রাহমাতুল্লিল আলামীন’র অনন্য বৈশিষ্ট্য

রাহমাতুল্লিল আলামীন’র অনন্য বৈশিষ্ট্য

রাহমাতুল্লিল আলামীন’র অনন্য বৈশিষ্ট্য-
মাওলানা মুহাম্মদ মুনরিুল হাছান >
পৃথিবী যখন অন্যায়, অবিচার, জুলুম, নির্যাতন, অনৈতিক ও অসামাজিক কার্যকলাপে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, মানুষের বসবাসের উপযুক্ততাও হারিয়ে গিয়েছিল, আইয়্যামে জাহেলিয়ার ঘোর অন্ধকার যখন মানবতার নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গাটাও দখল করেছিল ঠিক ঐ সময়ে পৃথিবীর জমিনে আলোর দিশারী, আল্লাহর রহমত ও করুণার সারথি হিসেবে তশরিফ আনেন রাহমাতুল্লিল আলামীন সাইয়্যেদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। প্রিয় নবির আগমনে পৃথিবীতে শুরু হয়েছিল এক নতুন বসন্তকাল। যা জাগতিক বসন্তের চেয়ে লক্ষ কোটি গুণ বেশি প্রাণসঞ্চারকারী। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল আলোর মশাল। রাহমাতুল্লিল আলামীনের শুভাগমন সর্ম্পকে আল্লাহতায়ালা বলেছেন,আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে একটা নূর ও সুস্পষ্ট কিতাব। [সূরা মায়িদা-১৫]
শুভ আগমন মুহূর্তে অলৌকিক ঘটনাবলী
প্রিয় নবি রাহমাতুল্লিল আলামীনের শুভ আগমনের ব্যাপারে পূর্ববতী নবিগণ সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন। কারণ হযরত আদম আলায়হিস্ সালামের মাধ্যমে পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালা নুবূওয়াত ও রিসালাতের সূচনা করেছিলেন। যার পরিসমাপ্তি হয়েছিল “খাতামুন নবিয়্যীন” এর শুভাগমনের মাধ্যমে। প্রিয় নবির শুভাগমন এর পূর্বেই পিতা হযরত আব্দুল্লাহর ইনতিকাল হয়। হযরত আবু উমামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসুল করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, আমি তোমাদেরকে আমার প্রাথমিক বিষয় সর্ম্পকে বলছি। আমি হলাম হযরত ইবরাহিম আলায়হিস্ সালাম- এর দ্আু (অর্থাৎ দুআ কবুল হওয়ার প্রকাশ), হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর সুসংবাদ (অর্থাৎ, তিনি শেষ নবির আগমনের সুসংবাদ দিয়েছিলেন)। আর আমার মায়ের স্বপ্ন, যা তিনি আমাকে প্রসবকালীন সময়ে দেখেছিলেন, এমন এক নূর উদ্ভাসিত হয়েছিল যার দ্বারা আমার আম্মাজানের সামনে সিরিয়ার প্রাসাদও উজ্জ্বল হয়েছিল।
মুহাম্মদ ইবনে সাদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত আমেনা বিনতে ওহাব বলেছেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার গর্ভে থাকাকালে স্বপ্নে কে যেন তাকে বলতেন, তুমি এই উম্মতের সরদারকে গর্ভে ধারণ করেছ। তিনি ভূমিষ্ট হলে তুমি বলবে, একে আমি সকল হিংসুকের অনিষ্ট ও যাবতীয় বিপদাপদ থেকে এক আল্লাহর আশ্রয়ে সোপর্দ করছি। কারণ তিনি আল্লাহর নিকট খুবই মর্যাদাবান। তার সঙ্গে এমন একটি নূর বের হবে যা সিরিয়ার রাজপ্রাসাদ সমূহকে আলোকিত করবে। ভূমিষ্ট হলে তুমি তার নাম রাখবে “মুহাম্মদ”। আকাশ ও পৃথিবীর অধিবাসীরা তাঁর প্রশংসা করে। ইনজিলে তাঁর নাম আহমদ, আর কুরআনে তার নাম মুহাম্মদ।
[আল বিদায় ওয়াল নিহায়া, পৃ: ৪৮৭]
শিশুকালীন বৈশিষ্ট্যসমূহ
