কিয়ামত পূর্ববর্তী ফিতনার যুগে মু’মিনের করণীয়

কিয়ামত পূর্ববর্তী ফিতনার যুগে মু’মিনের করণীয়

মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ্ আল-মাসুম

ক্বিয়ামতের পূর্বে দুনিয়াবাসী নানাবিধ ফিৎনার ও কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হবে বলে আল্লাহর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দুনিয়াবাসীদের সতর্ক করে দিয়েছেন। আর তাদেরকে, বিশেষতঃ মু’মিন-মুসলমানদেরকে ওইসব ফিৎনার যুগে নিজেদেরকে এবং নিজেদের ঈমান রক্ষার পন্থাগুলো বাতলিয়ে দিয়েছেন। তাছাড়া, জীবনে নানা পরীক্ষার সম্মুখীন হবার এবং এর হিকমত সম্পর্কে পবিত্র ক্বোরআনে এরশাদ হয়েছে-
أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ
অর্থাৎ মানুষেরা কি ধারণা করে যে, তাদেরকে এ কথা বলাতেই ছেড়ে দেয়া হবে যে, আমরা ঈমান এনেছি এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবেনা? আমি তাদের পূর্ববর্তীদেরকে পরীক্ষা করেছি, যাতে আল্লাহ সত্যবাদীদেরকে (জগৎবাসীর নিকট) পরিচয় করে দেন এবং এটা প্রকাশ্যভাবে জানেন যে, কারা মিথ্যাবাদী।’ মুমিনকে তার ঈমান অনুযায়ী পরীক্ষা করা হয়। অর্থাৎ যার ঈমান যত মজবুত, তার পরীক্ষাও তত বড় ও কঠিন হয়ে থাকে। মানুষের মাঝে নবীগণের পরীক্ষা সবচেয়ে কঠিন ছিলো। অতঃপর পর্যায়ক্রমে অন্যদের পরীক্ষা নেওয়া হয়। আর মুমিন মাত্রই প্রতিনিয়ত পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। কিয়ামত পূর্ববর্তী সময়ের ফিতনাগুলো একটি অপরটির চেয়ে ভয়াবহ হবে। এমনকি ফিতনায় পড়ে মানুষ দ্বীন থেকে বের হয়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, إِنَّ بَيْنَ يَدَيِ السَّاعَةِ فِتَنًا كَأَنَّهَا قِطَعُ اللَّيْلِ الْمُظْلِمِ يُصْبِحُ الرَّجُلُ فِيهَا مُؤْمِنًا وَيُمْسِي كَافِرًا وَيَبِيعُ فِيهَا أَقْوَامٌ خَلَاقَهُمْ بِعَرَضٍ مِنَ الدُّنْيَا
অর্থাৎ নিশ্চয়ই কিয়ামতের পূর্বে অন্ধকার রাত্রির মত ঘন কালো অনেক ফিতনার আবির্ভাব হবে। সকালে একজন লোক মুমিন অবস্থায় ঘুম থেকে জাগ্রত হবে। বিকালে সে কাফিরে পরিণত হবে। বহু সংখ্যক লোক ফিতনায় পড়ে দুনিয়ার সামান্য স্বার্থের বিনিময়ে তাদের চরিত্র ও আদর্শ বিক্রি করে দেবে। পবিত্র ক্বোরআনে আরো এরশাদ হয়েছে- তোমাদের একজন দুনিয়ার সামান্য সম্পদের বিনিময়ে তার দ্বীন বিক্রি করে দেবে’’। উপর্যুক্ত হাদীস শরীফে বর্ণিত এই সময়টি বিশেষত সকল ঈমানদার-মুসলমানের জন্য কঠিনতর এক সময় হবে। মানুষ বুঝতেই পারবেনা কোনদিক থেকে কি হচ্ছে। মানুষ উত্তম কাজ করতে চাইবে, কিন্তু তার কোন সুযোগ থাকবেনা। আবার মানুষ মন্দ কাজ থেকে বাঁচতে চাইবে কিন্তু তা এড়িয়ে যাওয়াও দুস্কর হবে। বস্তুত মানুষ তার অভ্যন্তরীণ অবস্থা পরিবর্তন করার ফলে আল্লাহ তা‘আলা তার বাহ্যিক অবস্থা পরিবর্তন করে দেন। মানুষ যখন অভ্যন্তরীণ অবস্থা ভাল করে নেয় তখন আল্লাহ তাদের বাইরের অবস্থাও ভাল করে দেন। ইরশাদ হচ্ছে, إِنَّ اللهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِم
অর্থাৎ আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা তাদের নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে। তাই বিরাজমান এই ফিতনার যুগে মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে এ নিবন্ধে আলোকপাত করার প্রয়াস পেলাম।

