দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস গ্রন্থের আলোকে ভারতবর্ষে ওয়াহাবি মতবাদের প্রচারক
দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস গ্রন্থের আলোকে ভারতবর্ষে ওয়াহাবি মতবাদের প্রচারক
মুহাম্মদ রিদওয়ান আশরাফী
বৃটিশ গবেষক ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থটি LONDON এর TRUBNER AND COMPANY সর্বপ্রথম 1876 সালে প্রকাশ করে। ২১৯ পৃষ্ঠা বিশিষ্ট এ বইটিতে চারটি পরিচ্ছেদ রয়েছে। ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় বাংলা একাডেমি, ঢাকা, বইটির বাঙ্গানুবাদ প্রকাশ করে। Google এ english pdf / বাংলা pdf আকারে এমনকি microsoft word-এও বইটিতে রয়েছে। ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার তার ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ গ্রন্থের প্রথম ও দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী, মৌলভী ইসমাইল দেহেলভি এবং ওয়াহাবি আন্দোলন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
প্রথম পরিচ্ছেদ কিছু অংশ: হান্টার বলেন, ‘পাঞ্জাব সীমান্তে বিদ্রোহী শিবিরের গোড়াপত্তন করে সৈয়দ আহমদ (ব্রিটিশ ভারতের রায় বেরিলী জেলার বাসিন্দা, জন্ম ১২০১ হিজরি, খ্রী: ১৭৮৬)। অর্ধ শতাব্দী আগে আমরা পিন্ডারী শক্তিকে নির্মূল করার ফলে যে কয়জন তেজস্বী পুরুষ ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল, সৈয়দ আহমদ তাদের অন্যতম। কুখ্যাত এক দস্যুর (আমীর খান পিন্ডারী, পরবর্তীকালে টংকের নওয়াব) অশ্বারোহী সৈনিক হিসেবে সে জীবন আরম্ভ করে এবং বহু বছর যাবত মালওয়া অঞ্চলের আফিম সমৃদ্ধ গ্রামসমূহে লুটতরাজ চালায়।
১৮২২ খ্রিস্টাব্দে সে হজ্জ করতে মক্কা গমন করে। এইভাবে হজ্জের পবিত্র আবরণে সে তার প্রাক্তণ দস্যু চরিত্রকে সম্পূর্ণরূপে আচ্ছাদিত করে পরবর্তী বছর অক্টোবর মাসে বোম্বাই হয়ে ফিরে আসে। ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে সে পেশোয়ার সীমান্তের অসভ্য পার্বত্য অধিবাসীদের মধ্যে উপস্থিত হয় এবং পাঞ্জাবের শিখ অধ্যুষিত সমৃদ্ধ শহরগুলোতে পবিত্র জিহাদের বাণী প্রচার করতে থাকে। পার্বত্য পাঠান উপজাতীয়রা (মুসলমানদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা দুর্দান্ত) উন্মত্ত আগ্রহ সহকারে তার আবেদনে সাড়া দেয়। কান্দাহার ও কাবুল অতিক্রম করে অগ্রসর হওয়ার পথে সে জনসাধারণকে জাগ্রত করতে থাকে এবং সুকৌশলে বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে সম্প্রীতি (প্রধানত ইউসুফজাই ও বাবাকজাই উপজাতি) স্থাপনের মাধ্যমে তাদের উপর নিজের প্রতিপত্তি সুসংহত করে। একবার যুদ্ধের প্রাক্কালে (শিখদের সঙ্গে যুদ্ধের প্রাক্কালে যারাকজাই উপজাতীয়রা) সীমান্তবাসী উপজাতীয়দের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপজাতি দলত্যাগ করেছিল| পরবর্তীকালে ধর্মান্ধরা তাদের উপর কঠোর প্রতিশোধ গ্রহণ করে।
ধর্মীয় নেতা তার হিন্দুস্তানি অনুগামীদের উপর সর্বদা নির্ভর করতে পারত। ফলে সে তাদের প্রতি উদার নীতি গ্রহণের প্রয়োজনবোধ করে| প্রথমে সে তার হিন্দুস্তানি অনুগামী‡`i ভরণপোষণের জন্য কেবল সীমান্তবাসী অনুগামীদের উপর তির্থকর প্রয়োগ করে। সীমান্তবাসীরা ধর্মীয় কার্যে চাঁদা হিসাবে নির্বিবাদে এই করভার বহন করে।
