আল্লামা গাজী শেরে বাংলা বিরচিত ‘দীওয়ান-ই আযীয’ কাব্যগ্রন্থে প্রিয়নবীর প্রশংসাস্তুতি

আল্লামা গাজী শেরে বাংলা বিরচিত ‘দীওয়ান-ই আযীয’ কাব্যগ্রন্থে প্রিয়নবীর প্রশংসাস্তুতি

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল নোমান

আল্লামা গাজী আজিজুল হক শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন অদ্বিতীয় আশেকে রাসূল। তাঁর পুরো জীবনটাই ছিলো হুব্বে রাসূলের মূর্তপ্রতীক। ক্বোরআন-হাদিসের বর্ণনানুসারে তিনি তাঁর জীবনে ধারণ করতেন ‘নবী প্রেমই আল্লাহ প্রাপ্তির পূর্বশর্ত।’ ইশকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা’আলার অগণিত নিয়ামতের মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ, অদ্বিতীয় ও অতুলনীয় অমূল্য রতন। যে ব্যক্তি এ নিয়ামতের অংশ পায়নি সে বড়ই হতভাগা। আর যে এ নিয়ামত লাভে ধন্য হয়েছে, সে বড়ই সৌভাগ্যশালী। নবীপ্রেমের এ শিক্ষাই তিনি আজীবন প্রচার করে যান। তাই তো নবীর প্রেমানলে জ্বলে তিনি প্রায় সময় বলতেন- ‘মাই তু বিমারে নবী হুঁ’ – অর্থাৎ, ‘আমি নবীপ্রেমের রোগী’। নবীপ্রেমে মত্ত হয়ে তিনি প্রিয়নবীর শানে ফার্সি ভাষায় রচনা করেন বহু না’তিয়া কালাম। যা তাঁর বিরচিত বিখ্যাত ‘দীওয়ান-ই- আযীয’ এ বিদ্যমান। তাঁর লিখিত না’তিয়া কালামগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এগুলোর একেকটি পংক্তি যেনো ক্বোরআন-হাদিসেরই সার-নির্যাস। যেহেতু ইমাম শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি আলায়হির ওফাত শরীফ ১২ রজব, তাই আলোচ্য নিবন্ধে ইমামের বেসাল শরীফের সংখ্যাতাত্ত্বিক মিলবন্ধন অনুসারে তাঁরই রচিত ‘দীওয়ান-ই- আযীয’ হতে নির্বাচিত ১২টি পংক্তির উচ্চারণ, অনুবাদ, কাব্যানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপনের প্রয়াস পাচ্ছি।
ইমাম শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বিরচিত ‘দীওয়ান-ই আযীয’ এর ‘দর না’তে ঊ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’ অংশ হতে নির্বাচিত ১২টি পংক্তি নিম্নরূপ