ফিতনা ছড়ানো এক মারাত্মক অপরাধ। তাই কঠিন পরিস্থিতিতেও ফিতনা থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দিয়েছে ইসলাম। আল্লাহ তাআলা বলেন-‘বস্তুত ফিতনা ফ্যাসাদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ।’ এতদসত্ত্বেও মানুষ অপ্রয়োজন ও অযথা কথা ও কাজে ফেতনার পেছনে দৌঁড়াচ্ছে। অথচ হাদিস শরীফে রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের উদ্দেশ্যে চরম ফিতনার সময় কী করতে হবে তা সুস্পষ্টভাবে নসিহত করেছেন। এ প্রসঙ্গে রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘অচিরেই বিভিন্ন রকম ফিতনার আবির্ভাব ঘটবে। ফিতনার সময় বসে থাকা ব্যক্তি ফিতনার দিকে পায়ে হেঁটে অগ্রসর হওয়া ব্যক্তির চেয়ে নিরাপদ ও উত্তম। আবার পায়ে হেঁটে চলমান ব্যক্তি আরোহী ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক নিরাপদ ও উত্তম হবে। ফিতনা শুরু হয়ে গেলে যার উট থাকবে, সে যেন উটের যত্ন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আর যার ছাগল থাকবে, সে যেন ছাগলের পালের যত্ন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আর যার চাষাবাদের জমি আছে, সে যেন চাষাবাদের কাজে ব্যস্ত থাকে। এক ব্যক্তি আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইকা ওয়াসাল্লাম! যার কোনো কিছুই (উট, ছাগল, চাষাবাদের জমি) নেই, সে কী করবে? প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, পাথর দিয়ে তার তলোয়ারকে ভোঁতা করে নিরস্ত্র হয়ে যাবে এবং ফিতনা থেকে বাঁচতে চেষ্টা করবে। ফিতনার সময় একজন মুমিনের করণীয় হলো-

১. যাবতীয় গুনাহ থেকে তাওবা করা
মানব জাতির কৃত গুনাহ ও পাপাচারের কারণেই বিপদাপদ আসে এবং বিপদ এসে গেলে তাওবা ব্যতীত তা দূর হয়না। তাই ফিতনা ও বিপদাপদের সময় যাবতীয় গুনাহ ও পাপের কাজ থেকে আল্লাহর কাছে তাওবা করা আবশ্যক।

২. আল্লাহর নির্ধারিত ফয়সালার প্রতি সন্তুষ্ট থাকা
মুমিন মাত্রই বিশ্বাস রাখে যে, পৃথিবীতে যা কিছু হচ্ছে ও হবে তা সবই মহান আল্লাহর ইচ্ছাতেই। আল্লাহ এমন কোন জিনিষ সৃষ্টি করেন নি যাতে শুধু অকল্যাণ বিদ্যমান; বরং কখনও মুমিনের জন্য আল্লাহ তা‘আলা এমন কিছু বিষয় নির্ধারণ করেন, যা বাহ্যিক দৃষ্টিতে অকল্যাণকর মনে হয়, অথচ তাতে রয়েছে অত্যধিক কল্যাণ। ইরশাদ হচ্ছে, لَا تَحْسَبُوهُ شَرًّا لَكُمْ بَلْ هُوَ خَيْرٌ لَكُمْ
অর্থাৎ তোমরা তা (বিপদাপদ) অকল্যাণকর বলে মনে করোনা; বরং এটি তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক। অন্যত্র ইরশাদ করেন,
فَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا
অর্থাৎ হয়তো তোমরা কখনো এমন কোন বিষয়কে অপছন্দ করবে যাতে আল্লাহ অপরিমিত কল্যাণ নিহিত রেখেছেন’’।

