শিশুদের প্রতি মহানবী’র ভালোবাসা- আ. শ. ম. বাবর আলী

শিশুদের প্রতি মহানবী’র ভালোবাসা- আ. শ. ম. বাবর আলী

শিশুদের প্রতি মহানবী’র ভালোবাসা

আ. শ. ম. বাবর আলী

===

মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম শিশুদেরকে খুব ভালোবাসতেন। স্নেহ করতেন। তিনি বলতেন, ‘শিশুরা বেহেশ্তের প্রজাপতি।’ অর্থাৎ প্রজাপতিরা যেমন তাদের সুন্দর শরীর আর মন নিয়ে ফুলবনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, শিশুরাও তেমনি তাদের সুন্দর মন নিয়ে পৃথিবীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। প্রজাপতির স্বভাব যেমন নিষ্কলুষ, শিশুরাও তেমনি। তাই তিনি বলেন,‘শিশুদেরকে যে ভালোবাসে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’
শিশুদেরকে দেখলে তিনি আদর করতেন। দু’হাত মেলে দিতেন তাদের দিকে। তারপর বলতেন,‘ দেখিতো, কে আগে আমার কাছে পৌঁছাতে পারো।’

শিশুরা একসাথে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়তো। কেউ তাঁর কোলে, কেউ তাঁর কাঁধে, কেউ তাঁর বুকে। কেউ ঝুলে পড়তো তাঁর গলায়। এসব শিশুর অনেককেই তিনি হয়তো চিনতেন না। কিন্তু তাদের সবাইকে নিয়ে তিনি আদর করতেন। সবার সাথে আনন্দ করে খেলাধুলা করতেন। শুধু তাই নয়, তাঁদেরকে কোলে নিয়ে তিনি চুমু খেতেন। একদিন ‘আমর’ নামে একজন সাহাবা এসে দেখলেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কয়েকজন শিশুকে আদর করে চুমু খাচ্ছেন। তখন ‘আমর’ বললেন,‘ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম! আপনি শিশুদেরকে চুমু খাচ্ছেন। অথচ আমার ঘরে দশটি শিশুসন্তান আছে, আমি কখনো তাদেরকে একবারও চুমু খাইনি।’

নবীজী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন‘আমর, স্নেহবাৎসল্য, দয়ামায়া থেকে আল্লাহ তোমাকে বঞ্চিত রাখলে আমার করার কিছু নেই।’

অর্থাৎ যারা শিশুদেরকে আদর করে না, নবীজি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে দয়ামায়াহীন বলে অভিহিত করতেন। আর এমন ব্যক্তি আল্লাহর কাছে যে কত অপছন্দনীয় সে কথা তো সাহাবাদের কাছে তিনি অনেকবার অনেকভাবে বলেছেন।

নবীজি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের কাছে শিশু তো শিশুই। তার কোনো জাত-পাত, ধর্মাধর্ম ছিল না। বিধর্মী ও কাফেরদের শিশু সন্তানদের প্রতিও তাঁর সমান স্নেহবোধ ছিল। তাদেরকেও তিনি সমান আদর করতেন, একটু আগেই সে কথা বলা হয়েছে।

একবার কাফেরদের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে বেশ কিছু শিশু মুসলমানদের হাতে নিহত হয়। এ খবর শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম খুব বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তখন এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে বললো, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম! ওরা তো সব কাফেরদের সন্তান।’

এ কথা শুনে রাছুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, ‘কাফেরদের সন্তান বলে কি তাদেরকে হত্যা করতে হবে? শিশুরা যে ধর্মেরই হোক না কেন, তারা তোমাদের চেয়ে উত্তম। সাবধান! কোনো রকম পরিস্থিতিতে কোনো শিশুকে তোমরা হত্যা করো না। প্রতিটি শিশুই ইসলামের বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। পরে পিতামাতা দ্বারা পরিচালিত হয়ে তারা সত্য অথবা মিথ্যার পথে গমন করে।’

নবীজী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কোন পথ দিয়ে আসবেন জানতে পেরে সে এলাকার শিশুরা পথের দু’পাশে এসে হাজির হতো। নবীজী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের আগমন ঘটলে তারা নেচে-গেয়ে আনন্দ-উল্লাস শুরু করে দিত। নবীজী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামও এতে খুব আনন্দ করতেন। শিশুরাও নবীজী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের আদর পেয়ে আনন্দে উচ্ছ্বল হয়ে উঠতো।
নবীজী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন দরবারে বসে কোনো কাজ করতেন, সে সময় কোনো শিশু সেখানে এলে সব কাজ ফেলে রেখে আগে তাদের সাথে কথা বলতেন, তাদের ভালোমন্দের খোঁজখবর নিতেন। বেশ কিছুক্ষণ তাদের আদর করতেন। তারপর পুনরায় কাজে বসে যেতেন। কাজটি যতই জরুরী হোক না কেন, এর কোনো ব্যতিক্রম হতো না।

মদীনার মসজিদে নববীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নামাজের জামাতে ইমামতি করতেন। এ জামাতে মহিলা নামাজীরাও শরিক হতো। তারা তাদের শিশু সন্তানদেরকেও নিয়ে আসতো এবং তাদেরকে একটু দূরে রেখে জামাতে নামাজ আদায় করতো। তিনি যখন ইমামতি করতেন, এসময় কোনো শিশুর কান্নার আওয়াজ তাঁর কানে গেলে তিনি দ্রুত নামাজ শেষ করতেন, যাতে ওই শিশুর কোনো কষ্ট না হয়।

