শরীয়তের দৃষ্টিতে মিলাদ কিয়াম

শরীয়তের দৃষ্টিতে মিলাদ কিয়াম

শরীয়তের দৃষ্টিতে মিলাদ কিয়াম-
মাওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দীন >

মিলাদ শব্দের বিশ্লেষণ
আরবী ভাষায় মিলাদ শব্দটির তিন ধরনের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন- مَوْلٌوْدٌ ـ مَوْلِدٌ ـ مِيْلاَدٌ সবগুলো শব্দ প্রায় একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। ‘আল মুনজিদ’ নামক অভিধানে লেখা রয়েছে যে, ميلاد শব্দটি خلاف قياس اسم ظرف এর ছিগাহ্। এর অর্থ হবে وَقْتُ الْوِلاَدَةِ (জন্মের সময় কাল) অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামার শুভাগমনের সময় বা কালকে মিলাদ বলা হয়।

পারিভাষিক অর্থ
ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায়, মিলাদ শরীফের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে হিজরী নবম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ হাফেজুল হাদিস আল্লামা জালাল উদ্দীন আব্দুর রহমান সুয়ূতী (রহ.) তাঁর কিতাব الحاوى للفتاوى -এর ১ম খন্ডের ২৫১ পৃষ্ঠায় লেখেন-
عِنْدِىْ اَنَّ اَصْلَ عَمَلِ الْمَوْلِدِ الَّذِىْ هُوَ  اِجْتِمَاعُ النَّاسِ وَقِرَأَةُ مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْانِ وَرِوَايَةُ الْاَخْبَارِ الْوَارِدَةِ فِىْ مَبْدَأِ أَمْرِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَمَا وَقَعَ فِىْ مَوْلِدِه مِنَ الْايَاتِ ثُمَّ يَمُدُّ لَهُمْ سِمَاطٌ يَّأْكُلُوْنَه وَيَنْصَرِفُوْنَ مِنْ غَيْرِ زِيَادَةٍ عَلى ذلِكَ هُوَ مِنَ الْبِدْعِ الْحَسَنَةِ الَّتِىْ يُثَابُ عَلَيْهَا صَاحِبُهَا لِمَا فِيْهِ مِنْ تَعْظِيْمِ قَدْرِ النَّبِىِّ صَلّى  اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاِظْهَارِ الْفَرْحِ وَالْاِسْتِبْشَارِ  بِمَوْلِدِه الشَّرِيْفِ ـ
অর্থাৎ আমার (জালালুদ্দীন আব্দুর রহমান সয়ূতী রহ.) মতে নিশ্চয় মিলাদ শরীফ হলো, মানুষের একত্রিত হয়ে ক্বোরআন মজিদ থেকে যতটুকু সম্ভব তিলাওয়াত করা এবং রসূলে পাকের শুভ সূচনা (জন্ম) সম্পর্কিত হাদীসসমূহের আলোচনা করা এবং তাঁর শুভ মিলাদ (জন্মের) সময় যে সমস্ত অলৌকিক ঘটনা (ইরহাসাত) প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর বর্ণনা করা। অতঃপর দস্তরখানা বিছিয়ে উপস্থিত শ্রোতামন্ডলির জন্য তাবারুকের ব্যবস্থা করা, যা তারা খাবে। তারপর আর কিছু না করে তারা নিজ নিজ বাড়ি চলে যাবে, এটা বেদায়াতে হাসানাহ্ (উত্তম বিদআত) যার আয়োজক অনেক সাওয়াবের অধিকারী হবে, যেহেতু এতে রয়েছে রাসূলে পাকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, খুশি প্রকাশ করা এবং রসূলে পাকের জন্মের শুভ সংবাদ প্রদান।
[আল হাবি লিল ফাতাওয়া, পৃ.-২৫১, ২৫২]

এ প্রসঙ্গে শায়খুল ইসলাম, হাফেজুল হাদীস ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি মিলাদ শরীফ প্রমাণ করতে গিয়ে বোখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হাদীস নাম্বার ৩৩৯৭ ও ২৭১৪ এর ব্যাখ্যায় দীর্ঘ আলোচনার পর বলেন-
وَاَيُّ نِعْمَةٍ أَعْظَمُ مِنَ النِّعْمَةِ بِبُرُوْزِ هذَا النَّبِىِّ نَبِىِّ الرَّحْمَةِ  فِىْ ذلِكَ الْيَوْمِ ـ وَعَلى هذَا فَيَنْبَغِىْ أَنْ يَتَحَرّى الْيَوْمَ بِعَيْنِه حَتّى يُطَابِقَ قِصَّةَ مُوْسى فِىْ يَوْمِ عَاشُوْرَاءَ ـ وَمَنْ لَمْ يُلاَحِظْ ذلِكَ لاَ يُبَالِىْ بِعَمَلِ الْمَوْلِدِ فِىْ أَيِّ يَوْمٍ مِنَ الشَّهْرِ ـ بَلْ تَوَسَّعَ قَوْمٌ فَنَقَلُوْهُ اِلى يَوْمٍ مِنَ السَّنَةِ وَفِيْهِ مَا فِيْهِ ـ فَهذَا مَا يَتَعَلَّقُ بِأَصْلِ عَمَلِه ـ [الحاوى للفتاوى ـ صفحه ـ ২৬০] অর্থাৎ (১২ রবিউল আউয়াল শরীফের) ওই দিনে রহমতের নবীর শুভাগমনের চেয়ে বড় নেয়ামত আর কি হতে পারে? এর উপর ভিত্তি করে ঠিক ওই তারিখ অনুসন্ধান করা উচিত যাতে আশুরার দিনে হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম-এর ঘটনার অনুরূপ হয়। যে এ নির্দিষ্ট তারিখে মিলাদুন্নবীর অনুষ্ঠান করতে অক্ষম হয়, সে মাসের যে কোন দিন এটা করতে কোন প্রকার অসুবিধা নেই। বরং একদল ওলামায়ে কেরাম আরো ব্যাপক মত প্রদান করে বলেন, বছরের যে কোন দিনে করতে সমস্যা নেই। বরং মূল দিনের অনুষ্ঠানের মতই সাওয়াবের অধিকারী হবে। এটাই মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠানের মূল প্রমাণ। [আল-হাবী লিল ফাতাওয়া, ১ম খন্ড, পৃ.-২৬০]