পংক্তি -১
محمد گر چہ از جنس بشر ہست
نظیرش در جہاں لیکن محال ست
উচ্চারণ: মুহাম্মদ গর ছেহ্ আয্ জিনসে বশর হাস্ত,
নযী-রশ দর জাহাঁ- লে-কিন মুহা-লাস্ত।
কাব্যানুবাদঃ যদিও নবীজী এসেছেন মানব রূপ ধরে উপমা তাঁর নাহি পাবে ত্রিভুবন জুড়ে। [হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যদিও মানব জাতির অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু তাঁর উপমা গোটা বিশ্বেও অসম্ভব]
ব্যাখ্যাঃ হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম মানব জাতির মধ্যেই শুভাগমন করেছেন। কিন্তু সমস্ত বিশ্ব জগতের মধ্যে তিনি অতুলনীয়, সৃষ্টিকুলের মাঝে না তাঁর মতো কেউ ছিল, না তাঁর মতো কেউ ভবিষ্যতে হবে। গোটা বিশ্ব জগতে তাঁর উপমা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।
হাদিসে পাকে সওমে বেচাল সংক্রান্ত বর্ণনায় নবীজি নিজেই স্বীয় অতুলনীয় সত্তার কথা তুলে ধরে ইরশাদ করেছেন, أَيُّكُمْ مِثْلِي إِنِّي أَبِيتُ يُطْعِمُنِي رَبِّي وَيَسْقِينِ
-তোমাদের মধ্যে আমার মতো কে আছো? আমি তো রাত্রি যাপন করি এমন অবস্থায় যে, আমার রব আমাকে পানাহার করান। [সহীহ বুখারী, হাদিস নং,৬৮৫১-]
إِنِّي لَسْتُ كَهَيْئَتِكُمْ إِنِّي يُطْعِمُنِي رَبِّي وَيَسْقِينِ আমি তোমাদের মত নই, আমার প্রতিপালক আমাকে পানাহার করান। [সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৯৬৪]
তাছাড়া হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, لم ارا قبله ولا بعده مثله -আমি হুযূর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের মতো না পূর্বে দেখেছি, না পরে।
[ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ঈসা তিরমিযী: শামায়েলে তিরমিযী]
সুতরাং, প্রমাণিত হলো, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম অতুলনীয় মহামানব। তাঁর উপমা বিরল। আলোচ্য প্রসঙ্গে ইমামে আহলে সুন্নাত, আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র জবানেও একই সুর অনুরণিত হয়। তিনি বলেন,
لَم یَاتِ نَظِیْرُکَ فِیْ نَظَرٍمثلِ تو نہ شُد پیدا جانا
جگ راج کو تاج تورے سرسو ہے تجھ کو شہ دَوسَرا جانا
উচ্চারণঃ
লাম ইয়াতি নাযিরুকা ফি নাযরিন, মিসলে তু না শুদ পয়দা জানা,
জগরাজ কো তাজ তুরে সার সু, হ্যায় তুঝ কো শাহে দোসরা জা-না।
ওহে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কোনো কালে কোনো দৃষ্টিতে আপনার সমতুল্য কেউ দেখেনি কখনো। ওহে প্রিয় হাবীব! আপনার সমকক্ষ কিছু সৃষ্টিই হয়নি। জগতের রাজত্বের রাজমুকুট আপনার শিরে শোভা পায়। এ জন্যই আমি আপনাকে উভয় জগতের রাজাধিরাজ স্বীকার করলাম।
[আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (র.), হাদায়েকে বখশিশ,পৃষ্ঠা-২১, খ–১, প্রকাশনায়: ইমাম আহমদ রেযা একাডেমী,দিল্লী, ভারত]