শিশু হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ও হোসেন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ছিলেন নবীজি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের নাতি। নবীজি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তাঁদের দু’জনকে নিয়ে প্রায় সময় তিনি মজার মজার খেলা করতেন। নানা নিজে হামাগুড়ি দিয়ে ঘোড়া সাজতেন। দু’নাতি পিঠে সওয়ার হতেন। এমনিভাবে খেলা চলতো অনেকক্ষণ ধরে। আর এই মজার খেলাটা দুই নাতিকে নিয়ে তিনি প্রায়ই করতেন। নাতিরাও খুব আনন্দ পেতো। অনেক সময় নবীজী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন নামাজে সেজদায় যেতেন, শিশু দুই নাতি তাঁর পিঠে চড়ে বসতেন। তাঁরা তাঁর পিঠ থেকে না নামা পর্যন্ত তিনি সেজদারত অবস্থায় থাকতেন। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটতো। কিন্তু কখনোই তিনি বিরক্তিবোধ করতেন না। নিষেধও করতেন না।

একদিন নবীজী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মসজিদে খোত্বা দিচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখলেন, তাঁর শিশু নাতি হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ও হোসেন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর দিকে দৌড়ে আসতে যেয়ে পা পিছলে পড়ে যাওয়ার অবস্থা। সাথে সাথে খোত্বা দেওয়া বন্ধ করে মিম্বর তেকে ছুটে এসে তিনি তাঁদেরকে কোলে তুলে নিলেন। তারপর তাঁদেরকে সামনে বসিয়ে রেখে আবার খোত্বা দিতে শুরু করলেন।

মসজিদে কোনো শিশু এলে তাকে তিনি সামনে ডেকে নিতেন। তিনি তাঁর সাহাবাদেরকে উদ্দেশ করে বলতেনÑ‘শিশুদের প্রতি এমন আচরণ করো, যাতে তাদের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ সৃষ্টি হয়।’ তিনি আরও বলতেনÑ‘যারা শিশুদের প্রতি ভাল ব্যবহার করে না, তারা আমার উম্মত নয়।’ কোনো শিশুর সাথে নবীজী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাক্ষাৎ হলে নবীজী আগেই তাকে সালাম দিতেন। তিনি মনে করতেন, শিশুদের মন অত্যন্ত সরল ও বিশ্বাসী। তাই তাদের কাছে কোনো ওয়াদা করলে যথাসময়ে তা পূরণের জন্য তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। এতিম শিশুদের প্রতি তাঁর দরদটা ছিল আরও বেশি।

এক ঈদের দিনে সকালবেলা নবীজি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দেখলেন, রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে একটা শিশু কাঁদছে। পরনে তার ছিন্ন বস্ত্র। সারা শরীর কাদায় ঢাকা। শিশুটির কাছে যেয়ে জিজ্ঞাসা করে তিনি জানতে পারলেন, ছেলেটি এতিম। অর্থাৎ তার মা বাবা কেউ নেই। এ কথা শুনে তাঁর খুব খারাপ লাগলো। শিশুটির প্রতি তাঁর মায়া হলো। তাকে সাথে করে বাড়িতে নিয়ে এলেন। স্ত্রী হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে বললেন, শিশুটিকে ভালোভাবে গোছল করিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করিয়ে দিতে। হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা তাকে তেমনিভাবে করিয়ে দেওয়ার পর তিনি নিজ হাতে তাকে নতুন পোশাক পরিয়ে ঈদের নামাজ পড়তে নিয়ে গেলেন। আদর করে শিশুটিকে বললেনÑ‘আজ থেকে আমি তোমার বাবা আর আয়েশা তোমার মা।’

কোনো দুঃখী মানুষের কষ্ট দেখলে নবীজি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের কষ্ট তো হতোই, বিশেষ করে কোনো শিশুর কষ্ট দেখলে, তাঁর দু’চোখ অশ্রুতে ভরে যেতো। চলার পথে কোনো শিশুকে কাঁদতে দেখলে, তাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতেন।

অন্যকে জ্ঞান দান করা উত্তম কাজ। কিন্তু শিশুদেরকে জ্ঞান দান করা আরও উত্তম। তাই নবীজী বলেনÑ‘শিশুদেরকে সদাচার ও জ্ঞান শিক্ষা দেওয়া দান-খয়রাত করার চেয়েও উত্তম।’ শিশুদের কোনো ধরনের আচরণেই কখনও তিনি বিরক্ত হতেন না। একবার তিনি একটা শিশুকে কোলে নিয়ে মিষ্টি খাওয়াচ্ছিলেন। এমন সময় শিশুটি হঠাৎ তাঁর কোলে প্রস্রাব করে দিল। কিন্তু তিনি তাতে বিন্দুমাত্র বিরক্ত হলেন না; বরং নিজেই পানি দিয়ে উক্ত স্থানটি ধুয়ে নিলেন। এমনিভাবে শিশুদেরকে তিনি অন্তর দিয়ে অকৃত্রিমভাবে ভালোবাসতেন। হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু দীর্ঘদিন নবীজীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে ছিলেন। তিনি বলেনÑ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের মত শিশুদেরকে এত অধিক ভালোবাসতে আর কাউকে দেখিনি।’

লেখক: কনসালটেন্ট (প্রকাশনা), ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন।