আওলাদে রসূল, আল্লামা সৈয়দ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি (রহ.)’র প্রশংসা আল্লামা শেরে বাংলার (রহ.) দিওয়ানে আযীযে

আওলাদে রসূল, আল্লামা সৈয়দ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি (রহ.)’র প্রশংসা আল্লামা শেরে বাংলার (রহ.) দিওয়ানে আযীযে

মাশওয়ানী বংশধারার উজ্জ্বল জ্যোতি 
 সৈয়দ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি (রহ.)’র সম্মানে পঙক্তিমালা 

আল্লামা শেরে বাংলার (রহ.) দিওয়ানে আযীযে

কাব্যানুবাদ : শাহ্জাহান মোহাম্মদ ইসমাঈল

গাযীয়ে মিল্লাত ইমামে আহলে সুন্নাত শেরে বাংলা হযরত আযীযুল হক আল কাদেরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর সুলিখিত কাব্য গ্রন্থ “দিওয়ানে আযীয” এ প্রায় দুই শত আউলিয়ায়ে কিরামের কথা উল্লেখ করেছেন। সুললিত ফারসী ভাষায় লিখিত এ কাব্য গ্রন্থের ১৪৫-১৪৭ পৃষ্ঠায় আমাদের পরম সম্মানিত দাদা হুযুর কিবলা পীরে মুকাম্মেল হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি আল কাদেরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির সম্মানে একটা মানকাবাত উৎসর্গ করেছেন। সুধী পাঠক-পাঠিকাদের খেদমতে সেই ফারসী কবিতাটির বাংলা অনুবাদ পেশ করছি।
১. মারহাবা ছদ! মারহাবা ছদ! মারহাবা ছদ মারহাবা!
আযবরায়ে ফখরে মা শাহ্ সৈয়্যদ আহমদ মারহাবা।
শত স্বাগতম! শত ধন্যবাদ শত অভিনন্দন।
আমাদের গর্ব হযরত সাইয়্যেদ আহমেদ শাহ্কে স্বাগতম।
২. মুক্তাদায়ে আলেমা ও পেশওয়ায়ে সালেকা
দর জমানাশ মান না বীনম মিছলে উঁ পীরে মগাঁ
আলেমগণের আদর্শ পুরুষ তরিকত পন্থীদের শিরোমণি
সমকালে তাঁর মত কামিল পীর আমি আর দেখিনি।
৩. মসকনসরা গর তুযুয়ী দর হাযারা জিলাদাঁ
রওজায়ে পুরনূর উরা হাম বেদানী আন্দার আ।
বাসস্থান তাঁর জেনে রেখো অবস্থিত হাযারা জিলায়
তাঁর নুরানী মাযার শরীফও জেনে নাও রয়েছে সেথায়।
৪. আয বরায়ে আহলে সুন্নত মাদরাসাহ করদা বেনা
বাহরে ইসতি ছালে ওহাবী গসতে তীরে বেখতা।
সুন্নী মুসলমানদের তরে তিনি করেছেন প্রতিষ্ঠা মাদ্রাসা
অব্যর্থ তীর হয়েছে সে এক ওহাবী নিধনের তরে সেটা।
৫. মৌজায়ে নাজির পাড়া আন্দরাঁ ষোলা শহর
নামে পাকশ দর জাহাঁ রওশন বমানদ চুঁ বদর
নাজির পাড়া মৌজার ষোল শহরে তার অবস্থান
পূর্ণিমার মত উজ্জল রবে তাঁর নাম যত দিন আছে আসমান।
৬. জামেয়ায়ে আহমদিয়া সুন্নীয়া নামশ বেদাঁ
আয় খোদা! তু জিন্দা দারশ তা বকায়ে আসমাঁ।
জেনে রেখো ঐ মাদ্রাসার নাম জামেয়া আহমদিয়া সুন্নীয়া
হে খোদা! স্থায়ী হোক সে মাদ্রাসা, যত দিন আছে এ দুনিয়া।
৭. আফরি ছদ। আফরি ছদ। আফরি ছদ আফরি।
বাহরে আ পীরে মগাঁ বর হিম্মতস ছদ আফরি!