রাসুল করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর শুভাগমনকালীন সময়ে প্রকাশিত বৈশিষ্ট্যসমূহ ছিল সত্যিই অসাধারণ। যে সময়ে তার শুভাগমন হয় তখন আরবের মূর্তিগুলো উপুড় হয়ে স্থানচ্যুত হয়েছিল। সমস্ত ঘর আলোকিত হয়েছিল। শুধু তাই নয় ইবলিশ শয়তানও নবির আগমনে নিজের পরিণতির কথা ভেবে বিলাপ করে কেদেঁছিল। বর্ণিত আছে, ইবলিশ ৪ বার বিলাপ করে কেদেঁছিল। ১. অভিশপ্ত হওয়ার সময়, ২. জান্নাত থেকে বিতাড়িত হওয়ার সময়, ৩. প্রিয় নবির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর শুভাগমনের সময় এবং ৪. সূরা ফাতিহা নাযিল হওয়ার সময়।
হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে উত্তম সনদে বর্ণিত হয়েছে, এক ইয়াহুদি ব্যবসা উপলক্ষে মক্কায় অবস্থান করতো। যে রাতে নবি করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তশরিফ আনলেন এর পরেই ঐ ইয়াহুদী কুরাইশদের এক সভায় এসে জিজ্ঞাসা করল, এ রাতে কোনো ছেলে জন্ম গ্রহণ করেছে? কুরাইশরা বলল আমরা তো জানিনা, ইয়াহুদী বলল, একটু খবর নিয়ে দেখ। কেননা আজ রাতে এ উম্মতের নবি জন্মগ্রহন করেছেন। তাঁর দু’বাহুর মাঝখানে একটি চিহ্ন (মোহরে নবুয়াত) আছে। তিনি দু’রাত পর্যন্ত দুধপান করবেন না। লোকজন দ্রুত ঐ সভা থেকে উঠে অনুসন্ধান শুরু করল। জানা গেল আব্দুল্লাহ ইবনে আবদুল মোত্তালিবের ঘরে একটি পুত্র সন্তান জন্ম লাভ করেছে। ইয়াহুদী বলল, আমাকে নিয়ে গিয়ে শিশুটিকে দেখাও। ইয়াহুদী যখন তার দু’বাহুর মাঝখানে ঐ চিহ্ন দেখতে পেল, তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। জ্ঞান ফিরে আসার পর বলল, নুবূয়াত বণী ইসরাইল থেকে চলে গেছে। হে কুরাইশ, আল্লাহর শপথ এই নবজাতক তোমাদের উপর এমনই আক্রমন করবে (মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে) যার খবর পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে। [যারকানী, ১ম খন্ড-পৃ:১২০] ইমাম তবরানী, আবু নুআইম এবং ইবনে আসাকির বিভিন্ন সনদে বর্ণনা করেন, নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেছেন, মহান আল¬াহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে সম্মান ও মর্যাদার মধ্যে এটাও যে, আমি খাতনাকৃত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছি, আমার গুপ্তাঙ্গ কেউ দেখেনি। ইমাম বায়হাকীর বর্ণনায় রয়েছে, হযরত ইবনে আব্বাস তার পিতা আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) খাতনাকৃত ও নাড়ীকর্তিত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেন দেখে আব্দুল মোত্তালিব মুগ্ধ হয়ে যান এবং বলেন, আমার সন্তান সৌভাগ্যশালী হবে, আর হয়েছিলও তাই।
নাম মোবারক এর বৈশিষ্ট্য
