গান-বাজনা ও শরয়ী নির্দেশনা

গান-বাজনা ও শরয়ী নির্দেশনা

গান-বাজনা ও শরয়ী নির্দেশনা
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ্ আল মাসুম

সুখী জীবনের জন্য চাই কিছুটা স্বচ্ছ আনন্দ ও বিনোদন। কারণ একেবারে নিরস-নিরানন্দ জীবন হতাশা তৈরি করে। হতাশাই জীবনের ব্যর্থতার কারণ। আনন্দ মানে হাসি, পুলক, সুখ, তৃপ্তি, সন্তোষ, পরিতোষ, স্ফূর্তি, আহ্লাদ। বিনোদন মানে আমোদিতকরণ, তুষ্টিসাধন। এক কথায় মানসিক প্রশান্তির জন্য যা করা হয়, তা-ই বিনোদন। নিষ্পাপ আনন্দ ও বৈধ বিনোদন সুন্নাত। বিনোদনের বৈধ উপায়-উপকরণগুলোর প্রায় সব কটিই রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবায়ে কেরাম প্রয়োগ ও উপভোগ করেছেন। যেমন সত্য গল্প, মৃদু ও সত্য কৌতুক, হাস্যরস, কবিতা আবৃত্তি, পদ্য প্রণয়ন, গদ্যপাঠ, সাহিত্য রচনা, ইত্যাদি। আনন্দ-বিনোদনের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো নিষ্কলুষ গজল আবৃত্তি। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রিয় মাতৃভূমি মক্কা শরিফ থেকে হিজরত করে যখন মদিনা মুনাওয়ারায় তশরিফ নিয়ে গেলেন, তখন দীর্ঘ দুই সপ্তাহের অবিরাম সফরের ক্লান্তি সহকারে এক উষালগ্নে সেখানে পৌঁছেন, তখন মদিনার ছোট্ট ছেলেমেয়েরা অভ্যর্থনা গীত “ত্বলাআল বাদরু আলাইনা” গেয়ে প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বাগত জানিয়েছিলো। আলোচ্য নিবন্ধে এ বিষয়ে আলোকপাত করার প্রয়াস পেলাম।
ইরশাদ হচ্ছে :
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيلِ اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَ يَتَّخِذَهَا هُزُوًا
অর্থাৎ এক শ্রেণীর লোক রয়েছে, যারা অজ্ঞতাবশত মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্যে ‘লাহ্ভাল হাদীস’ (অবান্তর/বেহুদা কথাবার্তা) সংগ্রহ করে এবং ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। তাদের জন্যে রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।” উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউ’দ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আ’নহুমা বলেন, আল্লাহর কসম! যিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই, (এই আয়াতে উল্লেখিত) ‘লাহ্ভাল হাদীস’ (অবান্তর-কথাবার্তা)-এর অর্থ হচ্ছে গান তথা অশ্লীল গান-বাজনা। অন্যত্র আল্লাহ তাআ’লা ইরশাদ করেন, وَاسْتَفْزِزْ مَنِ اسْتَطَعْتَ مِنْهُمْ بِصَوْتِكَ
অর্থাৎ (হে ইবলীস!) তোমার আওয়াজ দ্বারা তাদের (পথভ্রষ্ট লোকদের) মধ্য থেকে যাকে পারো পদস্খলিত করো। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরকুল শিরোমণি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আ’নহুমা বলেন,“যে সকল বস্তু পাপাচারের দিকে আহ্বান করে, সেটাই হচ্ছে ইবলীসের আওয়াজ।” এ প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা বলেন, পানি যেমন (ভূমিতে) তৃণলতা উৎপন্ন করে তেমনি (অশ্লীল) গান মানুষের অন্তরে নিফাক্ব সৃষ্টি করে। ইমাম মুজাহিদ ও ইবনে ক্বাইয়্যুম বলেন, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পাপাচারের দিকে মানুষকে আহবানকারী বস্তুসমুহের মধ্যে (অশ্লীল) গান-বাজনা সর্বোচ্চ। এজন্যেই (অশ্লীল) গান-বাজনাকে ‘ইবলিসের আওয়াজ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। উক্ত বাণীর সত্যতা এখন দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার। (অশ্লীল) গান-বাজনার ব্যাপক বিস্তারের ফলে মানুষের অন্তরে এই পরিমাণ নিফাক্ব সৃষ্টি হয়েছে যে, গান-বাদ্য, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ইত্যাদিকে হালাল মনে করা হচ্ছে। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু লোক সৃষ্টি হবে, যারা ব্যভিচার, রেশম, মদ ও গান-বাজনাকে হালাল সাব্যস্ত করবে।
