আ‘লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা : একটি পুণ্যময় জীবন

আ‘লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা : একটি পুণ্যময় জীবন

আ‘লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা : একটি পুণ্যময় জীবন-

মুহাম্মদ নেজাম উদ্দীন >

আ‘লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা ১০ শাওয়াল ১২৭২ হিজরী মুতাবিক ১৪ জুন ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে শনিবার যোহরের সময়, ভারতবর্ষের উত্তরপ্রদেশের প্রসিদ্ধ শহর বেরেলীর জাসূলী মহল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মগত নাম ‘মুহাম্মদ’ আর তারিখি নাম ‘আল্ মুখতার’ [المختار]। যা আবজাদ হিসাবে তাঁর জন্মসাল(১২৭২ হি)কে নির্দেশ করে। তার মহিয়সী মাতা আদর করে তাকে ‘আম্মান মিয়া’ আর সম্মানিত পিতা ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজন ‘আহমদ মিয়া’ নামে ডাকতেন। তাঁর বুযর্গ দাদা মাওলানা রেযা আলী খাঁন তাঁর নাম রাখেন ‘আহমদ রেযা’। আর এ নামেই তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি স্বয়ং নিজের নামের আগে ‘আবদুল মুস্তাফা’ লিখতেন। তিনি তাঁর নাতিয়া কাব্যগ্রন্থের একস্থানে বলেন,
خوف نہ رکھ رضا ذرا تو، تو ہے عبد مصطفی
تیرے لئے امان ہے، تیرے لئے امان ہے
‘খওফ না রাখব রেযা যয়া তূ, তু হ্যায় আবদে মুস্তফা।
তেরে লিয়ে আমান হ্যায়, তেরে লিয়ে আমান হ্যায়।।’
আ‘লা হযরত নিজের জন্মসাল পবিত্র কুরআনের নিন্মোক্ত আয়াত থেকে বের করেন। যেমন:
ﺃُﻭﻟَٰﺌِﻚَ ﻛَﺘَﺐَ ﻓِﻲ ﻗُﻠُﻮﺑِﻬِﻢُ ﺍﻟْﺈِﻳﻤَﺎﻥَ ﻭَﺃَﻳَّﺪَﻫُﻢ ﺑِﺮُﻭﺡٍ ﻣِّﻨْﻪ
“এরা হচ্ছে ওইসব লোক যাদের হৃদয়গুলোতে আল্লাহ ঈমানকে অঙ্কন করে দিয়েছেন এবং নিজের পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা তাদেরকে সাহায্য করেছেন।” সূরা মুজাদালাহ্, আয়াত ২২।
সৌভাগ্যবশতঃ তাঁর জন্মের সময় সূর্যের অবস্থান ছিলো গফর মনযিলে, যা জ্যোতিষবিদের কাছে অত্যন্ত বরকতময়। এ প্রসঙ্গে তিনি স্বয়ং লিখেছেন:
دنیا، مزار، حشر، جہاں ہیں غفور ہیں
ہر منزل اپنےماہ کی منزل غفر کی ہے۔
একদিন জন্মের তারিখ নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে আ‘লা হযরত এরশাদ করেন: “আলহামদু লিল্লাহ! আমার জন্মের তারিখটি ﺃُﻭﻟَٰﺌِﻚَ ﻛَﺘَﺐَ ﻓِﻲ ﻗُﻠُﻮﺑِﻬِﻢُ ﺍﻟْﺈِﻳﻤَﺎﻥَ ﻭَﺃَﻳَّﺪَﻫُﻢ ﺑِﺮُﻭﺡٍ ﻣِّﻨْﻪ এ আয়াত শরীফ থেকে হিসাব করা যায়। এর পূর্বের আয়াত হলো, لَا تَجِدُ قَوۡمًا یُّؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ یُوَآدُّوۡنَ مَنۡ حَآدَّ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ وَ لَوۡ کَانُوۡۤا اٰبَآءَہُمۡ اَوۡ اَبۡنَآءَہُمۡ اَوۡ اِخۡوَانَہُمۡ اَوۡ عَشِیۡرَتَہُمۡ ؕ (“যারা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও পরকালে ঈমান রাখে, আপনি তাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধীদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনকারী রূপে পাবেন না। যদিও তারা তাদের পিতা, সন্তান, ভ্রাতা কিংবা তাদের গোষ্ঠী- জ্ঞাতীও হোক না কেন।”)
এর পরপরই বলেছেন, اُولٰٓئِکَ کَتَبَ فِیۡ قُلُوۡبِہِمُ الۡاِیۡمَانَ Ñ“এরা হচ্ছে ওইসব লোক যাদের হৃদয়গুলোতে আল্লাহ ঈমানকে অঙ্কন করে দিয়েছেন।”
আলহামদু লিল্লাহ। আল্লাহর দুশমনদের প্রতি আমার ঘৃণা ছোটবেলা থেকেই। আল্লাহর ফযলে আমার সন্তানদের এবং সন্তানদের সন্তানদের অন্তরেও আল্লাহর শত্রুদের প্রতি ঘৃণার বীজ বপন করে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর দয়ায় এ প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়ন হয়েছে যে, وَ اَیَّدَہُمۡ بِرُوۡحٍ مِّنۡہُ (এবং নিজের পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা তাদেরকে সাহায্য করেছেন।”) আলহামদু লিল্লাহ ! যদি আমার অন্তরকে দু‘টুকরা করা হয়, তা হলে আল্লাহর কসম একটিতে লেখা থাকবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (لااله الا الله) অপর অংশে লেখা থাকবে ‘মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্’ (محمد رسول الله)। আর মহান আল্লাহর দয়ায় যেকোন বদ মাযহাবের উপর সর্বদা কামিয়াবি ও বিজয় অর্জিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা রূহুল কুদুসের মাধ্যমে সাহায্য করেছেন।
আ‘লা হযরতকে তাঁর যুগের বিজ্ঞজনেরা অনেক লকব (উপাধি) দ্বারা ভুষিত করেছেন। তম্মধ্যে তাঁর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ উপাধি হচ্ছে ‘আ‘লা হযরত’। এ উপাধিতে তার নামকরণের কারণ সম্পর্কে মাওলানা বদরুদ্দীন কাদেরী লিখেছেন: “তাঁর বংশের লোকেরা পৃথক পরিচয় ও পার্থক্য করার জন্য নিজেদের কথাবার্তায় তাকে ‘আ‘লা হযরত’ বলে ডাকতেন। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর জ্ঞানগত যোগ্যতা, তাকওয়া পরহেযগারী ও বিশাল দ্বীনি খিদমতের করণে তাঁর যুগের সকল আলিমকে ছাড়িয়ে যাবার কারণে তাঁর ব্যক্তিত্বের সাথে এ উপাধি এমনভাবে মিশে গেছে যে, আজ শুধু দেশের সাধারণ ও বিশেষজনের কাছে নয় বরং সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে এ উপাধিতে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। আর এটা গ্রহণযোগ্যতার এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, কী আপন, কী পর, সবার কাছে আ‘লা হযরত বলা ছাড়া তার মহান ব্যক্তিত্বের পূর্ণ পরিচয় ফুটে উঠে না।”

