ইসলামি সংস্কৃতির উন্নয়ন ও পূনর্জীবনে গাউসে জামান আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (র)’র অনন্য অবদান

ইসলামি সংস্কৃতির উন্নয়ন ও পূনর্জীবনে গাউসে জামান আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (র)’র অনন্য অবদান

মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার

ইংরেজি Culture শব্দের পরিভাষা হিসেবে বাঙলা ‘সংস্কৃতি’ শব্দটি পরিচিত। এর আভিধানিক অর্থ শিক্ষা বা অভ্যাস দ্বারা লব্ধ উৎকর্ষ বা কৃষ্টি। সম্ -কৃ (করা) +ক্তি -এ ব্যুৎপত্তির মধ্যেই নিহিত থাকে পরিশীলিত, পরিমার্জিত, পরিশ্রুত, নির্মলীকৃত, শোধিত এ ধরনের অনুভবসমূহ। ফলে উৎকর্ষময় বা পরিশ্রুত জীবন চেতনাই সংস্কৃতির সারাৎসার-এ উক্তি মূলানুগ।
[নরেন বিশ্বাস, ইতিহাসের আলোকে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, সুকান্ত একাডেমী, ঢাকা,পৃ-৯] ড: আহমদ শরীফের মতে, সংস্কৃতি হল মানুষের অর্জিত আচরণ, পরিশ্রুত জীবন চেতনা’। তাঁর মতে, সংস্কৃতির উদ্ভব হয় প্রজ্ঞা ও বোধিসম্পন্ন ব্যক্তি চিত্তে এবং বিকাশ হয় ব্যক্তি থেকে ক্রমে সমাজে এবং সমাজ থেকে তা বিশ্বে ব্যপ্ত হয়। তাঁর মতে, চিন্তায়, কর্মে ও আচরণে জীবনের সুন্দর, শোভন, পরিশীলিত ও পরিমার্জিত অভিব্যক্তিই সংস্কৃতি। [মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাস, পৃ-৮, প্রকাশক-ফজলুল করিম তালুকদার, চট্টগ্রাম ২৭ মার্চ ২০০২] তাজুল ইসলাম হাশেমীর মতে মানুষের চিন্তাধারা, মূল্যবোধ, আচার-বিশ্বাস, শিল্পকলা, আইন-কানুন, অনুশীলন ও অভ্যাস এবং তাঁর সমগ্র সৃষ্টির সমষ্টিই তার সংস্কৃতি। [প্রাগুক্ত, পৃ -৮] মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘সংস্কৃতি কথা’ মতে, সংস্কৃতির অনিবার্য শর্ত হচ্ছে মূল্যবোধ। [প্রাগুক্ত, পৃ-৯]

উপরোক্ত, বাঙালি বাম বুদ্ধিজীবীদের সংস্কৃতির সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনায় আমরা বলতে পারি সংস্কৃতি হল মূলত সুন্দর, পরিশুদ্ধ জীবনাচার বা জীবন ব্যবস্থার নাম। আর ইসলাম হল একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। এমনকি আল্লাহর নিকট মনোনীত একমাত্র জীবনধারা হল ইসলাম ‘‘ইন্নাদ্ দী-না এনদাল লাহিল ইসলাম’’। [আল ক্বুরআন]

উক্ত আয়াতের মর্মার্থ হল ইসলামি জীবনধারা বা জীবনাচারই মূলত গ্র্রহণযোগ্য এবং বিশুদ্ধতম। আর যেহেতু ব্যক্তি থেকে সমাজে এবং বিশ্বে ক্রমে সংস্কৃতি ছড়িয়ে যায়, সুতরাং আমরা দেখি, ইসলামি সংস্কৃতির বিকাশেও উক্ত বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন দেখা যাবে। প্রকৃত অর্থে ইসলামের শিক্ষা-সংস্কৃতির শুরুটা হয় আদি মানব এবং নবী হযরত আদম (আ) হতে। আর এর পরিপূর্ণতা আসে শেষ এবং শ্রেষ্ঠ নবী মুহম্মদুর রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে।’ ‘আল ইয়াওমা আক্বমালতু লাকুম দ্বীনকুম ওয়াত মামতু আ’লাইকুম নে’মাতি। [আল আয়াত]

খোলাফায়ে রাশেদ-সাহাবায়ে কেরাম, আহলে বাইত (রা), আউলিয়ায়ে কেরাম, ইসলামের প্রভাবশালী দার্শনিক-বুদ্ধিজীবী, ওলামা-পীর-মাশায়েখ এমনকি গ্রহণযোগ্য ইসলামি নেতৃত্ব-ব্যক্তিত্বের অবদানের কারণে আজ চৌদ্দশ বছর ধরে এর পরিধি সম্প্রসারিত হচ্ছে। আকার বাড়ছে এর উপরি কাঠামোর (super structure)। যেমন, আমাদের সৃষ্টি পর্বের শুরুতে, হযরত আদম (আ) কে সৃষ্টির বিরোধিতা হয়েছিল, দোষারোপ হয়েছিল, আর কোন প্রকারের অপরাধ না করেও বাবা আদম (আ) আল্লাহ্ পাকের দরবারে ক্ষমা চেয়ে আমাদেরকে যে বিনয়ের কালচার শিক্ষা দিয়েছেন তাই প্রকৃত অর্থে সংস্কৃতি, বা ইসলামি সংস্কৃতি। তাঁর সে বিনয়ী ফরিয়াদ ছিল, ‘রাব্বানা যোয়ালামনা আনফুসেনা ওয়াইনলাম তাগফিরলানা ওয়াতার হামনা লানা কু নান্না মিনাল খাসেরীন।’ অর্থাৎ হে প্রভু! আমি অপরাধী (নিজের উপর জুলুম করেছি), যদি তুমি আমায় মাফ না কর, যদি তুমি দয়া না কর, তবে আমি ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে গণ্য হব।’ [আল ক্বুরআন]