গান বাজনার ভয়াবহ পরিণতি বর্ণনা করে নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার উম্মতের কিছু লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা পান করবে। আর তাদের মাথার উপর বাদ্যযন্ত্র ও গায়িকা রমনীদের গান বাজতে থাকবে। (এক পর্যায়ে) আল্লাহ তাআলা তাদেরকে যমীনে ধ্বসিয়ে দিবেন। অন্যত্র ইরশাদ করেন, سَيَكُوْنُ فِيْ آخِرِ الزَّمَانِ خَسْفٌ وَ قَذْفٌ وَمَسْخٌ، قِيْلَ: وَمَتَى ذَلِكَ يَارَسُوْلَ اللهِ؟ قَالَ: إِذَا ظَهَرَ تِ الْمَعَازِفُ وَالْقَيْنَاتُ
অর্থাৎ অচিরেই শেষ যুগে দেখা দেবে ভূমি ধস, নিক্ষেপ ও বিকৃতি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহ্র রাসূল! তা কখন? তিনি বললেন, যখন বাদ্যযন্ত্র ও গায়ক-গায়িকারা বেশি হারে প্রকাশ পাবে।
আমাদের দেশে ইতিমধ্যে যে বিল্ডিং ধ্বসে মারাত্মক দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে, নিঃসন্দেহে এগুলো আল্লাহর আজাব-গজবের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত। এমন হওয়াও অসম্ভব নয় যে- (অশ্লীল) গান, গায়িকা, মদ, ব্যভিচারের প্রাদুর্ভাব হিসেবে এগুলো সেই আজাবের অংশ, যা হাদীস শরীফে কেয়ামতের আলামত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে তবে এখনো বাকি রয়েছে মানুষকে শুকর ও বানরে পরিণত করা। আল্লাহ তাঁর নবী রাসূলদের যে ওয়াদা দিয়েছেন তা অবশ্যই সত্য। একদিন হয়তো এমন হবে, এরকম (অশ্লীল) গান-বাজনা, মদ, অশ্লীল নারীদের নৃত্যের কোন প্রোগ্রামে মানুষেরা সারা-রাত আনন্দ ফূর্তিতে লিপ্ত থাকবে। আর সকাল বেলায় তাদেরকে বানর ও শূকরে পরিণত করে দেওয়া হ।ে (নাউজুবিল্লাহ)
প্রখ্যাত তাবেয়ী হযরত নাফে’ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
عن سليمان بن موسى عن نافع قال : سمع ابن عمر مزمارا قال : فوضع إصبعيه في أذنيه ونأى عن الطريق) أي أبعد ( وقال لي : يانافع هل تسمع شيئا؟ قال فقلت : لا فرفع إصبعيه من أذنيه وقال: كنت مع النبي صلى الله عليه وسلم فسمع مثل هذا فصنع مثل هذا
অর্থাৎ একবার চলার পথে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা বাঁশির আওয়াজ শুনলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দুই কানে আঙ্গুল দিলেন। কিছু দূর গিয়ে আমার নিকট জিজ্ঞাসা করলেন, হে নাফে’! এখনো কি আওয়াজ শুনছ? আমি বললাম হ্যাঁ। অতঃপর আমি যখন বললাম, এখন আর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না তখন তিনি কান থেকে আঙ্গুল সরালেন এবং বললেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চলার পথে বাঁশির আওয়াজ শুনে এমনই করেছিলেন। বস্তুত যারা এসব থেকে দূরে থাকবে তাদেরকে সুসংবাদ জানিয়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যখন কিয়ামত কায়েম হবে, তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, তোমরা কোথায়? যারা দুনিয়াতে শয়তানের গান বাজনা থেকে দুরে সরে ছিলে? তাদেরকে পৃথক করে মিশক অম্বরের সুগন্ধি যুক্ত একটি টিলার পাশে দাঁড় করানো হবে, অতঃপর আল্লাহ তা’আলা ফিরিস্তাদের বলবেন, তাদেরকে আমার তাসবিহ ও প্রশংসা শুনাও, তারা এমনভাবে শুনবেন যে, এ রকম সুন্দর আওয়াজ দুনিয়াতে কেউ কখনো শুনেনি।
