অসংখ্য কারামতের অধিকারী বড়পীর গাউসুল আযম

অসংখ্য কারামতের অধিকারী বড়পীর গাউসুল আযম

মাওলানা হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান

আল্লাহ্ তা‘আলা সমস্ত প্রশংসার মালিক, যিনি তাঁর বান্দাদের প্রশংসা শোনেন আর প্রশংসাকারীর প্রতি অনুগ্রহ করেন। তাঁর পবিত্রতা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি, যিনি কৃতজ্ঞতা দৃষ্টে তাঁর নেয়ামতরাজি বাড়িয়ে দেন।
আল্লাহ্ এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর একত্ব স্বীকারই নাজাতের মূল মন্ত্র। তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই, তাঁর কোন শরীক নেই। তাঁর শান, ওয়াহ্দাহু লা-শরীক। আমাদের মুনিব, রাহ্বর সায়্যিদুনা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্র বান্দা ও তাঁর রাসূল।

আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত ক্ষমতার একচ্ছত্র মালিক। তিনি যেভাবে ইচ্ছা করেন, স্বীয় কুদরতের প্রকাশ ঘটান, আল্লাহ প্রদত্ত অলৌকিক ক্ষমতা নবীদের মাধ্যমে মু’জিযা রূপে প্রকাশিত হয়, আর আউলিয়ায়ে কেরামের মাধ্যমে কারামত রূপে প্রকাশিত হয়। মু’জিযা বা কারামত কোন অর্জিত শক্তি নয়, বরং তা আল্লাহ প্রদত্ত। আল্লাহর নবী হযরত সুলাইমান আলায়হিস্ সালাম’র নির্দেশে তাঁর দরবারের একজন ওলী আসেফ বিন বরখিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু যখন সাবার রাণী বিলকিসের সিংহাসন পলকেই হাজির করলেন, তখন হযরত সুলাইমান আলায়হিস্ সালাম বলেছিলেন, ‘হাযা মিন ফাদ্বলি রাব্বী’ (২৭:৪০) অর্থাৎ এটি আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ থেকে (একটি অনুগ্রহমাত্র)। আর আউলিয়ায়ে কেরামের খোদাপ্রদত্ত ক্ষমতাকে অস্বীকার করা গোমরাহী। শরহে আকায়েদে নাসাফী গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, তাঁদের অলৌকিক ক্ষমতা সত্য। এটি সন্দেহাতীত ও তর্কাতীত ভাবে প্রতিষ্ঠিত, মৌলিক বিশ্বাসের অন্তর্গত একটি বিষয়। কারামত আল্লাহর ইচ্ছাতেই আউলিয়া কেরামের নিকট থেকে প্রকাশিত হয়, যাতে কুদরতের ক্ষমতার প্রতি মু’মিনের আস্থা আরো সুদৃঢ় হয়।

আখেরি নবীর তিরোধানের পর আর কোন নবী আসবেন না, তাঁর লোকান্তর গমনের কারণে প্রত্যক্ষ মুজিযা দেখা যাবে না। তবে তাঁর নবুওয়তের কাল হবে মহাপ্রলয় অবধি। তাই তাঁর উম্মতের ওলীগণের মাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকবে কারামত যা তাঁরই পরোক্ষ মু’জিযা। পূর্বের নবীগণের উম্মতের ওলীর কারামত আর প্রকাশিত হবে না। কেননা নবীর আবির্ভাবে তাঁদের দায়িত্ব রহিত হয়ে যায়। কিন্তু শেষ নবীর যমানার আউলিয়ায়ে কেরামের কারামত অব্যাহত থাকবে। যুগে যুগে বিশুদ্ধ আকীদাপন্থি আহ্লে সুন্নাত এর অনুসারীদের মাধ্যমে এ ধারা জারি থাকবে। [আশরাফুত তাফাসীর]

সুরা নাম্ল’র প্রাগুক্ত আয়াতের আলোকেই বলা যায়, আল্লাহ্র ওলীগণ হচ্ছেন বান্দার প্রতি আল্লাহ্র অনন্য অনুগ্রহ। তাঁদের অবদান’র স্বীকৃতি ও তাঁদের মহিমা বর্ণনা কৃতজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ।

