আলহাজ্ব মুহাম্মদ আমিনুর রহমান আলকাদেরী

আলহাজ্ব মুহাম্মদ আমিনুর রহমান আলকাদেরী

তরজুমান ডেস্ক
যারা মানব কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করতে পেরেছেন তাঁরাই উৎকৃষ্ট ব্যক্তি। তাঁরা চিরকাল মানব সমাজে স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে থাকেন। জীবনের চারিত্রিক মাধুর্য সৃষ্টিকুলের প্রতি ভালবাসা ও দায়বদ্ধতা সর্বোপরি স্রষ্টার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য, আপন মুর্শিদের প্রতি নিবেদিত প্রশ্নাতীত আত্মসমর্পণ প্রভৃতি গুণাবলী মানুষকে অমর করে রাখে। আল্লাহ্ ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর সন্তুষ্টি লাভের লক্ষ্যে আপন মুর্শিদে বরহকের নির্দেশনা অনুসরণ করেন। এমন সফলকাম ব্যক্তিত্ব সমাজের সর্বস্তরে বরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়। দুনিয়াবী সকল অর্জনের চেয়ে আখিরাতের প্রাপ্তি অনেক বেশী কাম্য ও মূল্যবান মনে করে যাঁরা আপন মুর্শিদের সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হন তাঁরাই হলেন প্রকৃত মানুষ। এমন একজন গুণী ব্যক্তিত্ব আলহাজ্ব মুহাম্মদ আমিনুর রহমান আলকাদেরি (রহ.)। যিনি আপন পীরের সান্নিধ্য, অনুসরণ-অনুকরণে ত্যাগী জীবন-যাপনে ছিলেন দীপ্যমান। তাঁর জীবনালেখ্য আলোচনার প্রয়াস।

১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুলাই বর্তমান চান্দগাঁও থানাধীন খোলাপাড়া গ্রামের হাশিম মহল্লাদার বাড়ির ব্যবসায়ী মরহুম আবদুল জলিল ও মরহুমা রাইসুন্নেসা বেগমের ঔরসে এক শুভ মুহূর্তে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা কাপড়ের ব্যবসায়ী ছিলেন। চকবাজারে তাঁর একটা কাপড়ের দোকান ছিল। মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। পিতার সংসারে তাঁর এক সৎভাই ও একজন সৎবোন ছিল। আর্থিক দৈন্যতায় শৈশবে তাঁর পড়া-লেখা বন্ধ হয়ে যায়। সাবেক ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে (বর্তমান হাজি মুহাম্মদ মহসিন কলেজে) অষ্টম শ্রেণি হতে পাঠ চুকিয়ে ব্যবসায় মনোযোগী হন। কৈশোরেই ব্যবসায়ে ধাপে ধাপে উন্নতি করে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে খাতুনগঞ্জে কাপড়ের দোকান দেন। বিভিন্নমুখী ব্যবসা পরিচালনা করে তিনি যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেন। সম্প্রসারিত ব্যবসায় তাঁর বড় ছেলে মরহুম আলহাজ্ব মুস্তাফিজুর রহমান সম্পৃক্ত হলে তিনি দ্বীন, মাজহাব-মিল্লাত ও সমাজ সেবায় মনোনিবেশ করেন। সামাজিক ও ধর্মীয় কাজে তাঁকে সবসময় পাওয়া যেত। তাঁর জ্যৈষ্ঠ সন্তান মরহুম মুস্তাফিজুর রহমান খাতুনগঞ্জের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। ধার্মিক পরিবারের সন্তান বিধায় তিনি ধর্মীয় কাজে আকৃষ্ট হতেন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের কোন এক সময় শরীয়ত তরীক্বতের মহান পথপ্রদর্শক সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়ার কান্ডারী মহান আধ্যাত্মিক সাধক আওলাদে রাসূল হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব হাফেজ সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি আলায়হির পবিত্র দস্ত মুবারকে হাত রেখে ‘বাইআত’ গ্রহণ করেন। ‘বাইআত’ গ্রহণের পর হতে তিনি দ্বীন মাযহাব মিল্লাতের খেদমতে ক্রমশ নিজেকে অধিকতর সম্পৃক্ত করতে থাকেন। আনজুমান, জামেয়া সহ হুজুর ক্বিবলার প্রতিষ্ঠিত দ্বীনি সংগঠন সমূহের প্রচার প্রসারে এবং মসজিদ-মাদরাসা, খানকাহ সমূহের উন্নয়ন কাজে অংশগ্রহণ ও তদারকী করা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
দেশের সর্ববৃহৎ শরীয়ত-তরিক্বত ভিত্তিক আদর্শ ধর্মীয় সংগঠন আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার সিনিয়র সহ-সভাপতি ও এশিয়া বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

