উইঘুর মুসলিম নিপীড়ন বন্ধে মুসলিমবিশ্ব নির্লিপ্ত কেন?

উইঘুর মুসলিম নিপীড়ন বন্ধে মুসলিমবিশ্ব নির্লিপ্ত কেন?

আবসার মাহফুজ

উইঘুর মুসলমানরা যুগের পর যুগ ধরে চীন কর্তৃক পাশবিক নির্যাতন-নিপীড়ন ও গণহত্যার শিকার। জাতিসংঘসহ বিশ্বসম্প্রদায় লজ্জাজনক নীরবতা পালন করে চলেছে। মাঝেমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাবিশ্ব চীনের সাথে স্বার্থ ও আদর্শগত দ্বন্দ্বের কারণে সোচ্চারকণ্ঠ হলেও ওআইসি সহ মুসলিমবিশ্ব পুরোপুরি নীরব ভূমিকা পালন করে চলেছে। মুসলিম উম্মাহ্র এ ন্যাক্কারজনক অবস্থানের সুযোগে চীন উইঘুরদের নিশ্চিহ্ন করার দুঃসাহসও দেখাচ্ছে। সম্প্রতি চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিম জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘে এক বিতর্কে পাকিস্তান-ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কয়েকটি মুসলিমদেশ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। উইঘুর মুসলিম নির্যাতনের ইস্যুকে কেন্দ্র করে গত ৬ অক্টোবর ২০২২ জাতিসংঘের ৪৭ সদস্যের মানবাধিকার পরিষদে চীনের বিরুদ্ধে আনীত জাতিসংঘ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে ১৯টি দেশ। এর মধ্যে বেশির ভাগই মুসলিমপ্রধান দেশ। প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে বলিভিয়া, ক্যামেরন, চীন, কিউবা, ইরিত্রিয়া, গ্যাবন, ইন্দোনেশিয়া, আইভরিকোস্ট, কাজাখস্তান, মৌরিতানিয়া, নামিবিয়া, নেপাল, পাকিস্তান, কাতার, সেনেগাল, সুদান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, উজবেকিস্তান ও ভেনিজুয়েলা। ভোটদানে বিরত থাকে আর্জেন্টিনা, আর্মেনিয়া, বেনিন, ব্রাজিল, গাম্বিয়া, ভারত, লিবিয়া, মালাবি, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো ও ইউক্রেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, হন্ডুরাস, জাপান, লিথুয়ানিয়া, লুক্সেমবার্গ, মন্টেনেগ্রো, নেদারল্যান্ডস, প্যারাগুয়ে, পোল্যান্ড, তুরস্ক ও অন্যান্য দেশ। জিনজিয়াং ইস্যুতে বিপক্ষে ১৯ ও পক্ষে ১৭টি দেশ ভোট দেয়। ভোটদানে বিরত ছিল ১১টি দেশ। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের মুসলিম দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলে উইঘুর মুসলিমদের ওপর চীনা নিপীড়ন বন্ধে অন্তত একটি চাপ তৈরির সুযোগ ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হলো না। এর পরিণামে চীন উইঘুর মুসলিম নিপীড়নে আরো উৎসাহিত হবে, সন্দেহ নেই।

উল্লেখ্য, জাতিসংঘের অধিকার বিষয়ক সাবেক প্রধান মিশেল ব্যাচেলে সিনজিয়াং পরিস্থিতি নিয়ে তার বিলম্বিত রিপোর্ট প্রকাশের পর তা আলোচনার উদ্যোগ নেয় যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্ররা। ওই রিপোর্টে চীনের সর্বপশ্চিমাঞ্চল সিনজিয়াংয়ে বসবাসকারী উইঘুর ও অন্য মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে চরম মানবাধিকারের লঙ্ঘনজনিত অপরাধ হয়ে থাকতে পারে দাবি করা হয়। প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় মিশেল ব্যাচেলের মেয়াদের একেবারে শেষপ্রান্তে, গত ৩১ আগস্ট। এতে জিনজিয়াংয়ে বসবাসকারী উইঘুর মুসলিমদের বিরুদ্ধে চীনের ভয়াবহ নির্যাতন, ইচ্ছেমতো আটকে রাখা, ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘন এবং সন্তান জন্মদানের অধিকার লঙ্ঘনের কথা তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে এ উপসংহার টানা হয়েছে, জিনজিয়াং নিয়ে বেইজিংয়ের নীতি মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল হতে পারে। দীর্ঘদিন চীনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আছে। ফলে জাতিসংঘ এই অভিযোগ আমলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এছাড়া আরো বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করে আসছে। তাদের মতে, চীন উইঘুরদের পাইকারিভাবে আটক করার এক কঠোর কর্মসূচি চালু রেখেছে। জিনজিয়াং নিয়ে প্রতিবেদন করতে চীনে অনেক বছর কাটিয়েছেন বিবিসির জন সুডওয়ার্থ। ফলাফল হিসেবে চীন ছাড়তে কার্যত বাধ্য হন তিনি।

উল্লেখ্য, চীনের বিস্তীর্ণ জিনজিয়াং প্রদেশ আয়তনে জার্মানির প্রায় পাঁচ গুণ। এখানেই উইঘুর জনগোষ্ঠীর বসবাস। চীনের দূর পশ্চিম সীমানা ও পূর্ব-পশ্চিমের সংযোগস্থলে নিজেদের অস্তিত্বের প্রতিফলন ঘটিয়ে চলেছে এই জাতিসত্তার মানুষেরা। ফর্সা ত্বক, সবুজ চোখ, লাল চুল উইঘুর জনগোষ্ঠীর সাধারণ শারীরিক বৈশিষ্ট্য। মধ্যএশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা উইঘুরদের সংস্কৃতিতে ইসলামি রীতিনীতি, আচার প্রবল।

গত শতকের প্রথম ভাগে জিনজিয়াং দুটি স্বল্পমেয়াদি স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের দেখা পেলেও কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসার পর সেখানে চীনের সর্বাত্মক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে বিক্ষিপ্ত সহিংসতার ছড়াছড়িতে বিচ্ছিন্নতাবাদের লক্ষণ দীর্ঘায়িত হচ্ছে সেখানে। এতে চীন উইঘুরদের ক্রমে আরও বেশি শুধু সন্দেহের চোখেই দেখছে না; বরং বিপজ্জনক রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবেও বিবেচনা করছে। চীন বিশাল আকারের সব বন্দিশিবির নির্মাণ এবং উইঘুর পরিচয়, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের যেকোনো অভিব্যক্তি নিশানা করে গণহারে তাঁদের আটক করা শুরু করে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের শুরুর দিকে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রতিবেদনে উইঘুরদের ওপর নির্যাতন ও জন্মনিয়ন্ত্রণে বাধ্য করার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। এতে করে তাদের জন্মহার নাটকীয়ভাবে কমে এসেছে। এ ছাড়া উইঘুরদের সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের ওপরও সহিংস দমনপীড়ন চালানো হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

