গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ‘মুহিউদ্দীন’ নামের সার্থকতা

গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ‘মুহিউদ্দীন’ নামের সার্থকতা

গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ‘মুহিউদ্দীন’ নামের সার্থকতা- 

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান >

সাইয়্যেদুনা গাউসুল আ’যম শায়খ আবদুল ক্বাদির জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র অগণিত ‘লক্বব’ (উপাধি তথা গুণবাচক নাম) রয়েছে। তন্মধ্যে একটি বরকতমন্ডিত লক্বব হচ্ছে, ‘মুহিউদ্দীন’ (দ্বীন-ইসলামকে পুনর্জীবিতকারী) এ নামে নামকরণের কারণ খোদ্ হুযূর গাউসে আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এভাবে বর্ণনা করেছেন, তাঁকে কেউ আরয করলো, ‘হুযূর, আপনার লক্বব (উপাধি) ‘মুহিউদ্দীন’ কিভাবে দেওয়া হয়েছে?’’ তিনি বললেন, ‘৫১১ হিজরীতে আমি বাগদাদে একবার খালি পায়ে যাচ্ছিলাম। রাস্তায় আমি একজন অসুস্থ হাড্ডিসার ফ্যাকাশে রংঙের লোক পড়ে থাকতে দেখতে পেলাম। সে আমাকে ‘আস্সালামু আলায়কুম’ বলে আমার নাম ধরে ডাক দিলো এবং তার নিকটে যেতে অনুরোধ করলো। আমি যখন তার নিকটে গেলাম, তখন সে আমাকে টেনে তুলতে বললো। আমি তার অনুরোধ রক্ষা করলাম; কিন্তু কী দেখলাম? দেখতে দেখতে লোকটির শরীর সুস্থ হতে লাগলো। আর গায়ের রং ও আকৃতি একেবারে সুস্থ-সুঠাম বলে মনে হতে লাগলো।
আমি হঠাৎ এ পরিবর্তন দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। সে আমাকে বললো, ‘আপনি কি আমাকে চিনেছেন?’ আমি বললাম, ‘নাতো!’ তখন সে বলতে লাগলো, ‘‘আমি হলাম ‘দ্বীন-ইসলাম’। আপনি আমাকে ইতোপূর্বে যেমনি দেখেছিলেন, আমি বর্তমান সমাজে তেমনি অতি শোচনীয় অবস্থায় ছিলাম; কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা আপনার প্রচেষ্টায় আমাকে নতুন করে জীবন দান করেছেন।’’
এটা কোন অলীক-অমূলক কথা নয়; বরং বাস্তব কথাই। কারণ, হুযূর গাউসে আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এ ধরাধামে তাশরীফ আনার পূর্বে দ্বীন-ইসলামের অবস্থা অতি দুর্বল হয়ে গিয়েছিলো। এরপর তাঁর শুভ আবির্ভাবের ফলে, তাঁরই মাধ্যমে তা যেভাবে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছিলো, সেটার বর্ণনা ইতিহাসের পাতাগুলো উল্টালে বুঝা যাবে। এ নিবন্ধে আমি সে সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করার প্রয়াস পাচ্ছিঃ অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী বিশ্বনবীর ভবিষ্যদ্বাণী
হুযূর সরওয়ার-ই আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, (হিজরী) পঞ্চম শতাব্দির কাছাকাছি সময়ে (৪৭০/৭১হি.) আমার উম্মতের উপর মহাবিপদের একটি চাক্কি ঘুরবে। যদি তারা তা থেকে রক্ষা পেয়ে বেরিয়ে আসতে পারে; তবে আবার কিছু কালের জন্য স্থায়িত্ব লাভ করবে। [সূত্র. ফয়যুল বারী, কৃত. আনোয়ার শাহ্ কাশমীরী]

বিভিন্ন ঘটনায় এ সত্যতা প্রমাণিত
সুতরাং ওই শতাব্দিতে উম্মতের উপর ওই চাক্কি ঘুরেছিলো। ইতিহাস এর জ্বলন্ত সাক্ষী। ওই যুগে ইসলামের উপর অবনতি ও অধঃপতনের সূচনা ব্যাপকাহারে হয়েছিলো। যদিও বাহ্যিকভাবে ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর অবস্থানের পরম্পরা সুদূর স্পেন থেকে আরম্ভ করে এদিকে ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো; কিন্তু অভ্যন্তরীণ অবস্থাদি অত্যন্ত শোচনীয় ছিলো। ইসলামী দুনিয়ার কেন্দ্রীয় শক্তি অর্থাৎ খিলাফত (শাসন ক্ষমতা) বাগদাদে অতিমাত্রায় দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। এর বাইরে চতুর্দিকে দেউলিয়াপনা বিরাজ করছিলো। রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক দিয়ে সর্বত্র বিশৃঙ্খলা বিরাজিত ছিলো। আল্লামা ইবনে জাওযীর লিখিত ‘আল-মুনায্যাহ্’-এ এবং ভারতের শিবলী নো’মানী ও সুলায়মান নদভীর লিখিত ইতিহাস বিষয়ক কিতাব (গ্রন্থ)গুলোতে ওই সময়কার ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা থেকে বুঝা গেলো যে, ব্যভিচার, পাপাচার, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং চারিত্রিক অধঃপতন চরম সীমানায় পৌঁছে গিয়েছিলো। যেমন-
স্পেন: স্পেনে উমাইয়া বংশের আমীর আবদুর রহমানের প্রতিষ্ঠিত সরকারের কেন্দ্রীয় কাঠামো ভেঙ্গে পড়েছিলো। ইউরোপের খ্রিস্টান রাজ্যগুলো সুযোগের সন্ধানে ও অপেক্ষায় ছিলো- মুসলমানদের ক্ষমতা নিঃশেষ করে নিজেদের শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে।

