দ্বীন প্রচার (দা’ওয়াত)-এর গুরুত্ব ও পদ্ধতি

দ্বীন প্রচার (দা’ওয়াত)-এর গুরুত্ব ও পদ্ধতি

সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী

প্রারম্ভিকা
আজ আমরা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। আর তা হলো দাওয়াত ও তাবলীগে দ্বীনের মহান দায়িত্ব, যা আম্বিয়া-ই কিরামের ওপর অর্পিত অভিন্ন দায়িত্ব বলে বিবেচিত। দাওয়াত-প্রচারের মহান দায়িত্ব নিয়েই আম্বিয়া-ই কিরাম প্রেরিত হয়েছেন যুগে যুগে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির কাছে। আল্লাহর প্রতি যাদের বিশ্বাস নেই, অথবা থাকলেও শিরক-মিশ্রিত অথবা বিকৃত, তাদের সঠিক পথের দিশা দেয়া, সরল সঠিক পথ তাদের সামনে পরিষ্কারভাবে উন্মোচিত করে তাদেরকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, যাতে ক্বিয়ামতের ময়দানে বলতে না পারে, আমাদের কাছে জান্নাতের সুসংবাদদাতা অথবা জাহান্নাম থেকে হুঁশিয়ারকারী হিসেবে কেউ আসেননি। ইরশাদ হয়েছে :
أَنْ تَقُولُوا مَا جَآءَنَا مِنْ بَشِيرٍ وَلَا نَذِيرٍ فَقَدْ جَآءَكُمْ بَشِيرٌ وَنَذِيرٌ وَاللهُ عَلٰى كُلِّ شَيْءٍ قَدِير
তরজমা: ‘যেন তোমরা না বলেন যে, আমাদের নিকট কোন সুসংবাদদাতা কিংবা সতর্ককারী আসেননি। অবশ্যই তোমাদের নিকট সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী এসেছেন। আর আল্লাহ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান’। [সূরা আল-মা-ইদাহ্: ১৯] ইসলাম একটি বিশ্বজনীন শান্তি ও কল্যাণের ধর্ম। এ শান্তির ধর্মের প্রচার-প্রসারের একমাত্র উপায় হলো দা’ওয়াত। যুগে যুগে মহান আল্লাহ তা‘আলা যে সকল নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন, তাঁদের সকলের কাযর্ক্রম ছিল এ সত্য ধর্মের প্রচার, সত্যের বাণী সকলের কাছে পৌঁছানো। আজ তাঁদের উত্তরসুরী হিসেবে একেকজন মুসলিমের অন্যতম প্রধান কর্তব্য হলো ‘ইসলামের দা’ওয়াত’ দেয়া। সত্যের বাণী তথা ক্বোরাআন-সুন্নাহর বাণী নিজেরা সঠিকভাবে জানবো, মেনে চলবো এবং অপরের কাছে তা পৌছিয়ে দেবো- এটাই হওয়া উচিত দা’ওয়াতের মূল কৌশল।
আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন। আর তা হলো একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার একক সত্তার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে কেবল তাঁরই ইবাদত করা, ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে অন্য কাউকে তাঁর সাথে শরীক না করা। ইরশাদ হয়েছে
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ، مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ مِنْ رِزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَنْ يُطْعِمُونِ.
তরজমা: ‘আর জিন্ ও মানুষকে আমি কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমারই ইবাদত করবে। আমি তাদের কাছে কোন রিয্ক্ব চাই না; আর আমি চাই না যে, তারা আমাকে খাবার দিক। [সূরা আয্যা-রিয়াত: ৫৬-৫৭] আর আল্লাহ তা‘আলা অসীম দয়ালু, করুণার আধার। তাই তিনি মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য, পৃথিবীতে মানুষের করণীয়, মানুষের সর্বশেষ গন্তব্য ইত্যাদি বিষয় সবিস্তারে বাতলিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নিজ ক্বুদরতের হাতে নিয়েছেন এবং নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে তার সুস্পষ্ট বিবরণ মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। কারণ মানুষ নিজ উদ্যোগে এসব বিষয়ের আদ্যোপান্ত জানতে অক্ষম আর এসব বিষয় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা অর্জিত না হলে মানুষ তার কর্তব্য নির্ধারণে ব্যর্থ হবে নিশ্চিতরূপেই। ফলে পরকালের শাশ্বত জীবনে বঞ্চিত হবে অফুরন্ত নিয়ামতপূর্ণ জান্নাত থেকে, বঞ্চিত হবে রাব্বুল আলামীনের মহা-আনন্দময় দীদার থেকে। শুধু তা নয়; বরং তার আবাস হিসেবে নির্ধারিত হবে মর্মন্তুদ শাস্তি ও অসহনীয় কষ্ট-যাতনার ভয়াবহ স্থান জাহান্নাম।
তাই নবী-রাসূলগণের মৌলিক দায়িত্ব ছিল মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করা, চিরন্তন সত্যের পথে আহ্বান করা, মানুষ যেসব সত্য নিজ থেকে আবিষ্কার করতে অক্ষম সেসব বিষয়ে তাকে অবহিত করা। আর যারা তাদের দাওয়াত গ্রহণ করবে তাদেরকে পরকালীন শাশ্বত সুখের সুসংবাদ দেয়া এবং যারা তা প্রত্যাখ্যান করবে তাদেরকে জাহান্নামী জীবনের দুঃসংবাদ পৌছিয়ে দেয়া, তাদেরকে জাহান্নাম থেকে হুঁশিয়ার করা। ইরশাদ হয়েছে
إِنَّا أَخْلَصْنَاهُمْ بِخَالِصَةٍ ذِكْرَى الدَّارِ
‘নিশ্চয় আমি তাদেরকে বিশেষ করে পরকালের স্মরণের জন্য নির্বাচিত করেছি।’ [সূরা সোয়াদ: ৪৬]

নবী-রাসূলগণ মানুষকে জাহান্নামী জীবন থেকে উদ্ধার করে জান্নাতের পথে নিয়ে আসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত সংবাদ অক্লান্ত পরিশ্রম করে, সীমাহীন নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। নবী-রাসূলগণ যেসব জাতি ও মানব সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছেন তাদেরকে পয়গামে ইলাহী পৌঁছিয়ে বালাগুল মুবীনের পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে গেছেন এবং তাদের ওপর আল্লাহ্র প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন। অর্থাৎ তাদেরকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে, তাদের কেউ আর বলতে পারবে না-‘আমাদের কাছে চির সুখের জান্নœাতী জীবনের পথ দেখানোর জন্য কেউ আসেনি। জান্নাতের সুসংবাদবাহক কেউ প্রেরিত হয়নি। অথবা মর্মন্তুদ শাস্তির ঠিকানা জাহান্নাম থেকে হুঁশিয়ারকারীও কেউ আসেনি।’
ইরশাদ হয়েছে-
رُسُلًا مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا
তরজমা: ‘আর (আমি পাঠিয়েছি) রাসূলগণকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে, যাতে আল্লাহর বিপক্ষে রাসূলগণ পর মানুষের জন্য কোন অজুহাত না থাকে। আর আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’। [সূরা আন-নিসা: ১৬৫] আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাবের মাধ্যমে নবী-রাসূল প্রেরণের ধারাবাহিকতার সমাপ্তি ঘটে। হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লামের পর আর কেউ নবী হিসেবে প্রেরিত হয়ে মানুষের কাছে আল্লাহর পয়গাম পৌঁছাতে আসবে না। যেহেতু পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মানব সম্প্রদায়ের বংশ বিস্তার অব্যাহত থাকবে, তাই যারা ঈমানহারা, যারা সত্যের পথ থেকে দূরে অবস্থান করে, তাদের কাছে আল্লাহর পয়গাম পৌঁছিয়ে দেয়ার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। তাদেরকে ঐশী আদর্শ ও মূল্যবোধ তথা ইসলামের প্রতি আহ্বানের দায়িত্ব রহিত হয়ে যায় নি, বরং খতমে নবূওতের পর দ্বীনের দা’ওয়াতের এ মহান দায়িত্ব উম্মতে মুহাম্মাদীর কাঁধে অর্পিত হয়েছে।
ইরশাদ হয়েছে-
قُلْ هٰذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللهِ عَلٰى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ
তরজমা: হে হাবীব, আপনি ‘বলুন, ‘এটা আমার পথ। আমি জেনে-বুঝে আল্লাহ্র দিকে দাওয়াত দিই এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও। আর আল্লাহ পবিত্র-মহান এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই’। [সূরা ইয়ূসুফ: ১০৮] তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসারী হিসেবে প্রতিটি ব্যক্তিকেই যার যার সাধ্য অনুযায়ী ইসলামের প্রচারমূলক কার্যক্রমের সাথে জড়িত থাকতে হবে। অন্যথায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসারী হওয়ার দাবি মিথ্যা বলে সাব্যস্ত হবে।
দা’ওয়াত তথা ইসলামের প্রচার-প্রসারে আমাদেরকে ঐকান্তিকভাবে কাজ করে যেতে হবে। এ পথে জান-মাল ব্যয় করতে হবে। কেবল নিজে সত্যোর অনুসারী হলে দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে না; বরং অন্যদেরকেও সত্যের দিকে আহ্বান করতে হবে।

দা’ওয়াহ্ বা দা’ওয়াত কি?
দা’ওয়াত হলো ব্যক্তি জীবন সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের এমন একটি পন্থা, যা দ্বারা এ মানবজাতিকে সত্যধর্ম ইসলামের প্রতি আহবান করা হয়, কুফরী হতে ঈমানের দিকে এবং অন্ধকার হতে আলোর দিকে পথ প্রদর্শন আর জীবনের সংকীর্ণতা হতে পার্থিব ও পরকালৌকিক জীবনের প্রশস্ত অবস্থায় রূপান্তরিত করা হয়। দা’ওয়াত বলতে শুধু ওয়াজ-নসীহত, মসজিদ-মহল্লায় গিয়ে নামায-রোযার কথা বলাকেই বোঝায় না, বরং এগুলো হলো দা’ওয়াতের অংশ বিশেষ। দাওয়াতী কার্যক্রমে শুধুমাত্র ইসলামের প্রতি আহবান নয়, বরং অমুসলিমসহ সকল মানবজাতির সামনে সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলামের কল্যাণ-মহিমা উপস্থাপন এবং ইসলাম গ্রহণের প্রতি আহবান জানানোকে বুঝায়।
দা’ওয়াতী কার্যক্রমে অভিজ্ঞ ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টি কর্তৃক বিজ্ঞান ও শিল্পসম্মত (শৈল্পিকভাবে ইসলামের মহিমা উপস্থাপন) উপায়ে ইসলামী জীবন-ব্যবস্থার দিকে মানব সমাজকে আকৃষ্ট করা, তা মেনে নেয়া এবং বাস্তব জীবনে তা চর্চার ব্যবস্থা করে দেয়ার পদ্ধতিগত ও শরীয়াহ মোতাবেক সকল প্রচেষ্টা ও কার্যাবলী অন্তর্ভুক্ত থাকে, তা-ই ইসলামী দা’ওয়াহ (দাওয়াত)।
নিজের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি নিজের আশেপাশে অবস্থানরত অন্যান্য মানুষের মধ্যে আল্লাহ্র দ্বীনকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করা মু’মিনের অন্যতম দায়িত্ব। এ জন্য মু’মিনের জীবনের একটি বড় দায়িত্ব হলো الامر بالمعروف والنهي عن المنكر (আল-আমরু বিল মা’রূফ ওয়ান নাহ্য়ু ‘আনিল মুনকার। অর্থাৎ ন্যায় কাজের আদেশ ও অন্যায় থেকে নিষেধ করা। আদেশ ও নিষেধকে একত্রে ‘আদ্ দা’ওয়াতু ইলাল্লাহ্’ বা আল্লাহর দিকে আহবান বলা হয়। এ ইবাদত পালনকারীকে দা‘ঈ ইলাল্লাহ বা আল্লাহর দিকে আহবানকারী ও সংক্ষেপে দা‘ঈ অর্থাৎ দা’ওয়াতকারী বা দাওয়াত-কর্মী বলা হয়।