পংক্তি-২
وجود او کہ از نور خدا ہست
ز نور او ہمہ عالم ہویدہ است
উচ্চারণ: ওজূদে ঊ- কেহ্ আয্ নূ-রে খোদা- হাস্ত,
যে নূ-রে ঊ হামাহ্ ‘আলম হুয়াইদাহ্ আস্ত।
কাব্যানুবাদঃ সৃষ্টি যে তাঁর মহান খোদার অতুল নুরে, বিশ্বভুবন সৃজন হলো তাঁরই শাহী নুরে। [তাঁর সৃষ্টি হলো আল্লাহর পবিত্র নূর থেকে, তাঁরই নূর থেকে গোটা বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে।]
ব্যাখ্যা: ইমামে আহলে সুন্নাত বিরচিত একেকটি পংক্তি বাতিলদের জন্য ছিল শাণিত তরবারীস্বরূপ। ইমাম শেরে বাংলা বিরচিত উক্ত পংক্তিতে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত আক্বিদার কথা পরিপূর্ণভাবে ফুটে উঠেছে যে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম -এর সৃষ্টি হলো আল্লাহর পবিত্র নূর থেকে। অনাদি অনন্ত সত্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যখন একা ও অপ্রকাশিত ছিলেন, যখন তাঁর আত্মপ্রকাশের হলো। তখন তিনি একক সৃষ্টি হিসেবে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) -এর নূর মোবারক সৃষ্টি করলেন। তাইতো পবিত্র ক্বোরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন,
قَدْ جَاءَكُم مِّنَ اللهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُّبِينٌ
-নিশ্চয় তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা ‘নূর’ এবং সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে। [আল-ক্বোরআন, সূরা মায়েদা, ৫: ১৫]
আর তাঁর নূর হতেই গোটা বিশ্বজগৎ সৃষ্টি হয়েছে। ‘মুসান্নাফ’ কিতাবের লেখক ইমাম আব্দুর রাযযাক হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণনা করেন, তিনি ইরশাদ করছেন যে, আমি (জাবের রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু) আরজ করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)! আমার পিতা-মাতা আপনার উপর কুরবান হোক, আপনি আমাকে বলুন, সে জিনিসটি কি, যা আল্লাহ তা’আলা সকল কিছুর পূর্বে সৃষ্টি করেছেন? হুযূর আকরম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন, হে জাবের! নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা’আলা সর্বপ্রথম তোমার নবীর নূরকে স্বীয় নূর মোবারক হতে সৃষ্টি করেছেন। তারপর এ নূর আল্লাহর ইচ্ছা মোতাবেক পরিভ্রমণ করতে লাগলো। সে সময় না লওহ ছিল, না কলম ছিল, না জান্নাত, না জাহান্নাম, না ফেরেশতা, না আসমান, না জমিন, না সূর্য, না চন্দ্র, না জ্বিন, না ইনসান।অতঃপর আল্লাহ তা’আলা যখন সৃষ্টিজগত সৃষ্টি করার ইচ্ছা করলেন, তখন এ নূরকে চার অংশে ভাগ করলেন। প্রথম অংশ দ্বারা কলম বানালেন, দ্বিতীয় অংশ দ্বারা লওহ, তৃতীয় অংশ দ্বারা আরশ এবং চতুর্থ অংশকে আবার চারভাগে বিভক্ত করলেন। এটার প্রথম অংশ দ্বারা আরশ বহনকারী ফেরেশতা, দ্বিতীয় অংশ দ্বারা কুরসী, তৃতীয় অংশ দ্বারা অবশিষ্ট ফেরেশতাগণকে সৃষ্টি করলেন এবং চতুর্থ অংশকে আবার চারভাগ করেন। এভাবে অপরাপর সৃষ্টিরাজি সৃষ্টি করেন। [ইমাম আহমদ বিন হাম্বল এর উস্তাদ এবং ইমাম বুখারী ও মুসলিম এর উস্তাদ আব্দুর রাযযাক আবু বকর ইবনে হুযাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু স্বীয় গ্রন্থ “মুসান্নাফ” এ এই হাদীস বর্ণনা করেন। তাছাড়া আরো বিদ্যমান আছে, আল্লামা কুস্তালানী, মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যহ, ১ম খ-, পৃষ্ঠা-৫৫, আল্লামা আলূসী বাগদাদী, তাফসীরে রুহুল মা’আনী,পারা -১০, পৃষ্ঠা -৯৬]