উপরোক্ত বর্ণনা সমূহে অশ্লীল গান-বাজনার কুফল ও শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

অশ্লীল গান বাজনার কুফল
গান ও বাজনার মধ্যে নানা ধরনরে ক্ষতিকর দিক রয়েছে। যেমন-
ক) এটা নিফাক্ব এর উৎস
খ) ব্যভিচারের প্রেরণা জাগ্রতকারী
গ) মস্তিষ্কের উপর আবরণ তৈরিকারী
ঘ) কুরআনের প্রতি অনিহা সৃষ্টিকারী
ঙ) আখিরাতের চিন্তা নির্মূলকারী
চ) গুনাহের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টিকারী ও
ছ) জিহাদী চেতনা বিনষ্টকারী।
পেশাদার গায়ক/গায়িকা
বর্তমানে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে অশ্লীল গান বাজনা ও বাদ্যযন্ত্রের বিশাল বাজার তৈরী হচ্ছে- মনে রাখতে হবে, এর সকল উপার্জন অবৈধ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।
ইরশাদ হচ্ছে, অবশ্যই আল্লাহ আমার উম্মতের জন্য মদ, জুয়া, ঢোল-তবলা এবং বীণা জাতীয় বাদ্যযন্ত্রকে হারাম করেছেন। অন্যত্র ইরশাদ করেন, “তোমরা গায়িকা (দাসী) ক্রয়-বিক্রয় করো না এবং তাদেরকে গান শিক্ষা দিও না। আর এসবের ব্যবসায় কোন কল্যাণ নেই। জেনে রেখো, এর প্রাপ্ত মূল্য হারাম।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেন, গায়ক গায়িকার জীবিকা (গানের মাধ্যমে) হারাম এবং ব্যবিচারের জীবিকা হারাম। যে শরীর হারাম দ্বারা গঠিত তাকে আল্লাহ তায়ালা জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।
উপরোক্ত হাদিস সমুহ থেকে প্রতিয়মান হয় যে, অশ্লীল গান বাজনার মাধ্যমে যে টাকা-পয়সা অর্জন করে এবং যারা গান বাজনার অনুষ্ঠান করায় এবং তাতে যে টাকা ব্যয় করে তা অবৈধ; শিল্পী বা গায়ক-গায়িকা, নায়ক-নায়িকা, শ্রোতা এবং দর্শক সবাই সমান অপরাধী। টেলিভিশন, কম্পিউটার, ডিস লাইন মোবাইল ফোন ইত্যাদির মাধ্যমে অশ্লীল, নগ্ন ছায়া-ছবি, নাচানাচি, অশ্লীল গান-বাজনা ইত্যাদি দেখা এবং দেখানো দুটোই সমান অপরাধ, পাপ ও গর্হিত কাজের অন্তর্ভুক্ত, যা আল্লাহ্ তা’আলা পছন্দ করেন না। রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন-
لَا یُحِبُّ اللّٰهُ الْجَهْرَ بِالسُّوْٓءِ مِنَ الْقَوْلِ اِلَّا مَنْ ظُلِمَؕ- وَ كَانَ اللّٰهُ سَمِیْعًا عَلِیْمًا(۱۴۸)
অর্থাৎ আল্লাহ্ তায়ালা অশ্লীল ও কোন মন্দ বিষয় প্রকাশ করা পছন্দ করেন না। কিন্তু মজলুমের বিষয় স্বতন্ত্র, অর্থাৎ (যার উপর অন্যায়ভাবে জুলুম করা হয়েছে সে জালেমের মন্দ দিকগুলো প্রকাশ করতে পারবে এবং আল্লাহ্ তা‘আলা সব কিছু শুনেন ও জানেন।)
তাই চায়ের দোকানে বা বিভিন্ন এন্টিনা ও কম্পিউটার দোকানে কাষ্টোমারকে আকৃষ্ট করার জন্য ডিস-এন্টিনা এর সাথে সংযোগ স্থাপন করে নারী-পুরুষ ও যুবক-যুবতীদের অর্ধ উলঙ্গ ছায়া-ছবি ও নাচানাচি প্রদর্শন করা নিঃসন্দেহে বেহায়াপনা ও অশ্লীলতা যা মুসলিম নর-নারী, মা-বোন, ও যুবক-যুবতী ও ছাত্র-ছাত্রীদের চরিত্র ধ্বংস ও অশ্লীল করে দিচ্ছে। সামর্থবান ও সক্ষম মুসলমানের উপর এ জাতীয় গর্হিত কুকর্মকে প্রতিহত করা অবশ্যই জরুরী। নতুবা আল্লাহর দরবারে জবাব দিহি করতে হবে। অশ্লীল নাচ-গান প্রদর্শন কারীর গুনাহ্ ও অপরাধ যে ব্যক্তি দেখে তার চেয়ে অনেক বেশী। যারা এসব দোকানে অশ্লীল ছায়া-ছবি দেখে নষ্ট হচ্ছে তাদের সকলের গুনাহের বোঝা প্রদর্শন কারীর উপর বর্তাবে। এদেরকে বাধা দেয়া ও প্রতিরোধ করা আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূলের নির্দেশ। এ সম্পর্কে ক্বোরআনে অসংখ্য বর্ণনা এসেছে। যেমন আল্লাহ তা’আলা আমাদের প্রিয় নবীর উম্মতের চরিত্র ও প্রশংসা বর্ণনা করে ইরশাদ করেন-