প্রিয়নবি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর শুভাগমনের পূর্বে দাদা আব্দুল মোত্তালিব একটি স্বপ্ন দেখেন যার কারণে তিনি প্রিয় নবীর নাম “মুহাম্মদ”(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রেখেছিলেন । স্বপ্নটি হলো, তিনি দেখেন তার পিঠ থেকে একটি শিকল বের হয়েছে- যার একটি মাথা আসমানে অপর মাথাটি জমিনে, একটি মাথা পূর্ব প্রান্তে এবং অপর মাথাটি পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। কিছুক্ষণের মধ্যে এটি বৃক্ষে পরিণত হয়। যার প্রতিটি পাতা সূর্যের আলোর চেয়েও সত্তর গুণ বেশি আলোকোজ্জ্বল ছিল। পূর্ব ও পশ্চিমের জনগণ ঐ বৃক্ষের ডালের সাথে জড়িত ছিল। কুরাইশদের কিছু লোক গাছটির ডাল আকড়ে ছিল, আর কিছু লোক গাছটি কাটার উদ্দেশ্যে বৃক্ষটির নিকটবর্তী হচ্ছিল। তখন খুবই সুঠাম ও সুন্দর এক যুবক এসে তাদের সরিয়ে দিচ্ছিল। স্বপ্নের ব্যাখ্যাকারকগণ এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা করেন যে, আপনার বংশে এমন একজন ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করবেন, পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত সমস্তÍ মানুষ তার অনুসরণ করবে এবং আসমান ও জমিনের অধিবাসীরা তার প্রশংসা করতে থাকবে। এ কারণেই আব্দুল মোত্তালিব তার নাম “মুহাম্মদ” রাখেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন, আর যখন ইসা ইবনে মরিয়ম বলল, হে বনী-ইসরাঈল আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত রসুল এবং আমার পূর্বেকার কিতাব তাওরাতের সত্যায়নকারী এবং পরবর্তীতে আগমনকারী এক রাসুলের সুসংবাদ দাতা যাঁর নাম হবে আহমদ। [সূরা সাফ-৬] হাদিসের মধ্যে রয়েছে, হযরত জুবায়ের ইবনে মুত‘ইম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, আমার পাঁচটি (প্রসিদ্ধ) নাম রয়েছে, আমি মুহাম্মদ, আমি আহমদ, আমি আল-মাহি (নিশ্চি‎হ্নকারী) আমার দ্বারা আল্লাহ কুফর ও শিরককে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন, আমি আল-হাশির (কেয়ামতের ভয়াবহ দিবসে সমবেতকারী), আমার চারপাশে মানব জাতিকে একত্রিত করা হবে। আমি সর্বশেষ আগমনকারী আমার পর অন্য কোনো নবীর আগমন হবে না । [সহীহ বুখারী-৩২৮০] আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন মজিদে পূর্ববর্তী আম্বিয়ায়ে কেরামের নাম ধরে সম্বোধন করেছেন। যেমন, আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন আয়াতে হে আদম, হে নুহ, হে ইবরাহিম, হে ঈসা, হে দাউদ, হে যাকারিয়া আলায়হিস্ সালাম-বলে বিভিন্ন নবিকে নাম নিয়ে সম্বোধন করেছেন। কিন্তু সাইয়্যেদুল আম্বিয়া রাসুলে আকরাম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে আল্লাহ তায়ালা কোথাও হে মুহাম্মদ, হে আহমদ নাম নিয়ে সম্বোধন করেননি। বরং আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত আদর ¯েœহ মায়া মমতা দিয়ে প্রিয় নবিকে বলেছেন-হে নবি,হে রাসুল, হে বস্ত্রাবৃত্ত, হে বস্ত্রাচ্ছাদিত, ইয়াসিন, তা-হা, ইত্যাদি নামে।
প্রিয় নবীর বংশ ছিল সম্ভ্রান্ত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী
প্রিয় নবী ছিলেন কুরাইশ বংশের বনি হাশিম গোত্রের অধিবাসী। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন-নিশ্চয় তোমাদের নিকট তশরিফ আনয়ন করেছেন তোমাদের মধ্য থেকে ঐ রাসুল, যার নিকট তোমাদের কষ্টেপড়া কষ্টদায়ক, তোমাদের কল্যাণ অতিমাত্রায় কামনাকারী, মুসলমানদের উপর পূর্ণ দয়াদ্র, দয়ালু । [সূরা তাওবা-১২৮] হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলে কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উক্ত আয়াতের ‘আনফুসিকুম’ শব্দের ’ফা’ অক্ষরে যবর দিয়ে তেলাওয়াত করে বলেন, বংশ লতিকার দিক দিয়ে আমি তোমাদের থেকে উত্তম ও সম্ভ্রান্ত। আমার পূর্বপুরুষদের মধ্যে হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত কোন ব্যভিচারী নেই বরং সবাই বিবাহিত। [শরহে মাওয়াহিব, ১ম খন্ড, পৃঃ ৬৭] হাদিসে রয়েছে প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একদা মিম্বরে উঠে প্রশ্ন করলেন আমি কে? সাহাবায়ে কেরাম জবাব দিলেন, আপনি হলেন আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। নবিজী বললেন, আমি মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব। নিশ্চয় আল¬াহ সৃষ্টি জগতকে সৃষ্টি করে আমাকে সর্বোত্তম অংশে (মানবসমাজে) সৃষ্টি করেছেন। এরপর সৃষ্টিকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন (আরব-আজম)। আমাকে উত্তম অংশে আরবে রেখেছেন। অতঃপর আরবের অনেকগুলো বংশের মধ্যে আমাকে সর্বোত্তম বংশে (কুরাইশ) রেখেছেন। অতঃপর এ বংশের গোত্রগুলোর মধ্যে আমাকে সর্বোত্তম গোত্রে (বনু হাশেম) এবং আমাকে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মধ্যে রেখেছেন। [সুনানে তিরমিযী-৩৫৩২]
সৃষ্টি জগতের সকল বস্তুই নবিকে চিনতেন
আল্লাহ তায়ালা তার নবিকে সমগ্র সৃষ্টি জগতের জন্য রহমত করে প্রেরণ করেছেন। তিনি যেহেতু সকল সৃষ্টি জগতের জন্য রহমত হয়ে প্রেরিত হয়েছেন তাই তাঁকে সৃষ্টি জগতের সকলেই চিনবেন এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। হাদীসের মধ্যে রয়েছে, হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমি প্রিয় নবীর সাথে মক্কার বিভিন্ন অলিতে-গলিতে চলাফেরা করতাম । আমি দেখলাম মক্কার পাহাড়-পর্বত ও গাছপালাগুলো যেটাই নবীর সামনে আসতো সেগুলো “আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ” বলে সালাম পেশ করতো। [সুনানে তিরমিযী- ৩৬২৬] প্রিয় নবি হাঁটার সময় আকাশের মেঘমালা ছায়া দিতে তৎপর হতো। হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন- আমি একবার আরজ করলাম ইয়া রাসূলাল্ল¬াহ, আপনার উপর কি উহুদের চেয়েও কঠিন কোন দিন অতিবাহিত হয়েছে? তিনি এরশাদ করলেন, তোমার সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে যে কষ্ট পাওয়ার তা তো পেয়েছি; কিন্তু সর্বাপেক্ষা কঠিন দিন ছিল ওই দিন যেদিন আমি নিজেকে আবদ ইয়ালীলের (তায়েফে) পুত্রদের সামনে উপস্থাপন করি। ওরা আমার দাওয়াত গ্রহণ করেনি। আমি সেখান থেকে অত্যন্ত চিন্তিত ও ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ফিরেছিলাম। পথিমধ্যে ‘কারনুস সাআলিব’ নামক স্থানে পৌঁছে কিছুটা স্বস্থি এলো। হঠাৎ যখন মাথা উঠালাম তখন দেখলাম, একখন্ড মেঘ আমার উপর ছায়াদান করছে এবং এর মধ্যে হযরত জিবরাইল আলায়হিস্ সালাম-বিদ্যমান। জিবরাইল সেখান থেকে আওয়াজ দিলেন, আপনার সম্প্রদায় আপনার কথার যে উত্তর দিয়েছে আল্ল¬াহ তায়ালা তা শুনেছেন। এই সময় আল্লাহ তাআলা আপনার নিকট পাহাড়ের ফেরেশতা প্রেরণ করেছেন, আর তাঁকে যা