الدعوة (দা’ওয়াত) শব্দের অর্থ
‘দা’ওয়াত’ (الدعوة) একটি আরবী শব্দ, যার অর্থ ডাকা, আহবান করা। ইসলামের দাওয়াতের সারকথা হচ্ছে- মানুষকে দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের মুক্তির দিকে আহবান করা।
ইসলামের আবির্ভাব শুধু ব্যক্তির কল্যাণের জন্য নয়; সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য ইসলাম। আর ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের সৌভাগ্য দু’টি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল: সালাহ ও ইসলাহ। অর্থাৎ নিজে সংশোধন হওয়া এবং অন্যকে সংশোধন করা। দা’ওয়াতের কাজ ছাড়া যা কখনো সম্ভব নয়।
اَلْأَمْرُ- আর আরবিতে (الأمر) বলতে আদেশ, নির্দেশ, উপদেশ, অনুরোধ, অনুনয় সবই বুঝায়।
النهى- অনুরূপভাবে নাহয়ু (النهى) বলতে নিষেধ, বর্জনের নির্দেশও অনুরোধ ইত্যাদি বুঝানো হয়।
ক্বোরআন-হাদীসে এই দায়িত্ব বুঝানোর জন্য আরো অনেক পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে: তন্মধ্যে রয়েছে ‘আত-তাবলীগ’ (التبليغ), ‘আন-নাসীহাহ্’ (النصيحة) ‘আল-ওয়া’য’ (الوعظ) ইত্যাদি।
التبليغ (আত-তাবলীগ)-এর অর্থ পৌঁছানো, প্রচার করা, খবর দেওয়া, ঘোষণা দেওয়া বা জানিয়ে দেওয়া।
النصيحة (আন-নাসীহাহ্) শব্দের অর্থ আন্তরিক ভালবাসা ও কল্যাণ কামনা। এ ভালবাসা ও কল্যাণ কামনাপ্রসূত ওয়ায, উপদেশ বা পরামর্শকেও নসীহত বলা হয়।
الوعظ (ওয়া’য) বাংলায় প্রচলিত অতি পরিচিত আরবী শব্দ। এর অর্থ উপদেশ, আবেদন, প্রচার, সতর্কীকরণ ইত্যাদি।
দা’ওয়াতের এ দায়িত্ব পালনকে ক্বোরআনুল কারীমে ‘ইক্বামতে দ্বীন’ বা দ্বীন প্রতিষ্ঠা বলে অভিহিত করা হয়েছে। এগুলোর সবই একই ইবাদতের বিভিন্ন নাম এবং একই ইবাদতের বিভিন্ন দিক। পরবর্তী আলোচনা থেকে আমরা তা বুঝতে পারব, ইনশাআল্লাহ।

ক্বোরআনের আলোকে দা’ওয়াত-এর গুরুত্ব
দা’ওয়াতী কাজের গুরুত্ব ও ফযীলত এত অধিক, যা কোনো মানুষ বাহ্যিক দৃষ্টিতে অনুধাবন করতে পারে না। পবিত্র কালামের অসংখ্য আয়াত এর পক্ষে উজ্জ্বল সাক্ষী। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন-
وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِّمَّن دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ
তরজমা: ওই ব্যক্তির কথার চেয়ে ভালো কথা আর কার হতে পারে, যে আল্লাহ্র প্রতি আহবান করে, সৎ কাজ করে এবং বলে, আমি অনুগতদের একজন?
[সূরা হামীম আস্ সাজ্দাহ : ৩৩] এই আয়াতে ওই সকল বিশেষ প্রিয়ভাজন বান্দার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যারা এক আল্লাহর প্রভুত্বে বিশ্বাস স্থাপন করে নিজেদের স্থিরতা ও দৃঢ়তার প্রমাণ দিয়েছে। এখানে তাদের অপর একটি উচ্চ মর্যাদার কথা আলোচনা করা হয়েছে। অর্থাৎ উত্তম ও উৎকৃষ্ট লোক ওই ব্যক্তি, যে একমাত্র আল্লাহর জন্য নিজেকে নিবেদিত করে তাঁর আনুগত্য ও নির্দেশ পালনের ঘোষণা দেয়, তাঁর মনোনীত পথে চলে এবং দুনিয়াবাসীকে তাঁর দিকে আসার আহবান জানায়। তার কথা ও কাজ অন্যদেরকে আল্লাহর পথে আসার জন্য প্রভাবিত করে। লোকজনকে সে যে সকল ভালো কাজের দাওয়াত দেয় সে নিজেও সেগুলো অনুসারে আমল করে।

নবী-রাসূলগণের মূল দায়িত্ব
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ, প্রচার, নসীহত, ওয়া’য এক কথায় আল্লাহর দ্বীন পালনের পথে আহবান করাই ছিল সকল নবী ও রাসূল (আলাইহিমুস সালাম)-এর দায়িত্ব। সকল নবীই তাঁর উম্মতকে তাওহীদ, রিসালত ও ইবাদতের আদেশ করেছেন এবং শিরক, কুফর ও পাপকাজ থেকে নিষেধ করেছেন।
মহান আল্লাহ বলেন-
الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِندَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنجِيلِ يَأْمُرُهُم بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنكَرِ
তরজমা: “যারা অনুসরণ করে এ রসূল, বাহ্যিক কোন ওস্তাদের কাছে পড়াবিহীন অদৃশ্য সংবাদদাতার, যাঁর উল্লেখ তারা তাদের নিকট রক্ষিত তাওরাত ও ইনজীলে লিপিবদ্ধ পায়, যিনি তাদেরকে সৎকাজের নির্দেশ দেন এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করেন। [সূরা আ’রাফ: ১৫৭] এ আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কর্মকে আদেশ ও নিষেধ নামে অভিহিত করা হয়েছে।
অন্যত্র এ কর্মকে দা’ওয়াত বা আহ্বান নামে অভিহিত করা হয়েছে। আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা এরশাদ করেন-
وَمَا لَكُمْ لا تُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَالرَّسُولُ يَدْعُوكُمْ لِتُؤْمِنُوا بِرَبِّكُمْ وَقَدْ أَخَذَ مِيثَاقَكُمْ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ
তরজমা: “তোমাদের কি হল যে, তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনছো না, অথচ রাসূল তোমাদেরকে এ মর্মে আহবান করছেন যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আন। [সূরা হাদীদ: ৮] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এ দায়িত্বকে দা’ওয়াত বা আহবান বলে অভিহিত করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন-
ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهٖ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ
তরজমা: ‘‘আপনি আপনার প্রতিপালকের দিকে আহবান করুন হিকমত বা প্রজ্ঞা দ্বারা এবং সুন্দর ওয়া’য-উপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে উৎকৃষ্টতর পদ্ধতিতে আলোচনা-বিতর্ক করুন। [সূরা নাহ্ল: ১২৫] অন্যত্র এই দায়িত্বকেই তাবলীগ বা দ্বীন প্রচার বলে অভিহিত করা হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এরশাদ করেন-
يَآأَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَالله يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ الله لا يَهْدِى الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ ـ
তরজমা: ‘‘হে রাসূল! আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তা আপনি প্রচার করুন। যদি আপনি তা না করেন তাহলে আপনি আল্লাহর বার্তা প্রচার করলেন না।” [সূরা মা-ইদাহ্ : ৬৭] ক্বোরআনুল কারীমে বারবার এরশাদ হয়েছে যে, প্রচার বা পোঁছানোই রাসূলগণের একমাত্র দায়িত্ব।

