মসলকে সিদ্দীক্বে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু

মসলকে সিদ্দীক্বে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু

মসলকে সিদ্দীক্বে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু- 
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান >

আফযালুন্ নাসি বা’দাল আম্বিয়া (নবীদের পর শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি) হযরত আবূ বকর সিদ্দিক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মসলক বা দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাঁর অনুসৃত পথ ও মত ঈমানদার মুসলমানদের জন্য নির্ভুল অনুকরণীয়। আল্লাহ্র হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- ‘আলায়কুম বিসুন্নাতী ওয়াসুন্নাতিল খোলাফা-ই রাশেদীন’ (তোমরা আমার সুন্নাত ও খোলাফা-ই রাশেদীনের সুন্নাতকে আকঁড়ে ধর)। খোলাফা-ই রাশেদীনের মধ্যেও শ্রেষ্ঠ হলেন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু। নিম্নে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মসলক তথা কয়েকটা বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার প্রয়াস পাচ্ছি।

 

এক. ইসলাম গ্রহণ
হযরত সিদ্দীক্বের ইসলাম গ্রহণের ঘটনায় কতিপয় বিষয় সুস্পষ্ট হয়- নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে ইসলামের পয়গাম পৌঁছালেন, তখন এ পয়গাম শুনে তিনি যা বলেছিলেন তার কাব্যানুবাদ নিম্নরূপ-
كها بو بكر نے سركار آمنّا و صدّقنا
ميرے مالك ميرے مختار آمنّا و صدّقنا

يه كه كر جكত گےপ بوبكر چومے هاتھ حضرت كے
لگے پرবخدمت اسلام كرنے ساتھ حضرت كے

অর্থ:১. হযরত আবূ বকর বললেন, ওহে আমার সরকার (সরদার)! আমরা ঈমান আনলাম, আমরা সত্যায়ন করলাম। ওহে আমার ‘মালিক’, ‘মোখতার’ আমরা ঈমান আনলাম, আমরা আপনাকে সত্য বলে স্বীকার করে নিলাম।
২. একথা বলে হযরত আবূ বকর বিনয়ের সাথে ঝুঁকে গেলেন আর হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর হাত মুবারকে চুমু খেলেন। তারপর হুযূর-ই আকরামের সান্নিধ্যে রয়ে ইসলামের খিদমত করতে লাগলেন।
[সূত্র: তারীখে ইসলাম বযবানে শাহ্নামা: ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৪০] বুঝা গেলো যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ‘মালিক’ ও ‘মোখতার’ (যথাক্রমে মালিক ও ইখতিয়ারপ্রাপ্ত) জানা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্বের মসলক। তাছাড়া, আল্লাহর প্রিয়পাত্রের হাতে চুমু খাওয়া হচ্ছে- ‘সিদ্দীক্বিয়াত’ আর সেটাকে শির্ক, বিদ‘আত জানা ‘মাহরূমিয়াত’ (বঞ্চিত হওয়া)।

প্রেক্ষাপট
হযরত সিদ্দীক্বে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ব্যবসার উদ্দেশ্যে শাম (সিরিয়া) রাজ্যে ছিলেন। সেখানে তিনি স্বপ্নে দেখলেন যে, সূর্য ও চন্দ্র তাঁর কোলে নেমে এসেছে। তিনি ওই দু’টিকে আপন বক্ষের সাথে লাগালেন। যখন ঘুম থেকে জাগ্রত হলেন, তখন তিনি এক খ্রিস্টান ‘রাহিব’ (পাদ্রী)কে তাঁর স্বপ্নের তা’বীর (ব্যাখ্যা) জিজ্ঞাসা করলেন। রাহিব বললেন, ‘‘আপনি কে?’’ তিনি বললেন, ‘‘আমি আবূ বকর, মক্কা মুর্কারামার বাসিন্দা।’’ রাহিব বলেন, ‘‘কোন্ গোত্রের?’’ তিনি বললেন, ‘‘ক্বোরাঈশ গোত্রের।’’ রাহিব বললেন, ‘‘আপনি কি কাজ করেন?’’ তিনি বললেন, ‘‘ব্যবসা করি।’’ রাহিব বললেন, ক্বোরাঈশের ‘বনূ হাশিম’ শাখা থেকে (হযরত মুহাম্মদ-ই আমীন) নবী হয়ে প্রেরিত হবেন, যিনি সাহেবে লাওলাক শেষ যমানার নবী হবেন (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)। আপনি তাঁর ধর্ম গ্রহণ করবেন। তাঁর উজির হবেন। তাঁর পর তার খলীফা হবেন। এটাই হচ্ছে আপনার স্বপ্নের তা’বীর বা ব্যাখ্যা।

