নবী-রাসুলগণের আনুগত্য নাজাতের নিশ্চয়তা

নবী-রাসুলগণের আনুগত্য নাজাতের নিশ্চয়তা

অধ্যক্ষ হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী

بسم الله الرحمن الرحيم
اِقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ(১( وَاِنْ یَّرَوْا اٰیَةً یُّعْرِضُوْا وَ یَقُوْلُوْا سِحْرٌ مُّسْتَمِرٌّ(২) وَ كَذَّبُوْا وَ اتَّبَعُوْۤا اَهْوَآءَهُمْ وَ كُلُّ اَمْرٍ مُّسْتَقِرٌّ(৩) وَلَقَدْ جَآءَهُمْ مِّنَ الْاَنْۢبَآءِ مَا فِیْهِ مُزْدَجَرٌ(৪) حِكْمَةٌۢ بَالِغَةٌ فَمَا تُغْنِ النُّذُرُ(৫) فَتَوَلَّ عَنْهُمْۘ- یَوْمَ یَدْعُ الدَّاعِ اِلٰى شَیْءٍ نُّكُرٍ(৬) خُشَّعًا اَبْصَارُهُمْ یَخْرُجُوْنَ مِنَ الْاَجْدَاثِ كَاَنَّهُمْ جَرَادٌ مُّنْتَشِرٌ(৭) مُّهْطِعِیْنَ اِلَى الدَّاعِؕ- یَقُوْلُ الْكٰفِرُوْنَ هٰذَا یَوْمٌ عَسِرٌ(৮) كَذَّبَتْ قَبْلَهُمْ قَوْمُ نُوْحٍ فَكَذَّبُوْا عَبْدَنَا وَ قَالُوْا مَجْنُوْنٌ وَّ ازْدُجِرَ(৯) فَدَعَا رَبَّهٗۤ اَنِّیْ مَغْلُوْبٌ فَانْتَصِرْ(১০) فَفَتَحْنَاۤ اَبْوَابَ السَّمَآءِ بِمَآءٍ مُّنْهَمِرٍ(১১)

তরজমা: যা শাশ্বতরূপে চলে আসছে, নিকটে এসেছে ক্বিয়ামত এবং দ্বিখন্ডিত হয়েছে চাঁদ। আর যদি তারা কোন নিদর্শন দেখে, তবে মুখ ফিরিয়ে নেয় আর বলে, এটা তো জাদু এবং তারা মিথ্যারোপ করেছে এবং নিজেদের কুপ্রবৃত্তি গুলোর অনুসরন করেছে, আর প্রত্যেক কাজই নিরূপিত হয়েছে। এবং নিশ্চয় তাদের নিকট ওই সংবাদ এসেছে, যাতে সাবধান বাণী রয়েছে। চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌছেছে এমন হিকমাহ-প্রজ্ঞা, অত:পর কি কাজে আসবে ভীতি প্রদর্শন কারীরা। সুতরাং আপনি তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন। যেদিন আহ্বানকারী এক অপ্রিয় পরিণামের দিকে আহ্বান করবে। তারা অবনমিত নেত্রে কবরগুলো থেকে বের হবে বিক্ষিপ্ত পংগপাল সদৃশ। তারা আহ্বানকারীর দিকে দৌড়াতে থাকবে। কাফিরগণ বলবে, এটা কঠিন দিন। তাদের পূর্বে নূহের সম্প্রদায় ও অস্বীকার করেছিল। সুতরাং তারা আমার (প্রিয়তম) বান্দাকে অস্বীকার করেছে আর বলেছে ‘সে উন্মাদ’ এবং তাকে তিরস্কার করেছে। তখন সে আপন প্রতিপালকের দরবারে প্রার্থনা করলো ‘আমি পরাস্ত, অতএব, তুমি প্রতিবিধান কর। অত:পর আমি আসমানের দরজা খুলে দিলাম মুষলধারে বৃষ্টি দ্বারা।
(সূরা আল-ক্বামার, ১-১১নং আয়াত)

আনুষঙ্গিক আলোচনা
শানে নুুযুল: উদ্ধৃত আয়াত সমূহের শানে নুযুল বর্ণনায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করছেন- আলোচ্য ‘সূরা আল-ক্বামার’ এর প্রারম্ভিক আয়াত সমূহে রাসূলে খোদা আশরাফে আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম উল্লেখযোগ্য মুজিজা চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করা বিষয়ে বিবৃত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন রেওয়ায়ত বর্ণিত হয়েছে।
আল্লামা আহমাদ খরপূতী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ‘কাসিদাহ বুরদাহ’ শরিফের ব্যাখ্যা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন-একদা মক্কার কাফির সর্দার আবু জাহেল মক্কাবাসীদের ইসলাম গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করার কাজে সাহায্য করার জন্য তার ইয়ামানি বন্ধু হাবীবে ইয়েমেনীকে ডেকে পাঠালো। হাবীব মক্কা মুয়াজ্জামায় আগমন করলো আবু জাহেল এর আহ্বানে তখন আবু জেহল রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করলো। জবাবে হাবীবে ইয়ামেনী বললো ‘আচ্ছা’ আমিও তাঁর সাথে সাক্ষাত করে জেনে নিই।” আল্লাহর হাবীবের দরবারে দূত মারফত বলে পাঠালো- আমি হাবিবে ইয়ামেনি ইয়েমান থেকে মক্কায় এসেছি। অমূক স্থানে কুরাইশ বংশীয় নেতৃবৃন্দের সাথে বসে আছি। আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই। সময়টা জোসনা রাতের ছিল।

আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম- তাশরীফ আনয়ন করলেন। হাবীবে ইয়েমেনী আরজ করলেন- আপনি কিসের দাওয়াত দিচ্ছেন? জবাবে রাসুলে খোদা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন-আল্লাহর একত্ববাদ ও আমার রিসালাতের। আপনার কোন মুজিযা আছে কি? আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন-তুমি যা চাও। হাবীবে ইয়ামেনি বলেলো- আমি দুটি মুজিযা চাই। একটি হচ্ছে আপনি চাঁদকে দ্বিখন্ডিত করে দেখান, আর দ্বিতীয়টি পরে আরজ করব। আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম- বললেন ‘আচ্ছা’ সাফা পর্বতের উপর চলো। হাবীবে ইয়ামেনি কুরাইশ বংশীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে হুজুরের সাথে সাফা পর্বতের উপর গেলেন।
সকলের সম্মুখে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম- চাঁদের দিকে আঙ্গুল মুবারক দ্বারা ইঙ্গিত করলেন। তৎক্ষনাৎ আকাশের চাঁদ দু টুকরো হয়ে এক টুকরা সাফা পর্বতের একদিকে আর অন্য টুকরো অপরদিকে রইলো। দীর্ঘক্ষণ ব্যাপী দেখানোর পর আবার ইঙ্গিত করা মাত্র উভয় টুকরো সংযুক্ত হয়ে গেল। (সুবহানাল্লাহ)
আল্লাহর রাসূল বললেন- হাবীব! দ্বিতীয় দাবিটি পেশ কর। জবাবে হাবিব বললো-হুজুর আপনিই বলে দিন যে আমার অন্তরে কি আছে। তখন রাসূলে আকরাম নুরে মুজাস্সাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন- হাবীব তোমার একটা কন্যা সন্তান রয়েছে যেটা পঙ্গু, বিকলাঙ্গ, অন্ধ ও বধির, যৌবনে পদার্পন করেছে। তুমি চাও যে, সে হয়ত সুস্থ হয়ে যাক অথবা মৃত্যু বরণ করূক। যাও সে সুস্থ হয়ে গেছে। আর তুমি এখানে কালেমা পড়ে নাও। তখনই হাবীবে ইয়ামানি এবং আরো অনেকে ঈমান আনয়ন করলো। আর আবু জেহেল বলল ‘এ সবই জাদু।’ (তাফসিরে নুরুল ইরফান)

সাইয়্যেদুনা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ রয়েছে একদা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় মিনা নামক স্থানে উপস্থিত ছিলেন। তখন মুশরিকরা তাঁর কাছে নবুওয়াতের নিদর্শন স্বরূপ মুজিযা তালাশ করলো। তখন ছিন চন্দ্রোজ্জ্বল রাত্রি। আল্লাহ পাক এই সুস্পষ্ট অলৌকিক ঘটনা দেখিয়ে দিলেন যে, চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হয়ে এক খন্ড পূর্বে ও অপর খন্ড পশ্চিম দিকে চলে গেল। এবং উভয় খন্ডের মাঝখানে পর্বত অন্তরাল হয়ে গেল। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম- সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন-দেখ এবং সাক্ষ্য দাও। সবাই যখন পরিষ্কার রূপে এই মুজিযা দেখে নিল তখন চন্দ্রের উভয় খন্ড পুণরায় একত্রিত হয়ে গেল। কোন চাক্ষুশ্মান ব্যক্তির পক্ষে এই সুস্পষ্ট মুজেযা অস্বীকার করা সম্ভবপর ছিলনা। কিন্তু মুশরিকরা বলতে লাগলো মুহাম্মদ সারা বিশে^র মানুষকে জাদু করতে পারবে না। অতএব বিভিন্ন স্থান থেকে আগত লোকদের জন্য অপেক্ষা কর। তারা কি বলে শুনে নাও। এরপর বিভিন্ন স্থান থেকে আগত মুশরিকদের কে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করলো আর তারা সকলে চন্দ্রকে দ্বিখন্ডিত অবস্থায় দেখেছে বলে স্বীকার করলো।

اقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانشَقَّ الْقَمَرُ
আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীর শাস্ত্র বিশারদগণ উল্লেখ করেছেন-পূর্ববর্তী ‘সূরা আন-নজম’ এর ৫৭নং আয়াতে অর্থাৎ ازفة الأزفة অর্থাৎ কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে বলে মুমিনগণকে সতর্ক করা হয়েছে। যাতে দুনিয়ার প্রতি আসক্তি হ্রাস পায় এবং আখিরাতের স্মরণ বৃদ্ধি পায়। অতঃপর সূরা আল-ক্বামার কে اقتربة الساعة বলে আরম্ভ করত: উপরোক্ত বিষয় কে তাগিদ দেয়া হয়েছে। এরপর ক্বেয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার একটি দলীল চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়ার মুজেযা উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা, কেয়ামতের অসংখ্য নিদর্শনাবলির মধ্যে সর্ববৃহৎ নিদর্শন হচ্ছে স্বয়ং সর্বশেষ নবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শুভাগমন। এক হাদীসে তিনি ইরশাদ করেছেন انا والساعة كهاتين অর্থাৎ আমি নবীর আগমন এবং কেয়ামত দুই আঙ্গুলের ন্যায় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আরও অনেক হাদীসে এই নৈকট্যেও বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে। অনুরূপভাবে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মুজেযা হিসেবে চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হয়ে যাওয়াও কেয়ামতের একটি বড় নির্দশন। এছাড়াও এ মুজিযাটি আরও এক দিক দিয়ে কেয়ামতের বড় নিদর্শন। তা এই যে, চন্দ্র যেমন আল্লাহর কুদরতে দুই খন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল তেমনিভাবে কেয়ামতের দিন সমগ্র গ্রহ উপগ্রহ খন্ড বিখন্ড হয়ে যাওয়া কোন অসম্ভব ব্যাপার নয়।

كَذَّبَتْ قَبْلَهُمْ قَوْمُ نُوحٍ فَكَذَّبُوا عَبْدَنَا وَقَالُوا مَجْنُونٌ
উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীর শাস্ত্র বিশারদগণ উল্লেখ করেছেন-সাইয়্যেদুনা হযরত নূহ আলায়হিস সালামের সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁকে উন্মাদ বলে আখ্যায়িত করলো এবং হুমকি প্রদর্শন করে রেসালতের কর্তব্য পালনে বিরত রাখতে চাইল। অন্য এক রেওয়ায়তে উল্লেখ আছে যে, তারা নুহ আলায়হিস্ সালামকে হুমকি প্রদর্শন করে বলল-যদি আপনি প্রচার ও দাওয়াতের কাজ থেকে বিরত না হন, তবে আমরা আপনাকে প্রস্তর বর্ষণ করে মেরে ফেলব (নাউজুবিল্লাহ)।
হযরত আবদ ইবনে হুমায়দ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ইমাম মুজাহিদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ননা করেন- সাইয়্যেদুনা হযরত নূহ আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের কিছু লোক তাঁকে পথে ঘাটে কোথাও পেলে গলা টিপে ধরত। ফলে তিনি বেহুশ হয়ে যেতেন। এরপর হুশ ফিরে এলে তিনি আল্লাহর দরবারে দোয়া করতেন- আল্লাহ!আমার সম্প্রদায়কে ক্ষমা করুন। তারা অজ্ঞ। সাড়ে নয়শ বছর পর্যন্ত সম্প্রদায়ের এমন নির্যাতনের জাওয়াব দোয়ার মাধ্যমে দান করে অবশেষে নিরুপায় হয়ে তিনি বদদোয়া করেন।
আল্লাহর পক্ষ থেকে যখন এ আয়াত নাযিল হলো যে- أن لن يومن من قومك الا من قد أمن
অর্থাৎ আপনার সমগ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে তারা ব্যতীত নতুন করে আর কেউ ঈমান আনবে না।” সাইয়্যেদুনা হযরত নুহ আলায়হিস সালাম বদদোয়া করলেন-
رب لا تذر على الأرض من الكافرين ديارا إنك إن تذرهم يضلوا عبادك ولا يلدوا إلا فاجرا كفارا
অর্থাৎ সাইয়্যেদুনা হযরত নুহ আলায়হিস সালাম বললেন- হে আমার পালনকর্তা আপনি পৃথিবীতে কোন কাফের গৃহবাসী কে রেহাই দিবেন না। যদি আপনি তাদের রেহাই দেন তবে তারা আপনার বান্দাদের পথভ্রষ্ট করবে এবং জন্ম দিতে থাকবে কেবল পাপাচারী কাফের।’ নূহ আলাইহিস সালামের এহেন বদদোয়ার পর চল্লিশ দিন ব্যাপি মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষিত হল। বিশ^ব্যাপী মহা প্লাবনে নূহ আ. এর অবাধ্য সম্প্রদায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো। প্রমাণিত হলো নবী-রাসূলগণের অনুসরণ-আনুগত্য নাজাতের নিশ্চয়তা আর অবাধ্যতার পরিণাম ধ্বংস।

লেখক: অধ্যক্ষ, কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা, মুহাম্মদপুর, এফ ব্লক, ঢাকা।

 

 

Share:

Leave Your Comment