গান-বাজনা ও শরয়ী নির্দেশনা
গান-বাজনা ও শরয়ী নির্দেশনা
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ্ আল মাসুম
সুখী জীবনের জন্য চাই কিছুটা স্বচ্ছ আনন্দ ও বিনোদন। কারণ একেবারে নিরস-নিরানন্দ জীবন হতাশা তৈরি করে। হতাশাই জীবনের ব্যর্থতার কারণ। আনন্দ মানে হাসি, পুলক, সুখ, তৃপ্তি, সন্তোষ, পরিতোষ, স্ফূর্তি, আহ্লাদ। বিনোদন মানে আমোদিতকরণ, তুষ্টিসাধন। এক কথায় মানসিক প্রশান্তির জন্য যা করা হয়, তা-ই বিনোদন। নিষ্পাপ আনন্দ ও বৈধ বিনোদন সুন্নাত। বিনোদনের বৈধ উপায়-উপকরণগুলোর প্রায় সব কটিই রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবায়ে কেরাম প্রয়োগ ও উপভোগ করেছেন। যেমন সত্য গল্প, মৃদু ও সত্য কৌতুক, হাস্যরস, কবিতা আবৃত্তি, পদ্য প্রণয়ন, গদ্যপাঠ, সাহিত্য রচনা, ইত্যাদি। আনন্দ-বিনোদনের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো নিষ্কলুষ গজল আবৃত্তি। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রিয় মাতৃভূমি মক্কা শরিফ থেকে হিজরত করে যখন মদিনা মুনাওয়ারায় তশরিফ নিয়ে গেলেন, তখন দীর্ঘ দুই সপ্তাহের অবিরাম সফরের ক্লান্তি সহকারে এক উষালগ্নে সেখানে পৌঁছেন, তখন মদিনার ছোট্ট ছেলেমেয়েরা অভ্যর্থনা গীত “ত্বলাআল বাদরু আলাইনা” গেয়ে প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বাগত জানিয়েছিলো। আলোচ্য নিবন্ধে এ বিষয়ে আলোকপাত করার প্রয়াস পেলাম।
ইরশাদ হচ্ছে :
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيلِ اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَ يَتَّخِذَهَا هُزُوًا
অর্থাৎ এক শ্রেণীর লোক রয়েছে, যারা অজ্ঞতাবশত মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্যে ‘লাহ্ভাল হাদীস’ (অবান্তর/বেহুদা কথাবার্তা) সংগ্রহ করে এবং ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। তাদের জন্যে রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।” উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউ’দ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আ’নহুমা বলেন, আল্লাহর কসম! যিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই, (এই আয়াতে উল্লেখিত) ‘লাহ্ভাল হাদীস’ (অবান্তর-কথাবার্তা)-এর অর্থ হচ্ছে গান তথা অশ্লীল গান-বাজনা। অন্যত্র আল্লাহ তাআ’লা ইরশাদ করেন, وَاسْتَفْزِزْ مَنِ اسْتَطَعْتَ مِنْهُمْ بِصَوْتِكَ
অর্থাৎ (হে ইবলীস!) তোমার আওয়াজ দ্বারা তাদের (পথভ্রষ্ট লোকদের) মধ্য থেকে যাকে পারো পদস্খলিত করো। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরকুল শিরোমণি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আ’নহুমা বলেন,“যে সকল বস্তু পাপাচারের দিকে আহ্বান করে, সেটাই হচ্ছে ইবলীসের আওয়াজ।” এ প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা বলেন, পানি যেমন (ভূমিতে) তৃণলতা উৎপন্ন করে তেমনি (অশ্লীল) গান মানুষের অন্তরে নিফাক্ব সৃষ্টি করে। ইমাম মুজাহিদ ও ইবনে ক্বাইয়্যুম বলেন, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পাপাচারের দিকে মানুষকে আহবানকারী বস্তুসমুহের মধ্যে (অশ্লীল) গান-বাজনা সর্বোচ্চ। এজন্যেই (অশ্লীল) গান-বাজনাকে ‘ইবলিসের আওয়াজ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। উক্ত বাণীর সত্যতা এখন দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার। (অশ্লীল) গান-বাজনার ব্যাপক বিস্তারের ফলে মানুষের অন্তরে এই পরিমাণ নিফাক্ব সৃষ্টি হয়েছে যে, গান-বাদ্য, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ইত্যাদিকে হালাল মনে করা হচ্ছে। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু লোক সৃষ্টি হবে, যারা ব্যভিচার, রেশম, মদ ও গান-বাজনাকে হালাল সাব্যস্ত করবে।