এ ঘটনার পর যখন সিদ্দীক্ব-ই আকবর মক্কা মুর্কারামায় ফিরে আসলেন এবং নবী-ই পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁকে ইসলাম গ্রহণের জন্য দাওয়াত দিলেন, তখন সিদ্দীক্ব-ই আকবর আরয করলেন, ‘‘আপনি যদি নবী হন, তবে আপনার মু’জিযা থাকাও জরুরী।’’ নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, ‘‘হে আবূ বকর! তোমার জন্য কি ওই মু’জিযা যথেষ্ট নয়, যা তুমি সিরিয়ায় স্বপ্নে দেখেছিলে এবং রাহিব সেটার ব্যাখ্যা (তা’বীর) করেছিলেন?’’ সিদ্দীক্ব-ই আকবর এটা শুনে আরয করলেন, ‘‘আপনি সত্য বলেছেন।’’ আর কলেমা-ই শাহাদাত পড়ে ইসলাম কবূল করে নিলেন।
[সূত্র: জামেউল মু’জিযাত: পৃষ্ঠা- ৪, নুযহাতুল মাজালিস: ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩০২]

বুঝা গেলো যে, অদৃশ্যের জ্ঞানী নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ‘ইল্মে গায়ব’ (অদৃশ্যের জ্ঞান)-এর উপর হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্বের ‘ই’তিক্বাদ’ (নিশ্চিত বিশ্বাস) ছিলো। আর ‘ইলমে গায়ব’ প্রকাশ করাই তাঁর ঈমান আনার কারণ হয়েছিলো। সুতরাং হুযূর-ই আকরামের ইল্মে গায়ব মু’জিযা এবং তা ঈমান আনার কারণ হওয়া- সিদ্দীক্ব-ই আকবরের ‘মাস্লাক’ তাতে সন্দেহ নেই। পক্ষান্তরে ইলমে গায়বের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া মুনাফিক্বীই।

দুই. আল্লাহ্-রসূল কর্ম ব্যব্যস্থাপক
হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, একবার রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সাদক্বাহ্ করার হুকুম দিয়েছেন। অতঃপর যা কিছু হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্বের নিকট ছিলো সবকিছু নিয়ে তিনি হাযির করে দিলেন। যখন রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য কি রেখে এসেছ?’’ তখন তিনি আরয করলেন, ‘‘আমি আমার পরিবার-পরিজনের জন্য আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলকে রেখে এসেছি।
[সূত্র: মিশকাত্ শরীক: পৃষ্ঠা ৫৫৪] অর্থাৎ- তাদের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার অনুগ্রহ ও সাহায্য আর হুযুর মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাহায্যই যথেষ্ট। [আশি’ ‘আতুল লুমআত: ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৫২] যেমন- ক্বোরআনে পাকেও এরশাদ হয়েছে- ‘‘এবং তাদের জন্য উত্তম হতো যদি তারা সেটার উপর রাজি হতো যা আল্লাহ্ ও রসূল তাদেরকে দিয়েছেন। আর বলতো, ‘‘আমাদের জন্য আল্লাহ্-ই যথেষ্ট। আর আগামীতেও আল্লাহ্ তাঁর অনুগ্রহ থেকে এবং তাঁর রসূল আমাদেরকে দেবেন। [পারা-৪, রুকু’- ১৩] আরো এরশাদ হয়েছে- ‘‘তাদেরকে আল্লাহ্ ও রসূল ধনী করে দিয়েছেন নিজ অনুগ্রহে।’’ [পারা: ১০, রুকু’- ১৬] আর হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে- ‘‘আল্লাহ্ তা‘আলা দান করেন আর আমি বন্টন করি।’’
[বোখারী শরীফ: ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ২৪] বুঝা গেলো যে, ক্বোরআন ও হাদীস এবং আবূ বকর সিদ্দীক্বের মসলক অনুসারে-
১.আল্লাহ্-রসূল স্থায়ী।
২. আল্লাহ্-রসূল যথেষ্ট কর্ম ব্যবস্থাপক।
৩. আল্লাহ্ ও রসূল দান করেন এবং ধনী করে দেন।
৪. আল্লাহ্ রিয্ক্বদাতা এবং রসূল বন্টনকারী ও সাহায্যকারী।
৫. আল্লাহ্র অনুগ্রহে তাঁর মসজিদে নবভী শরীফেও উপস্থিত এবং সিদ্দীক্ব-ই আকবরের পরিবার-পরিজনের নিকটও সদয় উপস্থিত।
আর এসব বিষয়ের ভিত্তিতে সিদ্দীক্ব-ই আকবর আরয করেছেন- পরিবার-পরিজনের জন্য আল্লাহ্ ও রসূল রয়েছে। (জাল্লা-জালালুহু ওয়া সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)।

