মহান আল্লাহর ভয়-ভীতিই মুমিন জীবনের বড় অবলম্বন

মহান আল্লাহর ভয়-ভীতিই মুমিন জীবনের বড় অবলম্বন

অধ্যক্ষ হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী

بسم الله الرحمن الرحيم
فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ(34) یُرْسَلُ عَلَیْكُمَا شُوَاظٌ مِّنْ نَّارٍ وَّ نُحَاسٌ فَلَا تَنْتَصِرٰنِ(35) فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ(36) فَاِذَا انْشَقَّتِ السَّمَآءُ فَكَانَتْ وَرْدَةً كَالدِّهَانِ(37) فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ(38) فَیَوْمَىٕذٍ لَّا  سْــٴَـلُ عَنْ ذَنْۢبِهٖۤ اِنْسٌ وَّ لَا جَآنٌّ(39) فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ(40) یُعْرَفُ الْمُجْرِمُوْنَ بِسِیْمٰىهُمْ فَیُؤْخَذُ بِالنَّوَاصِیْ وَ الْاَقْدَامِ(41) فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ(42) هٰذِهٖ جَهَنَّمُ الَّتِیْ یُكَذِّبُ بِهَا الْمُجْرِمُوْنَ(43) یَطُوْفُوْنَ بَیْنَهَا وَ بَیْنَ حَمِیْمٍ اٰنٍ(44) فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ(45) وَ لِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهٖ جَنَّتٰنِ(46) فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ(47) ذَوَاتَاۤ اَفْنَانٍ(48) 

তরজমা: সুতরাং তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে? তোমাদের উভয়ের উপর ছোঁড়া হবে ধূ¤্রবিহীন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ এবং শিখা বিহীন কালো ধোয়া। তখন তোমরা সেসব প্রতিহত করতে পারবে না। অতএব তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে? অতঃপর যখন আসমান বিদীর্ণ হবে তখন তা গোলাপ ফুলের ন্যায় হয়ে যাবে। যেমন নিরেট লাল। সুতরাং তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে? সুতরাং ওই দিন পাপীর পাপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবেনা, কোন মানব ও জীন থেকে। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে। অপরাধীগণকে তাদের চেহেরা দ্বারাই চেনা যাবে। অতঃপর তাদের চুল ও পা ধরে টেনে নেয়া হবে। অর্থাৎ জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে সুতরাং তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে? এটা হচ্ছে ওই জাহান্নাম, যাকে অপরাধীগণ অস্বীকার করে। তারা প্রদক্ষিন করবে তাতে এবং চরম পর্যায়ের জ্বলন্ত ফুটন্ত পানিতে। সুতরাং তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে? এবং যে ব্যক্তি আপন প্রতিপালকের সম্মুখে দন্ডায়মান হওয়াকে ভয় করে তার জন্য দুটি জান্নাত রয়েছে। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে? উভয় জান্নাতই ঘন শাখা প্রশাখা ও পল্লব বিশিষ্ট। সুতরাং তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে? (সুরা আর-রহমান ৩৪-৪৯ নং আয়াত)

আনুষঙ্গিক আলোচনা
يُرْسَلُ عَلَيْكُمَا شُوَاظٌ مِّن نَّارٍ وَنُحَاسٌ
উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাস্সিরকুল সরদার সাইয়্যেদুনা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুসহ অন্যান্য তাফসীর শাস্ত্র বিশারদগণ বলেছেন-উদ্ধৃত আয়াতে উল্লেখিত شواظ মানে ধূম্রবিহীন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আর نحاس মানে অগ্নিবিহীন ধূম্রকুণ্ড। অতএব এ আয়াতেও জ্বিন আর মানব উভয় কে সম্বোধন করত, তাদের প্রতি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ও ধূম্রকুণ্ড ছাড়ার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য এরূপও হতে পারে যে, হিসাব-নিকাশ এর পর জাহান্নামের অপরাধীগণকে উপরোক্ত দুই প্রকার আযাব দেয়া হবে। কোথাও ধূম্রহীন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হবে এবং কোথাও অগ্নিহীন ধূম্রকুঞ্জ হবে। কোন কোন তাফসিরবেত্তা ধূম্রহীন এই আয়াত কে পূর্ববর্তী আয়াতের পরিশিষ্ট ধরে নিয়ে এরূপ অর্থ করেছেন যে, ওহে জ্বীন ও মানব! আকাশের সীমানা অতিক্রম করার সাধ্য তোমাদের নেই। তোমরা যদি এরূপ করতেও চাও তবে যেদিকে পালাতে চাইবে, সেদিকেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ও ধূম্রকুঞ্জ তোমাদের কে পরিবেষ্টন করে ফলবে। (নাউজুবিল্লাহ) তাফসিরে ইবনে কাছীর।
কেউ কেউ বলেন- شواظ মানে এমন আগুন, যার সমগ্র অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই জ্বালিয়ে থাকে। আর نحاس মানে এমন ধূম্রকুঞ্জ, যাতে নামে মাত্র আলোও নেই। অর্থাৎ আগুন ধোঁয়া মুক্ত হবে। এবং ধোঁয়া হবে আগুনমুক্ত। (খাযায়েনুল ইরফান) মহান আল্লাহর আযাব অত্যন্ত কঠিন ও কঠোর। এ আযাবকে প্রতিরোধ করা কিংবা প্রতিহত করা কারো পক্ষে সম্ভবপর নয়। আল্লাহর এ আযাব হতে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে জি¦ন-মানব একে অপরকে সাহায্যও করতে পারবে না।(সুবহানাল্লাহ) فلا تنتصران আয়াত দ্বারা এ সত্যই বুঝানো হয়েছে।