শৈশব, বাল্যকাল ও শিক্ষা দীক্ষা
আ‘লা হযরত শৈশব থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ও ধীশক্তির অধিকারী ছিলেন। তিনি অন্যসব শিশু ও বালকদের চেয়ে আশ্চর্যজনকভাবে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম ছিলেন। চার বছর বয়সে দেখে দেখে কুরআন পাঠ সমাপ্ত করেন। ছয় বছর বয়সে রবিউল আওয়াল শরীফ উপলক্ষে আয়োজিত বড় সমাবেশে মিলাদ শরীফের বিষয়ে বক্তব্য প্রদান করেন।
শিক্ষা দীক্ষা, ধর্মীয় ও পার্থিব ঐতিহ্যে আ‘লা হযরতের পারিবারিক অবস্থান ছিল অতি উঁচু পর্যায়ের। ভারতবর্ষের জ্ঞানীগুণীসমাজ এ পরিবারকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখতেন। তাঁর পরিবারবর্গের প্রতিজন সদস্য ধর্মীয় রঙে পুরোপুরিভাবে রঞ্জিত ছিল। ফলে মাত্র ১৩ বছর বয়সে তাঁর পিতার নিকট থেকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্তির পরে তিনি তৎকালীন কতিপয় বিশেষজ্ঞ ও পণ্ডিত ব্যক্তির নিকট জ্ঞান বিজ্ঞানের বিশেষ কয়েকটি বিষয়ে অনানুষ্ঠানিক উচ্চতর পাঠ গ্রহণ করনে।যেমন, মাওলানা আব্দুল আলী রামপূরীর নিকট থেকে ‘শরহে চাগমীনী’ নামক কিতাবের কিছু অধ্যায় পাঠ করেন, আপন পীর মুরশিদ সায়্যিদ শাহ্ আলে রাসূল মারহারাভীর কাছে তাসাওউফ,তরীকত ও আফকার এবং সায়্যিদ আবূল হুসাইন আহমদ নুরীর কাছ থেকে ইলমে জুফর, তাকসীর ও তাসাওউফ ইত্যাদি শিক্ষা অর্জন করেন।
এভাবে তাঁর নিয়মিত ও অনিয়মিত শিক্ষকের সংখ্যা দাঁড়ায় সর্বমোট ছয়জন। তাঁরা হলেন:
১. মক্তবের উস্তাদ মহোদয়
২. মাওলানা মির্জা গোলাম কাদের বেগ
৩. শ্রদ্ধেয় পিতা মাওলানা নকী আলী খান
৪. মাওলানা আবদুল আলী রামপুরী
৫. মাওলানা শাহ্ সায়্যিদ আবুল হুসাইন আহমদ নূরী
৬. মাওলানা শাহ্ সায়্যিদ আলে রসূল মারহারাভী
নিয়মিত ও অনিয়মিত শিক্ষার্জন করা ছাড়াও নিন্মোক্ত ওলামায়ে কিরাম থেকে তিনি হাদীস ও ফিক্হর সনদ লাভ করেন।
১. শায়খ আহমদ যায়নী দাখলান শাফী মক্কী
২. শায়খ আব্দুর রহমান সিরাজ মক্কী
৩. শায়খ হুসাইন বিন সালিহ মক্কী
উপরিউক্ত এ কয়েকজন উস্তাদ ব্যতীত তিনি অন্য কারো শিষ্যত্ব গ্রহণ করেননি। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার অসীম অনুগ্রহ ও রহমতে জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিলো অত্যন্ত নিবিড়। আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিভা ও বুদ্ধিমত্তার ফলে তিনি তাঁর যুগের প্রচলিত ও আবিস্কৃত জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় ৫৫ এর অধিক বিষয়ে শুধূ পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন তা নয় বরং ওই বিষয়সমূহে কিছু না কিছু রচনাবলীও রেখে যান। তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ও পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতি শুধু তাঁর ভক্তরা দিয়েছেন তা‘ নয় বরং তাঁর আদর্শ ও মতবাদের সাথে বৈরীভাব পোষণকারীরাও শেষ পর্যন্ত এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে, ‘মাওলানা আহমদ রেযা খান কলমের সম্রাট’।
শিক্ষা সমাপনী সনদ লাভের পরপরই তাঁর পিতা মহোদয় তাঁকে ফাত্ওয়া প্রদানের দায়িত্বও অর্পণ করেন। আর ওই বয়স থেকেই তিনি ফাতওয়া লেখার কাজ শুরু করে দেন।

