হালাল-হারাম

হালাল-হারাম

 হালাল হারাম

হালাল শব্দের অর্থ অনুমোদিত বা সিদ্ধ বিষয়। শরীয়তের পরিভাষায়-

مَا اَجَازَہُ الشَّارِعُ فَہُوَ حَلَالٌ অর্থাৎ শরীয়ত প্রবর্তক যা করার বা বলার অনুমতি দিয়েছেন, তাই হালাল।

হাদীস শরীফে, রসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যা হালাল করেছেন তা-ই হালাল।

আর হারাম শব্দের আভিধানিক অর্থ নিষিদ্ধ বিষয়।

শরীয়তের পরিভাষায় وَمَانَہٰی عَنْہُ فَہُوَ حَرَامٌ  অর্থাৎ শরীয়ত প্রবর্তক যা স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছেন, যা করার পরিণামে পরকালে শাস্তি অনিবার্য, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে পার্থিব জীবনেও দণ্ডনীয় হতে হয় এরূপ বস্তু বা কাজকে হারাম বলা হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-

وَمَاحَرَّمَ اللّٰہُ فِیْ کِتَابِہٖ فَہُوَ حَرَامٌ وَمَا سَکَتَ عَنْہُ فَہُوَ عَفْوٌ فَاقْبَلُوْا مِنَ اللّٰہِ عَافِیَتَہٗ অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর কিতাবে যা হারাম করেছেন তা-ই হারাম। আর যে বিষয়ে কিছু এরশাদ করেন নি তা ক্ষমাযোগ্য। সুতরাং তোমরা মহান আল্লাহর ক্ষমাকেই গ্রহণ করো।

হালাল হারাম নির্ণয়ের উপায়

ইসলামী শরীয়তে হালাল ও হারাম নির্ধারণের মূলনীতি হলো প্রত্যেক বস্তুর মৌলিকত্ব হচ্ছে হালাল, শরীয়ত প্রবর্তক দ্বারা অকাট্য ও সুষ্পষ্টরূপে কোন বস্তুকে হারাম করা প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তা নিঃসন্দেহে হালাল বা অনুমোদনযোগ্য বলে গণ্য হবে; সেটাকে নিছক ধারণা দ্বারা কিংবা কোন দুর্বল সূত্র দ্বারা হারাম বলা যাবে না। কারণ, মহান আল্লাহ সকল বস্তুই মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আর কল্যাণকর বস্তু মাত্রই হালাল বা বৈধ হওয়ার দাবী রাখে। তবে কিছু কিছু বস্তুর মধ্যে অল্প বিস্তর ক্ষতিকর বিষয়ও থাকে বিধায় ওই বস্তুর অবৈধতা বিবেচিত হয়। যেমন ক্বোরআন মাজীদে  خمر (মদ)میسر (জুয়াখেলা)সম্পর্কে বলা হয়েছে-

قُلْ فِیْہِمَا اِثْمٌ کَبِیْرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَاِثْمُہُمَا اَکْبَرُ مِنْ نَفْعِہِمَا অর্থাৎ হে রসূল,  সাল্লাল্লাহু ত ‘আলা আলায়কা ওয়াসাল্লাম আপনি বলে দিন, ওই দুঞ্চটির মধ্যে রয়েছে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য কিছু উপকারও। তবে ওই দুটির গুনাহ্‌ উভয়ের উপকার থেকে বড়।        [সূরা বাক্বারা ২১৯]

সুতরাং خمر  (মদ) এবং میسر  (জুয়া) এ দুটিকে হারাম করা হয়েছে।

আল্লাহ তা’আলা সকল বস্তুই যে মানুষের কল্যাণে সৃষ্টি করেছেন, তার প্রমাণ হচ্ছে- ہُوَ الَّذِیْ خَلَقَ لَکُمْ مَا فِی الْاَرْضِ جَمِیْعًا তরজমাঃ তিনি ওই মহান সত্ত্বা, যিনি তোমাদের কল্যাণার্থে পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন।  [সূরা বাক্বারা, আয়াত- ২৯]

একথা স্বতসিদ্ধ যে, সকল বস্তুর মৌলিকত্ব বৈধ বলে প্রমাণিত হওয়ার পর একেকটি নিশ্চিত সত্য করে হালাল বস্তু নিরূপণ করা সম্ভব নয়; বরং সে ক্ষেত্রে শুধু হারাম বলে ঘোষিত বস্তুসমূহকে চিহ্নিত করাই যথেষ্ট। কারণ, ওইগুলোর সংখ্যাই সীমিত। পক্ষান্তরে, হালালের সংখ্যা অসংখ্য। ক্বোরআনে পাকে এ প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে- وَقَدْ فَصَّلَ لَکُمْ مَا حَرَّمَ عَلَیْکُمْ

