অতুলনীয় নবীর বংশধারার পবিত্রতা, শুভজন্ম, শৈশবের অলৌকিকত্ব

অতুলনীয় নবীর বংশধারার পবিত্রতা, শুভজন্ম, শৈশবের অলৌকিকত্ব

অতুলনীয় নবীর বংশধারার পবিত্রতা, শুভজন্ম, শৈশবের অলৌকিকত্ব-

হাফেজ আনিসুজ্জমান >

পবিত্র বংশধারায় নূরের আমানত
আল্লাহ্ তা‘আলা অতি সুন্দর, তিনি সুন্দরকে ভালবাসেন। তিনি সুন্দরের ¯্রষ্টা। তাঁর বিশাল সৃষ্টির ক্ষূদ্রাতিক্ষূদ্র অংশেও মুগ্ধ হওয়ার মত এত শিল্প সুষমা, যে কোন দর্শককেই নিমেষে মুগ্ধ করবে। তাঁর সৃষ্টির অনুপম সৌন্দর্য দেখে শ্রদ্ধায় মাথা আপনিই নুয়ে আসে। তবুও স্বীকার করতে হয়, প্রতিটি সুন্দরের মাঝে তিনি খুঁত রেখেছেন। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টিজুড়ে এমন এক সৃষ্টির নজীরই রেখেছেন, যাঁর সৌন্দর্যে কোন খুঁত নেই, যাঁর পূর্ণতায়ও নেই কোন ত্রুটি। তাঁর অনুপম রূপসৌন্দর্যে মোহিত কেউ গেয়ে ওঠেন, ‘‘তিনি সুন্দর, অতি সুন্দর, নিখিলের চির সুন্দর।’’ বলতে হবে, তিনি অনিন্দ্য সুন্দর।
কে, সেই সুন্দর কে? তিনি আর কেউ নন, তিনি আমাদের প্রিয় নবী, আল্লাহ্র হাবীব, নির্দোষ, নির্মল, নিখুঁত, রূপের চির অহঙ্কার সায়্যিদুনা হযরত আহমদে মুজতাবা, মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। আর কেউ বা সেই রূপে মুগ্ধ হয়ে বলে ওঠেন-
بلغَ الْعلى بكماله -كشف الدُّجى بجماله
حسنت جميع خصاله- صلُّوا عليه واله
[হযত শেখ সা’দী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি] কোন প্রকার ত্রুটি নেই এমন সৌন্দর্যের আধার, তাঁর সেই পবিত্র রূপ মনোহর দৃষ্টে শায়েরে রাসূল হযরত হাস্সান বিন সাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর দিওয়ানে হস্সান-এ লিখেন,
خلقت مُبَرّأ من كُلّ عيْبٍ – كانّك قد خلقتَ كمَا تَشَاءُ
সকল প্রকার ত্রুটি থেকে মুক্ত রূপে আপনাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আপনি যেমনটি চান, ঠিক তেমনভাবেই যেন আপনাকে বানানো হয়েছে। কী সমস্যা, জানি না, কুফর, শির্ককে যারাই দূষণীয় মনে করে, তারা নবীজির বংশধারায় এগুলোর কালিমা মাখাতে চায় কী করে? অথচ তাঁর বংশধরকেও আল্লাহ্ তা‘আলা পবিত্র করার কথা ঘোষণা করেছেন। [সূরা: আহযাব’র ৩৩ নম্বর আয়াত দ্রষ্টব্য] প্রিয়নবীর পিতা-মাতাই শুধু নন, বরং তাঁর উর্ধ্বতন বংশ পরম্পরায় হযরত আদম ও হযরত হাওয়া আলায়হিমাস্ সালাম পর্যন্ত সকলেই মুমিন ছিলেন। আল্লাহ্ রাব্বুল আ-লামীন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, ولعبد مؤمن خير من مشركٍ-অর্থাৎ ‘‘মুশরিকের চেয়ে মুমিন বান্দাই উত্তম।
[সূরা: বাক্বারা, ২২১ আয়াত] মুমিন উৎকৃষ্ট, পক্ষান্তরে মুশরিক নিকৃষ্ট। আল্লাহ্ তাঁর নবীর পিতা-মাতাসহ হযরত আদম-হাওয়া পর্যন্ত (আলায়হিমুস্ সালাম) উভয়কুলে বংশধারায় কেউ মুশরিক রাখতে পারেন, এ কথা বলা যায় না।
এ মর্মে স্বয়ং রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
بُعثت من خيرِ قُرونِ بنِى ادم قرنًا فقرنًا حتى كنتُ مِن القرنِ الّذِىْ كنْتُ فِيه-
অর্থাৎ আদম সন্তানের প্রজন্ম পরম্পরায় আমি উত্তম প্রজন্মেই প্রেরিত হয়েছি। (হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত এ হাদীস ইমাম বুখারী তাঁর সহীহ-তে লিপিবদ্ধ করেন।)
অন্যত্র আল্লাহ্ জাল্লাহ্ শানুহু ইরশাদ করেন-انما المشركون نجسُ অর্থাৎ- মুশরিকরাই তো অপবিত্র, নাপাক। [সূরা: তাওবা, আয়াত-২৮] পবিত্র ক্বোরআনে আল্লাহ্ নিজেই ঘোষণা করছেন, মুশরিক না-পাক। আর তিনিই কি তাঁর হাবীবকে না-পাক বংশধারায় প্রেরণ করে থাকবেন? যাঁকে তিনি প্রেরণ করেছেন কুফর, শির্ক, ইলহাদ থেকে তাঁর বান্দাদের পাক করার জন্য।
এ প্রসঙ্গে আরও একটি হাদীস শরীফ চয়ন করা যাক,
لم ازل افقل من املاب الطاهرين الى ارحام الطاهرات-
(ইরশাদে নবভী), ‘‘আমি বরাবর পবিত্র পৃষ্ঠদেশ থেকে পবিত্র জঠর দেশে স্থানান্তরিত হয়ে এসেছি।’’
আরেকটি হাদীসে পাকে ইরশাদ হয়েছে-
لم يزل الله ينقلنى من الاصلاب الطيبة انى الارحام الطاهرة مصفى مهذبًا لاتشعب سعبة الا كنت فى خير هما-
অর্থাৎ- ‘‘আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে পবিত্র পৃষ্ঠদেশ থেকে পবিত্র উদরে স্থানান্তর করতে থাকেন। যাঁরা ছিলেন নির্দোষ, নিষ্কলুষ হালতে। সেই ধারা যখনই বিভক্ত হযেছে, আমি ছিলাম তাঁর উত্তম ভাগে।’’
উভয় হাদীস ইমাম আবু নুয়াইম তাঁর ‘দালায়েলুন নুবুওওয়াত’ গ্রন্থে সায়্যিদুনা ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণনা করেন।
উপরোক্ত বর্ণনা থেকে এ দাবী প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে, প্রিয় নবীর পিতৃকুল ও মাতৃকুলের পূর্ব পুরুষগণ সকলেই ঈমান ও তাওহীদে বিশ্বাসী ছিলেন।
আমাদের নবীজির পবিত্র বংশধারা কুফর, শির্ক, এমনকি অনৈতিক আচরণ থেকেও পাক-সাফ রাখা হয়েছিল। এ দলীল সমূহ আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র ‘শুসূলুল ইসলাম লিউসূলির রাসুল আল্কিরাম’- এ পত্রস্থ উদ্ধৃতি। যা গ্রহণ করেন ফখরুল মুতাকাল্লিমীন ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী আলায়হির রাহমাহ্। সে মতামতকে সঠিক জেনে তাঁকে সমর্থন করেছেন ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূতী, মুহাক্কিক সানূসী, আল্লামা তিল মিসানী, ইমাম ইবনে হাজার আলমক্কী, মাওয়াহেবে লাদুনিয়্যাহ্’র ব্যাখ্যাকার ইমাম যুরকানী’র মত বিশ্ববরেণ্য ওলামায়ে কেরাম। ইমাম সুয়ূতী তো ছয় ছয়টি প্রামাণ্য কিতাব এ বিষয়ের ওপর প্রণয়ন করেন।
সুরা শুআরার ২১৯তম আয়াতের তাফসীরে ‘‘আফদ্বালুল কুরা’’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘‘প্রিয়নবীর নূর মুবারক একজন সাজদাকারী থেকে অপর সাজদাকারীর মধ্যে স্থানান্তর হতে হতে (অবশেষে মা-আমেনা হতে) প্রকাশিত হয়। অতুলনীয় এক শিশুর অভিনব শুভাগমন
সায়্যিদুনা আমেনা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা নিজে বর্ণনা করেন, আমার সন্তান পৃথিবীতে শুভাগমন করার শুভ মুহূর্তে আমি দেখলাম, এক ‘নূর’ প্রকাশিত হল। যার আলোতে সিরিয়ার প্রাসাদগুলো পর্যন্ত উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। ওই প্রাসাদগুলো আমি (মক্কা নগর থেকে) দেখতে পাই। [মাদারেজুন্নুবুওওয়াহ্] প্রকাশিত ওই ‘নূর’ আর কিছু নয়, এযে নবীয়ে মক্কী, মাদানী, আরবী ধুলার ধরায় আত্মপ্রকাশ করল। মা আমেনার কোলে আজ যিনি আত্মপ্রকাশ করলেন, তিনি তাঁর কোলই শুধু আলোকিত করেননি, পৃথিবীর চতুর্দিগন্তই আজ আলোকিত। বিশ্বপ্রকৃতিতে এমন আলোড়ন সহকারে যিনি মর্ত্যরে মাটিতে শুভপদার্পন করলেন, তিনি যে আমার তোমার মত কেউ নয়, তা বুঝবার কী বাকী আছে! সীরাতের গ্রন্থাবলীর পৃষ্ঠাই শুধু পূর্ণ হয়েছে, তা নয়, সৃষ্টি জুড়ে যে আনন্দের বন্যা, তা অনুভবের, বর্ণনার নয়। মানুষের অন্তর্জগত পর্যন্ত কী এক স্বর্গীয় আলোর বন্যায় উদ্ভাসিত!
এ ক্ষণে গোলাম মোস্তফার ‘বিশ্বনবী’ থেকে কিছু উদ্ধৃতি না আনলে মনে হচ্ছে বাংলাভাষী সুন্নী মুসলমান হিসেবে অন্তরের অলিন্দে কী এক অপূর্ণতা রয়ে গেল। রেওয়ায়েতগুলোর নির্যাস মিলবে এতে।
‘‘আমিনা দেখতেছিলেন: এক অপূর্ব নূরে আসমান-যমীন উজালা হইয়া গিয়োছে। সেই আলোকে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা ঝলমল করিতেছে। কার যেন আজ শুভাগমন, কার যেন আজ অভিনন্দন। যুগ-যুগান্তরে প্রতীক্ষিত সেই না আসা অতিথির আগমন মুহূর্ত আজ যেন আসন্ন হইয়া উঠিয়াছে। তাঁরই অভ্যর্থনার জন্য আজ যেন এই আয়োজন। কুল মাখ্লুকাত আজ সেই আনন্দে আত্মহারা। গগনে-গগনে ফেরেশতারা ছুটাছুটি করিতেছে, তোরণে-তোরণে বাঁশী বাজিতেছে। সবাই আজ বিস্মিত, পুলকিত, কম্পিত শিহরিত। জড়-প্রকৃতির অন্তরে আজ দোলা লাগিয়াছে, খসরুর রাজ প্রাসাদের স্বর্ণচূড়া ভাঙিয়া পড়িয়াছে, কা’বা, মন্দিরের দেব-মূর্তিগুলি ভূলুন্ঠিত হইয়াছে; সিরিয়ার মরুভূমিতে নহর বহিতেছে। তাঁরই অপূর্ব বর্ণনায়, ‘‘কে এই নব অতিথি- কে এই বেহেশতী নূর- যাঁহার আবির্ভাবে আজ দ্যুলোকে ভূলোকে এমন পুলক শিহরণ লাগিল?
এই মহামানব শিশুই আল্লাহর প্রেরিত সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ পয়গম্বর-নিখিল বিশ্বের অনন্ত কল্যাণ ও মূর্ত আশীর্বাদ- মানব জাতির চরম এবং পরম আদর্শ-¯্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি- বিশ্বনবী- হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম।’’
প্রিয় নবীর আম্মাজান সায়্যিদা আমেনা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা আরো অভিনব ঘটনার বর্ণনা করেছেন অলৌকিক শক্তির অধিকারী এ শিশুর শুভাগমনের মুহূর্তে। তাঁরই যবানীতে, ‘‘যখন আমার প্রিয় পুত্র রতœ ভূমিষ্ট হন, আমি দেখতে পেলাম যে, আমার এ শিশু সন্তান সাজদায় পড়ে আছেন। কতক্ষণ আবার দেখি, শির উত্তোলন করে উর্ধ্বমুখী হয়ে শাহাদত আঙ্গুলে ইশারা করে প্রাঞ্জল আরবী ভাষাতেই পাঠ করছেন, ‘আশহাদু আন লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্নী রাসূলুল্লাহ্।’’ অদ্ভুত, অপূর্ব এ দৃশ্যের বর্ণনা ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর খাঁসায়েসে কুবরা গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। ‘যিকরে জামীল’র বরাতে এ ঘটনার বর্ণনা অধ্যক্ষ আল্লামা হাফেজ এম এ জলীল রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর ‘নূর নবী’ গ্রন্থে সংকলন করেছেন।

ধারায় এল এ কোন শিশু
এ শিশু কোন্ অলোকের নূরের পুতুল, তিনি জানেন, তাঁর ¯্রষ্টা জানেন। দোলনায় শুয়ে কচি আঙ্গুলের ইঙ্গিতে চাঁদের সাথে কেমন তাঁর খেলা চলে! পৃথিবীর কোন্ মানব শিশু এমন আছে, আসমানী চাঁদ যাঁর খেলার অনুঃষঙ্গ। এ ঘটনার বর্ণনাকারী রাসূলুল্লাহ্র চাচা হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু। একবার আলাপচ্ছলে তিনি বললেন, ‘‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম! শৈশবে দোলনায় থাকাকালীন আপনার এক অদ্ভুত ঘটনা আমার মনে দারুণ রেখাপাত করে, যা পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণের প্রতি আমাকে প্রভাবিত করে। আমার দেখা এটি আপনার নবুওয়তের সপক্ষে স্মরণীয় ঘটনা ছিল। আমি লক্ষ্য করেছি দোলনায় শুয়ে শুয়ে আপনি আকাশের চাঁদের সাথে আপন মনে খেলছিলেন। আপনি ওই কচি আঙ্গুলে যেদিকে ইশারা করতেন, চাঁদ সেদিকেই হেলে যেত।’’
এ কথা শুনে মুচকি হেসে নবীজি বলেন, ‘‘চাচাজান, শুধু তাই নয়, আমি সে সময় চাঁদের সাথে কথাও বলতাম। চাঁদ আমার কথার জবাবও দিত। চাঁদ তো আমার নূরের খেলনা।’’ [মাওয়াহেবে লাদুনিয়্যাহ’র সূত্রে প্রাগুক্ত] উক্ত ঘটনা উপজীব্য করে আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু লিখেন ‘‘কাসীদায়ে নূর’-এর একটি পঙক্তি-
چاند جهك جاتاهے جدهر انلىক اٹهاے مهد ميں
كيا هى چلتا تها اشاروں پر كهلونا نور كا-
চন্দ্র ঝুঁকেই যেতো সেদিক, দোলনায় আঙ্গুল উঠতো যেদিক, চলতো কেমন সে ইশারায় আসমানী খেলনা নূরের।
