পর্দা প্রথা নারীর সতীত্ব সংরক্ষনের গুরুত্বপূর্ন অবলম্বন

পর্দা প্রথা নারীর সতীত্ব সংরক্ষনের গুরুত্বপূর্ন অবলম্বন

অধ্যক্ষ হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী

بسم الله الرحمن الرحيم
وَمِنْ دُوْنِهِمَا جَنَّتٰنِ(৬২( فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ(৬৩( مُدْهَآ مَّتٰنِ(৬৪( فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ(৬৫( فِیْهِمَا عَیْنٰنِ نَضَّاخَتٰنِ (৬৬( فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ (৬৭( فِیْهِمَا فَاكِهَةٌ وَّنَخْلٌ وَّرُمَّانٌ(৬৮( فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ(৬৯( فِیْهِنَّ خَیْرٰتٌ حِسَانٌ(৭০( فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ(৭১( حُوْرٌ مَّقْصُوْرٰتٌ فِی الْخِیَامِ (৭২( فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ (৭৩( لَمْ یَطْمِثْهُنَّ اِنْسٌ قَبْلَهُمْ وَلَا جَآنٌّ (৭৪( فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ (৭৫( مُتَّكِـٕیْنَ عَلٰى رَفْرَفٍ خُضْرٍ وَّ عَبْقَرِیٍّ حِسَانٍ(৭৬( فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ(৭৭ ( تَبٰرَكَ اسْمُ رَبِّكَ ذِی الْجَلٰلِ وَالْاِكْرَامِ (৭৮(

তরজমা: এবং (উপরোক্ত) ওই দুটি ব্যতীত আরো দুটি জান্নাত রয়েছে। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন অনুগ্রহ কে অস্বীকার করবে? এ জান্নাত দুটির মধ্যে গাঢ় সবুজ থেকে কালো বর্ণের ঝলক বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন অবদানকে অস্বীকার করবে? ওই দুটিতে দুটি প্র¯্রবন রয়েছে উচ্ছলিত। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন অবদানকে অস্বীকার করবে? ওই দুটিতে রয়েছে ফলমূল, খেজুর সমূহ এবং আনার সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন অবদানকে অস্বীকার করবে? সেগুলোর মধ্যে রয়েছে স্ত্রীগণ-অভ্যাসে সতী, আকৃতিতে সুন্দর। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন অবদানকে অস্বীকার করবে? হুরসমূহ রয়েছে-যাঁরা শুধু তাবু সমূহের মধ্যে অবস্থান করেন। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন অবদানকে অস্বীকার করবে? কোন মানব ও জীন পূর্বে তাদেরকে স্পর্শ করেনি। অতএব তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন অবদান কে অস্বীকার করবে? তারা সবুজ বিছানাসমূহ ও কারুকার্যকৃত সুন্দর চাদর সমূহের উপর হেলান দিয়ে বসবে। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন অবদান কে অস্বীকার করবে? মহা বরকতময় আপনার প্রতিপালকের নাম, যিনি মহিমাময় ও মহানুভব। (সূরা আর-রহমান, ৬২-৭৮ আয়াত)