শত সাবাস। শত সাবাস। শত সাবাস।
তাঁর এমনি সৎ সাহসের জন্য, ঐ পীরে কামেলকে শত সাবাস।
৮. ছদ হাযারা চাটগাঁমী আজ মুরীদানস বেদাঁ
আয বরায়ে মুরশীদে আ হক ই হামা আছারা দা।
আরও জেনে রেখো তাঁর শত হাজার মুরিদ রয়েছে চট্টগ্রামে
মুরশীদে বরহকের এসবই হল উজ্জ্বল নিদর্শন।
৯. রুকনে আযম বুঁদে বাহরে আহলে সুন্নত বেগুমাঁ
ছম্মে কাতিল বুঁদে লেকিন আজ ওয়াবায়ে ওহাবীয়া
আহলে সুন্নতের জন্য তিনি এক মহা স্তম্ভ নিঃসন্দেহে
একই সাথে প্রাণাঘাতী বিষ তিনি ওহাবীদের তরে।
১০. তুরবতশরা বাগে জান্নাত, সায আয় রাব্বে জাহাঁ
ইসতাযিব এয়া রাব্ব! তুফায়েলে সরওয়া পয়গম্বরা।।
ওগো মহান রব্ব! তাঁর মাযারকে বানাও বেহেস্তী ফুল বাগিচায় এ দোয়া মোর কবুল কর, নবীকুল সর্দারের ওসীলায়।
১১. নামে নাযেম গরতু খাহি শেরে বাঙ্গালা বেদাঁ
মুনকিরানে সুন্নীয়ারা সাইফে বোররা বেগুমাঁ।।
এ কবিতার রচয়িতার নাম জানতে চাও? নামটি তাঁর ‘শেরে বাংলা’
সুন্নীয়তের অস্বীকারকারীদের তরে, তরবারি এক খাপ খোলা।
[মাসিক তরজুমান-১৪৩৮ হিজরির যিলক্বদ সংখ্যা]
===০===
মাশওয়ানী বংশধারার উজ্জ্বল জ্যোতি 
আওলাদে রসূল, আল্লামা সৈয়দ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি (রহ.)

চির তরুণ হোসাইনী শোণিত ধারা চিরদিনই বিপ্লবী ও জালিম শাহীর তখতে তাউস উৎপাটনকারী। বিংশ শতকের মহান দার্শনিক, ইসলামী রেনেসাঁর স্বপ্নদ্রষ্টা, সূফী কবি ড. আল্লামা ইকবাল  ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর পবিত্র রক্তের এ স্বভাবজাত চিরন্তন গুণাবলীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় গেয়ে উঠেন,
“হাম ভুল নেহি সেকতে সা-দাত কি কুরবানী;
দরবারে ইয়াজিদি মে উয়হ বাত ছুনাতে হ্যাঁয়।”
অনুবাদঃ আমরা কভু ভুলতে নারি, নবী বংশের কুরবানী,
ইয়াজিদের দরবারে তাঁরা নির্ভয়ে শোনান সত্য বাণী।

সত্য ও ন্যায়ের প্রতি নিবিষ্টচিত্ত থেকে জীবন উৎসর্গকারী চির গৌরবময় মহান হোসাইনী বংশ ধারার একটা শাখা “মাশওয়ানী বংশ” নামে ইতিহাসে পরিচিতি পেয়েছে। এটা আসলে ফাতেমী সৈয়্যদ বংশেরই বহমান একটা পবিত্র ধারা। নূর নবীজীর প্রিয়তমা কন্যা সৈয়্যদা ফাতিমাতুয যাহ্রা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহার মাধ্যমে বিকশিত নবী বংশের অন্যতম মূলধারা হিসেবে এটাকে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কারণ বংশলতিকা বিশ্লেষণে এঁদের রক্ত সম্পর্কের সূত্রটি হযরত ইমাম জয়নুল আবেদিন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মাধ্যমে হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র