আহলে হাদীস নামধারী ভ্রান্ত ও লা-মাযহাবীদের খন্ডন (পর্ব-8)

আহলে হাদীস নামধারী ভ্রান্ত ও লা-মাযহাবীদের খন্ডন (পর্ব-8)

রফ‘ই ইয়াদাঈন নিষিদ্ধ
(তাকবীরে তাহরীমা ছাড়া অন্যান্য অতিরিক্ত
তাকবিরগুলো বলার সময় হাত উঠাবে না)

আহলে সুন্নাতের মধ্যে হানাফী মাযহাবের ইমামগণের মতে, নামাযে রফ্‘ই ইয়াদাঈন অর্থাৎ রুকূ’তে যাবার সময় এবং রুকূ’ থেকে ওঠার সময় উভয় হাত উঠানো সুন্নাতের পরিপন্থী ও নিষিদ্ধ; কিন্তু ওহাবী-গায়র মুক্বাল্লিদ (লা-মাযহাবী) এ দু’ সময়ে রফ‘ই ইয়াদাঈন করে থাকে এবং এর উপর খুব জোর দেয়। সুতরাং আমি এ মাস্আলাকেও দু’টি পরিচ্ছেদে বর্ণনা করছি; প্রথম পরিচ্ছেদে এ মাস্আলার পক্ষে আমাদের প্রমাণাদি এবং দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে এ মাস্আলার বিপক্ষে আনীত আপত্তিগুলো এবং সেগুলোর খন্ডন উল্লেখ করছি। মহান রব কবূল করুন!

প্রথম পরিচ্ছেদ
নামাযে রুকূ’তে যাওয়া ও তা থেকে মাথা ওঠানোর সময় রফ‘ই ইয়াদাঈন করা মাক্রূহ ও সুন্নাতের পরিপন্থী। এর পক্ষে অনেক বিশুদ্ধ হাদীস ও মুজতাহিদ ইমামগণের ক্বিয়াস-এর সমর্থন রয়েছে। আমি তন্মধ্যে নি¤েœ কয়েকটা উল্লেখ করার প্রয়াস পাচ্ছি-

হাদীস শরীফ নম্বর : ১-৪
তিরমিযী, আবূ দাঊদ, নাসাঈ ও ইবনে আবী শায়বাহ্, হযরত আলক্বামাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন-
قَالَ قَالَ لَنَا اِبْنُ مَسْعُوْدٍ اَلاَ أُصَلِّىْ بِكُمْ صَلوةَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلَمْ يَرْفَعُ يَدَيْهِ اِلاَّ مَرَّةً وَّاحِدَةً مَعَ تَكْبِيْرِ الْاِفْتِتَاحِ ـ وَقَالَ التِّرْمِذِىُّ حَدِيْثُ اِبْنِ مَسْعُوْدٍ حَدِيْثٌ حَسَنٌ وَبِه يَقُوْلُ غَيْرُ وَاحِدٍ مِنْ اَهْلِ الْعِلْمِ مِنْ اَصْحَابِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَالتَّابِعِيْنَ ـ
অর্থ: একবার আমাদেরকে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাস‘ঊদ বললেন, ‘‘আমি কি তোমাদের সামনে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নামায পড়বো না?’’ সুতরাং তিনি নামায পড়লেন। তাতে তিনি তাকবীর-ই তাহ্রীমাহ্ ব্যতীত কখনো হাত উঠাননি। ইমাম তিরমিযী বলেন, ‘‘হযরত ইবনে মাস‘ঊদের হাদীস ‘হাসান’ পর্যায়ের। এ ‘রফ্‘ই ইয়াদাঈন’ না করার উপর অনেক আলিম- সাহাবী ও আলিম-তাবে‘ঈর আমল রয়েছে।’’

