ইসলামী বক্তার যোগ্যতা ও বক্তব্যের বৈশিষ্ট্য

ইসলামী বক্তার যোগ্যতা ও বক্তব্যের বৈশিষ্ট্য

মাওলানা মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম ক্বাদিরী

আল্লাহপাক বলেন,
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ.
অর্থাৎ- “অবশ্যই তোমাদের মধ্যে এমন একদল লোক হওয়া চাই যাঁরা (সাধারণ লোকদের) কল্যাণের পথে আহ্বান করবেন এবং সৎকাজের আদেশ দেবেন আর মন্দকাজে বাঁধা প্রদান করবেন। আর এঁরাই সফল ব্যক্তিদের অর্ন্তভূক্ত।” (আল-কুরআন, সূরা: আলু ইমরান-০৩:১০৪)
আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ইসলাম পৃথিবীর দিক-দিগন্তে ছড়িয়েছে ইসলামের পথে আহ্বানকারী তথা আয়াতে বর্ণিত দাঈগণের অক্লান্ত পরিশ্রম, সীমাহীন ত্যাগ-তিতীক্ষা হাজারো কুরবানীর মাধ্যমে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর গোটা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, আল্লাহর জমীনে দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য। প্রিয় নবীর আত্মত্যাগে উজ্জ্বীবিত হয়ে সাহাবাগণ অতঃপর তাবিয়ী-তবে তাবিয়ীগণ এভাবে ক্রমান্বয়ে সুদক্ষ ইসলাম প্রচারকগণের মাধ্যমে মেরুতে মেরুতে ইসলামের আলো বিকিরিত হয়েছে। আপন জন্মভূমি, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং শুভানুধ্যায়ীদের ছেড়ে একমাত্র ইসলামের শান্তির বাণী আল্লাহর বান্দাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার মহান লক্ষ্যে তাঁরা আপন জীবন উৎসর্গ করেছেন। মহান আল্লাহপাক এই কাজকে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট-মর্যাদার কাজ বলেও স্বীকৃতি দিয়েছেন। আল-হামদুলিল্লাহ! দাঈগণ পবিত্র কুরআন-সুন্নাহকে কেন্দ্র করেই আল্লাহর পথে মানুষকে হেদায়েত করবেন। সত্য-বাস্তব বিবৃতির মাধ্যমে দ্বীন প্রচার করবেন। মিথ্যাকে আশ্রয় করে দ্বীন প্রচার, লৌকিকতার্থে ওয়াজকরণ, দুনিয়াবী সম্মান-প্রতিপত্তি অর্জনার্থে বক্তব্যকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা বড়ই গর্হিত ও পাপের কাজ। অথচ বৃহত্তর মানবতার কল্যাণের তরে পরহিযগার, সুযোগ্য-বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ উলামাসমাজ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে যুগযুগ ধরে দাঈ-এর ভূমিকা পালন করে আসছেন।

 ইসলামী বক্তার যোগ্যতা
ইসলামে যে কেউ বক্তা হতে পারেনা। বক্তা হওয়ার জন্য যোগ্যতা থাকা আবশ্যক। বক্তার যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ণিত আছে। ইসলামী আলোচকদের কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা, ক্বিয়াসের জ্ঞান থাকা অপরিহার্য। ফিক্বহী মাসায়িলের জ্ঞান, আরবী ভাষা ও এর ব্যাকরনিক জ্ঞান শ্রোতার অবস্থা, পরিবেশ ও স্থানীয় পরিভাষা সম্পর্কে জ্ঞান (ইলমু মুক্বতাযাল-হাল) ইত্যাদি বিষয়ে পরিপূর্ণ ধারণা থাকা আবশ্যক। আপন ইলম অনুযায়ী যথাযথ আমলকারী হওয়াও আবশ্যক। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য বর্তমান সমাজে এমন কিছু বক্তা দেখা যায়, তাঁরা যা বলেন, তা নিজে আমল করেন না। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ- كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللَّهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ. অর্থাৎ- “হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা আমল করো না তা কেন বলো? তোমরা আমল না করে যা বলো তা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত ঘৃণিত বিষয়।” (সূরা: আস্-সাফ-৬১:২ও৩)
একজন সুবিজ্ঞ আমলদার আলিমই একজন সুদক্ষ দাঈ বা ইসলামী বক্তা হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। ইসলামের মৌলিক উৎস পবিত্র কুরআন-সুন্নাহ’র আলোকে বক্তব্যের মাধ্যমে সমাজে ইসলামের প্রকৃত আদর্শ প্রচার করবেন।
আল্লাহপাক বলেন, ٱدْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلْحِكْمَةِ وَٱلْمَوْعِظَةِ ٱلْحَسَنَةِ – وَجَٰدِلْهُم بِٱلَّتِى هِىَ أَحْسَنُ – إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِۦ – وَهُوَ أَعْلَمُ بِٱلْمُهْتَدِينَ.