كُنْتُمْ خَیْرَ اُمَّةٍ اُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَاْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَ تَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ
অর্থাৎ হে আমার হাবীবের উম্মত! তোমরা সর্বশ্রেষ্ঠ সম্প্রদায়, তোমাদেরকে মানুষের কল্যাণের জন্য পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে যেন তোমরা একে অপরকে সৎ ও পুণ্যের আদশে করো এবং (যত প্রকারের) অশ্লীল মন্দ কাজ আছে তা হতে একে অপরকে বিরত রাখো ও নিষেধ করো। সরকারে দু’জাহাঁ রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ে হাদীস শরীফে ইরশাদ করেন-
من راى منكم منكرا فلغيره بيده فان لم يستطع فبلسانه وان لم يستطع فبقلبه وذالك اضعف الايمان
অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অশ্লীল ও কু-কর্ম দেখবে তা অবশ্যই হাতে প্রতিরোধ করবে অর্থাৎ শক্তি থাকলে শাস্তি প্রয়োগ করবে আর যদি হাতে বাধা দেয়ার সামর্থ না রাখে তবে মুখে বাধা দেবে আর যদি মুখে ও বাধাঁ দেয়ার সামর্থ না রাখে তবে এ জাতীয় অশ্লীল ও গুনাহের কাজকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করবে। আর এটা হল খুবই দুর্বল ঈমানের পরিচয়।
উল্লেখ্য এ সব নগ্ন ও উলঙ্গ অশ্লীল ছায়া-ছবি ও নাচা-নাচি প্রদর্শন কারীরা উক্ত ডিস-এন্টিনা ও কম্পিউটার হতে কখনো কখনো পবিত্র ক্বোরআনের তেলাওয়াত ও প্রচার করে থাকে, এক্ষেত্রে তাদের উদ্দেশ্য যদি ক্বোরআন তেলাওয়াতকে হেয় প্রতিপন্ন ও বেইজ্জত করা হয় তখন ঈমান ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশংকা, আর এ উদ্দেশ্যে ও নিয়ত না হলে অসুবিধা নেই। আর শ্রবণকারী ও দর্শক যদি ভাল ও সওয়াবের নিয়তে টিভি-ডিস-এন্টিনা ও কম্পিউটার হতে ক্বোরআন তেলাওয়াত ভক্তি ও আদবের সাথে শ্রবণ করে তা হলে সওয়াব। ফতোয়ায়ে শামীর কিতাবুল কারাহিয়াতে রয়েছে-
إنَّ آلَةَ اللَّهْوِ لَيْسَتْ مُحَرَّمَةً لِعَيْنِهَا، بَلْ لِقَصْدِ اللَّهْوِ مِنْهَا….. أَلَاتَرَى أَنَّ ضَرْبَ تِلْكَ الْآلَةِ بِعَيْنِهَا حَلَّ تَارَةً وَحَرُمَ أُخْرَى بِاخْتِلَافِ النِّيَّةِ بِسَمَاعِهَا وَالْأُمُورُ بِمَقَاصِدِهَا
অর্থাৎ বাদ্য-যন্ত্র মূলতঃ হারাম নয় বরং খেল-তামাশার দরুন হারাম হয়েছে। এ সব বিষয়ে ইসলামী আইন ও ফিকহ ফতোয়ার ধারা হল الاموربمقاصدها তথা কর্ম-কান্ডে ও দ্বীনী-দুনিয়াবী বিষয় সমূহ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে সম্পৃক্ত। উদ্দেশ্য ও নিয়ত সহীহ হলে সওয়াব পাবে আর উদ্দেশ্য শুদ্ধ না হলে গুনাহ হবে। ফলে এসব বাদ্য-যন্ত্রের ব্যবহারে উদ্দেশ্য মন্দ হওয়ার কারণে তা হারামে পরিণত হয়েছে।
গান বাজনা শ্রবণের প্রতিকার