আলহামদুলিল্লাহ্, প্রকৃত অলী-আউলিয়া, সূফি-দরবেশদের হাতে এমন সংস্কৃতির বিকাশ এখনো চলছে, কেয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে। যেমন, গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ্ (র) বলতেন যার মধ্যে আমিত্ব-অহংকার আছে, তার কাছে ত্বরিকতের গন্ধও নাই। তিনি বলতেন, ‘মেই কা পট্টি ছোড়’। বলতেন আপনাকো হাকির সমঝো, না’চিজ সমঝো’ জররা এ না চিজ সমঝো’, অর্থাৎ নিজেকে পায়খানার চেয়েও নিকৃষ্ট মনে কর, ইত্যাদি। পক্ষান্তরে বলা যায় যে, অপসংস্কৃতির শুরু ইবলিশের হাতে, এবং হাজার হাজার বছর ধরে এর বিকাশ চলছে মানবজাতির এই প্রধান শত্রু ইবলিশ শয়তানের অনুসারিদদের মাধ্যমে। তাই আশরাফুল মাখলুকাত বা পরিশীলিত মানুষরাই সংস্কৃতির বাহক। আর, ইবলিশ ও তার অনুগত মানুষরুপী ইবলিশদের হাতেই অপসংস্কৃতি ছড়ায়। সেদিন, ইবলিশ, আদম (আ) কে সেজদা না করে আল্লাহর আদেশের অমান্য করেছিল এবং কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়, ওয়া কা’না মিনাল কাফেরীন। [আয়াত]

ইবলিশ অহংকার করে বলেছিল যে সে আদম (আ)’র চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তাকে আগুন হতে আর আদম (আ) কে মাটি হতে বানানো হয়েছে।’ আর, এ অহংকারের কালচারই বর্তমানে শয়তানি প্ররোচনায় ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপি। শয়তানের সমালোচনার তীর আদম (আ)’র দিকে তাক করেছিল, অথচ আর হযরত আদম (আ) করেন আত্মসমালোচনা। এটিই পছন্দ হল আল্লাহর কাছে,। আমাদের প্রথম মানব তাঁর বংশধরদের আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা হবার আচরণ শিক্ষা দিয়েছিলেন, আর সূফি-দরবেশ, আউলিয়ায়ে কেরামগন তাঁদের অনুগতদের সেই শিক্ষা -দীক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ্ (র) বলতেন, ‘তুমি অন্যের সমালোচনা, বা বদনামের জন্য আঙুল তাক কর একটি, আর তোমারই বাকি চার আঙুল তোমার দিকে তাক হয়ে, তোমাকে জানিয়ে দেয় যে, তুমিত তারচেয়ে চারগুণ বেশি খারাপ!’ বদরুদ্দিন ওমর’র মতে, ‘জীবন চর্চারই অন্য নাম সংস্কৃতি। মানুষের জীবিকা, তার আহার-বিহার, চলাফেরা, তার শোকতাপ, আনন্দ-বেদনার অভিব্যক্তি, তার শিক্ষা-সাহিত্য, ভাষা, তার দিন রাত্রির হাজারো কাজ কর্ম, সবকিছুর মধ্যেই তার সংস্কৃতির পরিচয়। [প্রাগুক্ত, পৃ -৯]

জীবন-জীবিকার বিষয়টি সংস্কৃতির আলোচনায় অবিচ্ছেদ্য একটি দিক। আর, এই জীবন-জীবিকা উপভোগের এক অসুস্থ প্রতিযোগিতার পরিণামেই এই মানুষ হয়ে ওঠে অমানুষ, অহংকারী শয়তান। তাই, জীবন- জীবিকা অর্জনে সীমালঙ্গন থামাতে হুজুর কেবলা তৈয়্যব শাহ্’র শিক্ষা ছিল অত্যন্ত চমৎকার। তিনি বলতেন, নৌকা চলতে পানির দরকার হয় বটে, কিন্তু সেই পানি যেন নৌকার পৃষ্ঠে রাখা হয়, পানিকে বুকে যেন প্রবেশের সুযোগ না দেওয়া হয়। কারণ, নৌকার বুকে পানি ওঠার পরিণাম হল নৌকা ডুবি, ভয়ানক বিপদ, তেমনি,যতক্ষণ এই দুনিয়াতে আছি, ততক্ষণ একে ছাড়া চলবেনা বটে, কিন্তু, একে বুকে নিতে গেলেই মানুষের ধ্বংস নেমে আসে, তাই দুনিয়াকেও বুক নয়, পৃষ্ঠ প্রদর্শণ করতে হবে, সুবহানআল্লাহ, কি দার্শনিকতা তাঁর তালিম-তারবিয়াতে। এ হল, প্রকৃত ইসলামি সংস্কৃতির মূল্যবোধ শিক্ষার একটি দিক সম্পর্কে ধারণা মাত্র।এরুপ, রয়েছে বহু উদাহরণ। যেহেতু সংস্কৃতির আওতাভুক্ত অপরাপর বিষয়গুলোও এ প্রবন্ধের আলোচনায় আনা উচিত, তাই আমরা সে সব বিষয়ে সংক্ষেপ পরিচয় দেওয়ার প্রয়াস পাব। ইতোপূর্বের আলোচনায় দেখানো হয়েছে যে, আমাদের শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য, আইন -আদালত, আচার-বিশ্বাস, চলাফেরা, দিন রাত্রির হাজারো কাজ কর্ম কোন কিছুই বাদ থাকেনা এ আলোচনায়, তাই এটি একটি ব্যাপক বিষয়। আমরা মাত্র কয়েকটি ক্ষেত্রে, নিবন্ধের শিরোনামের প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় আলোচনা করব।

শিক্ষা-দীক্ষা
সংস্কৃতির আভিধানিক অর্থ হল, শিক্ষা বা অভ্যাস দ্বারা অর্জিত উৎকর্ষ বা কৃষ্টি। আর, পরিশীলিত, পরিশ্রুত জীবনাচার শিক্ষার প্রধান বাহন হল ধর্মীয় শিক্ষা, যার মূল ঠিকানা হল মাদরাসা। বিশেষত যে সব মাদরাসা কোরান-সুন্নাহ্-ফেকাহ্ শিক্ষার পাশাপশি সূফি-আউলিয়ায়ে কেরামের চিন্তাধারা বা জীবনাচারের তালিম -তারবিয়াতি ব্যবস্থা রয়েছে সে সবেই রয়েছে প্রকৃত ইসলামের আক্বিদা ও আমল। গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ্ (র) এক্ষেত্রে ছিলেন তাঁর পিতা শাহানশাহে সিরিকোট, আল্লামা হাফেজ সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ (র)’র পদাংক অনুসারি। সিরিকোটি হুজুর চট্টগ্রামে এমন আদর্শ স্থানীয় মাদরাসার এক অনন্য নমুনা জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এবং মুরীদ-ভক্তদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন -‘মুঝেহ্ দেখনা হ্যায় তো মাদরাসা কো দেখো, মুঝসে মহব্বত হ্যায় তো মাদরাসা কো মহব্বত করো’। ঠিক তেমনি আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ মুহম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (র) বলেছিলেন, ‘‘কাম করো, দ্বীনকো বাচাও, ইসলাম কো বাচাও, সাচ্চা আলেম তৈয়ার করো’’, এবং বানিয়েছেন ঢাকা-মুহম্মদপুরস্হ কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া (কামিল) মাদরাসা, হালিশহর তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া (ফাজিল) মাদরাসা, চন্দ্রঘোনায় তৈয়্যবিয়া অদুদিয়া সুন্নিয়া (ফাজিল) মাদরাসা সহ বহু দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। পরবর্তিতে, তাঁর প্রেরণায় উজ্জীবিত মুরীদ-ভক্তদের হাতে নির্মিত হয়েছে শতাধিক মাদরাসা, যে সব মাদরাসা শিক্ষা দেওয়া হয় ইসলামের মূলধারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত ‘র আক্বিদা-আমল তথা প্রকৃত ইসলামের সংস্কৃতি। ফলে, আজ এ সব মাদরাসা শত শত ‘সাচ্চা আলেম’ দেশ -বিদেশে সুন্নিয়ত ভিত্তিক সূফিবাদী ইসলামি কালচারের পরিধিকে দিন দিন সম্প্রসারিত করে চলেছে।