অর্থাৎ-“হে হাবীব! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি আপন প্রভূর পথে (মানুষকে) হিকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে আহ্বান করুন এবং তাদের সাথে সুকোমল পন্থায় সুন্দরভাবে আলোচনা/বিতর্ক করুন! নিশ্চয়ই আপনার রব অবগত আছেন যে, কে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং কে সৎপথের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত রয়েছে।” (সূরা: আন-নাহাল-১৬:১২৫)
আল্লাহপাক তাঁর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণকে সতর্কতার সাথে আল্লাহর পথে আহ্বানের নির্দেশনা দিয়ে ইরশাদ করেন,
قُلْ هٰذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلىٰ بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي.
অর্থাৎ- “(হে হাবীব! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি বলুন! এটাই আমার দাওয়াত নীতি যে, আমি এবং আমার অনুগামীগণ সত্য-প্রজ্ঞায় সতর্ক পন্থায় আল্লাহর পথে মানুষদের আহ্বান করে থাকি।” (সূত্র: আল-কুরআন, সূরা: ইউসূফ-১২:১০৮)
অত্র আয়াতে বাসীরাত-এর অর্থ বর্ণনায় ইমাম বাগাভী বলেন, والبصيرة: هي المعرفة التي تميز بها بين الحق والباطل.
অর্থাৎ- বাসীরাত হলো সত্য-মিথ্যার মাঝে পার্থক্য করার গভীর জ্ঞান। (তাফসীর-ই বাগাভী)। বক্তাকে সদয় এবং কোমলভাষী হতে হবে। অন্যথায় শ্রোতা অমনোযোগী এবং বিছিন্ন হয়ে যাবে। আল্লাহপাক বলেন, فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللَّهِ لِنتَ لَهُمْ ۖ وَلَوْ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ.
অর্থাৎ- “অতএব হে হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আল্লাহর অনুগ্রহের ফলেই আপনি তাদের প্রতি সদয় হয়েছেন। আর যদি আপনি কর্কশভাষী এবং কঠোর হৃদয়ধারী হতেন, তবে তারা আপনার চারপাশ (সংশ্রব) থেকে পালিয়ে যেতো।” (সূরা: আলু ইমরান-০৩:১৫৯)
উপরিউক্ত আয়াতে করীমাসমূহে মহান আল্লাহপাক তাঁর পথে আহ্বানকারী তথা ওয়ায়িজের জন্য (১) গভীর জ্ঞানী হওয়া, (২) ইলম অনুযায়ী আমলদার হওয়া, (৩) সদুপদেশ প্রদানে সুদক্ষ হওয়া, (৪) সুতার্কিক হওয়া (৫) সর্তক দাওয়াত প্রদানকরী হওয়া, (৬) সদয় হওয়া এবং (৭) কোমলভাষী হওয়াকে যোগ্যতা হিসেবে নির্ণিত করে দিয়েছেন। সুতরাং ওয়ায়িজগণের মধ্যে এই যোগ্যতাসমূহ অবশ্যই থাকতে হবে। তবেই শ্রোতা বা আহূতব্যক্তির অন্তরে আহ্বানকারীর ওয়াজের প্রতিক্রিয়া হবে। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্বজগৎ পরিশুদ্ধ হবে।