বায়আত ও খিলাফত
আ‘লা হযরত এক দ্বীনি ও আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেন। ফলে বংশসূত্রে তিনি সূফীমত ও আত্মশুদ্ধির অনুপ্রেরণা লাভ করেন। তিনি ও তাঁর সম্মানিত পিতা মুফতী নকী আলী খাঁন উভয়ে ১২৯৪ হি/ ১৮৭৭ সালে হযরত আলে রাসূল মারহারভীর দরবারে উপস্থিত হলে তখন যুগের অদ্বিতীয় আরিফ হযরত আলে রাসূল আ’লা হযরতকে লক্ষ করে বললেন, “আসুন, আমি কয়েকদিন হতে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। অতঃপর প্রথমে নকী আলী খান রহমাতুল্লাহি আলায়হিকে, তারপর আলা হযরতকে তিনি বায়আত করান। পীর স্বীয় রূহানী দর্পনে এই পূতপবিত্র নিষ্কলুষ মুরিদের সমোজ্জ্বল কপালে শতাব্দীর মুজাদ্দিদিয়্যাতের আভা অবলোকন করে বায়আতের সাথে সাথে পিতা-পুত্র উভয়কে তরীকতের সকল সিলসিলার রূহানী খিলাফত ও ইজাযত দানে বিভূষিত করেন। শুধু তা নয়, এ খান্দানের পূর্বসূরী বুযর্গগণের নিকট হতে রূহানী  সূত্রে চলে আসা সকল প্রকারের আমাল, আশগাল, আওরাদ ও ওয়াযীফারও অনুমতি দিয়ে দেন। বায়আতের পরপরই পীরের পক্ষ হতে এত রূহানী নিয়ামত পেয়ে ধন্য হতে দেখে উপস্থিত মুরীদগণ আশ্চর্য হয়ে যায়। ওইসময় আলে রাসূলের নাতি যুগের কুতুব সায়্যিদ শাহ্ আবুল হুসাইন আহমদ নূরী সাহস করে জিজ্ঞেস করলেন, হুযূর! ২২ বছরের এ বাচ্চার প্রতি এত দয়া কেন? অথচ আমরা দেখে আসছি আপনার দরবার থেকে খিলাফত ও ইজাযত পেতে অনেক সাধনার প্রয়োজন পড়ে। আপনি যদি কাউকে উপযুক্ত মনে করেন, তাহলে মাত্র দু’একটি সিলসিলার ইজাযত দিয়ে থাকেন। কিন্তু আজ সম্পূর্ণ বিপরীত দেখছি? উত্তরে সায়্যিদ আলে রাসূল মারহারাভী বললেন: “তোমরা আহমদ রেযাকে কী জান।” এটুকু বলে তিনি কেঁদে ফেললেন আর বললেন, “মিয়া! আমি খুব চিন্তিত ছিলাম যে, যদি কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা জিজ্ঞাসা করেন, আলে রাসূল, তুমি আমার জন্য দুনিয়া থেকে কী নিয়ে এসেছ? তখন আমি কি উত্তর দেব। আলহামদুলিল্লাহ্! আজ আমার ওই চিন্তা দূর হয়ে গেল। মহান রবের দরবারে তখন আমি আহমদ রেযাকে দেখাব। মিয়া! আমার কাছে যারা ময়লা অন্তর নিয়ে আসে তাদের মেহনতের প্রয়োজন হয়, ইবাদত ও রিয়াযতের মাধ্যমে প্রথমে আত্মাকে পবিত্র করতে হয়। তাই তাদের খিলাফত অর্জনে সময় লাগে। কিন্তু এরা দু’জন অত্যন্ত পবিত্র ও আলোকিত অন্তর নিয়ে পূর্ণ প্রস্তুতি হয়ে এসেছে, তাঁদের জন্য শুধু ‘নিসবত’ এর প্রয়োজন ছিল।আর বায়আত হওয়ার মাধ্যমে তা অর্জিত হয়ে গেছে।”
আধ্যাত্মিকতার কত মহান আসনে আ’লা হযরত অধিষ্ঠিত ছিলেন তা তাঁর পীর-মুরশিদের উপরিউক্ত উক্তি হতে সহজে প্রতিভাত হয়।

সনদসমূহ ও ইজাযত
আ‘লা হযরত দেশ বিদেশের অনেক সূফীসাধক, মুহাদ্দিস ও ফকীহ্ নিকট থেকে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষ সনদ অর্জন করেছেন। তাসাওউফ তরীকত, হাদীস ও ফিকহসহ তাঁর অর্জিত সকল সনদের বিশদ বিবরণ তিনি তাঁর ‘আল ইজাযাতুল মাতীনাহ্ লি ওলামায়ি বাক্কাতা ওয়াল মাদীনাহ্ (الاجازات المتینة لعلماء بکة والمدینة) পুস্তকে বর্ণনা করেছেন।
তিনি তাঁর পীর মুরশিদ সায়্যিদ আলে রাসূল মারহারাভী থেকে তরীকতের প্রায় ১৩ টিরও বেশী সিলসিলাহর খিলাফত ও ইজাযত (সনদ) লাভ করেন। তম্মধ্যে তিনি কাদিরীয়া তরীকার পীর-মুরশিদগণের ধারাবাহিকতায় ৩৫ তম অধস্তন। এ ছাড়া তিনি তাঁকে ইলমে হাদীসেরও সনদ দান করেন।
আ’লা হযরত ১২৯৫হি. ১৮৭৮খ্রি হজ্বের উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কায় তাশরীফ নিয়ে গেলে তখন হিজাযের বিজ্ঞ আলিম শায়খ সায়্যিদ আহমদ বিন যায়নি দাখলান মক্কী (১২৯৯/১৮৮১) ও মুফতিয়ে হানাফিয়্যাহ্ শায়খ আবদুর রহমান সিরাজ মক্কী (১৩০১ ১৮৮৩) প্রমুখ তাঁকে তাফসীর, হাদীস, ফিকহ ও উসূলে ফিকহ্ ইত্যাদি বিষয়ের সনদ প্রদান করেন। শেষোক্তজনের সনদের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হল এ সনদে বর্ণিত সকল ফকীহ্ হানাফী মতাবলম্বী, যা ৩৫ ব্যক্তি পরম্পরায় প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছেছে। ওই সফরে মক্কার প্রখ্যাত আলিম শায়খ হুসাইন বিন সালিহ্ শাফিঈ মক্কী স্বহস্তে সিহাহ্ সিত্তার সনদ ও কাদিরিয়াহ্ তরীকার ইজাযত প্রদান করেন। এ সনদে আ’লা হযরতের সাথে ইমাম বুখারী পর্যন্ত ১১ স্তরের ব্যবধান।
সুতরাং আ’লা হযরতের ইলমে হাদীস ও ফিকহের সনদ উপরিউক্ত সনদসমূহের ধারাবাহিকতায় নিম্নোক্ত স্বনামধন্য মুহাদ্দিসগণের সাথে সম্পৃক্ত হয়। যেমন:
১. শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (মৃ ১০৫২হি)
২. শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ দেহলভী (মৃ১১৭৬॥১৭৬২খ্রি),
৩.মাওলানা আবদুল আলী লাক্ষ্ম্নৌভী (মৃ১২৩৫॥১৮২০খ্রি)
৪. শায়খ আবিদ আসসিন্ধি (মৃ১২৫৭॥১৮৪১খ্রি)

