মাহে মুহাররমুল হারাম’র দশম দিবসকে ‘ইয়াওমে ‘আশূরা’ (يوم عاشوراء) বলা হয়। মানবজাতির ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে এ দিন ও সেটার রাত অতীব তাৎপর্যপূর্ণ, বরকতময় ও মহিমান্বিত। এ দিনকে ‘আশূরাহ্ এ জন্যেই বলা হয় যে, এটি মুর্হারম শরীফের দশম দিন।[ ] কিছু সংখ্যক আলেম বলেন, আল্লাহ্ তা‘আলা এ উম্মতকে যে সকল মহান পুরষ্কার ও সম্মাননা দান করেছেন, তন্মধ্যে এ দশটি সম্মাননাও রয়েছে। যথা:
প্রথম সম্মাননা হচ্ছে- রজব মাস। রজব আল্লাহ্ তা‘আলার মাস। সেটার সকল মাসের উপর এমন মর্যাদা অর্জিত হয়েছে, যেমনি এ উম্মত অন্যান্য উম্মতদের অপেক্ষা সর্বোত্তম।
দ্বিতীয় সম্মাননা হচ্ছে- শা’বান মাস। এ মাস অন্য মাসগুলোর মধ্যে এমন ফযীলতপূর্ণ, যেমনিভাবে রসূল-ই কারীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম অপর নবীগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।
তৃতীয় সম্মাননা হচ্ছে- মাহে রমযানুল মুবারক। এ মাসের মর্যাদা অপর মাসসমূহের মধ্যে এমন, যেমনি আল্লাহ্ তা‘আলা সৃষ্টিকুল অপেক্ষা সর্বশ্রেষ্ঠ।
চতুর্থ সম্মাননা হচ্ছে- শব-ই ক্বদর, যা হাজার মাসের চেয়ে সর্বোত্তম।
পঞ্চম সম্মাননা হচ্ছে- ঈদুল ফিতর, যা রোযাসমূহের প্রতিদান দিবস।
ষষ্ঠ সম্মাননা হচ্ছে- যিল্হজ্জের দশ দিন। এ দিনগুলো আল্লাহ্র যিক্র’র দিন।
সপ্তম সম্মাননা হচ্ছে- আরাফার দিন, এ দিনে রোযা রাখলে দু’বছরের সগীরা গুনাহের কাফ্ফারা হয়।
অষ্টম সম্মাননা হচ্ছে- ক্বোরবানীর দিন, যা হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালামের পবিত্র স্মরণের দিন।
নবম সম্মাননা হচ্ছে- জুমু‘আর দিন, যা সমস্ত দিনের সরদার।
দশম সম্মাননা হচ্ছে- ‘আশূরার দিন এবং সেটার রোযা এক বছরের সগীরা গুনাহের কাফ্ফারা হয়।
এ সকল দিনের একটি বিশেষ ফযীলত ও মর্যাদা হাসিল হয়েছে এবং আল্লাহ্ তা‘আলা এ সম্মাননাগুলো এ উম্মতকে দিয়েছেন, যাতে এ পবিত্র দিবসগুলো উম্মতের পাপরাশির কাফ্ফারা হয়ে যায় এবং উম্মত গুনাহ্ থেকে পবিত্র হয়ে যায়।[ ]
আম্বিয়া-ই কিরাম আলায়হিমুস সালাম’র সম্মাননাসমূহ
কিছু সংখ্যক আলেম বলেন, দশ মুর্হারমকে ‘আশূরা এ কারণে বলা হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা এ দিনে দশজন নবীকে পরম সম্মাননা দান করেছেন।
আল্লাহ্ তা‘আলা এ দিনে হযরত আদম আলায়হিস সালাম’র তাওবা কবূল করেছেন।
এ দিনে হযরত ইদ্রিস আলায়হিস সালামকে সুউচ্চ স্থানে উন্নীত করা হয়েছে।
এ দিনে হযরত নূহ্ আলায়হিস সালামের নৌযান জূদী পর্বতে গিয়ে থেমেছিল।
এ দিনে হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস সালাম শুভ জন্মগ্রহণ করেন। আর এ দিনে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে স্বীয় ‘খলীল’ (ঘনিষ্ঠ বন্ধু) বানিয়েছেন এবং এ দিনে তাঁকে নমরূদ-এর আগুন থেকে রক্ষা করেছিলেন।
এ দিনে আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত দাঊদ আলায়হিস সালাম’র তাওবা কবূল করেছেন এবং হযরত সুলায়মান আলায়হিস সালামকে তাঁর বাদশাহী ফিরিয়ে দিয়েছেন।
