যিনি হাসানী-হোসাঈনী, তিনি মুহিউদ্দীন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু

যিনি হাসানী-হোসাঈনী, তিনি মুহিউদ্দীন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান

শাহানশাহে বাগদাদ হযরত শায়খ আবদুল কাদির জীলানী হলেন নজীবুত্ব ত্বরফাঈন। অর্থাৎ তিনি পিতার দিক দিয়ে হাসানী সাইয়্যেদ আর মায়ের দিক দিয়ে হোসাঈনী সাইয়্যেদ। তিনি নিজেই বলেছেন- اَنَا نَجِيْبُ الطَّرْفِيْنِ (আমি পিতা ও মাতা উভয় দিক দিয়ে অভিজাত, সাইয়্যেদ বংশীয়।) যাঁর ধমনীতে হযরত হাসান ও হযরত হোসাঈন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমার রক্ত মুবারক প্রবাহিত, তিনি তো দ্বীনকে পুনর্জীবিত করার মতো কঠিন ও ঐতিহাসিক কাজ সম্পাদন করবেনই। এ নিবন্ধে প্রথমে হুযূর গাউসে পাকের বংশীয় শাজরা বা ধারা বর্ণনা করার এবং এরপর তাঁর ‘মুহিউদ্দীন’ (দ্বীনকে পুনর্জীবিত করা)’র নমুনা পেশ করার প্রয়াস পাবো- ইনশা-আল্লাহ্।

পিতার দিক দিয়ে তাঁর নসবনামা নিম্নরূপ
হযরত মুহিউদ্দীন আবদুল ক্বাদির ইবনে আবূ সালিহ্ মূসা ইবনে আবদুল্লাহ্ আল-জীলী ইবনে ইয়াহিয়া যাহিদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাসান মুসান্না ইবনে আমীরুল মু’মিনীন হাসান ইবনে আমীরুল মু’মিনীন আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম। (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম)

মায়ের দিক দিয়ে তাঁর নসবনামা
তাঁর মহিয়সী আম্মাজানের নাম ফাতিমা, কুনিয়াৎ উম্মুল খায়র বিনতে আবদুল্লাহ্ সাউমা‘ঈ ইবনে আবূ জামাল ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মাহমূদ ইবনে তাহির ইবনে আবূ ‘আত্বা ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে আবূ কামাল ইবনে ঈসা ইবনে আবূ আলা উদ্দীন ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে মূসা কাযিম ইবনে হযরত ইমাম জা’ফর সাদিক্ব ইবনে ইমাম বাক্বির ইবনে ইমাম যায়নুল আবিদীন ইবনে ইমাম হোসাঈন ইবনে আমীরুল মু’মিনীন আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুল কারীম। (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম ওয়া আনহা)
সুতরাং হুযূর শাহানশাহে বাগদাদ পিতার দিক দিয়ে হাসানী এবং মায়ের দিক দিয়ে হোসাঈনী সাইয়্যেদ। ইহুদী ও রাফেযীরা ব্যতীত সব ইসলামী দল তাঁকে ‘নজীবুত্ব ত্বরফাঈন বলে মান্য করে। এ ইহুদী ও রাফেযী (শিয়া)দের খ-ন ‘ইমাত্বাতুল আযা-‘আন গাউসিল ওয়ারা’য় আল্লামা ফয়য আহমদ ওয়াইসী অতি প্রামাণ্যভাবে করেছেন।