রেডিও, টেলিভিশন, ভিডিও কিংবা অন্য কোন স্থানে যে অশ্লীল গান-বাজনা হয়, তা শয়তানের প্ররোচনায় হয়ে থাকে। আর এগুলো শ্রবণ করা হতে বিরত থাকতে হলে আল্লাহর যিকির, নবী-অলির জীবনী আলোচনা, দুরুদ শরীফ ও ক্বোরআন তেলাওয়াত বিশেষত সূরা বাকারা তেলাওয়াতে মশগুল থাকা চাই। ইরশাদ হচ্ছে, إنَّ الشَّيْطَانَ يَنْفِرُ مِنَ الْبَيْتِ الذِيْ يَقْرَأُ فِيْهِ الْبَقَرَةَ
যে বাড়িতে সূরা বাকারা তেলাওয়াত করা হয় সে বাড়ি হতে শয়তান পলায়ন করে।
আল্লাহ তায়ালা বলনে:
يَاأَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُمْ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَ رَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ
অর্থাৎ হে মানব সম্প্রদায়! তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে উপদেশ এবং অন্তর সমূহে বিদ্যমান ব্যাধি নিরাময়কারী, আর মু’মিনদের জন্য হিদায়ত ও রহমত।
ইসলামী সংগীত পরিবেশন
ওই সমস্ত সংগীত, যাতে আল্লাহর তাওহীদের মর্মবাণী, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত ও তাঁর শামায়েল, মুসলিম ভাতৃত্ব বন্ধন, কিংবা জিহাদের প্রেরণা রয়েছে, অথবা যাতে ইসলামের মৌলিক নীতি বা সৌর্ন্দয ফুটিয়ে তোলা হয় অথবা জাতি ও সামাজিক উপকারমূলক তা পরিবেশন করা শরীয়ত সম্মত। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাব্য পছন্দ করতেন। হযরত হাসসান ইবনে সাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ভালো কবিতা রচনা করতেন এবং চমৎকার আবৃত্তি করতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুশি হয়ে তাঁর জন্য মদিনা শরিফে মসজিদে নববীতে আরেকটি মিম্বর বানিয়েছিলেন, যেটার উপর দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর কাব্য উপস্থাপন করতেন। হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা শ্রবণ করতেন তিনি হজরত হাসসান রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর কবিতায় মুগ্ধ হয়ে নিজের গায়ের চাদর শরীফ তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। নবীপতœীগণসহ বহু নারী সাহাবিও কবিতা রচনা করেছেন। হজরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তিনি অনেক কবিতা লিখেছেন। যেমন-
‘লানা সামসুন ওয়া লিল আফা-ক্বি সামসুন;
ওয়া সামছি আফদ্বালু মিন শামসিস্ সামা-ই।
ফা ইন্নাশ শামসা তাৎলাউ বাদাল ফাজরি;
ওয়া শামছি তাত্বলাউ বাদাল ‘ইশায়ি।’
অর্থাৎ আমার আছে সূর্য, দিগন্তেও আছে সূর্য; আমার সূর্যটি আকাশের সূর্য হতে শ্রেষ্ঠ। দিগন্তে সূর্য ওঠে ফজরের পরে; আমার সূর্য উদিত হয় ইশার অন্তে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে খন্দকের যুদ্ধে যখন খন্দক (পরিখা) খনন করছিলেন, তখন সাহাবায়ে কেরামকে পরিখা খননে উদ্বুদ্ধ করতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নিম্নোক্ত কবিতা পরিবেশন করেন, হে আল্লাহ! কোনই জীবন নেই আখেরাতের জীবন ব্যতীত। তাই আনসার ও মুহাজিরদের ক্ষমা করুন। তখন আনসার ও মুহাজিরগণ উত্তর দিলেন: আমরাই হচ্ছি ঐ ব্যক্তিবর্গ, যারা রাসূলের নিকট আমরণ জিহাদের নিমিত্তে বাইআত গ্রহণ করেছি। [সহীহ বোখারী-কিতাবুল জিহাদ ইত্যাদি] সুতরাং এ জাতীয় ভাল অর্থবোধক হামদ-গজল, নাতে রসূল, মানকাবাত, কছিদা (যা অশ্লীলতা থেকে মুক্ত) আবৃত্তি ও শ্রবণ করা দুষনীয় নয় বরং উত্তম। মূলতঃ এটাই প্রকৃত সেমা। এটা যদি বেগানা যুবক-যুবতি অবাধ আচরণ, ফাসিক-ফাজির, বেনামাযী হতে মুক্ত হয় এবং সেমার মজলিসে সবাই নামাযী ও শরিয়তের পাবন্দ হয়, রং তামাশা ও অশ্লীলতা হতে পবিত্র হয় তখন উক্ত সেমা অবৈধ হওয়ার কোন কারণ নাই বরং ভাল ও উত্তম।