মিলাদ শরীফের সূচনা ও ইতিহাস
প্রকাশ থাকে যে, রসূলে পাকের শুভ মিলাদ (জন্ম) হয়েছিল (নূর হিসেবে) সকল সৃষ্টির পূর্বে। সহীহ্ হাদিসের মধ্যে আল্লাহর রসূল এরশাদ করেন- اَوَّلُ مَا خَلَقَ اللهُ نُوْرِىْ অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলা সব কিছুর আগে আমি নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন। উল্লেখ্য যে, প্রত্যেকেরই রূহ সৃষ্টি হয়েছে আগে, শরীর সৃষ্টি হয়েছে পরে। রাসূলে পাকের ক্ষেত্রেও তাঁর নূর মোবারক প্রথমে এবং দেহ মোবারক ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে সৃষ্টি করা হয়েছিল যা ইতিহাসের কিতাবসমূহে বিদ্যমান রয়েছে।
আল্লামা সামশুদ্দীন যাহাবী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর কিতাব ‘আস্ সিরাতুন নাবাবীয়্যাহ্’ এর ৩৩ পৃষ্ঠায় এবং আল্লামা ইবনে আসাকের রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর তারিখ তথা ইতিহাসের কিতাবের ৩য় খন্ডের ৭০ পৃষ্ঠায় এবং হাফেজ ইমাদুদ্দীন ইবনে কাসির রহমাতুল্লাহি আলায়হি আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া গ্রন্থের ২য় খন্ডের ২৬০ পৃষ্ঠায় হযরত জাবের ও আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে এক খানা হাদিস বর্ণনা করেন-
عَنْ جَابِرٍ  وَاِبْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا اَنَّهُمَا قَالاَ وُلِدَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَامَ الْفِيْلِ يَوْمَ الْاِثْنَيْنِ الثَّانِىْ عَشَرَ مِنْ شَهْرِ رَبِيْعِ الْاَوَّلِ وَفِيْهِ بُعِثَ وَفِيْهِ هَاجَرَ وَفِيْهِ مَاتَ وَهذَا هُوَا الْمَشْهُوْرُ [البداية والنهايةـ جلد ـ ২ـ صفحه ২৬০] অর্থাৎ ‘‘সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস ও হযরত জাবের রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম থেকে বর্ণিত, তাঁরা বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম জন্ম গ্রহণ করেছেন বা দুনিয়াতে তাশরীফ এনেছেন হস্তিবাহিনীর বছর, রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার। এ দিনই তাঁর উপর নবুয়াত প্রকাশিত হয়েছিল। এ দিনই তিনি হিজরত করেছিলেন এবং এ দিনেই তিনি ওফাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। এটাই হচ্ছে প্রসিদ্ধ কথা। [আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ২য় খন্ড, পৃ. ২৬০] রাসূলে পাকের নূর মোবারক কত আগে সৃষ্টি করা হয়েছিল তা সুনির্দিষ্ট করে বলা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তবে নবীজি থেকে বর্ণিত হাদীস সমূহের পর্যালোচনা করলে বিভিন্ন রকম তথ্য পাওয়া যায়। যেমন-الانوار المحمدية من المواهب اللدنية কিতাবের ১৩ নম্বর পৃষ্ঠায় এবং মৌং আশরাফ আলী থানভী লিখিত কিতাবنشر الطيب فى ذكرى النبى الحبيب صلى الله عليه وسلم এর ৮নম্বর পৃষ্ঠায় এক খানা হাদিস বর্ণনা করেছেন-
عَنْ عَلِىِّ بْنِ الْحُسَيْنٍ عَنْ اَبِيْه عَنْ جَدِّه رَضِىَ اللهُ عَنْهُمْ عَنِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ كُنْتُ نُوْرًا بَيْنَ يَدَيْ رَبِّىْ قَبْلَ خَلْقِ ادَمَ بِاَرْبَعَةَ عَشْرَ اَلْفَ عَامٍ
অর্থাৎ হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন তাঁর পিতা হযরত হুসাইন থেকে এবং ইমাম হুসাইন তাঁর পিতা শেরে খোদা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম থেকে বর্ণনা করেন যে, রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমি আদম আলায়হিস্ সালামকে সৃষ্টির ১৪ হাজার বছর পূর্বে আল্লাহর নিকট নূর আকারে বিদ্যমান ছিলাম।
এখানে প্রনিধানযোগ্য যে, আল্লাহর নিকট সময়ের গণনা হলো আখিরাতের হিসাব মোতাবেক। আর আখিরাতের এক দিন সমান হলো দুনিয়ার এক হাজার বছরের সম পরিমাণ। সে হিসেবে প্রতীয়মান হয় যে, আখিরাতের ১৪ হাজার বছর সমান দুনিয়ার হিসেবে ৫,১১,০০০০০০০ (পাঁচ কোটি এগার লক্ষ) বছর। এভাবে অন্যান্য হাদীস দ্বারা হিসাব করলে দেখা যায় রাসূলে পাকের নূর মোবারক আরো অনেক আগে সৃষ্টি করা হয়েছে। কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় অন্য হাদীসগুলো উল্লেখ করা থেকে বিরত রইলাম।
এ পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত পরিসরে রাসূলে পাকের নূর ও দেহ মোবারকের সৃষ্টি তথা মিলাদের ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
কতিপয় বিভ্রান্ত লোক মনগড়া তথ্যের আলোকে বলে যে, মিলাদ শরীফ ৬০৪ হিজরীতে প্রচলিত হয়েছিল। উল্লেখিত হাদিস তাদের এ মতকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে।
তবে হ্যাঁ ৬০৪ হিজরীতে নয় বরং আরো অনেক আগে মিশরের ফাতেমিয় শাসকগণ সর্বপ্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর অনুষ্ঠান শান-শওকতের সাথে আরম্ভ^ করেন। তাদের খিলাফতকাল ছিল ৩৬২ হিজরি সন থেকে ৫৬৭ হিজরী পর্যন্ত। এরপর বিশ্ববিখ্যাত খোদাভীরু ও আশেকে রসূল শাসক সুলতান শায়খ ওমর আল-মোল্লা হাবীব নুরুদ্দীন মাহমুদ জঙ্গী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ওফাত ৫৭০ হিজরী ও তাঁর সমসাময়িক বিশ্বখ্যাত মুসলিম শাসক ক্রুসেডারদের (খৃস্ট ধর্মাবলম্বীদের মুসলিম বিরোধী যোদ্ধা) বিরুদ্ধে মহান বিজয়ী বীর ইতিহাস খ্যাত গাজী সালাউদ্দীন আইয়ুবী রহমাতুল্লাহি ও এ ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখেন।
[تاريخ الاحتفال بمولد النبى صلى الله عليه وسلم ومظاهره فى العالم ـ صفحه ـ ২৭-৩৩]