খানেক্বাহ্ ভিত্তিক সংস্কৃতির জাগরণে
এই উপমহাদেশের ইসলামি সংস্কৃতির হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান হল খানেক্বাহ্। গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ্’র সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথ ধরে বর্তমান পর্যন্ত শত শত খানেক্বাহ্ প্রতিষ্ঠিত হয়ে শহর-গ্রাম -বন্দরে ত্বরিকত ভিত্তিক সাংস্কৃতিক চর্চা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাঁর জীবদ্দশায়, তিনি তদীয় আব্বা হুজুর কেবলার স্মৃতিময় চট্টগ্রাম আন্দরকিল্লাস্থ আলহাজ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের ‘কোহিনুর মনজিল’, এরপর পার্শবর্তী আলহাজ আবদুল জলিল সওদাগরের ‘বাংলাদেশ প্রেস’কে খানেক্বাহ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাছাড়া, ঢাকার কায়েৎটুলিস্থ খানেক্বাহ্ শরিফ সহ আরো বেশ কিছু পুরোনো প্রতিষ্ঠান তাঁর হাতে চাঙ্গা থাকে। এরপর আনুমানিক ১৯৬৫ সনের দিকে, আলহাজ নুর মুহম্মদ আল কাদেরীর হাতে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রামের কোরবানিগঞ্জস্থ বলুয়ারদীঘি পাড়ের ঐতিহ্যবাহী খানেক্বাহ্ শরিফ ছিল জীবদ্দশায় হুজুর কেবলা তৈয়্যব শাহ্’র প্রধান নিদর্শন। তিনি এখানে তাঁর শেষ সফর ১৯৮৬ পর্যন্ত রাত যাপন থেকে শুরু করে যাবতীয় ত্বরিকতের কাজ এবং আনজুমানের কাজ সহ যাবতীয় কর্মকান্ড চালাতেন। প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর তিনি এখানে কোরানে করিমের দরস দিতেন। বাংলাদেশ ও বিশ্ব ইসলামি সংস্কৃতিতে তাঁর অনন্য উপহার ‘জসনে জুলুস’র প্রথম যাত্রাটি হয়েছিল এই বলুয়ারদীঘি পাড় খানক্বাহ্ হতে, ১৯৭৪ সনে (১২ রবিউল আউয়াল, ১৩৯৫ হিজরি) তারিখে, তাঁরই নির্দেশে আলহাজ্ব নুর মুহম্মদ আল কাদেরীর নেতৃত্বে। আজ এই খানেক্বাহ্ শরিফ এবং তাঁর নির্দেশে পরবর্তিতে প্রতিষ্ঠিত ষোলশহর জামেয়া সংলগ্ন আলমগীর খানেক্বাহ্ শরিফ সহ বহু খানেক্বাহ্ শরিফে প্রতিদিন চলছে কাদেরিয়া ত্বরিকার খতমে গাউসিয়া শরিফ, মীলাদ, সালাত-সালাম, এবং প্রতি মাসে পালিত হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী গেয়ারভী শরিফ সহ বিভিন্ন ইসলামি কর্মকান্ড। বিশেষত, আলমগীর খানেক্বাহ শরিফ বর্তমানে শরিয়ত-ত্বরিকতের যাবতীয় শিক্ষা -সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে শরিয়তের মাসয়ালা -মাসায়েল শিক্ষা প্রকল্প ‘দাওয়াতে খায়র’ এর প্রধান কেন্দ্র হিসেবেও এ খানেক্বাহ্ ব্যবহৃত হচ্ছে। এখন হুজুরের শত শত খানেক্বাহ্ শরিয়ত-ত্বরিকতেরর নির্মল সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র হিসেবে আলো ছড়াচ্ছে সমগ্র দেশে, এমনকি বিদেশেও।

জসনে জুলুস প্রবর্তক
বর্তমান বিশ্ব ইসলামি সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণীয় এবং জনপ্রিয় সংযোজন হল জসনে জুলুস। সাধারনত এর অর্থ বর্ণাঢ্য শোভা যাত্রা বা মিছিল বোঝানো হলেও, বর্তমানে এটি অধিকতর প্রাসঙ্গিকতা পেয়েছে ‘জসনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ হিসেবে। এটি এখন মিলাদুন্নবী শোভাযাত্রা বোঝায় বিশ্বব্যাপি। পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদযাপন বর্তমানে এক বর্নাঢ্য রুপ পেয়েছে এ জসনে জুলুসের সৌন্দর্য ও প্রভাবে। ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, আজ হতে চৌদ্দশ বছর আগে সমগ্র সৃষ্টির রহমত নবী মুহম্মদুর রাসুলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কা শরিফ থেকে হিজরত করে মদিনায় পৌঁছেন সেদিন এই শ্রেষ্ঠ অতিথির আগমন সংবাদে মদিনার উপকন্ঠে এসে জড়ো হয়েছিলেন মদিনার সকল বয়সী নারী-পুরুষেরা। তাঁরা তাঁদের প্রিয়তম এ অতিথি নবীজি কে নিয়ে কাসিদা গাইতে গাইতে বর্নাঢ্য শোভাযাত্রা বা জসনে জুলুস সহকারে শহরের অভ্যন্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার এ ধরাপৃষ্ঠে নবীজির শুভাগমন অর্থাৎ মীলাদের সময়ে মা আমেনার ঘরে এসেছিল অসংখ্য ফেরেস্তা ও জান্নাতি রমনীদের নূরানি মিছিল। ৮ম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং নবী পাক (দ) ও লক্ষাধিক সাহাবায়ে কেরামের মিছিল। ধর্মীয় শোভাযাত্রার এ সব ঐতিহ্যকে ধারন করেই প্রবর্তিত হলো নবীজির শুভ আগমন বা মীলাদ উপলক্ষে জসনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী (দ)। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বিশাল এবং আকর্ষণীয় যে জসনে জুলুসটি সমগ্র বিশ্ববাসীর দৃষ্ট আকর্ষণ করেছে সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা হতে প্রতিবছর ১২ রবিউল আউয়াল যে জসনে জুলুসটি বের হয়ে আসছে। আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট’র ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত চট্টগ্রামের এ জসনে জুলুসে লোক সমাগম হয় অন্তত চল্লিশ লক্ষ। এ উপলক্ষে ১২ রবিউল আউয়াল সমগ্র চট্টগ্রাম শহরে ওঠে সাজ সাজ রব। চট্টগ্রামের এ জসনে জুলুস শুরু হয় ১৯৭৪ সনে, রাসুলেপাক (দ)’র ৩৯ তম অধ:স্তন বংশধর, মাতৃগর্ভের অলী,দরবারে আলিয়া কাদেরিয়া সিরিকোট শরিফের তৎকালিন সাজ্জাদানশীন, আল্লামা হাফেজ সৈয়্যদ মুহম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (র)’র নির্দেশ ও রূপরেখা অনুসরনে। সেদিন ১৯৭৪ এর ১২ রবিউল আউয়াল সকালে আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আলহাজ নূর মুহম্মদ আল কাদেরীর নেতৃত্বে কোরবানিগঞ্জস্হ বলুয়ারদিঘীপাড় খানকাহ্ এ কাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবিয়া হতে শুরু হয়ে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক সমূহ প্রদক্ষিণ করে ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা ময়দানে এসে ওয়াজ, মিলাদ ও মুনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয়েছিল জুলুসটি।