সাথে মিলিত হয়েছে। মাশওয়ানী সৈয়্যদ বংশীয়গণ প্রধানত পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বসবাসকারী এক বিরাট জনগোষ্ঠী। মাশওয়ানী সৈয়্যদদের মাতৃভাষা পশ্তু। পশতুভাষী বলে অনেকে এঁদেরকে পশতুনও বলে থাকেন বস্তুত মাশওয়ানীদের পূর্ব পুরুষগণ সুদূর ইরাকের আউস নগরী থেকে হিজরত করে এসেছিলেন বলে জানা যায়। পারস্য ও আফগানিস্তান হয়ে অবশেষে তাঁরা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিভিন্ন অংশে বসবাস করতে থাকেন। মাশওয়ানী সৈয়্যদ বংশীয়দের বেশ কয়টা উপ-গোত্রও রয়েছে। এগুলোকে ‘খিল’ বলা হয়ে থাকে। যেমন শাহানশাহ্ এ সিরিকোট -এর ২৮ তম পূর্বপূরুষ হযরত সৈয়্যদ হোসাইন শাহ্  থেকে উৎসারিত মাশওয়ানী সৈয়্যদদের শাখাটির নাম “হোসাইন খিল”। এছাড়া অন্য মাশওয়ানীদের উপ-গোত্র বা খিল গুলোর মধ্যে বাজি খিল, লোদিন, মাটকানি, রোঘানী, কাযীয়ুনি, গরীব, ইউসুফ খিল, মুসা খিল, আদম খিল, সাখার, হাসান খিল (সিন্ধু), আযাদ খিল, গানজিয়া, মারজান খিল, ভাতাল, আমানি খিল, জানি খিল, রাহাতি, সেন খিল, দোয়ারা খিল, মিয়া খিল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
মাশওয়ানী পশতু শব্দ। এর অর্থ দাওয়াত বা নিমন্ত্রণ। মাশওয়ানীদের পূর্বপুরুষ হযরত সৈয়্যদ আহমদ গেসূদারাজ  আফগানিস্তানে এসে স্থানীয় কাকড়ী সর্দারের এক সুশীলা কন্যাকে বিবাহ করেন। তাঁর নববধূ সন্তান সম্ভবা আর হযরত সৈয়্যদ আহমদ গেসূদারাজ  একটা বহু প্রতিক্ষিত দাওয়াতের প্রত্যাশায় অপেক্ষারত। এমনি মধুর ক্ষণে তাঁর স্ত্রীর গর্ভে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। আনন্দ লহরীতে ভাসমান দম্পতি সদ্য জন্ম নেয়া পুত্ররতেœর আদুরে নাম রাখেন ‘হযরত সৈয়্যদ মাসুদ আহমদ মাশওয়ানী’। হযরত সৈয়্যদ আহমদ গেসূদারাজ -এর মাথায় লম্বা গেসূ বা ‘বাবরি চুল’ ছিল বিধায় তাঁকে সবাই গেসূদারাজ নামেই চিনতো। তিনি একাদশ শতকে জীবিত ছিলেন। আনুমানিক ৪২১ হিজরি/১০৩১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ওফাত হয়। সে হিসেবে তিনি বড় পীর গাউসুল আযম হযরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানী  (জন্ম -৪৭১ হিজরি/১০৭৭ খৃ.) এর পূর্বসূরি এক বিশিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। একজন বিশিষ্ট সূফী সাধক ও পশতুন কবি হিসেবে ভারত বর্ষে তাঁর সুখ্যাতি রয়েছে। ইতিহাসে অনুরূপ আরও দু’জন গেসূ দরাজ-এর নাম পাওয়া যায়। যেমন- ১. সৈয়্যদ মুহাম্মদ গেসূদারাজ  ষোড়শ শতকের বিখ্যাত মরমী সাধক ও কবি, ২. সৈয়্যদ আহমদ গেসূদারাজ  চতুর্দশ শতকের বিশিষ্ট