বক্তা এমন কথা বলবেন না যা বুঝার ক্ষমতা সাধারণ আলিমেরও নেই এবং যার ব্যখ্যা দিতে হয়। এ ব্যাপারে সুবিজ্ঞ সাহাবী সৈয়্যদুনা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘তুমি কোনো জাতির কাছে এমন কোন কথা বর্ণনা করবে না, যা তাদের বুঝে আসে না। যদি করো- তবে তা তাদের কারো কারো জন্য ফিৎনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।” (ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, খন্ড-০১, পৃ.নং-০৯; ইমাম আবূ দাউদ, আস-সুনান, হাদীছ নং-৪৯৯২)।

কুরআন-হাদীসের নামে মিথ্যা বক্তব্যের বিধান
মিথ্যা বড়পাপ। সকল পাপের মূল মিথ্যা। লোকজনকে আশ্চর্যান্বিত করা বা লোকসমাজে বাহবা কুড়ানোর নিমিত্তে কুরআন-হাদীসের নামে মিথ্যা-মনগড়া তথ্য-কাহিনী বর্ণনা করা বড়ই খেয়ানতের কাজ। পবিত্র কুরআন-হাদীসের নামে মিথ্যা বলা মানে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর মিথ্যা অপবাদ দেয়া। পবিত্র ইসলামের সম্মানহানি করা। আর এ দু’টি কাজই উলামায়ে কেরামের সর্বসম্মতিতে কুফুরী কাজ। মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শানে মিথ্যারোপ করা কাফিরদের কাজ উল্লেখ করে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হচ্ছে- فَأَعْقَبَهُمْ نِفَاقًا فِي قُلُوبِهِمْ إِلَى يَوْمِ يَلْقَوْنَهُ بِمَا أَخْلَفُوا اللَّهَ مَا وَعَدُوهُ وَبِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ
অর্থাৎ- “পরিণামে তিনি (আল্লাহ) তাদের (কাফিরদের) অন্তরে কপটতা স্থিত করলেন আল্লাহর সাথে তাদের সাক্ষাৎ-দিবস পর্যন্ত। কারণ, তারা আল্লাহর কাছে যে অঙ্গীকার করেছিল তা ভঙ্গ করেছিলো এবং তারা ছিলো মিথ্যাচারী।” (সূরা: তাওবাহ-০৯:৭৭)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- إِنَّ اللَّهَ لا يَهْدِي مَنْ هُوَ مُسْرِفٌ كَذَّابٌ
অর্থাৎ- “আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারী মিথ্যাবাদীকে সৎপথে পরিচালিত করেন না।” (সূত্র: আল-কুরআন, সূরা: মু’মিন-৪০:২৮)
অনিচ্ছায় ভুল হলে ক্ষমাযোগ্য কিন্তু ইচ্ছাকৃত ভুল অমার্জনীয়। আল্লাহপাক বলেন, وَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ فِيمَا أَخْطَأْتُمْ بِهِ وَلَكِنْ مَا تَعَمَّدَتْ قُلُوبُكُمْ
অর্থাৎ- “আর তোমাদের কোন পাপ হবে না এমন (মিথ্যার) ক্ষেত্রে, যা তোমরা অনিচ্ছায় করো। তবে যে পাপ তোমরা অন্তরের ইচ্ছয় করেছ তা অবশ্যই শাস্তিযোগ্য। (সূরা: আহযাব-৩৩:০৫)
হাদীস শরীফে মিথ্যাকে ভয়ঙ্কর পাপ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
اتَّقوا الحديثَ عنِّي إلا ما علمتُم؛ فإنَّهُ مَن كذبَ عليَّ متعمِّدًا فليتبوَّأ مقعدَه منَ النَّارِ
অর্থাৎ- ‘তোমরা আমার হতে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সতর্ক হও! যা নিশ্চিতরূপে জানো তাই বর্ণনা করো! কেননা, যে ব্যক্তি আমার উপর ইচ্ছাকৃত মিথ্যারোপ করবে সে জাহান্নামে যেন তার ঠিকানা করে নেয়।’ (ইমাম তিরমিযী, আস-সুনান, হাদীছ নং-২৯৫১; ইমাম আহমদ, আল-মুসনাদ, হাদীছ নং-২৯৭৬)