বায়তুল মুক্বাদ্দাস
বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপর খ্রিস্টানদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর তারা ইরাক্ব ও হিজাযের উপর হামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, এমন মনে হচ্ছিলো যেন খ্রিস্টানগণ গোটা বিশ্ব থেকে মুসলমানদের সম্মিলিত শক্তিকেও নিশ্চিহ্ন করার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছিলো।

মধ্যপ্রাচ্য
মধ্যপ্রাচ্যের বিরাজিত আব্বাসী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ক্রমশ: নামমাত্র হয়ে যাচ্ছিলো, সালজূক্বী ও অন্যান্য অধীনস্থ সুলতানগণ পরস্পর গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। যে সুলতানেরই ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছিলো বাগদাদে তাঁর নামেই খোৎবা পাঠ আরম্ভ হয়ে যেতো।

আফগানিস্তান ও ভারতবর্ষ
আফগানিস্তান ও ভারতের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে সুলতান মাহমূদ গযনভীর উত্তরসূরীদের পতন শুরু হয়েছিলো। এখানকার হিন্দু রাজা-মহারাজাগণ তাদের পূর্ববর্তী পরাজয় ও অবমাননার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য শলা-পরামর্শ করছিলো।

মিশর
মিশরে, আল্লামা জালাল উদ্দীন সুয়ূতী আলায়হির রাহমাহ্ তাঁর ‘তারীখুল খোলাফা’য় সালতানাৎ-ই বাতেনিয়া ওবায়দিয়াকে ‘দৌলতে খবীসাহ্’ (নাপাক রাজ্য) বলে আখ্যায়িত ওই সম্প্রদায়টি ‘ইলহাদ ও বে-দ্বীনী’ মতবাদ ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রসারে লিপ্ত হলো। বস্তুত: এ সম্প্রদায়ের নেতারা ইসলামের যে পরিমাণ ক্ষতি করে ছিলো,তা প্রসিদ্ধ ও সর্বজন বিদিত।

চারিত্রিক অধঃপতন
এতদ্ব্যতীত মুসলমানদের চারিত্রিক অবস্থানও অধঃপতিত হয়ে গিয়েছিলো। আমির-ওমারা শ্রেণী বিলাসিতায় মগ্ন হয়ে পড়েছিলো। উদাহরণ স্বরূপ, মধ্য প্রাচ্যের এ মাঝারি পর্যায়ের ধনাঢ্য ব্যক্তি ইবনে মারওয়ান সম্পর্কে বর্ণিত যে, তার হেরম (আন্দর মহল)-এ গান-বাদ্যকারী ও নর্তকী দাসীদের সংখ্যা ছিলো পাঁচ শতের কাছাকাছি। ইমাম শাফে’ঈ আলায়হ্রি রাহমাহর বর্ণনামতে, কর্ডোবার মু’তামাদ নামের এক আমীর (ধনবান সরকারী কর্মকর্তা)-এর নিকট এমন আটশ নারী ছিলো। স্পেনের পর্দারূপী রুমাল পরিহিত সুলতানদের শাসনামলে ‘ইসলামী পর্দাপ্রথা’ও নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলো। পুরুষেরা নেকাব (পর্দারূপী রুমাল) পরতে আরম্ভ করলো, আর তাদের নারীরা বে-পর্দা, খোলা মুখে ও খোলামাথায় চলাফেরা করছিলো। মদ্যপান ও যিনা-ব্যভিচার ব্যাপক হারে চলছিলো। সাধারণ লোকদের কথা কি বলবো, আমীর-ওমারা, সুলতান-বাদশাহ্গণ, এমনকি জ্ঞানী লোকেরাও আভিজাত্যের গর্ব-অহংকার আর আরাম-আয়েশের শিকার হয়ে গিয়েছিলো।