এ কেমন শিশু! তায়েফ থেকে আসতে হালিমা সা’দিয়ার বিলম্ব হয় মক্কায় পৌঁছতে। কারণ, হালিমার বাহনের পশু ছিল দূর্বল। এদিকে ধনী ঘরের সন্তানদের আরব্য প্রথানুযায়ী মজুরী ভিত্তিক দুগ্ধদানের জন্য নিয়ে ফিরে যেতে লাগল বাকী ধাত্রীরা। হালিমা স্বামীর সাথে পরামর্শ করে ইয়াতীম শিশু মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) কেই নিয়ে ফিরল। কিন্তু একী? সবার পরে আসা হালিমার বাহন দ্রুত চলে সবাইকে ফেলে যাচ্ছিল। অদ্ভুত! এর কারণ একটি, পশুটির পিঠে সওয়ার আর কেউ নয়, সে যে অদূর ভবিষ্যতে বুরাকের সওয়ার, মে’রাজের যাত্রী। এঁরই বরকতে দূর্ভিক্ষের দরুণ যেখানে অন্য ছাগল ও মেষ পাল শুকিয়ে রোগা, সেখানে হালিমার ছাগল মেষ পরিতৃপ্ত হয়ে ঘরে ফিরে আসত স্তন ভরা দুধ নিয়ে। তাদের ঘরের হাড়ি-পাতিল দুধে টই-টম্বুর। তাঁর (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) দুধ মা হালিমা বলেন, ‘‘এই শিশুটির কারণে আমাদের ঘরে অভাব রইল না। প্রতিবেশীরা অধিক খাবারের আশায় তাদের মেষপাল পাঠাত আমাদের মেষপাল যেখানে চরতো সেখানেই। কিন্তু তাদের মেষপাল ফিরে আসত অভূক্ত পেটে, আর আমাদের মেষপাল ফিরে আসত ভরা পেটে, স্ফীত স্তনে। এ অবস্থা দেখে আমার স্বামী বলতেন, হালিমা আমাদের ভাগ্যে পাওয়া ইয়াতীম শিশুটি ভবিষ্যতে অসামান্য মর্যাদার অধিকারী হবে।’’ তাই কোন কবির নিবেদন ‘‘দুনিয়া ইয়ে ক্যহ্তী হে হালিমা, তু নে নবীকো পা-লা হ্যায়,’’ হালিমা সা’দিয়ার ঘরে থাকাকালীন আরেকটি ঘটনার কথাও বিবি হালিমা বর্ণনা করেন, ‘‘শিশুকালে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে কাঁদতে শোনা যেত না। একবার তাঁর কান্না শোনার ইচ্ছায় দু’টি হাত রশি দিয়ে বেঁধে দেই।’’ পরের অবস্থা স্বয়ং নবীজি বর্ণনা করেন, ‘‘আমার হাতের বাঁধন শক্ত হওয়ায় আমি ব্যথা অনুভব করতে থাকি। ব্যথায় আমি কান্না করতে যাবো এমন সময় আকাশের চাঁদ আমাকে শান্তনা দিয়ে বলতে লাগল, ‘আপনি কাঁদবেন না, কাঁদবেন না।’ চাঁদের কথার ধরনে আমি হেসে ফেললাম। মায়ের ওই আশা আর পূরণ হলো না।’’ [যিকরে জামীল’র বরাতে ‘নূর নবী (দ.)’] বিবি হালিমার কিশোরী কন্যা সায়মা শিশু নবীর দোলনা দোলাতেন, তাঁকে কোলে নিয়ে আদর-¯েœহে মাতিয়ে রাখতেন। কোরেশী ভাইটিকে তিনি কাছ ছাড়া করতে চাইতেন না। এ কারণে নবীজি তাঁকে খুবই সমীহ করতেন। সে ¯েœহ-মমতা আমাদের নবী সারা জীবন ভুলেননি। হুনাইনের যুদ্ধে (৮ম হিজরী) বনু সকীফ ও হাওয়াযেন গোত্রের প্রায় ছয় হাজার লোক নবীজির হাতে বন্দী হয়। নিজ বংশীয় বন্দীদের মুক্তি সুপারিশ জানাতে বার্ধক্যে নুয়ে পড়া সেই সায়মা নবীজির খেদমতে এসে হাজির। তাঁকে দেখেই মানবতার মুক্তি দাতা নবী সসম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে যান। ব্যস্ত হয়ে মাথার চাদর নামিয়ে তাঁর বসার জন্য বিছিয়ে দেন। সায়মা বন্দীদের মুক্তির আবেদন জানালে রহমাতুল্লিল আলামীন নিজের ভাগে পড়া বন্দীদের তাৎক্ষণিক মুক্ত করে দেন। নবীজির মহানুভবতায় মুগ্ধ প্রিয় সাহাবীগণ নিজেদের বন্দীদেরও মুক্তি দিয়ে দেন। নবীজির এমন উদার মানবতার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা কি আমাদের মনের সংকীর্ণতা দূর করতে পারব?
