আর পছন্দের হবে? দু’টি চোখ না থাকায় এ সুন্দর পৃথিবীতে আল্লাহর সৃষ্টির কিছুইতো দেখতে পাই না। তাই, এ দুটো নয়ন ছাড়া আর কিছুই কাম্য নয়।’’ ফিরিশতাটি তার চোখে হাত বুলিয়ে দিতেই চোখ সুস্থ হয়ে গেলো। সে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলো। ফিরিশতা বললেন, তোমার কাছে কোন ধরনের সম্পদ ভাল লাগে?’’ সে বললো, ‘‘ছাগল।’’ ফিরিশতা তাকে খুব অল্প সময়ে বাচ্চা দেবে এমনটি একটি গর্ভবর্তী ছাগী দিলেন এবং দো’আ করলেন, ‘‘আল্লাহ তোমার সম্পদে বরকত দিন।’’

রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান, ফিরিশতা চলে গেলেন, আর এদিকে ওদের উল্ক্রী, গাভী আর ছাগী বাচ্চা দিলো। আল্লাহ তা’আলা এদের এ সমস্ত সম্পদে এমন প্রাচুর্য এবং বরকত দান করলেন যে, মাত্র কয়েক বছরে তাদের প্রত্যেকের নিকট যথাক্রমে উট, গরুত এবং ছাগলে বিরাট বিরাট মাঠ ভর্তি হয়ে গেলো।

অনেক দিন পর আল্লাহর হুকুমে ফিরিশতাটি নিজেই ওই কুষ্ঠরোগীর দুয়ারে এসে দাঁড়ালেন। হাঁক মারলেন- ভাই একজন মিসকীন, মুসাফির, সফরে দেশে ফিরে যাওয়ারও উপায় নেই। এখন তোমার সাহায্য ছাড়া কোন রাস্তা দেখছি না। আমি তোমার কাছে ওই সত্তার দোহাই দিয়ে চাচ্ছি, যিনি তোমাকে কুষ্ঠরোগ থেকে মুক্তি দিয়ে এ সুন্দর রং, উত্তম চামড়া আর অঢেল সম্পদের মালিক করেছেন। আমাকে একটি উট দাও, যেটার উপর সৎওয়ার হয়ে আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারি।’’ সে জবাবে বললো, ‘‘দিতে পারবো না।’’ ফিরিশতা বললেন, ‘‘তোমাকে তো চেনা চেনা মনে হচ্ছে। তুমি তো কুষ্ঠরোগী ছিলে? মানুষ তোমায় ঘৃণা করতো আল্লাহ তোমায় সুস্থতা দিয়েছেন। তুমি নিঃস্ব দরিদ্র ছিলে, আল্লাহ তোমাকে সম্পদ দিয়েছেন।’’ সে বলল, ‘‘এ সব কী বলছো? আমি তেমনটি কখনও ছিলাম না। আমি বংশ পরস্পরায় মালদার হয়েছি।’’ মানব আকৃতিতে আসা ফিরিশতাটি বললেন, ‘‘দেখ! তুমি যদি মিথ্যে বলে থাকো তাহলে আল্লাহ তোমাকে তোমার পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দিন।’’ এরপর ফিরিশতাটি টাক্‌ ওয়ালার কাছে আসলেন এবং কুষ্ঠরোগীর কাছে যেভাবে সাওয়াল করেছিলেন সেভাবে তার কাছেও সাওয়াল পেশ করলেন। সেও একই জবাব দিলো। ফলে ফিরিশতা তাকেও বদদো’আ দিয়ে চলে গেলেন।

রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান, অতঃপর ফিরিশতাটি শেষোক্ত অন্ধ ব্যক্তিটির নিকট তাশরীফ আনলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে হাঁক মেরে বললেন, ‘‘ভাই, একজন মিসকীন, মুসাফির। সর্বহারা হয়ে আপনার দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছি। সাহায্যের প্রার্থনা করছি ওই সত্তার ওসীলায়, যিনি আপনাকে দু’টি চোখে আলো দান করেছেন, আপনাকে অসংখ্য ছাগল দিয়ে সম্পদশালী করেছেন। আপনার সাহায্য ছাড়া উপায় দেখছি না। আপনি আমাকে একটা ছাগল দান করুন, যেন আমার গন্তব্যে পৌঁছার সহায় হয়।’’ লোকটি বলল, ‘‘হ্যাঁ ভাই, সত্যি আমি অন্ধ ছিলাম। আল্লাহ তা’আলা আমাকে চোখের জ্যোতি আর সম্পদ দিয়ে ধন্য করেছেন। আপনি ওই আল্লাহর নামে যত চান নিয়ে যান। আমি আপনাকে বাধা দেবো না।’’ ফিরিশতা বললেন, ‘‘হ্যাঁ ভাই, আল্লাহ তা’’আলারই সকল প্রশংসা। আমি ফিরিশতা। আল্লাহর হুকুমে এসেছিলাম। তোমরা তিনজনকেই পরীক্ষা করা হয়েছে। তোমার দু’সঙ্গী কুষ্ঠরোগী এবং টাক্‌ ওয়ালা নিজেদের আসল কথা ভুলে গিয়ে কৃপণতা করে পরীক্ষায় হেরে গেছে। পক্ষান্তরে, তুমি তোমার পূর্বের কথা ও প্রকৃত ঘটনা এবং আল্লাহর করুণা মনে রেখেছো। সাথে সাথে এ দান করে কামিয়াব হয়েছো এবং নিজের জান-মালকে হেফাযত করেছো। আল্লাহ তোমার প্রতি সন্তুষ্ট এবং তাদের উপর নারায হয়েছেন।’’