ধর্মীয় অঞ্চলে মতভেদ ও হানাহানি
ধর্মীয় ও রূহানী অঙ্গনের সূরতে হাল মন্দ থেকে মন্দতর পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলো। ক্বারামিত্বাহ্, বাত্বেনিয়া, শিয়া-রাফেযী ও মু’তাযিলা ফির্ক¡ার ওলামা-ই সূ’ (মন্দ আলিমগণ)-এর ফিৎনাগুলো এবং অগণিত সংখ্যায় মাথাচাড়া দেওয়া বিভিন্ন ফির্ক্বা ইসলামের তদানীন্তনকালীন কেন্দ্রীয় শহর বাগদাদে এক অরাজকতাপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রেখেছিলো, প্রতিদিন অগণিত ওলামা-মাশাইখ, নেতৃস্থানীয় ও ধনাঢ্য মুসলমান ‘বাতেনিয়াহ্’ ফির্ক্বার নানা ষড়যন্ত্র ও খঞ্জর-তরবারির আঘাতের শিকার হচ্ছিলেন। সালজূক্বী শাসনের প্রসিদ্ধ মন্ত্রী (উজির) নিযামুল মুল্ক তূসী এবং পরে ৪৮৫ হিজরীতে সালজূক্বী শাসক মালিক শাহ্ও ওই খোদা তা‘আলার না-ফরমান ইত্যাকারীদের হাতে শাহাদত বরণ করেছিলেন। অন্যদিকে গ্রীক দর্শন পৃথকভাবে ইসলামী আক্বাইদ ও দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে মূল থেকে উপড়ে ফেলে দিতে ও সেগুলোকে অকার্যকর করার মতো অপকর্মে লিপ্ত হয়েছিলো। ইসলামী বহু আলিমও ওইগুলো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পূতঃপবিত্র দ্বীন-ইসলাম থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যেতে লাগলেন। এসব কারণেই মি. গ্যাবন ও অন্যান্য ইউরোপীয় ঐতিহাসিক ওই যুগকে ইসলামী দুনিয়ার এক অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ বলে গণ্য করেছেন।
ইমাম গাযালী আলায়হ্রি রাহমাহ্ ‘তাঁর ইহ্য়াউল উলূম’-এ তাঁর নিজের যুগ সম্পর্কে লিখেছেন-এ যুগের মুসলমানগণ শিয়া-সুন্নী এবং হাম্বলী-আশা‘ইরা পারস্পরিক তর্ক্ব-মুনাযারাহ্য় লিপ্ত হয়ে পড়েন। এটা অনায়াসে পরস্পর গালি-গালাজ, এমনকি খুন-খারাবী পর্যন্ত গড়িয়ে যেতো। মোটকথা, দেশের সামাজিক অবস্থাদি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলো, যার আশঙ্কা খোদ্ আমাদের নবী আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্সালাম করেছিলেন এবং উম্মতকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।

প্রতিকার
মিশরের সর্বশেষ অবস্থা
মিশরের বাত্বেনিয়া সরকারেরও হুযূর গাউসে পাকের যুগে পতন হয়ে শেষ পর্যন্ত ৫৬৭ হিজরীতে অর্থাৎ হুযূর গাউসে পাকের ওফাতের পর পাঁচ বছরের মধ্যে অস্তিত্বের খাতা থেকে ভুল বর্ণের ন্যায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এবং তদস্থলে সুলতান নূর উদ্দীন যঙ্গী এবং তারপর সুলতান সালাহ্ উদ্দীন আইয়ূবী রাজত্বের তখতের উপর আবির্ভূত হয়। তাঁরা কেন্দ্রীয় খিলাফতের সাথে সম্পর্ক কায়েম করে নিজ নিজ রাজ্যকে ইসলামী ঐক্যের রজ্জুতে গেঁথে আব্বাসীয় খলীফার নামে খোৎবা পড়াতে আরম্ভ করলেন। আর আপন আপন সময়ে ইউরোপের সম্মিলিত খ্রিস্টীয় ক্ষমতা (তথাকথিত ক্রুসেড)কে কয়েকটা যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে বায়তুল মুক্বাদ্দাসকে আযাদ করে নেন। ইমাম ইয়াফে‘ঈ ও ইবনে আসীর তাঁদের ইতিহাস-গ্রন্থগুলোতে ওই দ্বীনদার শাসকদের প্রশংসায় অতি বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।
এ যুগগুলোতেই গযনী বংশের ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজত্বের স্থলে ঘুরী বংশের বাদশাহ্গণ এক নতুন ও প্রশস্ততর ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন। এবং তাতে সফলকামও হন। এতে হযরত গাউসুল আ’যমের অতি ঘনিষ্টজন ও প্রিয়পাত্র এবং ফয়যপ্রাপ্ত হযরত খাজা মু‘ঈন উদ্দীন চিশ্তী আজমীরীরও হাত ছিলো। এর পরে তাঁর খলীফাগণ ও শীষ্যগণ এবং মাশাইখে চিশ্ত আহলে বেহেশ্ত, মাশাইখে সুহরুওয়ার্দিয়া, হযরত শায়খ বাহাউদ্দীন যাকারিয়া, শাহ্ সদর উদ্দীন, আবুল ফাতাহ্ শাহ্ রুক্নে আলম মুলতানী, সাইয়্যেদ জালাল উদ্দীন বোখারী আউচী, মাখদূম-ই জাহানিয়া জাহান-গাশ্ত আউচী, জনাব ‘লা’ল-শাহবায ক্বলন্দর সিন্দী প্রমুখ বুযুর্গ এ উপমহাদেশে নিকটে ও দূরে নিজ নিজ বিরামহীন প্রচেষ্টা দ্বারা লোকজনকে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে এনে ধন্য করেছেন।
যেন হুযূর গাউসে আ’যম এবং তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফয়য প্রাপ্তগণের প্রচেষ্টায় না শুধু দ্বীন ইসলাম নতুন জীবন লাভ করেছে, বরং যেমন পূর্বে আরয করা হয়েছে, সেটার রূহানী প্রতিরোধী ক্ষমতা এ পর্যন্ত জাগ্রত ও মজবুত হয়ে গেছে যে, এসব দেশে ইসলাম প্রদীপ নিভে যাবার স্থলে শুধু সমুজ্জ্বলই থাকেনি,বরং শুধু পাঁচশ বছরের অভ্যন্তরে, অর্থাৎ- ৬৮০ হিজরী পর্যন্ত সময়সীমায়, খোদ্ ওই সব লুঠেরা (তাতারীগণ)-কে ইসলামের গণ্ডিতে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সফলকাম হয়েছিলো।
উল্লেখ্য, এ যুদ্ধের জয় ছিনিয়ে আনা কোন রাজকীয় সেনা-বাহিনী কিংবা পার্থিব কোন ক্ষমতা প্রয়োগ করে সম্ভব হয়নি, বরং ওই সৃষ্টির সেরা বাদশাহ্ ও যুগশ্রেষ্ঠ ক্বুত্বব, এ বিশ্বে খোদার প্রতিনিধি, কিতাব (ক্বোরআন)-এ ওয়ারিস,নায়েবে রসুল (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম গাউসে আ’যম দস্তগীরের রূহানী ক্ষমতা প্রয়োগের কারামত বা অলৌকিক ক্ষমতাই ছিলো। এর ফলশ্রুতিতে ইসলামের শত্রুরা ইসলাম গ্রহণ করে, ইসলামের অনন্য খিদমত আনজাম দিয়েছেন।