৩. কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতের পূর্ণ অনুশীলন
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন যে, এই উম্মতের উপর বিভিন্ন বিপদাপদ ও ফিতনার ঝড় বয়ে যাবে এবং তিনি এই বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার পথও বলে দিয়েছেন। ইরশাদ করেন, تَرَكْتُ فِيكُمْ اَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوْا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا: كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ رَسُوْلِهِ
অর্থাৎ আমি তোমাদের জন্যে এমন দু’টি বস্তু রেখে যাচ্ছি যা দৃঢ়ভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবেনাঃ আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাত’’। রাসূলুল্লাহ আরও বলেন, فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَ سُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ تَمَسَّكُوْا بِهَا عَضُّوْا عَلَيْهَا بِالَّنَواجِذِ –
অর্থাৎ তোমরা আমার সুন্নাত এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের অনুসরণ করবে। তা দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে এবং ঐগুলোর উপর অটল থাকবে। আল্লাহ তাআলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার সুন্নাতের অনুসরণের আদেশ দিয়ে বলেন-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُوْلِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রাসূলের আনুগত্য কর। আরো আনুগত্য করো তোমাদের ইমামগণের। তোমাদের মাঝে যখন কোন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেবে তখন তোমরা তার সমাধানের জন্য আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের দিকে ফিরে আসবে যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকো। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর ও পরিণামের দিক দিয়ে উত্তম।’’

৪. ফিতনার সময় নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া
নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘অচিরেই এমন ফিতনার আত্মপ্রকাশ হবে যে, তখন বসে থাকা ব্যক্তি দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি হতে উত্তম থাকবে। আর দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি তখন চলমান ব্যক্তি হতে উত্তম থাকবে। আর চলমান ব্যক্তি তখন দ্রুতগামী ব্যক্তি হতে ভালো থাকবে।’

৫. ফিতনার সময় বিভ্রান্তিকর প্রচারণা থেকে সাবধান থাকা
মিথ্যা সংবাদ প্রচারকারীরাই অনেক সময় নানা সমস্যা, ফিতনা ও বিপর্যয়ের কারণ হয়ে থাকে। তারা এমন সংবাদ প্রচার করে যা বাস্তবের সাথে কোন সম্পর্ক রাখেনা; বিশেষ করে যখন অধিকাংশ প্রচার মাধ্যম ইসলামের শত্রুদের হাতে। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে সকল সংবাদ যাচাই করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে, يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا
অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কাছে যদি ফাসিক ব্যক্তি কোন খবর নিয়ে আসে তোমরা তা যাচাই করে দেখ। অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে
وَإِذَا جَاءَهُمْ أَمْرٌ مِنَ الْأَمْنِ أَوْ الْخَوْفِ أَذَاعُوا بِهِ وَلَوْ رَدُّوهُ إِلَى الرَّسُولِ وَإِلَى أُوْلِي الْأَمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِينَ يَسْتَنْبِطُونَهُ مِنْهُمْ
অর্থাৎ তাদের কাছে যখন নিরাপদ অথবা ভীতি সংক্রান্ত কোন সংবাদ আসে তখন তারা তা প্রচার করে বেড়ায়। তারা যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং জ্ঞানীদের কাছে আসতো তাহলে তাদের আলেমগণ অবশ্যই প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করতে পারতেন।

৬. ফিতনার সময় ঐক্যবদ্ধ থাকা
ফিতনার সময় মুসলমানদের জামাআতের সাথে সংঘবদ্ধ ও তাদের (মাজহাবের) ইমামকে অনুসরণ করতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুযায়ফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে এই উপদেশই দিয়েছেন। হুযায়ফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ফিতনার সময় করণীয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘‘তুমি মুসলমানদের জামাআত ও তাদের ইমামের অনুসরণ করবে। হুযায়ফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি আরজ করলাম তখন যদি মুসলমানদের কোন জামাআ’ত ও ইমাম না থাকে? তিনি বললেন, তাহলে তুমি ফিতনা সৃষ্টিকারী সকল ফির্কা পরিত্যাগ করবে। মৃত্যু পর্যন্ত তুমি এ অবস্থায় থাকবে ’’।

৭. ফিতনা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার উম্মাহর উপর এমন এক সময় আসবে যখন তারা নিজেদের মুসলিম ও মুমিন হিসেবে পরিচয় দেবে কিন্তু তাদের নামাজ যথার্থ হবেনা, উঁচু উঁচু দালান ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র এবং লোকজন আল্লাহর নামে বেশি বেশি কসম করবে কিন্তু তা পূরণ করবেনা।” উপর্যুক্ত হাদীসে যে বিষয়টির প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে, তা হচ্ছে-এমন এক সময় আসবে যখন মুসলিম উম্মাহ সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে। আখিরাতের চিরস্থায়ী কল্যাণের পরিবর্তে দুনিয়ার সাময়িক বিলাসিতা তাদের কাছে অধিক মূল্যবান মনে হবে। হাদীসের পরবর্তী অংশেই রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরামর্শ দিয়েছেন, “তুমি যদি তোমার সময়ে এই অবস্থা দেখ, তবে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও।” অপর হাদীসে এসেছে, এক লোক আরয করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইকা ওয়াসাল্লাম! কিভাবে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইবো?” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তাকে বলেন, ‘‘তোমার ঘরে অবস্থান নিও এবং তোমার মুখকে বন্ধ রেখো। একইসাথে তোমার রসনাকে সংযত রেখো এবং হারাম থেকে বিরত থেকো যতক্ষণ না তোমার মৃত্যু হয়।” বিপদাপদ ও ফিতনা থেকে বেঁচে থাকার জন্যে দোআ একটি উত্তম উপায়। যখন মানুষ দোআয় মশগুল থাকে তখন (এমতাবস্থায়) আকাশ থেকে যদি কোন মুসীবত আসে তবে দোআর সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটে। দোয়া ও মুসীবত আকাশে পরস্পর ঝগড়ায় লিপ্ত হয়। আকাশ থেকে মুসীবত নাযিল হতে চায়। আর দোয়া তাকে বাধা দেয়। মুসীবতের সময় নিম্নোক্ত দোআ পড়া ফলপ্রসু। اللّهُمَّ أَجِرْنِىْ فِىْ مُصِيْبَتِى وَاخْلُفْلِى خَيْرًا مِنْهَا
অর্থাৎ হে আল্লাহ! আপনি আমাকে এই বিপদ থেকে মুক্তি প্রদান করুন এবং এর পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম বস্তু দান করুন’’। যে কেউ এই দো’আ পাঠ করবে আল্লাহ তাকে বিনিময় প্রদান করবেন এবং মুসীবতের স্থলে উত্তম বস্তু দান করবেন। দোআ করার অন্যতম আদব হলো দোআ কবূল হওয়ার সময় ও মাধ্যম অনুসন্ধান করা এবং দোয়া কবূল না হওয়ার কারণসমূহ থেকে বিরত থাকা। দুআ কবূল না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো হারাম খাওয়া, দ্বীনের কাজে গাফেল থাকা ইত্যাদি। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায শেষে আল্লাহর কাছে ফিতনা থেকে আশ্রয় চেয়েছেন। তিনি এভাবে বলতেন-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَفِتْنَةِ الْمَمَاتِ
অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে কবরের আযাব থেকে আশ্রয় চাই। হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে মিথ্যুক দাজ্জালের ফিতনা থেকে আশ্রয় চাই। হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে জীবন ও মরনের ফিতনা থেকে আশ্রয় চাই।