মিলাদ শরীফের অনুষ্ঠানের ইতিহাস   
ইতোপূর্বে আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি যে, মিলাদ শরীফ মানে রাসূলে পাকের শুভাগমন তথা জন্মের ঘটনাবলীর বর্ণনা দেয়া। ক্বোরআন ও হাদীস পর্যালোচনা করলে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, আনুষ্ঠানিকভাবে সর্বপ্রথম স্বয়ং মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনই রাসূলে পাকের শুভ মিলাদের বর্ণনা দিয়েছিলেন। সেখানে শ্রোতা ছিলেন ২২৩৯৯৯ জন বা ততোধিক নবী ও রসূল এবং সে অনুষ্ঠানের দর্শকমন্ডলী ছিলেন হাজার হাজার ফেরেশতা, স্থান ছিল রুহের জগত।
আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা আল-ই ইমরানের ৮১ নম্বর আয়াতে বলেন-
وَإِذْ أَخَذَ اللهُ مِيثَاقَ النَّبِيِّينَ لَمَا آتَيْتُكُم مِّن كِتَابٍ وَحِكْمَةٍ ثُمَّ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مُّصَدِّقٌ لِّمَا مَعَكُمْ لَتُؤْمِنُنَّ بِهِ وَلَتَنصُرُنَّهُ قَالَ أَأَقْرَرْتُمْ وَأَخَذْتُمْ عَلَى ذَلِكُمْ إِصْرِي قَالُواْ أَقْرَرْنَا قَالَ فَاشْهَدُواْ وَأَنَاْ مَعَكُم مِّنَ الشَّاهِدِينَ
অর্থাৎ আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন তাঁর মাহবুব নবীকে সম্বোধন করে বলেন এবং স্মরণ করুন ওই সময়ের কথা যখন আল্লাহ্ পাক সকল নবীদের থেকে এ মর্মে মজবুত অঙ্গিকার নিয়েছিলেন যে, তোমাদেরকে যখন আমার পক্ষ হতে কিতাব এবং শরিয়ত প্রদান করা হবে অতঃপর তোমাদের নিকট তাশরীফ আনবেন একজন সম্মানিত রাসূল যিনি তোমাদের নবুয়ত (কিতাব)কে সত্যায়ন করবেন, তখন অবশ্যই তোমরা তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং অবশ্যই তাঁকে সাহায্য করবে, আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, তোমরা কি স্বীকার করে নিলে? এবং এ সম্পর্কে আমার দেয়া দায়িত্ব গ্রহণ করলে? সকল নবী বললেন আমরা স্বীকার করে নিলাম, আল্লাহ বলেন সুতরাং তোমরা একে অপরের উপর সাক্ষী হয়ে যাও এবং আমি নিজেই তোমাদের সাথে সাক্ষীদের মধ্যে রইলাম। [সূরা আল-ই ইমরান, আয়াত-৮১] রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজেই নিজের মিলাদ শরীফকে এবাদতের মাধ্যমে পালন করেছেন। সে জন্যে তিনি প্রতি সোমবার রোজা রাখতেন। অতঃপর সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাব‘ই তাবে‘ঈন, আইম্মায়ে মোজতাহেদীন, সালফে সালেহীনগণ কোন প্রকার মতানৈক্য ব্যতিরেকে মিলাদ মাহফিলের অনুষ্ঠান করেছেন। যেমন আল্লামা ইবনে জাওযী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর মাওলদুন্নবী কিতাবের মধ্যে উল্লেখ করেন-
مَازَالَ  اَهْلُ الْحَرَمَيْنِ الشَّرِيْفَيْنِ وَالْمِصْرِ وَالشَّامِ وَالْيَمَنِ وَسَائِرِ بِلاَدِ الْعَرَبِ مِنَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ يَحْتَلِفُوْنَ بِمَجْلِسِ مَوْلِدِ النَّبِىِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَيَفْرَحُوْنَ بِقُدُوْمِ هِلاَلِ رَبِيْعِ الْاَوَّلِ وَيَلْبَسُوْنَ بِالثِّيَابِ الْفَاخِرَةِ وَيَتَزَيَّنُوْنَ بِأَنْوَاعِ الزِّيْنَةِ وَيَتَطَيَّبُوْنَ وَيَكْتَحِلُوْنَ بِالسُّرُوْرِ فِىْ هذِهِ الْاَيَّامِ وَيَتَبَذَّلُوْنَ عَلى النَّاسِ مَا كَانَ عِنْدَهُمْ مِنَ الْمَضْرُوْبِ وَالْاَجْنَاسِ وَيَهْتَمُّوْنَ اِهْتِمَامًا بَلِيْغًا