অধ্যাপনা ও ছাত্রবৃন্দ
আ‘লা হযরত শিক্ষা সমাপ্তির পর পরই অধ্যাপনা, গ্রন্থ রচনা ও ফতোয়া লিখা ও প্রদানের কাজে মনোনিবেশ করেন। তবে প্রথমদিকে অধ্যাপনার কাজে বেশী মনোযোগী ছিলেন। কারণ তখন বেরেলীতে উল্লেযোগ্য কোন দ্বীনি প্রতিষ্ঠান ছিলনা। ফলে ছাত্র ও আলিমদের কেন্দ্রবিন্দু ছিল আ’লা হযরতের মহান সত্তা। যখন তাঁর জ্ঞান ও অধ্যাপনার প্রসিদ্ধি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন দেশ-বিদেশের অনেক শিক্ষার্থী জ্ঞানার্জনের জন্য তাঁর কাছে উপস্থিত হতে থাকে। ওই সময় মাদরাসায়ে আলীয়া রামপুর, দেওবন্দ ও সাহারানপুরের মাদরাসা সারা ভারতে অনেক প্রসিদ্ধ ছিল। কিন্তু ওইসব মাদরাসা ছেড়ে অনেক ছাত্র বেরেলীতে এসে আ‘লা হযরতের দরসে যোগদান করত। একদিন এ প্রকার তিনজন নতুন ছাত্র আ‘লা হযরতের কাছে পড়তে আসলে উপস্থিত ছাত্রদের কেউ তাদেরকে বললো, ইতিপূর্বে কোথায় পড়তেন? তারা বললো, প্রথমে দেওবন্দ পড়তাম, সেখাান থেকে গাঙ্গুহ্ (সাহারানপুর) গেছি, তারপর এখানে এসেছি। সাধারণত কোন মাদরাসা বা উস্তাদের প্রসিদ্ধি শুনলে এ রকম নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানো ছাত্রদের স্বভাব হয়ে থাকে কিন্তু আমার বুঝে আসে না যে, আপনারা দেওবন্দ বা গাঙ্গুহে বেরেলীর প্রশংসা শুনেছেন, যার কারণে আগ্রহী হয়ে এখানে এসেছেন। তারা বললো, আপনি ঠিকই বলেছেন। মাযহাব ও মতের ভিন্নতার কারণে বেশীরভাগ বেরেলীর সমালোচনাই হয়ে থাকে, তবে যত কথাই বলুক শেষ পর্যন্ত এ কথা বলতে শুনেছি যে, তিনি কলমের সম্রাট। যে বিষয়ে কলম ধরেছেন এর বিপরীত লেখার করো সাধ্য নাই। এটা দেওবন্দেও শুনেছি এবং গাঙ্গুহেও শুনেছি। তখনই আমাদের অন্তরে আগ্রহ জন্মেছে যে, সেখানেই গিয়ে ইলম অর্জন উচিত যার প্রশংসার সাক্ষ্য স্বয়ং তার বিরুদ্ধবাদীরা দিয়ে থাকে। (والفضل ماشهدت به الاعداء)
তেমনি সুদূর হিজায মুকাদ্দাস থেকেও জ্ঞানপিপাসুরা আ‘লা হযরতের কাছে ছুটে আসতো। কিন্তু তাদের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়নি। তবে তাদের মধ্যে দু’জন ছাত্রের নাম পাওয়া যায়, যারা বেরেলীতে দ্বীর্ঘদিন অবস্থান করে আ’লা হযরতের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা অর্জন করেন। তাঁরা হচ্ছেন, শায়খ আবদুস সাত্তার শামীর ছেলে সায়্যিদ ইয়াছিন মাদানী এবং সায়্যিদ হুসাইন বিন আল্লামা সায়্যিদ আবদুল কাদির তারাবুলিসী। প্রথমজন সম্পর্কে তিনি বলেন: “মাওলানা সায়্যিদ ইয়াছিন মাদানী (যিনি মাওলানা সায়্যিদ আবদুস সাত্তার শামীর সাহেবজাদা) তাশরীফ এনেছেন, ১৪ মাস গরীবালয়ে অবস্থান করেন এবং ইলমে তাকসীর শিখেছেন। তাঁর জন্য আমি আমার পুস্তক ‘আতায়িবুল ইকসীর ফী ইলমিত তাকসীর'(اطايب الاکسیر فی علم التکسیر ) আরবী ভাষায় ইমলা (শ্রুতিলিখন) করায়। তিনি লিখতেই ইবারত বুঝে যেত।”
অন্যজন সম্পর্কে বলেন: “মাদীনা মুনাওয়ারাহ্ থেকে এক ফাযিল (ছাত্র) সায়্যিদ হুসাইন বিন আল্লামা সায়্যিদ আবদুল কাদির তারাবুলিসী মাদানী এ বিদ্যা (ইলমে জুফর) ও অন্যান্য বিদ্যা অর্জন করার জন্য আমার কাছে আসে এবং অত্যন্ত আগ্রহ দেখায়। যেহেতু বংশগত সাআদাত, সেহেতু আমি তাঁর অনুরোধের সম্মানার্থে তার জন্য ইস্তিখারার মাধ্যমে অনুমতি প্রার্থনা করি, যা এ ইলমের জন্য জরুরী। আমি স্বপ্নে হুযূর নবী করীম সায়্যিদে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নুরানী দর্শনে ধন্য হলাম আর দেখলাম, তিনি নিজের সন্তানকে একটি কিতাব দিচ্ছেন। এ বরকতময় স্বপ্ন থেকে আমি জেনে নিলাম যে, তাঁর জন্য এ ইলমের অনুমতি আছে। তাই এ বিদ্যার কিছু নিয়ম আমি তাকে ইমলা (শ্রুতিলিখন) করায় এবং তা অন্শুীলন (মশক)ও করায়। যখন ওই নিয়মগুলোর মশক শেষ হয় তখন এ সংক্ষিপ্ত পুস্তক ‘মুতাজাল্লিয়ুল উরূস ওয়া মুরাদুন নুফূস'(متجلی العروس ومراد النفوس)লিখা হয়ে যায়। যার রচনাকাল হচ্ছে ১৩২৮ হিজরী।”
এতে বুঝা যায় যে, শিক্ষা সমাপ্তির পর পরই আ‘লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা ছাত্রদেরকে পাঠদানে রত ছিলেন। অতঃপর ফাতওয়া রচনা ও অন্যান্য ইলমী কাজের ব্যস্ততার দরুন তিনি শেষ পর্যন্ত অধ্যাপনার ধারা বজায় রাখতে পারেননি। ফলে ১৩২২/১৯০৪ সালে তাঁর নিজের গড়া দ্বীনি শিক্ষাপ্রষ্ঠিান ‘জামেয়ায়ে মানযারে ইসলাম’ পরিচালনার সব দায়িত্ব আপন বড় ছেলে মাওলানা হামেদ রেযা খাঁনকে দিয়ে দেন।