তাতারী শাহ্যাদা
তাতারীদের ইসলাম গ্রহণের ঘটনাও অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত হয়েছে- তাতারীদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর সিলসিলাহ্-ই আলিয়া কাদেরিয়ার এক খোরাসানী বুযুর্গ অদৃশ্য থেকে আদিষ্ট হয়ে হালাকু খানের পুত্র নাগুদার খানের নিকট পৌঁছেন। তখন তিনি শিকার করে ফিরে আসছিলেন। আর নিজের শাহী মহলের দরজায় এক দরবেশকে দেখে ঠাট্টা-বিদ্রুপের ভঙ্গিতে বলতে লাগলেন, ‘‘হে দরবেশ! তোমার দাড়ির লোমগুলো কি উত্তম, না আমার কুকুরের লেজ?’’ তিনি জবাবে বললেন, ‘‘আমিও আমার মালিকের কুকুর। যদি আমি প্রাণপণ প্রচেষ্টা ও বিশ্বস্ততার সাথে তাঁকে খুশী করতে পারি, তবে আমার দাড়ির লোমগুলো উত্তম, অন্যথায় আপনার কুকুরের লেজ উত্তম, যা আপনার আনুগত্য করে এবং আপনার জন্য শিকার করার মতো সেবা সম্পাদন করে।’’ তাগুদার খানের মনে তাঁর কথাগুলো অতিমাত্রায় রেখাপাত করলো এবং তাঁকে নিজের নিকট অতিথি হিসেবে রেখে তাঁর শিক্ষা ও দীক্ষা এবং ইসলাম প্রচারের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে নেপথ্যে ইসলাম কবুল করে নিলেন; কিন্তু তাও এ ধারণায় প্রকাশ করেন নিজে, তিনিও প্রতিকূল অবস্থাদিকে সামনে রেখে, ধীরে ধীরে সুকৌশলে আপন সম্প্রদায়কে মানবিকভাবে এ নতুন ধর্ম (ইসলাম) কবুল করার জন্য তাদেরকে প্রস্তুত করতে পারবেন।
ওই দরবেশ তো এরপর তাঁর জন্মভূমিতে চলে গেলেন, কিন্তু যেহেতু তাঁর জীবদ্দশার মেয়াদকাল পূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো, সেহেতু তিনি মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে এ ধরাধাম থেকে চলে গেলেন। কিন্তু তাঁর স্থলে তাঁর পুত্র এ হিদায়ত ও দ্বীনী খিদমতে আত্মনিয়োগ করলেন। ফার্সীতে একটি প্রবাদ আছে-
هر چه پدر نتوانست پر تمام نهد (পিতা যা পূর্ণাঙ্গ করতে পারেন না, তা তাঁর পুত্র পূরণ করে)। কিছু দিন পর তাঁর সাহযাদা পিতার স্থলাভিষিক্ত হয়ে তাঁর ওসীয়ৎ মোতাবেক তাগুদার খানের নিকট পৌঁছলেন। তাগুদার তাঁকে বললেন, ‘‘সম্প্রদায়ের প্রায় সব সরদার তো ইসলামের প্রতি ধাবিত হয়ে গেছে, কিন্তু একজন সরদার, যার পেছনে বিরাট একটি দল রয়েছে, ইসলাম গ্রহণে রাযী হচ্ছে না। হযরত তাগুদার খানকে পরামর্শ দিলেন যেন ওই সরদারকে তাঁর দরবারে দাওয়াত দেন। তিনি তা করলেন। সরদারটি আসলে হযরত তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। কিন্তু লোকটি বললো, ‘‘আমি এমন একজন সিপাহী, যার গোটা জীবন যুদ্ধ-বিগ্রহে অতিবাহিত হয়েছে। আমি শুধু ক্ষমতা প্রয়োগে বিশ্বাস করি। যদি আপনি আমার অধিনস্থ পলোয়ানকে কুশতীতে ধরাশায়ী করতে পারেন, তবে আমি মুসলমান হয়ে যাবো।’’ একথা শুনে বুযুর্গ ব্যক্তিটি তাতে রাযী হয়ে গেলেন। কিন্তু তাগুদার খান তাঁকে বারণ করলেন। কিন্তু বুযুর্গ তাতে ক্ষান্ত হলেন না। তিনি উক্ত চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। কুশতীর দিন-তারিখ-সময় ও স্থান ঠিক হলো। জনসাধারণের জমায়েতের জন্য আম ঘোষণা দেওয়া হলো। এদিকে তাগুদার খান বুুযুর্গকে বুঝাতে চাইলেন- আপনার প্রতিপক্ষ একজন তাতারী যুবক, পেশায় পলোয়ান। তার মোকাবেলায় আপনি একজন বয়োপ্রাপ্ত দুর্বল কায়ার দরবেশ। এটাতো একদিকে ইন্সাফের পরিপন্থী, অন্যদিকে স্বেচ্ছায় আত্মত্যার নামান্তর। প্রতিপক্ষ সরদারকেও উক্ত শর্ত তুলে নেয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হলো। কিন্তু সে মানলোনা। সে মনে করলো- এভাবে দরবেশটি হত্যা করতে পারলে ‘এক ঢিলে অনেক পাখীর শিকার হয়ে যাবে- ইসলাম প্রচারের পথ রোধ হবে, কারো এ ধরনের দুঃসাহস দেখানোর পথ বন্ধ হবে, আর খানে আ’যম তাগুদার খানও ভবিষ্যতে এ ধরনের যেনতেন লোকের কথায় কান দেবেন না, ইত্যাদি।