ইচ্ছা নির্দেশ দিতে পারেন। ইত্যবসরে মালাকুল জাবাল (পাহাড়ের ফেরেশতা) আমাকে সালাম জানালেন। আর বললেন- হে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহ আমাকে আপনার নিকট পাঠিয়েছেন আর আমি পাহাড়কে নিয়ন্ত্রণ করি। আপনি যা ইচ্ছা আদেশ দিতে পারেন। যদি আপনি আদেশ করেন তাহলে দুই পাহাড়কে (যার মধ্যখানে তায়েফবাসীর অবস্থান ছিল) একত্রিত করে দিই যাতে সমস্ত মানুষ পিষ্ঠ হয়ে যায়। রাহমাতুল্লিল আলামীন (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন- না, আমি আল্ল¬াহ তাআলার নিকট আশা করি যে, আল্ল¬াহ ওদের বংশে এমন মানুষ সৃষ্টি করবেন যারা লা-শরীক আল্ল¬াহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরিক করবেনা। [সহীহ বুখারী]
সাহাবীগণের বর্ণনায় রাহমাতুল্লিল আলামিনের বৈশিষ্ট্য
হযরত আনাস বিন মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বেমানান লম্বাও ছিলেন না এবং বেঁটেও ছিলেননা। ধবধবে সাদাও ছিলেননা, আবার তামাটে বর্ণেরও ছিলেন না। কেশরাজি কুঞ্চিত ছিল না একে বারে সোজাও ছিল না। চল্লিশ বছর বয়সে তিনি নুবূয়াত প্রকাশ করেন। নুবূয়াত কালের প্রথম ১০ বছর মক্কায় এবং পরবর্তী ১০ বছর মদিনায় অতিবাহিত করেন। যখন তাঁর ওফাত হয় তখন তাঁর মাথা ও দাড়িঁতে কুুড়িটি চুলও পাকেনি। [সহীহ বুখারী-৩২৯৬] প্রিয় নবি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর চেহারা মোবারক এত সুন্দর ছিল যে সাহাবায়ে কেরাম-এর সৌন্দর্যকে চন্দ্র-সূর্যের সাথে তুলনা করেছেন। কেননা পৃথিবীতে এ দুটির চেয়ে উজ্জ্বল ও জ্যোতিময় আর কিছু নেই। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন,আমি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অপেক্ষা সুন্দর আর কাউকে দেখিনি। তার মুখমন্ডলে যেন সূর্য জ্বলত আর যখন তিনি হাসতেন, তার দীপ্তি প্রাচীরে গিয়ে পড়ত।
হযরত বারা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কে জিজ্ঞেস করা হল নবি করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর চেহারা মোবারক কি তরবারির ন্যায় চকচকে ছিল? তিনি বললেন, না, বরং চাঁদের মতো (স্নিগ্ধ ও মনোরম) ছিল। [সহীহ বুখারী-৩৩০০] হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বর্ণ ছিল স্বচ্ছ, উজ্জ¦ল, ঝকঝকে তার ঘামবিন্দু ছিল যেন মুক্তা। যখন তিনি চলতেন সামনের দিকে ঝুঁকে চলতেন, আমি এমন কোন দিবাজ (এক প্রকার রেশমী বস্তু) পরাপর্শ করিনি যা রাসুলুল্লাহ (সাল্ল¬াল্ল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর হস্ত তালু অপেক্ষা অধিক নরম ও কোমল। আমি এমন কোন মেশক আম্বরের ঘ্রাণ নিইনি যা নবি করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর দেহের সৌরভ অপেক্ষা অধিক খুশবুদার। প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কথা বলার সময় নূরের ঝলক বের হত মুখ মোবারক দিয়ে। রাত্রিবেলায় যখন হাসতেন তখন সমগ্র ঘর আলোকিত হয়ে যেত।
