আসরের নামাযের ফযীলত ও মাসায়েল

আসরের নামাযের ফযীলত ও মাসায়েল

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

وَعَنْ اِبْنُ عُمَرَ رَضَى اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلى عليه وسلم الَّذِىْ يَفُوْتُهُ صَلَوةَ الْعَصْرِ فَكَانَّمَا وُتِرَ اَهْلُهُ وَمَالُهُ (متفق عليه)
عَنْ بُرَيْدَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلى الله عليه وسلم مَنْ تَرَكَ صَلوةَ الْعَصْرَ فَقَدْ حَبِطَ عَمْلُهُ -(متفق عليه)
অনুবাদ: হযরত ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যার আসরের নামাযের সময় চলে গেলো, তার ঘর বাড়ী ও ধন-সম্পদ যেন লুন্ঠিত হয়ে গেলো। [বুখারী শরীফ]
হযরত বুরায়দা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আসরের নামায পরিত্যাগ করলো, তার আমল বিনষ্ট হয়ে গেলো। [বুখারী-মুসলিম]

প্রাসঙ্গিক আলোচনা
বর্ণিত হাদীস হতে আসরের নামাযের গুরুত্ব আলোকপাত হয়েছে। পবিত্র ক্বোরআন ও সুন্নাহর বর্ণনায় আসরের নামাযকে সালাতুল উস্তা বলা হয়েছে। আল ক্বোরআনে এরশাদ হয়েছে-
حَافِظُوا عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالصَّلَاةِ الْوُسْطَىٰ وَقُومُوا للهِ قَانِتِينَ
অর্থাৎ- তোমরা সকল নামায এবং বিশেষত মাধ্যবর্তী নামায হিফাজত কর। আর আল্লাহ্র সামনে বিনয়াবনত অবস্থায় দাঁড়াও। [সূরা বাক্বারা: আয়াত-২৩৮, পারা-২]
হাদীস শরীফে বর্ণিত নামায প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা বর্ণিত, হয়েছে নিম্নরূপ-
عَنْ اِبْنِ مَسْعُوْدٍ وَسَمُرة بن جُنْدَب قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَلَوةُ الوُسْطى صَلَوةُ الْعَصْرِ (رواه الترمذى)
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ও হযরত সামুরাহ্ ইবনে জুনদাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে বর্ণিত, তাঁরা বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন মধ্যবর্তী নামায হচ্ছে আসরের নামায। [তিরমিযী শরীফ]
আসরের নামায হচ্ছে দিন ও রাতের নামাযগুলোর মধ্যবর্তী নামায। আসরের সময়‘ দিন ও রাতের ফিরিস্তাগণ একত্রিত হন, এ সময়ে দুনিয়াবী কাজ-কর্মের ব্যস্ততা ও শারীরিক ক্লান্তি বেশী অনুভূত হয়। এ করণে এ নামাযের প্রতি অত্যাধিক গুরুত্ব ও তাকীদ দেয়া হয়েছে। মধ্যবর্তী নামায সম্পর্কে সাহাবাদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে কারো মতে এর দ্বারা ফজরের নামায, কারো মতে এর দ্বারা যোহরের নামায, কোনো কোনো বর্ণনা মতে মাগরীবের নামায বুঝানো হয়েছে। তবে আসরের নামায মর্মে যে বর্ণনা রয়েছে তা প্রধান্য পেয়েছে।
[মিরআতুল মানাজীহ:১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৫৪]
ফজর ও আসর নামায আদায়কারী জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عَنْ عُمَارَةَ بنِ رَوَيْبَةَ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ لَنْ يَلِجَ النَّارَ اَحَدٌ صلّى قَبْلَ طُلُوْعِ الشَّمْسِ وَقَبْلَ غُرُوْبِهَا يَعْنِى الْفَجْرَ وَالْعَصْرَ- (رواه مسلم)
অর্থ: হযরত ওমারাহ্ ইবনে রুয়াইবাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে এরশাদ করতে শুনেছি। ওই ব্যক্তি কখনো জাহান্নামে প্রবেশ করবে না যে সূর্য উদিত হওয়া ও অস্ত যাওয়ার পূর্ববর্তী নামায আদায় করবে। অর্থাৎ ফজর ও আসর। [মুসলিম শরীফ]

আসর নামায পরিত্যাগের পরিণাম
হাদীস শরীফে আসর নামায পরিত্যাগকারীর জন্য দুঃসংবাদ তথা আমল বিনষ্ট হওয়ার যে বর্ণনা রয়েছে উক্ত হাদীসের মর্ম হলো অর্থাৎ তার কাজের বরকত শূন্য হয়ে যাবে। আর যদি আসর নামায ছেড়ে দেওয়ার অভ্যাস হয়ে যায় তার সব আমল বাযেয়াপ্ত হয়ে যাবে।
[মিরআতুল মানাজীহ: ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৩৩, কৃত- হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নাঈমী রাহ.]
মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর প্রতি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামার তিনটি উপদেশ হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عَنْ عَلِىّ اَنَّ النَّبِى صلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ يَا عَلِىُّ ثَلثٌ لَا توخرها الصلوة اذا اتت وَالْجَنَازَةُ اذا حَضَرَتَ والايمُ اِذَا وَجَدْتَ لَهَا كَفُوًا- (رواه الترمذى)
হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, হে আলী তিনটি বিষয়ে বিলম্ব করো না, নামাযের সময় যখন উপস্থিত হয়, জানাযা যখন প্রস্তুত হয়ে যায়, এবং কন্যা বিবাহের জন্য যখন সম-সম্প্রদায়ের পাত্র পাওয়া যায়। [তিরমিযী]
এ হাদীসের ব্যাপারে বলা হয়েছে নামাযের ওয়াক্ত আরম্ভ হতেই নামায পড়ে নেয়াটা উত্তম ও আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম। কন্যার জন্য উপযুক্ত পাত্র যদি পাওয়া যায় অকারণে বিলম্ব করা অনুচিত। কারণ এতে বিভিন্ন প্রকার ফিৎনা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।