সুতরাং নির্দ্ধারিত তারিখে যথাসময়ে বিশাল জমায়েতে মোকাবেলা হলো। হযরত মঞ্চে যাওয়া মাত্র ওই তাতারী পলোয়ানের মুখে এক চড় (থাপপড়) অতি জোরে মেরে দিলেন। চড়ের আঘাতে তার মাথার খুলি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। ওলীর মারতো! ওদিকে উপস্থিত লোকদের মধ্যে শোরচিৎকারের রোল পড়ে গেলো। সবাই হতভম্ভ হয়ে গেলো- এ কি হলো? তারা কি জানে যে, এ দরবেশ তো কারো পলোয়ানই ছিলেন? ওলীগণতো খোদারই পলোয়ান হন! কবি বলেন-
ترى خاك ميں هے اگر شررتوخيال فقرو غنا نه كر
كه جها ميں نان شعير پر هے مداد قوت حيدرى
অর্থ: তোমার মাটিতে (দেহে) যদি অগ্নি স্ফুলিংগ থাকে, তাহলে দারিদ্র ও ধনাঢ্যতার কল্পনাও করো না! কারণ- এ জগতে যবের রুটির উপর প্রতিষ্ঠিত- হায়দারী ক্ষমতার ভিত্তি।
অতএব, এর প্রভাব এভাবে পড়লো যে, শুধু ওই সর্দার তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ময়দানে বের হয়ে ওই দরবেশের হাতে চুমু খেয়ে ইসলাম গ্রহণের প্রকাশ্যে ঘোষণা দেননি, বরং উপস্থিত বিশাল জমায়েতের বেশীরভাগ লোক ইসলাম গ্রহণ করেছেন। আর তাগুদার খানও নিজের ইসলাম গ্রহণের প্রকাশ্যে ঘোষণা দিলেন এবং নিজের নাম রাখলেন- ‘আহমদ’। ইতিহাসে তার নাম এটা লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। তিনি তাঁর শাসনামলে মিশরের সুলতানদের সাথে তাঁর সম্পর্ককে অধিকতর মজবুত করার চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু তাতারী সামরিক জেনারেলগণ সাধারণত: তাঁর ইসলাম গ্রহণকে পছন্দ করেনি এবং বিদ্রোহ করে বসেছিলো। আহমদ তাদের সাথে মোকাবেলা করেও জয়ী হতে পারেননি, বরং শহীদ হয়ে গেছেন।
ঐতিহাসিকগণ এ হৃদয় বিদারক ঘটনার পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘এটা ইতিহাসের এক আজব ঘটনা! পিতা অর্থাৎ হালাকু খান তো ইসলাম ও আরবের তাহযীব-তামাদ্দুনকে ধ্বংস করেছে, আর তার পুত্র আহমদ (তাগুদার খান) ওই তাহযীব ও ইসলামের হিফাযতের জন্য নিজের প্রাণটুকুও বিসর্জন দিলেন।!’’
যদিও এ ঘটনার পর তাতারীদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের গতি কিছুটা কমে গিয়েছিলো, কিন্তু অন্যদিকে হালাকু খানের এক চাচাতো ভাই বারাকাহ্ (১২৫৬-১২৬৬ খ্রিস্টাব্দ)-ও হযরত শায়খ শামসুদ্দীন বা-খোরীর বরকতময় হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। আবার এদিকে আহমদ অর্থাৎ তাগুদার খানের ভাতিজার পুত্র গাযান মাহমূদ (১২৯৫-১৩০৪ খ্রিস্টাব্দ)-ও ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এ কারণে মধ্য-এশিয়ায় নিছক ‘তাতারী রাজ্য’ ‘তাতারী ইসলামী রাজ্য’-এ পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলো। উল্লেখ্য, এ গাযান মাহমূদের বিরুদ্ধেও তাঁর সামরিক জেনারেলগণ তাঁর ধর্মান্তরের কারণে বিদ্রোহ করেছিলো, কিন্তু তিনি তাদের সকলকে পরাজিত করে বিজয়ী হতে সফল করেছিলা। এর ফলশ্রুতি এলো যে, প্রায় সব তাতারী জনগোষ্ঠী (সম্প্রদায়) ইসলাম করে নিয়েছিলো। কবি বলেন-