[تحفة الصوفية فى ميلاد خير البرية جلد ـ১ صفحه ـ ৪৩] অর্থাৎ হারামে মক্কা, হারামে মদিনা, মিশর, ইয়ামন এবং সমগ্র আরব বিশ্বের পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত গোটা মুসলিম উম্মাহ অহরহ মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অনুষ্ঠান করে থাকেন এবং রবিউল আউয়াল শরীফের চন্দ্র উদয়ের সাথে সাথে তাঁরা অত্যন্ত খুশির সাথে উত্তম পোশাক পরিধান করে, বিভিন্নভাবে সৌন্দর্যমন্ডিত হয়ে সুগন্ধি ও সুরমা ব্যবহার করার মাধ্যমে পরিপূর্ণ মাস খুশি উদযাপন করতেন। গরিব মিসকিনদের প্রতি অধিক হারে দান খয়রাত ও দ্রব্য সামগ্রী বিতরণ করতঃ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এ সমস্ত নেক কাজের ব্যবস্থাপনা করতেন। [তোহফাতুস্ ছুফিয়া ফি মিলাদে খাইরিল বারিয়্যাহ্, খন্ড-১, পৃ. ৪৩] আল্লামা ইবনে জাওজী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর এ লিখনীর মধ্যে এ মর্মে ইজমায়ে উম্মতের বর্ণনা দিয়েছেন যে, সমগ্র মুসলিম বিশ্বের কোন প্রকার দ্বিধাদ্বন্ধ ও মতানৈক্য ব্যতিরেকে মিলাদ শরীফের প্রচলন ছিল।
এতেই প্রমাণিত হয় যে, স্বার্থান্বেষী মহল নবীবিদ্বেষী ঈমানের সুঘ্রাণবঞ্চিত শিক্ষকগণের নিকট পড়া-শুনার কারণে কালক্রমে নিজেরাও নবীদিদ্বেষী ও মিলাদ শরীফ বিরোধী হয়ে ওঠে।
ইসলামী আইনের ৪ উৎসের কোনটার মধ্যেই মিলাদ কিয়ামের বিরুদ্ধে কোন দলিল খুঁজে পাওয়া যায়না। এ দেশে যারা মিলাদ কিয়ামের বিরোধিতা করেন তারা কোন প্রকারের মজবুত দলীলতো দুরের কথা কোন রকম দুর্বল দলিলও উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা শুধু মাঝে মধ্যে চোরের মত চোরাগোপ্তা চিঠি ছেড়েই মিলাদ কিয়ামের বিরোধিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছেন। ওলামায়ে কেরামের সামনে এ ব্যাপারে মুখোমুখি বাহাস তথা কিতাবী আলোচনার আহ্বান জানালে তাদের ওস্তাদগণ আসতেন না তারাও আসেন না। আসতে পারার কথাও নয়। কারণ তারা নবী পাকের সাথে অযথা বেয়াদবী করে ঈমান হারাতে বসেছেন। তাই তাদের ঈমানী সৎ সাহস থাকারও কথা নয়।
পাক ভারত উপমহাদেশে মিলাদ-কিয়ামের বিরোধিতা শুরু হয়েছে ১৮৬৭ সালের দিকে। বিরোধিতায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা হলেন মৌং রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী, মৌং আশরাফ আলী থানভী প্রমুখ। এ সকল ব্যক্তির পীর ছিলেন হাজী এমদাদুল্লাহ্ মোহাজেরে মক্কী সাহেব। তিনি প্রতি বছর মিলাদ শরীফের আয়োজন করতেন এবং দাঁড়িয়ে (কিয়াম করে) নবিজীকে সালাম প্রদান করতেন। এতে তিনি স্বাদ অনুভব করতেন, তাঁর কিতাব ‘কুল্লিয়াতে ইমদাদিয়া’র ৮০ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন যে-
مَشْرَبْ فَقِيْرْكَا يه هے كه محفل مولد ميں شريك هوں بلكه ذريعه بركات سمجھ كر منعقد كرتاهوں اور قيام ميں لطف ولذت پاتاهو- [كليات امدادية ـ صفحه ـ ৮০] অর্থাৎ আমার মত হলো এ যে, আমি মিলাদ শরীফের মাহফিলে অংশগ্রহণ করি এবং বরকত হাসিলের ওসীলায় মিলাদ মাহফিলের অনুষ্ঠান করি এবং কিয়ামের (দাঁড়িয়ে সালাম দেয়া) মধ্যে ঈমানী সৌন্দর্য ও স্বাদ অনুভব করি।
[কুল্লিয়াতে ইমদাদিয়া, পৃ. ৮০] হাজী এমদাদুল্লাহ্ মোহাজেরে মক্কী উপরোক্ত বক্তব্য প্রমাণ করে যে, যারা তাঁর মুরীদ হবার পরও মিলাদ কিয়াম নিয়ে তাঁর সাথে বিরোধিতায় লিপ্ত হয় তাদের মধ্যে তরিকতের শিক্ষা ও শিষ্টাচারিতার অভাব ছিল। যা তাদেরকে আপন পীর হতে তরীকতের ফয়েজ পাওয়া থেকে বঞ্চিত করার জন্য যথেষ্ট ছিল।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়া মুস্তাহাব
সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মাখলুক দু’জাহানের বাদশাহ্ এবং মানব জাতির প্রতি সর্বশেষ প্রেরিত রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সালাম দেয়ার সময় তাঁর সম্মানে দাঁড়ানো শরীয়তের দৃষ্টিতে সাওয়াবের কাজ। দাঁড়াতে অস্বীকার করা বেয়াদবীর নামান্তর। রসূলের সাথে বেয়াদবী করে ঈমানদার দাবী করা পাগলামী বৈ কিছু নয়।

ক্বোরআন-ই মজীদে মিলাদ শরীফে কিয়ামের প্রমাণ
পবিত্র ক্বোরআন মজীদের সূরা আহযাবের ৫৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
إِنَّ اللهَ وَمَلائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
তরজমা: নিশ্চয় আল্লাহ্ ও তাঁর ফিরেশতাগণ অদৃশ্যের সংবাদদাতা (নবীর) উপর দরূদ প্রেরণ করেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দরূদ ও যথোপযুক্ত সালাম প্রদান করো। [সূরা আহযাব, আয়াত-৫৬] উক্ত আয়াতে কারিমায় আল্লাহ্ তা‘আলা ‘সাল্লিমু’ আমরের ছিগাহ্ উল্লেখ করার পর ‘তাসলিমা’ শব্দটি উল্লেখ করেছেন, যা আরবী ব্যাকরণ মতে ‘মাফউলে মাতলাক্ব’ হিসেবে তাকিদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। যা দ্বারা অধিক পরিমাণ ও সম্মানজনকভাবে সালাম প্রদানকে বুঝানো হয়েছে। অধিকন্তু ‘তাসলিমা’ শব্দের শেষ অক্ষরে দুই যবর (তানবীন) ব্যবহার করা হয়েছে যা তাফসীরের পরিভাষায় তা’জিম তথা সম্মানের জন্য ব্যবহৃত হয়।

হাদীসের আলোকে মিলাদ-কিয়ামের প্রমাণ
নবী করীমের সাহাবায়ে কেরাম থেকে বর্ণিত বিভিন্ন হাদীস শরীফে তাঁরা নবীজির সম্মানে দাঁড়িয়েছেন মর্মে অনেক হাদীসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। কিয়ামের মধ্যে যেহেতু নবীজিকে সালাম প্রদান করা হয়, সেহেতু ওই সময়ে দাঁড়ানো ইসলামী শিষ্টাচারের মধ্যে গণ্য।

রাসূলে করীমের সম্মানে দাঁড়ানো
সুন্নাতে সাহাবা
عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَجْلِسُ مَعَنَا فِى الْمَسْجِدِ يُحَدِّثُنَاـ فَاِذَا قَامَ قُمْنَا قِيَامًا حَتّى نَرَاهُ قَدْ دَخَلَ بَعْضَ بُيُوْتِ اَزْوَاجِهِ
[مشكاة المصابيح ـ صفحة ـ ৪০৩/৪০৪] অর্থাৎ হযরত আবু হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন, রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র স্বভাব এমন ছিলো যে, তিনি মসজিদে এসে আমাদের সাথে বসে কথোপকথন করতেন। অতঃপর তিনি যখন দাঁড়াতেন আমরাও তাঁর সাথে দাঁড়িয়ে যেতাম যতক্ষণ না তাঁকে নিশ্চিতরূপে কোন স্ত্রীর ঘরে প্রবেশ করতে দেখতাম।
[বায়হাক্বী শরীফ, শোয়াবুল ঈমান, খন্ড-১১, পৃ. ২৭১, মিশকাতুল মাসাবিহ, পৃ. ৪০৩/৪/৪] শুধু নবী নয় উম্মতের সম্মানিত ব্যক্তিদের জন্যও দাঁড়ানো শরীয়তে মোস্তাহাব। যেমন হাদীস শরীফে এসেছে-
عَنْ اَبِىْ سَعِيْدٍ نِ الْخُدْرِىِّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ لَمَّا نَزَلَتْ بَنُوْ قُرَيْظَةَ عَلى حُكْمِ سَعْدٍ هُوَ ابْنُ مُعَاذٍ بَعَثَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهَ وَسَلَّمَ وَكَانَ قَرِيْبًا مِنْهُ فَجَآءَ عَلَى حِمَارٍ فَلَمَّا دَنَا قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قُوْمُوْا اِلَى سَيِّدِكُمْ ـ [متفق عليه ـ مشكاة المصابيح ـ صفحه ৪০৩] অর্থাৎ মদীনার ইহুদী গোত্র বনু কুরাইযা যখন তাদের বিচারের জন্য সা‘আদ ইবনে মুয়ায রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে বিচারকরূপে মেনে নিল, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁকে ডেকে আনার জন্য লোক পাঠালেন, তিনি নিকটেই ছিলেন, অতপর তিনি যখন একটা গাধায় চড়ে রসূলে পাকের (ওই স্থানে) নামাযের স্থানের নিকটে আসলেন, রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মদীনার আনসারী সাহাবীদেরকে বললেন, তোমরা তোমাদের বিচারকদের সম্মানার্থে দাঁড়াও।
[বুখারী শরীফ, ৪র্থ খন্ড, পৃ. ৬৭, ও মুসলিম শরীফ এবং মেশকাত শরীফ, ৪০৩ পৃ.] উক্ত হাদীস প্রমান করে সম্মানিত ব্যক্তির আগমনে দাঁড়ানো শরিয়ত সম্মত।
এখন মু’মিন ভাইদের নিকট আমাদের প্রশ্ন ‘রাসূলের একজন সাহাবীর সম্মানে দাঁড়ানো যদি জায়েয হয় তাহলে রসূলের জন্য দাঁড়ানো কি না জায়েয?
যারা রসূলের শানে দাঁড়ানো না জায়েয বলে ফতোয়াবাজী করেন তারা এ উম্মতকে কোন্ দিকে নিয়ে যেতে চায়, আদবের দিকে না কি বে-আদবীর দিকে? রাসূলের সাথে বে-আদবী করে ঈমানদার হওয়া যায় কি? যা সরলপ্রাণ মুসলমানদের সহজেই বুঝার কথা।
কোন কোন লোক খোঁড়া যুক্তির আলোকে বলেন, রসূলে পাক বলেছেন, ‘তোমরা আজমীদের মত কিয়াম করোনা’ তাই কিয়াম করা না জায়েয। প্রকৃতপক্ষে তারা আজমীদের কিয়াম সম্পর্কে অবহিত নয়। আজমীদের কিয়াম দ্বারা হিন্দু রাজাদের সম্মানে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়ানো এবং কুর্ণিশ করার প্রথাকে বুঝানো হয়েছে, প্রচলিত মিলাদের কিয়াম নয়।
যেমন কাউকে বলা হল, ‘বে-আদবের মত কথা বলিওনা’ তাহলে কি আদবের সাথেও কথা বলবে না? জ্ঞানীদের জন্য ইশারাই যথেষ্ট।
প্রথম হাদিসে দাঁড়ানো অপছন্দের কথা থাকলেও দ্বিতীয় হাদীসে বলা হয়েছে সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম রাসূলে পাকের সম্মানে ততক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়াতেন যতক্ষণ না তিনি মসজিদ থেকে বের হয়ে আপন কোন স্ত্রীর কক্ষে প্রবেশ করতেন।
যেহেতু রাসূলে পাক নিজের জন্য দাঁড়ানোকে পছন্দ করতেন সেহেতু তাঁর জন্য দাঁড়ানো বৈধ; যেমন হাদীস শরীফে এসেছে-
عَنْ مُعَاوِيَةَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ مَنْ سَرَّهُ اَنْ يَتَمَثَّلَ لَهُ الرِّجَالُ قِيَامًا ـ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ
[روَاهُ الترمذى وابو داؤد ومشكاة المصابيح صفحه ـ ৪০৩] অর্থাৎ হযরত মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাকে বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি অন্যান্য ব্যক্তিবর্গকে তার জন্য দন্ডায়মান হয়ে থাকতে পুলক অনুভব করে সে যেন নিজের ঠিকানা জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়। [তিরমিযী শরীফ, আবু দাঊদ শরীফ, মিশকাত শরীফ, পৃ. ৪০৩] সিহাহ্ সিত্তার অন্যতম কিতাব সুনানে আবু দাঊদ শরীফের  ৭০৮নং পৃষ্ঠার ৬নং হাশিয়ার মধ্যে কিয়াম সম্পর্কিত সকল হাদীস পর্যালোচনা পূর্বক এ মর্মে মত প্রকাশ করা হয় যে,
وَفِيْهِ كَلاَمٌ كَثِيْرٌ وَالصَّحِيْحُ اَنَّ اِحْتِرَامَ اَهْلُ الْفَضْلِ مِنْ اَهْلِ الْعِلْمِ وَالصَّلاَحِ وَالشَّرَفِ بِالْقِيَامِ جَائِزٌ وَفِىْ مَطَالِبِ الْمُؤْمِنِيْنَ ـ لاَ يَكْرَهُ قِيَامُ الْجَالِسِ لِمَنْ دَخَلَ تَعْظِيْمًا وَالْقِيَامُ لَيْسَ مَكْرُوْهًا لِعَيْنِه وَاِنَّمَا الْمَكْرُوْهُ مُحَبَّةُ الْقِيَامِ مِنَ الَّذِىْ يُقَامُ لَه وَمَا جَاءَ مِنْ كَرَاهِيّتِه صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قِيَامُ الصَّحَابَةِ لَه فَهُوَ مِنْ جِهَةِ الْاِتِّحَادِ الْمَوْجِبِ لِرَفْعِ التَّكْلِيْفِ لاَ لِلنَّهْىِ ـ [ابو داؤد صفحه ৭০৮ـ رقم الهامش ـ ৬] অর্থাৎ এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের অনেক মতামত বিদ্যমান, তবে বিশুদ্ধ মত হলো এ যে, নিশ্চয়ই নেক্কার পরহেযগার, জ্ঞানী-গুণী ও সম্মানিত ওলামায়ে কেরামদেরকে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করা জায়েয এবং মাতালেবুল মু’মেনিন নামক কিতাবে রয়েছে যে, আগন্তুক ব্যক্তির সম্মানে কিয়াম করা মাকরূহ হবে না। প্রকৃতপক্ষে কিয়াম করাটা মাকরূহ নয়। বরং মাকরূহ হলো, যাকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য দাঁড়ানো হচ্ছে তাঁর পক্ষ থেকে দাঁড়ানোটা পছন্দ করা এবং রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁর জন্য সাহাবায়ে কেরামের দাঁড়ানোকে অপছন্দ করতেন মর্মে যে বর্ণনা এসেছে তা হলো সাহাবায়ে কেরামের কষ্ট বিদুরিত করার জন্য; নিষেধাজ্ঞার জন্য নয়। [আবূ দাঊদ শরীফ, পৃ.-৭০৮, হাশিয়া নং-৬] উক্ত পর্যালোচনার মাধ্যমে বুঝা যায় যে, কারো সম্মানে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকাটা ইসলাম সমর্থিত নয়, তবে সালাম প্রদানের জন্য দাঁড়ানোতে কোন অসুবিধা নেই বরং সুন্নাত বা সাওয়াবের কাজ।