পংক্তি-৩
نبودہ سایہ در ذات محمد- ہمہ عالم بسائہ محمد
উচ্চারণ: নাবূ-দাহ্ সা-য়াহ্ দর যা-তে মুহাম্মদ,
হামাহ্ ‘আলম ব সা-য়াহ্ -এ মুহাম্মদ।
কাব্যানুবাদঃ নাহি ছিল ছায়া কোনো তাঁরই শরীরে, অথচ সারা জগত তাঁরই ছায়াসম চাদরে। [হুযূর মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সত্তা মুবারকের ছায়া ছিলো না, অথচ গোটা বিশ্ব তাঁরই ছায়াতলে।]
ব্যাখ্যাঃ আলোচ্য পংক্তিতে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আরেকটি আক্বিদা স্পষ্ট হলো যে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র নূরাণী কায়া মোবারকের ছায়া ছিল না, যা হাদিসে পাক দ্বারা স্বীকৃত। যেমন – لم يكن له صلي الله عليه وسلم ظل في شمس ولا قمر لانه كان نورا –
সূর্য চন্দ্রের আলোতে নবী কারিম (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর কায়া মোবারকের ছায়া পড়তো না। কেননা, তিনি ছিলেন আপাদমস্তক নূর।
[যারকানী শরীফ, ৪র্থ খ-, ২২০ পৃষ্টা।] ইমাম কাযী আয়ায মালেকী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির ‘আশ-শিফা’ গ্রন্থে বলেন, انه كان لا ظل لشخصه في شمس ولا قمر لانه كان نورا- দিনের সূর্যের আলো কিংবা রাত্রের চাঁদের আলো- কোনটিতেই হুযূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর শরীর মোবারকের ছায়া পড়ত না। কারণ, তিনি ছিলেন, আপাদমস্তক নূর। [শিফা শরীফ, খ–১, পৃষ্ঠা- ২৪২]
বিভিন্ন গ্রন্থে এ ধরণের অসংখ্য বর্ণনা বিদ্যমান। আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলায়হি যথার্থই বলেছেন, تو ہے سایہ نور کا ہر عُضْو ٹکڑا نور کا سایہ کا سایہ نہ ہوتا ہے نہ سایہ نور کا হে প্রিয় রাসূল! আপনি তো আল্লাহর নূরের প্রতিচ্ছবি বা ছায়া। আপনার প্রত্যেকটি অঙ্গই একেকটি নূরের টুকরা। নূরের যেমন ছায়া হয় না, তদ্রূপ ছায়ারও প্রতিচ্ছায়া হয় না। সুতরাং আপনারও প্রতিচ্ছায়া নেই। কেননা, আপনি নূর এবং আল্লাহর নূরের ছায়া। [আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (র.), হাদায়েকে বখশিশ, পৃষ্ঠা-৪, খ–২, প্রকাশনায়: ইমাম আহমদ রেযা একাডেমী, দিল্লী, ভারত] আর ছায়াহীন কায়াধর প্রিয় রাসূলের রহমতের ছায়াতলেই আমাদের আশ্রয়। কেননা মহান আল্লাহ ইরশাদ করছেন, وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ আমি আপনাকে জগতসমূহের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি। [ আল-ক্বোরআন, সূরা আম্বিয়া, ২১:১০৭] যেহেতু রহমত ব্যতীত সৃষ্টির অস্তিত্ব কল্পনাতীত, সেহেতু সমগ্র জগৎ তাঁর রহমতের গ-িতে প্রবিষ্ট হয়ে এখনো চলমান ও সক্রিয় রয়েছে। তিনি সমস্ত জগতের প্রাণ ও চালিকাশক্তি। তিনি অস্তিত্বহীন হলে জগতের অস্তিত্ব নিমিষেই বিলীন হয়ে যেত। তাই এক কথায় আমরা প্রিয়নবী রাহমাতুল্লিল আলামীনের রহমতের ছায়াতলে আবদ্ধ আছি। আ’লা হযরত চমৎকার বলেছেন,
وہی نورِ حق وہی ظلِّ ربّ ہے انہیں سے سب ہے انہیں کا سب نہیں ان کی مِلک میں آسماں کہ زمیں نہیں کہ زماں نہیں
উচ্চারণ: উঅহী নূরে হক উঅহী যিল্লে রব, হ্যায় উনহী সে সব, হ্যায় উনহী কা সব নেহী উনকী মিল্ক মে আসমাঁ, কেহ্ যমীঁ নেহীঁ, কেহ্ যমাঁ নেহীঁ।
হুযূর আনওয়ার সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম হলেন খোদায়ী নূরের জ্যোতি। তিনি কুদরতের প্রতিচ্ছায়া। তাঁর থেকেই সবকিছু, তাঁরই মালিকানায় সব। শুধু কি তা; বরং আসমান, যমীন, কি যমানা, কী নয় তাঁর কব্জায়? (স্বয়ং স্রষ্টাই যে তাঁর মালিকানায় দিয়েছেন নিজ সৃষ্টি জগৎ।)
[আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (র.), হাদায়েকে বখশিশ, পৃষ্ঠা-৬৬, খ–১, প্রকাশনায়: ইমাম আহমদ রেযা একাডেমী,দিল্লী, ভারত]