এছাড়াও খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ্ খান জামে মসজিদের সম্প্রসারণের দায়িত্ব নিয়ে বহু মামলার ঝুঁকিতেও মসজিদের ২য় তলা পর্যন্ত নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন। খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের সহযোগিতায় মসজিদ পরিচালনা কমিটিতে বহু যোগ্য ও আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিদের সমন্বয় ঘটে। আনজুমান ট্রাস্ট’র সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি আলহাজ্ব নূর মুহাম্মদ আলকাদেরী রহমাতুল্লাহি আলায়হি, আনজুমান ট্রাস্ট ও জামেয়ার সাবেক কর্মকর্তা আলহাজ্ব ওয়াজির আলী সওদাগর আলকাদেরী রহমাতুল্লাহি আলায়হি, আলহাজ্ব আকরাম আলী খান রহমাতুল্লাহি আলায়হি, মরহুম হাজী সুলতান সওদাগর, মরহুম হাজী গোলাম কাদের এবং আলহাজ্ব জাকির হোসেন কণ্ট্রাক্টর সহ অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী সে সময়কার মসজিদ পরিচালনা কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আলহাজ্ব নূর মুহাম্মদ সওদাগর আলকাদেরী ও আলহাজ্ব আমিনুর রহমান সওদাগর আলকাদেরী যথাক্রমে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন দক্ষতার সাথে। এ ছাড়াও তিনি লালদীঘি জামে মসজিদ, কালুরঘাট তৈয়্যবিয়া মসজিদ ও কাপাসগোলা জামতলা জামে মসজিদ নির্মাণ ও সম্প্রসারণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। হুজুর ক্বিবলা আওলাদে রাসূল হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রতিষ্ঠিত ছাবেরিয়া খলিলীয়া সুন্নিয়া মাদরাসা ও ঢাকাস্থ কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসার প্রতিষ্ঠালগ্নে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। কায়েৎটূলী (ঢাকা) খানকায়ে কাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া খানকাহ্ শরীফের জন্য জমি ক্রয় করে তাঁর সহধর্মিণীর নামে ওয়াকফ করে দেন। ক্রমান্বয়ে তিনি আনজুমান ট্রাস্ট’র সিনিয়র সহ-সভাপতির পদে উন্নীত হন। আওলাদে রাসূল হযরতুল আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলায়হি কর্তৃক ১৯৭৬ সালে খিলাফত প্রাপ্ত হন। একই সময়ে আনজুমান ট্রাস্ট ও জামেয়ার অপর দুই নিবেদিত খেদমতগার সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি আলহাজ্ব নূর মুহাম্মদ সওদাগর আলকাদেরী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ও ট্রেজারার আলহাজ্ব ওয়াজের আলী সওদাগর আলকাদেরী রহমাতুল্লাহি আলায়হি খেলাফত প্রাপ্ত হন।