হজ্ব ও যিয়ারত (প্রথমবার)
১২৯৫ হিজরী মুতাবিক ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে আ‘লা হযরত আপন বুযর্গ পিতার সাথে প্রথমবার হজ্ব ও যিয়ারতের উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কা ও মদিনা শরীফে গমন করেন। তাঁর খোদাপ্রদত্ত জ্ঞান ও মহত্ত্ব, বুদ্ধিমত্তা ও তীক্ষèবোধ এবং আধ্যাত্মিক শক্তির স্ফুরণের কারণে মক্কা ও মদীনাবাসী ওলামাদের নিকট তাঁর পরিচিতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং তিনি সকলের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। যার সুস্পষ্ট প্রমাণ সে সময়কার শাফেঈ মাযহাবের বিশিষ্ট আলেম ও জ্ঞানী শায়খ হুসাইন বিন সালেহ্ এর সাথে আকস্মিক সাক্ষাতের ঘটনা থেকেই পাওয়া যায়। ঘটনাটি হলো এ যে, একদিন আ‘লা হযরত ‘মকামে ইবরাহীম’-এ নামায আদায়ের পর বসে আছেন। এমন সময় ইমাম হুসাইন বিন সালেহ্ পূর্ব পরিচয় ছাড়াই আ’লা হযরতকে তাঁর হাত ধরে মক্কাস্থ আপন বাসভবনে নিয়ে যান। এবং দীর্ঘক্ষণ গভীর দৃষ্টিতে আ’লা হযরতের নুরানী চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকলেন আর বললেন, “নিশ্চয় আমি এ কপালে আল্লাহর নূর দেখতে পাচ্ছি।” অতঃপর তিনি সিহাহ্ সিত্তাহ ও কাদিরীয়া তরীকার সনদ ও ইজাযত স্বহস্তে লিখে তাঁকে প্রদান করলেন। আর বললেন, তোমার নাম ‘যিয়াউদ্দীন আহমদ’। এ সনদের বড় সৌন্দর্য হচ্ছে, তাঁর সাথে ইমাম বুখারী পর্যন্ত ১১ স্তরের ব্যবধান। শায়খ হুসাইন বিন সালিহ্ তাঁর জ্ঞানের গভীরতা উপলব্ধি করে মানাসিকে হজ্বের উপর আরবী পদ্যাকারে তাঁর লিখিত ‘আল জাওহারাতুল মুদিয়্যাহ্’ পুস্তকের উর্দুতে অনুবাদ করতে অনুরোধ করলেন এবং আরো বললেন, “যেহেতু ভারতবর্ষের অধিকাংশ মুসলমান হানাফী আর আমার পুস্তকটি শাফিঈ মতানুযায়ী লিখিত সেহেতু হাশিয়া বা পার্শ্বটিকায় হানাফী মত সুস্পষ্ট করা হোক।” আলা হযরত তার অনুরোধ রক্ষার্থে দু’দিনের মধ্যে ‘আন নায়্যারাতুল ওয়াদিয়্যাহ্ ফী শরহিল জাওহারাতিল মুদিয়্যাহ্’ নামে ওই পুস্তকের অনুবাদ ও শরাহ রচনা করে শায়খের খিদমতে পেশ করেন। এতে তিনি অত্যন্ত খুশী হন এবং তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন।
তিনি ছাড়াও মুফতীয়ে শাফিঈ সায়্যিদ আহমদ যায়নী দাহলান মক্কী (মৃ. ১২৯৯হি./১৮৮১খ্রি.), ও মুফতীয়ে হানাফী শায়খ আবদুর রহমান সিরাজ মক্কী (মৃ. ১২০১হি./১৮৮৩খ্রি.)প্রমুখ মক্কা শরীফের প্রখ্যাত আলেম ও ইমামগণ আ‘লা হযরতকে তাফসীর, হাদীস, ফিকহ্ ও উসূলে ফিকহ্ প্রভৃতিতে সনদ দানে ধন্য করেন।
অনুরূপ তিনি মদীনা শরীফেও সেখানকার আলিম ওলামার স্নেহধন্য হন। বিশেষতঃ মুফতিয়ে শাফিঈ মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ বিন আরব আ’লা হযরতকে তাঁর ঘরে দাওয়াত করেন। খাবার দাবারের সময় জান্নাতুল বকীতে দাফনকৃতদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ এ মাসআলা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। আ‘লা হযরত বললেন, তাদের মধ্যে আমীরুল মুমিনীন হযরত উসমান গনী শ্রেষ্ঠ। আর শায়খ মুহাম্মদ বললেন, ইব্রাহীম বিন রাসূলুল্লাহ্ শ্রেষ্ঠ। উভয়ে স্ব স্ব মতের পক্ষে দলীল পেশ করলেন। শেষে শায়খ বললেন, উভয় মতই বিশুদ্ধ ও ব্যাখার অবকাশ রাখে। আ’লা হযরত বললেন, ولکل وجهة هو مولیها আর ওই সময়ে হেরেমে আসরের আযান দেওয়া শুরু হয়। আযান শেষ হলে আ’লা হযরত বললেন, فاستبقوا الخیرات এতে মজলিস শেষ হয় আর সবাই নামাযের জন্য হেরেম শরীফে রওয়ানা হয়ে যায়। রাতে আ’লা হযরত মসজিদে খায়ফে একাকী অবস্থান করেন আর মাগফিরাতের সুসংবাদ পেয়ে ধন্য হন।