পংক্তি-৪
ہمہ مردم مثال سنگ خارا -چو یاقوت است بدانی مصطفیٰ را
উচ্চারণ: হামাহ্ মরদুম মেসা-লে সঙ্গে খা-রা,
ছূ- ইয়া-কূ-ত আস্ত বেদা-নী- মুস্তফা- রা।
কাব্যানুবাদঃ সব মানুষই তুলনীয় যেন কঠিন পাথরে, নবীজীর সত্ত্বা জেনো পদ্মরাগমণি ওরে। [সকল মানুষ শক্ত পাথরের মতোই, আর পদ্মারাগমণির মতোই জেনে রেখো হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র সত্তাকে।]
ব্যাখ্যাঃ অনেক হতভাগাই প্রিয়নবীকে মানব জাতিতে শুভাগমন করায়, নিজের মতো সাধারণ মনে করে, নাঊযুবিল্লাহ! তাদের জবাবে ইমামে আহলে সুন্নাতের এই পংক্তি যথার্থ। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মানবজাতিতে শুভাগমন করলেও তিনি অতুলনীয় ও মর্যাদাধর সত্তা। তিনি নিজেই বলেন,
انا أكرم ولد آدم علي ربي ولا فخر আমি আদম সন্তানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ,আল্লাহর নিকট সর্বাপেক্ষা সম্মানিত এবং এটা গর্ব নয়।
[ইমাম তিরমিযী, জামে আত-তিরমিযী, পৃষ্ঠা-২০২, কিতাবুল মানাকিক]
তাঁর এই শান-মান ও মর্যাদা স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাই বৃদ্ধি করেছেন। আর এখানে ‘ইয়াকুত’ পাথরের উদাহরণ দিয়ে মানব জাতির মধ্যে প্রিয়নবীর অতুলনীয় সত্তার জানান দেওয়া হয়েছে। কেননা, পাথর বিশারদগণ অবগত আছেন যে, সব পাথর একই ধরণের নয়। রাস্তার ধারে পড়ে থাকা সাধারণ শক্ত পাথর আর স্বর্ণ ও ডায়মন্ড ইত্যাদি দামী জিনিসের গুনাগুণ নিখুঁত ও খাঁটি কি না? তা নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত কষ্ঠিপাথর কাষ্মিনকালেও সমান হতে পারে না। ‘ইয়াকুত’ এক বিরল ও দুর্লভ পাথর, যা সহজলভ্য নয়। তাই ‘ইয়াকুত’ পাথরের সাথে অন্য পাথর তুলনীয় নয়। সত্তাগতভাবে পাথর হওয়ার পরও এ ধরনের পাথরের সাথে অন্য পাথরের তুলনা অসম্ভব। একইভাবে মানব জাতিতে শুভাগমন করলেও তাঁর সাথে অন্য কোনো মানুষের তুলনা অসম্ভব। কোনো এক আরবি কবি চমৎকার বলেছেন, ﻣﺤﻤﺪ ﺑﺸﺮ ﻟﻴﺲ ﻛﺎﻟﺒﺸﺮ، ﻳﺎﻗﻮﺕ ﺣﺠﺮ ﻟﻴﺲ ﻛﺎﻟﺤﺠﺮ
হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাশার, তবে তিনি অন্য সাধারণ বাশারের মত নন, যেভাবে ইয়াকুত পাথর পাথর বটে, অন্য সাধারণ পাথরের মত নয়। ইমামে আহলে সুন্নাতের আলোচ্য পংক্তিটি যেনো উপরোক্ত আরবি কাব্য পংক্তির ফার্সি রূপ। উল্লেখ্য, অনেককেই দেখা যায়, যারা আমাদের প্রিয়নবীসহ সম্মানিত নবী-রাসূলগনকে দোষে-গুণে মানুষ বলে দোষ-ত্রুটির কালিমা লেপন করে ক্রুটিযুক্ত বানানোর অপচেষ্ঠায় লিপ্ত। হতে পারে সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের জীবন ভুল-ভ্রান্তি ও দোষে ও গুনাহে ভরা। কিন্তু আল্লাহর পেয়ারা মাহবুবসহ সকল সম্মানিত নবী-রাসূলগন এগুলোর উর্ধ্বে। তারা দোষ-ত্রুটি ও গুনাহ হতে মুক্ত। আর আমাদের প্রিয়নবী তো সামগ্রিকভাবে অতুলনীয় মহামানব। নবুয়তের পূর্বাপর সর্বাবস্থায় তিনি পাপ-পক্সিক্ষলতা মুক্ত ছিলেন। তাই ইসলামী আক্বিদাহ হলো, الانبياء عليهم الصلاة والسلام كلهم منزهون عن الصغائر و الكبائر সম্মানিত নবীগণ আলায়হিমুস সালাম সর্বপ্রকার ছোট-বড় গুনাহ হতে পুতঃপবিত্র। [আল-ফিকহুল আকবর, কৃত: ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, আক্বিদা নং-১৩ নং]
আর নিষ্কলুষতার অধিকারী সম্মানিত নবী-রাসূলগণকে নিজেদের মতো মনে করাকে আল্লাহ কাফিরদের চরিত্র বলে আখ্যায়িত করেছেন। কেননা তারা বলতো- مَا أَنْتُمْ إِلَّا بَشَرٌ مِثْلُنَا আপনি তো আমাদের মতো মানুষ। [আল-ক্বোরআন, সূরা ইয়াসিন, ৩৬: ১৫]
এক কথায় বলতে গেলে, আমাদের নবী মানুষ; তবে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ নন। প্রখ্যাত আশেক কবি ইমাম শরফুদ্দীন বুসীরী বিরচিত বিশ্ববিখ্যাত ‘কসিদায়ে বুরদা’ শরীফের একটি পংক্তি উপরোক্ত আলোচনার সারমর্ম বলে মনে করি। সেটি হলো, فَمَبلَغُ الْعِلْمِ فِيْهِ انَّهُ بشَر وَانَّهُ خيْر خلْقِ اللهِ كُلِّهِمِ
তাঁর (প্রিয়নবী) সম্পর্কে যতদূর জানা গেছে তা হল, তিনি একজন মানুষ এবং আল্লাহর সকল সৃষ্টির সেরা অতুলনীয়।