৯. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান, তোমরা নিরলসভাবে সাদক্বাহ করে যাও। কারণ সাদক্বাহকে অতিক্রম করে কোন বালা-মুসিবত আসতে পারে না।

১০. সহীহ তিরমীযি শরীফে সাইয়েদুনা হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত আছে, হুযূর নবী-ই দোজাহাঁ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমাচ্ছেন, আল্লাহ তা’আলা এ যমীন সৃষ্টি করার পর সেটা হেলতে-দুলতে লাগলো। তখন বিরাট-বিশাল পর্বতমালা সৃষ্টি করে এতে প্রতিস্থাপন করলে যমীন স্থির হয়ে যায়। ফিরিশতারা আশ্চর্যান্বিত হয়ে আরয করল, ‘‘হে আল্লাহ! মনে হয় তোমার সৃষ্টিকুলে পাহাড়ই সর্বাধিক শক্তিমান। খোদা! তুমি কি পাহাড়ের চেয়েও শক্তিশালী কিছু সৃষ্টি করেছো?’’ আল্লাহ তা’আলা বললেন, ‘‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। পাহাড়ের চাইতেও শক্তিশালী করেছি লোহাকে।’’ ফিরিশতারা বললো, ‘‘লোহার চেয়ে অধিক শক্তিমান সৃষ্টিও কি আছে?’’ আল্লাহ্‌ তা’আলা বললেন, ‘‘হ্যাঁ আছে- তা হচ্ছে আগুন।’’ ফিরিশতারা বললো, ‘‘আগুনের চাইতেও শক্তিমান কিছু আছে কি?’’ আল্লাহ পাক বললেন, ‘‘অবশ্যই আমার সৃষ্টিতে আগুনের চাইতেও শক্তিশালী হচ্ছে পানি।’’ তখন ফিরিশতারা বললো,  ‘‘তা হলে কি পানিই সর্বাধিক শক্তিধর? আল্লাহ বললেন, ‘‘অবশ্যই নয়। পানির চাইতে অধিক শক্তিমান করে সৃষ্টি করেছি বাতাসকে।’’ তারা বললো, ‘‘নিশ্চয় বাতাসই কি সৃষ্টি জগতে সবচেয়ে অধিক শক্তিশালী সৃষ্টি?’’ আল্লাহ পাক বললেন, ‘‘দেখো! বাতাসের চাইতেও শক্তিধর একটি বস্তু রয়েছে আমার জগতে।’’ ফিরিশতারা তা’আজ্জব হয়ে জানতে চাইলো,  ‘‘হে আল্লাহ! ওটা কোন্‌ বস্তু? যা পাহাড়, লোহা, আগুন, পানি ও বাতাসকে অতিক্রম করেছে শক্তি ও সামর্থ্যে’’ আল্লাহ তাজ্ঞআলা বললেন, ‘‘হ্যাঁ সে মহাশক্তিধর বস্তুটি হচ্ছে ঈমানদারের রিয়ামুক্ত গোপন সদ্‌ক্বাহ।’’

১১. পবিত্র ক্বোরআনে হাকীমে রয়েছে, আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ‘‘তোমাদের নিকট যা আছে সেটা নিঃশেষ হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে যা আল্লাহর নিকট রাখবে তা-ই হবে চিরস্থায়ী।’’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রিয় নবীর একটি জীবন্ত শিক্ষা প্রত্যক্ষ করুন- উম্মুল মু’মেনীন হযরত সাইয়্যেদাতুনা আয়েশা সিদ্দীক্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা বলেন, ‘‘একদা আহলে বায়তে রাসূল একটা ছাগল যবেহ করে। সবাই ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়ার পূর্বে সেখানে ফক্বীর-মিসকীনরা এসে জড়ো হলো। কাউকে ‘না’ বলার দজ্ঞৈর আহলে বায়তে পাকের তো পূর্ব থেকেই ছিল না। ফক্বীর-মিসকীন-এতিমদের তা থেকে তাঁরা যথা নিয়মে দান করছিলেন। ইত্যবসরে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাশরীফ আনলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ছাগলের কিছু বাকী আছে? আরয করা হলো, এয়া রাসুলাল্লাহ! কেবল কাঁধের একটি টুকরো বাকী আছে, ‘‘সব শেষ হয়ে গেছে।’’ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন- ‘‘বরং বলো-এ একটি টুকরো ছাড়া সব বাকী আছে।’’ (কারণ সেগুলোতো আল্লাহর নিকটেই জমা দেয়া হয়েছে)।