১৯৭৬-১৯৮৬ পর্যন্ত এর নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং এর প্রতিষ্ঠাতা রূপকার গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ (র)। ১৯৮৭ হতে অন্তত ৩২ বার এর নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁরই শাহজাদা এবং সাজ্জাদানশীন, রাহনুমায়ে শরিয়ত ও তরিকত, আল্লামা সৈয়্যদ মুহম্মদ তাহের শাহ্ (মাজিআ)। ১৯৭৪ সনে শুরু হওয়া মাত্র কয়েক হাজারের এ জসনে জুলুস বর্তমানে চল্লিশ লাখ মানুষের জনশ্রোতে রুপ নিয়েছে এই মহান আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব আল্লামা তাহের শাহ ‘র নেতৃত্বে। ধারনা করা যায়, এই জসনে জুলুসটিই বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ এবং এটিই বিশ্বের অপরাপর জুলুসের মূল প্রেরণা। সে হিসেবে এর প্রতিষ্ঠাতা রুপকার, ইসলামের মহান সংস্কারক, আল্লামা সৈয়্যদ মুহম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (র) হলেন বিশ্ব জসনে জুলুসের প্রকৃত স্বপ্নদ্রষ্টা এবং রুপকার। বিচ্ছিন্নভাবে অনাড়ম্বরভাবে পৃথিবীর অন্য কোথাও জসনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী (দ) আয়োজন এর আগে হলেও হতে পারে। হয়তো সেগুলোর খবর বিশ্ববাসীর কাছে সময়মত এসে পৌঁছায়নি, বা ঐ সব আয়োজন মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। সে হিসেবে শুরুতেই প্রথমে সমগ্র বাংলাদেশে, এবং পরবর্তিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রেরনার কারণ হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছে চট্টগ্রামের এই বিশাল আয়োজনটি। তাই বলা যায়, এটিই বিশ্ব জসনে জুলুসের প্রেরণাদানকারী প্রথম জুলুস, এবং এর রুপকার আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ হলেন এর প্রতিষ্ঠাতা প্রানপুরুষ। যেভাবে বলা যায় যে, ভারত বর্ষে ইসলামের সূচনা ৭১২ খ্রিস্টাব্দে আরবদের সিন্ধু বিজয় বা আরো আগের পীর দরবেশদের মাধ্যমে শুরু হলেও তাঁদের হিন্দুস্তানে ইসলামের সূচনাকারী বলা যায়, আর প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় খাজা গরীবনওয়াজ মঈনুদ্দিন চিশতি (র) কে যিনি এসেছিলেন আরো পাঁচশত বছর পরে। কারণ, তাঁর হাতে ইসলামের জোয়ার এসেছিল এ উপমহাদেশে।

সাহিত্য প্রকাশনা
শিল্প -সাহিত্য- ভাষা, সংস্কৃতির বড় বাহন, যা শুরুতে বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও হুজুর তৈয়্যব শাহ্ (র) ‘র অবদান অসামান্য। সুন্নি মতাদর্শ ভিত্তিক দ্বীনি শিক্ষা -সংস্কৃতিকে ভিন্ন ভাষা থেকে বাংলায় ভাষান্তর করে বাঙালি মুসলিম সমাজকে উপকৃত করবার প্রয়োজন অনুভব করে তিনি ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭৬ তারিখে,আনজুমান এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার এক সভায় ‘তরজুমান এ আহলে সুন্নাত’ নামক মাসিক পত্রিকা প্রকাশের নির্দেশ দেন। ১৯৭৭ সনের জানুয়ারি থেকেই এর প্রকাশ শুরু হয়ে অদ্যাবধি চালু আছে। বিগত চার দশক ধরে এ ‘তরজুমান’ সুন্নি অঙ্গনের প্রধান মাসিক পত্রিকা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, খাজা চৌহরভী (র) রচিত, ৩০ পারা দরুদ গ্রন্থ ‘মজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ যা ১৯৩৩ সনে রেঙ্গুন হতে সিরিকোটি হুজুরের হাতে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল, তা পরবর্তিতে তৈয়্যব শাহ্ হুজুরের তত্বাবধানে হুবহু প্রকাশ ছাড়াও উর্দু তরজমা সহ প্রকাশ করা হয়। ইলমে লাদুন্নির এক বিরল আধার এই উচ্চাঙ্গের আরবী ভাষার দরুদ গ্রন্থটি তাঁর তত্বাবধানে উর্দুতে প্রকাশ হবার সুবাদে বর্তমানে বাংলা ভাষায় তরজমা হয়ে এ মহাগ্রন্থের বরকত ও জ্ঞান বাঙালিদের কাছে ছড়িয়ে পড়বার সুযোগ তৈরী হল। বর্তমানে এর অর্ধেক কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছেন হুজুরের বিশিষ্ট মুরীদ আনজুমান রিসার্চ সেন্টারের মহাপরিচালক আল্লামা মুহম্মদ আবদুল মান্নান ও সৈয়্যদ মুহম্মদ জালাল উদ্দিন আল আজহারী। খাজা চৌহরভী (র)’র দৈনন্দিন অজিফা যা ত্বরিকত পন্থীদের আধ্যাত্মিক উন্নয়নের পথে বড় সহায়ক নেয়ামত, তা সংকলন করে ‘আওরাদুল কাদেরিয়াতুর রহমানিয়া’ নামে প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন হুজুর তৈয়্যব শাহ্। শুধু তাই নয়, তাঁর দিক -নির্দেশনা অনুযায়ী ইসলামি সাহিত্য প্রকাশনার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পাওয়ায় বর্তমানে প্রায় অর্ধশত কিতাব আনজুমান হতে প্রকাশিত হয়ে বাঙালি মুসলমানদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে-যেখানে ‘গাউসিয়া তারবিয়াতি নেসাব’র মত অতীব মূল্যবান এবং প্রয়োজনীয় গ্রন্থও রয়েছে।