বর্তমান আলমগীর খানকাহ্ শরীফের জমির বন্দোবস্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ঢাকার মুহাম্মদপুরে অবস্থিত এ কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা, চট্টগ্রাম বন্দর হালিশহরস্থ মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিলা সুন্নিয়া ফাযিল, তৈয়্যবিয়া সুন্নিয়া দাখিল কে.পি.আর.সি মাদরাসা চন্দ্রঘোনা বিনির্মাণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। চকবাজার মসজিদ, কোর্ট বিল্ডিং মসজিদসহ অনেক মসজিদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। জমিয়তুল ফালাহ্ জাতীয় মসজিদ প্রতিষ্ঠালগ্নে তিনি বোর্ড অব গভর্ণর’স এর সদস্য ছিলেন। খাতুনগঞ্জ শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। গাউসে জমান আওলাদে রসূল আলহাজ্ব হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলায়হি’র সফরসঙ্গী হিসেবে পবিত্র হজ্ব পালনসহ বাগদাদ শরীফ, আজমির শরীফ ও মায়ানমারের (ইয়াঙ্গুন) সফর করেন। বহুবার সিরিকোট শরীফ যাতায়ত করেন এ সৌভাগ্যবান ব্যক্তিত্ব। হুজুর কিবলা আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলায়হি চিকিৎসার্থে লন্ডন গেলে তিনি ভিসা ছাড়া লন্ডন হিথরো বিমান বন্দরে পৌঁছে যান। এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। আপন মুর্শিদের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ও আনুগত্য থাকার কারণে তিনি ভিসাবিহীন লন্ডন ভ্রমণে হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে এ রকম একটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন।

ফানাফিশ্ শায়খ এ মহৎ ব্যক্তিত্ব দ্বীন-মাযহাব, মিল্লাত তথা আনজুমান ট্রাস্ট, জামেয়াসহ শরীয়ত তরিকত-এর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনরত অবস্থায় ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল, ২১ জমাদিউস্সানী, মঙ্গলবার রাতে ঢাকার শহীদ হোসেন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজেঊন)।

জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা ময়দানে মরহুমের নামাযে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর মসজিদ সংলগ্ন কবস্থানে হামদ-না’ত পরিবেশনের মাধ্যমে সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়ার আজীবন খেদমতগার আনজুমান ট্রাস্ট ও জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার সিনিয়র সহসভাপতিকে দাফন করা হয়।

তাঁর জ্যৈষ্ঠ্যপুত্র মরহুম আলহাজ্ব মুস্তাফিজুর রহমান আনজুমান ট্রাস্ট’র উপদেষ্টা ছিলেন ও কনিষ্ঠপুত্র আলহাজ্ব লোকমান হাকিম মুহাম্মদ ইব্রাহিম আনজুমান ট্রাস্ট’র সাবেক জয়েন্ট সেক্রেটারি ও গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান হিসেবে দীর্ঘ দিন দায়িত্ব পালন করেন নিষ্ঠার সাথে। তিনি বর্তমানে আনজুমান ট্রাস্ট’র কার্যকরী কমিটির সদস্য। বর্তমানে তাঁর দৌহিত্র হাফেজ মাওলানা খালেদ রিসাত ও মুহাম্মদ আবু নাসের রনি গাউসিয়া কমিটির সাথে সম্পৃক্ত আছেন এবং নিষ্ঠার সাথে এ সিলসিলার খেদমত ও দায়িত্ব আন্জাম দিচ্ছেন। অন্য পুত্রগণও এ সিলসিলার সাথে সম্পৃক্ত আছেন। আমাদের অগ্রজ পথপ্রদর্শক ফানাফিশ্ শায়খ এর মতো এ মহান সিলসিলার যাবতীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারি আজকের দিনে রাব্বুল আলামীনের দরবারে এ প্রার্থনাই রইল।

আল্লাহ্ পাক শ্রদ্ধাস্পদ আলহাজ্ব মুহাম্মদ আমিনুর রহমান আলকাদেরী রহমাতুল্লাহি আলায়হির রাফে দারাজাত নসীব করুন। আ-মী-ন।

Share:

Leave Your Comment