স্মর্তব্য যে, এ হাদীস শরীফ অনেক কারণে অত্যন্ত শক্তিশালী। যেমন-
এক. এর রাভী (বর্ণনাকারী) হচ্ছেন হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাস্‘ঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, যিনি সাহাবীদের মধ্যে বড় ফক্বীহ্ আলিম।
দুই. তিনি সাহাবা-ই কেরামের একটি জামা‘আত (দল)-এর সামনে হুযূর-ই আক্রামের নামায পেশ করেছেন। আর কোন সাহাবী তা অস্বীকার করেননি। বুঝা গেলো যে, সবাই সেটা সমর্থন করেছেন। যদি ‘রফ‘ই ইয়াদাঈন’ সুন্নাত হতো, তবে সাহাবীগণ তাঁর এ আমলের বিপক্ষে আপত্তি উত্থাপন করতেন; কারণ, তাঁরা সবাই হুযূর-ই আক্রামের নামায দেখেছিলেন।
তিন. ইমাম তিরমিযী এ হাদীসকে ‘দুর্বল’ বলেননি, বরং ‘হাসান’ (সবল) বলেছেন।
চার. ইমাম তিরমিযী বলেছেন, অনেক সাহাবী আলিম ও তাবে‘ঈ আলিম রফ‘ই ইয়াদাঈন করতেন না। তাঁদের এ আমল এ হাদীস শরীফের সমর্থন করছে।
পাঁচ. ইমাম আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মতো যুগের মহা মর্যাদাবান আযীমুশ্শান মুজতাহিদ এটাকে গ্রহণ করেছেন এবং সেটা অনুসারে আমল করেছেন।
ছয়. রসূল করীমের আম উম্মত এ হাদীস শরীফ অনুসারে আমল করেছেন।
সাত. এ হাদীস শরীফ ক্বিয়াস ও আক্বল বা যুক্তির একেবারে অনুরূপ। সামনে আমিও এ সম্পর্কে আলোচনা করবো, ইনশা-আল্লাহ্। এ সব কারণে তো দ্ব‘ঈফ (দুর্বল) হাদীসও সবল হয়ে যায়; অথচ এ হাদীস শরীফ স্বয়ং ‘হাসান’ (উত্তম) পর্যায়ের আছেই।

হাদীস শরীফ-৫
ইবনে আবী শায়বাহ্ হযরত বারা ইবনে ‘আ-যিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
قَالَ كَانَ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِذَا اِفْتَتَحَ الصَّلواةَ رَفَعَ يَدَيْهِ ثُمَّ لاَ يَرْفَعُهُمَا حَتّى يَفْرُغَ –
অর্থ: হুযূর নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন নামায শুরু করতেন, তখন আপন হস্তযুগল শরীফ উঠাতেন, অতঃপর নামায সমাপ্ত করা পর্যন্ত হাত তুলতেন না।
স্মর্তব্য যে, হযরত বারা ইবনে ‘আ-যিবের হাদীস শরীফকে ইমাম তিরমিযী এভাবে উদ্ধৃত করেছেন-فِى الْبَابِ عَنِ الْبَرَاءِ (এ অধ্যায়ে হযরত বারা ইবনে ‘আ-যিবের হাদীস বর্ণিত)।

হাদীস শরীফ- ৬
ইমাম আবূ দাঊদ হযরত বারা ইবনে আ-যিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
قَالَ رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَفَعَ يَدْيَهِ حِيْنَ اَفْتَحَ الصَّلوٰةَ ثُمَّ لَمْ يَرْفَعُهُمَا حَتّٰى اِنْصَرَفَ
অর্থ: তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি- যখন তিনি নামায আরম্ভ করেছেন, তখন উভয় হাত তুলেছেন। তারপর নামায সমাপ্ত করা পর্যন্ত হাত দু’টি উঠাননি।

হাদীস শরীফ-৭
ত্বাহাভী শরীফে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাস‘ঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করা হয়েছে-
عَنِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَنَّه كَانَ يَرْفَعُ يَدَيْهِ فِىْ اَوَّلِ تَكْبِيْرَةٍ ثُمَّ لاَ يَعُوْدُ
অর্থ: তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি প্রথম তাকবীরে হাত উঠাতেন। তারপর কখনো উঠাতেন না।

হাদীস শরীফ ৮- ১৪
৮. ইমাম হাকিম ও ৯. ইমাম বায়হাক্বী হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস ও হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম থেকে বর্ণনা করেন-
قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تُرْفَعُ الْاَيْدِىِ فِىْ سَبْعِ مَوَاطِنَ عِنْدَ اِفْتَتَاحِ الصَّلوةِ وَاسْتَقْبَالِ الْبَيْتِ وَالصَّفَا وَالْمَرْوَةَ وَالْمَوْقِفِيْنِ وَالْجَمْرَتَيْنِ ـ
অর্থ: তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, সাতটি স্থানে হাত উঠানো হয়- ১. নামায আরম্ভ করার সময়, ২. কা’বা শরীফের সামনে মুখ করার সময়, ৩. সাফা ও মারওয়া পর্বত দু’টির উপর, ৪. ও ৫. দু’ মাওক্বিফে অর্থাৎ মীনা ও মুয্দালিফায় এবং ৬. ও ৭. দু’ জামরার নিকটে।