فَيَوْمَئِذٍ لَّا يُسْأَلُ عَن ذَنبِهِ إِنسٌ وَلَا جَانٌّ
উদ্ধৃত মহান আল্লাহর বাণী ‘সেদিন কোন মানব কিংবা জ্বিন কে তার অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবেনা।” এর ব্যাখ্যায় মুফাস্সিরকুল সরদার সাইয়্যেদুনা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন- মানব কিংবা জ্বিন কে কেয়ামত দিবসে এই প্রশ্ন করা হবে না যে, তোমরা অমুক গুনাহ করেছ কিনা? কারণ, এ কথা তো ফেরেশতাদের লিখিত আমলনামায় এবং মহান আল্লাহর আদি জ্ঞানে পূর্ব থেকেই বিদ্যমান রয়েছে। বরং প্রশ্ন এই হবে যে, তোমরা অমুক গুনাহ কেন করেছ? সুরা বনী ঈসরাইলের এক আয়াতে উল্লেখিত আছে যে, اقرأ كتابك –كفى بنفسك اليوم عليك حسيبا অর্থাৎ ফেরেশতা বলবে-হে আল্লাহর বান্দা!তোমার আমলনামা পাঠ করো। আজ তুমি নিজেই তোমার আমল এর হিসাব গ্রহণকারী হিসেবে যথেষ্ট।
সাইয়্যেদুনা হযরত ইমাম মুজাহিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু উক্ত আয়াতের তাফসিরে বলেছেন-অপরাধীদের শাস্তি দানে আদিষ্ট ফেরেশতাগণ তাদেরকে জিজ্ঞাসা করবে না যে, তোমরা এই গুনাহ করেছ কিনা? এর প্রয়োজনই হবে না। কেননা, প্রত্যেক গুনাহের একটি বিশেষ লক্ষণ অপরাধীদের চেহেরায় ফুটে উঠবে।
ফেরেশতাগণ এই চিহ্ণ দেখে তাদের কে জাহান্নামের দিকে ঠেলে দিবে। অতএব উপরোক্ত উভয় তাফসীরের সারমর্ম এই যে, হাশরের ময়দানে হিসাব-নিকাশের পর অপরাধীদের কে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার ফয়সালার পর এ বিষয়টি সংঘটিত হবে। যেমন সুরা আস-সাফফাত এর আয়াতে রয়েছে- وقفوهم انهم مسئولون অর্থাৎ হে ফেরেশতাগন! তোমরা তাদেরকে দাঁড় করাও। তাদের কে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা হবে। ’ সুতরাং জিজ্ঞাসাবাদের এ পর্বের পর পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হবেনা। বরং তারা আলামত দ্বারা চিহ্ণিত হয়েই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।
সাইয়্যেদুনা হযরত ইমাম ক্বাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন-এটা তখনকার অবস্থা যখন একবার অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ হয়ে যাবে এবং অপরাধীরা অস্বীকার করবে ও কসম করবে। তখন তাদের মুখে মোহর করে দেয়া হবে এবং হস্ত-পদের সাক্ষাৎ গ্রহণ করা হবে। যেমন, সূরা ইয়াসীন এর আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে- اليوم نختم علي افواههم وتكلمنا ايديهم و تشهد ارجلهم بما كانوا يكسبون অর্থাৎ মহান আল্লাহ বলেন- আজ আমি তাদের মুখে মোহর এটে দেব, তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং তাদের পা সমূহ তাদের কৃতকর্মের সাক্ষাৎ দেবে। (সুবহানাল্লাহ) (তাফসীরে ইবনে কাছীর)

وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَانِ
পবিত্র কুরআনে কারীমের স্বাভাবিক ও স্থায়ী বর্ণনা ভঙ্গীর আলোকে পূর্বের আয়াতসমূহে অপরাধীদের কঠোর শাস্তি সম্পর্কে আলোচনা ছিল। এর বিপরীতে আলোচ্য আয়াতসমূহে সৎকর্মপরায়ন মুমিনগণের উত্তম প্রতিদান ও অবদান বর্ণনা করা হয়েছে। তন্মধ্যে জান্নাতীদের প্রথমোক্ত দুই জান্নাত ও এর নেয়ামতসমূহ এবং শেষোক্ত দুই জান্নাত ও তাতে সরবরাহকৃত নেয়ামত সমূহ বর্ণিত হয়েছে।
উদ্ধৃত আয়াতের তাফসীরে মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন যে, প্রথমোক্ত দুই জান্নাত কাদের জন্য, একথা আলোচ্য আয়াত- وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَانِ এর নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ যারা সর্বদা ও সর্বাবস্থায় কেয়ামতের দিন মহান আল্লাহর সম্মুখে উপস্থিত হওয়ার ও হিসাব-নিকাশ দানে ভয়ে, ভীত-সন্ত্রস্থ থাকে তারাই দুই জান্নাতের অধিকারী হবে। ফলে তারা কোন পাপকর্মের কাছেও যায় না। বলাবাহুল্য, এ ধরনের লোক বিশেষ নৈকট্যশীলগণই হতে পারে।
অধিকাংশ তাফসীরবিশারদগণের মতে مَقَامَ رَبِّهِ বলে কেয়ামতের দিন আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সামনে হিসাব দানের জন্য উপস্থিতি কে বুঝানো হয়েছে। এই পরিস্থিতির ভয় রাখার অর্থ এই যে, জনসমক্ষে ও নির্জনে প্রকাশ্যে ও গোপনে সর্বাবস্থায় এই ধ্যান থাকা যে, আমাকে একদিন আল্লাহর সামনে উপস্থিত হতে হবে এবং জাগতিক জীবনের সর্বাবস্থায় সকল কর্মকান্ডের হিসাব দিতে হবে। (সুবহানাল্লাহ) বলা বাহুল্য, যে ব্যক্তির সদা-সর্বাদা এরূপ ধ্যান থাকবে, সে পাপকর্মের কাছেও যেতে পারবেনা। প্রসিদ্ধ তাফসীর বিশারদ ইমাম কুরতুবী (র.) সহ কোন কোন তাফসীরে আল্লাহর বাণী এরূপ তাফসীরও করেছেন যে, মহান আল্লাহ প্রত্যেক কথা, কাজ এবং গোপন ও প্রকাশ্য সকল কর্মকান্ড দেখাশুনা করেন।

যেমন এরশাদ হয়েছে- الله بصير بما تعلمون ও الله بصير بالعباد এবং والله شهيد على ما تعملون ইত্যাদি আয়াতের মর্মবাণী। বান্দার প্রতিটি পদক্ষেপ তাঁর দৃষ্টির সামনে। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের এহেন ধ্যান ও মানুষ কে পাপকর্ম থেকে বাঁচিয়ে রাখবে।
অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে- واما من خاف مقام ربه و نهى النفس عن الهوى فان الجنة هى الماوى অর্থাৎ অতএব যারা কেয়ামত দিবসে হিসাব দানের জন্য মহান আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয় করে এবং নিজেকে কুপ্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ থেকে সর্বোতভাবে বিরত রাখে অবশ্যই জান্নাত তার আশ্রয়স্থল হবে। (আলহামদুলিল্লাহ) তাকওয়া-পরহেজগারীর মূল মর্মবাণী হলো মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ভয়-ভীতি। যার অন্তর জগতে আল্লাহর ভয় যতটুকু তার সামগ্রিক কর্মকান্ডে ও চিন্তায়-কল্পনায় দ্বিনদারীর বাস্তবায়ন ও ততটুকু। এজন্য কুরআনে কারীমে এরশাদ হয়েছে- ان الله مع الذين اتقوا অর্থাৎ মহান আল্লাহ তাদের সঙ্গে রয়েছেন যারা তাঁকে ভয় করে। হাদীসে নববীতে এরশাদ হয়েছে- الورع سيَد العمل অর্থাৎ তাকওয়া তথা আল্লাহর ভয়ই হলো আমল-ইবাদতের সরদার।

লেখক: অধ্যক্ষ, কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা, মুহাম্মদপুর, এফ ব্লক, ঢাকা।

Share:

Leave Your Comment