সংস্কৃতি চর্চায় মসলকে আ’লা হযরতের সমন্বয়
চতুর্দশ শতাব্দির মহান মুজাদ্দিদ, আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা বেরলবী (র)’র সাথে বাংলা ভাষাভাষিদের প্রথম পরিচয়ের বুনিয়াদি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের জামেয়া প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শাহানশাহে সিরিকোট যে বীজ বপন করেছিলেন, একে বর্তমানের বটবৃক্ষ বানিয়েছেন আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ হুজুর। আ’লা হযরত ইসলামের বিশুদ্ধ শিক্ষা -সংস্কৃতি-আক্বিদা-আমলের যে ধারার মাধ্যমে বিগত শতাব্দিতে দ্বীনের সংস্কারক (মুজাদ্দিদ) হিসেবে গণ্য হয়েছেন, সে সংস্কার কর্মসূচি আল্লামা তৈয়্যব শাহ্’র হাতে বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পৌঁছে যায়। আ’লা হযরত রচিত সালামে রেযা ‘মুস্তফা জানে রহমত পে লাখো সালাম, না’তিয়া কালাম’ ‘সবসে আওলা ওয়া আ’লা হামারা নবী’র মত অত্যন্ত জনপ্রিয় ইসলামি সংস্কৃতি বাংলাদেশ, বার্মা সহ পৃথিবীর বহুদেশে গৃহীত হয় আল্লামা তৈয়্যব শাহ্’র কারণে। তিনি মাদরাসার এসেম্বলিতে যে ‘সবসে আওলা’ ‘নাত’ চালু করেছেন, তা আজ আনজুমান পরিচালিত শত মাদরাসা ছাড়াও দেশের প্রায় সুন্নি মাদরাসায় গৃহীত হয়েছে। খতমে গাউসিয়া, গেয়ারভী শরিফ সহ মীলাদ-কেয়াম, ওয়াজ মাহফিল সর্বত্র এখন যে ‘মুস্তফা জানে রহমত’ সালামি এবং সবসে আওলা না’ত শরিফ চালু হয়েছে, এর সূচনাকারী হলেন তৈয়্যব শাহ্ হুজুর। এ দুটি নাত, সালাম সহ বহু না’ত-কাসিদা আজ আমাদের ইসলামি সংস্কৃতির ভান্ডারকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি এতে এনেছে বৈচিত্র্য। আ’লা হযরত রচিত বিশুদ্ধতম তরজুমানুল ক্বুরআন ‘কানযুল ঈমান’ এবং এর আলোকে রচিত তাফসির ‘নুরুল ইরফান’ উর্দু থেকে বাংলাতে তরজমা মূলত তাঁরই পরামর্শ এবং দোয়ার ফসল যা আল্লামা আবদুল মান্নানের মাধ্যমে তিনি করিয়ে নিয়েছেন। আ’লা হযরতের রচনাবলীর বাংলা সংস্করণ এখন অহরহ হচ্ছে এ ঘরানার আলেমদের হাতে, চলছে তাঁর চিন্তাধারার উপর উচ্চতর গবেষণা। হুজুর কেবলা তৈয়্যব শাহ্ ‘র মুরীদ এবং চট্টগ্রাম জামেয়ার ছাত্র সৈয়দ মুহম্মদ জালাল উদ্দিন আল আজহারীই প্রথম বাঙালি, যে কিনা আ’লা হযরতের আক্বায়িদী খেদমতের বিষয়ে মিশরের কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে এম ফিল সম্পন্ন করেন। আরবীতে লিখিত এ মূল্যবান থিসিসটিও বাংলাতে আসার দাবি রাখে। আজ, এদেশে আ’লা হযরত চর্চার জন্য যত সংগঠন-সংস্থা-প্রতিষ্ঠান আত্মপ্রকাশ করেছে, সবগুলোর কান্ডারীর ভূমিকায় হুজুর কেবলাদের অনুসারী, বা তাঁদের মাদরাসার ছাত্ররা রয়েছে,এ কথা আজ চোখ বন্ধ করে বলা যায়।