হদীস শরীফে ইরশাদ হচ্ছে- بَلِّغُوا عَنِّي ولو آيَةً، وَحَدِّثُوا عن بَنِي إِسْرَائِيلَ وَلَا حَرَجَ، وَمَن كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا، فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ
অর্থাৎ- ‘আমার থেকে লোকদের নিকট দ্বীন প্রচারের স্বার্থে একটি আয়াত হলেও পৌঁছে দাও। বনী ইসরাঈলের যা (সঠিক) বর্ণনা আছে তা বর্ণনা করতে কোন অসুবিধে নেই। আর যে ব্যক্তি আমার উপর ইচ্ছাকৃত মিথ্যারোপ করবে সে জাহান্নামে যেন তার ঠিকানা করে নেয়।’
(ইমাম বুখারী, আস-সাহীহ, হাদীছ নং-৩৪৬১)
প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো ইরশাদ করেন,
إنَّ كَذِبًا عَلَيَّ ليسَ كَكَذِبٍ علَى أَحَدٍ، مَن كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا، فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ. سَمِعْتُ النبيَّ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ يقولُ: مَن نِيحَ عليه يُعَذَّبُ بما نِيحَ عليه
অর্থাৎ- ‘আমার ব্যাপারে মিথ্যা বলা অন্য কারো ব্যাপারে মিথ্যা বলার মত নয়। যে ব্যক্তি আমার উপর ইচ্ছাকৃত মিথ্যারোপ করবে সে জাহান্নামী হবে। আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আরো বলতে শুনেছি- যে তার (আমার প্রতি মিথ্যারোপকারী জাহান্নামীর) জন্য শোক করবে এর জন্য সেও (শোক প্রকাশকারী) শাস্তি পাবে।’
(ইমাম তিরমিযী, আস-সুনান, হাদীছ নং-২৯৫১; ইমাম আহমদ, আল-মুসনাদ, হাদীছ নং-২৯৭৬)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বলেননি তা বলা বড়ই পাপ।
ইরশাদ হচ্ছে-
من تقوَّلَ عليَّ ما لم أقُلْ، فليتبوَّأ مقعدَهُ منَ النَّارِ
অর্থাৎ- যে ব্যক্তি আমার সম্পর্কে এমন কিছু বলে যা আমি বলিনি, সে যেন জাহান্নামে তার স্থান করে নেয়।’
(ইবনু হিব্বান, আস-সাহীহ, হাদীস নং-৩৩)
সুতরাং মনগড়া কথা ও বক্তব্যকে কুরআন-সুন্নাহর কথা বলে চালিয়ে দেয়া যাবে না। মিথ্য দিয়ে কথনো সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় না। শ্রোতামন্ডলী সাময়িক কর্ণসুখ অনুভব করবে বৈকি! বক্তা কিন্তু নিজের স্থান জাহান্নামে করে নেবে। নাঊযু-বিল্লাহ!

 ইসলামী বক্তব্যের বৈশিষ্ট্য
মানুষের মেধা-মনন-মানষিক যোগ্যতা অনুযায়ী নসীহত-ওয়াজ হতে হবে। অতি ধীরে ধীরে বক্তব্য পেশ করতে হবে, যাতে শ্রোতা সব কথা বুঝতে পারে। উম্মুল মু’মিনীন মা আয়শা সিদ্দীক্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা বলেন, أنَّ النَّبيَّ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ كانَ يُحَدِّثُ حَدِيثًا لوعَدَّهُ العَادُّ لَأَحْصَاهُ.