এ দিনে আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত আইয়ূব আলায়হিস সালামকে রোগ-ব্যাধি থেকে আরোগ্য দিয়েছিলেন।
এ দিনে হযরত মূসা আলায়হিস সালামকে লোহিত সাগরে রাস্তা তৈরী করে দেয়া হয়েছিল এবং ফির‘আউনকে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল।
এ দিনে হযরত ইয়ূনুস আলায়হিস সালাম মাছের পেট থেকে পরিত্রাণ পেয়েছিলেন।
এ দিনে হযরত ঈসা আলায়হিস সালামকে জীবিত আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়।
এ দিনে আমাদের আক্বা ও মাওলা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র নূর সৃষ্টি করা হয়েছে।[ ] ইয়াওমে ‘আশূরা সম্পর্কে আরো একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে, এ দিনে নবী-ই রহমত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র প্রিয় দৌহিত্র হযরত সায়্যিদুনা ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে ইয়াযীদ বাহিনী কারবালার ময়দানে ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত অবস্থায় সপরিবারে নৃশংসভাবে শহীদ করে দিয়েছিল। এছাড়াও এ দিনে হুযূর সায়্যিদুল কাওনাঈন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজাতুল কোবরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা’র সাথে শাদী মোবারক হয়েছিল। শুধু তা নয়, পৃথিবীর সৃষ্টি এবং ধ্বংসও এ ‘আশূরাতে সংঘটিত হয়েছে এবং হবে।
শব-ই ‘আশূরার ফযীলত
হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, সরকার-ই দো‘আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
وَمَا مِنْ أَحَدٍ أَحْيَا لَيْلَةَ عَاشُوْرَاءِ وَأَصْبَحَ صَائِمًا مَاتَ وَلَمْ يَدْرِ بِالْمَوْتِ.
“যে ব্যক্তি আশূরার রাতে ইবাদত করবে এবং দিনে রোযা রাখবে, তার মৃত্যুর সময় কষ্ট অনুভবই হবে না।”[ ]
হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, নূর-ই মুজাস্সাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:
مَنْ أَحْيَا لَيْلَةَ عَاشُوْرَاءِ أَحْيَاهُ اللهُ تَعَالٰى مَا شَاءَ
“যে ব্যক্তি অঅশূরার রাতকে ইবাদতের মাধ্যমে জীবিত রাখে (অর্থাৎ রাত জাগরণ করে), তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত ইচ্ছা করবেন আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে কল্যাণের সাথে জীবিত রাখবেন।”[ ]
‘আশূরার রাতে নফল নামায
‘আশূরার রাতের বহু সংখ্যক নামাযের বর্ণনা এসেছে,
১. যে ব্যক্তি এ রাতে ৪ রাক্‘আত নামায পড়বে (এভাবে যে,) প্রতি রাক্‘আতে ‘আল্হামদু শরীফ’-এর পর ৫০ বার সূরা ইখলাস (قُلْ هُوَ اللهُ أحَدٌ) পড়বে, তাহলে আল্লাহ্ তা‘আলা তার ইতিপূর্বের ৫০ বছর এবং আগামীর ৫০ বছরের পাপরাশি ক্ষমা করে দেবেন এবং তার জন্য ‘মালা-ই আ’লা’ (উচ্চ সমাবেশ)-এ এক হাজার নূরের মিম্বর/প্রাসাদ তৈরী করবেন। [ ] ২. এ রাতে দু’রাক্‘আত নামায কবর আলোকিত করার জন্য পড়া হয়। এ পদ্ধতিতে যে, প্রতি রাক্‘আতে ‘আল্হামদু শরীফ’-এর পর ৩ বার সূরা ইখলাস (قُلْ هُوَ اللهُ أحَدٌ) পড়বে; যে ব্যক্তি এ রাতে এ নামায পড়বে, আল্লাহ্ তা‘আলা ক্বিয়ামত পর্যন্ত তার কবর আলোকিত রাখবেন। [ ]