কিয়ামে আমরা কেন দাঁড়াই?
এ কথা সর্বজন বিদিত যে, মিলাদ শরীফের কিয়ামের মধ্যে মু’মিন মুসলমানগণ নবীজিকে সালাম প্রদান করেন। সালাম দেয়ার আদব কি? আসুন আমরা নবীজির হাদীস শরীফে দৃষ্টিপাত করি, যেমন বর্ণিত হয়েছে যে,
عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُسَلِّمُ الرَّاكِبُ عَلى المَاشِىِّ وَالْمَاشِىُ عَلى الْقَاعِدِ وَالْقَلِيْلُ عَلى الْكَثِيْرِ [متفق عليه ومشكاة المصابيح ـ صفحه ـ ৭৯৩] অর্থাৎ হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আরোহী ব্যক্তি পদব্রজে চলাচলকারীকে, পদব্রজে চলাচলকারী বসা ব্যক্তিকে এবং কম সংখ্যক লোক অধিক সংখ্যক লোককে সালাম প্রদান করবে। [বোখারী, মুসলিম ও মিশকাত শরীফ, পৃ. ৩৯৭] উক্ত হাদীসের اشارة النص দ্বারা বুঝা যায় যে, কোন মুসলমানকে সালাম দেয়ার আদব হলো দাঁড়িয়ে সালাম দেয়া। যেহেতু অন্য হাদীসে এসেছে- يُسَلِّمُ الْقَائِمُ عَلَى الْقَاعِدِ অর্থাৎ দাঁড়ানো ব্যক্তি সালাম প্রদান করবে বসা ব্যক্তিকে। এটা নবীজি উম্মতকে শিক্ষা প্রদান করেছেন।
উক্ত দুই হাদীসের মর্মে বুঝা যায় যে, কোন মু’মিন মুসলমানকে বসে সালাম দেয়া বেয়াদবী। সুতরাং যে নবী আমাদেরকে উক্ত আদব শিক্ষা দিলেন তাঁকে বসে সালাম দেয়া কি আদবের মধ্যে গণ্য হবে? নাকি বেয়াদবী?

