নবীপ্রেম সমস্ত ইবাদতের প্রাণ

নবীপ্রেম সমস্ত ইবাদতের প্রাণ

নবীপ্রেম সমস্ত ইবাদতের প্রাণ
عَنْ اَنَسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ  اَنَّ رَجُلًاقَالَ یَارَسُوْلَ اللّٰہِ مَتٰی اَلسَّاعَۃُ قَالَ وَیْلَکَ وَمَااَعْدَدْتَ لَھَا قَالَ مَااَعْدَدْتُ لَھَااِلاَّ اَنِّیْ اُحِبُّ اللّٰہَ وَرَسُوْلَہٗ قَالَ اَنْتَ مَعَ مَنْ اَحْبَبْتَ قَالَ انَسٌص فَمَارَأَیْتُ الْمُسْلِمِیْنَ فَرِحُوْابِشَیْءٍم بَعْدَالْاِسْلَامِ فَرْحَھُمْ بِھَا  مُتَّفَقٌ عَلَیْہِ مِشْکٰوۃصفحہ۶۲۴
অর্থাৎ, হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি আবেদন করলেন, এয়া রসূলাল্লাহ্‌! কেয়ামত কখন হবে? উত্তরে আল্লাহ্‌র রসূল জিজ্ঞেস করলেন, ক্বিয়ামতের জন্য তুমি কী প্রস্তুতি নিয়েছ? লোকটি আরয করলো, তজ্জন্য আমি তেমন কোন প্রস্তুতি নিতে পারিনি; তবে আমি আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রসূলকে ভালবাসি। এবার হুযূর এরশাদ করলেন, তুমি যাকে ভালবাস ক্বিয়ামত দিবসে তুমি তার সাথেই থাকবে। (এ হাদীসের বর্ণনাকারী) হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, আবির্ভাবের পরে আমি মুসলমানদেরকে এরূপ আর খুশি হতে দেখিনি, যেরূপ এ কথাটুকু শুনে খুশি হয়েছেন।
[সূত্র : বুখারী শরীফ ২য় খণ্ড ৯১১ পৃষ্ঠা, মুসলিম শরীফ ২য় খণ্ড ৩৩১ পৃষ্ঠা, মিশকাত শরীফ ৪২৬ পৃষ্ঠা]
প্রাসঙ্গিক আলোচনা
নবীপ্রেমই খোদাপ্রাপ্তির পূর্বশর্ত। কারণ আল্লাহ্‌ পাক স্বয়ং ক্বোরআনে ইঙ্গিত দিয়েছেন, আমাকে কেউ ভালবাসতে চাইলে কিংবা আমার ভালবাসা পেতে চাইলে, সে যেন আমার হাবীবের আনুগত্য করে, এক কথায় আমার নবীর গোলামী করে। আর আল্লাহ্‌র হাবীব এরশাদ করেছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের কেউ পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার কাছে বেশি প্রিয় হব না তার মাতাপিতা, সন্তান-সন্ততি, মানুষ ও সবকিছুর চেয়ে। [বুখারী শরীফ : ১ম খণ্ড : ৭১ পৃষ্ঠা]
পবিত্র ক্বোরআন-হাদীস’র সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনায়ও প্রতীয়মান হয়, পৃথিবীতে কোন ব্যক্তি যত বড় নামাযী, রোযাদার, দানবীর তথা ইবাদতকারী হোকনা কেন যদি তার অন্তরে নবীর প্রেম-ভালবাসা স্থান না পায়, তাহলে তার ওইসব ইবাদত, নামায, রোযার কোন মূল্য নেই। কারণ, ঈমানদার হওয়ার জন্য নবীর মুহাব্বত প্রত্যেকের উপর ওয়াজিব তথা আবশ্যক। আর নামাযের ভিতরেও আল্লাহ্‌র নবীর উপর দুরূদ পড়া ও আল্লাহ্‌র হাবীবকে সালাম দেওয়া ওয়াজিব। আর সালাম প্রদানের সময় নবীজীর স্মরণ অন্তরে একাগ্রতার সাথে রাখা বাঞ্ছনীয়। আনমনা, তথা অন্যমনস্ক হয়ে নামায পড়া হলে, তা