প্রতিক্ষণে অযুত কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে ফিরছে তাঁর মহিমাগাথা

প্রতিক্ষণে অযুত কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে ফিরছে তাঁর মহিমাগাথা

প্রতিক্ষণে অযুত কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে ফিরছে তাঁর মহিমাগাথা
কাশেম শাহ

প্রতিদিন প্রতিক্ষণে বিশ্বের প্রতি প্রান্তে অযুত কণ্ঠে ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছে তাঁর মহিমাগাথা। তিনি রাহমাতুল্লিল আলামিন। তিনি সমগ্র সৃষ্টির পথপ্রদর্শক। তিনি ইমামুল আম্বিয়া। সকল আসমানি কিতাবে তাঁর আগমন বার্তা ও প্রশংসাসূচক আয়াত সন্নিবেশিত ছিল। পূর্ববতী প্রত্যেক নবী-রাসূল আলায়হিমুস্ সালাম স্ব-স্ব উম্মতের নিকট তাঁর আগমনের কথা পৌঁছিয়েছেন। তিনি নূর, তিনি জ্যোতি, তিনি আলোকবর্তিকা। তিনি সর্বকালের, সর্বযুগের, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল, সোমবার তাঁর আগমনে ধন্য হয়েছিল গোটা পৃথিবী-আকাশ-নক্ষত্রমণ্ডল। তাঁর জন্মের চেয়ে আগমনের বিষয়টি অধিক তাৎপর্যপূর্ণ এবং ব্যাপক অর্থবোধক। তাঁর আগমন কিয়ামত অবধি সকল প্রাণী, স্থান ও কালের জন্য প্রযোজ্য। তাই তাঁর আগমনকে উপলক্ষ করে আনন্দ প্রকাশের মূল উদ্দেশ্য হল তাঁর জাতের প্রতি এবং তাঁর আনীত যাবতীয় বিধি-বিধানের প্রতি ভালোবাসাপূর্ণ ও সুদৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা এবং বাস্তব জীবনে তাঁর পূর্ণাঙ্গ অনুসারী হওয়ার সাধনা করা। এভাবে ঈদে মিলাদুন্নবীর দর্শনকে গ্রহণ করলে যথাযথ খুিশ উদ্যাপন করা হবে নিঃসন্দেহে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আপনি বলে দিন, আল্লাহর ফজল (অনুগ্রহ) এবং রহমত (দয়া) এর বিনিময়ে তারা যেন আনন্দ করে। এটি তাদের অর্জিত সকল সঞ্চয় হতে উত্তম।’ [সূরা ইউনুস : ৫৮] এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর অনুগ্রহ ও দয়া প্রাপ্তির ওপর খুশি উদ্যাপন করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এমন কাজকে উত্তম ইবাদত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র জন্মদিনই গোটা দুনিয়ার সৃষ্টির জন্য এক বিরাট নিয়ামত প্রাপ্তির দিন, মহাখুশির দিন, সর্বোত্তম দিন। হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যেই দিন যেই মুহূর্তে পৃথিবীতে তাশরিফ এনেছিলেন, সেই দিন ও সেই মুহূর্তটি বিশ্বজগতের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দের দিন। এ জন্য বলা হয় ঈদে মিলাদুন্নবী বা নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মোৎসব বা জন্ম দিবসের আনন্দ। তিনি বিশ্বমানবতার প্রতীক ও সত্য-সুন্দরের বাণীবাহক।
কোরআনে পাকে ইরশাদ হচ্ছে, ‘যদি আল্লাহর ফজল ও রহমত তোমাদের ওপর না হত, তাহলে তোমাদের মুষ্টিমেয় ব্যক্তি ছাড়া সকলেই শয়তানের অনুসরণ করতে’  [সূরা নিসা : ৮৩] আরবি ব্যাকরণ ও তাফসীর বিশেষজ্ঞদের মতানুযায়ী এখানে ‘ফজল’ ও ‘রহমত’ দ্বারা একই ব্যক্তি বা বস্তুকে বুঝানো অধিক যুক্তি সঙ্গত। আর এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছেন প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। যদি ‘ফজল’ ও ‘রহমত’ দ্বারা স্বতন্ত্র অর্থ নেয়া হয় তখনও শব্দদ্বয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছেন তিনি। কেননা, তাঁকে সূরা আম্বিয়া’র ১০৭ নম্বর আয়াতে ‘রহমত’ এবং সূরা জুমুয়া’র ৪র্থ আয়াতে ‘ফজল’ বলা হয়েছে। অতএব এ মহান জাতের আগমনের ওপর যতই আনন্দ করা হোক না কেন, তা কমই হবে।

আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘আমি আপনাকে সমগ্র জগতের রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনকে মহান আল্লাহ তা’য়ালা মানবজাতির জন্য বড় অনুগ্রহ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর মহান অনুগ্রহ হয়েছে মুসলমানদের উপর যে, তাদের কাছে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রসূল প্রেরণ করেছেন’। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আগমনের দিনকে তাই যথাযথভাবে উদযাপন করা সকল মুসলমানের দায়িত্ব। আল-কুরআনের বহু আয়াতে আল্লাহ তায়ালা নিয়ামতের স্মরণ এবং এর শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর শ্রেষ্ঠ নিয়ামত হচ্ছেন রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। যেমন বলা হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের প্রতি (প্রেরিত) আল্লাহর নিয়ামতের স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে। অতঃপর তিনি তোমাদের অন্তরে ভালবাসা সৃষ্টি করে দিলেন এবং তোমরা তাঁর নিয়ামতের মাধ্যমে পরস্পর ভাই হয়ে গেলে’। [সূরা আলে ইমরান : ১০৩]

তাঁর আদর্শ ও চারিত্রিক মাধুর্যের কারণে নানা গোত্রে বিভক্ত, কলহ-বিবাদপ্রিয়, সামাজিক ও নৈতিকভাবে অধঃপতিত, যাযাবর ও বর্বর আরব জাতি একটি সুমহান জাতিতে পরিণত হয়। তিনি উৎপীড়িত ও অত্যাচারিত মানুষের প্রকৃত বন্ধু ছিলেন। অনাথ, দাস, কন্যাশিশু, বিধবা নারী ও গরিব-দুঃখীর দুঃখ মোচনে সদা তৎপর ছিলেন। যাঁর আগমনের কারণে মানুষ এক আল্লাহর সন্ধান পেয়েছে, অন্ধকারের অমানিশা থেকে মুক্তি পেয়েছে, সত্যিকার স্বাধিনতা পেয়েছে, নারীরা প্রকৃত মর্যাদা ও ন্যায্য অধিকার পেয়েছে, প্রত্যেক শ্রেণি ও পেশার মানুষ নিজেদের স্ব-স্ব মর্যাদা ও অধিকার পেয়েছে, সর্বোপরি মানবতার বিজয় সূচিত হয়েছে, সে মহান জাতের আগমন দিবসটি কি সবচেয়ে বড় আনন্দের দিন হবে না?

ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এ আনন্দঘন দিন আমাদের কাছে আরো আনন্দময়, বরকতময় করে তুলেছে জশনে জুলুস। আওলাদে রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, গাউমে জামান হযরতুল আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির দূরদর্শী চিন্তার ফসল এ জশনে জুলুস। যা আজ চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে সারা দেশে এক যুগান্তকারী ধর্মীয় বিপ্লবে রূপ নিয়েছে। ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আনন্দঘন এ দিনে আমরা প্রার্থনা করি, মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শান্তি, মিলন ও ভ্রাতৃত্বের জীবনাদর্শই হোক আমাদের জীবনের একমাত্র পাথেয়। তাঁর জীবনাদর্শ অনুসরণ করেই আমরা সব ধরনের অন্যায়-অবিচার থেকে মুক্তি পেতে পারি। জাতিতে-জাতিতে মিলেমিশে বসবাস করতে পারি। সারা বছর ও সারা জীবন নবীজি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পদাঙ্ক অনুসরণের মধ্যেই আমাদের যাবতীয় মুক্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ নিহিত। সব ধরনের নৈরাশ্য ও ফ্যাসাদ বা সন্ত্রাস দূর করতেই ইসলামের আবির্ভাব। একবিংশ শতাব্দীতে আমরা নিরাপত্তাহীনতা ও নানা সংকটে নিপতিত। আমরা যখন আজ শান্তির অন্বেষায় দিশাহারা, তখন নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা ও আদর্শই আমাদের সঠিক পথ দেখাতে পারে। সারা পৃথিবীর মুসলমানদের মতো বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরাও আজ যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্যাপন করবে। শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, নবীজির বাণী হৃদয়ে ধারণ করা এবং তা মেনে চলার মধ্যেই রয়েছে এই দিবস উদ্যাপনের প্রকৃত তাৎপর্য। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর তাৎপর্য বুঝা ও মেনে চলার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : সহ সম্পাদক দৈনিক আযাদী, চট্টগ্রাম।