সীমান্তের উপজাতীয়দের উপর তার যে আশ্চর্য প্রভাব সৃষ্টি হয়েছিল, অনতিকাল পরই তা বিনষ্ট হতে শুরু করে। ক্ষমতার যতই ভাটা পড়তে থাকে, ক্রমান্বয়ে ততই তার কঠোরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। অবশেষে পার্বত্য জাতির হৃদয়ের কোমলতম তন্ত্রীতে একদিন সে আঘাত করে। তার ভারতীয় অনুগামী দল নিজেদের বাড়িঘর ত্যাগ করে তার সঙ্গে চলে এসেছিল এবং স্ত্রীরাও তাদের সঙ্গে ছিল না। নেতা ফরমান জারি করল যে, সেইদিন থেকে বারো দিনের মধ্যে কোন উপজাতীয় মেয়ের বিবাহ না হলে সেই মেয়ে তার (নেতার) অনুচরদের সম্পত্তি বলে গণ্য হবে। এর ফলে উপজাতীয়রা ক্ষিপ্ত হয়ে তার হিন্দুস্তানি অনুচরবর্গকে হত্যা করে। নেতার প্রাণ রক্ষা হয় অতি অল্পের জন্য (পাঞ্জাতার থেকে পাকলী উপত্যকায় পলায়ন); কিন্তু তার রাজত্বের অবসান ঘটে। ১৮৩১ সালে ধর্মীয় নেতা তার একজন প্রাক্তণ অনুচরকে সাহায্য করার সময় রাজপুত্র শের সিংহের অধীনস্থ সেনাবাহিনীর দ্বারা অতর্কিতভাবে আক্রান্ত হয়ে নিহত হন। (বালাকোট, মে, ১৮৪১ খ্রীঃ, ভারত সরকারের পররাষ্ট্র দফতর থেকে তথ্য সংগৃহীত)
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের কিছু অংশ : ১৮২০ সালে যখন সে তার মিশন শুরু করে, তখন তার বয়স ছিল চৌত্রিশ বছর। স্বল্পভাষী ও বিনম্র স্বভাবের এই লোকটি আইন কানুন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল। সর্বাগ্রে যারা তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল, তাদের মধ্যে দুইজন পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। উপরোক্ত দুই ব্যক্তি (শাহ আবদুল আজিজের ভ্রাতুষ্পুত্র মৌলভী মোহাম্মাদ ইসমাইল এবং জামাতা মৌলভী আবদুল হাই) ছিল সে যুগের শ্রেষ্ঠতম মুসলমান পণ্ডিতের পরিবারভুক্ত। তারা উভয়ই তাদের মূর্খ পীর ভাই ও প্রাক্তণ দস্যুকে এই সংস্কার সাধনের উদ্দেশ্যে আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ বলে গ্রহণ করেছিল। তাকবিয়াতুল ইমান অথবা বিশ্বাস দৃঢ়ীকরণ শীর্ষক বইটির রচয়িতা এই মৌলভী মোহাম্মাদ ইসমাইল।
মক্কায় হজ্জ করতে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সৈয়দ আহমদ তার মতবাদ সুনির্দিষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করেছিল বলে মনে হয় না। তার অন্যতম শিষ্য মুহাম্মদ ইসমাইল তার বক্তব্যসমূহ সংকলিত করে সিরাতুল মুস্তাকিম নামে পুস্তকাকারে প্রকাশ করেছে। লেখক এই গ্রন্থে তার গুরুর সংক্ষিপ্ত বাণীসমূহকে নিজের ভক্তি মিশ্রণে সম্প্রসারিত করে লিখেছে বলে মনে করা হয়। ধর্মীয় নেতার ১৮২২-২৩ খ্রিস্টাব্দে মক্কা সফরের পর অনাড়ম্বর নিষ্ঠাবান জীবনযাপনের নীতিমালা নিরূপিত ও প্রচারিত হয়। সফরকালে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে, পবিত্র নগরীতে মরুভূমির জনৈক বেদুঈনের (ইবনে আবদুল ওয়াহাব নজদি) প্রচেষ্টায় ব্যাপক সংস্কার প্রবর্তিত হয়েছে। এ সংস্কারের প্রবর্তক পশ্চিম এশিয়ায় এক বিশাল ধর্মীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। ভারতে সৈয়দ আহমদ ঠিক একই রকম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আশা পোষণ করে।