বড়পীর গাউসুল আযম হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ওলীকুল শ্রেষ্ঠ সর্বজনমান্য অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। আধ্যাত্মিক পথ চলায় বিশ্বের অধিকাংশ তাসাওউফপন্থি মুসলমান তাঁর তরীকায় দীক্ষিত। তাঁর উঁচু মর্তবা, রূহানী জগৎ থেকে শুরু করে মাতৃগর্ভ শৈশব ও পরিণত বয়সে এমনকি ওফাতোত্তর (৫৬১হি.) আজ অবধি প্রকাশিত অসংখ্য কারামত কিংবদন্তীকেও হার মানিয়েছে। এ চাঁদের ১১ তারিখ হল তাঁর ওফাতের তারিখ। এ দিন স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যে সারা বিশ্বে ফাতেহায়ে ইয়াযদাহম (বা একাদশ দিবস) পালিত হয়। ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলেও মুসলমানদের কাছে পালনীয় দিন হিসাবে এদিনকে সরকারি ছুটি ঘোষিত ছিল। [সূত্র : অধ্যক্ষ আল্লামা এম.এ. জলিল প্রণীত কারামাতে গাউছুল আজম রাদ্বি.]

মিলাদে শায়খে বরহকে গ্রন্থে আছে, ১০ মুহররম বা আশুরার দিন নবী রাসূলগণের অনেকের জীবনে বিশেষ নেয়ামত প্রাপ্তিতে তাঁরা এর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ পরবর্তী রাত অর্থাৎ এগারতম রাতে বিশেষ ইবাদত বন্দেগী করতেন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্বপ্ন যোগে এই গেয়ারভী শরীফ গাউসে পাক জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে দান করেছেন।

তিনি পারস্যের ‘জিলান’ নগরে ৪৭১ হিজরীর মাহে রমযানের প্রথম রাতে ভূমিষ্ঠ হন। পিতা যুগশ্রেষ্ঠ আলেম ও মহান তাপস হযরত সায়্যিদ আবু সালেহ মুসা ভঙ্গিদোস্ত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু। মহিয়সী মাতার নাম সায়্যিদা উম্মুল খায়ের আমাতুল জাব্বার ফাতিমা রাহমাতুল্লাহি আলায়হা। তাঁর পিতা হযরত হাসান মুজতবা এবং মাতা ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা’র বংশধর হিসাবে তিনি হাসানী ও হোসাইনী, অর্থাৎ বাবা-মার উভয়কুলে তিনি নবীজির আওলাদ। জন্মের প্রথম দিন হতে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দুধ পান না করে রোযা পালন করে যান। সেদিন কি পহেলা রমযান, না ৩০ শা’বান, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হওয়ায় তা সন্দেহে থেকে যায়। অনেকে এসে তাঁর আব্বাজানের কাছ থেকে সন্দেহের অবসান চান। তখনই গাউসে পাকের আম্মা অন্দর মহল থেকে এ বিস্ময়কর সংবাদটি জানান। মুহূর্তে তা রাষ্ট্র হয়ে যায়, জন্ম লগ্নেই এ বিস্ময়কর শিশু শুধু রোযাই পালন করলেন, তাই নয়, বরং উম্মতের এক জটিল দ্বন্দ্বের কারামতের মাধ্যমে সমাধানও দিয়ে দিলেন। তিনিই আমাদের বড়পীর গাউসুল আযম হযরত আবদুল কাদের জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু।

