হায়াতুন্‌ নবী

হায়াতুন্‌ নবী

হায়াতুন্‌ নবী

عَنْ اَبِیْ الدَّرْدَاءِ ص قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰہِ ﷺ اِنَّ اللّٰہَ حَرَّمَ عَلَی الْاَرْضِ اَنْ تَأْکُلَ اَجْسَادَ الْأَنْبِیَاءِ فَنَبِیُّ اللّٰہِ حَیٌّ یُرْزَقُ۔  رَوَاہُ اِبْنُ مَاجَۃ

অনুবাদ
হযরত আবূ দারদা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত, আল্লাহ্‌র রসূল সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, জ্ঞজ্ঞনিশ্চয় আল্লাহ্‌ পাক নবীগণের দেহ মুবারক খাওয়া মাটির জন্য হারাম করে দিয়েছেন। আর আল্লাহ্‌র নবী জীবিত ও রিয্‌ক্ব দেওয়া হয়।  -[সূত্র: ইবনে মাজাহ্‌ শরীফের সূত্রে মিশকাত শরীফ ১২১ পৃষ্ঠা]
হাদীস বর্ণনাকারীর পরিচিতি
নাম: ওয়াইমার ইবনে যায়দ, উপনাম: আবূ দারদা, পিতার নাম: আবদুল্লাহ্‌। হাকীমুল উম্মত হিসেবে তিনি সবার কাছে পরিচিত ছিলেন।
ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে উহুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্বের পরিচয় দেন। তিনি রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র কাছে পবিত্র ক্বোরআনুল করীম পড়ে হাফিযে ক্বোরআন হয়েছিলেন। পরবর্তীতে সিরিয়াবাসী মুসলমানদেরকে তিনি ক্বোরআন শিক্ষা দেন এবং সেখানকার ফক্বীহ ও ক্বাযী নিযুক্ত হন। হযরত আবূ ইদরীস খাওলানী, খালিদ ইবনে মি’দান, সাঞ্চঈদ ইবনে মুসাইয়্যাব, আলক্বামা, যুবাইর ইবনে নুফাইর, উম্মে দারদা এবং স্বীয় পুত্র বেলালসহ অনেকেই তাঁর কাছে হাদীস শরীফ শিক্ষা করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীস শরীফের সংখ্যা ১৭৯ খানা। আল্লাহ্‌র রসূল তাঁকে হযরত সালমান ফারসী রদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে দেন। হুযূরের ওফাত শরীফের সময় যে চারজন সাহাবী-এ রসূল পূর্ণাঙ্গ হাফিযে ক্বোরআন ছিলেন তন্মধ্যে হযরত আবূ দারদা রদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু অন্যতম। অবশিষ্ট তিনজন ছিলেন হযরত মুআয ইবনে জাবাল, হযরত যায়দ ইবনে সাবিত এবং হযরত আবূ যায়দ রদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুম। ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এ সাহাবী হযরত আবূ দারদা হিজরি ৩২ সন মোতাবেক ৬৫২ সালের ৯ নভেম্বর দামেস্কে ইন্তিকাল করেন।   -[তাযকিরাতুল হুফ্‌ফায]
হাদীসের প্রাসঙ্গিক আলোচনা