‘আশূরার রোযার ফযীলত
হযরত সায়্যিদুনা আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে বর্ণিত,
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَدِمَ الْمَدِينَةِ فَوَجَدَ الْيَهُودَ صِيَامًا يَوْمَ عَاشُورَاءَ فَقَالَ لَهُمْ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَا هَذَا الْيَوْمُ الَّذِي تَصُومُونَهُ؟ فَقَالُوا: هَذَا يَوْمٌ عَظِيمٌ: أَنْجَى اللَّهُ فِيهِ مُوسَى وَقَوْمَهُ وَغَرَّقَ فِرْعَوْنَ وَقَوْمَهُ فَصَامَهُ مُوسَى شُكْرًا فَنَحْنُ نَصُومُهُ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: فَنَحْنُ أَحَقُّ وَأَوْلَى بِمُوسَى مِنْكُمْ فَصَامَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ-
‘রাসূলুল্লাহ্ মদীনা মুনাওয়ারায় তাশরীফ আনলেন। তখন ইহুদীদেরকে আশূরার দিন রোযা রাখতে দেখতে পেলেন। তাদেরকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এটা কেমন দিন, যাতে তোমরা রোযা রাখছো?” তারা বললো, “এটা ওই সম্মানিত দিন, যাতে আল্লাহ্ তা‘আলা মূসা আলায়হিস সালাম এবং তাঁর সম্প্রদায়কে মুক্তি দিয়েছেন এবং ফির‘আউন ও তার সম্প্রদায়কে ডুবিয়ে মেরেছেন। মূসা আলায়হিস সালাম কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে রোযা রেখেছেন। আমরাও রাখছি।” তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমালেন, “আমরা মূসা আলায়হিস সালাম-এর তোমাদের চেয়ে বেশি হক্বদার। সুতরাং এ রোযা রাসূলুল্লাহ্ ও রেখেছেন। আর এ রোযার হুকুমও দিয়েছেন।[ ]
তাঁরই থেকে বর্ণিত,
حِينَ صَامَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّهُ يَوْمٌ يُعَظِّمُهُ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَى. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَئِنْ بَقِيتُ إِلَى قَابِلٍ لأصومن التَّاسِع –
‘যখন রাসূলুল্লাহ্ আশূরার দিনে রোযা রাখলেন এবং এর রোযা পালনের হুকুম দিলেন, তখন সাহাবীগণ আরয করলেন, “হে আল্লাহ্র রাসূল! এটা হচ্ছে ওই দিন, যার প্রতি ইহুদী ও খৃষ্টানগণ সম্মান প্রদর্শন করে।” তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমালেন, “যদি আমি আগামী বছর জীবদ্দশায় থাকি, তবে ৯ মুর্হারামেরও রোযা রাখবো।”[ ]
এটি দশম হিজরীর ঘটনা। পরবর্তী বছর রহমত-ই আলম এ দুনিয়া থেকে পর্দা করেছেন। এ হাদীস শরীফসমূহ থেকে বুঝা যায় যে, যেদিন আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে কোন বান্দার প্রতি কোন নি’মাত দেয়া হয়, সেদিন আল্লাহ্র কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা এবং সেদিনকে স্মরণীয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র সুন্নাত এবং সাহাবা-ই কিরামেরও। এমনকি যদি তাতে কাফেরদের সাথে সাদৃশ্য হওয়ার সম্ভাবনা হয়, তাহলেও ওই কাজকে ত্যাগ করা হবে না, বরং কাফেরদের বিরোধীতার অন্য কোন পদ্ধতি সৃষ্টি করা হবে।