অর্থাৎ- “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন আস্তে ও স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতেন যে, শ্রোতা তাঁর প্রতিটা শব্দ গণনা করতে পারতেন।” নিজের ইলমের বাহাদুরী দেখাতে গিয়ে মু’মিনকে পথভ্রষ্ট করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। বক্তা অর্থের লোভে মুসলিম উম্মাহর ঈমান আক্বিদা নষ্ট হয় এমন বক্তব্য রাখতে যাবে না। ইসলাম যেরূপ ভারসাম্যপূর্ণ ধর্ম সেভাবে ওয়াজ-নসীহতও ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে। শ্রোতার গ্রহণক্ষমতা দেখে-বুঝে তাকে উপদেশ দিতে হবে। এজন্য আরবী প্রবাদে আছে- كَلِّمِ النَّاسَ بِقَدْرِ عُقُوْلِهِمْ অর্থাৎ- “মানুষের সাথে তাদের বিবেক-বুদ্ধির সামর্থ্যানুসারে কথা বলুন!” বক্তব্য সহজ-সরল ও সংক্ষিপ্ত হওয়াও আবশ্যক। বক্তব্য কঠিন, অস্পষ্ট এবং দুর্বোধ্যভাষায় হলে মানুষ অর্থ উৎঘাটনে অপারগ হয়ে বা ভুল শিখে বিপথে চলে যেতে পারে। এজন্য মাওলা আলী শের-এ খোদা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, .حَدِّثُوا النَّاسَ، بما يَعْرِفُونَ. أتُحِبُّونَ أنْ يُكَذَّبَ اللهُ ورَسولَه.
অর্থাৎ- “মানুষ বুঝতে সক্ষম এমন ভাষায় কথা বলুন। তোমার কি চাও যে (তারা তোমার কথা না বুঝে বা ভুল বুঝে) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মিথ্যাপ্রতিপন্ন করুক?” (ইমাম বুখারী, তা’লীকে বুখারী, পৃ.নং-১২৭)।
অর্থাৎ- তোমার (বক্তার) কথা না বুঝে তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ব্যাপারে মন্দ ধারণা পোষণ করুক এবং ঈমানহারা হয়ে যাক? নাঊযূবিল্লাহ! মানুষের সাথে তাদের যোগ্যতা এবং বুঝার ক্ষমাতানুযায়ী কথা বলুন! হযরত সৈয়্যদুনা ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, خَيْرُ الكَلَامِ مَا قَلَّ وَدَلَّ وَلَمْ يَطُلْ فَيَمُلَّ
অর্থাৎ- ‘সংক্তিপ্ত ও সহজবোধ্য কথা যা দীর্ঘ নয় এবং পূর্ণ অর্থজ্ঞাপক তাই হলো সর্বোত্তম বক্তব্য।’ যেহেতু বক্তব্য দীর্ঘ হলে বিচলিত হয়ে যায়। একজন বক্তা লোকের সামনে কথা বলার সময় এমন কথা বলবে যা তারা সহজে বুঝতে পারে এবং তাদের মনে রেখাপাত করে। এমন কঠিন ও অদ্ভুত শব্দ দিয়ে সম্বোধন করবে না, যা তারা বোঝে না। বক্তা বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে মৌলিক, স্পষ্ট, সহজ বিষয়গুলি বেছে নেবেন যা সর্বোতভাবে গ্রহণযোগ্য হয় এবং এমন বিষয়গুলি ছেড়ে দেবেন যেগুলির দ্বারা মানুষ বিচ্ছিন্ন হতে পারে। কারণ, সেগুলি তাদের কাছে অদ্ভুত, দুর্বোধ্য এবং দ্বৈতার্থক; যদিও তা ধর্মের বিষয়ভূক্ত হয়। এজাতীয় উপস্থাপনা শ্রোতাদের আল্লাহপাক ও তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অস্বীকার করার দিকে নিয়ে যায়। সুতরাং যে কথা-কাজ বান্দাকে আল্লাহপাক ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অস্বীকার করতে প্ররোচিত করবে তা এড়িয়ে চলা ফরয।
প্রত্যেক আমলের একটা সময়-স্থান আছে। সময়-স্থান ভিন্নতায় আমলের বিধানও ভিন্নতর হয়ে থাকে। যেমন, হযরত সাঈদ ইবনু মুসাইয়্যিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এক লোককে বাদ আসর নফল নামায পড়তে দেখেন। নামায শেষে লোকটি তাঁর নিকট এসে জানতে চাইলো- হযরত আমাকে আল্লাহপাক তাঁর ইবাদতের কারণেও কি শাস্তি দেবেন? তখন তিনি এর উত্তরে বললেন, হ্যাঁ শাস্তিতো তোমার হবে। তবে তা ইবাদতের কারণে নয় বরং তাঁর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র নির্দেশ না মানার কারণে। (সুনানু দারিমী)

বুঝা গেলো- সৎকাজ আপন স্থান ও উপযুক্ত সময়ে হলেই ফলদায়ক। অন্যথায় সমূহ বিপদ!