তরজমাঃ এবং তিনি তোমাদের জন্য বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন যা কিছু তিনি তোমাদের উপর হারাম করেছেন।             [সূরা আন’আম, আয়াত- ২৯]

মহান আল্লাহ যে সব বস্তুকে হারামের পর্যায়ভুক্ত করেছেন, সেগুলোই হারাম বলে গণ্য হবে। এ ছাড়া অপরাপর যাবতীয় বস্তুই তার মৌলিক অবস্থায় হালাল হিসেবে থাকবে।

ইসলাম মানবতার ধর্ম, বিশ্ব মানবের সার্বিক কল্যাণই ইসলামের লক্ষ্য। তাই ইসলাম মানুষের জন্য ওই সকল বস্তুর পক্ষে সম্মতি দিয়েছে, যা পবিত্র ও নিষ্কলুষ। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন-  یٰٓاَیُّہَا النَّاسُ کُلُوْا مِمَّا فِی الْاَرْضِ حَلاَلاً طَیِّبًا وَلاَ تَتَّبِعُوْا خُطُوَاتِ الشَّیْطَانِ اِنَّہٗ لَکُمْ عَدُوٌّ مِّبِیْنٌ

তরজমাঃ হে লোকেরা! তোমরা ওই হালাল ও পবিত্র বস্তু আহার করো, যা যমীনে রয়েছে এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে প্রকাশ্য শত্রু।

অতঃপর মহান আল্লাহ তা’আলা অপবিত্রগুলোকে চিহ্নিত করে, মু’মিন বান্দারকে সম্বোধন করে এরশাদ করেন-

اِنَّمَا حَرَّمَ عَلَیْکُمُ الْمَیْتَۃَ وَالدَّمَ وَلَحْمَ الْخِنْزِیْرِ وَمَآ اُحِلَّ بِہٖ لِغَیْرِ اللّٰہِج فَمَنِ اضْطُرَّ غَیْرَ بَاغٍ وَلاَ عَادٍ فَلاَ اِثْمَ عَلَیْہِ طاِنَّ اللّٰہَ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ  তরজমাঃ তিনি এসবই তোমাদের উপর হারাম করেছেন- মড়া, রক্ত, শুকরের মাংস এবং ওই পশু, যাকে আল্লাহ ব্যতীত অন্যকারো নাম নিয়ে যবেহ করা হয়েছে; তবে যে ব্যক্তি অনন্যোপায় হয়ে, না এমন যে, একান্ত কামনার বশবর্তী হয়ে আহার করে, এমনও নয় যে, প্রয়োজনের সীমা লঙ্ঘন করে, তবে তার গুনাহ্‌ হবে না। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল, দয়ালু।            [২ :১৭৩]

মহান আল্লাহ আরো এরশাদ করেন-

اُحِلَّ لَکُمْ صَیْدُ الْبَحْرِ وَطَعَامَہٗ مَتَاعًالَّکُمْ وَلِلسَّیَّارَۃِج وَحَرَّمَ عَلَیْکَ صَیْدَ الْبَرِّ مَادُمْتُمْ حُرُمًاط

তরজমাঃ হালাল করা হয়েছে তোমাদের জন্য সমুদ্রের শিকার এবং তা ভক্ষণ করা; তোমাদের ও মুসাফিরদের উপকারার্থে; এবং তোমাদের জন্য হারাম স্থলের শিকার যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা ইহরাম অবস্থায় থাকবে।           [৫:৯৬]

পক্ষান্তরে, মদ ও জুয়া মানুষের চরিত্র বিধ্বংসী। এ দু’টি মানুষের প্রভূত ক্ষতি সাধন   করে; যার কারণে মহান আল্লাহ পবিত্র ক্বোরআনে মদ ও জুয়াকে হারাম করেছেন। তিনি এরশাদ করেন-

یٰٓاَیُّہَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا اِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَیْسِرُ وَالْاَنْصَابُ وَالْاَزْلاَمُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّیْطَانِ فَاجْتَنِبُوْہُ لَعَلَّکُمْ تُفْلِحُوْنَ O

তরজমাঃ হে ঈমানদারগণ! জুয়া মূর্তি এবং ভাগ্য-নির্ণায়ক শর অপবিত্র, শয়তানী কাজ। সুতরাং তোমরা তা থেকে বেঁচে থাকো, যাতে তোমরা সাফল্য লাভ করো। [৫:৯০]