১২.যাকাত-ফিতরায় ধন বা নিসাবের মালিক হতে হয়; কিন্তু সাদক্বাহ্‌র জন্যে ‘মনের’ মালিক হলেই চলে। প্রিয় নবী বলেন, প্রত্যেক মুসলমানই সাদক্বাহ করতে পারে। হযরত আন~ মূসা আশ‘আরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, সাহাবীরা আরয করলেন, এয়া রাসূলাল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়কা ওয়াসাল্লাম! যদি সাদক্বাহ করার মতো কিছু না পায়?’’ রাসূলে পাক বললেন, কেন? গতর খেটে মযদূরী করে উপার্জন করবে। এতে নিজেরও আয় হবে, সাদক্বাহও করতে পারবে।শশ আরয করা হলো, যদি কাজের সামর্থ্য না থাকে?’’ এরশাদ করলেন, একটা ভাল কাজ বাতিলয়ে দেবে। বলা হলো, এয়া রাসুলাল্লাহ, সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, এটাও করলো না বা সুযোগ হলো না, তখন? প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, অন্ততঃ নিজে অন্যায় থেকে বিরত থাকবে। এতে তার জন্য পাপ থেকে বাঁচার সাওয়াবও হবে, সাদক্বাহর পুণ্যও পেয়ে যাবে।[বুখারী, মুসলিম ও মিশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা- ১৬৭]

১৩. এক মহিলা সাহাবী হযরত উম্মে বুজায়দ আরয করলেন, ‘‘এয়া রাসূলাল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়কা ওয়াসাল্লাম)! ঘরের দরজায় ফক্বীর-মিসকীন দাঁড়িয়ে হাঁক মারে. লজ্জা লাগে. কারণ উপযুক্ত কিছু পাই না বলে দিতে পারি না।’’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, ‘‘লজ্জা কিসের? কিছু নিশ্চয়ই দাও। বেশী কিছু না পারলে ছাগলের ক্ষুর-পায়ার মত ক্ষুদ্র জিনিস হলেও দান করে সাদক্বাহর সাওয়াব অর্জনে সচেষ্ট হও।’’  [আহমদ, আবু দাউদ, তিরমিযী, মিশকাত শরীফ-বাবুল ইনফাক্ব, পৃষ্ঠা- ১৬৬]

১৪. বুখারী ও মুসলিম শরীফে রয়েছে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ফরমাচ্ছেন, ‘‘দু’জন মানুষের মাঝে ন্যায় বিচার করে দেয়া সাদ্‌ক্বাহ, কোন দূর্বল মানুষকে বাহন বা গাড়ীতে উঠিয়ে দেয়া, তার মাল-সামগ্রী উঠিয়ে দেয়া সাদক্বাহ, একটু হাসিমুখে ভাল একটি কথা বলাও সাদক্বাহ, নামাযের দিকে যেতে প্রতিটি ক্বদমে একেকটি সাদক্বাহ এবং চলার পথ থেকে কষ্টদায়ক কাঁটা, পাথর ইত্যাদি সরিয়ে রাস্তাকে নিরাপদ করাও সাদ্‌ক্বাহ।’’        [বুখারী, মুসলিম, মিশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা-১৬৭]

১৫. তিরমীযী শরীফে হযরত আবূ যার গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘ভাইয়ের সামনে হাসি মুখে যাওয়া, ভাল কাজের আদেশ করা, মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখা, পথহারা মানুষকে পথ বাতলিয়ে দেয়া, চোখে কম দেখে এমন লোককে সাহায্য করা, চলার পথ থেকে কাঁটা সরিয়ে ফেলা, যার কাছে পানি নেই তাকে পানি দেয়া-এগুলো সবই সাদক্বাহ।’’[মিশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা- ১৬৯]

১৬. প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান- ‘‘ঈমানদার কোন গাছ লাগিয়েছে কিংবা ক্ষেত করেছে আর সে গাছের ছায়ায় বসে কেউ আরাম করলো বা তার ফলমূল মানুষ, পশু-পাখীরা খেলো, এভাবে তার ক্ষেতের ফসল থেকে পশু-পাখীরা বা ক্ষুধার্ত মানুষ যা কিছু খেলো সবই সাদক্বাহ হিসেবে গণ্য হবে এবং সাওয়াবের ভাগী হবে।’’ [বুখারী, মুসলিম, মিশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা-১৬৮]

১৭. হাদীস শরীফে এসেছে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘কোন বস্ত্রহীন মানুষকে কাপড় দাও। তাহলে আল্লাহ তোমাকে বেহেশতে সবুজ পোশাক দান করবেন। যতক্ষণ তোমার দেয়া কাপড় তার শরীরে থাকবে তুমি আল্লাহর হেফাযতে থাকবে। তুমি ক্ষুধার্তকে অন্ন দাও, তৃঞ্চার্তকে পানি দাও, আল্লাহ তোমাকে জান্নাতের পানাহার দান করবেন।’’ [মিশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা-১৬৯]

১৮. রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান- সাদক্বাহ আল্লাহর গযবকে ঠাণ্ডা করে এবং অপমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচায়। [মিশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা-১৬৮]

১৯. হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমাচ্ছেন- ‘‘সাদক্বায় ইহকালীন-পরকালীন ছয়টি উপকারিতা রয়েছে ইহকালীন বা পার্থিব ৩টি হচ্ছে- ১. তার আয় ও রিয্‌ক্ব বৃদ্ধি পাবে, ২. সম্পদ বাড়বে, ৩. দেশ ও জনপদ আবাদ থাকবে। অন্যদিকে আখিরাতে ৩টি উপকার হচ্ছেঃ ১. সাদক্বাহ্‌র বদৌলতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখা হবে, ২. ক্বিয়ামতের দিন তার মাথায় ছায়া হবে এবং ৩. জাহান্নামের আযাব থেকে তাকে রক্ষা করবে।শশ