মক্কায় অবস্থানকালে সৈয়দ আহমদ বেদুইনদের কাছে যেরূপ সরল ভাষায় প্রচার চালান, অনুরূপ সারল্য প্রদর্শন করে সরকারী কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরে এ পবিত্র নগরী বেদুইনদের হামলার শিকার হয়। মুফতি প্রকাশ্যভাবে সৈয়দ আহমদের পদাবনতি ঘটান এবং শেষ পর্যন্ত তাকে শহর থেকে বহিষ্কার করেন। এ নিগ্রহের স্বাভাবিক ফলশ্রুতি হেসেবে তিনি ভারতে প্রত্যার্বতন করেন। কিন্তু শুধুমাত্র মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে প্রচারক হিসেবে নয়। gynv¤§` Be‡b আবদুল ওয়াহাবের ধর্মান্ধ সাগরেদ হিসেবেই তিনি ভারতে ফিরে আসেন। তার শিক্ষায় এতদিন যা কিছু অস্পষ্ট ছিল এখন তা আবদুল ওয়াহাবের মত ধর্মীয় উগ্রনীতিতে স্পষ্টরূপ পরিগ্রহ করে| এই ধর্মীয় উগ্রতা কাজে লাগিয়ে আবদুল ওয়াহাব আরবে একটা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এবং সৈয়দ আহমদ আশা করেন যে, ঐ একই পদ্ধতি অনুসরণ করে ভারতে তিনি বৃহত্তম ও অধিকতর স্থায়ী একটা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন।
নোট: উইলিয়াম হান্টারের বক্তব্যের সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায় সৌদি আরব হতে প্রকাশিত “আশ শায়খ মুহাম্মদ বিন আবদিল ওহহাব” নামক পুস্তকে| বইটির ৭৭/৭৮ পৃষ্ঠায় বর্ণিত তথ্যানুযায়ী ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ইবনে আবদুল ওয়াহাব নজদির ওহাবি মতবাদ প্রচারের জন্য সৈয়দ আহমদ বেরলভীকে ভারতীয় প্রতিনিধি নিয়োগের কথা উল্লেখ আছে। [ইজহারে হক্ব- অধ্যক্ষ শেখ আব্দুল করিম সিরাজনগরী, পৃ/৩৩] |
তিতুমীরের আন্দোলন
সৈয়দ আহমদের মতবাদে তিতুমীর দীক্ষিত হয়েছিলেন। এ সম্পর্কে ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার তার “দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস“ গ্রন্থের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বলেন, “১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ধর্মগুরুর যেসব শিষ্য সাগরেদ ছিল, তাদের মধ্যে পেশাদার কুস্তিগির ও গুণ্ডা প্রকৃতির একটা লোক ছিল তিতু মিয়া (ওরফে নিছার আলী; জন্মস্থান চাঁদপুর, গ্রাম ও বাসস্থান, বারাসাত)। সে এক লাঠিয়াল বাহিনীতে যোগদান করেছিল। এই জীবিকার দরুন অবশেষে কারাগারে যেতে হয়েছিল। সেখান থেকে মুক্তিলাভের পর সে হজ্জ করতে মক্কায় গমন করেছিল। সেই পবিত্র নগরীতেই তার সাক্ষাৎ হয়েছিল সৈয়দ আহমদ-এর সাথে। মক্কা থেকে সে ভারতে ফিরে এসেছিল শক্তিশালী একজন ধর্মপ্রচারক হয়ে। তারপর কলকাতার উত্তর ও পূর্ব দিকের জেলাগুলোতে সে ব্যাপকভাবে সফর করে এবং অসংখ্য লোককে তার শিষ্য করে নেয়। তার নেতৃত্বে এক প্রচণ্ড কৃষক বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়। কলকাতার উত্তর ও পূর্বে অবস্থিত তিনটি জেলা (২৪ পরগণা, নদীয়া, ফরিদপুর) সম্পূর্ণরূপে তাদের পদানত হয়ে পড়ে। মুসলমানদের মধ্যে যারা তাদের দলে যোগদান না করত তাদের প্রতি বৈরী আচরণ করত। একজন বিত্তশালী মুসলমান তাদের আনুগত্য অস্বীকার করলে তারা তার বাড়ি লুট করে এবং তার কন্যাকে জোরপূর্বক তাদের দলের সর্দারের সঙ্গে বিবাহ দেয়।
ফারায়েজী আন্দোলন
বাংলার ফারায়েজী আন্দোলন ওয়াহাবী মতবাদেরই একটি শাখা। এ সম্পর্কে ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার বলেন, “গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এলাকার ধর্মান্ধ মুসলমানরা নিজেদেরকে ওয়াহাবী না বলে ফারায়েজী বলে ((আরবী ফারাইজা, বহু বচনে ফারায়েজ, অর্থাৎ ফরজ-এর সমতুল্য শব্দ থেকে ফারায়েজী নামের উৎপত্তি)। ফারায়েজীরা দাবী করে যে, তাদের মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা শরিয়াত উল্লাহ যিনি ১৮২৮ সালে ঢাকায় প্রচার কার্যে অবতীর্ণ হন।
সূত্র: “দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস“ ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার, অনুবাদ: এম. আনিসুজ্জামান ।
বিশিষ্ট গবেষক ও প্রাবন্ধিক।