মেঘ কাকে ছায়া দেয়ার খেদমতে নিয়োজিত? মেঘমালা আল্লাহ্র সৃষ্টি, তাঁরই হুকুমে বান্দার রিযকের মাধ্যম পানি সেচনের কাজ করে সে কিন্তু এ মেঘমালার আরেকটি দায়িত্ব নবীর সেবায় থেকে তাঁকে ছায়া দিয়ে চলা। পরাশক্তির কোনো রাষ্ট্র নায়কের জন্যও মেঘ তা করবে না। নবীজির দুধ বোন সায়মার বর্ণনা, ‘‘আমি আমার কুরাইশী ভাইকে নিয়ে মাঠে মেষ চরাতে যেতাম। সেখানে একটি ব্যাপার আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করতাম, মরুর বুকে প্রচন্ড রোদে এক টুকরো বড় মেঘ বরাবর তাঁকে অনুসরণ করে তাঁর মাথায় ছায়া দিয়ে চলতো। সে যেদিকে যেত, তাঁর সাথে সাথে ওই মেঘ খন্ড ছাতা ধরা সেবকের মত তাঁকে ছায়া দিয়ে ভেসে চলত। [প্রাগুক্ত] যাঁকে কেন্দ্র করে বিস্তৃতি পেয়েছে মহান আল্লাহর সৃষ্টি লীলা, সেই সৃষ্টির মূল শ্রেষ্ঠতম রাসূল’র জাগতিক জীবনের দু’বছর যখন বয়স, তখন ঘটে আরেক অদ্ভুত, অলৌকিক এক ঘটনা। ‘‘হযরত দুধভাইদের সাথে মাঠে গিয়েছেন। ভাইয়েরা মেষ চরাচ্ছিল। এমন ক’জন বালক এসে জানাল, সাদা পোশাকের দু’জন লোক ‘মুহাম্মদ’কে ধরে বুক চিরে ফেলেছে। আমরা ছুটে গিয়ে দেখি সে বিবর্ণ হয়ে শোয়া। আমরা তাঁকে কোলে তুলে নিলাম। পরে সে জানাল দু’টি লোক আমাকে শুইয়ে দিয়ে আমার কলজে বের করে নিল। কিন্তু একটা জিনিষ তা থেকে বের করে ফেলে দিল। ’’ (বর্ণনায় বিবি হালিমা) আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এঘটনা বর্ণনা করেছেন। ইবনে হিশাম তা সংকলন করেন। পরিণত বয়সে আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর বুকে সেলাইয়ের দাগ দেখার স্বাক্ষ্য দেন। যাঁর শৈশবেই এত কিছু অলৌকিকত্ব, তাঁকে সাধারণ জানা কি সঙ্গত?

লেখক: আরবী প্রভাষক, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া, ষোলশহর, চট্টগ্রাম