প্রখ্যাত তাবে’ঈ হযরত ইমাম মাকহূল রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, ‘‘ঈমানদার যখন সাদক্বাহ করে, তখন জাহান্নাম সাজদায় পড়ে আল্লাহর কাছে এ বলে শোকর আদায় করে, ‘‘হে আল্লাহ তুমি তোমার হাবীবের একজন উম্মতকে আমার থেকে মুক্তি দান করলে।’’ [নুযহাতুল মাজালিস, পৃষ্ঠা- ১৮৯]

২০. আল্লামা ইবনুল জাওযী তাঁর প্রণীত ‘আলমা-জেরিয়্যাত ফিল আস্‌ইলাতি ওয়াল জাওয়াবাত’ কিতাবে লিখেছেন- একবার উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা একজন দাসী ক্রয় করলেন. হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস্‌ সালাম এসে প্রিয় নবীকে বললেন, ‘‘এয়া রাসুলাল্লাহু (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়কা ওয়াসাল্লাম)! এ দাসীকে আপনার ঘর থেকে বের করে দিন, কারণ সে জাহান্নামী।’’ উম্মুল মু’মেনীন তাকে বের করে দিলেন। যাওয়ার সময় তাকে কিছু খেজুর দিলেন। দাসীটি যাওয়ার সময় রাস্তায় এক ফক্বীর দেখে তাকে অর্ধেক খেজুর সাদক্বাহ করে দিলো। এ দিকে হযরত জিব্রাইল আলায়হিস্‌ সালাম এসে রাসূলে পাককে বললেন, ‘হে আল্লাহ্‌র রাসূল (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)! আল্লাহ তা’আলা দাসীটি ফিরিয়ে আনতে বলেছেন। যেহেতু সে সাদক্বাহ করার দরুণ আল্লাহ তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দিয়েছেন।’’       [নুবহাতুল মাজালিস, পৃষ্ঠা- ১৮৯]

২১. ‘শরফুল মোস্তফা’ নামক কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে আল্লামা আবদুর রহমান সফূরী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ‘নুয্‌হাতুল মাজালিস’-এ লিখেছেন, একদিন আল্লাহ্‌র প্রিয়নবী আটটি দিরহাম নিয়ে জামা কিনতে বাজারের দিকে তাশরীফ নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে দেখতে পেলেন এক মহিলা বসে বসে কাঁদছে। এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। সে বললো, ‘পরিবারের জন্যে কিছু সওদা কিনতে দুট দিরহাম নিয়ে এসেছিলাম। দিরহাম দু’টি হারিয়ে গেছে।’’ নবী করীম তাকে দু’টি দিরহাম দান করে দিলেন। অতঃপর বাজৎরে গিয়ে চার দিরহামে একটি জামা নিয়ে ফিরছিলেন, পথে দেখতে পেলেন একজন লোক হাঁক মারছে, ‘‘কেউ আছেন আমাকে কাপড় দান করবেন? আল্লাহ আপনাকে জান্নাতী পোশাকে ভূষিত করবেন।’’ প্রিয় নবী তাকে জামাটা দিয়ে দিলেন। এবার বাজারে গিয়ে মাত্র দু’দিরহাম দিয়ে একটি ক্বামীস ক্রয় করলেন। আসার পথে দেখতে পেলেন একজন মহিলা (ক্রীতদাসী) রাস্তার ধারে বসে কাঁদছে। জানতে চাইলেন-কেন কাঁদছো? আরয করলো, ‘‘হুযূর, বিলম্বের কারণে মুনিব পক্ষ শাস্তি দিতে পারে- এই ভয়ে কাঁদছি।’’ নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘ঠিক আছে আমাকে নিয়ে চলো।শশ দাসীটি নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পেছনে পেছনে চললো। মালিকের বাড়ী গিয়ে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বাইরে থেকে সালাম জানিয়ে দরজায় কড়া নাড়লেন। একবার দু’বার. কোন জবাব এলো না। তৃতীয় বারে দরজা খোলা হলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন দরজা খুলতে দেরী করলে কেন? তারা বিনীতভাবে বললো, ‘‘এয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়কা ওয়াসাল্লাম), আপনার নূরানী বরকতমণ্ডিত চেহরা-ই পাকের দিদার পেয়ে নিজেদের ধন্য মনে করছিলাম।শশ নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দাসীকে ক্ষমা করে দিতে বললেন। তারা আরয করলো, ‘‘এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়কা ওয়াসাল্লাম, আপনারই জন্যে আমরা এ দাসীকে আযাদ করে দিলাম। প্রিয় নবী এ কথাটি বলতে বলতে ফিরে আসলেন, ‘‘এ আটটি দিরহাম কত বরকতময়! এর দ্বারা একজন দাসীকে আযাদ করলাম, একজনকে পরিবারের মন্দ কথা শোনা থেকে মুক্তি দিলাম এবং একজন বস্ত্রহীনকে কাপড় দিতে পারলাম.     [নুয্‌হাতুল মাজালিস, পৃষ্ঠা- ১৯০]

২২. হযরত মানসূর ইবনে আম্মার রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু একদিন সাদক্বাহ্‌র ফযীলতের উপর ওয়ায করছিলেন। এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললো, ‘‘হুযূর আমাকে চারটি দিরহাম সদক্বাহ দিন।’’ তিনি বললেন, ‘‘কেউ আছে, একে চার দিরহাম সদক্বাহ করবে, আমি তার জন্য চারটি দো’আ করব।’’

এক ইহুদীর একজন মুসলিম ক্রীতদাস হযরত মানসূর ইবনে আম্মারের মাহফিলে ছিলেন। বললেন, হুযূর আমি চার দিরহাম সদক্বাহ করছি। আমার জন্য চারটি দো’আ করুনঃ ১. আমি ক্রীতদাস, আমার মুক্তির জন্য দো’আ করুন। ২. আমি ফক্বীর, দো’আ করুন যেন আল্লাহ আমাকে সম্পদশালী করেন। ৩. আমি পাপী, আল্লাহ পাক আমায় যেন ক্ষমা করে দেন এবং ৪. দো’আ করুন যেন আমার মুনিব মুসলমান হয়ে যান। অতঃপর ঘরে আসলে মালিক জিজ্ঞেস করলেন, দেরী করলে কেন? তিনি বললেন, হুযূর, আমি হযরত মানসূর বিন আম্মার-এর মাহফিলে বসেছিলাম। চারটি দিরহাম সদক্বাহ করে তাঁকে দিয়ে চারটি দো’আ করিয়েছি। প্রথম দো’আ করেছেন- আল্লাহ যেন আমাকে আযাদ করে দেন। মালিক বললেন, যাও আমি তোমাকে আল্লাহর নামে আযাদ করে দিলাম। হুযূর, দ্বিতীয় দো’আ করেছেন আল্লাহ তা’আলা যেন আমাকে ধনী বানিয়ে দেন। মুনিব বললেন, নাও, আল্লাহর ওয়াস্তে আমি চারহাজার দিরহাম তোমাকে দান করলাম। লোকটি বললেন, হুযূর তৃতীয় দো’আ করিয়েছি আল্লাহ যেন আপনাকে ইসলাম দান করেন। ইহুদী মুনিব বললেন, তুমি সাক্ষী থাকো, ‘‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই, এও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর সাচ্চা রাসূল। অর্থাৎ আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম।’’ লোকটি বললেন, হুযূর চতুর্থত আমার গুনাহ মাফের জন্য দো’আ করিয়েছি। মুনিব বললেন, ‘‘দেখ এটা তো আমার ক্ষমতাধীন নয়।’’ সে রাতেই ওই মুনিব স্বপ্নে দেখলেন, আল্লাহ পাক বললেন, ‘‘হে আমার বান্দা! তুমি তোমার ক্ষমতায় যা আছে করেছো। বিনিময়ে আমি আমার দয়া ও ক্বুদরতে যা আছে তাই করছি। আমি তোমাকে, তোমার গোলামকে, ওই ওয়ায়েয এবং ওই মাহফিলে উপস্থিত সবাইকে ক্ষমা করে দিলাম।’’   [নুয্‌হাতুল মজালিস, পৃষ্ঠা- ১৯১]

২৩. হাকিম ও ত্বাবরানী আওসাত্ব গ্রন্থে হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমাচ্ছেন, এক লোক্বমা রুটি কিংবা এক মুষ্ঠি খেজুর অথবা এমন কোন বস্তু, যাদ্বারা একজন মিসকীনের উপকার হয়, এর ওসীলায় আল্লাহ তা’আলা তিনজনকে জান্নাত দান করেন। একজন গৃহকর্তা, যার নির্দেশে দেওয়া হয়, দ্বিতীয়জন স্ত্রী, যে এগুলো প্রস্তুত করে এবং তৃতীয়জন খাদিম, যে মিসকীনের হাতে দিয়ে আসে। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘শোকর ও প্রশংসা আল্লাহর জন্যে, যিনি আমাদের খাদিমদেরও বাদ দেন নি।’’

২৪. আল্লামা আবদুর রহমান সফূরী রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি ‘নুয্‌হাতুল মাজালিস’ গ্রন্থে লিখছেন- এক ব্যক্তি খোরাসান থেকে বসরায় এসে হযরত হাবীবে আজমী রাহমাতুল্লাহি আলায়হিকে দশ হাজার দিরহাম দিয়ে বললেন, ‘‘হুযূর, আমি হজ্বে যাচ্ছি। আপনি বসরা শহরে আমার জন্য একটি বাড়ী কিনে রাখবেন। যেন আমি ফিরে এসে ওই বাড়ীতে বসবাস করতে পারি।’’ এ দিকে বসরা ও খোরাসান এলাকায় মারাত্মক দূর্ভিক্ষ দেখা দিলো। হযরত হাবীবে আজমী ওই দশ হাজার দিরহামের আটা কিনে গরীব মিসকীনদের মধ্যে সদক্বাহ করে দিলেন। লোকেরা জানতে চাইলেন, হুযূর, উনি তো বাড়ী কিনতে বলেছিলেন, আর আপনি সদক্বাহ করে দিলেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি তার জন্যে বেহেস্তে বাড়ী কিনেছি। সে রাজী হলে ভাল; নয়তো টাকা ফিরিয়ে দেবো। লোকটি ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলেন- হুযূর বাড়ী কিনেছেন?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোমার জন্যে সুদৃশ্য বাগান আর স্রোতস্বিনীসহ বিশাল বাড়ী কিনেছি। লোকটি শুনে খুশী হলেন এবং বলেলেন হুযূর আমরা বাড়ীতে উঠতে চাই। তিনি বললেন, হ্যাঁ আমি বাড়ীটা আল্লাহর নিকট থেকে জান্নাতে ক্রয় করেছি। এতদ্বশ্রবণে তারা অত্যোধিক আনন্দিত হলো। ওই ব্যক্তির স্ত্রী বললো, হুযূরকে যিম্মাদার হয়ে বেহেস্তের ওই বাড়ীটির একটি আঙ্গিকারনামা লিখে দিতে বলুন। সাথে সাথে তিনি লিখে দিলেন, ‘‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, আমি এ অঙ্গিকারনামা দিচ্ছি যে, হাবীবে আজমী মহান আল্লাহর নিকট থেকে অমুকের ছেলে অমুকের জন্যে অসংখ্য নহর ও বাগান সহ বেহেশতের একটি বাড়ী কিনে রেখেছে, যা যথা সময়ে আল্লাহ তাঞ্চআলা হাবীবের পক্ষ থেকে পূরণ করবেন।’’

লোকটি সবাইকে ওসীয়ত করলেন, আমার ইনতিকালের পর হাবীবে আজমীর লিখাটি আমার কাফনের ভেতরে দিও। কিছুদিন পর লোকটির ওফাত হলো। দাফনের সময় কাফনের ভেতর যথারীতি কাগজখানা দেয়া হলো। পরদিন ভোরে তার কবরের উপর একখানা লিখিত কাগজ পাওয়া গেলো। ওখানে স্বর্ণাক্ষরে লিখা ছিলো- ‘‘হাবীব যে ঘর অমুকের জন্য আল্লাহর নিকট থেকে নিয়েছিলেন, জান্নাতের সে ঘরটি আল্লাহ তা’আলা তাকে দান করেছেন এবং হাবীবকে দায়মুক্ত করেছেন।’’ এ মাকতূব শরীফটি পেয়ে হযরত হাবীব আজমী এ বলে আনন্দে কেঁদে ফেললেন, আল্লাহ আমাকে দায়মুক্ত করেছেন এবং নিজ ওয়াদা পূরণ করেছেন।  [নুয্‌হাতুল মজালিস, পৃষ্ঠা-১৯১]

২৫. ত্বাবরানী ও বায়হাক্বী শরীফে হযরত হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, প্রিয় নবী এরশাদ ফরমাচ্ছেন! আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘‘হে আদম সন্তান! তোমার সঞ্চয় থেকে আমার কাছে কিছু জমা রাখো, ওটা পুড়ে যাবে না, ডুবে যাবে না এবং চুরিও হবে না। আমি তোমাকে এর পরিপূর্ণ প্রতিদান দেবো তখনই যখন এটা তোমার বড়ই প্রয়োজন হবে।’’

২৬. হযরত ঈসা আলায়হিস সালাম-এর যুগে এক ধোপা ছিলো। প্রায়শ সে মানুষের কাপড়-চোপড়গুলো ওলট-পালট করে ফেলতো। অনেক  চেষ্টা-তদবীর করেও এর কোন প্রতিকার করা গেলো না। সবাই মিলে সায়্যেদুনা হযরত ঈসা আলায়হিস সালাম-এর দরবারে অভিযোগ করলো। তিনি বললেন, ‘‘ঠিক আছে তোমরা চিন্তা করো না, আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দেবেন।’’ ধোপা প্রতি দিনকার ন্যায় কাপড়-চোপড় নিয়ে পুকুর ঘাটের দিকে বের হলো। তার সাথে তিনটা রুটি ছিল, পথে এক ভিখারী তার কাছে ভিক্ষা চাইলে সে একটি রুটি তার হাতে দিয়ে দিলো। ফক্বীর হাত তুলে দো’আ করল, ‘‘আল্লাহ তোমাকে এমন সব বালা-মুসীবত থেকে রক্ষা করুন, যেগুলো আসমান থেকে নাযিল হয়।’’ দোজ্ঞআটি তার পছন্দ হলো তাই আরো একটি রুটি তাকে দিয়ে দিলো। ফক্বীর দো’আ করলো, ‘‘আল্লাহ তোমাকে সব ধরনের বিপদ থেকে হিফাযত করুন।’’ সে তৃতীয় রুটিটাও ফক্বীরকে দিয়ে দিলো। এবার ফক্বীর দো’আ করল, ‘আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান নসীব করুন।’’ এ দিকে তার কাপড়গুলোর ভেতরে একটি বিরাট সাপ ঢুকে পড়েছিলো। সে কাপড়গুলো খুললো। সাপটি তাকে দংশন করতে উদ্যত হলো। ঠিক তখন দেখা গেলো, সাপটির মুখে লোহার লাগাম পরানো। সে কাপড়গুলো ধুয়ে যথারীতি নিরাপদে প্রত্যাবর্তন করলো। লোকেরা আর্শ্চযান্বিত হয়ে হযরত ঈসা রূহুল্লাহ্‌র দরবারে-এর কারণ জানতে চাইলো। হযরত ঈসা আলায়হিস সালাম তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা তুমি আজ পথে যেতে যেতে কোন্‌ নেক কাজ করেছো? সে বললো হুযূর! সাথে তিনটা রুটি ছিলো, ফক্বীরকে সাদক্বাহ করে দিয়েছিলাম! অতঃপর হযরত রূহুল্লাহ সাপকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি একে দংশন করোনি কেন? সাপ আরয করল, হুযূর আপনার বাণী মতো আমাকে ওই লোকটাকে দংশন করার জন্যেই পাঠানো হয়েছিলো। কিন্তু সে সাদক্বাহ করায় এক ফিরিশতা এসে আমার মুখে লাগাম এঁটে দিলেন। ফলে আমি আর তাকে দংশন করতে পারিনি। এতে সমস্ত লোক তা’আজ্জব বনে গেলো এবং ওই ধোপা খালেসভাবে তাওবা করলো।  [নুয্‌হাতুল মজালিস, পৃষ্ঠা-১৯২]