হজ্ব ও যিয়ারত (দ্বিতীয়বার)
অতঃপর ১৩২৩ হিজরী মুতাবিক ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে আ‘লা হযরত দ্বিতীয়বার শুধুমাত্র যিয়ারতের উদ্দেশ্যে হিজায গমন করেন।
মাওলানা যুফর উদ্দীন বলেন, “আ’লা হযরতের ছোটভাই মাওলানা মুহাম্মদ রেযা ও বড় পুত্র হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা হামেদ রেযা এবং হুযূরের স্ত্রী হজ্বের জন্য রওয়ানা হলে তিনি তাদেরকে বিদায় জানানোর জন্য জান্িস স্টেশন পর্যন্ত যান। সেখান থেকে তাঁরা বোম্বাই মেইলে সোজা বোম্বাইর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান। তখনও তাঁর হজ্ব ও যিয়ারতের বাসনা জাগেনি। কারণ, ইতোপূর্বে তিনি ফরয হজ্ব আদায় করেছেন এবং রাসূলের রওযা শরীফ যিয়ারত দ্বারাও ধন্য হয়েছিলেন। হাজিদেরকে এগিয়ে দেওয়ার জন্যই শুধু তার যাওয়া। এরই মধ্যে আ‘লা হযরতের হৃদয়ে তার একটি নাতিয়া গযল স্মরণে আসে, যার প্রথম চরণ হচ্ছে:
گزرے جس راہ سے وہ سید والا ہو کر
رہ گٸی ساری زمیں عنبر سارا ہو کر
ওই দ্বীর্ঘ গযলের একটি পঙক্তি এও ছিল:
واۓ محرومی قسمت کہ میں پھر اب کے برس
رہ گئے ہمرہ زوار مدینہ ہو کر
এ পঙক্তি স্মরণ আসতেই তাঁর অন্তর বিচলিত হয়ে উঠে এবং অন্তরের অবস্থা তাই হলো যা তিনি এ গযলে ব্যক্ত করেছেন:
پھر اٹھا ولولہ یاد مغیلان عرب
پھر کھنچا دامن دل سوۓ بیابان عرب
তখনিই তিনি মনে মনে হজ্ব ও যিয়ারত, বিশেষ করে হুযূর সরওয়ারে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যিয়ারতে যাবার জন্য দৃঢ় ইচ্ছা করে বসেন। কিন্তু মায়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসেননি বলে অগত্য হজ্ব কাফেলাকে জানসি স্টেশনে বিদায় জানিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন। বাড়িতে এসে মায়ের কাছে হজ্বের অনুমতি পেয়ে মনের প্রশান্তি ফিরে পান। অন্যথায় জানসি থেকে ফিরে আসার পর থেকে হুযূরকে বড়ই পেরেশান দেখাচ্ছিল। মায়ের অনুমতির পর কালবিলম্ব না করেই হজ্ব ও যিয়ারতের উদ্দেশ্যে বোম্বের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান। ভাগ্যিস আলা হযরত না পৌছা পর্যন্ত জাহাজ ছাড়েনি। তিনি গিয়ে ওই কাফেলার সাথে মিলিত হন এবং সবাই একই জাহাজে হিজাযের উদ্দেশ্যে রওনা হন। এ বরকতময় সফর খুবই সুন্দর ও কল্যাণের সাথে সুসম্পন্ন হয়। এ সফর সম্পর্কে আ‘লা হযরত লিখেছেন:
کعبہ کا نام تک نہ لیا طیبہ ہی کہا
پوچھا تھا ہم سے جس نے کہ نہضت کدھر کی ہے
যেহেতু আ‘লা হযরতের এ সফর ছিল একমাত্র হুযূর আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র পবিত্র যিয়ারতের উদ্দেশ্যে, সেহেতু তাই হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে মাওলানা যুফর উদ্দীন বিহারী বলেন: “আ’লা হযরত যখন মদীনা শরীফে উপস্থিত হন, তখন তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র দীদার লাভের আশায় দীর্ঘক্ষণ যাবৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র রওযা মুবারকের সামনে সালাত ও সালাম পাঠ করতে থাকেন। কিন্তু প্রথম রাতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র দীদার লাভের সৌভাগ্য না হওয়াতে কিছুটা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তিনি সেখানে বসে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র শানে একটি প্রশংসামূলক গজল লিখলেন, যার প্রথম চরণে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র দীদার লাভের আকাঙ্খা পোষণ করেছিলেন। চরণটি নিম্নরূপ:
وہ سوۓ لالہ زار پھرتے ہیں – ترے دن اے بہار پھرتے ہیں
অর্থাৎ হে (বাহার) বসন্ত আন্দোলিত হও ! এজন্য যে, তোমার বসন্তের উপর বসন্ত আগমণকারী। ওই দেখ, মদীনার তাজেদার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র লালাযার(বাগান)এর দিকে তাশরীফ আনছেন !
কবিতার শেষ চরণে নিজের বিনয় ও অসহায়ত্বের চিত্র তুলে ধরে লিখলেন:
کوئی کیوں پوچھے تیری بات رضا – تجھ سے کتے ہزار پھرتے ہیں
এ গযল আরয করার পর তিনি হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র দীদার লাভের অপেক্ষায় আদবের সাথে বসে রইলেন। হঠাৎ তাঁর ভাগ্য জেগে উঠে, জাগ্রত অবস্থায় স্বচক্ষে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র দীদার লাভের সৌভাগ্য নসীব হয়। [আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে এ মহান সৌভাগ্য দান করুন। আমীন।] এ সফরে হিজাযবাসী ওলাময়ে কিরাম তাঁর প্রতি প্রাণঢালা সম্মান প্রদর্শন করেন। এ সময় ওলামায়ে হিজায তাঁর নিকট প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ এর ‘ইলমে গায়ব’ এবং ‘কাগজী নোট’ সম্পর্কে ফাতওয়া তলব করেন। দীর্ঘ সফর হেতু শরীরের অসুস্থতা এবং প্রয়োজনীয় সহায়ক গ্রন্থাবলী সঙ্গে না থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ্ তাআলা প্রদত্ত নৈসর্গিক শক্তি গুণে সুনিপুন হস্তে মাত্র ৮ ঘন্টার মধ্যে ‘আদদাওলাতূল মক্কীয়াহ্ বিল মা’আদ্দাতিল গায়বিয়াহ্’ এর মত উচ্চংগের আরবী ভাষায় গ্রন্থ রচনা করে উহার জবাব দেন এবং কাগজী নোট সম্পর্কীয় গ্রন্থ ‘কিফলুল ফকীহিল ফাহিম ফী আহ্কামি কিরতাসিত দারাহিম’ রচনা করেন। আরব-ওলামাবৃন্দ এ দু’টি গ্রন্থে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ও ভাষাগত যোগ্যতা দেখে সবাই হতভম্ব হয়ে পড়েন।
অতঃপর তিনি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ এর স্মৃতি বিজড়িত মদীনা মুনাওয়ারাহ্’য় তশরীফ নিয়ে যান। এখানেও মদীনাবাসী ওলামা ও গুণীজনরা তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে নেন এবং নানা উপাধি দ্বারা সম্মান প্রদর্শন করেন। এ প্রসঙ্গে ভারত নিবাসী শায়খ মুহাম্মদ আবদুল হক মুহাজিরে মক্কী (মৃ. ১৩৩৩ হিজরী) তাঁর চোখদেখা বর্ণনা লক্ষ্য করুন। তিনি বর্ণনা করেন- “আমি অনেক বছর ধরে মদীনা মুনাওয়ারাহ্’য় অবস্থান করে আসছি। হিন্দুস্থান থেকে হাজার হাজার জ্ঞানী ব্যক্তি এখানে আসেন। তাঁদের মধ্যে আলিম, বুযর্গ, পরহেযগার সবই আছেন। আমি যা লক্ষ্য করেছি, তাঁরা শহরের (মদীনা শরীফ) অলী গলিতে ইচ্ছা মাফিক ঘুরে বেড়ায় কিন্তু কেউ তাঁদের দিকে ফিরেও তাকায় না; কিন্তু তাঁর (আ’লা হযরত এর) গ্রহণযোগ্যতার এমন আশ্চর্য অবস্থা দেখলাম যে, মদীনাবাসী বড় বড় আলিমগণ তাঁর প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এটা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ; তিনি যাকে চান দান করেন।”
উল্লেখ্য যে, মক্কা ও মদীনার অনেক আলিম-ওলামা তাঁর নিকট থেকে হাদীস,ফিকহ্ ও তরীকতের ‘ইজাযত’ ও ‘খিলাফত’ লাভ করেন। অনেককে লিখিত ও মৌখিক অনুমতি দান করেন। আর সময়ের অভাবে যাদেরকে লিখিত সনদ দিতে পারেননি দেশে ফিরে এসে এখান থেকে লিখিত ইজাযতের সনদ প্রেরণের প্রতিশ্রুতি দেন; আর কথা মত বেরেলী ফেরার পর তাদের জন্য সনদ প্রেরণ করেন। তার ওই সমস্ত সনদ الاجازات المتینة لعلماء بکة والمدینة নামক পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়।
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযার খ্যাতি শুধু উপমহাদেশের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না বরং আরব-আযমের সর্বত্রে তিনি তাঁর যুগেই প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