এ হাদীস শরীফ ১০. বায্যার, হযরত ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে, ১১. ইবনে আবূ শায়বাহ্ হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে, ১২. ইমাম বায়হাক্বী হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে, ১৩. ইমাম ত্বাবরানী ও ১৪. ইমাম বোখারী ‘কিতাবুল মুফরাদ’-এ হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে কিছু পার্থক্য সহকারে বর্ণনা করেছেন। কোন কোন বর্ণনায় দু’ ঈদের নামাযেরও উল্লেখ রয়েছে।

হাদীস শরীফ – ১৫
ইমাম ত্বাহাভী হযরত মুগীরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, আমি ইব্রাহীম নাখ্‘ঈ’র সমীপে আরয করলাম, ‘‘হযরত ওয়া-ইল তো হুযূর-ই আক্রামকে দেখেছেন যে, তিনি নামাযের প্রারম্ভে, রুকূ’তে ঝুঁকার সময় এবং রুকূ’ থেকে ওঠার সময় উভয় হাত উঠাতেন, এ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?’’ জবাবে তিনি বলেন- اِنْ كَانَ وَائِلٌ رَاٰهُ مَرَّةً يَّفْعَلُ ذلِكَ فَقَدْ رَاهُ عَبْدُ اللهِ خَمْسِيْنَ مَرَّةً لاَ يَفْعَلُ ذلِكَ ـ
অর্থ: যদি হযরত ওয়া-ইল হুযূর-ই আক্রামকে একবার ‘রফ‘ই ইয়াদাইন’ করতে (উভয় হাত উঠাতে) দেখে থাকেন, তাহলে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাস‘ঊদ হুযূর-ই আক্রামকে পঞ্চাশ বার রফ‘ই ইয়াদাঈন না করতে দেখেছেন।

এ থেকে বুঝা গেলো যে, হযরত সাইয়্যেদুনা আবদুল্লাহ্ ইবনে মাস‘ঊদ-এর হাদীস অত্যন্ত শক্তিশালী। কেননা, তিনি সাহাবীদের মধ্যে ফক্বীহ্ আলিম, হুযূর-ই আক্রামের সঙ্গে বেশীর ভাগ সময় অবস্থানকারী, নামাযে হুযূর-ই আক্রামের নিকটে দাঁড়াতেন এমন। কেননা, হুযূর-ই আক্রামের নিকটে তাঁরাই দাঁড়াতেন, যাঁরা আলিম ও অধিকতর বিবেকবান ছিলেন। এমনটি একাধিক বর্ণনায় এসেছে।

হাদীস শরীফ ১৬-১৭
ইমাম ত্বাহাভী ও ইমাম ইবনে আবী শায়বাহ্ হযরত মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেন-
قَالَ صَلَّيْتَ خَلْفَ اِبْنِ عُمَرَ فَلَمْ يَكُنْ يَرْفَعُ يَدَيْهِ اِلَّا فِى التَّكْبِيْرَةِ الْاُوْلى مِنَ الصَّلوٰةِ ـ
অর্থ: আমি হযরত ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমার পেছনে নামায পড়েছি। তিনি নামাযে প্রথম তাকবীর ছাড়া অন্য কোন সময় হাত উঠাতেন না।

হাদীস শরীফ- ১৮
আল্লামা আয়নী, বোখারী শরীফের ব্যাখ্যাকারক হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে যোবায়র থেকে বর্ণনা করেছেন-
اِنَّه رَاى رَجُلاً يَرْفَعُ يَدَيْهِ فِى الصَّلوٰةِ عِنْدَ الرُّكُوْعِ وَعِنْدَ رَفْعِ رَأْسِه مِنَ الرُّكُّوْعِ فَقَالَ لَه لاَ تَفْعَلْ فَاِنَّه شَىْءٌ فَعَلَه رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثُمَّ تَرَكَه
অর্থ: তিনি এক ব্যক্তিকে রুকূ’তে যাওয়া ও রুকূ’ থেকে উঠার সময় হাত তুলতে দেখেছেন। তখন তিনি তাকে বললেন, এমন করোনা! কেননা, এটা এমন কাজ, যা হুযূর-ই আক্রাম প্রথমে করেছেন, তারপর ছেড়ে দিয়েছেন।
এ হাদীস শরীফ থেকে বুঝা গেলো যে, রুকূ’র পূর্বে ও পরে রফ‘ই ইয়াদাঈন (হাত তোলা) মানসূখ (রহিত) হয়ে গেছে। যেসব সাহাবী এবং হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে ‘রফ‘ই ইয়াদাঈন’-এর প্রমাণ পাওয়া যায়, তা প্রথমাবস্থার কর্ম; পরবর্তীতে মান্সূখ (রহিত) হয়ে গেছে।