২৭. হযরত আবূ যার রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান, ‘‘(অভাবের সময়) যখন কোন ব্যঞ্জন তৈরী করো তখন পানি বাড়িয়ে দিও। যাতে প্রতিবেশীর খেদমত করা যায়।’’ [মিশকাত শরীফ, আয়াত-১৭১]

২৮. সদক্বাহ-খয়রাতে নিকটতম আত্মীয়রাই অগ্রাধিকার পাবে। সায়্যেদুনা হযরত আবূ হোরায়ারা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র সূত্রে মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে, সরকারে দো-আলম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ফরমাচ্ছেন- তুমি একটা দীনার আল্লাহর পথে, অর্থাৎ জিহাদ ইত্যাদিতে, একটা গোলাম আযাদ করার জন্যে এবং কোন একটা মিসকীনকে সদক্বাহ করলে, এভাবে নিজের পরিবারভুক্ত কারো জন্যে একটা দীনার খরচ করলে। ফলে, এর মধ্যে নিকটতম ব্যক্তির জন্যে যা খরচ করেছো ওটারই সর্বাধিক সাওয়াব পাবে।

প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাস’ঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র স্ত্রী হযরত যয়নাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা অপর একজন মহিলা সাহাবীসহ রাসূলে পাকের দরবারে মাসআলা জানতে চাইলেন যে, স্ত্রী নিজ মালিকানাধীন অর্থ দরিদ্র স্বামী এবং তার পূর্বস্বামীর সন্তানকে সাদক্বাহ হিসেবে প্রদান করলে সাওয়াব পাওয়া যাবে কিনা? প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, তখনতো তোমরা দ্বিগুণ সাওয়াব পাবে। একতো আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার এবং অপরটি সাদক্বাহর। তাই, রাসূলে পাক প্রায় সময় বলতেন, ‘‘তোমরা সাদক্বাহ প্রদানের সময় নিজ দায়িত্বভুক্ত নিকটতম ব্যক্তিদের দিয়েই শুরু করো, কারণ এদেরেকে দিলেৎ দু’দিকে দায়িত্ব পালন করা হয় এবং সৎওয়াবও দ্বিগুণ পাওয়া যায়। [মিশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা-১৭১]

২৯. দরিদ্র ব্যক্তির অভাবের ভেতরেও সাদক্বাহ করাকে রাসূল-ই করীম উত্তম সাদক্বাহ হিসেবে অভিহিত করেছেন। বর্ণিত আছে, হযরত শেরে খোদা আলী মুর্তাদ্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হযরত খাতূনে জান্নাত ফাতেমাতুয্‌যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহার একটি কাপড় নিয়ে বিক্রি করে কিছু খাদ্য সামগ্রী কেনার উদ্দেশ্যে বের হলেন। তিনি ওটা ছয় দিরহামে বিক্রি করে খাদ্য সামগ্রী কেনার উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন। পথে এক ভিখারী হাত পাতলে তার হাতে ওই ছয় দিরহাম পুরোটাই তিনি দিয়ে দিলেন। একটু পর এক উষ্ট্রীসহ একজন লোক এসে বললো, হুযূর আমার উষ্ট্রীটা কিনবেন? তিনি বললেন, ভাই আমার হাতে তো টাকা নেই। লোকটি বললো, ঠিক আছে, বাকীতে নিন। পরে দিয়ে দেবেন। হযরত, শেরে খোদা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ১০০ দিরহামে বাকীকে উষ্ট্রীটি নিয়ে সামনে কিছুদূর যেতেই অপর একজন ব্যক্তি এসে বললেন, হযরত, আপনার উষ্ট্রীটা বিক্রি করবেন? তিনি বললেন। হ্যাঁ, আমি তো এটা ১০০ দিরহামে কিনেছি। লোকটি বললো, ঠিক আছে আমি আপনাকে ৬০ দিরহাম লাভ দিচ্ছি। ১৬০ দিরহামে উষ্ট্রীটি বিক্রি করে তিনি সামনেভ দিকে আসছিলেন। প্রথম ব্যক্তিটি হাজির। বললো, হুযূর! আমার টাকাগুলো দেবেন? তিনি তাকে ১০০ দিরহাম পরিশোধ করে বাকী ষাট দিরহাম নিয়ে ঘরে ফিরে আসলেন। হযরত খাতূনে জান্নাত রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা এ বাড়তি টাকাগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি আল্লাহ পাকের সাথে ছয় দিরহমের সওদা করেছি, বিনিময়ে তিনি আমাকে ষাট দিরহাম দিয়েছেন। পরে রাসূলে পাকের দরবারে ঘটনার কথা বললে প্রিয় নবী এরশাদ করলেন- প্রথম উট বিক্রেতা হযরত জিব্রাঈল এবং দ্বিতীয় উট ক্রেতা হচ্ছেন মীকাইল আলাইহিস সালাম। আর এ উষ্ট্রীটি ফাতেমার জন্যে সংরক্ষিত আছে। ওটা ক্বিয়ামতের দিন তাঁর বাহন হবে।   [নুয্‌হাতুল মজালিশ, পৃষ্ঠা- ১৯৫]