অনুরূপ, হারাম কাজে সহযোগিতা করা বা মদদ যোগানো হারাম। সুতরাং সুদ খাওয়া যেমন হারাম, সুদ দেয়াও হারাম। সুদী লেন-দেনের চুক্তিপত্র লিখা, তাতে সাক্ষী হওয়া, সুদ আদায়ে কোন প্রকার সহযোগিতা করা সবকিছু হারাম। অনুরূপ, ব্যভিচার হারাম, এ হারাম কাজে যাবতীয় সহায়তা ও সহযোগিতাও হারাম। যথা- যুবক-যুবতীর অবাধ মেলামেলা, তাদের নির্জনে একত্রিত হওয়া, অবাধ দেখা-সাক্ষাৎ করা, নগ্ন, উলঙ্গ ও যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধিকারী ছবি দেখা, অশ্লীল পত্র-পত্রিকা ও চিত্র দেখা ইত্যাদি ব্যভিচারের মতই হারাম। অতএব, হারাম কাজের সহায়ক কাজও হারাম আর হালাল কাজের সহায়ক কাজও হালাল। ক্বোরআনে পাকে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন-تَعَاوَنُوْا عَلَی الْبِرِّ وَالتَّقْوٰی وَلاَ تَعَاوَنُوْا عَلَی الْاِثْمِ وَالْعُدْوَانِ  

তরজমাঃ তোমরা সৎকাজে ও খোদাভীরুতায় পরস্পরের সহযোগিতা করো আর পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করো না। [সূরা মা-ইদাহ্‌, আয়াত-২]

উপরোক্ত আয়াতের মর্মানুসারে স্পষ্টত বুঝা গেলো যে, যেমনিভাবে সৎকাজে এবং খোদাভীরুতার কাজে একজন অন্যজনকে সহযোগিতা করা প্রয়োজন, তেমনিপাপ ও যাবতীয় যুল্‌ম ও সীমালঙ্ঘনের কাজে একজন অপরজনকে সহযোগিতা করাও  হারাম নৎ ংথংরষ।

অনুরূপ হারামকে হালাল করার উদ্দেশ্যে কৌশল ও ফন্দি আবলম্বন করাও শরীয়তে হারাম, ইহুদীগণ এমনি অপকৌশল অবলম্বন করে হারামকে হালাল করতে দ্বিধাবোধ করতো না। যার তারা বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামও স্বীয় উম্মতের উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়ে এরশাদ করেন-لاَ تَرْکَبُوْا مَا ارْتَکَبَہُ الْیَہُوْدُ وَتَسْتَحِلُّوْا مَحَارِمَ اللّٰہِ بِاَدْنٰی الْحِیَلِ

অর্থাৎ ইহুদীগণ যে কাজ করেছিলো, তোমরা সে কাজ করো না আর আল্লাহ তা’আলার হারামকৃত বস্তুসমূহকে নগণ্য কৌশল ও ফন্দি অবলম্বন করে অর্থাৎ হালাল করেনা।

এভাবে ইসলাম শালীনতা রক্ষাকারী কার্যাদি হালাল এবং বৈধ করেছে। যেমন পুরুষের যৌন চাহিদা পুরণের লক্ষ্যে ইসলাম বিবাহ বন্ধনের ব্যবস্থা করেছে। ক্বোরআনে পাকে এরশাদ হয়েছে- فَانْکِحُوْا مَا طَابَ لَکُمْ مِنَ النِّسَآءِ مَثْنٰی وَثُلاَثَ وَرُبٰعَ

তরজমাঃ তোমরা নারীদের মধ্য হতে তোমাদের পছন্দ অনুসারে দুই-দুই, তিন-তিন, চার-চার নারী পর্যন্ত বিবাহ করতে পারো। অর্থাৎ একত্রে চারজন নারী পর্যন্ত বিবাহ করার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। পবিত্র ক্বোরআনের উপরোক্ত নির্দেশাবলীর মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনের ঘোষণার সাথে সাথে ব্যভিচার ও অশ্লীলতাকে হারাম ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন- اَلزَّانِیَۃُ وَالزَّانِیْ فَاجْلِدُوْا کُلَّ وَاحِدٍ مِنْہُمَا مِاءَۃَ جَلْدَۃٍ …… اَلایت

তরজমাঃ ব্যাভিচারীনী ও ব্যাভিচারী এদের প্রত্যেককে একশ’ করে চাবুক মারো। [সূরা নূর, আয়াত- ২]

অবিবাহিত ব্যাভিচারী ও ব্যাভিচারিণীর এই শাস্তি। বিবাহিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীর শাস্তি হল ‘রাজ্‌ম’ বা পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে হত্যা করা।

ইসলামী শরীয়তে অশ্লীলশতা ও ব্যাভিচারের পথরোধ কল্পে পবিত্র বিবাহ প্রথার প্রবর্তন করা হয়েছে।

এভাবে মহা পবিত্র ইসলামী শরীয়ত পবিত্র ও উপকারী বস্তুকে হালাল এবং বৈধ করেছে আর অপবিত্র, অশ্লীল ও অপকারী বস্তুকে হারাম ও নিষিদ্ধ করেছে। এটাই ইসলামী শরীয়তে হালাল-হারামের যৌক্তিকতা ও যথার্থতা।