পরিশেষে বলতে চাই- ওয়াজ-নসীহত দ্বীনী যিম্মাদারী। শুধু ইলম থাকলেই ওয়াজ-নসীহত করা যাবে না। ইলমের সাথে সাথে স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করে শব্দ ব্যবহারের যোগ্যতা-প্রজ্ঞাও থাকতে হবে। আগের যুগে ইসলামী দাওয়াত, আলোচনা-বক্তব্য এবং বিধি-নিষেদের নির্দেশনা দূরাঞ্চলে পৌঁছানো খুবই কষ্টসাধ্য কাজ হয়ে থাকলেও বর্তমান আধুনিক গ্লোবালাইজেশনের যুগে ঘরে বসে মুহুর্তের মধ্যেই যে কোন তথ্য-নিদের্শনা পৃথিবীর এ প্রান্ত হতে ওপ্রান্তে চলে যাচ্ছে। এক সময়ের স্বশরীরের দাওয়াত বর্তমানে ইন্টারনেটের কল্যাণে হাজারো ঘরে একসময়ে এক মুহুর্তেই পৌঁছে যাচ্ছে। প্রেরিত তথ্য সংরক্ষণের সুযোগও তৈরি হয়েছে। কথা – বক্তব্য – চিঠি – ছবি – বিজ্ঞাপন -বিজ্ঞপ্তি -গ্রন্থ – চ্যাটিং – মেসেইজ – স্ট্যটাস যাই হোক না কেন তথ্যভান্ডারে তা সেভ হয়ে যাচ্ছে। হাজারো ক্যামেরা আপনাকে চারপাশে ঘিরে রেখেছে। মুখ দিয়ে কিছু বলার পর তা মোচার কোন সুযোগ নেই। কারণ, কথা ও তীর বের হয়ে গেলে তা আর আপন জায়গায় ফিরে আসে না। বক্তাকে তাই সদা সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি বর্তমান তথ্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ ইসলামি বিষয়ে বক্তব্য বিকৃত। ফিকহী মাসআলা মাসায়িলের বিশুদ্ধ বর্ণনা তুলে ধরলে মানুষ ইসলাম সম্পর্কে সহজে জ্ঞান লাভ করতে পারবে। ঈমান-আক্বিদা আমল শুদ্ধ করতে সহায়ক হবে। বিষয় ভিত্তিক দক্ষতা অর্জনসহ এবং বিধিত বিষয়ে সুদূর গবেষণার মাধ্যমে যোগ্য হয়ে আবেগকে নিয়ন্ত্রণের উপযুক্ত বয়সে পৌঁছার পর বক্তব্যের মঞ্চে নিজেকে একজন নগণ্য ‘দাঈ ইসলাম’ রূপে প্রকাশ করেই সঠিক বক্তব্য-নির্দেশিকা দেওয়া সম্ভব হতে পারে।

লেখক: প্রভাষক (আরবী), হাশিমপুর মকবুলিয়া কামিল মাদরাসা, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম।

Share:

Leave Your Comment