গাউসে আ’যমের ‘মুহিউদ্দীন’ উপাধির সার্থকতা
সাইয়্যেদুনা গাউসে আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর অগণিত লক্বব (উপাধি) রয়েছে। তন্মধ্যে একটি হলো-‘মুহিউদ্দীন’।
এ সম্পর্কে খোদ্ হুযূর গাউসে আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এভাবে বলেছেন, ‘তাঁকে কেউ বলেছিলো, ‘‘আপনার উপাধি ‘মুহিউদ্দীন’ কিভাবে হলো?’’ তিনি বললেন, ‘‘৫১১ হিজরীতে আমি খোলা গায়ে বাগদাদের দিকে যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে আমি এক রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখতে পেলাম। সে ছিলো অতি দুর্বল ও শীর্ণকায়। তার গায়ের রংও বিগড়ে গিয়েছিলো। সে ‘আস্সালামু আলায়কুম’ বলে আমার নাম ধরে ডাকলো। আর আমাকে তার কাছে যেতে বললো। আমি যখন তার নিকট গেলাম তখন সে আমাকে তাকে টেনে তুলতে বললো। আমিও তা করলাম। দেখতে দেখতে সে স্বাস্থ্যবান হতে লাগলো, গায়ের রং ও চেহারা সুন্দর হতে লাগলো। আমি হঠাৎ এমন পরিবর্তন দেখে ভয় পেয়ে গেলাম।’’ সে আমাকে বললো, ‘‘আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?’’ আমি বললাম, ‘‘না।’’ এবার সে আমাকে বললো, ‘‘আমি হলাম ‘দ্বীন’। আপনি আমাকে একটু আগে যেমনটি দেখছিলেন, তেমনি আমি বর্তমান সমাজে অতি শোচনীয় অবস্থায় ছিলাম। কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা আপনার প্রচেষ্টায় নতুনভাবে আমাকে জীবন দান করেছেন।’’ এরপর থেকে আমার নাম ‘মুহি উদ্দীন’ (দ্বীনকে পুনর্জীবনদাতা) হয়ে গেলো।’’ দুনিয়ায় তাঁর জন্মগ্রহণের পূর্বাপর অবস্থাদি পর্যালোচনা করলে তাঁর এ উপাধির সার্থকতা অতি উত্তমরূপে প্রকাশ পায়। হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ইলমে গায়ব সঞ্জাত ভবিষ্যদ্বাণীরও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে হুযূর গাউসে আ’যমের অবদানগুলোর মাধ্যমে। হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘‘পঞ্চম শতাব্দির নিকটবর্তী সময়ে আমার উম্মতের উপর বিপদাপদের একটি চাক্কি ঘুরবে। যদি তা থেকে কেউ নিরাপদে বের হয়ে আসতে পারে, তবে বেশ কিছুদিন যাবৎ সে দ্বীনের উপর অটলতা পেয়ে যাবে।’’
[সূত্র. ফয়যুল বারী: কৃত. আনোয়ার শাহ্ কাস্মিরী]

বিভিন্ন ঘটনা থেকে এ ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যায়ন
সুতরাং ওই শতাব্দিতেই উম্মতের উপর ওই চাক্কি ঘুরেছিলো। ইতিহাসের পাতায় পাতায় এর প্রমাণ মিলে। ওই যুগে ইসলাম ও মুসলমানদের পতন ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছিলো, যদিও বাহ্যিকভাবে ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতার পরম্পরা সুদূর স্পেন থেকে শুরু হয়ে ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো কিন্তু অভ্যন্তরীণ অবস্থাদি ছিলো অতি শোচনীয়। ইসলামী দুনিয়ার কেন্দ্রীয় ক্ষমতা অর্থাৎ বাগদাদের খিলাফত অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। বিশ্বের অন্যান্য স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক রাষ্ট্র থাকলেও সেগুলোতে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিক্ষিপ্ত অবস্থাই বিরাজ করছিলো। শিবলী নো’মানী ও সাইয়্যেদ সুলায়মান নদভী তাঁদের ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে আর আল্লামা ইবনে জাওযী ‘আল মুনায্যাম’-এ তদানীন্তন যুগের ইসলামী রাজ্যগুলোর যেসব অবস্থা লিখেছেন, সেগুলো পাঠ-পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় যে, অপকর্ম, পাপাচার, রাজনৈতিক অনৈক্য এবং চারিত্রিক অধঃপতন চরমে পৌঁছে গিয়েছিলো, যেসব অবস্থা থেকে হুযূর গাউসে পাক দেশ ও জাতিকে রক্ষা করেছিলেন তখনকার কয়েকটা দেশ ও অঞ্চলের অবস্থা নি¤েœ সংক্ষেপে তুলে ধরা হলোঃ