দফ’র বিধান
দফ বলা হয় ঐ বাদ্য যন্ত্রকে যার উপরের অংশ চালুনির মত, যাতে ঘন্টির মত আওয়াজ নেই, আর তার একাংশে থাকবে চামড়ার পর্দা। এর আওয়াজ স্পষ্ট ও চিকন নয় এবং সুরেলা ও আনন্দদায়কও নয়। কোনো দফ-এর আওয়াজ যদি চিকন ও আকর্ষণীয় হয় তখন তা আর দফ থাকবে না; বাদ্যযন্ত্রে পরিণত হবে। আর দফ-এর মধ্যে যখন বাদ্যযন্ত্রের বৈশিষ্ট্য এসে যাবে তখন তা সর্বসম্মতিক্রমে নাজায়েয বলে পরিগণিত হবে। দফ বাজানোর বিধান সম্পর্কে উলামায়ে কেরামদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। কিছু উলামায়ে কেরাম শুধু মাত্র বিবাহের অনুষ্ঠান উপলক্ষে জায়েজ বলেন। যেমন: ইমাম শাফেয়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি শর্তসাপেক্ষে শুধু ওলীমা অনুষ্ঠানে দফ বাজানোর অবকাশ আছে বলে মত দিয়েছেন। কেননা বিয়ের ঘোষণার উদ্দেশ্যে ওলীমার অনুষ্ঠানে দফ বাজানোর অবকাশের বর্ণনা হাদীসে রয়েছে। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বর্ণনা করেন,
قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صلى الله عليه وسلم أَعْلِنُوا هٰذَا النِّكَاحَ وَاجْعَلُوهُ فِى الْمَسَاجِدِ وَاضْرِبُوا عَلَيْهِ بِالدُّفُوفِ-
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা বিবাহকার্য প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে মসজিদে সম্পন্ন কর এবং তাতে দফ বাজাও। মনে রাখতে হবে, এখানে দফ বাজানোর উদ্দেশ্য হল বিবাহের ঘোষণা, অন্য কিছু নয়।
কেউ কেউ দফ বাজানো মুবাহ বলেছেন। যেমন: ইমাম শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,“বিনোদন দুই প্রকারঃএকটি হারাম, যেমন বাঁশি বা অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান আবৃত্তি করা। অন্যটি মোবাহ। যেমন, ওয়ালিমা বা এই রকম আনন্দ প্রকাশের অনুষ্ঠানে দফ বাজিয়ে বৈধ গান।” ইমাম ইবনে কুদামা আল মুগনী গ্রন্থে হাম্বলী মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে গিয়ে অনুরূপ মন্তব্য করেন।
কিছু উলামায়ে কেরাম নিম্নোক্ত তাফসীর ও হাদীসসমুহের আলোকে ইসলামী সংগীতে দফ বাজানো নিষিদ্ধ বলে মন্তব্য করেছেন।
ক. আল্লামা ইবনে কাসীর তার বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থে সূরায়ে মায়েদার ৯০ নাম্বার আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে তাওরাতের উদ্বৃতি দিয়ে তিনি বলেন –
عن عبدالله بن عمرو قال: إن هذه الآية التي في القرآن: }يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالأنْصَابُ وَالأزْلامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ{ قال: هي في التوراة: إن الله أنزل الحق ليذهب به الباطل، ويبطل به اللعب،والمزامير،والزَّفْن،والكِبَارات–يعني البرابط–والزمارات –يعني به الدف -والطنابير-والشعر،والخمر مرة لمن طعمها. أقسم الله بيمينه وعزة حَيْله من شربها بعد ماحرمتها لأعطشنه يوم القيامة، ومن تركها بعد ما حرمتها لأسقينه إياها في حظيرة القدس-
অর্থাৎ নিশ্চয় আল্লাহ সত্য নাযিল করে এর দ্বারা বাতিলকে নির্মূল করেন। আর বাতিলের অন্তর্ভূক্ত বিষয়ের মাঝে দফ বাজানোও শামিল। ঠিক একই তাফসীর রয়েছে আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী প্রণীত আদ দুররুল মানসুর তাফসীর গ্রন্থেও।
খ-১.