هر نبائے كُهنه كآ باداں كنند – اول ا ٓں نبياد را و سراں كنند
অর্থ: এমনও হয় যে, প্রতিটি পুরাতন দালানকে আবাদ তারাই করেছে, যারা ইতোপূর্বো সেগুলোর বুনিয়াদকে ধ্বংস করেছে।
এমন এক সময়ও ছিলো, যখন তাতারী কাফিরদের প্রাথমিক হামলার সময়, সুলতান আলাউদ্দীন মুহাম্মদ খাওয়ারিযম শাহ্, প্রসিদ্ধ অভিমতানুসারে, একথা বলে নিজের ঘোড়াকে ফিরিয়ে এনেছিলেন, ‘‘হে ফেরেশতাগণ ও আল্লাহর ওলীগণের রূহসমূহের, চেঙ্গিজী সেনাবাহিনীর লোকদের মাথার উপর ছাইয়ে ফেলা ছায়া থেকে একথা বলতে দেখা যাচ্ছে- اَيُّهَا الْكَلفَرَةُ اُقْتُلُوْا الْفَجَرَةَ (হে কাফিররা! এসব পাপীকে হত্যা করো) যার ফলশ্রুতিতে লাখো-কোটি মুসলমানের রক্ত প্রবাহিত হয়েছে, আবার একটা সময় এমনও এসেছে যে, একজন দরবেশ একাকীই নিজের হাতের, খোদাপ্রদত্ত শক্তি প্রয়োগ করে অসংখ্য তাতারীকে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে নিয়ে আসে। এ উভয় অবস্থায় আল্লাহ্ তা‘আলার ইচ্ছাই সময় ও অবস্থানুসারে আপন ব্যবস্থাপনায় শান বা তাজাল্লী প্রদর্শন করেছিলো।
আজ একথা জোর দিয়ে বলা যায় যে, যদি গাউসে আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ফুয়ূয ও বরকাতের ফোয়ারা জারী না হতো, তাহলে আজ না মসজিদগুলো থাকতো, না মাদ্রাসাগুলো থাকতো, না ইসলাম থাকতো, না মুসলমান। প্রসঙ্গত একথা অতি দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, এ মহান উপকারীর উপকারকে ভুলে গিয়ে এক শ্রেণীর মুসলমান নামধারী লোক তাঁর বিরুদ্ধে কেমন আশ্চর্যজনক পদ্ধতিতে তাদের ফাতওয়া উচ্চারণ করছে!
আমাদের এ উপমহাদেশের দিকে দেখুন! হুযূর গাউসে পাকের ফয়য ও বরকতপ্রাপ্ত সিলসিলা ও সিলসিলার সম্মানিত মাশাইখ পাক-বাংলা-ভারতে ইসলামের কেমন খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন! সিলসিলাহ্-ই কাদেরিয়ার পাশাপাশি অন্যান্য হক সিলসিলাগুলোও ইসলামের প্রচার-প্রসারে অংশগ্রহণ করেছেন। হযরত মাওলানা আবদুল কাদির ইরবিলী তাঁর প্রসিদ্ধ কিতাব ‘তাফরীহুল খাত্বির ফী মানাক্বিবিশ্ শায়খ আবদুল ক্বাদির’ এর ৪৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-
قَالَ الشّيْخُ نُوْرُ اللهِ حفِيْدُ الفَقِيْه الشّيْخُ الْحَسَنُ الْقُطْعِىُّ فِى اللَّطَالِفِ الْقَادِرِيَّةِ اَنَّ شّيْخَ الْوَاصِلِيْنَ مُعِيْنَ الْحَقَّ والدِّيْنَ طَلَبَ الْعِرَاقَ مِنَ الْغَوْثِ الْاَعْظَمِ فَقَالَ لَه اَلْغَوْثُ اَعْطَيْتُ الْعِرَاقُ شِهَابَ الدِّيْنِ عُمَرَ الشَّهْرُوَرْدِىُّ وَاَعْطَيْتُكَ الْهَنُدَ-
অর্থ: শায়খ নূরুল্লাহ্ ফক্বীহ্ শায়খ হাসান ক্বুতবীর নাতি তাঁর ‘লাত্বাইফুল ক্বাদেরিয়াহ্’য় লিখেছেন- শায়খুল ওয়াসেলীন শায়খ মুঈনুল হক্বক্ব ওয়াদ্দীন (হযরত খাজা গরীব নাওয়ায আলায়হির রাহমাহ্) হুযূর গাউসে আ’যম (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু)-এর নিকট ইরাক চাইলেন। তখন তিনি বলেন, ‘‘এটাতো শিহাব উদ্দীন ওমর সোহ্রুওয়ার্দীকে দিয়ে দিয়েছি। আপনাকে হিন্দুস্তান দিচ্ছি।’’