নি¤েœ বর্ণিত আয়াতে এরশাদ হয়েছে-
وَمَا عَلَيْنَا إِلاَّ الْبَلاَغُ الْمُبِينُ
তরজমা: আমরা রাসূলগণের দায়িত্ব তো কেবল সুস্পষ্টভাবে প্রচার করা।
[সূরা: ইয়াসীন- ১৭] হযরত নূহ আলায়হিস্ সালাম-এর জবানিতে এরশাদ হয়েছে-
أُبَلِّغُكُمْ رِسَالَاتِ رَبِّي وَأَنْصَحُ لَكُمْ وَأَعْلَمُ مِنَ اللهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ
“আমি আমার প্রতিপলকের রিসালাতের দায়িত্ব তোমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিচ্ছি এবং আমি তোমাদের নসীহত করছি।’’ [সূরা আ’রাফ: ৬২] সূরা আ’রাফের ৬৮, ৭৯, ৯৩ নম্বর আয়াত, সূরা হুদ-এর ৩৪ নম্বর আয়াত ও অন্যান্য স্থানে দা’ওয়াতকে নসীহত বলে অভিহিত করা হয়েছে।
সূরা শুরার ১৩নম্বর আয়াতে এরশাদ করেছেন-
شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ مَا وَصّٰى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهٖ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِينَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَيْهِ اللَّهُ ط يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَن يَشَآء وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَن يُنِيبُ О
তরজমা: “তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন দ্বীন, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন নূহ আলায়হিস্ সালামকে আর যা আমি ওহী করেছি আপনাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহীম, মূসা এবং ঈসাকে, এ বলে যে, তোমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠা কর এবং তাতে দলাদলি-বিচ্ছিন্নতা করো না। আপনি মুশরিকদেরকে যার প্রতি আহবান করছেন তা তাদের নিকট দুর্বহ মনে হয়। আল্লাহ্ আপন নৈকট্যের জন্য মনোনিত করে নেন যাকে চান এবং নিজের দিকে পথ প্রদান করেন তাকেই, যে প্রত্যাবর্তন করে। [সূরা শুরা: ১৩] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَذَكِّرْ فَإِنَّ الذِّكْرَى تَنْفَعُ المُؤْمِنِينَ
তরজমা: ‘‘আর আপনি বুঝাতে থাকুন। কারণ বুঝানো ঈমানদারদের উপকারে আসে।’’ [সূরা যা-রিয়াত, আয়াত : ৫৫] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ করে আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন-
يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ . قُمْ فَأَنذِرْ . وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ
‘‘হে বস্ত্রাবৃত! উঠুন, সতর্কবাণী প্রচার করুন এবং আপনার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন।’’ [সূরা মুদ্দাস্সির:১-৩] উম্মতে মুহাম্মদীর অন্যতম দায়িত্ব ও বৈশিষ্ট্য
দা’ওয়াত, আদেশ-নিষেধ, দ্বীন প্রতিষ্ঠা বা নসীহতের এ কাজই উম্মতে মুহাম্মাদীর অন্যতম দায়িত্ব ও বৈশিষ্ট্য।
ইরশাদ হয়েছে-
وَلْتَكُن مِّنكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ ۚ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
তরজমা: আর যেন তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের প্রতি আহবান করবে, ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম। [সূরা আলে ইমরান: ১০৪] অন্যত্র মহান আল্লাহ এরশাদ করেন –
كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللّهِ
তরজমা: “তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, মানবজাতির (কল্যাণের) জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে। তোমরা ন্যায়কার্যের আদেশ এবং অন্যায় কার্যে নিষেধ কর এবং আল্লাহতে বিশ্বাস কর।’’ [সূরা আলে ইমরান: ১১০] প্রকৃত মু’মিনের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন-
يُؤْمِنُونَ بِالله وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُسارِعُونَ فِي الْخَيْراتِ وَأُولئِكَ مِنَ الصَّالِحِينَ
“তারা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে এবং তারা ভাল কাজের আদেশ দেয় ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করে। আর তারা কল্যাণকর কাজে দ্রুত ধাবিত হয় এবং তারা নেক্কারদের অন্তর্ভুক্ত।’’ [সূরা আলে ইমরান: ১১৪] আল্লাহ তাবারকা ওয়া তা‘আলা আরও বলেন-
وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللهَ وَرَسُولَهُ ط أُولَٰئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللهُ ط إِنَّ اللهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
তরজমা: “আর মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারীরা একে অপরের বন্ধু, তারা ভাল কাজের আদেশ দেয় আর অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করে, আর তারা সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। এদেরকে আল্লাহ শীঘ্রই অনুগ্রহ করবেন, নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
[সূরা তাওবা: ৭১] সূরা তাওবার ১১২ আয়াতে, সূরা হজ্জের ৪১ আয়াতে, সূরা লোক্বমানের ১৭ নম্বর আয়াতে ও অন্যান্য স্থানেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহর প্রকৃত মু’মিন বান্দাদের অন্যতম বৈশিষ্ট হলো সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ।
এভাবে আমরা দেখছি যে, ঈমান, নামায, রোযা ইত্যাদি ইবাদতের মত সৎকাজের নির্দেশ ও অসৎকাজের নিষেধ মু’মিনের অন্যতম কর্ম। শুধু তা নয়, মু’মিনদের পারস্পারিক বন্ধুত্বের দাবি হলো যে, তারা একে অপরের অন্যায় সমর্থন করেন না, বরং একে অপরকে ন্যায়কর্মে নির্দেশ দেন এবং অন্যায় থেকে নিষেধ করেন। এখানে আরও লক্ষণীয় যে, এ সকল আয়াতে ঈমান, নামায, যাকাত ইত্যাদির আগে সৎকার্যের আদেশ ও অসৎকার্যে নিষেধ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে আমরা মু’মিনের জীবনে এর সবিশেষ গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি।
অন্য জায়গায় আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন
وَالْعَصْرِ Ñ إِنَّ الإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ Ñإِلا الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ
“মহাকালের শপথ, নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা নয়, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়।’ [সূরা আসর] অর্থাৎ ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মানুষের চারটি জিনিস প্রয়োজন :
ক) আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান আনা এবং তাদের হিদায়ত ও প্রতিশ্রুতির প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করা-তা দুনিয়া সম্পর্কিত হোক, কিংবা আখিরাত সম্পর্কিত হোক।
খ) ওই ঈমান ও ইয়াক্বীনের প্রভাব কেবল মন-মানস পর্যন্ত সীমাবদ্ধ না রাখা; বরং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও তা প্রকাশ করা এবং বাস্তব জীবনে আন্তরিক বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটানো।
গ) কেবল নিজের ব্যক্তিগত সংস্কার ও কল্যাণ নিয়েই তুষ্ট না থাকা, বরং দেশ ও জাতির সামষ্টিক স্বার্থকেও সম্মুখে রাখা। দু’জন মুসলমান একত্রে হলে নিজের কথা এবং কাজ দ্বারা একে অপরকে সত্য দ্বীন মেনে চলার এবং প্রতিটি কাজে সত্য ও সততা অবলম্বনের তাকীদ দেওয়া।
ঘ) প্রত্যেকে একে অপরকে এ নসীহত ও ওসীয়ত করা যে, সত্য ও ন্যায়ের ক্ষেত্রে এবং ব্যক্তিগত ও জাতীয় সংস্কার-সংশোধনের ক্ষেত্রে যত বাধা-বিপত্তি, যত অসুবিধা ও বিপদাপদ দেখা দেবে, এমনকি যদি মন-মানসের বিরোধী কাজও বরদাশত করতে হয় তাহলেও ধৈর্য ও সবরের সঙ্গে তা বরদাশ্ত করতে হবে। পুণ্য ও কল্যাণের পথ থেকে পা যেন কখনো ফসকে না যায় এই ওসীয়ত করতে হবে।
যে সৌভাগ্যবান ব্যক্তির মধ্যে এ চারটি গুণের সমাবেশ ঘটবে এবং যিনি নিজে পূর্ণাঙ্গ হয়ে অন্যদেরকে পূর্ণাঙ্গ করার চেষ্টা চালাবেন, কালের পৃষ্ঠায় তিনি অমর হয়ে থাকবেন। আর এমন ব্যক্তি যেসব নিদর্শন রেখে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবেন তা ‘বাক্বিয়াতে সালেহাত’ তথা অবশিষ্ট নেক কাজ হিসেবে সর্বদা তার নেকীর খাতায় সংযোজন ঘটাবে।
বস্তুত এ ছোট সূরাটি সমস্ত দ্বীন ও হিকমতের সার-সংক্ষেপ। ইমাম শাফে‘ঈ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি যথার্থ বলেছেন যে, ক্বোরআন মজীদে কেবল যদি এ সূরাটিই নাযিল করা হতো, তাহলে (সমঝদার) বান্দাদের হিদায়তের জন্য যথেষ্ট ছিল। পূর্বকালের মনীষীদের মধ্যে দু’জন একত্র হলে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় তারা একে অপরকে সূরাটি পাঠ করে শুনাতেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মত হওয়ার কারণে আমাদের উপরও দা’ওয়াতের কাজ জরুরি। যেমন সূরা ইয়ূসুফে আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন-
قُلْ هَٰذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللهِ قف عَلَىٰ بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي ط وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ ০
তরজমা: “বলুন, ‘এই আমার পথ। আল্লাহর দিকে ডাকি বুঝে-শুনে আমি এবং যারা আমার সঙ্গে আছে। আল্লাহ পবিত্র এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।’
[সূরা ইয়ূসুফ : ১০৮] এই দায়িত্ব পালনকারী মু’মিনকেই সর্বোত্তম বলে ঘোষণা করা হয়েছে পবিত্র ক্বোরআনে।
মহান আল্লাহ এরশাদ করেন-
وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ
তরজমা: ‘‘ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা কথায় কে উত্তম যে আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহবান করে, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি তো মুসলিমদের একজন’’।
[সূরা ফুস্সিলাত: ৩৩] আমরা দেখেছি যে, আদেশ, নিষেধ বা দা’ওয়াত-এর আরেক নাম নসীহত। নসীহত বর্তমানে সাধারণভাবে উপদেশ অর্থে ব্যবহৃত হলেও মূল আরবিতে নসীহত অর্থ আন্তরিকতা ও কল্যাণ কামনা। কারো প্রতি আন্তিরকতা ও কল্যাণ কামনার বহি:প্রকাশ হলো তাকে ভাল কাজের পরামর্শ দেওয়া ও খারাপ কাজ থেকে নিষেধ করা। এ কাজটি মুমিনদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি অন্যতম দায়িত্ব; বরং এই কাজটির নামই দ্বীন । —০—
হাদীস শরীফের আলোকে দা’ওয়াতের গুরুত্ব
عن تميم بن أوس رضي الله عنه ، أن النبي صلى الله عليه وسلم قال ” الدِّينُ النَّصِيحَةُ”، قُلْنَا : لِمَنْ يَا رَسُولَ اللَّهِ ؟ قَالَ : “لِلهِ ، وَلِكِتَابِهٖ ، وَلِرَسُولِهٖ، وَلأَئِمَّةِ الْمُسْلِمِينَ وَعَامَّتِهِمْ
অর্থাৎ : “দ্বীন হলো নসীহত। সাহাবীগণ বললেন, ‘‘কার জন্য?’’ বললেন, ‘‘আল্লাহ্র জন্য, তাঁর কিতাবের জন্য, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য, মুসলিমগণের নেতৃবর্গের জন্য এবং সাধারণ মুসলিমদের জন্য।” [মুসলিম] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ নসীহতের জন্য সাহাবীগণের বায়‘আত তথা প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতেন। বিভিন্ন হাদীসে জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু মুগীরা ইবনে শু‘বাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু প্রমুখ সাহাবী বলেন-
عن جرير بن عبدالله – رضى الله عنه – قال: “بايعتُ رسول الله صلى الله عليه وسلم على إقامِ الصلاةِ وإيتاء الزكاةِ والنصحِ لكل مسلمٍ”. وفي رواية قال: بايعتُ النبي صلى الله عليه وسلم على السمعِ والطاعةِ فلقننى: “فيما استطعتَ”، والنصح لكل مسلم
অর্থাৎ : “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট বায়‘আত বা প্রতিজ্ঞা করেছি সালাত কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা ও প্রত্যেক মুসলিমের নসীহত (কল্যাণ কামনা) করার উপর”। [বোখারী-৭২০৪, মুসলিম-৫৬] এ অর্থে যে, তিনি সৎকার্যের আদেশ ও অসৎকার্যে নিষেধের বায়‘আত গ্রহণ করতেন। হযরত ওবাদাহ ইবনে সামিত ও অন্যান্য সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন-
عن عبادة بن الصامت رضي الله عنه : “بايَعْنَا رسول الله صلى الله عليه وسلم على السمعة والطاعة في المنشط والمكره، وعلى العدل في القول والعمل لا نخاف في ذلك لومة لائم”.
অর্থাৎ : “আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের হাতে বায়‘আত করেছি আনুগত্যের এবং সৎকর্মের আদেশ প্রদান ও অসৎকর্মের নিষেধের এবং এ কথার উপর যে, আমরা মহিমাময় আল্লাহর জন্য কথা বলব এবং সে বিষয়ে কোন নিন্দুকের নিন্দা বা গালি গালাজের তোয়াক্কা করব না।
[আহমাদ, বিভিন্ন গ্রহণযোগ্য সনদে] অনুরূপভাবে, নিজের পরিবার, নিজের অধীনস্থ মানুষগণ ও নিজের প্রভাবাধীন মানুষদের আদেশ-নিষেধ করা গৃহকর্তা বা কর্মকর্তার জন্য ফরযে আইন। কারণ আল্লাহ তাকে এদের উপর ক্ষমতাবান ও দায়িত্বশীল করেছেন এবং তিনি তাকে এদের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করবেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ يَقُولُ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْؤول عَنْ رَعِيَّتِهِ، الإِمَامُ رَاعٍ وَمَسْؤولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ فِي أَهْلِهِ وَهُوَ مَسْؤولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ،وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ فِي بَيْتِ زَوْجِهَا وَمَسْؤولَةٌ عَنْ رَعِيَّتِهَا، وَالْخَادِمُ رَاعٍ فِى مَالِ سَيِّدِهٖ ومَسْؤولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، قَالَ: وَحَسِبْتُ أَنْ قَدْ قَالَ: وَالرَّجُلُ رَاعٍ فِي مَالِ أَبِيهِ وَمَسْؤولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ- وَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَمَسْؤولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ – أخرجهما البخارى ومسلم فى صحيحهما عن ابن عمر
অর্থাৎ: “সাবধান! তোমরা সকলেই অভিভাবকত্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং প্রত্যেককেই তার দায়িত্বাধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। মানুষদের উপর দায়িত্বপ্রাপ্ত শাসক বা প্রশাসক হচ্ছে অভিভাবক এবং তাকে তার অধীনস্থ জনগণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। বাড়ীর কর্তাব্যক্তি তার পরিবারের সদস্যদের দায়িত্বপ্রাপ্ত অভিভাবক এবং তাকে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে। স্ত্রী তার স্বামীর বাড়ী ও তার সন্তান-সন্ততির দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং তাকে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে। খাদিম তার মালিকের সম্পদের ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং তার অধিনস্থ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। বর্ণনাকারী বলেন, আমার ধারণা ছিলো যে, তিনি এরশাদ করেছেন, পুরুষ দায়িত্বপ্রাপ্ত, সে তার অধিনস্থদের সম্পর্কে জবাবদিহি করবে। আর তোমাদের প্রত্যেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং তাকে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।
[ইমাম বোখারী ও মুসলিম এ দু’টি হাদীস তাদের সহীহ্ গ্রন্থে হযরত ইবনে ওমর থেকে বর্ণনা করেছেন] কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, অন্যায় ও অসৎকর্মের প্রতিবাদ করা শুধুমাত্র এদেরই দায়িত্ব; বরং তা সকল মুসলমানের দায়িত্ব। যিনি অন্যায় বা গর্হিত কর্ম দেখবেন তাঁর উপরেই দায়িত্ব হয়ে যাবে সাধ্য ও সুযোগমত তার সংশোধন বা প্রতিকার করা।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-
عَنْ أبي سعيد الخدري رضي الله عنه قال : سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : “مَنْ رَأٰى مِنْكُمْ مُنْكَراً فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهٖ، فَإنْ لمَ يَسْتَطِعْ فَبلِسانِهِ، فَإنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبقَلْبِهِ، وَذَلِكَ أضْعَفُ اْلإِيمَانِ”..
অর্থাৎ : “তোমাদের কেউ যদি কোনো অন্যায় দেখতে পায় তবে সে তাকে তার বাহুবল দিয়ে প্রতিহত করবে। যদি তাতে সক্ষম না হয় তবে সে তার বক্তব্যের মাধ্যমে (প্রতিবাদ) বা পরিবর্তন করবে। এতেও যদি সক্ষম না হয় তা হলে অন্তর দিয়ে তার পরিবর্তন (কামনা) করবে। আর এটা হলো ঈমানের দুর্বলতম পর্যায়।” [মুসলিম] এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, প্রত্যেক মু’মিনেরই দায়িত্ব হলো, অন্যায় দেখতে পেলে সাধ্য ও সুযোগ মত তার পরিবর্তন বা সংশোধন করা। এক্ষেত্রে অন্যায়কে অন্তর থেকে ঘৃণা করা এবং এর অবসান ও প্রতিকার কামনা করা প্রত্যেক মু’মিনের উপরই ফরয। অন্যায়ের প্রতি হৃদয়ের বিরক্তি ও ঘৃণা না থাকা ঈমান হারানোর লক্ষণ।
আমরা অগণিত পাপ, হারাম ও নিষিদ্ধ কর্মের সয়লাবের মধ্যে বাস করি। বারংবার দেখতে দেখতে আমাদের মনের বিরক্তি ও আপত্তি কমে যায়। তখন মনে হতে থাকে, এ তো স্বাভাবিক, বা এ তো হতেই পারে। পাপকে অন্তর থেকে মেনে নেওয়ার এ অবস্থাই হলো ঈমানের দুর্বলতা অবস্থা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যা নিষেধ করেছেন তাকে অর্থাৎ পাপ ও অন্যায়কে ঘৃণা করতে হবে, তা নিজের দ্বারা সংঘটিত হোক কিংবা বিশ্বের অন্য মানুষ দ্বারা সংঘটিত হোক। এ হলো ঈমানের ন্যূনতম দাবী।