৮. ফিতনার সময়ধীরস্থি রতা অবলম্বন করা
তাড়াহুড়া করা যদি আনন্দের সময় দূষণীয় হয়ে থাকে তাহলে বিপদের সময় কেমন হবে? হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে যে, আখিরাতের কাজ ব্যতীত প্রতিটি কাজেই ধীরস্থিরতা অবলম্বন করা ভাল। অর্থাৎ আখিরাতের কাজে প্রতিযোগিতার সাথে অগ্রসর হতে হবে। আর ফিতনার সময় সব সময় পিছিয়ে থাকতে হবে।

৯. ফিতনার সময় ইবাদতে লিপ্ত থাকা
হুযুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘‘ফিতনার সময় আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত থাকা আমার নিকট হিজরত করে আসার মত’’।

১০. মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব রাখা
ফিতনার সময় মুমিনদের উচিত পরস্পরকে সাহায্য – সহযোগিতা করা এবং কাফির ও বাতিল মতাদর্শীদের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করা, তাদেরকে ঘৃণা করা এবং তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা। আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত মহান আল্লাহ আমাদেরকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে- وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلهِ
অর্থাৎ তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর ফিতনার অবসান না হওয়া পর্যন্ত এবং দ্বীন পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর জন্যে নির্দিষ্ট না হওয়া পর্যন্ত’’।

১১. ফিতনার সময় ধৈর্য্য ধারণ করা
মু’মিন ব্যক্তির সকল কাজই ভাল। কল্যাণ অর্জিত হওয়ার সময় যদি শুকরিয়া আদায় করে তবে তার জন্য এটাই ভাল। আর বিপদাপদের সময় যদি ধৈর্য্য ধারণ করে তাও তার জন্য ভাল। ইরশাদ হচ্ছে, إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ
অর্থাৎ নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের প্রতিদান পরিপূর্ণরূপে প্রদান করা হবে। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, মুমিন ব্যক্তি সব সময় মুসিবতের মধ্যে থাকে। পরিণামে সে আল্লাহর সাথে নিস্পাপ অবস্থায় সাক্ষাৎ করে।

১২. ফিতনার সময় দ্বীনের জ্ঞানার্জনের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা
দ্বীনের সঠিক জ্ঞান অর্জনই ফিতনা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায়। রাসূলে আরকাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন’’। দ্বীনের জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে শত্রুদের চক্রান্ত, পরিকল্পনা, ও তাদের অবস্থা সম্পর্কেও সম্যক ধারণা রাখতে হবে, যাতে তাদের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য সতর্কতা অবলম্বন করা যায়। ফিতনার জামানায় ফিতনা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করাও আবশ্যক। ‘ফিতনা গরুর ন্যায়। তাতে বহু মানুষ ধ্বংস হবে। তবে যারা পূর্বেই এ সম্পর্কে অবগতি লাভ করবে তারা ধ্বংস হবে না।’

১৩.ফিতনার দিকে দৃষ্টি বা উঁকি না দেওয়া এবং ফিতনার দিকে না যাওয়া
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ফিতনার দিকে তাকাবে, ফিতনা তাকে ঘিরে ধরবে। তখন কেউ যদি কোন আশ্রয়ের জায়গা কিংবা নিরাপদ জায়গা পায়, তাহলে সে যেন আত্মরক্ষা করে। [সহিহ বুখারি, হাদীস:৭০৮১]

১৪. ফিতনার সময় সৎকাজ করা, অসৎকাজ পরিহার করা
আল্লাহ ওয়ালা মুত্তাকীদের সাথে চলাফেরা করা। পাপীদের সঙ্গ ত্যাগ করা। রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যখন ফিতনা তীব্র আকার ধারণ করবে তখন তোমরা সৎকাজকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরবে এবং অসৎকাজ হতে বিরত থাকবে। তোমাদের মাঝে বিশেষ লোক যারা রয়েছে তাদের প্রতি মনোনিবেশ করবে এবং তাদেরকে এড়িয়ে চলবে।’ [আল ফিতান : ৭২১]