সূফী সাধক ও বীর মুজাহিদ; তিনি সিলেট বিজয়ী হযরত শাহ্ জালাল -এর সঙ্গী ছিলেন। এক কাফির জমিদারের বিরুদ্ধে জিহাদে শহীদ হন। তিতাস নদী দিয়ে তাঁর ভাসমান রক্তাক্ত মস্তক থেকে পবিত্র কলেমায়ে তৈয়্যবা উচ্চারিত হতে দেখে একদল জেলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং তাঁর রক্তাক্ত ছিন্ন মস্তক কবরস্থ করেন। আজও আখাউড়ার খড়ম পুরে তাঁর মাযার রয়েছে। তাঁর দেহের বাকি অংশ হবিগঞ্জে সমাহিত করা হয়েছে বলে জানা যায়।) চেনার সুবিধার্থে প্রথমোক্ত জন হযরত সৈয়্যদ আহমদ গেসূদারাজ  কে গিছুদারাজ আউয়ালও বলা হয়ে থাকে।)
মাশওয়ানীদের গৌরবময় অতীত ইতিহাস
মাশওয়ানী সৈয়্যদদের রয়েছে গৌরবময় অতীত ইতিহাস। এরা সাহসী, পরিশ্রমী, স্বাধীনচেতা ও ধর্মভীরু প্রকৃতির। প্রবল প্রতাপশালী মোগল সম্রাটেরা এদের নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘উত্তর পশ্চিম সীমান্ত নীতি’ নামে একটা বিশেষ বিভাগও চালু করেছিল। বেনিয়া ব্রিটিশরাও এদের দমনের জন্য এখানে একটা সুশিক্ষিত ঘোড়সওয়ার বাহিনী নিয়োগ করেছিল। অত্যাচারী শিখ ও দুর্দান্ত প্রতাপশালী ব্রিটিশ এ অগ্রাভিযানের বিরুদ্ধে অন্যান্য পশতুন গোত্রগুলোর সাথে মিলে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। শিখদের সাথে বীরদর্পে যুদ্ধ করে শহীদ হওয়া সলীম শাহ মাশওয়ানী আজো পশতুন জাতীয় বীরের মর্যাদায় অভিষিক্ত। এ অঞ্চলের বিখ্যাত ও প্রাচীন সূফী কবি হলেন হযরত সৈয়্যদ আহমদ গেসূদারাজ । যিনি মাশওয়ানী সৈয়্যদদের পূর্ব পুরুষরূপে বিবেচিত। এছাড়া বিখ্যাত পশতু কবি খোশহাল খান খটক ফার্সী ভাষায় কাব্য রচনা করে যশস্বী হয়েছেন।
উপজীবিকা
পশতুনভাষী মাশওয়ানীদের শারীরিক গঠন মজবুত ও পেশীশক্তিতে সমৃদ্ধ হওয়ায় এরা খুবই সাহসী ও পরিশ্রমী। দুনিয়ার যে কোন উন্নত জাতির সাথে প্রতিযোগিতার সামর্থ্য রাখেন পশতুন জনগণ। সামরিক বাহিনীতে এরা শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা হিসেবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে গৌরব অর্জন করে আসছেন। বর্তমানে সেদেশের পুলিশ ও প্রতিরক্ষা বাহিনী ও সেনাবাহিনীতে এরা বিশেষ সম্পদ হিসেবে তারা পরিচিত। কৃষিকাজ ও পশুপালন পাহাড়ি পশতুনদের অনেকের প্রধান পেশা। শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক প্রসার ও উন্নত যোগাযোগ সুবিধার ফলে আজকাল অনেকেই ব্যবসা বাণিজ্য ও শিল্প কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করার চেষ্টায় নিয়োজিত।
সমাজ-সংস্কৃতি