অদৃশ্যের সংবাদদাতা হুযূর এরশাদ করেন:
وَصِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ-
“আর আশূরার দিনের রোযা, আমার আল্লাহ্র বদান্যতার উপর আশা আছে যে, পূর্ববর্তী বছরের কাফ্ফারা করে দেবেন।”[ ]
‘আশূরা ও সাদ্ক্বাহ্
রহমত-ই আলম এরশাদ করেন:
مَنْ وَسَّعَ عَلَى أَهْلِهِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَسَّعَ اللهُ عَلَيْهِ سَائِرَ سَنَتِهِ
“যে ব্যক্তি আশূরার দিনে নিজ পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করার ক্ষেত্রে প্রশস্ততা অবলম্বন করবে ,আল্লাহ্ তা‘আলা তার জন্য সারা বছর রিয্ক্ব-এর মধ্যে প্রশস্ততা দান করবেন।”[ ] ইমাম ইবনে হিব্বান-এর নিকট হাদীস শরীফটি ‘হাসান’ পর্যায়ের, ইমাম বায়হাক্বীও অনুরূপ ‘হাসান’ বলেছেন। এ হাদীসটি দারে ক্বুতনীতে উত্তম সনদ সহকারে হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে ‘মাওকূফ’ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে।[ ] এ হাদীস শরীফ সম্পর্কে হযরত সুফিয়ান ইবনে ‘উয়ায়নাহ্ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন:
فَجَرَيْنَا ذٰلِكَ مُنْذُ خَمْسِيْنَ سَنَةً فَلَمْ نَرَ إِلَّا سَعَةً.
‘আমরা পঞ্চাশ বছর যাবত থেকে এটার পরীক্ষা করছি, অতঃপর প্রশস্ততা-ই দেখেছি।’[ ]
‘আশূরার দিনে করণীয় আমলসমূহ
‘আশূরা একটি সম্মানিত দিন। এ দিনের প্রতিটি নেক আমল বড় সাওয়াব ও প্রতিদান লাভের কারণ হয়। কিছু সংখ্যক নেক আমল নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
(১) ইয়াতীমের মাথায় হাত বুলানো বড় সাওয়াবের কাজ।
সায়্যিদুনা আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাহমাতুল্লিল আলামীন ইরশাদ করেন:
مَنْ مَسَحَ بِيَدِهِ عَلٰى رَأْسِ يَتِيْمٍ يَوْمَ عَاشُوْرَاءَ رَفَعَ اللهُ تَعَالٰى لَهُ بِكُلِّ شَعْرَةٍ عَلٰى رَأْسِهِ دَرَجَةً فِي الْجَنَّةِ.
“যে ব্যক্তি আশূরার দিনে ইয়াতীমের মাথায় হাত বুলাবে, আল্লাহ্ তা‘আলা ইয়াতীমের মাথার প্রতিটি চুলের বিণিময়ে তার জন্য জান্নাতে এক এক স্তর সুউচ্চ করবেন।” [ ]
এমনিতেই ইয়াতীমের সাথে মুহাব্বত, স্নেহ-মমতা প্রদর্শন করা বড় সাওয়াবের বিষয়। চাই ‘আশূরার দিনে হোক কিংবা অন্য কোন দিন। হাদীসে এসেছে,
مَنْ أَحْسَنَ إِلٰى يَتِيْمَةٍ اَوْ يَتِيْمٍ عِنْدَهُ كُنْتُ أَنَا وَ هُوَ فِى الْجَنَّةِ كَهَاتَيْنِ وَ قَرَنَ بَيْنَ اِصْبَعَيْهِ-
“যে ব্যক্তি ইয়াতীম মেয়ে কিংবা ইয়াতীম ছেলের প্রতি তার কাছে থাকা সামর্থ দ্বারা অনুগ্রহ করবে, তাহলে আমি এবং সে জান্নাতে এ দু’আঙ্গুলের ন্যায় একত্র হব এবং তিনি দু’আঙ্গুলকে মিলিত করেন।” [ ]
(২) গোসল করা: ‘আশূরার দিনে গোসল করা রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়।
রাহমাতুল্লিল আলামীন ইরশাদ করেন:
مَنِ اغْتَسَلَ يَوْمَ عَاشُوْرَاءَ لَمْ يَمْرِضْ مَرَضًا إِلَّا مَرْضَ الْمَوْتِ.