প্রাথমিক শিক্ষা মক্তবেই লাভ করেন। এখানেও প্রথম সবক পড়ার দিনই আঠারো পারা ক্বোরআন মুখস্থ শুনিয়ে ওস্তাদকে হতবাক করে দেন। মায়ের গর্ভে থাকতে মায়ের মুখের তেলাওয়াত শুনে তা তাঁর মুখস্থ হয়ে যায়। ৪৮৮ হিজরী সনে ১৮ বছর বয়সে জ্ঞানপিপাসা নিয়ে বাগদাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। যাওয়ার পথে মায়ের দেওয়া ৪০ দিনার (যা জননীর সঞ্চয় তিনি সন্তানের পড়ার খরচের জন্য জামার হাতার নিচে সেলাই করে দেন) পাথেয় হিসাবে নিয়ে যান। পথিমধ্যে দস্যু আক্রান্ত হন। এখানে মায়ের ওয়াদা সত্য রক্ষার চেষ্টা দৃষ্টে দস্যুদের সুমতি হয়। তারা তাওবা করে। বাগদাদে এসে নেজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। জিলান থেকে চার’শ মাইল পথ অতিক্রম করে বাগদাদে এসে আট বছর কঠোর অধ্যবসায়ে কুরআন, হাদীস, ফিকাহ, আদবসহ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। নেজামিয়ার অধ্যাপনায় নিয়োজিত তাঁর ওস্তাদবৃন্দের মধ্যে হাম্মাদ বিন মুসলিম, মুহাম্মদ বিন হাসান বাকেলানী ও ফকীহ আবু সাঈদ মাখযুমী প্রমুখ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তন্মধ্যে হযরত আবু সাঈদ মাখযূমী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক সাধক। হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর হাতে তরীকতের দীক্ষা গ্রহণ করেন। জাহেরী শিক্ষার পর একটানা পঁচিশ বছর তিনি কঠিন সাধনায় ব্রতী হন। অর্ধাহারে, অনাহারে, বিনিদ্র রিয়াযতে বনে-বাদাড়ে, গহীন জঙ্গলে, গিরি মরুর দুর্গম প্রান্তরে কাটিয়ে দেন। ৫১৩ হিজরীতে তাঁর পীর-মুর্শিদ ইন্তেকাল করেন। এরপর পীরের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায়ে বাবুল আ’জাজ পরিচালনার দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত হয়। রিয়াযতে কামালিয়ত প্রাপ্তির পর প্রিয় নবীর নির্দেশনা শিরোধার্য করে প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সে গাউসে পাক সাংসারিক জীবন শুরু করেন।

গাউসে বাগদাদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ছিলেন গর্ভজাত ওলী। আত্মার জগত থেকে তাঁর কারামত প্রকাশ পেয়েছে। এতদসত্তেও তিনি সাধনার অভাবনীয় দৃষ্টান্ত রেখেছেন। ছাত্রজীবনে একবার দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। একাধারে চল্লিশ দিন তিনি হালাল খাবার সন্ধান করেছেন, এভাবে পারস্য সম্রাটের ভগ্ন দুর্গের আশেপাশে হালাল আহার্যের সন্ধান করতে গিয়ে দেখলেন সত্তর জন অলিউল্লাহ অভুক্ত অবস্থায় খাবারের সন্ধান করছেন। তিনি তাঁদের সাথে প্রতিযোগিতা সঙ্গত নয় ভেবে ফিরে আসেন। পরে লোকমারফত মায়ের পাঠানো কিছু স্বর্ণমুদ্রা পেয়ে নিজের জন্য সামান্য কিছু রেখে বাকিটা তিনি ওই সত্তরজন দরবেশকে দিয়ে আসেন। তিনি বলেন, ইল্ম ও মারিফতের সন্ধানে আমি ব্যাপৃত হয়েছি; এক পর্যায়ে আমি ‘কুতবিয়্যত’ অর্জন করি। [কাসীদায়ে গাউসিয়া]