দাওয়াতের হুকুম
যদি সমাজের একাধিক মানুষ কোনো অন্যায় বা শরীয়ত বিরোধী কর্মের কথা জানতে পারে বা দেখতে পায় তাহলে তার প্রতিবাদ বা প্রতিকার করা তাদের সকলের উপর সামষ্টিকভাবে ফরয তথা ফরযে কিফায়া। তাদের মধ্য থেকে কোনো একজন যদি এ দায়িত্ব পালন করেন তবে তিনি ইবাদতটি পালনের সাওয়াব পাবেন এবং তা বাকিদের পক্ষ থেকেও সম্পন্ন বলে বিবেচিত হবে। বাকি মানুষেরা তা পালন করলে সাওয়াব পাবেন, তবে পালন না করলে গোনাহগার হবেন না। আর যদি কেউই তা পালন না করেন তাহলে সকলেই গুনাহ্গার হবেন।
দু’টি কারণে তা ফরযে আইন বা ব্যক্তিগত ফরযে পরিণত হয়,
প্রথমত: ক্ষমতা। যদি কেউ জানতে পারেন যে, তিনিই এ অন্যায়টির প্রতিকার করার ক্ষমতা রাখেন, তাহলে তার জন্য তা ফরযে আইন-এ পরিণত হয়। পরিবারের অভিভাবক, এলাকা বা দেশের রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও নেতৃবৃন্দের জন্য এ দায়িত্বটি এ পর্যায়ে ফরযে আইন হয়। এ ছাড়া যে কোনো পরিস্থিতিতে যদি কেউ বুঝতে পারেন যে, তিনি হস্তক্ষেপ করলে বা কথা বললে অন্যায়টি বন্ধ হবে ন্যায়টি প্রতিষ্ঠিত হবে তবে তা তাঁর জন্য ফরযে আইন বা ব্যক্তিগতভাবে ফরয হয়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত: দেখা। যদি কেউ জানতে পারেন যে, তিনি ছাড়া অন্য কেউ অন্যায়টি দেখেনি বা জানেনি, তবে তার জন্য তা নিষেধ করা ও পরিত্যাগের জন্য দাওয়াত দেওয়া ‘ফরযে আইন’ বা ব্যক্তিগত ফরয’-এ পরিণত হয়। সর্বাবস্থায় এ প্রতিবাদ, প্রতিকার ও দাওয়াত হবে সাধ্যানুযায়ী- হাত দিয়ে মুখ দিয়ে অথবা অন্তর দিয়ে।

আল্লাহর পথে দা’ওয়াত-এর বিষয়বস্তু
দাওয়াত, আদেশ, নিষেধ, ওয়ায, নসীহত ইত্যাদির বিষয়বস্তু কী? আমরা কোন কোন বিষয়ের দা’ওয়াত বা আদেশ-নিষেধ করব? কোন্ বিষয়ের প্রতি কতটুকু গুরুত্ব দিতে হবে? আমরা কি শুধু নামায ও রোযা ইত্যাদি ইবাদতের জন্য দা’ওয়াত প্রদান করব? নাকি চিকিৎসা, ব্যবসা, শিক্ষা, সমাজ, মানবাধিকার, সততা ইত্যাদি বিষয়েও দাওয়াত প্রদান করব? আমরা কি শুধু মানুষদের জন্যই দা’ওয়াত প্রদান করব? নাকি আমরা জীব-জানোয়ার, প্রকৃতি ও পরিবেশের কল্যাণেও দা’ওয়াত ও আদেশ-নিষেধ করব?
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। ঈমান, বিশ্বাস, ইবাদত, মু‘আমালাত (লেনদেন) ইত্যাদি সকল বিষয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর বিস্তারিত নির্দেশনা রয়েছে। সকল বিষয়ই দা’ওয়াতের বিষয়। কিছু বিষয় বাদ দিয়ে শুধুমাত্র কিছু বিষয়ের মধ্যে দাওয়াতকে সীমাবদ্ধ করার অধিকার মু’মিনকে দেওয়া হয়নি। তবে গুরুত্বগত পার্থক্য রয়েছে। ক্বোরআনুল কারীম ও হাদীস শরীফে যে বিষয়গুলোর প্রতি দা’ওয়াতের বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে, মু’মিনও সেগুলোর প্রতি বেশি গুরুত্ব প্রদান করবেন।
আমরা জানি যে, ক্বোরআন ও হাদীসে প্রদত্ত গুরুত্ব অনুসারে মু’মিন-জীবনের কর্মগুলোকে বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছেঃ ফরযে আইন, ফরযে কিফায়া, ওয়াজিব, সুন্নাত, মুসতাহাব, হারাম, মাকরূহ, মুবাহ ইত্যাদি পরিভাষাগুলো আমাদের নিকট পরিচিত। কিন্তু অনেক সময় আমরা ফযীলতের কথা বলতে যেয়ে আবেগ বা অজ্ঞতা বশত এক্ষেত্রে মারাত্মক ভুল করে থাকি। নফল-মুসতাহাব কর্মের দা’ওয়াত দিতে যেয়ে ফরয, ওয়াজিব কর্মের কথা ভুলে যাই বা অবহেলা করি। এছাড়া অনেক সময় মুস্তাহাবের ফযীলত বলতে যেয়ে হারামের ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা বলা হয় না।
ক্বোরআন-হাদীসের দা’ওয়াত-পদ্ধতি থেকে আমরা দা’ওয়াত ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার আদেশ-নিষেধের বিষয়াবলীর গুরুত্বের পর্যায় নি¤œরূপ দেখতে পাইঃ

প্রথমত: তাওহিদ ও রিসালাতের উপর বিশুদ্ধ ঈমান অর্জন, পক্ষান্তরে সর্ব প্রকার শিরক, কুফর ও নিফাক্ব থেকে আত্মরক্ষা
সকল নবী আলায়হি দাওয়াতের বিষয় ছিল প্রথমত: এটি। ক্বোরআন-হাদীসে এ বিষয়ের দা’ওয়াতই সবচেয়ে বেশি দেওয়া হয়েছে। একদিকে যেমন তাওহীদের বিধানাবলী বিস্তারিত বর্ণনা করে তাওহীদ প্রতিষ্ঠার দা’ওয়াত দেওয়া হয়েছে, তেমনি বারংবার শিরক, কুফর ও নিফাক্বের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে তা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। বর্তমান সময়ে দ্বীনের পথে দা’ওয়াতে ব্যস্ত অধিকাংশ দা’ঈ এ বিষয়টিতে ভয়ানকভাবে অবহেলা করেন। অনেকে করি যে, আমরা তো মু’মিনদেরকেই দাওয়াত দিচ্ছি। কাজেই ঈমান-আক্বীদা বা তাওহীদের বিষয়ে দা’ওয়াত দেওয়ার, পক্ষান্তরে শিরক-কুফর থেকে নিষেধ করার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই।