হাদীস শরীফ-১৯-২০
ইমাম বায়হাক্বী ও ত্বাহাভী শরীফ প্রণেতা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর সূত্রে বর্ণনা করেছেন-
اَنَّه كَانَ يَرْفَعُ يَدَيْهِ فِى التَّكْبِيْرَةِ الْاُوْلى مِنَ الصَّلوٰةِ ثُمَّ لاَ يَرْفَعُ فِىْ شَىْءٍ مِّنْهَا ـ
অর্থ: তিনি নামাযের প্রথম তাকবীরে হাত তুলতেন, তারপর কোন অবস্থাতেই হাঠ উঠাতেন না।

হাদীস শরীফ- ২১
ত্বাহাভী শরীফে হযরত আস্ওয়াদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করা হয়েছে –
قَالَ رَأَيْتُ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ رَفَعَ يَدَيْهِ فِىْ اَوَّلِ تَكْبِيْرَةٍ ثُمَّ لاَ يَعُوْدُ وَقَالَ حَدِيْثٌ صَحِيْحٌ ـ
অর্থ: আমি হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু)-কে দেখেছি, তিনি প্রথম তাকবীরে হাত তুলেছেন, তারপর আর উঠাননি। ইমাম ত্বাহাভী বলেছেন, এ হাদীস শরীফ সহীহ।

হাদীস শরীফ- ২২
আবূ দাঊদ শরীফে হযরত সুফিয়ান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর সূত্রে
حَدَّثَنَا سُفْيَانُ اِسْنَادُه بِهذَا قَالَ فَرَفَعَ يَدَيْهِ فِى اَوَّلِ مَرَّةٍ وَقَالَ بَعْضُهُمْ مَرَّةً وَاحِدَةً
অর্থ: হযরত সুফিয়ান এ-ই সনদে বলেছেন, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাস‘ঊদ প্রথমবারেই হাত তুলেছেন। কোন কোন বর্ণনাকারী বলেছেন, তিনি মাত্র একবার হাত তুলেছেন।

হাদীস শরীফ- ২৩
দারু ক্বুত্বনী হযরত বারা ইবনে আযিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন-
اَنَّه رَأَى النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حِيْنَ اِفْتَتَحَ الصَّلوةَ رَفَعَ يَدَيْهِ حَتّى حَاذى بِهِمَا اُذُنَيْهِ ثُمَّ لَمْ يَعُدْ اِلٰى شَىْءٍ مِّنْ ذلِكَ حَتّٰى فَرَغَ مِنَ الصَّلوٰةِ ـ
অর্থ: তিনি হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে দেখেছেন, যখন হুযূর-ই আক্রাম নামায আরম্ভ করেছেন, তখন হাত এতটুকু উঠিয়েছেন যে, কান দু’টির বরাবর করে নিয়েছেন। তারপর নামায সমাপ্ত করা পর্যন্ত কোথাও হাত তুলেননি।

হাদীস শরীফ-২৪
ইমাম মুহাম্মদ ‘কিতাবুল আ-সা-র’-এ হযরত ইমাম আবূ হানীফা থেকে, তিনি হযরত হাম্মাদ থেকে, তিনি হযরত ইব্রাহীম নাখ্‘ঈ থেকে এভাবে বর্ণনা করেছেন-
اَنَّه قَالَ لاَ تَرْفَعِ الاَيْدِىْ فِيْ شَىْءٍ مِّنْ صَلوتِكَ بَعْدَ الْمرَّةِ الْاُوْلٰى ـ
অর্থ: তিনি বলেন, প্রথমবার ব্যতীত নামাযের কোথাও হাত উঠাবে না।