জিনজিয়াং নিয়ে বিবিসি ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায় চীন জিনজিয়াংয়ে মুসলিমবিরোধী কঠোর নীতি অনুসরণ করছে, যা সম্পূর্ণ মানবাধিকারবিরোধী। ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে জিনজিয়াংয়ে উইঘুরদের চারটি বন্দিশিবির পরিদর্শনের জন্য নেওয়া হয়েছিল বিবিসির সাংবাদিকদের। খুব কড়াকড়িভাবে নিয়ন্ত্রিত ওই সফরে চীনের উদ্দেশ্য ছিল ভুয়া প্রচারণা চালানো। বন্দিশিবিরগুলোতে বিবিসির দলকে উইঘুরদের নাচ দেখানো হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছিল যে সেখানে উইঘুররা তাঁদের রীতিনীতি-সংস্কৃতি উদযাপনের দিক দিয়ে একেবারে স্বাধীন। নাচ দেখতে দেখতে বিবিসির এক প্রতিবেদক ওপরের দিকে তাকান। চোখ আটকে যায় সঙ্গে থাকা একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার দিকে। তিনি কাঁদছিলেন। সেটি ছিল আনন্দের কান্না। ঘটনাটি বিবিসির প্রতিবেদককে নাড়া দিয়েছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, চীনা সরকার এই প্রচারণা বিরাট খারাপ কিছু লুকোনোর জন্য করছে। জিনজিয়াংয়ের উরুমকি এলাকার একটি ফটকে চীনা কর্তৃপক্ষের বসানো চেহারা শনাক্তকরণ যন্ত্রও দেখেছেন বিবিসির সাংবাদিক। এ যন্ত্রের মাধ্যমে চেহারা শনাক্তকরণ হলেই কেবল নির্দিষ্ট এ এলাকায় প্রবেশ করতে পারেন স্থানীয় উইঘুর বাসিন্দারা। এছাড়াও নানামাত্রিক নির্যাতন-নিপীড়ন চলছে উইঘুর মুসলিমদের উপর। এমনকি উইঘুরদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চীন আড়ালে-আবড়ালে গণহত্যা এবং প্রজনন ক্ষমতা শেষ করে দিতে নানা কুকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে বলেও অভিযোগ আছে। যদিও বরাবরই জোর দিয়ে এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছে বেইজিং, কিন্তু জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনসহ নানা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা উইঘুরদের উপর চীনের বহুমাত্রিক নিপীড়নের তথ্যপ্রমাণ হাজির করে চলেছে কয়েকবছর ধরে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের দাঙ্গার পর সরকারের সমালোচনা করে শান্তিপূর্ণভাবে মতামত প্রকাশের দায়ে চীন গোপনে বেশ কয়েকজন উইঘুর মুসলিম বুদ্ধিজীবীর বিচার করেছে। এখনো গোপনে মুসলিম নেতাদের মৃত্যুদ-সহ নানা শাস্তি দিচ্ছে। জিনজিয়াংয়ে স্থানীয় আইন পরিবর্তন করে এখন ‘শিক্ষাশিবির’ চালু করেছে দেশটি। প্রাপ্তবয়স্কদের এই শিক্ষাশিবিরের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিতে হয়। আর এসব শিবিরে মুসলিম মতাদর্শবিরোধী শিক্ষা দিয়ে ব্রেনওয়াশের ব্যর্থ চেষ্টা চলছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, জিনজিয়াংয়ের উইঘুর সংস্কৃতি ও জাতিগত সত্তাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। উইঘুর বন্দীদের মান্দারিন ভাষা শিখতে বাধ্য করা হয়। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রশংসা ও তাদের নিয়মগুলো কঠোরভাবে মনে রাখতে বাধ্য করা হয়। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে ‘মেকিং ফ্যামিলি’ নামের একটি উদ্যোগের মাধ্যমে উইঘুর পরিবারকে প্রতি দুইমাসে কমপক্ষে পাঁচ দিনের জন্য তাদের ঘরে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের হোস্ট করতে বাধ্য করে। উইঘুর শিশুদের জন্যও চালু করা হয়েছে ক্যাম্প ও স্কুল, যেখানে তাদের পরিবার, ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। আরো নানা কর্মসূচির মাধ্যমে চীন রাষ্ট্রীয়ভাবে উইঘুরদের ধর্মীয় পরিচয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে। আর চীন এসব করছে প্রধানত তিনটি যুক্তিতে। চরমপন্থা, সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদ। তবে চীনা অভিযোগের কোনো শক্ত ভিত্তি নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন উইঘুরদের ভয়ে ভীত। কারণ মুসলিম অধ্যুষিত জিনজিয়াং একসময় স্বাধীন ছিল। চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর দেশটি জিনজিয়াংকে তাদের সঙ্গে জোর করে একীভূত করে। এরপর থেকে সেখানে স্বাধীনতার আন্দোলন চলে আসছে। চীন মনে করছে পশ্চিমাবিশ্ব বা মুসলিমবিশ্বের সহায়তায় উইঘুররা যে কোনো সময় জিনজিয়াং স্বাধীন করতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করতে পারে। তখন তাদের দমন বা নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়বে। তাই উইঘুরদের ধর্ম এবং সংস্কৃতি মুছে ফেলার নানা পদক্ষেপের পাশাপাশি ব্রেনওয়াশ, গণহত্যা এবং প্রজননক্ষমতা ধ্বংস করে দেয়াসহ নানা পাশবিক পন্থা অনুসরণ করছে, যা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য। আর মুসলিমবিশ্বের নির্লিপ্ততার সুযোগে চীন নির্বিঘেœ তার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এটি সমগ্র মানবজাতির জন্য এক কলঙ্কতিলকই নয় শুধু, বিশ্বের অন্যান্য ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলোর জন্যও এক অশনিসংকেত। চীনকে অনুসরণ করে অন্যদেশগুলোও যদি বিরুদ্ধ মত দমনের প্রয়াসে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোকে নানা অপকৌশলে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায় তাহলে বিশ্ব ভয়াবহ অরাজকতার দিকে হাঁটবে, সন্দেহ নেই।
উল্লেখ্য, ‘উইঘুর’ শব্দটি ‘উয়্যুঘুর’ শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ সংঘবদ্ধ। উইঘুর জাতির ইতিহাস প্রায় চারহাজার বছর আগের। মূলত, এরা স্বাধীন পূর্বতুর্কিস্তানের অধিবাসী। দেশটি প্রাচীন সিল্করোডের পাশে অবস্থিত মধ্যএশিয়ার একটি দেশ। এর চারপাশে চীন, ভারত, পাকিস্তান, কাজাখস্তান, মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়ার অবস্থান। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের এক হিসাব অনুযায়ী, চীনের জিনজিয়াংয়ে ১ কোটি ২০ হাজার, কাজাখস্তানে ২ লাখ ২৩ হাজার, উজবেকিস্তানে ৫৫ হাজার, কিরগিজস্তানে ৪৯ হাজার, তুরস্কে ১৯ হাজার, রাশিয়ায় ৪ হাজার, ইউক্রেনে ১ হাজারের মতো উইঘুর লোক বাস করে। প্রসঙ্গত, চীনের সর্ববৃহৎ প্রদেশ জিনজিয়াংয়ের আয়তন ১৬ লাখ ৪৬ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার (বাংলাদেশের আয়তনের ১২ গুণ)। দেশটির উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এ প্রদেশটি আয়তনে চীনের প্রায় এক-ষষ্ঠাংশ। এর পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমে আছে তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান ও কাজাখস্তান; দক্ষিণ-পশ্চিমে আছে আফগানিস্তান ও জম্মু-কাশ্মীর। প্রদেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৮ শতাংশ মুসলিম। বিপুল পরিমাণ খনিজ ও তেলসম্পদে সমৃদ্ধ এই জিনজিয়াংয়ে ইসলাম প্রবেশ করে মধ্যযুগে। উইঘুরদের বর্ণমালা আরবি। সাংস্কৃতিক দিক থেকে এরা তুর্কি ও আরবি প্রভাবিত। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে মাঙ্কু সা¤্রাজ্য উৎখাতের মাধ্যমে সেখানে চীনা শাসন চালু হয়। কিন্তু স্বাধীনচেতা উইঘুররা চীনা শাসনের সামনে মাথা নোয়ায়নি। এরপর থেকে তাদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু হয়। যদিও ১৯৩৩ ও ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে চীনের সাথে লড়ে উইঘুররা দুবার জিনজিয়াংয়ের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়। তবে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর চীনা কমিউনিস্ট সেনারা জিনজিয়াং দখল করে নেয়। আর জিনজিয়াং হয়ে উঠে চীনের স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ। তখন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য সাইফুদ্দিন আজিজি জিনজিয়াংয়ের গভর্নর নিযুক্ত হন। কিন্তু পরবর্তীতে জিনজিয়াংয়ের জনমিতি পাল্টে দিতে নানা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয় চীন। সেখানে চীনের হান সহ নানা জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসিত করা হয়। চীনের এ নীতির বিরুদ্ধে উইঘুর জনগোষ্ঠী সোচ্চার হয়ে উঠলে চীন নানা দমন-পীড়নের আশ্রয় নেয়, যা এখন চরম আকার ধারণ করেছে। একইসঙ্গে বিংশশতাব্দীর শেষপ্রান্ত থেকে উইঘুর মুসলমানরাও স্বাধীনতার দাবিতে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে, যা এখনও চলমান।