পশতুনরা সাহসী, পরিশ্রমী, শান্তিপ্রিয়, স্বাধীনচেতা ও ধর্মভীরু প্রকৃতির। অতিথি পরায়ণতা এদের বিশেষ গুণ। প্রাচীন গোত্রীয় শাসন ব্যবস্থা আজো সেখানে প্রচলিত। প্রাচীন আফগান সমাজ ব্যবস্থার সাথে পশতুনদের যথেষ্ট মিল রয়েছে। গোত্রীয় সংহতি ও গোত্রীয় মানবতাবোধ এদের প্রধান সামাজিক বৈশিষ্ট্য। স্থানীয় ভাষায় পঞ্চায়েতকে ‘জিরগা’ বলা হয়ে থাকে। গোত্রীয় সামাজিক অনুশাসন মেনে চলতে বাধ্য সকল পশতুন সদস্য। এরা নারীদেরকে সবিশেষ সম্মানের চোখে দেখে থাকে। এদের মধ্যে আন্তঃ গোত্রীয় বিবাহ প্রথা বহুল প্রচলিত। নারীদের পর্দার প্রতি তাদের কঠোর রীতি এখনো প্রসিদ্ধ।
সিরিকোট অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস
সিরিকোট গ্রামের আদি নাম সেতালু,এটি কোহে গংগর অর্থাৎ গংগর উপত্যকায় অবস্থিত। সিরিকোট শব্দের অর্থ – পর্বত শীর্ষ। সিরিকোট গ্রামটি আক্ষরিক অর্থেই পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। সমতলভূমি থেকে এটার উচ্চতা প্রায় ২০০০ মিটার। দুর্গম পার্বত্য এলাকায় অবস্থিত বিধায় এখানকার মানুষের জীবন যাত্রায় মিশে আছে বৈরী প্রকৃতির সাথে নিরন্তর সংগ্রাম করে টিকে থাকার প্রাণান্ত প্রয়াস। বর্তমানে এটি সৈয়্যদবাদ শরীফ নামে বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করেছে। আশপাশের এলাকাসমূহে চরম ভাবাপন্ন জলবায়ু বিরাজ করলেও, সিরিকোট গ্রামটি সমতল ভূমি থেকে প্রায় ২০০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত হবার কারনে এখানকার আবহাওয়া বেশ শীতল, আরামপ্রদ ও স্বাস্থ্যকর। মাশ্ওয়ানী সৈয়্যদগণ এখানকার প্রধান বাসিন্দা। পশতুনদের মাঝে ইসলাম প্রচারের মহান ব্রত নিয়ে, সর্বপ্রথম ইসলামের দাওয়াত নিয়ে এসেছিলেন মারুফ কাপুর শাহ্, যিনি নবী বংশের ২৪তম ধারার বাহক ছিলেন। তাঁকে ‘ফাতেহে সিরিকোট’ (সিরিকোট বিজিয়ী) নামে ইতিহাসে অভিহিত করা হয়েছে।
প্রধান মাশওয়ানী জনপদসমূহ
মাশওয়ানী অধ্যুষিত প্রধান বসতিগুলোর মধ্যে গাযী তহসীলের অন্তর্গত সিরিকোট অন্যতম। এই সিরিকোটের জনসংখ্যা প্রায় ৮৫ হাজার। (২০০৫ এর গণনানুযায়ী)। এতে বসতি স্থাপনকারী জনগণের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার হচ্ছেন মাশওয়ানী সৈয়্যদ। ইরাক থেকে ইরান ও আফগানিস্তান হয়ে এঁদের পূর্বপুরুষেরা বর্তমান পাকিস্তানের ডেরা ইসমাইল খান এলাকার দমন উপত্যকায় বসতি স্থাপন করেন। পরে এরা কুহে সোলায়মানী ও মারদান এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়েন। মাশওয়ানীদেরকে প্রধানত সিরিকোট ও এর পার্শ্ববর্তী গ্রাম গুদওয়ালীয়া, হরিপুর জেলার কুন্ডী, তহসীল গাযী, এবং সোয়াবী জেলার তোর ডেহরী অঞ্চলে বেশী দেখা যায়। পেশওয়ার ও কোয়েটা এবং বেলুচিস্তান প্রদেশেও কিছুসংখ্যক মাশওয়ানী পরিবার বসবাস করেন। সিরিকোট গ্রামের আশপাশে অর্থাৎ গংগর উপত্যকায় প্রায় শতাধিক মাশওয়ানী সৈয়্যদ পরিবার যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছেন। এ এলাকায় মাশওয়ানী সৈয়্যদগণ খুবই সম্মানিত।