গান বাজনার ভয়াবহ পরিণতি বর্ণনা করে নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার উম্মতের কিছু লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা পান করবে। আর তাদের মাথার উপর বাদ্যযন্ত্র ও গায়িকা রমনীদের গান বাজতে থাকবে। (এক পর্যায়ে) আল্লাহ তাআলা তাদেরকে যমীনে ধ্বসিয়ে দিবেন। অন্যত্র ইরশাদ করেন, سَيَكُوْنُ فِيْ آخِرِ الزَّمَانِ خَسْفٌ وَ قَذْفٌ وَمَسْخٌ، قِيْلَ: وَمَتَى ذَلِكَ يَارَسُوْلَ اللهِ؟ قَالَ: إِذَا ظَهَرَ تِ الْمَعَازِفُ وَالْقَيْنَاتُ
অর্থাৎ অচিরেই শেষ যুগে দেখা দেবে ভূমি ধস, নিক্ষেপ ও বিকৃতি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহ্র রাসূল! তা কখন? তিনি বললেন, যখন বাদ্যযন্ত্র ও গায়ক-গায়িকারা বেশি হারে প্রকাশ পাবে।
আমাদের দেশে ইতিমধ্যে যে বিল্ডিং ধ্বসে মারাত্মক দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে, নিঃসন্দেহে এগুলো আল্লাহর আজাব-গজবের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত। এমন হওয়াও অসম্ভব নয় যে- (অশ্লীল) গান, গায়িকা, মদ, ব্যভিচারের প্রাদুর্ভাব হিসেবে এগুলো সেই আজাবের অংশ, যা হাদীস শরীফে কেয়ামতের আলামত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে তবে এখনো বাকি রয়েছে মানুষকে শুকর ও বানরে পরিণত করা। আল্লাহ তাঁর নবী রাসূলদের যে ওয়াদা দিয়েছেন তা অবশ্যই সত্য। একদিন হয়তো এমন হবে, এরকম (অশ্লীল) গান-বাজনা, মদ, অশ্লীল নারীদের নৃত্যের কোন প্রোগ্রামে মানুষেরা সারা-রাত আনন্দ ফূর্তিতে লিপ্ত থাকবে। আর সকাল বেলায় তাদেরকে বানর ও শূকরে পরিণত করে দেওয়া হ।ে (নাউজুবিল্লাহ)
প্রখ্যাত তাবেয়ী হযরত নাফে’ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
عن سليمان بن موسى عن نافع قال : سمع ابن عمر مزمارا قال : فوضع إصبعيه في أذنيه ونأى عن الطريق) أي أبعد ( وقال لي : يانافع هل تسمع شيئا؟ قال فقلت : لا فرفع إصبعيه من أذنيه وقال: كنت مع النبي صلى الله عليه وسلم فسمع مثل هذا فصنع مثل هذا
অর্থাৎ একবার চলার পথে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা বাঁশির আওয়াজ শুনলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দুই কানে আঙ্গুল দিলেন। কিছু দূর গিয়ে আমার নিকট জিজ্ঞাসা করলেন, হে নাফে’! এখনো কি আওয়াজ শুনছ? আমি বললাম হ্যাঁ। অতঃপর আমি যখন বললাম, এখন আর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না তখন তিনি কান থেকে আঙ্গুল সরালেন এবং বললেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চলার পথে বাঁশির আওয়াজ শুনে এমনই করেছিলেন। বস্তুত যারা এসব থেকে দূরে থাকবে তাদেরকে সুসংবাদ জানিয়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যখন কিয়ামত কায়েম হবে, তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, তোমরা কোথায়? যারা দুনিয়াতে শয়তানের গান বাজনা থেকে দুরে সরে ছিলে? তাদেরকে পৃথক করে মিশক অম্বরের সুগন্ধি যুক্ত একটি টিলার পাশে দাঁড় করানো হবে, অতঃপর আল্লাহ তা’আলা ফিরিস্তাদের বলবেন, তাদেরকে আমার তাসবিহ ও প্রশংসা শুনাও, তারা এমনভাবে শুনবেন যে, এ রকম সুন্দর আওয়াজ দুনিয়াতে কেউ কখনো শুনেনি।
উপরোক্ত বর্ণনা সমূহে অশ্লীল গান-বাজনার কুফল ও শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।