ইসলামের সঠিক রূপরেখা আহলে সুন্নাত ওয়া জামাআতের আক্বীদা হল আল্লাহ্‌র নবীগণ স্ব স্ব রওযা শরীফে জীবিত এবং সক্রীয় আছেন। বাতিলপন্থী কিছু লোকের আক্বীদা ও বিশ্বাস- জ্ঞনবীগণ মরে মাটির সাথে মিশে গেছেনঞ্চ (নাঊযু বিল্লাহ্‌)। এ ধরনের ঈমান বিধ্বংসী আক্বীদা অন্তরে লালন করে সাধারণ মানুষকে ঈমান ও আমলের দাওয়াত দিতে দেখে সচেতন মহলের নিশ্চয়ই হাসি পায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এদের বিভ্রান্তির জালে আটকা পড়ে যাচ্ছে সরলমনা কিছু মানুষ। তাই সরলমনা মুসলমানদের ঈমানকে হিফাযতের লক্ষ্যে ক্বোরআন-হাদীসের আলোকে ইসলামের মৌলিক আক্বীদাগুলো উপস্থাপন করা আমাদের দায়িত্ব। বাতিলপন্থীরা হায়াতুন্নবীর (নবীর জীবন) মত ক্বোরআন- হাদীস সমর্থিত একটি আক্বীদাকে ইতোমধ্যে বিতর্কিত বানিয়ে ফেলার অপচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু আলোচ্য হাদীস শরীফ এবং যুগবরেণ্য মুহাদ্দিসীনে কেরাম বিষয়টিকে কীভাবে মূল্যায়ন করে এসেছেন, আসুন আমরা তা আলোচনা করি।
হযরত শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন
پیغمبرخدا زندہ است بہ حقیقت حیات دنیاوی یعنی خدائے تعالی کے نبی دنیوی زندگی کی حقیقت کے ساتھ زندہ ہیں۔  اشعّۃ اللمعات: صفحہ ۶۷۵ جلد ۱
অর্থাৎ নবীগণ আলায়হিমুস্‌ সালাম জাগতিক জীবন নিয়ে জীবিত, অর্থাৎ দুনিয়াবী জীবন সত্তা নিয়েই তাঁরা সক্রিয়।   -[আশিআতুল লুমআত : ১ম খণ্ড : ৫৭৬ পৃষ্ঠা]
হযরত আল্লামা মোল্লা জ্ঞআলী ক্বারী রহমাতুল্লাহি তাআলা আলায়হি উক্ত হাদীস শরীফের ব্যাখ্যায় বলেন:
لَافَرْقَ لَھُمْ فِی حَالَتَیْنِ وَلِذَا قِیْلَ اَوْلِیَاءُ اللّٰہِ لَایَمُوْتُوْنَ وَلٰکِنَّ یَنْتَقِلُوْنَ مِنْ دَارِ اِلٰی دَارٍ۔
অর্থাৎ জীবন-মৃত্যু উভয় অবস্থার মধ্যে তাঁদের জন্য কোন পার্থক্য নেই। এ জন্যই বলা হয়- আল্লাহ্‌র ওলীগণ মৃত্যুবরণ করেন না, কেবল এ জগত হতে ওই জগতে স্থানান্তরিত হন মাত্র।   -[মিরক্বাত ২য় খণ্ড ১১২ পৃষ্ঠা, মুম্বাই, ভারত]
আবূ দাঊদ, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌ শরীফে রয়েছে
عَنْ اَوْسِ ابْنِ اَوْسٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰہِ ﷺ اِنَّ اللّٰہَ حَرَّمَ عَلَی الْاَرْضِ اَجْسَادَ الْاَنْبِیَاءِ
অর্থাৎ- হযরত আউস ইবনে আউস রদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত, রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- আল্লাহ্‌ তাআলা যমীনের উপর নবীগণ আলায়হিমুস্‌ সালাম-এর দেহ মুবারক (ভক্ষণ করা) হারাম করে দিয়েছেন।  -[আবূ দাঊদ, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌ শরীফের সূত্রে মিশকাত ১২০ পৃষ্ঠা]
হযরত মোল্লা আলী ক্বারী রহমাতুল্লাহি তাআলা আলায়হি উক্ত হাদীস শরীফের ব্যাখ্যায় বলেছেন-
اِنَّ الْاَنْبِیَ  اءَ فِیْ  قُبُوْرِہِمْ اَحْیَ آءٌ
অর্থাৎ- নবীগণ স্ব স্ব রওযা শরীফে জীবিত।
হযরত আবদুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী রহমাতুল্লাহি তাআলা আলায়হি বলেন, আম্বিয়া-ই কেরাম জীবিত। এটাই সর্বজন গ্রহণযোগ্য অভিমত। এতে কারো দ্বিমত নেই। তাঁদের হায়াত মুবারক জাগতিক এবং দৈহিক; শহীদগণের মতো কেবল রূহানী বা আত্মিক নয় (বরং আরো উন্নত)।