বিবাহ ও সন্তান সন্ততি
আ‘লা হযরত যখন ১৯ বছরে পরিণত যুবক তখনই ১২৯১ হিজরীর কোন এক শুভ মুহূর্তে তাঁর ফুফা শায়খ আফযল হুসাইনের বড় সাহেবজাদী ‘এরশাদ বেগম’ এর সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁর শ্বশুর শায়খ ফযল হুসাইন রামপুর রাজ্যে ডাক বিভাগে সরকারী উচ্চপদে চাকুরী করতেন। তাঁর এ শাদী মুবারক মুসলমানদের জন্য শরীয়তের উপর আমল করার এক সর্বোত্তম নমুনা ছিল। নিজের ঘর তো নিজের ঘর তিনি কন্যার পরিবারকেও এ ব্যাপারে সর্তক করে দেন যে, বিয়েতে যেন শরীয়ত বিরোধী কোন কাজ না হয়। অধিকন্তু কন্যাপক্ষও বিয়ের সকল গলদ রসম রেওয়াজ সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে নিজেদের ধার্মিকতার পরিচয় দেয় এবং লোকের প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হয়।
আ’লা হযরত তাঁর দাম্পত্যজীবনে দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়ের জনক ছিলেন। ছেলেরা হলেন যথাক্রমে:
১. মাওলানা হামিদ রেযা খান, (যিনি ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন।)
২. মাওলানা মুস্তাফা রেযা খান(যিনি ‘ মুফতীয়ে আযম’ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন)
আর মেয়েরা হলেন যথাক্রমে:
১. মুস্তাফায়ী বেগম ২. কানীয হাসান, ৩. কানীয হুসাইন,
৪. কানীয হাসনাইন ও ৫. মুরতাযা বেগম।

গড়ন-আকৃতি
তিনি ছিলেন হালকা পাতলা এবং দেখতে সুন্দর ও সুশ্রী। পাগড়ি ও অংগার পরিহিত অবস্থায় তাঁকে অনেক সুন্দর দেখাত।

পোশাক-পরিচ্ছদ
তিনি শরীয়তসম্মত পোশাক পরিধান করতেন। সপ্তাহে দুদিন – মঙ্গলবার ও শুক্রবারÑ পোশাক পরিবর্তন করতেন। ওইসব দিনে পারিবারিক কোন অনুষ্ঠান থাকলেও তিনি ওই পোশাক নিয়েই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। তবে হ্যা দু’ঈদের জন্য পোশাক পরিবর্তন করতেন।