একবার হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা রাত্রিকালে কাপড় সেলাই করছেন। হাত থেকে সুঁই পড়ে গেল চেরাগও নিভে গেল। ইত্যবসরে নবি করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঘরে তশরিফ আনলেন। অন্ধকার দেখে তিনি হেসে দিলেন এতে সারা ঘর আলোকিত হয়ে গেল। সেই আলোতে হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা সুঁই উঠিয়ে নিলেন। তিনি বললেন, ইয়া রাসুলাল্ল¬াহ আপনার চেহারায় কী অপূর্ব জ্যোতি! তিনি বললেন, আফসোস! ঐ সমস্ত কৃপণদের জন্য যারা কিয়ামতের দিন আমার মুখ দেখবেনা। তিনি বললেন, তারা কারা? নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, মজলিসে বা মাহফিলে যখন আমার নাম নেয়া হয়, আর যে আমার নাম শোনার পর দরূদ শরীফ পড়বেনা।
হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন হুদায়বিয়ায় অবস্থানকালে একদিন সাহাবায়ে কেরাম পিপাসায় অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়লেন। নবি করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সামনে একটি চামড়ার পাত্রে অল্প পানি ছিল। তিনি অজু করলেন। তাঁর নিকট পানি আছে মনে করে সকলেই তাঁর দিকে ধাবিত হলেন। নবিজী বললেন, তোমাদের কী হয়েছে? তারা বললেন, আপনার সম্মুখস্থ পাত্রে সামান্য পানি ব্যতীত ওযূ ও পান করার মত পানি আমাদের নেই। নবিজী ওই পাত্রে হাত মোবারক রাখলেন তখনই তাঁর হাত থেকে ঝর্ণা ধারার ন্যায় পানি বের হতে লাগল। আমরা সকলেই পানি পান করলাম ও ওযূ করলাম। হাদীসের একজন রাবী (সালিম) বলেন, আমি হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কে জিজ্ঞাসা করলাম আপনারা কতজন ছিলেন? তিনি বলেন, আমরা যদি এক লক্ষও হতাম তবুও আমাদের জন্য যথেষ্ট হত, তবে আমরা ছিলাম মাত্র পনেরশ। [সহীহ বুখারী-৩৩২৩] হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, মক্কার কাফেররা রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নিকট মুজিযা দেখানোর জন্য দাবি জানালে তিনি তাদেরকে চাঁদ দ্বিখন্ডিত করে দেখালেন। [সহীহ বুখারী- ৩৩৭৬]
প্রিয় নবীর অতুলনীয় কিছু বৈশিষ্ট্য
উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ একজন মুহাদ্দিস হযরত শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী পবিত্র ক্বোরআনের সূরা আদ-দ্বোহার তাফসীরে প্রিয় নবিজীর কয়েকটি অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য বর্ণনা দিয়েছেন। তা হল- ১. রাসুলে করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সামনে-পিছনে সমান ভাবে দেখতেন। রাতের অন্ধকারেও তিনি দিনের আলোর মতো দেখতে পেতেন। ২. রাসুলে পাকের লালা মুবারক লবণাক্ত পানিকেও সুস্বাদু পানিতে পরিণত করে দিত। ৩. সারাজীবন একবারও তিনি হাই তুলেননি। ৪. তাঁর ঘাম মোবারক মেশক আম্বর হতেও অধিক সুগন্ধিযুক্ত। সহীহ বুখারীতে রয়েছে, হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি আম্বর, কস্তুরি ও অন্য কোন সুগন্ধিকে রাসুলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সুরভী অপেক্ষা অধিক সুবাসিত পায়নি। [সহীহ বুখারী-খন্ড ১, পৃঃ ২৬৪]