শরীয়ত ও তরীকতের দুই ধারায় অসামান্য সংস্কার সাধন করে গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু দ্বীনের হক কে পুনর্জীবিত করেন। এজন্যই তিনি ‘মুহিউদ্দিন’ (বা দ্বীন’র পুনর্জীবন দানকারী) উপাধিতে কালজয়ী হয়ে আছেন। তদানীন্তন কালে শাহী ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামের নামে খারেজী, শিয়া, মু’তাযিলা, কারামতা শিয়া প্রভৃতি ফির্কার দৌরাত্ম্য মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছিল। গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু আধ্যাত্মিক ক্ষমতা প্রয়োগে সে সব বাতিল মতবাদের মূলোৎপাটন করে ইসলামের বিশুদ্ধ রূপরেখায় একে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। শরীয়ত ও তরীকতের সঠিক দিক নির্দেশনা সম্বলিত তাঁর প্রণীত গুনিয়াতুত তালেবীন মুসলিম জাহানের অমূল্য সম্পদ রূপে আজো অম্লান। সে গ্রন্থে তিনি উগ্রপন্থি গালি শিয়াদেরকে ইহুদীর মত কাফির সনাক্ত করায় শিয়ারা গাউসে পাকের নাম নবী বংশের তালিকা থেকে বাদ দেয়। [সূত্র : কারামাতে গাউছুল আজম]

গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু কাসীদায়ে গাউসিয়ায় বলেছেন, “প্রত্যেক ওলী আধ্যাত্মিক যাত্রায় একটি স্বতন্ত্র পদাঙ্কের অনুসরণ করেন, আমি (হেদায়তের) পূর্ণচন্দ্র নবী কুল সম্রাটের পদাঙ্ক অনুবর্তী।” প্রিয় নবীর কারামাতের যেমন অন্ত নেই, তেমনি গাউসে পাকের কারামাতও অগণিত, অসংখ্য কারামত কোন মু’জিযার গ্রন্থে সংকলনও দুঃসাধ্য। শুধু একটি প্রসিদ্ধ কারামত তাঁর অনুগ্রহ কামনায় তাঁর পবিত্র স্মৃতির সম্মানে উল্লেখ করে শেষ করা হবে এ আলোচনা।

বাগদাদের এক বিধবার সন্তান সায়্যিদ কবির ওরফে শাহ্দুলা বিবাহ শেষে নববধূসহ বরযাত্রী নিয়ে নদীপথে ফিরছিলেন। মাঝপথে ঝড়ে কবলিত হয়ে নৌকাডুবিতে সবাই নিহত হন। পুত্র বিরহে বিধবার শোক কাটেনা। প্রতিদিন নদীর পাড়ে বসে কাঁদতে থাকেন। এভাবে কেটে যায় বার বছর। একদিন ওই পথ দিয়ে যেতে গাউসে পাক বিধবার মনোকষ্টে খুবই মর্মাহত হন। তিনি আল্লাহর দরবারে আব্দার করে হাত উঠালেন। অবাক পৃথিবী। সাথে সাথে নদীর পানিতে ভেসে ওঠে একযুগ আগে নিমজ্জিত বর, নববধূসহ সকল বরযাত্রী। মহিলার আনন্দের সীমা রইল না। তিনি আল্লাহর শোকর করলেন।

মায়ের মৃত্যুর পর শাহদুলা বিবিসহ গাউসে পাকের দরবারে এসে স্থায়ী আশ্রয় নেন এবং গাউসে পাকের খেদমতে নিয়োজিত হন। একদিন গভীর রাতে গাউসে পাক অযু করার সময় শাহদুলা পরম ভক্তি নিয়ে পানি ঢালেন।
এক পর্যায়ে হযরতের পা মুবারক হতে গড়িয়ে পড়া পাঁচ ফোঁটা পানি শ্রদ্ধার সাথে পান করে ফেলেন। তাঁর ভক্তি দৃষ্টে গাউসে পাক দু‘আ করলেন প্রতি ফোঁটার বরকতে আল্লাহ যেন তাকে একশ’ বছর করে হায়াত দেন। সে দু‘আ শাহদুলা পাঁচশ বছর হায়াত পেয়ে ১০৬১ হি. সনে বহু দেশঘুরে গুজরাট এসে ওফাত প্রাপ্ত হন। সেখানে তিনি সমাহিত হন। [সূত্র: তাফ, নঈমীর বরাতে প্রাগুক্ত]  গাউসে পাকের ওফাত ৫৬১ হিজরি ১১ রবিউস্ সানী।

লেখক: আরবী প্রভাষক- জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাস, চট্টগ্রাম।

Share:

Leave Your Comment