হাদীস শরীফ-২৫
ইমাম আবূ দাঊদ হযরত বারা ইবনে ‘আযিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর সূত্রে বর্ণনা করেছেন-
اَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ اِذَا اِفْتَتَحَ الصَّلوٰةَ رَفَعَ يَدَيَهِ اِلى قَرِيْبٍ مِّنْ اُذُنَيْهِ ثُمَّ لاَ يَعُوْدُ
অর্থ: নিশ্চয় রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নামায শুরু করলে উভয় কান শরীফের নিকট পর্যন্ত হাত উঠাতেন। তারপর আর কখনো এটা করতেন না।

উল্লেখ্য, হাত না উঠানো সম্পর্কে (রফ‘ই ইয়াদাঈন নিষেধ মর্মে) আরো অনেক হাদীস শরীফ রয়েছে। আমি এখানে সংক্ষেপে মাত্র পঁচিশটা হাদীস শরীফ পেশ করলাম। যদি আগ্রহ থাকে তাহলে মুআত্তা-ই ইমাম মুহাম্মদ, ত্বাহাভী শরীফ ও সহীহুল বিহারী শরীফ পাঠ-পর্যালোচনা করুন।

পরিশেষে, আমি ইমাম আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ওই মুনাযারাহ্ (তর্কযুদ্ধ)-এর ঘটনা বর্ণনা করছি, যা ‘রফ‘ই ইয়াদাঈন’ সম্পর্কে মক্কা-ই মু‘আয্যামায় ইমাম আওযা‘ঈ’র সাথে হয়েছিলো। সম্মানিত পাঠকগণ! দেখুন ইমাম-ই আ’যম কত উঁচু পর্যায়ের মুহাদ্দিস ছিলেন এবং কত মজবূত ও সহীহ্ সনদের হাদীস শরীফ উপস্থাপন করছেন।

ইমাম আবূ মুহাম্মদ বোখারী মুহাদ্দিস রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি হযরত সুফিয়ান ইবনে ওয়ায়নাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, একদিন হযরত ইমাম-ই আ’যম ও ইমাম আওযা‘ঈ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিমার মক্কা মু‘আয্যামার দারুল হানাত্বীন নামক স্থানে সাক্ষাৎ হয়ে গেলো। তখন এ উভয় বুযুর্গ ইমামের মধ্যে লি¤œলিখিত কথোপকথন হয়েছিলো। দেখুন ও ঈমান তাজা করুন!
এ মুনাযারাহ্ বা তর্কযুদ্ধের বিবরণ ‘ফাত্হুল ক্বাদীর’ এবং ‘র্মিক্বাত শরহে মিশকাত’ ইত্যাদিতেও উল্লেখ করা হয়েছে-
ইমাম আওযা‘ঈ: আপনারা রুকূ’তে যাওয়া ও রুকূ’ থেকে ওঠার সময় ‘রফ‘ই ইয়াদাঈন’ করেন না কেন?
ইমাম আবূ হানীফা: এ জন্য যে, ‘রফ‘ই ইয়াদা‘ঈন’ এসব স্থানে (সময়ে) হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত নয়।

ইমাম আওযা‘ঈ: আপনি এ কি বললেন? আমি আপনাকে রফ‘ই ইয়াদাঈনের সহীহ্ হাদীস শুনাচ্ছি-
حَدَّثَنَا الزُّهْرِىُّ عَنْ سَالِمٍ عَنْ اَبِيْهِ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَنَّه كَانَ يَرْفَعُ يَدَيْهِ اِذَا اِفْتَتَحَ الصَّلوٰةَ وَعِنْدَ الرُّكُوْعِ وَعِنْدَ الرَّفْعِ مِنْهُ ـ
অর্থ: আমাকে যুহরী হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি সালিম থেকে, সালিম তাঁর পিতা থেকে, তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে যে, তিনি হাত উঠাতেন যখন নামায শুরু করতেন এবং রুকূ’তে যাবার করার সময় ও রুকূ’ থেকে উঠার সময়।
ইমাম আ’যম আবূ হানীফা: আমার নিকট এটা থেকে অধিকতর মজবুত হাদীস এর বিপক্ষে মওজুদ আছে।
ইমাম আওযা‘ঈ: আচ্ছা, এক্ষুণি তা পেশ করুন!
ইমাম-ই আ’যম: এ নিন, শুনুন-
حَدَّثَنَا حَمَّادٌ عَنْ اِبْرَاهِيْمَ عَنْ عَلْقَمَةَ وَالْاَسْوَدِ عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ اَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ لاَ يَرْفَعُ يَدَيْهِ اِلاَّ عِنْدَ اِفْتِتَاحِ الصَّلوٰةِ ثُمَّ لاَ يَعُوْدُ لِشَىْءٍ مِّنْ ذلِكَ ـ
অর্থ: আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করেছেন হযরত হাম্মাদ, তিনি ইব্রাহীম নাখ্‘ঈ থেকে, তিনি হযরত ‘আলক্বামাহ্ ও আস্ওয়াদ থেকে, তিনি হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাস্‘ঊদ থেকে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম শুধু নামাযের প্রারম্ভে হাত উঠাতেন, তারপর কখনো উঠাতেন না।
ইমাম আওযা‘ঈ: আপনার উপস্থাপিত হাদীসের, আমার পেশ কৃত হাদীসের উপর কিসের প্রাধান্য রয়েছে, যার কারণে আপনি ওটাকে গ্রহণ করেছেন, আর আমার পেশকৃত হাদীসকে ছেড়ে দিয়েছেন?