দ্বিতীয়ত: বান্দা বা সৃষ্টির অধিকার সংশ্লিষ্ট হারাম বর্জন
আমরা জানি ফরযকর্ম দুই প্রকারঃ করণীয় ফরয ও বর্জনীয় ফরয। যা বর্জন করা ফরয তাকে হারাম বলা হয়। হারাম হচ্ছে আবার দুই প্রকারঃ প্রথম প্রকার হারাম, মানুষ ও সৃষ্টির অধিকার নষ্ট করা বা তাদের কোনো ক্ষতি করা বিষয়ক হারাম। এগুলি বর্জন করা সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ। পিতামাতা, স্ত্রী, সন্তান, অধীনস্থ, সহকর্মী, প্রতিবেশী, দরিদ্র, এতিম ও অন্যান্য সকলের অধিকার সঠিকভাবে আদায় করা, কোনোভাবে কারো অধিকার নষ্ট না করা, কাউকে যুল্ম না করা, গীবত না করা, ওজন-পরিমাপ ইত্যাদিতে কম না করা, প্রতিজ্ঞা ও চুক্তি পালনে দায়িত্ব বা আমানত রক্ষায় অবহেলা না করা, হারাম উপার্জন থেকে বিরত থাকা, নিজের বা আত্মীয়দের বিরুদ্ধে হলেও ন্যায় কথা বলা ও ন্যায় বিচার করা, কাফির শত্রুদের পক্ষে হলেও ন্যায়ানুগ পন্থায় বিচার-ফয়সালা করা ইত্যাদি বিষয় ক্বোরআন ও হাদীসের দা’ওয়াত এবং আদেশ নিষেধের অন্যতম গুরিত্বপূর্ণ বিষয়।
এমনকি রাস্তা ঘাট, মজলিস, সমাজ বা পরিবেশে কাউকে কষ্ট দেওয়া এবং কারো অসুবিধা সৃষ্টি করাকেও হাদীস শরীফে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। সৃষ্টির অধিকার বলতে শুধু মানুষদের অধিকারই বুঝানো হয়নি। পশুপাখির অধিকার সংরক্ষণ, মানুষের প্রয়োজন ছাড়া কোনো প্রাণীকে কষ্ট না দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে অত্যন্ত কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে। দা’ওয়াতের ক্ষেত্রে অনেক সময় এ বিষয়গুলি অবহেলিত। এমনকি অনেক দা‘ঈ বা দাওয়াতকর্মীও এ সকল অপরাধে জড়িত হয়ে পড়েন।
যেকোনো কর্মস্থলে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীর জন্য কর্মস্থলের দায়িত্ব পরিপূর্ণ আন্তরিকতার সাথে সঠিকভাবে পালন করা ফরযে আইন। যদি কেউ নিজের কর্মস্থলে ফরয সেবা গ্রহণের জন্য আগত ব্যক্তিকে ফরয সেবা প্রদান না করে তাকে পরদিন আসতে বলেন বা একঘন্টা বসিয়ে রেখে চাশতের নামায আদায় করেন বা দাওয়াতে অংশ গ্রহণ করেন তাহলে তিনি মূলত: ওই ব্যক্তির মত কর্ম করছেন, যে ব্যক্তি পাগড়ির ফযীলতের কথায় মোহিত হয়ে লুঙ্গি খুলে উলঙ্গ হয়ে পাগড়ি পরেছেন।
অধিকার ও দায়িত্ব বিষয়ক আদেশ-নিষেধ ক্বোরআন হাদীসে বেশি থাকলেও আমরা এ সকল বিষয়ে বেশি আগ্রহী নই। কর্মকর্তা, কর্মচারী, শিক্ষক, ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্যদেরকে কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন ও আন্তরিকতার সাথে সেবা প্রদানের বিষয়ে দা’ওয়াত ও আদেশ নিষেধ করতে আমরা আগ্রহী নই। অবৈধ পার্কিং করে, রাস্তার উপর বাজার বসিয়ে, রাস্তা বন্ধ করে মিটিং করে বা অনুরূপ কোনোভাবে মানুষের কষ্ট দেওয়া, অপ্রয়োজনীয় ধোঁয়া, গ্যাস, শব্দ ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষ বা জীব জানোয়ারকে কষ্ট দেওয়া বা প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা, দা’ওয়াত বা আদেশ-নিষেধ করাকে আমরা অনেকেই আল্লাহর পথে দাওয়াতের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করি না; বরং এগুলিকে জাগতিক, দুনিয়াবী বা আধুনিক বলে মনে করি।

তৃতীয়ত: পরিবার ও অধীনস্থদেরকে ইসলাম অনুসারে পরিচালিত করা
বান্দার হক, বা মানবাধিকার বিষয়ক দায়িত্বসমূহের অন্যতম হলো নিজের দায়িত্বাধীনদেরকে দ্বীনের দা’ওয়াত দেওয়া ও দীনের পথে পরিচালিত করা। দাওয়াতকর্মী বা দা‘ঈ নিজে যেমন এ বিষয়ে সতর্ক হবেন, তেমনি বিষয়টি দা’ওয়াতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গ্রহণ করবেন।
চতুর্থত: অন্যান্য হারাম বর্জন করা
হত্যা, মদপান, রক্তপান, শুকরের মাংস ভক্ষণ, ব্যভিচার, মিথ্যা, জূয়া, হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার, রিয়া ইত্যাদিও হারাম। দা‘ঈ বা দাওয়াতকর্মী নিজে এ সব থেকে নিজের কর্ম ও হৃদয়কে পবিত্র করবেন এবং এগুলো থেকে পবিত্র হওয়ার জন্য দা’ওয়াত প্রদান করবেন। আমরা দেখতে পাই যে, ক্বোরাআন ও হাদীসে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বারংবার বিভিন্নভাবে এ বিষয়ক দা’ওয়াত প্রদান করা হয়েছে।

পঞ্চমত: পালনীয় ফরয-ওয়াজিবগুলো আদায় করা
নামায, যাকাত, রোযা, হজ্জ, হালাল উপার্জন, ফরযে আইন পর্যায়ের ইলম শিক্ষা ইত্যাদি এ জাতীয় ফরয ইবাদত এবং দা’ওয়াতের অন্যতম বিষয়।

ষষ্ঠত: সৃষ্টির উপকার ও কল্যাণমূলক সুন্নাত-নফল ইবাদত করা
সকল সৃষ্টিকে তার অধিকার বুঝিয়ে দেওয়া ফরয। অধিকারের অতিরিক্ত সকলকে যথাসাধ্য সাহায্য ও উপকার করা ক্বোরআন-হাদীসের আলোকে সর্বশ্রেষ্ঠ নফল ইবাদত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সবচেয়ে সহজ ও প্রিয়তম পথ। ক্ষুধার্তকে আহার দেওয়া, দরিদ্রকে দারিদ্রমুক্ত করা, বিপদগ্রস্তকে বিপদ হতে মুক্ত হতে সাহায্য করা, অসুস্থকে দেখতে যাওয়া, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং যে কোনোভাবে যে কোনো মানুষের বা সৃষ্টির কল্যাণ, সেবা বা উপকারে সামান্যতম কর্ম ও আল্লাহর নিকট অত্যন্ত প্রিয়। ক্বোরআন ও হাদীসে এ সকল বিষয়ে বারংবার দা’ওয়াত ও আদেশ নিষেধ করা হয়েছে।

সপ্তমত: আল্লাহ ও তাঁর বান্দার মধ্যেকার সুন্নত-নফল ইবাদত করা
নফল নামায, রোযা, যিক্র, তিলাওয়াত, ফরযে কিফায়া বা নফল পর্যায়ের দা’ওয়াত দেওয়া, জিহাদ, নসীহত ও তায্কিয়া ইত্যাদি এ পর্যায়ের। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দা’ওয়াতে রত মু’মিনগণ ষষ্ঠ পর্যায়ের নফল ইবাদতের চেয়ে সপ্তম পর্যায়ের নফল ইবাদতের দা’ওয়াত বেশি প্রদান করেন। বিশেষত, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান তৈরি, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, চিকিৎসা সেবা প্রদান ইত্যাদি বিষয়ের দা’ওয়াত প্রদানকে আমরা আল্লাহ্র পথে দা’ওয়াত বলে মনেই করি না। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মানুষ ছাড়া অন্য কোনো জীব-জানোয়ারও যদি কোনো অন্যায় বা ক্ষতিকর কর্মে লিপ্ত থাকে, তাহলে সাধ্য ও সুযোগমত তার প্রতিকার করাও আদেশ নিষেধ ও কল্যাণ কামনার অংশ। যেমন কারো পশু বিপদে পড়তে যাচ্ছে বা কারো ফসল নষ্ট করছে দেখতে পেলে মু’মিনের দায়িত্ব হল সুযোগ ও সাধ্যমত তার প্রতিকার করা। তিনি এই কর্মের জন্য আদেশ-নিষেধ ও নসীহতের সাওয়াব লাভ করবেন। পূর্ববর্তী যুগের প্রাজ্ঞ আলিমগণ এ সকল বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন; কিন্তু বর্তমান সময়ে অনেকেই এ সকল বিষয়কে আল্লাহর পথে দা’ওয়াত বা দীন প্রতিষ্ঠার অংশ বলে বুঝতে পারেন না। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে পরিচালিত করুন।