বিচার সংস্কৃতির উন্নয়ন প্রয়াস
আমাদের ছিল বিচার -আদালতের এক উজ্জ্বল ঐতিহ্য, যা ব্রিটিশরা এসে ধ্বংস করে দেয়। ব্রিটিশরা আমাদের ইসলামি আদালতের জায়গায় তাদের ব্রিটিশ পদ্ধতির এমন এক বিচার ব্যবস্থা দিয়ে গেল, যার জালে একবার আটকা পড়লে বাদি-বিবাদি, আসামি-ফরিয়াদি কারোই রেহায় থাকেনা। ত্রিশ বছরেও সমাধা হয়নি এমন মামলাও পাওয়া যাবে। এতদিনে মামলার উভয় পক্ষ শুধু সর্বশান্ত হয়না, তাদের মধ্যে যুগ যুগ ধরে শত্রুতাও চলতে থাকে, এমনকি মামলার মিমাংসার আগেই মারা যায় অনেকে। তাই, আজ, বাংলাদেশেও শালিশী মিমাংসার উপর গুরুত্ব দিয়ে বড় বড় বিজ্ঞাপন দিতে হচ্ছে। আর, এ বাস্তবতা উপলব্ধি করে ১৯১২ সালে, ‘তদবিরে ফালাহ্ ওয়া নাজাত ওয়া ইসলাহ’্ নামক দিক-নির্দেশনামূলক গ্রন্থে আ’লা হযরত পরামর্শ দিয়েছিলেন, যেন মুসলমানরা ব্রিটিশ আদালত বর্জন করে, এবং নিজেদের মামলা নিজেদের মধ্যে শালিশী ব্যবস্থায় মিমাংসার সর্বাত্মক চেষ্টা করে। কী আশ্চর্য মিল! দরবারে আলিয়া কাদেরিয়া সিরিকোট শরিফের হযরাতে কেরাম আগে থেকেই এ নীতিতে অটল এবং অনুশীলনকারী ছিলেন। সিরিকোটি হুজুর (র), তৈয়্যব শাহ্ (র) এবং বর্তমান সাজ্জাদানশীন আল্লামা তাহের শাহ্, পীর সাবির শাহ্ (মাজিআ) সবাই সিরিকোট অঞ্চলের বিচারক, আর দরবার হল আদালত প্রাঙ্গন। সিরিকোটবাসীর যাবতীয় মামলা-মোকাদ্দমা দরবার শরিফেই নিষ্পত্তি হয়ে আসছে আজ পর্যন্ত। যে মামলার বিচার করতে কোর্ট ব্যর্থ, এমন জটিল বিষয়ও মিমাংসা হয়ে যায় দরবারে। তাই, এখানকার মানুষ ব্রিটিশ বিচার ব্যবস্থার ক্ষতির শিকার হয়না। [মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার, আ’লা হযরতের চিন্তাধারা ও শাহানশাহে সিরিকোট, পৃ-১৯, সেমিনার প্রবন্ধ,তারিখ -২১ এপ্রিল ২০০৩, প্রকাশনায়-গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ,কেন্দ্রিয় পরিষদ, ২৪ মার্চ ২০০৫]

উল্লেখ্য, শুধু স্বদেশে নয়, এ দেশেও হুজুর কেবলা তৈয়্যব শাহ্ (র) এ বিচার সংস্কৃতি প্রবর্তনে যে প্রয়াস পান তা স্পষ্ট, তবে তা ছিল এ দরবারের ভাই-বোনদের নিজস্ব পরিমন্ডলে, নিজেদের মোয়ামেলাতের বিষয়ে। ‘হুজুর আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ (র), ১৯৭৮ সনে বাগদাদ শরিফ জেয়ারাতে সফরকালীন সময়ে, সেখান থেকেই (বাগদাদ শরিফ থেকেই) এ ব্যাপারে একটি পরিষ্কার নির্দেশ দিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন আনজুমানকে, এ চিঠিতে তিনি শালিসী বোর্ডের একটি দীর্ঘ তালিকা দেন, এবং বলেন, বিরোধের পক্ষদ্বয় উক্ত তালিকা থেকে নিজেদের পছন্দ অনুসারে দু’জন করে নমিনী দেবেন।উভয়ের পছন্দের চারজন নমিনী একই তালিকা হতে একজন সভাপতি বাছাই করবেন। আর, এ পাঁচ জন শালিশকারী যে সিদ্ধান্ত দেবেন, তা উভয় পক্ষ মানতে বাধ্য থাকবেন। কোন অবস্থাতেই, কোর্ট-কাচারি যাবেন না। [প্রাগুক্ত]

হুজুর কেবলার এ দিক-নির্দেশনা এখন আরো বেশি প্রাসঙ্গিক বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আমাদের উচিত, নিজেদের বিচারের ভার কোর্ট-কাচারির পরিবর্তে নিজেদের ভাই-বন্ধু -প্রতিবেশিদের মাধ্যমে উক্ত উপায়ে সমাধা করা। এতে, উভয় পক্ষের আর্থিক ক্ষতি যেমন নাই, তেমনি বিবাদ-বিসম্বাদও সমাধান হয়ে শান্তি ফিরে আসে, যা ব্রিটিশ পদ্ধতির কোর্ট এ পর্যন্ত দিতে সক্ষম হয়নি, ভবিষ্যতেও পারবেনা। বরং মিথ্যা মামলার সংখ্যাই বর্তমানে এসব আদালতে বেশি দায়ের হবার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষত, পারিবারিক আদালতে নারী শিশু আইন-আদালত বরং পরিবারের অশান্তির বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, এ থেকে ফিরে এসে, আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ প্রদর্শিত বিচার সংস্কৃতির সুযোগ নেওয়া জরুরি বলে মনে করি।

আক্বদ সংস্কৃতির উন্নয়ন
আক্বদ -নেক্বাহ্ ঐতিহ্যবাহি ইসলামি সংস্কৃতি বরং সুন্নত। আইনের দৃষ্টিতে মুসলিম বিয়ে শুধু একটি ধর্মীয় ফাংশন নয়, বরং একটি সুস্পষ্ট সামাজিক চুক্তি (Social contact)। চুক্তি কখনো অস্পষ্ট হতে পারেনা, একে স্পষ্ট করাই ইসলাম, এবং আইনের বিধান। অথচ, আমাদের বিয়ের আক্বদ সমূহের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই স্পষ্টতাকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়না বলে মনে হয়। আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ (র) ছিলেন এক্ষেত্রে খুব কঠিন একজন বিচারকের ভুমিকায় অবতীর্ণ। তিনি দু’জন সাক্ষীর পরিচয় নেবার পর, কখনো একজনের সামনে একজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন না। একজনকে বসাতেন, আর অন্যজনকে ওখান থেকে চলে যেতে বলতেন। একজনের সাক্ষী শেষ হবার পরই অপরজনকে ডাকা হত।দু’জনের সাক্ষী এক রকম না হলে তিনি বিয়ে পড়াতেন না। উকিল নিয়োগ, বা উকিলের বক্তব্য নিশ্চিত না হলেও বিয়ে পড়াতেন না। এমনকি দুলাহ্ কে সুস্পষ্টভাবে কবুল কিয়া (কবুল করলাম) শব্দটি উপস্থিতির সামনে বলা লাগত। বিয়ের মজলিশে হুজুর কেবলাকে মনে হত তিনি যেন বিচারপতির এজলাশে বসে বিচার -বিবেচনা করছেন। ঠিক এ পদ্ধতির বিয়ে এখনো পড়ান চট্টগ্রাম জামেয়া শাইখুল হাদিস মুফতি ওবাইদুল হক নঈমী সাহেব, যা তিনি হুজুর কেবলার সাথে সাথে থেকে রপ্ত করেছিলেন। এখন আক্বদের এ স্পষ্টতা নিশ্চিত করে বিয়ে পড়ানোর বিষয়টি এই ঘরানার আলেমদের মধ্যে যথেষ্ট অনুসৃত হচ্ছে বলে মনে হয়।