পংক্তি-৫
ندا کردن بآں اسم محمد -صریح ممنوع بتنزل محمد
উচ্চারণ: নেদা- করদন বআঁ- ইসমে মুহাম্মদ,
সরী-হ্ মামনূ-‘ ব তানযী-লে মুহাম্মদ।
কাব্যানুবাদঃ নিষিদ্ধ তাঁরে ডাকা ‘মুহাম্মদ’ নাম ধরে, তাঁরই উপর অবতীর্ণ ক্বোরআন অনুসারে। [‘মুহাম্মদ’ নাম ধরে ডাকা-স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ, হুযূর মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর অবতীর্ণ বিধানানুসারে।]
ব্যাখ্যাঃ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজেদের মতো করে আহবান করাকে আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। নিম্নোক্ত আয়াতে কারীমায় ইরশাদ হয়েছে, لَا تَجْعَلُوا دُعَاءَ الرَّسُولِ بَيْنَكُمْ كَدُعَاءِ بَعْضِكُمْ بَعْضًا ۚ রাসূলের আহবানকে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে তেমনই স্থির করো না, যেমন তোমরা একে অপরকে ডাক। [আল-ক্বোরআন, সূরা আন-নূর ২৪:৬৩]
এমনকি তিনি কারো বাবা, ছেলে, জামাতা, শ্বশুর ইত্যাদি নন। এভাবেও সাধারণভাবে তাকে আহবান করা যাবে না তাইতো মহান আল্লাহ সুস্পষ্টভভাবে বলে দিয়েছেন, مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَآ أَحَدٍۢ مِّن رِّجَالِكُمْ وَلَٰكِن رَّسُولَ ٱللهِ وَخَاتَمَ ٱلنَّبِيِّنَ ۗ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তোমাদের কারো পিতা নন;বরং তিনি আল্লাহর রাসূল ও শেষ নবী। [আল-ক্বোরআন,সূরা আহযাব,৩৩:৪০]
এভাবে পবিত্র ক্বোরআন মাজীদে আরো ইরশাদ হয়েছে, وَلَا تَجْهَرُواْ لَهُۥ بِٱلْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَن تَحْبَطَ أَعْمَٰلُكُمْ وَأَنتُمْ لَا تَشْعُرُونَ
নিজেদের মধ্যে যেভাবে উচ্চস্বরে কথা বল, তাঁর (রাসূলের) সাথে সেভাবে উচ্চস্বরে কথা বলো না। কারণ, এতে অজ্ঞতাসারে তোমাদের কর্ম নিষ্ফল হয়ে যাবে। [আল-ক্বোরআন, সূরা হুজরাত, ৪৯:২]
‘ইবারাতুন নস’ দ্বারা প্রমাণিত হলো, প্রিয় নবীজিকে নাম ধরে বা সাধারণ মানুষকে আহবানের ন্যায় ডাকা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। এতে আমল নষ্টের হুঁশিয়ারীও প্রদান করেন মহান আল্লাহ তা’আলা। ইমামে আহলে সুন্নাত আলোচ্য ইসলামী আক্বিদা উক্ত কাব্য পংক্তির মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন।