আন্দালূস বা স্পেন
এখানে উমাইয়া বংশের আমীর আবদুর রহমানের প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের কেন্দ্রীয় গৌরব পূর্ণ ভাবমূর্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলো। ইউরোপের খ্রিস্টান রাজ্যগুলো এ সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো যে, কখন মুসলমানদেরকে নিঃশেষ করে সেখানে তাদের শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করবে।

বায়তুল মুক্বাদ্দাস
বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপর খ্রিস্টানদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবার পর তারা ইরাক ও হেজাযের উপরও হামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। এমনকি গোটা খ্রিস্টীয় দুনিয়ার সম্মিলিত শক্তি দুনিয়ার বুক থেকে ইসলামকে চিরতরে ধ্বংস করে ফেলার জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলো।

মধ্যপ্রাপ্য
মধ্যপ্রাচ্যে আব্বাসী সা¤্রাজ্যের অস্তিত্ব নামে মাত্র ছিলো। সেখানে সালজূক্বী ও অন্যান্য অধীনস্থ সুলতানরা গৃহযুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। যেই সুলতানের ক্ষমতা বেড়ে যেতো বাগদাদে তার নামে খোৎবা পড়া আরম্ভ হয়ে যেতো।

আফগানিস্তান ও ভারত
আফগানিস্তান ও ভারতের উত্তর-পশ্চিম এলাকায় সুলতান মাহমূদ গযনভীর উত্তরসূরীদের পতন শুরু হয়েছিলো আর হিন্দু রাজা-মহারাজাগণ তাদের পূর্ববর্তী পরাজয় ও অপমানগুলোর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পরস্পর শলা-পরামর্শ করছিলো।