যিন্দা কারামত
এটা হুযূর গাউসে আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর যিন্দা কারামত ও চাক্ষুষ সাক্ষী যে, বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশে সিলসিলাহ্-ই চিশ্তিয়ার অকল্পনীয় উন্নতি হয়েছে। আর ইরাক ও ইরাকের পার্শ¦বর্তী অঞ্চলেগুলোতে সোহ্রুওয়ার্দিয়া সিলসিলার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। নক্বশবন্দিয়া সিলসিলাহ্ ও হযরত পীরানে পীরের ফয়যপ্রাপ্ত। আর সিলসিলাহ্-ই ক্বাদেরিয়া তো আপাদমস্তক ফয়য। কারণ সেটা স্বয়ং হুযূর শাহানশাহে বাগদাদের-ই প্রবর্তিত। আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা বেরলভী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন-
مجروبر شهر قرى سهل وخزن دشت و چمن
كون سے چك په پهنچتا نهيں دعوى قيرا-
অর্থ: জল, স্থল, গ্রাম, নগর, নরম যমীন, শক্ত পাহাড়, মরূভূমি, বাগান- এমন কোন্ ভূ-খণ্ড রয়েছে, যেখানে আপনার (বেলায়তী) শক্তি প্রয়াগের অধিকার দেওয়া হয়নি? (অর্থাৎ সর্বত্র আল্লাহ্ তা‘আলা আপনাকে বিচরণ ও ক্ষমতা প্রয়োগের অনুমতি বা শক্তি দিয়েছেন। [হাদাইকে বখশিশ] তিনি আরো বলেন-
مزدع چشش وبخارا وعراق واجمير
كون سى كشت ه برسا نهيں جهالا تيرا
অর্থ: চিশত, বোখারা, ইরাক ও আজমীর শরীফ ইত্যাদি যত জায়গা রয়েছে, যেখানে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর নেক বান্দা সৃষ্টি করেছেন, ওই সব জায়গায়ই হে গাউসে আ’যম, আপনার বদান্যতার ফয়য দ্বারা প্লাবিত (ধন্য) হয়েছে।
হুযূর গাউসে পাকের শুভ আবির্ভাবের ফলে বিশ্বের যেসব দেশে মুসলমানদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবার পর তাঁরা দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন, তারা আবার সবল হয়ে উঠেছিলেন। তাছাড়া, বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও ইসলামের ঝাণ্ডা উড্ডীন হয়েছে। এমনকি হুযূর গাউসে আ’যমের কোন কোন সাধারণ গোলামও খ্রিস্টীয় জগতের কবল থেকে ইসলামের বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। এক সাধারণ কাদেরি বান্দা গাযী সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর বীরত্ব ও অবদান ওখানে সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য।