শাহানশাহে সিরিকোট  এর বংশধারা
আমাদের দাদাপীর হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি  হলেন হযরত সৈয়্যদ আহমদ গেসূদারাজ -এর পবিত্র বংশধারার ২৬তম অধস্তন বংশধর। সিরিকোট অঞ্চলে ইসলামের ঝান্ডা বহনকারী সৈয়্যদ গফুর শাহ্ ওরফে মারুফ কাপুর শাহ্  হলেন হযরত সৈয়্যদ আহমদ গেসূদারাজ -এর পরবর্তী দ্বাদশ অধস্তন ব্যক্তিত্ব। আর শাহানশাহে সিরিকোট -এর পিতা হযরত সৈয়্যদ সদর শাহ্  হলেন হযরত সৈয়দ আহমদ গেসূদারাজ -এর পবিত্র শোণিত ধারার ২৫তম উত্তরাধিকারী। বংশগত শাজরা শরীফ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, শাহানশাহে সিরিকোট হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ্  পবিত্র নবী বংশের ৩৮তম আওলাদ। আর হযরত সৈয়্যদ আহমদ গেসূদারাজ  হচ্ছেন এ নবী বংশের দ্বাদশ ধারার বাহক।
দুর্গম পার্বত্য এলাকায় অবস্থিত হলেও বর্তমানে সিরিকোট অঞ্চলে আধুনিক জীবনযাত্রার সকল সুযোগ সুবিধাদি বিদ্যমান। এ সকল সর্বাধুনিক সুযোগ সুবিধার পেছনে রয়েছে শাহানশাহে সিরিকোট হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ্  এবং তাঁর আওলাদ ও মুরীদানদের অবদান। যেমন- সমতল ভূমি থেকে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ফুট উপরে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী সিরিকোট দরবার শরীফে যাতায়াতের জন্য আগে তেমন কোন সুব্যবস্থা ছিল না। আঁকা-বাঁকা পাহাড়ি বিপদসংকুল পথে যানবাহন ছিল অপ্রতুল ও ব্যয়বহুল। ছিলনা কোন সুপেয় পানীয় জলের সংস্থান। ২-৩ কিলোমিটার নিচের কূপ থেকে বহু কষ্টে জোগাড় করা হত পানি। আর সেটা দিয়েই চলত নাওয়া-খাওয়া সবকিছু। ছিল না বিদ্যুৎ সংযোগ, না ছিলো টেলি যোগাযোগের ব্যবস্থা, না ছিল কোন পাকা সড়ক পথ, এমনকি ছিলনা অতি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার কোন সুযোগ।