মিসর
মিসরে বাত্বেনিয়া-ওয়ায়দিয়া ফির্ক্বা, যাদের রাজ্যকে ইমাম সুয়ূত্বী ‘তারীখুল খোলাফা’য় ‘দওলতে খবীসাহ্’ (নাপাক রাজ্য) বলেছেন, ইলহাদ ও বে-দ্বীনী দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটাচ্ছিলো। তাদের নেতাগণ ইসলামের যে পরিমাণ ক্ষতি করছিলো, তা সবার নিকট প্রসিদ্ধই।
মিসরের কুখ্যাত ‘বাত্বেনী হুকুমত’ হযরত গাউসে আ’যমের জীবদ্দশায়ই পতন্মুখ হয়ে শেষ পর্যন্ত, ৫৬৭ হিজরীতে, অর্থাৎ তাঁর ওফাতের পর মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে একেবারে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলো এবং তদস্থলে সুলতান নূর উদ্দীন যঙ্গী তারপর সুরতান সালাহ্ উদ্দীন আইয়ূবী রাজত্বের ময়দানে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন; যাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সম্পর্ক জুড়ে নিয়ে তাঁদের রাজ্যগুলোকে ইসলামী ঐক্যের সাথে সম্পৃক্ত করে আব্বাসী খলীফার নামে খোৎবা পড়াতে আম্ভ করেন। তারপর নিজ নিজ রাজত্বকালে ইউরোপের সম্মিলিত খ্রিস্টীয় রাজ্যগুলোর সাথে একাধিকবার যুদ্ধ করে তাদেরকে পরাজিত করেন এবং বায়তুল মুক্বাদ্দাসকে আযাদ করে নেন। ইমাম ইয়াফি‘ঈ ও ইবনুল আসীর তাঁদের ইতিহাস-গ্রন্থগুলোতে এ-ই দ্বীনদার শাসকদের অতি বিস্তারিতভাবে প্রশংসা করেছেন।
ও-ই যুগে গযনীদের ধ্বংসপ্রাপ্ত বাদশাহীর স্থলে ঘুরী বংশ ভারতে এক নতুন ও প্রশস্ততর ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করেন। এ’তে হুযূর গাউসে আ’যমের নিকটাত্মীয় ও ফয়যপ্রাপ্ত বুযুর্গ হযরত খাজা গরীব-নাওয়ায মু‘ঈন উদ্দীন আজমীরী আলায়হির রাহমাহরও হাত ছিলো। পরবর্তীতে তাঁর খলীফাগণ ও শীষ্যরা মাশাইখে চিশ্ত আহলে বেহেশত, মাশাইখে সুহরুওয়ার্দিয়া হযরত বাহাউদ্দীন যাকারিয়া, শাহ্ সদরুদ্দীন, আবুল ফাত্হ শাহ্ রুকনে আলম মুলতানী, সৈয়্যদ জালাল উদ্দীন বোখারী আউচী, মাখদূম-ই জাহানিয়াঁ জাহান গাশত আউচী, জনাব লা’ল শাহবায ক্বলন্দর সিন্ধী প্রমুখ এ উপমহাদেশের দূরবর্তী ও নিকটবর্তী অঞ্চলগুলোতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে অগণিত লোকজনকে ইসলামে দীক্ষিত করে ধন্য করেছেন।
তদানীন্তনকালে মুসলমানদের চারিত্রিক অধঃপতনের অবস্থা এ ছিলো যে, রাজ্যের আমীর-উমারা বিলাসিতায় মগ্ন হয়ে পড়েছিলো। মধ্যপ্রাচ্যের একজন মাঝারী পর্যায়ের সরকারী ব্যক্তি ও ধনী ইবনে মারওয়ান সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তার হেরমে (আন্দর মহলে) শুধু গান-বাজনাকারী ও নতর্কীদের সংখ্যা পাঁচশ’র কাছাকাছি ছিলো। আর ইমাম শাফে‘ঈর বর্ণনানুসারে, কর্ডোবার মু’তামাদ নামের এক আমীরের নিকট তেমনি আটশ’ নারী ছিলো, স্পেনের নেকাব পরিহিত সুলতানদের যুগে ইসলামী পর্দাও নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলো। পুরুষগণ নেকাব পড়তে আরম্ভ করেছিলো আর নারীরা খোলামুখ ও খোলা মাথায় ঘোরাফেরা করছিলো আর নারীরা খোলামুখ ও খোলা মাথায় ঘোরাফেরা করছিলো। মদ্যপান ও ব্যভিচার ব্যাপকহারে চলছিলো। সাধারণ লোকের কথা কি বলবো? আমীর-ওমারা, সুলতানগণ এমনকি একশ্রেণীর দুনিয়াদার আলিম-ওলামাও উচ্চাভিলাষী ও পার্থিব বিলাসিতার শিকার হয়েছিলো।

ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিশৃংখলা
ধর্মীয় ও রূহানী সূরতেহাল আরো খারাপ ছিলো। ক্বায়ামাত্বাহ্, বাত্বেনিয়াহ্, রাফেযী (শিয়া), মু’তাযিলা, মন্দ আলিমদের (ওলামা-ই সূ) ফিৎনা এবং আরো অসংখ্য নতুন নতুন বাতিল ফির্ক্বার আত্মপ্রকাশ ইসলামের কেন্দ্রীয় শহর বাগদাদ পর্যন্ত বিশৃংখলা ও অশান্তির জাল প্রসারিত করে রেখেছিলো।
প্রতিদিন হাজারো ওলামা-মাশাইখ, আমীর-উমারা এবং অন্যান্য মুসলিম নেতৃস্থানীয় লোক বাত্বেনিয়া ফির্ক্বার ষড়যন্ত্র ও তলোয়ার খঞ্জরের আঘাতের শিকার হচ্ছিলেন। প্রসিদ্ধ সালজূক্বী উজির নিযামুল মুলক তূসী ও খোদার ভয়শূন্য ওই হত্যাকারীদের হাতে শহীদ হয়েছিলেন। গ্রীক দর্শন ইসলামী আক্বাইদ ও দৃষ্টিভঙ্গির শিকড়কে উপড়ে ফেলছিলো। ইসলামী আলিমগণও তাঁ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দ্বীন থেকে ক্রমশঃ দূরে সরে যাচ্ছিলেন। এসব কারণে মি. গীবন ও অন্য উপরোপীয় ঐতিহাসিকগণ এ যুগকে ইসলামী জুনিয়ার এক অন্ধকার যুগ বলে গণ্য করেছেন।

হুযূর গাউসে পাকের অপূর্ব সংস্কার
হযরত গাউসে আ’যম দস্তগীর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নিজের এবং তাঁর প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ফয়যপ্রাপ্তদের প্রচেষ্টায় না শুধু দ্বীন-ই ইসলামে নতুন জীবন প্রকাশ পেয়েছে বরং সেটার প্রতিরক্ষা ক্ষমতা এ পর্যন্ত জাগ্রত ও মজবুত হয়েছিলো। যখন ৭ম শতাব্দির শুরুতে অর্থাৎ ৬১৫ শতাব্দির অর্থাৎ ৬৫৬ হিজরী পর্যন্ত ইসলামী রাজ্যগুলোর বেহাল দশা হয়ে গিয়েছিলো, তখন প্রকাশ্য অবস্থাদির দাবী ও সাধারণ প্রত্যাশার বিপরীতে ইসলামের প্রদীপ নিভে যাওয়ার পরিবর্তে না শুধু আলোকিত ছিলো বরং শুধু পঁচিশ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ৬৮০ হিজরী সময় সীমায় খোদ্ ওই হামলা ও ধ্বংসলীলা পরিচালনাকারীদেরকে নিজেদের (মুসলমানগণ) দলের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে সক্ষম হয়েছিলো।
এ যুদ্ধজয় কোন শাহী সেনাবাহিনী কিংবা পার্থিব শক্তি দ্বারা সুসম্পন্ন হয়নি বরং ওই সুলতান ওজূদ, ক্বুত্ববুল ওয়াক্বত, খলীফাতুল্লাহ্ ফিল আরদ্ব, ওয়ারিসে কিতাব ও নায়েবে রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম গাউসে আ’যম দস্তগীরের রূহানী ক্ষমতা প্রয়োগেরই কারামাত ছিলো; ইসলামের শত্রুরা ইসলাম ক্বুবূল করে সেটার ওই খিদমত আনজাম দিয়েছেন, যা ইতিহাসে জ্বলন্ত স্বাক্ষর হয়ে আছে। যেমন এক তাতারী শাহযাদার ইসলাম গ্রহণ এবং তাঁর অসাধারণ খিদমত এ ক্ষেত্রে সবিশেষ প্রনিধানযোগ্য।