পরিপূর্ণ নামায নয় বলে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। আর মহান রব্বুল আলামীন হুঁশিয়ারবাণী উচ্চারণ করেছেন- ফাওয়াইলুল্লিল মুসাল্লী-না ল্লাযী-নাহুম আন সালা-তিহিম সা-হূ-ন (ঐসব নামাযীদের জন্য রয়েছে ধ্বংস, যারা নিজেদের নামাযের ব্যাপারে অন্যমনস্ক থাকে।) তাই উদ্ধৃত ক্বোরআন-হাদীসের বাণীদ্বয় আমাদেরকে শিক্ষা দিচ্ছে নামাযেও রসূলকে স্মরণ করা একান্ত আবশ্যক। অথচ ওহাবীরা বলে নামাযের মধ্যে নবীর খেয়াল আসা গাধা- গরুর খেয়াল আসার চেয়েও বেশি খারাপ (নাজ্ঞঊযু বিল্লাহ্‌)।
নবীর ভালবাসা কেমন হওয়া চাই, তার প্রমাণ দিয়ে গেছেন, আমীরুল মুমিনীন সিদ্দীক্ব-ই আকবর হযরত আবূ বকর রদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু। হিজরতের রাত ‘সওর’ পর্বতে গুহার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ছোট ছোট সকল গর্ত বন্ধ করে সর্বশেষ গর্তটি বন্ধ করার কিছু না পেয়ে নিজের পা দিয়ে গর্তের মুখ ঢেকে রেখেছিলেন, যাতে বিষাক্ত কিছু ওই গর্ত দিয়ে এসে আল্লাহ্‌র রসূলের আরামের ব্যাঘাত করতে না পারে। সর্বশেষ ওই গর্তেই বিষাক্ত সাপ এসে ছোবল মারলে সিদ্দীক্ব-ই আকবরের সমস্ত শরীর নীল হয়ে এক পর্যায়ে শরীরে কম্পন সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। নিজের প্রাণ চলে যাবার উপক্রম হয়েছিল এমন মুহূর্তে সিদ্দীক্ব-ই আকবর নবীজীর ঘুম ভেঙ্গে যাবে, কষ্ট হবে এমন ভেবে একটু শব্দও করেননি। এক কথায় প্রাণের চেয়েও বেশি নবী-ই পাকের আরামকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এত গেল কেবল একটা দৃষ্টান্ত। এরকম হাজারো দৃষ্টান্ত হযরত সিদ্দীক্ব-ই আকবর পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে গেছেন তাইতো একদা আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা’র প্রশ্নের উত্তরে হুযূর করীম বলেছিলেন- আকাশের নক্ষত্রের সংখ্যার চেয়েও বেশি আমল করেছে ফারূক্ব-ই আ’যম হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব। আর ওমরের এ ইবাদতের চেয়েও তোমার পিতা আবূ বকরের এক রাতের ইবাদত শ্রেষ্ঠ।  [মিশকাত শরীফ : কিতাবুল মানাক্বিব]
দেখুন! আমীরুল মুমিনীন খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র সারা জীবনের ইবাদতে বিভিন্ন প্রকারের আমল ছিল। যেমন- নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত, যিক্‌র্‌-আয্‌কার, তাসবীহ-তাহলীল, জিহাদ, ন্যায় বিচার আরো কত ইবাদত। এসব আমলের সমষ্টির চেয়েও সিদ্দীক্ব-ই আকবরের মাত্র এক রাতের আমল তার চেয়েও বেশি ভারী। মুহাদ্দিসীনে কেরামের মতে এখানে যে রাতের কথা বলা হয়েছে, সেটি হল- হিজরতের রাত, যে রাতে তিনি নিবেদিত প্রাণ হয়ে আল্লাহ্‌র রসূলকে সঙ্গ দিয়েছিলেন।