ফ্রিডম ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার মতে, উইঘুর মুসলমানদের ওপর চীনের ধর্মীয় নিপীড়ন এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যা মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ হিসেবে গণ্য। দেশটি সেখানে জাতিগত নির্মূল অভিযান চালাচ্ছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকায় এসব নিপীড়নের গোঙানির শব্দ বিশ্ববাসী খুব একটা জানতে পারে না। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার বরাতে কালেভদ্রে যা জানা যায়, তা যৎসামান্য মাত্র। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও উইঘুরদের ব্যাপারে সোচ্চার নয়, যেমন সোচ্চার ইউক্রেনসহ অন্য নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠীর ব্যাপারে। মুসলিমবিশ্বের দেশগুলোও নানাকারণে উইঘুরদের রক্ষায় যথাযথ ভূমিকা রাখছে না। এটি খুবই দুঃখজনক এবং অ্যালার্মিং। এ অবস্থায় চীন নির্বিঘ্নে জিনজিয়াংয়ে উইঘুরদের নিশ্চিহ্ন করার নীলনকশা বাস্তবায়ন করে চলেছে। কিন্তু উইঘুরদের প্রতি চীনের এমন পৈশাচিক নিপীড়ন একটি মানবসাম্যপূর্ণ শান্তির পৃথিবী গড়ার অন্তরায়। সংগতকারণে উইঘুরদের ওপর চীনের নিপীড়ন বন্ধে ও তাদের ন্যায়সংগত অধিকার রক্ষায় পৃথিবীর সব মানবতাবাদী মানুষের সোচ্চারকণ্ঠ হওয়া জরুরি। ওআইসিসহ মুসলিমবিশ্বেরও এ ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ-প্রতিরোধ জরুরি। অন্যথায় অন্যান্য দেশেও নিপীড়ক ও উগ্র সাম্প্রদায়িক শাসকগোষ্ঠীর কারণে সংখ্যালঘু মুসলিমদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে।

লেখক: সহকারী সম্পাদক দৈনিক পূর্বকোণ, চট্টগ্রাম।

Share:

Leave Your Comment