চিঠিপত্রে দিক-নির্দেশনা
চিঠিপত্র মানব ইতিহাস-ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। জ্ঞানীর কলমের কালি’কে শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম বলা হয়েছে। তাই আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে চিঠিপত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রেখেছে, যদিও প্রযুক্তির জ্যামিতিক উন্নয়নের ধারায় এখন আর কাগজে কলমে চিঠিপত্র লেখার প্রয়োজন হচ্ছেনা বললেও চলে। কিন্তু ইতোপূর্বে, বিংশ শতাব্দিতে যাঁরা আমাদের ছেড়ে গেছেন, তাঁদের সময় পর্যন্ত এ সংস্কৃতি চালু ছিল, বলে সেই বিষয়টি সেই তখনকার একজন বহুল আলোচিত আধ্যাত্মিক-সংস্কারক ব্যক্তিত্ব হিসেবে, হযরত তৈয়্যব শাহ্ (র)’র ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক, এবং তাঁর চিঠিপত্রাদি এখনও পরবর্তি প্রজন্মকে পথ দেখাতে সক্ষম। বিধায়, তাঁর এসব নিদর্শন সংরক্ষণ এবং বাংলায় প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় প্রকাশিত হওয়া দরকার বলে সচেতন মহল মনে করেন। কারণ, ইতোপূর্বে আলোচিত বিচার সংস্কৃতির উন্নয়নে তাঁর যে নির্দেশনা ছিল তাও কিন্তু চিঠির মাধ্যমে এসেছে। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে (১৩৯৫ হিজরিতে ১২ রবিউল আউয়াল) তাঁর নির্দেশে যে ‘জসনে জুলুস’ প্রবর্তন আজ ইতিহাস হয়ে আছে, তাও কিন্তু চিঠির মাধ্যমে হয়েছে। গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ’র মত এত বড় একটি অরাজনৈতিক-আধ্যাত্মিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠার নির্দেশটিও হয় চিঠিতে। তাই, চিঠিপত্র আলোচনার বিষয়টি তৈয়্যব শাহ্ হুজুরের আলোচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর চিঠি পেয়েই আনজুমান -জামেয়া কর্তৃপক্ষ, জামেয়ার লাইব্রেরী তল্লাশি চালায়, এবং দেখা যায় যে, হুজুর কেবলার কথাই ঠিক, সত্যিই জরুরি কিছু কিতাবপত্র পোকার আক্রমনে নষ্ট হবার উপক্রম হয়েছে। হুজুর কেবলার চিঠিতে সেই গায়েবী বিষয়টি না থাকলে, দ্রুততার সাথে লাইব্রেরীর কিতাবপত্র তল্লাশিও হতোনা, ফলে কিতাবগুলো রক্ষাও পেতনা। তাঁর একটা চিঠিতে পাওয়া যায় এমন একটি রাজনৈতিক ভবিষ্যত বাণী, যা মাত্র কয়েকবছর পরই ঘটেছিল। সাবেক পরাশক্তি সোভিয়েত রাশিয়া যখন মহা দাপটে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রন করে যাচ্ছিল, সে সময়ে হুজুর কেবলা তৈয়্যব শাহ্’র চিঠিতে বলা হয় যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) ভেঙ্গে যাবে শীঘ্রই, সেখান থেকে মুসলিম দেশগুলো বেরিয়ে আসবে। এরপর কি ঘটবে তা অলিআল্লাহরা ভাল জানেন’। আর, আনজুমান ট্রাস্ট’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আলহাজ মুহম্মদ মহসীন সাহেবের কাছে ১৯৮৭ সনে প্রদত্ত এবং তাঁর নিকট সংরক্ষিত, এই ঐতিহাসিক চিঠিটি ১৯৯৭ সনের এক রাতে যখন বলুয়ারদীঘি পাড়স্থ খানকাহ্ শরিফে পঠিত হচ্ছিল, তখন এ চিঠির ভবিষ্যত বাণী সত্যে পরিণত হয়ে সেই পরাশক্তি ভেঙ্গে গেছে, এবংছয়টি মুসলিম দেশ এ সুযোগে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে স্বাধীন হয়ে যায়, সুবহানাল্লাহ।
[মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার ইসলামের মহান সংস্কারক, গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ্ (র) শীর্ষক সেমিনার প্রবন্ধ, ২৭ এপ্রিল ১৯৯৮, চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন এবং গাউসুল আযম জিলানি: সংস্কার ও ত্বরিকা, পৃ ৭৬, ১৫ মে ২০০২, চট্টগ্রাম]

বাংলাদেশের বৃহত্তম খানকাহ্ হল চট্টগ্রামের আলমগীর খানকাহ্ শরিফ। এটির প্রতিষ্ঠা সম্পর্কেও ছিল গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ্’র চিঠি, আর, এ চিঠিটিও এসেছিল বাগদাদ শরিফে সফরের সময়ে। এরুপ বহু চিঠিপত্র রয়েছে, যেগুলোর গবেষনা হুজুর কেবলা (র)’কে জানবার জন্য জরুরি। বিশেষ করে বলতে হয়, তাঁর চিঠির উপরিভাগে লেখা থাকত আল্লামা ইকবালের একটি কাসিদা ‘কি মুহম্মদ সে ওফা, তু নে তু হাম তেরে হ্যায়- ইয়ে জাঁহা চিজ হ্যায়, কেয়া লওহ কলম তেরে হ্যায়’

কাজী নজরুল ইসলামের ভাবানুবাদে এই কাসিদার অর্থ দাঁড়ায়, আল্লাহ্ কে যে পাইতে চায়, হযরত কে ভালবেসে, আরশ কুরসি লওহ কলম, না চাইতে পেয়েছে সে’। তাঁর চিঠির উপরিভাগে অপর একটি কাসিদা শোভা পেত, সেটা হল ‘ওয়া সল্লাল্লাহু আ’লা নূরিন, কেজু শুধ নূরেহা পয়দা, জমি আজ হুব্বেও সাকিন, ফলক্ব দর এশক্বেও শায়দা’। নবীপ্রেমিকদদের চিঠি সংস্কৃতি অন্যদের চেয়ে আলাদা হওয়া স্বাভাবিক। কারণ, আশেকারা মিল্লাত ও মাজহাব জুদাস্ত, প্রেমিকদের পথ-মত-ধর্ম সব আলাদা। তিনি নিজেকে খুব ছোট জানতেন বলে চিঠির নিবেদক হিসেবে লিখতেন না’চিজ, (বা অধম), মুহম্মদ তৈয়্যব, গুফেরালাহু। সুতরাং তাঁর চিঠিপত্রাদিতে আমাদের জন্য অমূল্য নিদর্শন রয়েছে।