মিলাদ চালু রাখা অত্যাবশক
কোন কোন নির্বোধ ব্যক্তি বলে থাকে মিলাদ শরীফে কিয়াম করা কোনভাবেই জায়েয নয়। এগুলো তাদের নিজস্ব মনগড়া উক্তি। যা তাদের নবী বিদ্বেষীর চরম বহিঃপ্রকাশ মাত্র। ইসলামী শরীয়তের বিধান হলো কোন জায়েয কাজকে কেউ যদি মনগড়া খোঁড়া যুক্তিতে না জায়েয বলে, তখন সে জায়েয কাজটা প্রচলিত রাখা বা করা সত্যিকারের মু’মিন মুসলমানের আলামত বা চিহ্ণ হয়ে পড়ে। যেমন-
مَا رُوِىَ اَنَّ اَبَا حَنِيْفَةَ سُئِلَ عَنْ مَذْهَبِ اَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ فَقَالَ هُوَ اَنْ تُفَضِّلَ الشَّيْخَيْنِ وَتُحِبَّ الْخَتَنَيْنِ وَتَرى الْمَسْحَ عَلَى الْخُفَّيْنِ ـ [الْبحر الرائق ـ جلد ـ ১, صفحه ـ১৭৪] অর্থাৎ ইমাম আযম আবূ হানীফা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিকে প্রশ্ন করা হল যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের তথা আহলে হকের নিদর্শন কি? তিনি বলেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নিদর্শন হল তিনটিঃ ১. হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমাকে সকল সাহাবীর উপর মর্যাদা দেয়া, ২. হযরত ওসমান ও হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমাকে ভালবাসা এবং ৩. মোজার (চামড়ার মোজা যা তিন আঙ্গুল পরিমাণ ছিড়া নয়) উপর মাসেহ করাকে জায়েয মনে করা। [বাহরুর রায়েক, খন্ড-১, পৃ. ১৭৪] উল্লেখ্য যে, ওই সময়ে শিয়াগণ হযরত আবু বকর, হযরত ওমর ও হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমাকে জালিম মনে করত।  রাফেজীগণ চামড়ার মুজার উপর মাছেহ করাকে না জায়েয মনে করত। প্রকৃতপক্ষে হযরত আবু বকর, হযরত ওমর, হযরত ওসমান ও হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ছিলেন বেহেশতের শুভ সংবাদপ্রাপ্ত ন্যায়-পরায়ণ সাহাবী ও শরিয়তসম্মতবাবে নির্বাচিত খলিফা। আর মুজার উপর মাসেহ করা স্বয়ং রাসূলে পাকের আমল দ্বারা প্রমাণিত। তাই ইমামে আজম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি উক্ত ভ্রান্ত দলসমূহের বিভ্রান্তি নিরসণকল্পে উল্লেখিত মতামত পেশ করেন।

উক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কোন যুগে কোন জায়েয কাজকে কেউ যদি দলীল প্রমাণ ব্যতিরেকে না জায়েয সাব্যস্ত করার অপচেষ্টা চালায় তখন সেটা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আলামতে পরিণত হয়ে যায়। তেমনিভাবে মিলাদ শরীফের আমল জারি রাখা ও নবীজিকে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়াও বর্তমানে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আলামতে পরিণত হয়েছে। এর বিরোধিতা করা ভ্রান্ত দলের চিহ্ণ বা আলামতে পরিণত হয়েছে। তাঁরা দলীল প্রমাণ ব্যতিরেকে মিলাদ কিয়ামের বিরোধিতা করার কারণে আমাদের উপর এটা করা ওয়াজিব তথা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।

ইরবিলের বাদশাহ্ মোজাফ্ফর মহাসমারোহে মীলাদুন্নবীর মাহফিল আয়োজন করতেন
وَكَانَ صَاحِبُ اِرْبِلَ الْمَلِكُ الْمُظَفَّرْ اَبُوْ سَعِيْدْ كُوْكْبِرِىْ بْنِ زَيْنُ  الدِّيْنْ عَلِىْ  بِنْ بُكْتَكِيْنْ اَحَدُ الْمُلُوْكِ الْاَمْجَادِ والْكُبَرَاءِ الْاَجوَادِ وَكَانَ لَه اَثَارٌ حَسَنَةٌ وَهُوَ الَّذِىْ عَمَّرَ الْجَامِعِ الْمُظَفَّرِىْ بِسَفْحِ قَاسِيُوْنَ [الحاوى للفتاوى ـ صفحه ـ ২৫২] আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, ইরবীল রাষ্ট্রের (ইরাক) বাদশাহ্ আল মোজাফ্ফর আবু সাঈদ কুকবুরী বিন জাইনুদ্দীন আলি বিন বোক্তাকিন ছিলেন অত্যন্ত বড় মাপের দানবীর ও সম্মানিত বাদশাহগণের মধ্যে অন্যতম, তাঁর রাজত্ব কালের অনেক নেক নিদর্শনাবলী রয়েছে। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের উপকণ্ঠে কাসিয়ূন নামক পর্বতের পাদদেশে ‘আল-জামে আল মোজাফ্ফরী’ নামক জামে মসজিদ তিনিই নির্মাণ করেছিলেন। [আল হাবী লিল ফাতাওয়া-২৫২] قَالَ ابن كثير فى تاريخه : البداية والنهاية : كَانَ يَعْمَلُ الْمَوْلِدُ الشَّرِيْفَ فِىْ رَبِيْعِ الْاَوَّلِ وَيَحْتَفِلُ بِه اِحْتِفَالاً هَائِلاً وَكَانَ شَهْمًا شُجَاعًا بَطَلاً عَاقِلاً عَالِمًا عَادِلاً رَحِمَهُ اللهُ وَاَكْرَمَ مَثْوَاهُ [ الحاوى للفتاوى ـ صفحه ـ ২৫২] উক্ত বাদশাহ্ মোজাফ্ফর সম্পর্কে আল্লামা হাফেজ ইমাদ উদ্দীন ইবনে কাসির রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর বিশ্বখ্যাত কিতাব আল বিদায়া ওয়ান নিহায়ায় উল্লেখ করেন যে, তিনি রবিউল আউয়াল মাসে পবিত্র মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উপলক্ষে অসাধারণ অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যবস্থা করতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র, সাহসি বীর পুরুষ, বিবেকবান ও ন্যায় পরায়ণ আলেম শাসক। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর প্রতি রহমত প্রদান করুন এবং আখেরাতে তাঁকে সম্মানজনক অবস্থানস্থল প্রদান করুন। [হাবী লিল ফাতাওয়া-২৫২]

লেখক : অধ্যক্ষ, দারুল উলুম আহসানিয়া কামিল মাদরাসা, ঢাকা।