তিন. সর্বশেষ ওসীয়ত
সাইয়্যেদুনা সিদ্দীক্ব-ই আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর ওফাতের সময় উপস্থিত সাহাবা-ই কেরামকে ওসীয়ত করেছেন, ‘‘আমার ওফাতের পর যখন আমার জানাযার নামায সমাপ্ত করবে, তখন আমাকে নবী-ই আকরামের রওযা শরীফের দরজার সামনে নিয়ে গিয়ে প্রথমে ‘আস্ সালামু আলায়কা ইয়া রসূলাল্লাহ্’ বলবে। তারপর আরয করবে- ‘‘আবূ বকর আপনার দরবারে হাযির হবার অনুমতি চাচ্ছেন।’’ অতঃপর যদি দরজা খুলে যায়, তবে আমাকে রওযা-ই পাকে দাফন করবে। আর দরজা না খুললে জান্নাতুল বক্বী’তে নিয়ে যাবে।’’ (আর সেখানে দাফন করে দেবে।)

সুতরাং যখন হযরত আবূ বকরের ওসীয়ত অনুসারে আমল করা হলো, তখন দরজার তালা খুলে নিচে পড়ে গেলো। এবং দরজা খুলে গেলো। আর আওয়াজ আসলো- প্রিয়জনকে প্রিয়জনের নিকট পৌঁছিয়ে দাও। বন্ধু বন্ধুর জন্য আগ্রহে অপেক্ষামান।
[খাসাইযে কুবরা: ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৮, সীরাতে হালাবিয়া: ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৮৮, তাফসীর-ই কবীর: ২১তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৭, জামালুল আউলিয়া: কৃত- আশরাফী থানভী, পৃষ্ঠা ২৯, তাকরীমুল মু’মিনীন: কৃত- নওয়াব সিদ্দীক্ব হাসান গায়র মুক্বাল্লিদ, পৃষ্ঠা৩৭] বুঝা গেলো যে, সিদ্দীক্ব-ই আকবরের মসলক অনুসারে-
১. ‘আস্সালামু আলায়কা ইয়া রসূলাল্লাহ্’ বলা জায়েয।
২. রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রকৃত হায়াত মুবারকাহ্ সহকারে জীবিত।
৩. তিনি আপন গোলামদের দুরূদ ও সালাম এবং ফরিয়াদ শুনেন।
৪. আল্লাহর অনুগ্রহ ক্রমে তিনি তাদের উদ্দেশ্য পূরণ করেন।
৫. হুযূর-ই আকরামের রওযা-ই পাকে হাযির হওয়া এবং নিজের প্রয়োজনাদি আরয করা- সবই একেবারে ইসলাম সম্মত। এতে শির্ক-বিদ‘আতের লেশমাত্রও নেই। এটাই সিদ্দীক্ব-ই আকবরের ওসীয়ত এবং তাঁর মসলক (অনুসৃত পথও মত)। আর এরই উপর সাহাবা-ই কেরামের ইজমা’ বা ঐকমত ও প্রতিষ্ঠিত। (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম)।

চার. আঙ্গুল-চুম্বন করা
ইমাম আবূ তালেব মক্কী তাঁর ‘ক্বূ-তুল ক্বুলূব’-এ উদ্ধৃত করেছেন- পয়গাম্বর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম একদা মসজিদ শরীফে তাশরীফ আনলেন। হযরত বেলাল (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু) আযান দিলেন। আর হযরত সিদ্দীক্বে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হুযূর আকরামের নাম মুবারক শুনা মাত্র তাঁর উভয় আঙ্গুলে চুমু খেয়ে চোখে লাগালেন। আর বললেন- ‘‘র্ক্বুরাতু ‘আইনী বিকা ইয়া রসূলাল্লাহ্।’’ [আল্ হাদীস] [তাফসীর-ই রূহুল বয়ান: ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২৯, হাশিয়া-ই তাফসীর-ই জালালাঈন: পৃষ্ঠা ৩৫৭, মওদ্বূ-‘আত-ই কবীর: পৃষ্ঠা ৬৪] মোল্লা আলী ক্বারী আলায়হি রাহমাতুল বারী অঙ্গুলী-চুম্বন সংক্রান্ত রেওয়ায়তগুলোর বিপক্ষে সমালোচনাকারীদের জবাবে বলেছেন, ‘‘যখন সিদ্দীক্ব-ই আকবর পর্যন্ত সেটার সনদ (সূত্র) পৌঁছেছে মর্মে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তখন সেটা অনুসারে আমল করার বৈধতার জন্য যথেষ্ট। কেননা, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- ‘আমার সুন্নাত ও খোলাফা-ই রাশেদীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরো।’ [সূত্র: মওদ্বূ-‘আত-ই কবীর: পৃষ্ঠা ৬৪] মোটকথা, হুযূর-ই আকরামের পবিত্র নাম শুনে বৃদ্ধাঙ্গুলীতে চুমু খেয়ে উভয় চোখে লাগানো আর ‘র্ক্বুরাতু ‘আইনী বিকা ইয়া রসূলাল্লাহ্’ বলা সিদ্দীক্ব-ই আকবারের মসলক, আহলে সুন্নাতের মসলক এবং আ’লা হযরত (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম)-এর মসলক।