عن ابن مسعود رضى الله تعالى عنه قال نهى عن ضرب الدف ولعب الصنج وضرب الزمارة-
খ-২.
عن مطر بن سالم عن على رضى الله تعالى عنه قال : نهى رسول الله – صلى الله عليه وسلم – عن ضرب الدف ولعب الصنج وصوت الزماره-
খ-৩.
عن بشر بن عاصم عن أبيه عن جده فصل ما بين الحلال و الحرام ضرب الدف و الصوت فى النكاح-
অর্থাৎ হযরত ইবনে মাসউদ ও হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা থেকে বর্ণিত উপরোক্ত হাদিসদ্বয়ে রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুস্পষ্টভাবে “দফ” বাজাতে নিষেধ করেছেন। আর বশীর ইবনে আসেম রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে দফের বিধান হালাল ও হারামের মাঝে দোদুল্যমান বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
খ-৪.
عَنْ أَبِى هَاشِمٍ الْكُوفِىِّ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ : الدُّفُّ حَرَامٌ وَ الْمَعَازِفُ حَرَامٌ وَ الْكُوبَةُ حَرَامٌ وَ الْمِزْمَارُ حَرَامٌ.
অর্থাৎ হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, দফ হারাম। বাদ্যযন্ত্র হারাম। মদের পেয়ালা হারাম। বাঁশী হারাম।
গ-১.
وأما الضرب بالدف فقد كان جماعة من التابعين يكسرون الدفوف ৃৃৃوكان الحسن البصري يقول ليس الدف من سنة المرسلين في شيء –
অর্থাৎ তাবেয়ীদের এক জামাত দফ ভেঙ্গে ফেলতেন। আর হাসান বসরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন-দফ বাজানোতে নবীগণের অনুসরণের কিছু নেই।
গ-২.
وَاسْتِمَاعُ ضَرْبِ الدُّفِّ وَ الْمِزْمَارِ وَغَيْرِذَلِكَ حَرَامٌ وَ إِنْ سَمِعَ بَغْتَةً يَكُونُ مَعْذُورًا وَ يَجِبُ أَنْ يَجْتَهِدَ أَنْ لَا يَسْمَعَ قُهُسْتَانِيٌّ
অর্থাৎ দফের বাজনা ও বাঁশির আওয়াজ এবং এ জাতীয় বিষয় শোনা হারাম, আর যদি আচমকা শোনে ফেলে তবে তাকে মাজুর ধরা হবে। আর চেষ্টা করবে যেন তা না শুনতে পায়।
সুতরাং সতর্কতা মূলক ইসলামী সংগীতে দফ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা শ্রেয়।
সামা- কাওয়াল
এ প্রসঙ্গে হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আজকাল যে কাওয়ালী সাধারণভাবে প্রচলিত, যেখানে অশ্লীল বিষয়ের গান পরিবেশন করা হয় এবং যেখানে পাপীতাপী, বড় ছোট সবাই জমায়েত হয় আর গানের তালে তালে নৃত্য করা হয়, এটা নিশ্চয়ই হারাম। কিন্তু যদি কোন জায়গায় এ ব্যাপারে পালনীয় সমস্ত শর্তাদি পালন পূর্বক কাওয়ালী হয় এবং কাওয়ালী পরিবেশনকারী আর শ্রোতাগণ যদি উপযোগী ও ইসলামী শরিয়তের অনুসারী হয়, তাহলে একে হারাম বলার সুযোগ নেই। অনেক সুফিয়ায়ে কিরাম উপযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য সঠিক কাওয়ালী হালাল এবং অনুপযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য হারাম বলেছেন। এজন্য সুফিয়ায়ে কিরাম কাওয়ালীর জন্য কিছু শর্তারোপ করেছেন।
[জাআল হক, ২য় খন্ড;তাফসীরাতে আহমদীয়া, ২১ পারা,সূরা লুকমান; ফায়সালায়ে হাফত মাসায়েল]