কতিপয় সুন্দর অভ্যাস
ক্স    নামাযে ইমামের সাহু (ভুল) হলে সংশোধনের জন্য আল্লাহু আকবর (الله اکبر) এর স্থলে সুবহানাল্লাহ্(سبحان الله) বলতেন।
ক্স    হাদীসগ্রন্থের উপর অন্য পুস্তক রাখতেন না।
ক্স    অন্যের কথা কেটে কথা বলতেন না। পায়ের উপর পা রেখে বসা পছন্দ করতেন না। বসার সময় বড় বালিশ ব্যবহার করতেন না। তবে কোমরে ব্যথা অনুভব করলে তখন বালিশ ব্যবহার করতেন।
ক্স    মিলাদ মাহফিলে দুজানু হয়ে আদবের সাথে বসতেন। ওয়ায বা বক্তব্য প্রদানকালেও দুজানু হয়ে বসতেন। পান বেশী খেতেন কিন্তু মিলাদের মাহফিলে খেতেন না। শেষ বয়সে পান খাওয়া সম্পূর্ণ ছেড়ে দেন। পানের সাথে তামাক পাতা কখনো খান নি।
ক্স    প্রিয় নবীর বরকতময় নাম মুহাম্মদ শব্দটি শুনলে দরূদ শরীফ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবশ্যই বলতেন।
ক্স    ঘুমাবার সময় নিজ দেহকে আরবী মুহাম্মদ(محمد) লিপির আকৃতি ধারণ করে ঘুমাতেন।
ক্স    কখনো উচ্চস্বরে হাসতেন না। হাই আসলে দাঁতগুলোর উপর হাতের আঙ্গুল চেপে নিতেন, যাতে শব্দ না হয়।
ক্স    কিবলার দিকে কখনো থুথু নিক্ষেপ করতেন না এবং পা প্রসারিত করতেন না।
ক্স    পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে গিয়ে আদায় করতেন। সবসময় জমাআত সহকারে নামায আদায় করতেন। নামায আদায়কালে সর্বদা পাগড়ি ও জুব্বা পরে খুব ধীরে ও শান্তভাবে নামায পড়তেন।
ক্স    নিজের চিরুনি ও আয়না পৃথক রাখতেন। মিসওয়াক অবশ্যই ব্যবহার করতেন। মাথায় ফুলেল(پھلیل)পুষ্পগন্ধ তেল ব্যবহার করতেন।
ক্স    খিদমতে খালক বা সৃষ্টির সেবার নিয়্যতে বিনা হাদিয়ায় লোকদেরকে তাবিজ দিতেন।
ক্স    পরিচিত কোন দোকানদার বা ব্যবসায়ী বিনা মূল্যে বা কম মূল্যে দ্রব্য দিতে চাইলে তিনি সবসময় বাজারের পূর্ণ মূল্য দিয়ে সওদা খরিদ করতেন।
ক্স    লোকদের সাথে আন্তরিকতার সাথে নম্র ও ভদ্র ব্যবহার করতেন। যখনই কোন সুন্নী আলেমের সাথে সাক্ষাৎ হতো তখনই খুশীতে উৎফুল্ল হয়ে যেতেন। তাঁর যোগ্য সম্মান করতে কার্পন্য করতেন না।
ক্স    কোন হাজি হজ্ব করে তাঁর সাক্ষাতে আসলে তাকে প্রথমে পবিত্র রওযায় হাযির হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতেন। উত্তরে যদি হ্যা বলতো তবে তখনিই তিনি তার কদমে চুমু খেতেন। আর যদি বলতো ‘ না’, তবে তার দিকে আর চোখ তোলেও তাকাতেন না।
ক্স    কোন প্রার্থী তাঁর নিকট থেকে খালি হাতে ফিরে যেতনা। এলাকার বিধবা ও দরিদ্র লোকের প্রয়োজন পূরণে নিজের উপার্জন থেকে মাসিক এক বিরাট অংক নির্দিষ্ট করে রাখতেন।
ক্স    তাঁর হাত থেকে কেউ কিছু নিতে বাম হাত বাড়ালে তিনি সাথে সাথে হাত গুড়িয়ে নিতেন আর বলতেন, ডান হাতে নাও, বাম হাতে শয়তানই নিয়ে থাকে। এমনকি বিসমিল্লাহ্ শরীফের সংখ্যাও ডান দিক থেকে লিখতেন। অর্থাৎ প্রথমে ৬, তারপর ৮ এবং তারপর ৭ লিখতেন।
ক্স    হাঁটার সময় সর্বদা দৃষ্টি অবনত রেখে খুব ধীরে পা উঠিয়ে হাঁটতেন।
ক্স    বই পুস্তক অধ্যয়ন, ফাতওয়া লিখন এবং কিতাবপত্র রচনা, সংকলন ও সম্পাদনায় বেশীরভাগ সময় ব্যয় করতেন।
ক্স    আগত অতিথি ও জনসাধারণকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় আসর নামাযের পর সাক্ষাৎ দিতেন এবং তাদের অভাব অভিযোগ শুনে সাধ্যমত ব্যবস্থা নিতেন।
ক্স    তাঁর প্রতিটি কাজ ছিলো আল্লাহ্ তাআলার নিরেট সন্তুষ্টি লাভের জন্যই। তিনি না কারো প্রশংসার ধার ধারতেন, না করো সমালোচনার ভয় করতেন। ‘ যে আল্লাহর জন্যই ভালবাসলো, আল্লাহর জন্যই অপছন্দ করলো, আল্লাহর জন্যই দান করলো এবং আল্লাহর জন্যই নিজেকে বিরত রাখলো, নিশ্চয় সে তার ঈমানকে পূর্ণতা দান করলো’ –এ পবিত্র হাদীসের পূর্ণ প্রতিচ্ছবি ছিলেন তিনি।
ইন্তেকাল
আ’লা হযরত তাঁর ইন্তিকালের চার মাস বাইশদিন পূর্বে তাঁর ইন্তিকালের সংবাদ দিয়ে পবিত্র কুরআনের ২৯ পারার সূরা দাহরের ১৫নং আয়াত থেকে তাঁর ইন্তিকালের বছর বের করেন। সে আয়াতটির ইলমে আবজদ অনুসারে সংখ্যা হয় ১৩৪০। আর এটিই হিজরী সাল মোতাবেক ইন্তিকালের সাল। আয়াতটি হল:
ﻭَﻳُﻄَﺎﻑُ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢ ﺑِﺂﻧِﻴَﺔٍ ﻣِّﻦ ﻓِﻀَّﺔٍ ﻭَﺃَﻛْﻮَﺍﺏٍ.
“এবং তাদের সামনে রূপার পাত্রসমূহ ও পানপত্রাদি পরিবেশনের জন্য ঘুরানো ফিরানো হবে ।” (সূরা-আদ দাহর, পারা-২৯, আয়াত-১৫) (সাওয়ানেহে ইমাম আহমদ রেযা, ৩৮৪ পৃষ্ঠা)
২৫ সফর ১৩৪০ হিজরী মোতাবেক ২৮ অক্টোবর ১৯২১ খ্রি রোজ জুমাবার ভারতীয় সময় বেলা ২টা ৩৮ মিনিটে ঠিক জুমার আযানের সময়, ইমাম আহমদ রেযা খান এ নশ্বর জগত ত্যাগ করে মহান আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্য লাভে ধন্য হন। ﺍِﻧَّﺎ ﻟِﻠّٰﻪِ ﻭَﺍِﻧَّﺎ ﺍِﻟَﻴْﻪِ ﺭَﺍﺟِﻌُﻮْﻥ
তাঁর নূরানী মাজার শরীফ বর্তমানে বেরেলী শরীফে অবস্থিত। যা এখনও পর্যন্ত তাঁর ভক্ত অনুরক্তদের যেয়ারতগাহ ও সমাগমে পরিণত হয়ে আছে।

রাসূলের দরবারে মাকবুলিয়াত
২৫ সফর ১৩৪০ হিজরী বায়তুল মুকাদ্দাসে একজন সিরীয় বুযর্গ স্বপ্নে নিজেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র দরবারে উপস্থিত দেখতে পেলেন। তিনি সমস্ত সাহাবায়ে কিরামদেরকেও রাসলূ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র দরবারে উপস্থিত দেখতে পেলেন। মজলিশে কারও কোন সাড়া শব্দ নেই, সকলেই নিরব নিস্তব্ধ ছিল। মনে হল সবাই যেন কারো আগমণের অপেক্ষায় আছেন। সিরীয় বুযর্গ বিনীতভাবে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র দরবারে আরয করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা উৎসর্গিত হোক। আমাকে একটু বলুন: “কার অপেক্ষা করা হচ্ছে?” আল্লাহর নবী, রাসূলে আরবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন: “আমরা আহমদ রেযার জন্য অপেক্ষা করছি।”
সিরীয় বুযর্গ আরজ করলেন: “হুযুর! আহমদ রেযা কে?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করলেন: “তিনি হলেন হিন্দুস্তানের বেরেলীর অধিবাসী।” ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর সে সিরীয় বুযর্গ মাওলানা আহমদ রেযার খোঁজে হিন্দুস্তানের দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। যখন তিনি বেরেলী শরীফ পৌঁছলেন, তখন তিনি জানতে পারলেন, সেদিনই (অর্থাৎ ২৫ সফর, ১৩৪০ হিজরী) এ মহান নবীপ্রেমিক এ পৃথিবী ত্যাগ করে পরপারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন। এটি ছিল ঐ দিন, যেদিন তিনি স্বপ্নে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এরশাদ করতে শুনেছেন: “আমরা আহমদ রেযার অপেক্ষায় আছি।” (সাওয়ানেহে ইমাম আহমদ রেযা, ৩৯১ পৃষ্ঠা)