১৫. ফিতনার জামানায় জান্নাত লাভের উপায়
উকবা ইবনে আমির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার সাথে সাক্ষাৎ করলাম এবং বললাম, নাজাতের উপায় কি? তিনি বললেন, ‘নিজের জিহ্বা আয়ত্তে রাখ, নিজের ঘরে অবস্থান করো এবং নিজের পাপের জন্য রোদন করো।’
[মুসনাদে আহমাদ; জামে তিরমিযি]

১৬. গাইরে মাহরাম নারী থেকে বেঁচে থাকতে হবে
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কোনো নারীর ওপর তোমার দৃষ্টি পড়লে তার প্রতি দ্বিতীয় দৃষ্টিপাত করো না। বরং নজর অতিসত্তর ফিরিয়ে নিও, কারণ, তোমার জন্য প্রথমবার ক্ষমা, দ্বিতীয়বার নয়। [সহিহ বুখারি, হাদীস: ৫০৯৬]
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, পুরুষের জন্য নারী জাতি অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকর কোনো ফিতনা নেই। [সহিহ বুখারি, হাদীস: ৫০৯৬]

১৭. ধন-সম্পদ ও ফেতনা
এটি আল্লাহর আনুগত্য থেকে মানুষকে গাফেল রাখে। এটা পরিহার করা, যাতে আল্লাহ ইবাদত করা থেকে দূরে না রাখে। কা’ব ইবনে ইয়ায রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামাকে বলতে শুনেছি, প্রত্যেক উম্মাতের জন্য কোনো না কোনো ফিতনা রয়েছে। আর আমার উম্মাতের ফিতনা হলো ধন-সম্পদ। [জামে তিরমিযি, হাদীস: ২৩৩৬]

অতএব মুমিন মুসলমানের উচিত, নিজে ফিতনা থেকে মুক্ত থাকা। অন্য মুমিনকেও ফিতনা থেকে মুক্ত রাখা। ইসলামের বিধান সম্পর্কে অযথা মনগড়া তথ্য প্রচার না করা। অন্যকে ফিতনার কাজে সহযোগিতা না করা। আর এটাই হলো ঈমানের জন্য নিরাপদ কাজ। আল্লাহ তাআলা মুমিন মুসলমানকে দুনিয়ার সব ফিতনা থেকে হেফাজত থেকে অন্যকে ফিতনা থেকে হেফাজত থাকতে সহযোগিতা করার তাওফিক দান করুন। আমিন বিজাহিন নবিয়্যিল আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

টিকা:
– সূরা আনকাবূত,আয়াত : ২-৩
– সহিহ মুসলিম, অধ্যায়: কিতাবুল ফিতান
– জামে তিরমিজী; সহীহুল জামে আস্ সাগীর হাদীস: ৫১২৫
– সূরা রা’দ,আয়াত:১১
– সূরা বাকারা: আয়াত ১৯১
– সহিহ মুসলিম
– সূরা নূর,আয়াত: ১০
– সূরা নিসা,আয়াত: ১৯
– মুআত্তা ইমাম মালেক; মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদীস: ১৮৬
– আবু দাউদ, অধ্যায়: কিতাবুস্ সুন্নাহ; সিলসিলায়ে সাহীহা, হাদীস: ১৭৬১
– সূরা নিসা,আয়াত:৫৯
– সহিহ মুসলিম, হাদীস:৭১৩৯
– সূরা হুজুরাত, আয়াত: ৬
– সূরা নিসা,আয়াত: ৮৩
– মুসলিম, অধ্যায়ঃ মুসলমানদের জামা’আতকে আঁকড়িয়ে ধরা ওয়াজিব
– সুনানে আবু দাউদ
– জামে তিরমিযি
– সহিহ বুখারী, অধ্যায়: কিতাবুল আযান
– সহিহ মুসলিম, অধ্যায়: কিতাবুল ফিতান
– সূরা আনফাল, আয়াত: ৩৯
– সূরা যুমার, আয়াত:১০
– সহিহ বুখারী, অধ্যায়: কিতাবুল ইলম
– আল ফিতান-৫

লেখক: আরবি প্রভাষক-তাজুশ শরী’আহ মাদরাসা, ষোলশহর, চট্টগ্রাম;
             খতিব-রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ জামে মসজিদ, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।

 

 

Share:

Leave Your Comment