ইমাম-ই আ’যম: এ জন্য যে, হযরত হাম্মাদ ইমাম যুহ্রী থেকে বড়তর ফক্বীহ্-আলিম, হযরত ইব্রাহীম নাখ্‘ঈ সালিম থেকে বড় আলিম-ফক্বীহ্, আলক্বামাহ্ সালিমের পিতা আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর অপেক্ষা নি¤œ পর্যায়ের আলিম নন; আস্ওয়াদ খুব বড় মুত্তাক্বী, ফক্বীহ্ ও শ্রেষ্ঠ। আর হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাস্‘ঊদ ফিক্বহ্ এবং ক্বিরাআতেও, আর তিনি হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গ অবলম্বনে হযরত ইবনে ওমর থেকে অনেক অনেক বড় মাপের। তিনি ( হযরত ইবনে মাস‘ঊদ) ছোটবেলা থেকে হুযূর-ই আক্রামের সঙ্গে ছিলেন। যেহেতু আমার উপস্থাপিত হাদীসের বর্ণনাকারীগণ তোমার উপস্থাপিত হাদীসের রাভীগণ অপেক্ষা বেশী জ্ঞানী ও অধিক গুণী, সেহেতু আমার পেশকৃত হাদীস শরীফ অনেক মজবুত ও অধিক গ্রহণযোগ্য।

ইমাম আওযা‘ঈ: নির্বাক। (মুনাযারাহ্ খতম)
হে গায়র মুক্বাল্লিদ, লা-মাযহাবী ওহাবী সম্প্রদায়! ইমাম-ই আ’যমের সনদ বর্ণনার ধরন দেখলেন তো? এ থেকে সম্ভব হলে কোন ত্রুটি বের করুন তো! ইমাম আওযা‘ঈর মতো আলিমের খামোশ (নির্বাক) হয়ে যাওয়া ব্যতীত অন্য কোন উপায় ছিলো না। এমনই হলো ইমাম-ই আ’যমের হাদীস শাস্ত্রে দক্ষতা! হাদীসের সনদ সম্পর্কে এ-ই হচ্ছে ইমাম-ই আ’যমের নৈপূণ্য! আল্লাহ্ তা‘আলা হক্বকে কবূল করার শক্তি দিন! জেদের কোন চিকিৎসা নেই। বস্তুত এ লম্বা লম্বা সনদ বা সূত্র এবং তাতে দুর্বল (দ্ব‘ঈফ) বর্ণনাকারীদের অন্তর্ভুক্তি হযরত ইমাম-ই আ’যমের পরে সৃষ্টি হয়েছে। ইমাম-ই আ’যম যেসব হাদীস গ্রহণ করেছেন, সেগুলো অতিমাত্রায় বিশুদ্ধ।