প্রথম ওয়াক্তে নামায আদায়ে রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি
وَعَنْ اِبن عُمَرَ رضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَلوَقْتُ الاوَّلُ من الصَّلوة رِضوانُ اللهِ وَالْلوَقْتُ الْاخِرُ عَفُوُ اللهِ- (رواه الترمذى)
হযরত ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, প্রথম ওয়াক্তে নামায আদায়ে রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি আর শেষ ওয়াক্তে রয়েছে আল্লাহর ক্ষমা। [তিরমিযী]

আসরের নামাযের রাক‘আত সংখ্যা
আসর নামায আট রাকা‘আত, সুন্নাতে গায়রে মুআক্কাদাহ্ চার রাকা‘আত, ফরয চার রাকা‘আত, মোট: আট রাকা‘আত।
মাসআলা: আসরের নামাযের সময়: যোহরের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার সাথে সাথে আসরের ওয়াক্ত শুরু হয়। সূর্যাস্ত পর্যন্ত আসরের সময় বাকী থাকে।[বাহারে শরীয়ত: ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-১২৯]
মাসআলা: আসরের নামায বিলম্বে পড়া মুস্তাহাব তবে এতটুকু বিলম্ব করবে না যাতে সূর্যের মধ্যে হলদে রং এসে যায়। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হলে আসর ও এশার নামায বিলম্ব না করা মুস্তাহাব। অন্যান্য নামাযের ক্ষেত্রে বিলম্ব করা মুস্তাহাব। [বাহারে শরীয়ত: ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-১৩১]
মাসআলা : আরাফার ময়দানে জোহর ও আসরের নামায যোহরের সময় পড়ে নেবে। মুযদালাফায় মাগরীব ও এশার নামায এশার সময় পড়ে নেবে।
[বাহারে শরীয়: ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-১৩১]
মাসআলা: আসরের সুন্নাত নামায শুরু করল, এমতাবস্থায় জামাত শুরু হল তখন দু’রাকা‘আত সুন্নাত পড়ে জামাতে শামিল হবে। বাকী দু’রাকা‘আত সুন্নাত পুনরায় পড়ার প্রয়োজন নেই। [ফাতওয়া-এ রজভীয়্যাহ্]

আসরের ওয়াক্ত সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞাতব্য
আসরের সময় কমপক্ষে ১ ঘন্টা ৩৫ মিনিট এবং বেশী হলে দুই ঘন্টা ৬ মিনিট পর্যন্ত হয়ে থাকে। তার ব্যাখ্যা নিম্নরূপ- অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ পৌনে চার মাস ১ ঘন্টা ৩৬ মিনিট পর্যন্ত থাকে।
বৎসরের মধ্যে এটাই আসরে সবচেয়ে কম সময়। এপ্রিল-মে মাসে প্রায় পৌনে দু’ঘন্টা সময় থাকে। মে মাসের শেষের দিকে এবং জুন মাসে প্রায় দু’ঘন্টা সময় থাকে। আবার আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে পৌনে ১ ঘন্টা ৩৭ মিনিটের কাছাকাছি সময় থাকে। [বাহারে শরীয়ত: ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-১২৯]
মাসআলা: আসরের নামাযের পর নফল নামায পড়া নিষেধ। [র্দুরুল মোখতার, আলমগীরি]
মাসআলা: আসরের নামাযের সুন্নাতে গায়রে মুআক্কাদাহ্ এর প্রত্যেক রাকা‘আতে সূরা ফাতিহার পর অন্য সূরা পড়তে হবে। [বাহারে শরীয়ত: ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-১৫]

আসরের ফরজের পূর্বে চার রাকা‘আত সুন্নাতের ফযীলত
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আসরের ফরয সালাতের পূর্বে চার রাকা‘আত সালাত আদায় করবে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর উপর রহমত বর্ষণ করবেন। [আবূ দাউদ: হাদীস-১২৭১]

ফরয নামাযের পর দু‘আ করার ফযীলত
ফরয নামাযের পর দুআ-মুনাজাত করা শরীয়ত সম্মত। নবীজিকে প্রশ্ন করা হয়েছে- اىُّ الدُّعَاء اَسْمَعُ قَالَ جَوفُ اللَّيْلَ الاخِر وَدُبِرِ الصلوة المكتوبات-
কোন সময়ের দুআ আল্লাহ্ সবচেয়ে বেশী শুনেন, নবীজি এরশাদ করেছেন, রাতের শেষের দিকের দুআ এবং প্রত্যেক ফরয নামাযের পর। [তিরমিযী: হাদীস-৩৪৯৯]
মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, ফরয সালাতের পর রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মুক্তাদিদের দিকে ফিরে দুআ করার বর্ণনা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। হে আল্লাহ্! আমাদের অন্তরে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের প্রতি মহব্বত সৃষ্টি করে দিন। নামাযের প্রতি যত্নবান হওয়ার তাওফিক নসীব করুন।

 

Share:

Leave Your Comment