“যে ব্যক্তি ‘আশূরার দিনে গোসল করবে, তাহলে মৃত্যু রোগ ব্যতীত অপর কোন রোগে আক্রান্ত হবে না।” [ ]
(৩) তাওবা করা: ‘আশূরার দিনে গুনাহসমূহ ও পাপরাশি থেকে তাওবা করা উচিত। আল্লাহ্ তা‘আলা এ দিনের তাওবা কবূল করেন। সায়্যিদুনা হযরত মূসা আলায়হিস সালাম-এর উপর ওহী নাযিল হয়েছিল এবং তাতে নির্দেশ দেয়া হলো:
مُرْ قَوْمَكَ أَنْ يَتُوْبُوْا إِلَيَّ فِيْ عَشَرِ الْمُحَرَّمِ فَإِذَا كَانَ فِي الْيَوْمِ الْعَاشِرِ فَلْيَخْرُجُوْا إِلَيَّ أَغْفِرُ لَهُمْ.
“তোমার সম্প্রদায়কে নির্দেশ দাও যে, তারা যেন দশ মুর্হারমে (‘আশূরার দিন) আমার দরবারে তাওবা করে এবং যখন দশ মুর্হারম-এর দিন হয়, তাহলে তারা যেন আমার প্রতি বের হয় (তথা তাওবা করে), আমি তাদেরকে ক্ষমা করে দেব।” [ ]
(৪) চোখে সুরমা লাগানো: ‘আশূরার দিনে চোখযুগলে সুরমা লাগালে, চোখের অসুখ থেকে আরোগ্য লাভ হয়।
বিশ্বকুল সরদার ইরশাদ করেন:
مَنِ اكْتَحَلَ بالْإِثْمَدِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ لَمْ يَرْمَدْ أَبَدًا.
“যে ব্যক্তি ‘আশূরার দিনে ‘ইসমদ’ সুরমা চোখযুগলে লাগায়, তাহলে তার কখনো চোখের রোগ হবে না।[ ] হযরত মোল্লা আলী ক্বারী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি স্বীয় ‘আল্ মাওযূ‘আতুল কাবীর’ গ্রন্থে বলেন, ‘আশূরার দিনে চোখযুগলে সুরমা লাগানো খুশি উদ্যাপনের জন্য হওয়া উচিত নয়, কেননা এটা খারেজী লোকদের কাজ তারা এর দ্বারা খুশি প্রকাশ করে। বরং হাদসি শরীফের উপর আমল করার জন্য চোখে সুরমা লাগানো উচিত।
(৫) রোগীর সেবা করা: ‘আশূরার দিনে রোগীর সেবা করা, দেখতে যাওয়া অনেক বড় সাওয়াবের কাজ। মাহবূব-ই কিবরিয়া ইরশাদ করেন:
مَنْ عَاَد مَرِيْضًا يَوْمَ عَاشُوْرَاءَ فَكَأَنَّمَا عَادَ وُلْدَ آدَمَ.