সংস্থা -সংগঠন
সংস্হা-সংগঠন-প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র থেকে শুরু করে মানুষের যাবতীয় সৃষ্টিশীল কার্যক্রমকেই সংস্কৃতি বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই, আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ (র)’র সাংগঠনিক অবদানের বিষয়টি আলোচিত না হলে প্রবন্ধটি অর্থবহ হবেনা মনে হচ্ছে। বিশেষত, প্রতিষ্ঠান-সংগঠনের মাধ্যমেই একজন প্রকৃত সংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্বের সৃষ্টিগুলো পৌঁছে যাবে সমাজ, দেশ-দেশান্তরে এটাই স্বাভাবিক। তাই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মাত্রই সাংগঠনিক মানসিকতা সম্পন্ন হবেন, এটাই সঙ্গত। গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ্ (র) ছিলেন বরাবরই একজন সাংগঠনিক ব্যক্তিত্ব, তাই তাঁকে দেখা গেছে সংগঠন দরদী হিসেবে। স্বাধীনের পর তাঁর প্রথম বাংলাদেশ আগমন হয় ১৯৭৬ সনে। এ বছরের ১৬ ডিসেম্বরেই তিনি ‘মাসিক তরজুমান’ প্রকাশের সিদ্ধান্ত ঘোষনার সাথে সাথে সুন্নি ওলামাদের সংগঠিত করার পদক্ষেপ নেন। জানুয়ারি ১৯৭৭ এ সে ওলামা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং একটি ‘ওলামায়ে আহলে সুন্নাত’ সংগঠনের আত্মপ্রকাশ হয় আর এ খবর তরজুমানের ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৮ সনে, তাঁর নির্দেশে পূনরায় চট্টগ্রাম জামেয়ায় অনেক টাকা খরচ করে ওলামা সম্মেলন আয়োজন করেছিল আনজুমান ট্রাস্ট। আবারো কমিটি গঠিত হয়েছিল এগার বছর পর । যদিও সুন্নি ওলামাদের দিয়ে সাংগঠনিক লক্ষ্য অর্জিত হয়নি পরপর দুই পদক্ষেপ নেবার পরও। ১৯৮৩-৮৬ পর্যন্ত, তাঁর দোয়া ও প্রত্যক্ষ সমর্থনের কারণে, অরাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র সেনা’র গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। এই সময়েও তিনি ওলামাদের জাতীয় সংগঠনের তাগিদ দেন, কিন্তু তাও তাঁরা পারেননি। ১৯৮৬ সনের পর তিনি আর বাংলাদেশে তশরিফ আনলেন না। এবার তিনি নিজস্ব ত্বরিকত ভিত্তিক সংগঠনের দিকে নজর দিতে বাধ্য হলেন, চিঠি তে নির্দেশ করলেন, গাউসিয়া কমিটি গঠনের। আলহামদুলিল্লাহ্, গঠিত হল ‘গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ’, এটি কাজে নেমে গেল ১৯৮৭ হতে। এখন দুনিয়ার ত্রিশটি দেশে এর শাখা গজিয়েছে। বাংলাদেশের অন্তত পঞ্চাশটি জেলায় এর কমিটি রয়েছে। যেখানে সুন্নিয়ত-ত্বরিকতের বাতি নিভে গিয়েছিল অশুভ শক্তির ফুৎকারে, আজ সেখানেও দেখা যাচ্ছে সূফি সংস্কৃতির আলোর ছটা। বিশ্বময় ছড়াচ্ছে এ আলোর নিশান। গাউসিয়া কমিটির কারণে আজ আনজুমানের হাতে পরিচালিত হচ্ছে শতাধিক সুন্নি-সূফি চেতনার মাদরাসা। গাউসুল আযম দস্তগীর (রা)’র সৈনিকরা শীঘ্রই চষে বেড়াবে সমগ্র বিশ্ব, ইনশাল্লাহ্। হুজুর কেবলা তৈয়্যব শাহ্ বলেছিলেন, ‘‘মেরে বাচ্চা মাহ্দী আলাইহিস সালাম কা ফৌজ বনেগা, আউর দাজ্জাল কা সাথ জেহাদ করেগা’’ ইনশাল্লাহ্, সে মহান লক্ষ্যভেদ করতে এগিয়ে চলেছে এই কাফেলা। যারা প্রকৃত সূফি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সমগ্র বিশ্বে পৌঁছে দিতে বদ্ধ পরিকর।

উপসংহার
মূলত : হুজুর কেবলা তৈয়্যব শাহ্ (র) হলেন চলতি হিজরি শতাব্দির অন্যতম সংস্কারক ব্যক্তিত্ব। (দেখুন, প্রাগুক্ত সেমিনার প্রবন্ধটি) তাঁর সংস্কারের পরিধি অনেক বিস্তৃত, যা আলোচনা সময় সাপেক্ষ বিধায় উপেক্ষিত হল এখানে। তিনি ছিলেন অলি আল্লাহদের শ্রেষ্ঠতম আসন ‘গাউসে জামান’র দায়িত্বে। [মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার মাতৃগর্ভের অলী, গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ্ গ্রন্থটি]

তাঁর ছিল অসংখ্য কারামত, যা প্রবন্ধের কলেবর সীমিত রাখবার প্রয়োজনে বাদ রাখতে হল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে ছিল তাঁর অবদান। কিন্তু এখানে শুধু বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আলোচনায় এসেছে। যেমন, শুধু করাচিতেই আছে তার অন্তত ৪টি মাদরাসা ও কয়েকটি মসজিদ। সিরিকোট দরবারে আছে জামেয়া তৈয়্যবিয়া। রেঙ্গুনে বাগিয়া গার্ডেনে রয়েছে বার্মার সুন্নিদের জন্য একমাত্র মাদরাসা। সূফি-দরগাহ্-ওরস সংস্কৃতিতে তাঁর প্রদর্শিত আদর্শ সুন্নি মুসলমানদের পাথেয়, বাতিল অপশক্তির মুখে কুলুপ আটকাতে তাঁর পরিশীলিত ত্বরিকত সংস্কৃতির গ্রহনযোগ্যতা আজ প্রশ্নাতীত। তিনি ছিলেন ‘জিনকি হার হার আ’দা সুন্নতে মুসতফা’র মূর্ত প্রতীক। তিনি ছিলেন রাসুলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ৩৯ তম অধস্তন বংশধারার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, এবং শাহানশাহে সিরিকোট (র)’র সাজ্জাদানশীন। [দেখুন, সাজরা শরিফ, আনজুমানে রহমানিয়া
আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট, চট্টগ্রাম প্রকাশিত]