পংক্তি-৬
حیات طیبہ اش بے بہا داں -بآں سو گند خدا کردہ بقرآں
উচ্চারণ: হায়া-তে ত্বাইয়্যেবাহ্ আশ্ বে- বাহা- দাঁ-,
বআঁ- সৌ গন্দ খোদা- করদাহ্ ব ক্বোরআঁ।
কাব্যানুবাদঃ হায়াত তাঁরই অমূল্য যে রেখো স্মরণ ওরে, মহান খোদা ক্বোরআনেতে তাঁরই কসম করে। [জেনে রেখো! তাঁর পবিত্র হায়াত হচ্ছে অমূল্য। এ কারণে, এ নামে মহান আল্লাহ ক্বোরআন মাজীদে শপথ করেছেন।] ব্যাখ্যাঃ ইমামে আহলে সুন্নাত বিরচিত এই পংক্তিতে প্রতিভাত হলো, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বরকতময় হায়াত আল্লাহর খুবই পছন্দনীয় এবং ঈমানদ্বারগণের জন্য বেশ উপকারী। মহান আল্লাহ পবিত্র ক্বোরআনে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র হায়াতের শপথ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, لَعَمْرُكَ إِنَّهُمْ لَفِي سَكْرَتِهِمْ يَعْمَهُونَ হে মাহবুব আপনার জীবন শপথ! নিশ্চয় তারা আপন নেশায় উদ্দেশ্যহীনভাবে বিচরণ করছে। [আল-ক্বোরআন, সূরা হিজর, ১৫: ৭২]
ইমাম কাযী আয়ায মালেকী তাঁর অনন্য সংকলন ‘আশ-শিফা’ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে বিশদ বর্ণনা দেন। তিনি হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মন্তব্য সরাসরি তার গ্রন্থে আলেকপাত করেন, তিনি বলেন,আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টজীবের মধ্যে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম -এর চেয়ে অধিক মর্যাদাবান কাউকে তিনি সৃষ্টি করেন নি। তিনিই হলেন তাঁর কাছে অধিক মর্যাদার অধিকারী। কেননা আল্লাহ তা’আলা তাঁর হাবীবের পবিত্র জীবনের শপথ করেছেন। আল্লাহ অন্য কোনো সৃষ্টজীবের জীবনের শপথ করেন নি।
[ইমাম কাযী আয়ায মালেকী, আশ-শিফা, ‘হুযুর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম -এর শানে আল্লাহ তা’আলার শপথ করা’ শীর্ষক পরিচ্ছেদ, খ–১।]
ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হির একটি কাব্য পংক্তিতে উপরোক্ত আলোচনার আভাস পাওয়া যায়। তিনি বলেন,
وہ خدا نے ہے مرتبہ تجھ کو دیا نہ کسِی کو ملے نہ کسی کو ملا کہ
کلامِ مجید نے کھائی شہا تِرے شہر و کلام و بقا کی قسم
উচ্চারণ: উঅহ খোদা নে হ্যায় মর্তবা তুঝ্ কো দিয়া, নাহ্ কিসী কো মিলে নাহ্ কিসী কো মিলা কেহ্ কালামে মজীদ নে খাঈ শাহা, তেরে শাহ্ র ও কালাম ও বক্বা কী ক্বসম। – হে রাসূল! খোদা আপনাকে ওই মর্যাদা দিয়েছেন, যা না কারো ভাগ্যে মিলবে না মিলেছে। আল্লাহর ক্বোরআন মাজীদ তো কসম খেয়েছে আপনার শহর, আপনার প্রিয় বচন,আপনার প্রিয় জীবনের। [আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (র.), হাদায়েকে বখশিশ, পৃষ্ঠা-৪৭,
খ–১, প্রকাশনায়: ইমাম আহমদ রেযা একাডেমী,দিল্লী, ভারত]

[আগামী সংখ্যায় সমাপ্য]

লেখক: বিশিষ্ট না’তখাঁ ও প্রচার সম্পাদক আ’লা হযরত ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।

Share:

Leave Your Comment