আক্বল বা যুক্তির দাবীও এ যে, রুকূ’তে যাবার সময় রফ‘ঈ ইয়াদাঈন করা হবেনা। কেননা, সবাই এ মর্মে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন যে, শুধু তাকবীর-ই তাহরীমায় ‘রফ‘ঈ ইয়াদাঈন’ হবে। আর এ মর্মেও সবাই ঐকমত্যে পৌঁছেছেন যে, সাজদা ও ক্বা’দার তাকবীরগুলোতে ‘রফ‘ই ইয়াদাঈন’ হবে না। রুকূ’র তাকবীরে মতবিরোধ আছে। সুতরাং দেখতে হবে রুকূ’র তাকবীর কি তাকবীর-ই তাহ্রীমার মতো, নাকি সাজদাহ্ ও আত্তাহিয়্যাতের তাকবীরের মতো! গভীরভাবে চিন্তা করলে জানা যায় যে, রুকূ’র তাকবীর তাকবীর-ই তাহ্রীমার মতো নয়, বরং সাজদাহ্ ও আত্তাহিয়্যাতের তাকবীরের মতো। কেননা, তাকবীর-ই তাহরীমা ফরয, যা ব্যতীত নামাযই হয়না। আর রুকূ’ ও সাজদার তাকবীরগুলো হচ্ছে- সুন্নাত; এগুলো ছাড়াও নামায হয়ে যায়।

তাকবীর-ই তাহরীমা নামাযে শুধু একবারই করা হয়, আর রুকূ’-সাজদার তাকবীরগুলো বলা হয় বারংবার। তাকবীর-ই তাহ্রীমা দ্বারা মূল নামায আরম্ভ হয়, আর রুকূ’-সাজদার তাকবীরগুলো দ্বারা নামাযের কয়েকটা রুক্ন আরম্ভ হয় মাত্র; মূল নামায নয়। তাকবীর-ই তাহ্রীমাহ্ নামাযীর উপর পার্থিব কাজ ও পানাহার ইত্যাদি হারাম করে দেয়; কিন্তু রুকূ’-সাজদার তাকবীরগুলোর কাজ বা অবস্থা এ নয়। এগুলোর পূর্বেই এ ‘হারাম হওয়া’ আরম্ভ হয়েছে।

সুতরাং যখন রুকূ’র তাকবীর সাজদার তাকবীরের মত হলো, তাকবীর-ই তাহ্রীমার মতো হয়নি, তখন উচিৎ হবে রুকূ’র তাকবীরেরও ওই অবস্থা হওয়া, যা সাজদার তাকবীরেরই অবস্থা; অর্থাৎ হাত না উঠানো। সুতরাং সঠিক অভিমত হচ্ছে- রুকূ’তে যাওয়া (ও তা থেকে মাথা উঠানো)র সময় ‘রফ’ই ইয়াদাঈন’ মোটেই করবেনা। [তাহাভী শরীফ থেকে উদ্ধৃত]

সার সংক্ষেপ: ‘রফ‘ই ইয়াদাঈন’ (হাত উঠানো) রুকূ’তে যাবার সময়, হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতের এবং হযরাত সাহাবা-ই কেরাম, বিশেষত খোলাফা-ই রাশেদীন-এর আমলের পরিপন্থী শরীয়তের যুক্তিরও বিপরীত। যেসব বর্ণনায় রফ‘ই ইয়াদা‘ঈনের পক্ষে কথা এসেছে, সেগুলো মান্সূখ (রহিত); যেমনটি হাদীস নম্বর ১৮ তে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অথবা ওইসব হাদীস প্রাধান্যপ্রাপ্ত নয় এবং আমল করার উপযোগীও নয়; অন্যথায় হাদীসগুলোর মধ্যে কঠোর দ্বন্দ্ব হবে।
একথাও স্মর্তব্য যে, নামাযে প্রশান্তি ও একাগ্রচিত্ততা দরকার। বিনা কারণে নড়াচড়া মাকরূহ্ এবং সুন্নাতের পরিপন্থী। এ কারণেই নামাযে বিনা কারণে পা নাচানো ও আঙ্গুলগুলো নড়াচড়া করা নিষিদ্ধ। রফ‘ই ইয়াদাঈনেও বিনা কারণে হাত দু’টি উঠানামা করা হয়। সুতরাং রফ‘ই ইয়াদাঈনের হাদীসগুলো নামাযের মধ্যে প্রশান্তির বরখেলাফ। পক্ষান্তরে, রফ‘ঈ ইয়াদাঈন বর্জনের হাদীসগুলো নামাযের প্রশান্তির অনুরূপ। সুতরাং যুক্তির দাবীও হচ্ছে এটাই যে, ‘রফ‘ঈ ইয়াদাঈন’ না করা বা হাত না উঠানোর পক্ষের হাদীস শরীফগুলো অনুসারেই আমল করা হবে।