প্রশ্ন হল- এমন কী আমল করেছিলেন তিনি সে রাতে, কিংবা কত হাজার রাক’আত নামায পড়েছিলেন; আর কীইবা দান-সাদাক্বাহ্‌ করেছিলেন? না, তিনি এমন কিছুই করেননি, তিনি শুধু নিজের প্রাণের চেয়ে অনেক বেশি ভালবেসেছিলেন আল্লাহ্‌র প্রিয় রসূলকে। আর নবীর প্রতি এক রাতের অকৃত্রিম ভালবাসা মহান আল্লাহ্‌র কাছে ফারূক্ব-ই আ’যম হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তাজ্ঞআলা আনহু’র মত মহান সত্ত্বার সারাজীবনের অসংখ্য ইবাদত-আমলের চেয়ে বেশি প্রিয় ও মূল্যবান হয়ে গেল।
তাই বুঝা যায়, নবীপ্রেমই ইবাদতের মূল। স্মর্তব্য, কেবল নবীর মুহব্বত দাবি করে আমল ছেড়ে দিলাম, তা মোটেই হতে পারেনা। আশিক্ব-ই রসূল নাম দিয়ে নামায, রোযা, ইত্যাদি ইবাদত বন্দেগী করতে হবেনা এমন ফতোয়া আজ পর্যন্ত কেউ দেননি। সুতরাং, আমল ছাড়া নবীপ্রেম দাবি করা প্রতারণার নামান্তর। তাই ঈমানের দাবি নিয়ে আল্লাহ্‌র রসূলকে প্রকৃতভাবে ভালবাসতে হবে এবং আল্লাহ্‌র হাবীবের প্রতিটি সুন্নাতকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালবেসে আঁকড়ে ধরতে হবে-অনুসরণ করতে হবে, তবেই হবে প্রকৃত মুমিন-মুসলমান। নবীপ্রেম আছে তো ঈমান আছে, সাথে আমলও এসব মিলেই হবে সোনায় সোহাগা।
এ পার্থিব জীবন স্বল্প, আর পরকালীন জীবন অন্তহীন। সেই অনন্ত জীবনের সুখ-সমৃদ্ধির কামনা সবার হৃদয়ে থাকাটা স্বাভাবিক। তাই সাহাবীগণ প্রায় সময়ই সে পরকালীন জীবনের বিষয়ে নবীজীর কাছে জানতে চাইতেন, আর পরকালীন জীবন নিয়ে খুবই চিন্তিত-বিমর্ষ থাকতেন। তেমনি একজন সাহাবীর আবেদন ফুটে ওঠেছে উল্লিখিত হাদীস শরীফে। ক্বিয়ামতের ভয়াবহ দৃশ্য আর তৎপরবর্তী অবস্থা ও ঠিকানা যে কী হবে! ইত্যাদি অন্তরে রেখে সামান্য প্রশ্ন করতেই ইল্‌মে গায়বের নি’মাতপ্রাপ্ত নবীকুল সরদার হুযূর আকরম সাল্লাল্লাহু তাজ্ঞআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম জবাব না দিয়ে বরং তার অন্তরে লুক্বায়িত পরবর্তী তথা চূড়ান্ত প্রশ্নটির উত্তর দিয়ে বুঝাতে চেয়েছেন, তুমি ক্বিয়ামত পরবর্তী বেহেশ্‌ত- দোযখের মধ্যে কোথায় থাকবে, সেটা জানতে চাচ্ছ। তাই জেনে নাও, তোমার অন্তরে আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রসূলের ভালবাসা যদি থেকে থাকে, তাহলে তুমি বেহেশ্‌তে রসূলের সাথেই থাকবে। সুবহানাল্লাহ্‌! এভাবে আরো কত সাহাবীকে নবী-ই আকরাম দুনিয়ায় থাকাবস্থায় বেহেশ্‌তের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। নবী করীম এরশাদ করেন, যে যাকে ভালবাসে, সে তার সাথেই থাকবে। আল্লাহ্‌ আমাদেরকে সত্যিকার অর্থে নবীপ্রেমিক হিসেবে কবূল করুন; আ-মীন।
—-><—-