৩০. উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা প্রিয় নবীর কাছে জানতে চাইলেন, এয়া রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু তাজ্ঞআলা আলায়কা ওয়াসাল্লাম)! এমন কোন বস্তু আছে, যা মানুষ চাইলে না দেওয়া উচিত নয়? রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, লবণ, পানি এবং আগুন। হযরত সিদ্দীক্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা আরয করলেন, হুযূর!পানির গুরুত্ব বুঝলাম; কিন্তু লবণ এবং আগুনের মাহাত্ম্য কি? নবী করীম এরশাদ করলেন, লবণ দ্বারা খাদ্য সুস্বাদু হয় আর আগুন দ্বারা পাক (রান্না) হয়। তাই যত পরিমাণ খাবার ঐআ লবণ দ্বারা স্বাদ হয়েছে এবং ওই আগুন দ্বারা রান্না হয়েছে, ওই পরিমাণ খাদ্য সাদক্বাহ করার সৎওয়াব পাওয়া যায়। রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ফরমাচ্ছেন- যেখানে পানি সহজে পাওয়া যায় সেখানে কোন তৃঞ্চার্ত ব্যক্তিকে পানি পান করালে একজন গোলাম আযাদ করার সওয়াব পাওয়া যায় এবং পানি যেখানে সহজলভ্য নয় সেখানে কোন পিপাসু ব্যক্তিকে পানি পান করালে জীবন রক্ষার সাওয়াব পাওয়া যাবে। কেউ সাধারণের চলার পথে তৃঞ্চার্তদের জন্যে খাবার পানির ব্যবস্থা করলে আল্লাহ পাক তার প্রতি প্রত্যেহ দু’বার রহমতের দৃষ্টি দেন।[নুয্‌হাতুল মজালিস, পৃষ্ঠা- ১৯৩]

বাস্তবিকই যাকাত-ফিত্‌রা ও সাদক্বাহ তথা সাখাওয়াত-বদন্যতা আর দানশীলতার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য লিখে বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। প্রিয়তম রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমাচ্ছেন- তোমার সঞ্চিত সম্পদকে যদি চোর-ডাকাত আর ঘুণ-পোকার আক্রমন থেকে রক্ষা করতে চাও, তাহলে আল্লাহ্‌র পথে সদ্‌ক্বাহ করে যাও।

’শেখ সাদী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন-সদ্‌ক্বাহ করে যাও, তবে খোঁটা দিয়ে তা বরবাদ করো না। কারণ এর সুফলতো অচিরেই তুমিই পাবে। তিনি বলেন- সাখাওয়াত অর্থাৎ দান-বৃক্ষ যেখানেই রোপন করো সেটার সুফল এবং সফলতার ডাল-পালায় আরশকেও ছাড়িয়ে যাবে। তবে তুমি এর সুফল ভোগ করতে চাইলে খোঁটা দিয়ে এর গোড়ায় কুড়াল এবং করাত চালিয়ে দিওনা। এখানে হযরত শেখ সাদী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র আরো একটি বাণী বড় গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘‘দু’ধরনের মানুষ সবচেয়ে বেশী আফসোস এবং অনুশোচনা নিয়েই মৃত্যুবরণ করেঃ এক. ওই কৃপণ ব্যক্তি, যে সারা জীবন শুধু উপার্জন করেছে কিন্তু না খেয়ে, নিজের কল্যাণে ব্যয় না করে পরের জন্য ছেড়ে গেছে এবং দুই. গ্গব অনেক অনেক জ্ঞান অর্জন করেছে, কিন্তু তা অনুযায়ী আমল করেনি।

সবশেষে, সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর একটি বাণী দিয়ে এ বিষয়টির ইতি টানছি। হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমাচ্ছেন-

‘‘যতদিন তোমাদের উত্তম লোকেরা সমাজে নেতৃত্ব দেবে, ধনীরা হবে দানশীল এবং তোমরা পরস্পর সুন্দর পরামর্শের মাধ্যমে কার্য সমাধা করবে, ততদিন সমাজ হবে সুন্দর, মৃত্যুর চেয়ে জীবন অনেক দামী হবে। পক্ষান্তরে, যখন দুষ্টলোকদের হাতে সমাজ পরিচালিত হবে, ধনীরা কৃপণ হয়ে যাবে আর পুরুষেরা নারীদের পরামর্শ অনুসারে কার্য সমাধা করবে তখন যমীনের উপরিভাগের চাইতে নিচের অংশ উত্তম হবে. (অর্থাৎ জীবনের চাইতে.) তথা এ কলুষময় সমাজ ও পরিবেশ থেকে মৃত্যুই শ্রেয়।)