আনুষঙ্গিক আলোচনা
حُورٌ مَّقْصُورَاتٌ فِي الْخِيَامِ : অর্থাৎ ‘হুর সমূহ রয়েছে, যাঁরা শুধু তাবু সমূহের মধ্যে অবস্থান করেন।’ আল্লাহ রব্বুল আলামীনের এ বাণীর ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন-বেহেশতী হুরগণের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হলো তাঁরা নিজেদের জন্য নির্ধারিত জান্নাতী গৃহ সমূহে অবস্থান করেন। স্বামীদের উপর তাঁদের দৃষ্টিপাত নিবদ্ধ থাকে। অন্যান্য পুরুষের প্রতি তাঁরা দৃষ্টিপাত করেননা। এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ মুমিন নারীদের প্রতি পর্দাশীল হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। পর্দা প্রথা বেহেশতী নেয়ামত। এটা নির্লজ্জতা দমন ও সতীত্ব সংরক্ষনের একটি গুরুত্বপূর্ন অবলম্বন আর বেপর্দা হওয়া জাহান্নামের বৈশিষ্ট্য। (নাউজুবিল্লাহ) সূরা আন-নূর এর ৩১নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে- وَقُل لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا ۖ وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ (ও হে রাসূল আপনি মুমিন নারীদের কে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাজত করে। তারা যেন যা সাধারণত: প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথায় ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে।
وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا এর ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছন- زينت মানে ঐ বস্তু যা দ্বারা মানুষ নিজেকে সুসজ্জিত ও সুদৃশ্য করে। অধিকাংশ তাফসীর বিশারদ আলোচ্য আয়াতে زينت এর অর্থ গ্রহণ করেছেন-সাজ-সজ্জার স্থান। অর্থাৎ যে সব অঙ্গে সাজ-সজ্জার অলংকার ইত্যাদি পরিধান করা হয়। অতএব আয়াতের অর্থ এই যে, সাজ-সজ্জার স্থান সমূহ প্রকাশ না করা মহিলাদের উপর ওয়াজিব। (তাফসীরে রূহুল মায়ানী)
কাজী নাসিরুদ্দীন বায়জাভী রাহ. এবং ‘খাযেন’ এ আয়াতের তাফসীরে বলেন: মুমিন নারীর আসল বিধান এই যে, সে তার সাজ-সজ্জার কোন কিছুই প্রকাশ করবে না। আয়াতের উদ্দেশ্য তাই মনে হয়। তবে চলাফেরা ও কার্যক্রম পরিচালনায় স্বভাবত: যে গুলো খুলে যায়, সে গুলো প্রকাশ করতে পারবে। বোরকা, চাদর, মুখমন্ডল ও হাতের তালু এগুলোর অন্তর্ভুক্ত। নারী কোন প্রয়োজনে বাইরে বের হলে বোরকা, চাদর ইত্যাদি প্রকাশ হয়ে পড়ো সুনির্দিষ্ট। লেন-দেনের প্রয়োজনে কোন সময় মুখমন্ডল ও হাতের তালু ও প্রকাশ হয়ে পড়ে। এটাও ক্ষমার্হ-গুনাহ নয়। কিন্তু এ আয়াতের মর্মবাণী থেকে কোথাও প্রমাণিত হয় না যে, বিনা প্রয়োজনে নারীর মুখমন্ডল ও হাতের তালু দেখা পুরুষের জন্য জায়েজ। বরং পুরুষদের জন্য দৃষ্টি নত রাখার বিধানই প্রযোজ্য। যদি নারী কোথাও মুখমন্ডল ও হাত খুলতে বাধ্য হয় তবে শরিয়ত সম্মত ওযর ও প্রয়োজন ব্যতীত তার দিকে না দেখা পুরুষদের জন্য অপরিহার্য। সাইয়্যেদুনা ইমাম মালেক (রহ.)এর প্রসিদ্ধ মাযহাবও এই যে, বেগানা নারীর মুখমন্ডল ও হাতের তালু দেখাও বিনা প্রয়োজনে জায়েজ নয়। ‘যাওয়াজের’ গ্রন্থে ইবনে হাজর মক্কী শাফেয়ী (রহ.) ইমাম শাফেয়ী (রহ.) এর ও এই মাযহাব বর্ননা করেছেন। নারীর মুখমন্ডল ও হাতের তালু গোপন অঙ্গের অন্তর্ভূক্ত নয়। এ গুলো খোলা অবস্থায় ও নাজায়েজ হয়ে যায়। কিন্তু বেগানা পুরুষের জন্য এগুলো দেখা শরিয়তসম্মত প্রয়োজন ব্যতিরেকে জায়েজ নয়। পূর্বে বলা হয়েছে যে, যেসব ফিকাহ শাস্ত্রবিদের মতে মুখমন্ডল ও হাতের তালু দেখা জায়েজ, তারাও এ বিষয়ে একমত যে, অনর্থক দেখা দেয়ার আশংকা থাকলে মুখমন্ডল ইত্যাদি দেখাও নাজায়েজ। বলাবহুল্য, মানুষের মুখমন্ডলই সৌন্দর্য ও শোভার আসল কেন্দ্র। এটা অনর্থ, ফ্যাসাদ, কামাধিক্য ও গাফিলতির যুগ। তাই বিশেষ প্রয়োজন যেমন চিকিৎসা অথবা তীব্র বিপদাশঙ্কা ছাড়া বেগানা পুরুষের সামনে ইচ্ছাকৃতভাবে মুখমন্ডল খোলা নারীর জন্য নিষিদ্ধ এবং তার দিকে ইচ্ছাকৃতভাবে দৃষ্টিপাত করা ও বিনা প্রয়োজনে পুরুষদের জন্য জায়েজ নয়।

: وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ
মহান আল্লাহর পবিত্র বাণী ‘তারা অর্থাৎ নারীরা যেন বক্ষদেশে ওড়না ফেলে রাখে।’ এর ব্যাখ্যায় তাফসীর শাস্ত্র বিশারদগণ উল্লেখ করেছেন- আরবি ‘خمر’ পদটি خمار এর বহুবচন। অর্থ ঐ কাপড়, যা নারী মস্তকের উপর ব্যবহার করে এবং তদ্ধারা গলা ও বক্ষ আচ্ছাদিত হয়ে যায়। আর আরবি جيوب শব্দটি جيب এর বহুবচন। এর অর্থ জামার কলার। প্রাচীন কাল থেকে জামার কলার বক্ষদেশ থাকাই প্রচলিত। তাই জামার কলার আবৃত করার অর্থ বক্ষদেশ আবৃত করা।
আলোচ্য আয়াতের শুরুতে সাজ-সজ্জা প্রকাশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। আর উপরোক্ত আয়াতাংশে সাজ-সজ্জা গোপন করার তাকিদ এবং একটা প্রকার বর্ণনা করা হয়েছে। এর আসল কারণ জাহেলী যুগের একটি প্রথার বিলোপ সাধন করা। সে যুগে নারীরা ওড়না মাথার উপর ফেলে তার দুই প্রান্ত পৃষ্ঠদেশে ফেলে রাখত। ফলে গলা , বক্ষদেশ ও কান অনাবৃত থাকত। তাই মুমিন নারীদেরকে আদেশ করা হয়েছে তারা যেন এরূপ না করে। বরং ওড়নার উভয় প্রান্ত পরস্পর উলটিয়ে রাখে, এতে সকল অঙ্গ আবৃত হয়ে পড়ে। (তাফসিরে রুহুল মায়ানী)
অতএব দ্বিতীয় ব্যতিক্রম এমন পুরুষদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে, যাদের কাছে শরিয়তের পর্দা নেই। এই পর্দা না থাকার দ্বিবিধ কারণ। (এক) যে সব পুরুষকে ব্যতিক্রমভুক্ত করা হয়েছে, তাদের তরফ থেকে কোন অনর্থের আশংকা নেই। তারা মুহরেম। মহান আল্লাহ তাদের স্বভাবকে দৃষ্টিগতভাবে এমন করেছেন, তারা এসব নারীর সতীত্ব সংরক্ষন করে। স্বয়ং তাদের পক্ষ থেকে কোন অনর্থের সম্ভাবনা নেই। (দুই) সদা সর্বদা এক জায়গায় বসবাসের কারণে প্রয়োজনে ও মানুষ পরষ্পরের প্রতি সহজ ও সরল হয়ে থাকে। স্মর্তব্য যে, স্বামী ব্যতীত অন্যান্য মুহরেম কে যে ব্যতিক্রমভূক্ত করা হয়েছে এটা পর্দার বিধান থেকে ব্যতিক্রম – গোপন অঙ্গ আবৃত রাখা থেকে ব্যতিক্রম নয়। নারীর যে গোপন অঙ্গ নামাযে খোলা রাখা জায়েয নয়, তা দেখা মুহরেমদের জন্যও জায়েজ নয়।
সূরা আল আহযাব এর ৫৯ আয়াতে এরশাদ হয়েছে
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُل لِّأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِن جَلَابِيبِهِنَّ ۚ ذَٰلِكَ أَدْنَىٰ أَن يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ ۗ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَّحِيمًا
অর্থাৎ ওহে নবী (দ.) আপনি আপনার বিবিগণ, কন্যাগন এবং মুমিনদের স্ত্রীগন কে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দাংশ নিজেদের উপর যেন টেনে নেয়। এতে তাদের কে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল ও দয়াপরবশ।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম বলেছেন- جلابيب শব্দটি আরবি جلباب এর বহুবচন। অর্থ বিশেষ ধরনের লম্বা চাদর। এ চাদরের আকার-অকৃতি সম্পর্কে হযরত ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন-এই চাদর ওড়নার উপর পরিধান করা হয়। ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সীরীন (রহ.) বলেন-আমি হযরত ওবায়দা সালমানী (রহ.) কে এ আয়াতের উদ্দেশ্য এবং জিলবাবের আকার-আকৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি মস্তকের উপর দিক থেকে চাদর মুখমন্ডলের উপর লটকিয়ে মুখমন্ডল ঢেকে ফেললেন এবং কেবল বামচক্ষু খোলা রেখে এর তাফসীর কার্যত: দেখিয়ে দিলেন।
বলা বাহুল্য এ আয়াত স্বাধীন নারীগণকে এক বিশেষ ধরনের পর্দার আদেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা মস্তকের উপর দিক থেকে চাদর লটকিয়ে মুখমন্ডল ঢেকে ফেলবে, যাতে সাধারণ বাদীদের থেকে তাদের স্বাতন্ত্র্য ফুঠে উঠে এবং দুষ্টদের কবল থেকে নিরাপদ হয়ে যায়। উল্লেখিত বর্ননায় এ কথাটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, এর অর্থ এরূপ কখনও নয় যে, ইসলাম সতীত্ব সংরক্ষনে স্বাধীন নারী ও বাদীর মাঝে কোনরূপ পার্থক্য করেছে এবং স্বাধীন নারীদের সতীত্ব সংরক্ষন করে বাদীদের ছেড়ে দিয়েছে। বরং প্রকতপক্ষে এই পার্থক্য লম্পটরাই করে রেখেছিল। তারা স্বাধীন নারীদের উপর হস্তক্ষেপ করার দুঃসাহস করত না। কিন্তু বাদীদের কে উত্যক্ত করতে দ্বিধা করত না। শরীয়ত তাদের সৃষ্ট পার্থক্য কে এভাবে কাজে লাগিয়েছে যে অধিকাংশ নারী তাদেরই স্বীকৃত নীতির মাধ্যমে আপনা-আপনি নিরাপদ হয়ে গেছে। এখন বাদীদের সতীত্ব সংরক্ষনের ব্যাপারটিও ইসলামে স্বাধীন নারীদের অনুরূপ ফরজ ও জরুরী।

লেখক: অধ্যক্ষ, কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা, মুহাম্মদপুর, এফ ব্লক, ঢাকা।

Share:

Leave Your Comment