শায়খুল আলম ফরিদুল হক ওয়াদ দ্বীন (হযরত দাতাগঞ্জে শাকর রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর সুযোগ্য খলিফা) হযরত মাহবুবে ইলাহী নিজামুদ্দিন আউলিয়া এ প্রসঙ্গে বলেন- নিম্নোক্ত শর্ত সাপেক্ষে সামা বৈধ। যথা-
১. সামা পরিবেশনকারীকে সাবালক পুরুষ হতে হবে।
২. শ্রবণকারীর অন্তরে খোদা ভীতি ও স্মরণ থাকা চায় এবং তা স্মরণ রাখতে সচেষ্ট হতে হবে।
৩. সামার কালামসমূহ হাসী-তামাশা, নিরর্থক ও অশালীন থেকে মুক্ত হবে।
৪. সামা পরিবেশনে বীণা, সারেঙ্গী, বেহালা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র থাকতে পারবে না। [সিয়ারুল আউলিয়া, পৃ:৫০১-৫০২] আল্লামা আমিন ইবনে আবেদীন শামী হানাফী রহমাতুল্লাহি আলাইহি কাউয়ালীর জন্য ছয়টি শর্ত আরোপ করেছেন। যথা-
১. মজলিসে অপ্রাপ্ত বয়স্ক দাঁড়ি বিহীন কোন ছেলে না থাকা
২. সমবেত সবাই উপযুক্ত হওয়া এবং অনুপযুক্ত কেউ না থাকা
৩. কাউয়ালের নিয়ত খাঁটি হওয়া এবং উপার্জানের উদ্দেশ্য না থাকা।
৪. শ্রোতাগণ খাবার ও স্বাদ গ্রহণের নিয়তে জমায়েত না হওয়া।
৫. বিনা আত্মহারায় না দাঁড়ানো এবং
৬. গানগুলো শরিয়ত বিরোধী না হওয়া। [ফাতোয়ায়ে শামী,কিতাবুল কারাহিয়া, ৬/৩৫০]
বাদ্যযন্ত্রসহ যিকির ও কাওয়ালি জায়েয দাবীদাররা দলীল হিসেবে সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম শরীফে বর্ণিত দুটি বালিকার দফ বাজিয়ে কবিতা গাওয়ার হাদীসটি উপস্থাপন করে। এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, উক্ত হাদীসে আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহার বর্ণনাই তাদের অবাস্তব দাবির বিরুদ্ধে উৎকৃষ্ট জবাব। গান-বাদ্য যে নাজায়েয এই বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য হাদীসের রাবী হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বলেছেন, উক্ত বালিকাদ্বয় কোনো গায়িকা ছিল না। [ফাতহুল বারী ২/৪৪২]
ইমাম কুরতুবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, গান বলতে যা বুঝায়, বালিকাদ্বয় তা গায়নি। কেউ ভুল বুঝতে পারে তাই আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে একশ্রেণীর সুফী যে ধরনের গান ও বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন ঘটিয়েছে তা সম্পূর্ণ হারাম। [তাফসীরে কুরতুবী ১৪/৫৪] বিখ্যাত সাধক হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তার যুগে কাওয়ালি শোনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। লোকেরা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, বর্তমানে কাওয়ালি শোনার শর্তগুলো পালন করা হয় না। তাই আমি এর থেকে বিরত রয়েছি। [আহসানুল ফাতাওয়া, ৮/৩৯২[
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক জীবন যাপন করার তওফিক দান করুক, বিহুরমাতি সৈয়্যদিল মুরসালিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
লেখক: আরবি প্রভাষক, রাণীরহাট আল আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদরাসা, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।

Share:

Leave Your Comment