“ যে ব্যক্তি ‘আশূরার দিনে রোগীর সেবায় দেখতে যায়, সে যেন সকল আদম সন্তানের সেবা করলো।” [ ] (৬) শরবত পান করানো: ‘আশূরার দিনে মুসলমানদেরকে বিশেষভাবে গরীব-দুঃখীকে পানি কিংবা দুধ অথবা শরবত পান করানো অত্যন্ত সাওয়াবের আমল। নবী করীম ইরশাদ করেন:
مَنْ سَقٰى شَرْبَةً مِنْ مَاءٍ يَوْمَ عَاشُوْرَاءَ فَكَأَنَّمَا لَمْ يَعْصِ اللهَ طُرْفَةَ عَيْنٍ
“যে ব্যক্তি ‘আশূরার দিনে (লোকদেরকে) পানীয় পান করায়, তাহলে সে যেন সামান্য সময়ের জন্যও আল্লাহ্ তা‘আলার অবাধ্যতা প্রদর্শন করেনি।” [ ]
(৭) ইসালে সাওয়াব ও ফাতিহা:
‘আশূরার দিনে সাহাবা-ই কিরাম এবং আহলে বায়ত বিশেষভাতে ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ও অপর সকল শহীদ-ই কারবালার পবিত্র আত্মাসমূহের প্রতি ইসালে সাওয়াব করা অনেক সাওয়াবের কাজ। এজন্য সাধারণত মুসলমানগণ এ দিনে ক্বোরআনখানি, আয়াত-ই ক্বোরআন ও হাদীস শরীফের আলোকে শাহাদাত-এর ফযীলত, ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শাহাদাতকে স্মরণ করে এবং এ সম্পর্কে আলোচনা শ্রবণ করে। অতঃপর শরবত, খেজুর এবং নানা রকমের খাদ্যবস্তুর উপর ফাতিহা পাঠ করে সেসকল পবিত্র সত্ত্বার প্রতি ইসালে সাওয়াব করে থাকেন। এ সকল কাজ ও বিষয় জায়েয এবং মুস্তাহাব।
‘আশূরার দিনে বর্জনীয় আমলসমূহ
আশূরার দিনে কালো কাপড় পরিধান করা, বক্ষ কুপিয়ে জখম করা, কাপড় ছেঁড়া, চুল উপড়ানো, শোকের মাতম করা, মারপিট করা, ছুরি, চাকু দ্বারা শরীরকে জখম করা, (যেগুলো রাফেযী (শিয়া)’র আচরণ) সম্পূর্ণ হারাম ও গুনাহ। এমন নোংরা কর্মসমূহ থেকে পরিপূর্ণ বিরত থাকা জরুরী। ‘আল্ মাওযূ‘আতুল কাবীর’-এর মধ্যে এমন কর্মসমূহের ব্যাপারে তীব্র শাস্তির বর্ণনা এসেছে,
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাস‘ঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ ইরশাদ করেন:
لَيْسَ مِنَّا مَنْ ضَرَبَ الْخُدُوْدَ وَشَقَّ الْجُيُوبَ وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ
“যে ব্যক্তি (মৃত ব্যক্তির শোকে) নিজের মুখাবয়বে আঘাত করে, জামার গলা ছিঁড়ে ফেলে এবং জাহিলিয়্যাতের ন্যায় হা-হুতাশ করে বিলাপ করে, সে প্রহার করে, আমাদের দলভুক্ত নয়।” [বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত: ১৭২৫]
অপর বর্ণনায় এসেছে,
হযরত আবূ মালিক আশ‘আরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ ইরশাদ করেন:
أَرْبَعٌ فِيْ أُمَّتِيْ مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ لَا يَتْرُكُوْنَهُنَّ: الْفَخْرُ فِي الْأَحْسَابِ وَالطَّعْنُ فِي الْأَنْسَابِ وَالِاسْتِسْقَاءُ بِالنُّجُومِ وَالنِّيَاحَةُ وَقَالَ: النَّائِحَةُ إِذَا لَمْ تَتُبْ قَبْلَ مَوْتِهَا تُقَامُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَعَلَيْهَا سِرْبَالٌ مِنْ قَطِرَان وَدِرْعٌ مِنْ جَرْبٍ.