দা’ওয়াত উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা
দা’ওয়াত উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা জরুরী। পুরো ইসলাম একসাথে উপস্থাপন করার পরিবর্তে প্রথমে আক্বীদা-বিশ্বাস দিয়ে শুরু করা। এরপর পর্যায়ক্রমে এগিয়ে যাওয়া উচিত। আল্লাহর প্রতি ঈমান, রাসূলের প্রতি ঈমান, আসমানী কিতাবের প্রতি ঈমান, আখিরাতের প্রতি ঈমান, ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান ইত্যাদি বিষয় সর্বাগ্রে উপস্থাপন করা। অর্থাৎ ঈমান ও আক্বীদা সংক্রান্ত বিষয়গুলো আগে উপস্থাপন করা। এসবের প্রতি যখন কোন ব্যক্তির ধারণা পরিষ্কার হয়ে যাবে এবং যথার্থভাবে এ বিশ্বাস স্থাপন করে নেবে, তখন পর্যায়ক্রমে তাকে আমলী বিষয়গুলোর প্রতি দা’ওয়াত দেয়া, যেমন নামায, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি। দা’ওয়াতী কার্যক্রমের ক্ষেত্রে এ ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরী। হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে এক বর্ণনায় এসেছে-
وَلَوْ نَزَلَ أَوَّلُ شَيْءٍ : لَا تَشْرَبُوْا الْخَمْرَ، لَقَالُوْا : لَا نَدَعُ الْخَمْرَ أَبَداً، وَلَوْ نَزَلَ : لَا تَزْنُوْا، لَقَالُوْا: لَا نَدَعُ الزِّنَا أَبَداً، لَقَدْ نَزَلَ بِمَكَّةَ عَلَى مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَإِنِّيْ لَجَارِيَةٌ أَلْعَبُ : {بَلِ السَّاعَةُ مَوْعِدُهُمْ وَالسَّاعَةُ أَدْهَى وَأَمَرُّ} . وَمَا نَزَلَتْ سُوْرَةُ الْبَقَرَةِ وَالنِّسَاءِ إِلَّا وَأَنَا عِنْدَهُ
অর্থাৎ : ‘যদি শুরুতেই নাযিল হতো ‘তোমরা মদপান করো না’, তবে তারা বলত, ‘আমরা কখনো মদ ছাড়ব না।, যদি শুরুতেই নাযিল হতো, ‘তোমরা যিনা করো না’, তবে তারা অবশ্যই বলত, ‘আমরা কখনো যিনা ছাড়ব না।’ মক্কায় হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লামের নিকট নাযিল হয়েছে- ((বরং কিয়ামত তাদের প্রতিশ্রুত সময়। আর ক্বিয়ামত অতি ভয়ঙ্কর ও তিক্ততর।)) তখন আমি ছিলাম ছোট বালিকা। আর সূরা বাক্বারা ও সূরা নিসা যখন নাযিল হলো তখন তো আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লামের ঘর করছি’। [বোখারী] তবে এক্ষেত্রে পরিবেশ ও পরিপার্শ্বিকতার দাবি ও চাহিদা সামনে রেখে কর্তব্য পালনে মনযোগী হতে হবে। গুরুত্বানুসারে দা’ওয়াতী কার্যক্রমের টার্গেটসমূহ ঢেলে সাজাতে হবে। যারা তাওহীদ ও রিসালতে অবিশ্বাসী, আল্লাহর নিরঙ্কুশ একত্ববাদে এবং রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লামের সার্বজনীন রেসালতে যাদের ঈমান নেই, তাদের প্রতি দা’ওয়াতী কার্যক্রমের প্রারম্ভিক বিন্দু হবে তাওহীদ ও রিসালতের প্রতি বিশ্বাসের আহ্বান। তাওহীদ ও রিসালতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপিত হলে নামাযের প্রতি আহ্বান। এরপর রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদির প্রতি পর্যায়ক্রমে আহ্বান। ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে-
حديث معاذ بن جبل رضي الله عنه: عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِمُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ حِينَ بَعَثَهُ إِلَى الْيَمَنِ إِنَّكَ سَتَأْتِي قَوْمًا أَهْلَ كِتَابٍ فَإِذَا جِئْتَهُمْ فَادْعُهُمْ إِلَى أَنْ يَشْهَدُوا أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لَكَ بِذَلِكَ فَأَخْبِرْهُمْ أَنَّ اللهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِي كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لَكَ بِذٰلِكَ فَأَخْبِرْهُمْ أَنَّ اللَّهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ فَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لَكَ بِذٰلِكَ فَإِيَّاكَ وَكَرَائِمَ أَمْوَالِهِمْ وَاتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ فَإِنَّهُ لَيْسَ بَيْنَهُ وَبَيْنَ اللهِ حِجَابٌ. )صحيح البخاري : كتاب الزكاة (৫৪৪باب أخذ الصدقة من الأغنياء وترد في الفقراء حيث كانوا , رقم الحديث- ১৪২৫(
অর্থাৎ : ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত মুআ’য ইবনে জাবাল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে যখন ইয়েমেনে পাঠান, তখন তাঁকে বললেন, ‘তুমি নিশ্চয় কিতাবীদের কাছে যাবে। তাই যখন তুমি তাদের কাছে যাবে, তাদেরকে এ কথার প্রতি সাক্ষ্য দানের আহ্বান জানাবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বূদ নেই এবং হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল। অতঃপর তারা যদি এ বিষয়ে তোমার আনুগত্য করে, তবে তাদেরকে জানিয়ে দেবে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের ওপর দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন। যদি তারা এ বিষয়ে তোমার আনুগত্য করে তবে তাদেরকে জানিয়ে দেবে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের ওপর যাকাত ফরয করেছেন, যা ধনীদের কাছ থেকে নিয়ে দরিদ্রদেরকে দেয়া হবে। যদি তারা এ ব্যাপারে তোমার অনুসরণ করে তবে তুমি তাদের সর্বোত্তম সম্পদ পরিহার করবে। আর মাযলুমের দো‘আ থেকে হুঁশিয়ার থাকবে; কেননা মাযলুম ব্যক্তি ও আল্লাহর মাঝে কোনো অন্তরাল নেই’। [বোখারী] হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে এক বর্ণনায় এসেছে যে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ , عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ , أَنَّهُ سُئِلَ ” أَيُّ الأَعْمَالِ أَفْضَلُ؟ قَالَ : إِيمَانٌ بِاللهِ وَرَسُولِهِ . قِيلَ : ثُمَّ مَاذَا؟ قَالَ : ثُمَّ الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ . قِيلَ : ثُمَّ مَاذَا ؟ قَالَ : ثُمَّ حِجٌّ مَبْرُورٌ) ” . هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحٌ مُتَّفَقٌ عَلَى صِحَّتِهِ , أَخْرَجَهُ الْبُخَارِيُّ , وَمُسْلِمٌ , مِنْ حَدِيثُ إِبْرَاهِيمَ بْنِ سَعْدٍ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করা হলো, ‘উত্তম আমল কোন্টি? তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান। বলা হলো, ‘এরপর কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ (জান মাল ব্যয়) করা’। বলা হলো, ‘এরপর কোন্টি?’ তিনি বললেন,‘মাবরুর হজ্জ্’। [বোখারী]

দা’ওয়াত প্রচারের ক্ষেত্রে হিকমত অবলম্বন, মাও‘ইযাহ্-ই হাসানাহ্ ও উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্কের গুরুত্ব
সূরা নাহল-এ আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন-
قوله تعالى : ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهٖ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ
অর্থাৎ: ‘ডাকুন স্বীয় প্রতিপালকের পথে হিকমত (সুন্দর কৌশল )এবং মাও‘ইযাহ্-ই হাসানাহ্ (উত্তমরূপে উপদেশ)সহকারে। আর তাদেরকে বিতর্কে নিরুত্তর করুন উত্তম পন্থায়।’ নিশ্চয় আপনার রব উত্তমরূপে জানেন তাকে, যে তাঁর পথ থেকে সরে গেছে আর তিনি হিদায়ত প্রাপ্তদেরকেও উত্তমরূপে জানেন।
[নাহ্ল-১২৫] এ আয়াতে খোদ নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর পক্ষ থেকে তা’লীম দেওয়া হচ্ছে মানুষকে কিভাবে পথে আনতে হবে। এর তিনটি পন্থা বলা হয়েছেঃ ক. হিকমত, খ. মাও‘ইযাহ্ হাসানাহ্ ও গ. জিদাল বিল্লাতী হিয়া আহসান (বিতর্কে উত্তমরূপে নিরুত্তর করা)।

হিকমত
দা’ওয়াত বা প্রচারের ক্ষেত্রে হিকমত একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দা’ওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তির সাথে দা’ওয়াতী সম্পর্ক কায়েম করার সঠিক পদ্ধতি কী হবে, কীভাবে তাকে ইসলামী আক্বীদা ও মূল্যবোধের প্রতি আগ্রহী করে তোলা যাবে, কখন ও কোন্ পদ্ধতিতে দা’ওয়াত দিলে সে অতি সহজে সত্য অনুধাবনে সক্ষম হবে, এসব বিষয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে হিকমতের আশ্রয় নেয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।
হিকমত অর্থাৎ মযবূত দলিল-প্রমাণের আলোকে প্রজ্ঞজনোচিত ভঙ্গিতে অত্যন্ত পরিপক্ক ও অকাট্য বিষয় বস্তু পেশ করতে হবে, যা শুনে সমঝদার ও জ্ঞানবান রুচিসম্পন্ন লোক তা মাথা পেতে মেনে নিতে বাধ্য হবে এবং দুনিয়ার কাল্পনিক দর্শনাদি তার সামনে ম্লান হয়েযায়। কোন রকম জ্ঞান-বিজ্ঞান ও চিন্তা-চেতনার বিকাশ যেন ওহী বর্ণিত তত্ত্ব ও তথ্যকে পরিবর্তন করতে না পারে।

মাও‘ইযাহ্-ই হাসানা
দা’ওয়াতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হলো মাও‘ইযাহ্-ই হাসানাহ্। মাও‘ইযা-ইযাহ্ হাসানাহ্ অর্থ সুন্দর ওয়াজ বা কথামালা। বাচনভঙ্গি থেকে শুরু করে দা’ওয়াতী কথার উপকরণ নির্ধারণ, ধারাবাহিকতা বজায় রেখে যুক্তি-প্রমাণ পেশ, কাহিনী বর্ণনা, জান্নাতের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা, জাহান্নামের ব্যাপারে ভয় ও শঙ্কা সৃষ্টি করা মাও‘ইযা-ই হাসানার অন্তর্ভুক্ত।
মাও‘ইযাহ-ই হাসানা দ্বারা মনোজ্ঞ ও হৃদয়গ্রাহী উপদেশকে বোঝানো হয়েছে, যা কোমল চরিত্র ও দরদী আত্মার রস ও আবেগে থাকবে ভরপুর। নিষ্ঠা, সহমর্মিতা, দরদ ও মধুর চরিত্র দিয়ে সুন্দর ও ভারসাম্যপূর্ণ পন্থায় যে নসীহত করা হয় তাতে অনেক সময় পাষাণ-হৃদয়ও মোম হয়ে যায়, মৃত দেহে প্রাণ সঞ্চার হয় এবং একটি হতাশ ও ক্ষয়ে যাওয়া জাতি গা ঝাড়া দিয়ে জেগে ওঠে। মানুষ ভয়-ভীতি ও আশাব্যঞ্জক বক্তব্য শুনে লক্ষ্যস্থলের দিকে ছুটে চলে প্রবল বেগে, বিশেষত যারা ততটা সমঝদার, ধীমান ও উচ্চ মেধা-মস্তিষ্কের অধিকারী নয়, অথচ অন্তরে সত্য-সন্ধানের স্পৃহা প্রবল, তাদের হৃদয়ে মনোজ্ঞ ওয়ায-নসীহত দ্বারা এমন কর্ম-প্রেরণা সঞ্চার করা যায়, যা উঁচু জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দ্বারা সম্ভব হয় না।

উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক করা
মাও‘ইযাহ্-ই হাসানার পরবর্তী পর্যায় হলো, ‘উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক করা’। অর্থাৎ যদি দাওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তি দাওয়াত দাতার সাথে বিতর্ক করতে চায়, অথবা পরিস্থিতি বিতর্কের দিকে গড়ায় তাহলে সে ক্ষেত্রে উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক করা। দুনিয়ায় সব সময় একটা দল এমনও থাকে, যাদের কাজই হচ্ছে প্রতিটি বিষয়ে জটিলতা সৃষ্টি করা এবং কথায় কথায় হুজ্জত করা ও কূটতর্কে লিপ্ত হওয়া। এরা না হিকমতপূর্ণ কথা ক্ববূল করে, না ওয়ায-নসীহতে কান দেয়। তারা চায় প্রতিটি বিষয়ে তর্ক-বিতর্কের ময়দান উত্তপ্ত হোক। অনেক সময় প্রকৃত বোদ্ধা, ন্যায়নিষ্ঠ ও সত্যানুসন্ধিৎসু স্তরের লোকদেরও সংশয়-সন্দেহ ঘিরে ধরে, আলোচনা-পর্যালোচনা ছাড়া তখন তাদেরও সন্তোষ লাভ হয় না। তাই বলা হয়েছে-‘আর তাদেরকে বিতর্কে নিরুত্তর কর উত্তম পন্থায়।’
অর্থাৎ কখনো এমন অবস্থার সম্মুখীন হলে তখন উৎকৃষ্ট পন্থায় সৌজন্য ও শিষ্টাচার এবং সত্যানুরাগ ও ন্যায়নিষ্ঠার সাথে তর্ক-বিতর্ক কর। প্রতিপক্ষকে নিরুত্তর করতে চাইলে তা উত্তম পন্থায় কর। অহেতুক বেদনাদায়ক ও কলজে-জ্বালানো কথাবার্তা বলো না, যা দিয়ে সমস্যার কোনো সুরাহা হয় না; বরং তা আরও জটিল হয়ে যায়। উদ্দেশ্য হওয়া উচিত প্রতিপক্ষকে বুঝিয়ে সন্তুষ্ট করা ও সত্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। রুক্ষতা, দুর্ব্যবহার, বাক-চাতুর্য ও হঠকারিতা কখনো সুফল দেয় না।
ইরশাদ হয়েছে-
ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ
তরজমা: ‘আপনি আপনার রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহ্বান করুন এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক করুন। নিশ্চয় একমাত্র আপনার রবই জানেন কে তার পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং হিদায়াত প্রাপ্তদের তিনি খুব ভাল করেই জানেন’। [সূরা আন নাহল: ১২৫] অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
وَلَا تُجَادِلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِلَّا الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْهُمْ وَقُولُوا آمَنَّا بِالَّذِي أَنْزِلَ إِلَيْنَا وَأَنْزَلَ إِلَيْكُمْ وَإِلٰهُنَا وَإِلٰهُكُمْ وَاحِدٌ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ.
তরজমা: ‘আর তোমরা উত্তমপন্থা ছাড়া আহলে কিতাবের সাথে বিতর্ক করো না। তবে তাদের মধ্যে ওরা ছাড়া, যারা যুলম করেছে। আর তোমরা বল, ‘আমরা ঈমান এনেছি আমাদের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে এবং তোমাদের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে তার প্রতি এবং আমাদের ইলাহ ও তোমাদের ইলাহ তো একই। আর আমরা তাঁরই সমীপে আত্মসমর্পণকারী’। [সূরা আল-আনকাবূত:৪৬]

দা’ওয়াতের স্থান, কাল ও পাত্র নির্ণয়ের ক্ষেত্রে দূরদর্শিতা
দা’ওয়াতের স্থান, কাল ও পাত্র নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও আমাদেরকে দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে দা’ওয়াতী বিষয়বস্তু উপস্থাপনের পন্থা ও পদ্ধতি নির্ণয় করতে হবে। যার সাথে যেভাবে কথা বললে অধিক ফলপ্রসূ বলে মনে হবে তার সাথে সে ধরনের ভাষায় কথা বলতে হবে। এ দিকে ইঙ্গিত করেই মহাগ্রন্থ পবিত্র ক্বোরআনে ইরশাদ হয়েছে-
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ فَيُضِلُّ اللَّهُ مَنْ يَشَآءُ وَيَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
তরজমা: ‘আর আমি প্রত্যেক রাসূলকে তাঁর সম্প্রদায়ের ভাষাতেই পাঠিয়েছি, যাতে তিনি তাদের কাছে বর্ণনা দেন, সুতরাং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সঠিক পথ দেখান। আর তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’।
[সূরা ইবরাহীম: ৪] কোনো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে দা’ওয়াত দিতে গেলে তাকে যথাযথ সম্মান দেখাতে হবে। অন্যথায় মানসিকভাবে সে দা’ওয়াতী কথাবার্তা শোনার জন্য প্রস্তুত থাকবে না। এ কারণেই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন-
“إِذَا أَتَاكُمْ كَرِيمُ قَوْمٍ فَأَكْرِمُوهُ ” . سنن ابن ماجه كتاب الأدب باب إذا أتاكم كريم قوم فأكرموه رقم الحديث-৩৭১২.المستدرك على الصحيحين كتاب الأدب إذا أتاكم كريم قوم فأكرموه.رقم الحديث . ৭৮৬১
অর্থাৎ : “তোমাদের কাছে কোনো সম্প্রদায়ের সম্মানিত ব্যক্তি এলে তাকে সম্মান কর’। [ইবনে মাজাহ-৩৭১২] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম যখন স¤্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত পাঠান, তখন তিনি তাকে ‘আযীমুর রুম’ অর্থাৎ রোমের মহান ব্যক্তি বলে খেতাব করেছিলেন। তাই সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখিয়েই দা’ওয়াত কর্ম শুরু করতে হবে।
আর যারা দুর্বল তাদের প্রতিও যতœশীল হতে হবে। কারণ এরাই হলো দা’ওয়াতের মূল শক্তি। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্বলরাই দা’ওয়াত গ্রহণে অধিক আগ্রহী হয়ে থাকে। দা’ওয়াতী কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে শক্তিবানদের তুলনায় দুর্বলরাই অধিক হারে এগিয়ে আসে।

দা’ওয়াত কর্মে আদর্শিক দৃঢ়তা ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া
দা’ওয়াত কর্মে আদর্শিক দৃঢ়তা অত্যন্ত জরুরী। সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে এ আশঙ্কায় অনেকেই দা’ওয়াতী বিষয়বস্তু উপস্থাপন করা থেকে বিরত থাকেন। এটা মারাত্মক অন্যায়। কেননা, দা’ওয়াত অবশ্যই পৌঁছাতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি বা উদাসীনতা আল্লাহর কাছে ক্ষমাযোগ্য হবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যাপারে এরশাদ করেন-
يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ.
তরজমা: “হে আমার প্রিয় রাসূল, আপনার রবের পক্ষ থেকে আপনার নিকট যা নাযিল করা হয়েছে তা পৌঁছিয়ে দিন। আর যদি আপনি তা না করেন তাহলে তো আপনি তাঁর রিসালাত পৌঁছালেন না। আর আল্লাহ আপনাকে মানুষ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফির সম্প্রদায়কে হিদায়ত করেন না’।
[সূরা আল মা-ইদাহ্: ৬৭] সম্মানিত নবীগণ সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। দা’ওয়াত কর্ম শুরু করার পূর্বে তাঁরা সবাই নিজ নিজ সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ছিলেন। কিন্তু দা’ওয়াত কর্ম শুরু করার সাথে সাথে তারা তাঁদের বিরাগভাজন হয়ে যায়। কিন্তু এ জন্য তাঁদের কেউ দা’ওয়াত কর্ম ছেড়ে দেননি। নবী হযরত সালেহ আলায়হিস্ সালাম সম্পর্কে তাঁর সম্প্রদায়ের বক্তব্য হলো-
قَالُوا يَا صَالِحُ قَدْ كُنْتَ فِينَا مَرْجُوًّا قَبْلَ هَذَا أَتَنْهَانَا أَنْ نَعْبُدَ مَا يَعْبُدُ آبَآؤُنَا وَإِنَّنَا لَفِي شَكٍّ مِمَّا تَدْعُونَا إِلَيْهِ مُرِيبٍ
তরজমা: “তারা বলল, ‘হে সালিহ, তুমি তো ইতোপূর্বে আমাদের মধ্যে প্রত্যাশিত ছিলে। তুমি কি আমাদেরকে নিষেধ করছ তাদের উপাসনা করতে, আমাদের পিতৃপুরুষরা যাদের উপাসনা করত? তুমি আমাদেরকে যার দিকে আহ্বান করছ, সে ব্যাপারে নিশ্চয় আমরা ঘোর সন্দেহের মধ্যে আছি’।
[সূরা হূদ:৬২]

দা’ওয়াত প্রচারে বিন¤্র আচরণ
দাওয়াত প্রচারে বিন¤্র আচরণ ও কথা একটি জরুরী বিষয়। হযরত মূসা ও হযরত হারূন আলায়হিমাস সালামকে আল্লাহ তা‘আলা খেতাব করে বলেন-
اذْهَبَا إِلَى فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَى. فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشٰى
তরজমা: “তোমরা দু’জন ফির‘আউনের নিকট যাও, কেননা সে সীমালংঘন করেছে। তোমরা তার সাথে ন¤্রভাবে কথা বলবে। হয়তো বা সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে।’’ [সূরা ত্বাহা:৪৩-৪৪]

দা’ওয়াত প্রচারে অকাট্য দলীল-প্রমাণ পেশ করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা জরুরী
দা’ওয়াত প্রচারে অকাট্য দলীল-প্রমাণ পেশ করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা জরুরী, যাতে দাওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তির সকল সন্দেহ দূরীভূত হয় এবং দা’ওয়াতকে অস্বীকার করার মতো তার কাছে কোন প্রমাণ না থাকে। এ ক্ষেত্রে নমরূদের সাথে হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস সালামের কথোপকথন বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِي حَآجَّ إِبْرَاهِيمَ فِي رَبِّهِ أَنْ اٰتَاهُ اللَّهُ الْمُلْكَ إِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّيَ الَّذِي يُحْيِي وَيُمِيتُ قَالَ أَنَا أُحْيىْ وَأُمِيتُ قَالَ إِبْرَاهِيمُ فَإِنَّ اللهَ يَأْتِي بِالشَّمْسِ مِنَ الْمَشْرِقِ فَأْتِ بِهَا مِنَ الْمَغْرِبِ فَبُهِتَ الَّذِي كَفَرَ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ ـ
তরজমা: আপনি কি ওই ব্যক্তিকে দেখননি, যে ইব্রাহীমের সাথে তার রবের ব্যাপারে বিতর্ক করেছে? আল্লাহ তাকে রাজত্ব দিয়েছেন। যখন ইবরাহীম বললেন, ‘আমার রব তিনিই, যিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। সে বলল, আমি জীবন দান করি এবং মৃত্যু ঘটাই। ইব্রাহীম বললেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ পূর্বদিক থেকে সূর্য আনেন। অতএব তুমি তা পশ্চিম দিক থেকে আন। ফলে কাফির হতভম্ব হয়ে গেল। আর আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে হিদায়ত দেন না’। [সূরা আল বাক্বারা:২৫৮] দাওয়াত পেশ করার ক্ষেত্রে আমাদেরকে দলীল-প্রমাণ ও যুক্তির আশ্রয় নিতে হবে। বিনা দলীলে কথা বললে মানুষের বুদ্ধি-বিবেক তার প্রতি আকৃষ্ট হয় না। পবিত্র ক্বোরআনে এ ধরনের অনেক যুক্তিপ্রমাণ রয়েছে, আম্বিয়া-ই কেরাম তাঁদের দা’ওয়াত প্রচারে যুক্তিপ্রমারে পেশ করেছেন।
দা’ওয়াতের ক্ষেত্রে যুক্তি-প্রমাণ বিভিন্ন প্রকৃতির হতে পারে। তন্মধ্যে একটি হলো, প্রাকৃতিক দলীল, যা মানুষ স্বাভাবিকভাবে বুঝে নিতে হয়। যেমন সৃষ্টিজগৎ ও মানব প্রকৃতি কেন্দ্রিক সাধারণ যুক্তি-প্রমাণ। এ ক্ষেত্রে নিজ সম্প্রদায়ের কাছে হযরত ইবরাহীম আলায়হিস্ সালামের যুক্তি-প্রমাণ পেশ করার পদ্ধতি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস সালাম চন্দ্র সূর্যের অস্ত যাওয়াকে, চন্দ্র-সূর্য যে রব হওয়ার অযোগ্য এবং রব কেবল তিনিই হবেন, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, এ বিষয়ের দলিল হিসেবে পেশ করেছেন। শিরকী আক্বীদা-বিশ্বাসের সপক্ষে আল্লাহ্র পক্ষ হতে কিছু নাযিল-হওয়া কোনো প্রমাণ নেই। তাই মুশরিকরা যেসব বস্তুকে মা’বূদ বলে বিশ্বাস করে সেগুলোকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, এ যুক্তিটিও একটি স্বাভাবিক যুক্তি, যা সকলেই বুঝে নিতে সক্ষম।