তাতারী শাহযাদা
ইতিহাসের পাতায় এ ঘটনা অতি প্রসিদ্ধ হয়ে আছে যে, তাতারীদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর সিলসিলাহ্-ই আলিয়া ক্বাদেরিয়ার এক খোরাসানী বুযুর্গ এক অদৃশ্য ইঙ্গিতে হালাকু খানের পুত্র তাগুদার খানের নিকট পৌঁছলেন। তখন তাগুদার খান শিকার করে ফিরে আসছিলেন। তিনি তাঁর মহলের দরজায় ওই দরবেশকে দেখে ঠাট্টাচ্ছলে বলতে লাগলেন, ‘‘ওহে দরবেশ! তোমার দাড়িরূপী লোমগুলো উত্তম, না কি আমার কুকুরের লেজ উত্তম।’’ তিনি জবাবে বললেন, ‘‘আমি ও আমার মালিকের কুকুর। যদি আমি আমার প্রাণটুকু উৎসর্গ করে এবং বিশ্বস্ততার মাধ্যমে তাঁকে খুশী করতে পারি, তবে আমার দাড়ির লোমগুলোই উত্তম। অন্যথায় আপনার কুকুরের লেজের লোমগুলো উত্তম, যা আপনার নির্দেশ পালন করে এবং আপনার জন্য শিকারের খিদমত আনজাম দেয়।’’
ক্বাদেরী দরবেশের এ সুন্দর জবাব ও বাচনভঙ্গি তাগুদার খানের উপর দারুণভাবে প্রভাব ফেললো। সুতরাং তিনি তাঁকে নিজের অতিথি করে রেখে তাঁর নিকট থেকে শিক্ষা ও দীক্ষা নিতে লাগলেন। দরবেশ তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং তাঁর দাওয়াতের প্রভাবে এক পর্যায়ে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন; কিন্তু তিনি তাঁর ইসলাম গ্রহণের কথা এ কারণে প্রকাশ করেননি যেন তিনি ক্রমশঃ অতি সতর্কতার সাথে তাঁর সম্প্রদায়কেও ইসলামের দিকে ধাবিত করতে পারবেন। তারপর সময় ও সুযোগ বুঝে তা প্রকাশ করবেন।
তারপর দরবেশ তাঁর দেশে চলে গেলেন এবং সেখানে ওফাত বরণ করেন। তবে তিনি তাঁর পুত্রকে তাগুদার খানের নিকট গিয়ে দ্বীন প্রচারের অবশিষ্ট কাজটুকু সমাধার জন্য ওসীয়ত করে যান। هر چه پدر نتوانست پسر تمام كند(পিতা যা অসম্পূর্ণ রেখে যান, তা পুত্র পূর্ণতায় পৌঁছায়) অনুসারে কিছুদিন পর তাঁর পুত্র পিতার ওসীয়ত অনুসারে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে তাগুদার খানের নিকট পৌঁছে যান। তাগুদার তাঁকে বললেন, ‘‘নেতৃস্থানীয় প্রায় সবাই ইসলাম কবুল করার উপক্রম হয়ে গেছে; কিন্তু একজন সরদার, যার অনুসারী এক বিরাট দল রয়েছে, কোনমতে ইসলাম গ্রহণে সম্মত হচ্ছে না।
দরবেশযাদা তাগুদার খানের সাথে পরামর্শ করে ওই সরদারকে ডেকে পাঠালেন। সরদার আসার পর তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন কিন্তু সে বললো, ‘‘আমি একজন সিপাহী, জীবনেন এ পর্যন্ত যুদ্ধের মধ্যে অতিবাহিত করেছি। আমি শুধু শারীরিক শক্তিতে বিশ্বাস রাখি। আপনি যদি আমার পলোয়ানকে কুস্তিতে পরাজিত করতে পারেন, তবে আমি মুসলমান হয়ে যাবো।’’ একথা শুনে দরবেশ তাগুদার খানের নিষেধ সত্ত্বেও ওই সরদারের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন আর মোকাবেলার জন্য দিন-তারিখ ও সময় নির্দ্ধারণ করে গণজমায়েতের সম্মুখে তা সম্পাদনের ঘোষণাও দিয়ে দিলেন। তাগুদার খান দরবেশকে এ বলে এ মল্ল যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করলেন একজন তাতারী নও জোয়ান পলোয়ানের সাথে আপনার মতো একজন বয়োপ্রাপ্ত দুর্বল লোকের কুস্তি খেলা আত্মহত্যার নামান্তর।’’ কিন্তু প্রতিপক্ষ সরদার বললো, ‘‘এ মোকাবেলা অবশ্যই হবে। কারণ, সরদার ভাবলো এতে দরবেশ যদি মারা যান, তবে এমন অযৌক্তিক কাজের দিকে অন্য কেউ আর এগুবে না, দ্বিতীয়তঃ তাগুদার খানও এ ভিন্নধর্মী দরবেশের প্রভাব ও প্রচারণা থেকে মুক্তি পাবেন।
সুতরাং নির্দ্ধারিত দিনে হাজার হাজার উৎসুক লোকের উপস্থিতিতে মোকাবেলা হলো। হযরত দরবেশ ময়দানে যাওয়া মাত্র প্রতিপক্ষ পলোয়ানের মুখম-লে এত জোরে চপেটাঘাত করলেন যে, তাঁর আঘাতের চোটে তাতারী পলোয়ানের মাথার খুলি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। পলোয়ান সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মারা গেলো। অমনি চতুর্দিকে দরবেশের জয় ধ্বনি উচ্চারিত হতে লাগলো। সবাই হতবাক হয়ে বলতে লাগলো, ‘‘জানি না এ শীর্ণকায় বৃদ্ধ ও বাহ্যিকভাবে দুর্বল দরবেশ কার পলোয়ান?’’
সুতরাং এর প্রভাব পড়লো যে, ওই সরদার ময়দানে এগিয়ে গিয়ে ওই দরবেশের হাতে চুমু খেলো এবং আপন প্রতিশ্রুতি অনুসারে ইসলাম গ্রহণ করে তা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিলো। এমনকি উপস্থিত লোকের বেশীর ভাগই ইসলাম কবূল করলো। তাগুদার খান নিজেও তাঁর গোপনকৃত ইসলাম গ্রহণের প্রকাশ্যে ঘোষণা দিলেন। তাঁরপর নিজের নাম রাখলেন ‘আহমদ’। এরপর তিনি ইসলাম বিদ্বেষী বিরুদ্ধবাদীদের হাতে শহীদ হবার পূর্ব পর্যন্ত ইসলামের খিদমতেও আত্মনিয়োগ করেন। তাঁরপর হালাকু খানের এক চাচাত ভাই রাফেযীর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন, তারপর আহমদ তাগুদার খানের ভ্রাতুষ্পুত্রের ছেলে গযন মাহমূদ (১২৯৫-১৩০৫খ্রি.)ও ইসলাম গ্রহণ করেন।
মোটকথা, এভাবে মধ্যপ্রাচ্য তাতারী রাজত্ব ‘তাতারী ইসলামী হুকুমত’ বা রাজত্বে পরিণত হয়েছিলো।
তাছাড়া, ভারতে চিশতিয়া সিলসিলাহ্ ও ইরাকে সুহরুওয়ার্দিয়া সিলসিলাহর প্রতিষ্ঠা এবং প্রসার ও হুযূর গাউসে পাকের ফয়যের ফসল। সুলতান সালাহ্ উদ্দীন আইয়ূবীও হুযূর গাউসে পাকের ফয়য ধন্য ছিলেন। আ’লা হযরত এ প্রসঙ্গে অতি চমৎকার বলেছেন-
تو حسنى حسينى كيوں نه محى اللدين هو
اۓ حضر مجمع بحرين هے شمه تيرا
অর্থ: আপনি পিতৃকুলের দিক দিয়ে হাসান এবং মাতৃকুলের দিক দিয়ে হোসাঈনী। সুতরাং আপনি কেনই বা মুহিউদ্দীন (দ্বীন ইসলাম) পুনর্জীবিতকারী হবেন না? হে উম্মতে খাদ্বির! আপনি তো হাসানী ও হোসাঈনীরূপী দু’সমুদ্রের সংযোগস্থল।

লেখক: মহাপরিচালক-আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।