১৯৫৬ সাল থেকে এসব ক্ষেত্রে উন্নতি হতে থাকে। ১৯৬৫ ইংরেজিতে সরকারিভাবে সিরিকোটগামী সড়ক পথ সংস্কারের ব্যবস্থা করা হয়। এরপর তাঁর কনিষ্ঠ পৌত্র পীরে বাঙ্গাল হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ সাবের শাহ্ মাদ্দাজিল্লুহুল আলী পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সীমান্ত প্রদেশের প্রত্যেক গ্রামে রাস্তা-ঘাটের ব্যাপক উন্নতি ঘটে। বিভিন্ন এলাকায় সুপেয় জলের ব্যবস্থা করা হয়। বিদ্যুতের আলোকে ঝলমল করে উঠে প্রত্যন্ত অঞ্চল। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় সিরিকোট এখন গড়ে উঠেছে এক আধুনিক নগরী রূপে। এখানে রয়েছে সরকারি কম্যুনিটি হাসপাতাল, প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চবিদ্যালয়-কলেজ, বাজার, ডাকঘর। বিদ্যুত ও পানীয় জলের সুব্যবস্থা ছাড়াও এখানে রয়েছে উন্নত ডাক-টেলিযোগাযোগ, যাতায়াত ব্যবস্থা ও অন্যান্য প্রশাসনিক স্থাপনাসমুহ। নিকটবর্তী জেলা শহর হরিপুর, এবোটাবাদ ও প্রাদেশিক রাজধানী পেশওয়ার ছাড়াও লাহোর, রাওয়ালপিণ্ডি ও কেন্দ্রীয় রাজধানী ইসলামাবাদের সাথে হরিপুরের মাধ্যমে সিরিকোটের রয়েছে সুবিধাজনক বাস সংযোগ। উল্লেখ্য, ২ কোটি পশতুন জনগোষ্ঠীর প্রাণের দাবী একটা স্বতন্ত্র্য খাইবার পাখতুন খাওয়া প্রদেশ স্থাপন করা এ ক্ষেত্রে কান্ডারির ভূমিকা পালন করেছেন হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ সাবের শাহ্ মাদ্দাজিল্লুহুল আলী। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ২০১০ সালে এটাও পূরণ হয়। মোটকথা, এলাকার কৃতজ্ঞচিত্ত জনগণ পরম শ্রদ্ধা ভরে এ এলাকার নাম দিয়েছে ‘সৈয়্যদাবাদ শরীফ’। কয়েক মাইল দূর থেকে দৃশ্যমান সিরিকোট দরবার শরীফের সুদৃশ্য সবুজ গম্বুজ শোভিত, নান্দনিক কারুকার্য খচিত সুউচ্চ মিনার আগত ভক্ত ও মুরিদানদের হৃদয়কে বেহেশতি প্রশান্তিতে ভরে দেয়।
দরবারের ব্যবস্থাপনা
ঐতিহ্যবাহী সিরিকোট দরবার শরীফের সার্বিক ব্যবস্থাপনার গুরু দায়িত্ব এখানকার সাহেবজাদা হুযুরগণ অত্যন্ত সুচারুভাবে আঞ্জাম দিয়ে আসছেন। আগত মুরীদান, ভক্ত-মেহমানদের আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়া, নানা রকম সুযোগ সুবিধার দিকে সদা সজাগ দৃষ্টি রয়েছে বর্তমান সাহেবজাদা হুযুরদের। দরবার শরীফের ব্যবস্থাপনায় এখানে পরিচালিত হচ্ছে একটা জামে মসজিদ, লঙ্গর খানা ও তৈয়্যবিয়া মাদ্রাসা।
হে মহান আল্লাহ্ পাক মদীনার সৌরভ, কাদেরিয়া তরীকার গৌরব, স্বর্গীয় প্রেমসুধায় আগ্রহীদের কেন্দ্রবিন্দু ও ইলমে মারিফাত পিয়াসীদের মিলন মেলা পবিত্র এ দরবার শরীফকে কিয়ামত পর্যন্ত আবাদ রাখুন। আ-মী-ন।

তথ্যসূত্র. শাজরা শরীফ ও মাসিক তরজুমান, প্রকাশক, আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া, চট্টগ্রাম।
পাকিস্তান, দেশ ও কৃষ্টি প্রকাশক ইস্ট পাকিস্তান স্কুল টেক্সট বুক বোর্ড ও বিভিন্ন ম্যাগাজিন।

[মাসিক তরজুমান-১৪৩৬ হিজরির যিলক্বদ সংখ্যা]