যাকে দা’ওয়াত দেয়া হচ্ছে তার বক্তব্য শোনা ও তাকে কথা বলতে দেয়া
যাকে দা’ওয়াত দেয়া হচ্ছে তার বক্তব্য শোনা ও তাকে কথা বলতে দেয়াও একটি জরুরী বিষয়। দাওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তি তার কথায় ও আচরণে কঠোর হলে দা’ওয়াতদাতাকে ধৈর্যধারণ করতে হবে। দা’ওয়াত প্রচারে ধৈর্য হলো নবী রাসূলগণের আদর্শ। দা’ওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তির অশালীন আচরণ সম্পর্কে সকল নবী-রাসূলের অভিন্ন বক্তব্য ছিল-
وَمَا لَنَا أَلَّا نَتَوَكَّلَ عَلَى اللَّهِ وَقَدْ هَدَانَا سُبُلَنَا وَلَنَصْبِرَنَّ عَلَى مَا اٰذَيْتُمُونَا وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُتَوَكِّلُونَ
তরজমা: “আমাদের কী হলো যে, আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করবো না, অথচ তিনি আমাদের সঠিক পথে পরিচালনা করেছেন। আর তোমরা আমাদের যে কষ্ট দিচ্ছ, আমরা তার ওপর অবশ্যই সবর করব। আর আল্লাহর ওপরই যেন তাওয়াক্কুলকারীরা তাওয়াক্কুল করে’। [সূরা ইবরাহীম: ১২] একজন দা’ওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তির সাথে প্রয়োজনে বছরের পর বছর দা’ওয়াতী মেহনত চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেও আমাদেরকে প্রত্যয়ী হতে হবে। এ ক্ষেত্রে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। হযরত নূহ আলায়হিস সালাম সাড়ে নয়শ’ বছর যাবৎ তাঁর সম্প্রদায়ের প্রতি দা’ওয়াতী মেহনত চালিয়ে গেছেন। রাতদিন, প্রকাশ্যে ও গোপনে সকল মাধ্যম ব্যবহার করে তাদেরকে তিনি দা’ওয়াত দিয়ে গেছেন। তাই এ ক্ষেত্রে ধৈর্যহারা হলে হক আদায় হবে না।

ব্যক্তিগতভাবে ও দলবদ্ধভাবে দা’ওয়াতী কাফেলা বা জামা‘আত প্র্রেরণ
দা’ওয়াত কর্ম ব্যক্তিগতভাবে, দলবদ্ধভাবে, দা’ওয়াতী কাফেলা বা জামা‘আত প্রেরণের মাধ্যমে আনজাম দেয়া যেতে পারে। সহীহ বোখারী শরীফের এক বর্ণনায় এসেছে-
عن مالك بن الحويرث قال قدمنا على النبي صلى الله عليه وسلم ونحن شببة فلبثنا عنده نحوا من عشرين ليلة وكان النبي صلى الله عليه وسلم رحيما فقال لو رجعتم إلى بلادكم فعلمتموهم مروهم فليصلوا صلاة كذا في حين كذا وصلاة كذا في حين كذا وإذا حضرت الصلاة فليؤذن لكم أحدكم وليؤمكم أكبركم (صحيح البخاري أبواب صلاة الجماعة والإمامة باب إذا استووا في القراءة فليؤمهم أكبرهم. رقم الحديث-৬৫৩
অর্থাৎ “হযরত মালেক ইবনে হুয়াইরিস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, ‘আমি আমার সম্প্রদায়ের একটি দল নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লামের কাছে গেলাম। আমরা সেখানে বিশ দিন অপেক্ষা করলাম। তিনি আমাদের প্রতি দয়া ও করুণাপরবশ ছিলেন। পরিবার-পরিজনের সাথে মিলিত হওয়ার তীব্র আগ্রহ আমাদের মধ্যে আঁচ করতে পেরে তিনি আমাদের নিজ গোত্রে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বললেন, ‘তোমরা ফিরে যাও এবং তাদের মাঝেই অবস্থান করো। তাদেরকে শেখাও এবং সালাত আদায় কর। সালাতের সময় হলে তোমাদের একজন আযান দেবে, আর তোমাদের মধ্যে অধিকতম বয়সী ব্যক্তি ইমামতী করবে’। [বোখারী শরীফ] এক বা একাধিক ব্যক্তিকেও উদ্দিষ্ট স্থানে পাঠিয়ে দাওয়াত কর্ম আনজাম দেয়া যেতে পারে। হযরত হুযায়ফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নাজরানবাসী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লামের কাছে এলেন এবং বললেন, ‘আমাদের জন্য একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি প্রেরণ করুন। তিনি বললেন-
عن حذيفة رضي الله عنه قال قال النبي صلى الله عليه وسلم لأهل نجران لأبعثن يعني عليكم يعني أمينا حق أمين فأشرف أصحابه فبعث أبا عبيدة رضي الله عنه (صحيح البخاري كتاب فضائل الصحابة باب مناقب أبي عبيدة بن الجراح رضي الله عنه, رقم الحديث-৩৫৩৫
অর্থাৎ: “নিশ্চয় আমি তোমাদের কাছে একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি পাঠাব, যে হবে সত্যিকার অর্থেই বিশ্বস্ত।’ লোকজন এ ব্যক্তির অপেক্ষায় থাকল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আবূ ওবায়দা ইবনুল জাররাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে পাঠালেন’। [বোখারী শরীফ] আবূ বুরদাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
عَنْ سَعِيدِ بْنِ أَبِي بُرْدَةَ، عَنْ أَبِيهِ عَنْ جَدِّهِ، قَالَ: لَمَّا بَعَثَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَمُعَاذَ بْنَ جَبَلٍ، قَالَ لَهُمَا: يَسِّرَا وَلاَ تُعَسِّرَا، وَبَشِّرَا وَلاَ تُنَفِّرَا، وَتَطَاوَعَاগ্ধ.. بَابُ قَوْلِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَسِّرُوا وَلاَ تُعَسِّرُوارقم الحديث [৬১২৪[
عَنْ سَعِيدِ بْنِ أَبِي بُرْدَةَ ، عَنْ أَبِيهِ ، عَنْ جَدِّهِ : أَنّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَعَثَهُ وَمُعَاذًا إِلَى الْيَمَنِ ، فَقَالَ : ” يَسِّرَا وَلَا تُعَسِّرَا، وَبَشِّرَا وَلَا تُنَفِّرَا، وَتَطَاوَعَا وَلَا تَخْتَلِفَا “(صحيح مسلم كِتَاب الْجِهَاد وَالسِّيَرِ بَاب فِي الْأَمْرِ بِالتَّيْسِيرِ وَتَرْكِ التَّنْفِيرِ …رقم الحديث- ৩২৬৯(
অর্থাৎ ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম, হযরত আবূ বুরদাহ্ ও হযরত মু‘আয রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমাকে ইয়েমেনে পাঠালেন, অতঃপর তিনি তাদেরকে উপদেশ দিয়ে বললেন, ‘তোমরা সহজ করবে কঠিন করবে না, সুসংবাদ দেবে ঘৃণা সৃষ্টি করবে না’। [বোখারী শরীফ]

দা’ওয়াত প্রচারে আধুনিক সকল মাধ্যম তথা প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া, ইন্টারনেট প্রযুক্তি ইত্যাদির ব্যবহার
দাওয়াত প্রচারে আমাদেরকে আধুনিক সকল মাধ্যমই ব্যবহার করতে হবে। প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া, ইন্টারনেট প্রযুক্তি এসব কিছুকেই দাওয়াত প্রচারে ব্যবহার করতে হবে। অন্যথায় শত কোটি মানুষের দোরগোড়ায় ইসলামের অমীয় বাণী পৌঁছিয়ে দেয়া সম্ভবপর হবে না। আধুনিক প্রচার ও যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এ বলে বর্জন করা যাবে না যে, এগুলো অমুসলিমদের আবিষ্কৃত। অথবা অন্যরা এসব মাধ্যমকে খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে থাকে। কেননা আধুনিক প্রচার ও যোগাযোগ মাধ্যম আল্লাহ তা‘আলার এক বিরাট নি’মাত। তাই এ নি’মাতকে আল্লাহর দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাঁর যুগের সকল প্রচার মাধ্যমকেই ব্যবহার করেছেন। তাই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের ইত্তিবা’ ও ইক্বতিদার দাবি হবে, আমাদের যুগের সকল প্রচার মাধ্যমকে আল্লাহর দীন প্রচারের ক্ষেত্রে যথাযথরূপে ব্যবহার করা।

উপসংহার
আল্লাহর পথে আহবান করতেই নবী-রাসূলগণের পৃথিবীতে আগমন। মু’মিনের জীবনের আন্যতম দায়িত্ব এই দা’ওয়াত। ক্বোরআনুল কারীমে এ দায়িত্বকে কখনো দাওয়াত, কখনো সৎকার্যে আদেশ ও অসৎকার্যে নিষেধ, কখনো প্রচার, কখনো নসীহত ও কখনো দ্বীন প্রতিষ্ঠা বলে অভিহিত করা হয়েছে। ক্বোরআন ও হাদীসের আলোকে এ কাজের গুরুত্ব, এর বিধান, পুরস্কার, এ দায়িত্ব পালনে অবহেলার শাস্তি এবং কর্মে অংশগ্রহণের শর্তাবলী এবং এর জন্য আবশ্যকীয় গুণাবলী আলোচনা করার চেষ্টা করেছি এ লেখাটিতে।
সমগ্র পৃথিবীতে ছয়শত কোটির বেশি মানুষের বসবাস। আর এদের অধিকাংশই অমুসলিম। আবার মুসলমানদের মধ্যে অধিকাংশই হল নামে মাত্র মুসলিম। তাই ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব থেকে পিছিয়ে থাকলে আল্লাহর কাছে জওয়াব দেয়ার মতো কোনো ভাষা আমাদের থাকবে না। কাজেই আসুন, আমরা সবাই মিলে ব্যাপক পরিকল্পনা ও নিরলস কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এ মহান দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার জন্য বদ্ধপরিকর হই। —০—

Share:

Leave Your Comment