গাউসে আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ও গাযী সালাহ্ উদ্দীন আইয়ূবী রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি
হযরত শায়খ আহমদ রেফা’ঈ তাঁর কিতাবে লিখেছেন, সাইয়্যেদুনা গাউসে আ’যম তাঁর কয়েকজন মুরীদকে সাথে নিয়ে দুসনানী এলাকায় দ্বীন প্রচারের জন্য তাশরীফ নিয়ে গেলেন। ইসলাম প্রচারের পরম্পরায় তাঁর সামনে এক লাট-পাদ্রী পড়লো। সে কিছু দিন বাগদাদ এবং মিশরেও ছিলো, সে মুসলমান আলিমদের নিকট কিছু সংখ্যক হাদীসও শুনেছিলো, সে এবার হুযূর গাউসে পাককে সম্বোধন করে বললো, ‘‘আপনার নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর একটি হাদীস আছে, যাতে তিনি বলেছেন, ‘‘আমার উম্মতের হক্কানী রব্বানী ওলামা (আলিমগণ) বনী ই¯্রাঈলের নবীগণের মত।’’ হুযূর গাউসে পাক বললেন, ‘‘তা তো আছে এ’তে তোমার সন্দেহ কোথায়?’’ পাদ্রী বললো, ‘‘কথা হলো এযে, হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম ও বনী ই¯্রাঈলের নবী ছিলেন। আর খোদা তা‘আলা তাঁকে এ মু‘জিযা দিয়েছেন যে, তিনি পায়ের আঘাতে মৃতকে জীবিত করতেন। এখন এ হাদীসের আলোকে, আপনিও হুযূর-ই আকরামের উম্মতের একজন আলেম। সুতরাং বনী ই¯্রাঈলের পয়গাম্বরের মতো কাজ করে দেখান!’’ হুযূর গাউসে পাক বললেন, ‘‘নিঃসন্দেহে আমাদের নবীর ওলামা-ই রব্বানী, অর্থাৎ আল্লাহর ওলীগণের এ মর্যাদা ও ক্ষমতা রয়েছে।’’ সুতরাং পাদ্রী তাঁকে পার্শ্ববর্তী এক কবরস্থানে নিয়ে গেলো, সে এক অনেক প্রাচীন কবরের দিকে ইঙ্গিত করলো আর বললো, ‘‘আমি এ মৃতকে জীবিতাবস্থায় দেখতে চাই।’’ হুযূর গাউসে পাক ওই কবরের নিকটে গেলেন আর ওই কবরে পদাঘাত করে বললেন, ‘‘হে কবরবাসী! আল্লাহ্র হুকুমে উঠে দাঁড়িয়ে যা! আর এ লোককে বলে দে সে যা শুনতে চায়।’’ তাৎক্ষণিকভাবে ওই কবর খুলে গেলো আর মৃত লোকটি বাইরে এসে দাঁড়িয়ে গেলো। লোকটি উচ্চস্বররে বললো, ‘‘আস্ সালামু আলায়কুম!” আর বললো, ‘‘ক্বিয়ামত কি এসে গেছে?’’ হুযূর গাউসে পাক বললেন, ‘‘ না। এ পাদ্রীর দাবী অনুসারেই এমনটি করা হয়েছে। তাকে বলো, তুমি কোন যুগের লোক!’’
তখন লোকটি বলতে লাগলো, ‘‘আমি হযরত দানিয়াল আলায়হিস্ সালাম-এর যুগের লোক। আমি তাঁরই উম্মত ও অনুসারী ছিলাম।’’ তারপর তিনি লোকটিকে বললেন, ‘‘তুমি পুনরায় কবরে চলে যাও, তোমাকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত ওখানে থাকতে হবে। সে কবরে ফিরে গেলো। আল্লাহ্র নির্দেশে কবর বন্ধ হয়ে গেলো। শাহানশাহে বাগদাদের এ কারামত দেখে ওই পাদ্রী এবং তার সমগ্র কুর্দী সম্প্রদায় ইসলাম গ্রহণ করে নিলো। শুধু তা নয়, তারা পরবর্তীতে ইসলামের জন্য বড় বড় বিজয় নিয়ে আসে। বায়তুল মুক্বাদ্দাসের বিজয়ী সুলতান সালাহ্ উদ্দীন আইয়ূবী ওই কুর্দী সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন। তাঁর পিতা ওই সময় ইসলাম গ্রহণ করে হুযূর গাউসে পাকের হাতে বায়‘আত গ্রহণ করেছিলেন, যিনি পরে সিরিয়ার যঙ্গী সুলতানগণের অতি বড় সামরিক অফিসার হয়েছিলেন। তিনি একবার বাগদাদে হাযির হযে তাঁর দশ বছর বয়সী পুত্র সালাহ্ উদ্দীন আইয়ূবীকে তাঁর বরকতময় দরবারে পেশ করেছিলেন, আর আরয করেছিলেন, ‘‘হযরত! আমার এ সন্তানের মাথায় হাত রেখে দো’আ করুন যেন সে ইসলামের বড় মুজাহিদ হয় এবং বিজয়ী হয়।’’ সুতরাং হুযূর গাউসে আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর (সালাহ্ উদ্দীন আইয়ূবী) মাথায় হাত মুবারক রেখে দো’আ করেছেন। আর সুসংবাদ দিলেন-ইন্শা-আল্লাহ্ এ সন্তান বিশ্ব ইতিহাসের এক প্রসিদ্ধ ব্যক্তি হবে। আল্লাহ্ তা‘আলা তার হাতে খুব বড় বড় ইসলামী বিজয়ী সম্পন্ন করাবেন।’’
সুতরাং বিশ্ব-ইতিহাস দেখেছে- সালাহ্ উদ্দীন আয়ূবী, যিনি সুলতান নূর উদ্দীন যঙ্গীর পর সুলতান নিয়োজিত হয়েছেন, আর তিনি কতবড় ইসলামী বিজয়ী ছিলেন! বায়তুল মুক্বাদ্দাস তাঁরই হাতে বিজিত হয়েছিলো। ইউরোপের বড় বড় খ্রিস্টান বাদশাহ্দের সৈন্য-বাহিনী তাঁর ধর্মীয় যোদ্ধা সুলভ দাপটের সামনে টিকে থাকতে পারেনি। সুলতান সালাহ্ উদ্দীন আয়ূবী ক্রুসেড-যুদ্ধে সমগ্র ইউরোপকে পরাস্ত করেছিলেন। এটা হুযূর গাউসে আ’যমেরই কারামত্ তাঁর দো‘আরই ফসল। জয়ের পর সমগ্র নকশা বদলে গিয়েছিলো। মুসলমান জাতির শির উচুঁ হয়েগিয়েছিলো।
মোটকথা, হুযূর গাউসে আ’যমের ফয়স প্রাপ্ত হয়ে গোটা বিশ্বে কাদেরিয়া, চিশ্তি, নক্বশবন্দিয়া ও মুজাদ্দেদিয়া তরীক্বার পীর-মাশাইখ ও প্রকৃত অনুসারীরা ধর্মীয়, মাসাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনগুলোতে অসাধারণ অবদান রেখে আসছেন। ক্বিয়ামত পর্যন্ত ইন্শা-আল্লাহ্-এর প্রভাব বলবৎ ও অব্যহাত থাকবে। সুতরাং হুযূর শাহানশাহে বাগদাদের উপাধি ‘মুহিউদ্দীন’-এর সার্থকতা। আজ মধ্যাহ্ন সূর্যের চেয়েও সমুজ্জ্বল। তাঁর সিলসিলা ও আদর্শ বিশ্বমাঝে যতই অনুসৃত থাকবে। ততই বিশ্ব সমাজের জন্য উপকারী।