৫. নবিজীর রক্ত মোবারক ছিল পবিত্র। ওহুদের যুদ্ধে প্রিয়নবির কপালে লৌহ শলাকা বিদ্ধ হয়। হযরত মালিক বিন সিনান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কপাল মোবারকে চুম্বন করে রক্ত চুষে পান করতে লাগলো। তখন প্রিয় নবি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, মালিক! তোমার ওপর দোযখের আগুন হারাম হয়ে গেল । কেননা তোমার দেহে নবির রক্ত প্রবেশ করেছে। ৬. নবিজী দুনিয়াতে তশরিফ আনার সাথে সাথে সিজদায় পড়ে ছিলেন। শাহাদাত আঙ্গুলি আসমানের দিকে উত্তোলিত ছিল। ৭. কোন ব্যক্তি নবিজীর প্রস্রাব-পায়খানা জমিনের উপর দেখতে পায়নি। জমিন ফেটে তা খেয়ে ফেলত। আর ওই স্থান থেকে মেশক আম্বরের খুশবু বের হত। হযরত উম্মে আইমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁর খাদেমা ছিলেন । একদা শীতের রাতে নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পেশাব করে একটি পাত্রে নিয়ে তা খাটিয়ার নিচে রেখে দেন। সকালে উম্মে আইমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু পরিষ্কার করতে এসে, খাটিয়ার নিচে অতি সুগন্ধিযুক্ত পানীয় এর মত কিছু দেখলেন। তিনি শরবত মনে করে তা পান করে ফেলেন। এটা জানতে পেরে রাসুলে করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এটা পেশাব ছিল। ওই পেশাব পান করার ফলে তাঁর সাতপুরুষ ক্বোরআনের হাফেজ হয়েছিল। ৮. রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর দেহ মোবারকের কোন ছায়া ছিল না। তিনি কোন দিন রোদে দাঁড়ালে রোদের কিরণ অপেক্ষা তার কিরণ প্রখর থাকত। তিনি নিজেই ছিলেন নূর। যাকে কোরআনে বলা হয়েছে, “সিরাজাম মুনিরা”। সিরাজুম মুনির হল যা নিজেই আলোকিত এবং অপরকে আলোকিত করতে পারে। সীরাতে হালভীয়ায় বর্ণিত রয়েছে- যখন তিনি রোদে বা চাঁদের আলোতে চলতেন তার কোন ছায়া পড়ত না। কেননা তিনি ছিলেন নূর। ইমাম রাগিব ইস্পপাহানি তার মুফরাদাত গ্রন্থে লিখেছেন- রাসুলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নাম গুলোর মধ্যে একটি হলো-নূর। বলা হয়েছে, তার বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি বৈশিষ্ট্য হল, যখন তিনি রোদে যেতেন তার কোন ছায়া দৃষ্টিগোচর হতো না। ৯. শিশুকালে ফেরেশতাগণ তার দোলনা দোলাতেন। দোলনায় থাকাকালে চাঁদ তার সাথে কথা বলত। আঙ্গুল দিয়ে যখন যেদিকে ইশারা করতেন চাঁদ সেদিকে হেলে যেত। ইমাম বায়হাকী হযরত আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন-আমি একদিন বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আপনার নুবূয়াতের একটি আলামত আমাকে আপনার দ্বীন কবুল করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। দোলনায় থাকাকালে আমি আপনাকে দেখেছি যে, আপনি চাঁদের সাথে কথা বলেছেন এবং নিজের আঙ্গুল দিয়ে চাঁদের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। আপনি যেদিকে ইশারা করতেন চাঁদ সে দিকে ঝুঁকে পড়তো। [আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খন্ড ২, পৃঃ-৪৯০] ১০. তিনি পাথরের উপর চলতে গেলে পাথর গলে নরম হয়ে যেত এবং কদম মোবারকের চিহ্ন বসে যেত।
লেখক: সহকারি শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা), চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল, চট্টগ্রাম।