“আমার উম্মতের মধ্যে মূর্খতার চারটি বিষয় রয়েছে, যেগুলো তারা ছাড়বে না- গোষ্ঠীগত গর্ব-অহংকার, বংশের ক্ষেত্রে তিরষ্কার, তারকারাজি থেকে বৃষ্টি চাওয়া এবং বিলাপ-রোদন। এরশাদ ফরমান, যদি বিলাপকারীনী তার মৃত্যুর পূর্বে তাওবা না করে, তবে সে ক্বিয়ামতে এভাবে দ-ায়মান হবে যে, তার উপর রাঙ্গতার পোষাক ও চর্মরোগের জামা থাকবে।” [মুসলিম, মিশকাত: ১৭২৭]
শায়খ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিস দেহ্লভী ক্বুদ্দিসা র্সিরুহু বলেন, “খবরদার! রাফেযীদের বিদ‘আতসমূহে শামিল হবে না। আহাজারি, হায় হায় বলে মাতম করা, বক্ষ ধারালো অস্ত্র দ্বারা কুপিয়ে জখম করা, দুঃখ-দুশ্চিন্তা বাহ্যিকভাবে প্রকাশ করা (যেমন কালো পোষাক ইত্যাদি)-এর মধ্যে মশগুল হবে না। কেননা এ কর্মকা-গুলো মুসলমানদের আক্বিদাহসমূহ ও আমলগুলোর সাথে কোন সম্পর্ক নেই।” [মা-সাবাতা মিনাস্ সুন্নাহ্, পৃ. ২০]
পরিশেষে, ‘আশূরা ইসলামী শরী‘আতে একটি সম্মানিত, বরকতময় ও ঐতিহাসিক দিবস হিসেবে পরিচিত। এ দিনে ইবাদত-বন্দেগী, সাদ্ক্বাহ্-খায়রাত ও নেক-আমলের পরিমাণ বৃদ্ধি করা উচিত। আর সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে, রাফেযী, শিয়া, খারেজীদের ভ্রান্ত আক্বীদা ও আমল পরিহার করতে হবে। আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদেরকে এ পবিত্র দিনের মর্যাদা ও পবিত্রতা রক্ষা করার তাওফীক্ব দান করুন। আমীন। বিহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালীন।
টিকা:
মোল্লা আলী ক্বারী, মিরক্বাত শরহে মিশকাত, পৃ. ২৮৬
গুনিয়াতুত্ ত্বালেবীন, (الغنية لطالبي طريق الحق عز وجل) আরবী, খ–২, পৃ. ৮৭, মুদ্রণ: বৈরূত
গুনিয়াতুত্ ত্বালেবীন খ–২, পৃ. ৯১,
প্রাগুক্ত, খ–২, পৃ. ৮৯
প্রাগুক্ত
মা সাবাতা মিনাস সুন্নাহ্, পৃ. ১৬, গুনিয়া, খ–২, পৃ. ৮৭,
জাওয়াহির-ই গায়বী, ফাযাইলুল্ আইয়াম ওয়াশ শুহুর, (উর্দূ), পৃ. ২৬৯
মুসলিম, আস্ সহীহ্, كِتَاب الصِّيَامِ بَابُ صَوْمِ يَوْمِ عَاشُورَاءَ খ– ২, পৃ. ৭৯৬, হা/ ১১৩০; মিশকাত শরীফ, হা/ ২০৬৭
মুসলিম, প্রাগুক্ত, হা/১১৩৪; মিশকাত শরীফ, প্রাগুক্ত, হা/২০৪১
মুসলিম, আস্ সহীহ্, كِتَاب الصِّيَامِ بَابُ اسْتِحْبَابِ صِيَامِ ثَلَاثَةِ أَيَّامٍ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ খ– ২, পৃ. ৮১৮, হা/ ১১৬২; মিশকাত শরীফ, হা/ ২০৪৪
ফাযাইলুল্ আওক্বাত লিত্ ত্বাবরানী; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, খ– ৫, পৃ. ৩৩৩, হা. নং- ৩৫১৪, মা-সাবাতা মিনাস্ সুন্নাহ্, পৃ. ২৩
মা-সাবাতা মিনাস্ সুন্নাহ্, পৃ. ২৩
গুনিয়াতুত্ ত্বালেবীন,খ–২, পৃ. ৮৯,
প্রাগুক্ত, খ–২, পৃ. ৮৭
আহমদ, তিরমিযী, মিশকাত শরীফ, পৃ. ৪২৩
গুনিয়াতুত্ ত্বালেবীন খ–২, পৃ. ৮৮
ফায়যুল ক্বাদীর শরহে জামিউস সগীর, খ–৩, পৃ. ৩৪
বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হাদীস: ৩৫১৭
গুনিয়াতুত্ ত্বালেবীন খ–২, পৃ. ৮৮
প্রাগুক্ত
পরিচালক: আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।