যৌক্তিক প্রমাণ
তাই তো মি’রাজ রজনীতে আমাদের প্রাণপ্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বায়তুল মুক্বাদ্দাস পৌঁছে নবীগণকে নিয়ে নামায আদায় করেছেন। নবীগণ যদি ইন্তিক্বালের পর জীবিত না হতেন তবে কিভাবে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে নামায আদায় করলেন।
নবীগণ দৈহিকভাবে জীবিত। আর এ জন্য তাঁদের পরিত্যাক্ত সম্পত্তি বন্টন করা যায় না এবং তাঁদের স্ত্রীগণকেও অন্য কারো জন্য বিয়ে করার অনুমতি নেই।
তাছাড়া, নবী-রসূলগণের জীবন-মৃত্যুর মধ্যে মূলতঃ কোন পার্থক্য নেই। পার্থক্য হল- সাধারণ লোকের চর্মচক্ষু দ্বারা দেখা ও অন্তর দিয়ে বুঝা যায় না। যেমন মারাক্বিউল ফালাহ্‌ কিতাবের রয়েছে:
وَمِمَّا ھُوَ مَقَرَّرٌعِنْدَ الْمُحَقِّقِیْنَ اَنَّہٗ ﷺ حَیٌّ یُرْزَقُ مُمَتِّعٌ بِجَمِیْعِ الْمَلاَذِ وَالْعِبَادَاتِ غَیْرَ اَنَّہٗ حَجَبٌ عَنْ اَبْصَارِ الْقَاصِرِیْنَ عَنْ شَرِیْفِ الْمَقَامِ۔ (طحطاوی علی مراقی الفلاح)
অর্থাৎ- অভিজ্ঞ ওলামা-ই কেরামের দৃষ্টিতে এ কথা প্রমাণিত যে, রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম জাগতিক জীবন নিয়ে জীবিত। তাঁর কাছে রিয্‌ক্ব পেশ করা হয়। তিনি সমস্ত সুস্বাদু খাবার এবং ইবাদতের স্বাদ অনুভব করেন। কিন্তু যে সমস্ত লোক উচ্চ মর্যাদায় পৌঁছতে পারেন নি, তাদের দৃষ্টি নবী-ই আকরামের অবস্থা দর্শন হতে বঞ্চিত। [তাহতাভী: মারাক্বিউল ফালাহ্‌: ৪৪৭ পৃষ্ঠা]
নাসীমুর রিয়াজ শরহে শেফা কাজী আয়াজ কিতাবে রয়েছে:
اَلْاَنْبِیَاءُ اَحْیَآءٌ فِیْ قُبُوْرِھِمْ حَیَاۃً حَقِیقَۃً
অর্থাৎ নবীগণ (আলায়হিমুস্‌ সালাম) প্রকৃত জীবন নিয়ে স্ব স্ব কবরসমূহে জীবিত। [নাসীমুর রিয়ায ১ম খণ্ড ১৯৬ পৃষ্ঠা]
মিরক্বাত শরহে মিশকাত ১ম খণ্ডের ২৮৪ পৃষ্ঠায় রয়েছে:
اِنَّہٗ ﷺ حَیٌّ یُرْزَقُ وَلِیُسْتَمَدُّ مِنْہُ الْمَدَدَ الْمُطْلَقُ
অর্থাৎ নিশ্চয় তিনি (সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) জীবিত, তাঁকে রিয্‌ক্ব প্রদান করা হয় এবং তাঁর কাছে সর্বপ্রকার সাহায্য প্রার্থনা করা যায়।
ইমাম আবূ ইয়া’লা রহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি স্বীয় মুসনাদে এবং ইমাম বায়হাক্বী রহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি ‘হায়াতুল আম্বিয়া’ কিতাবে উদ্ধৃত করেছেন-
عَنْ اَنَسٍ ص اَنَّ النَّبِیّ  ﷺ   قَالَ اَلْاَنْبِیَاءُ اَحْیَاءٌ فِیْ قُبُوْرِہِمْ یُصَلُّوْنَ
অর্থাৎ হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত, নিশ্চয় নবীপাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘নবীগণ স্ব স্ব কবর শরীফে জীবিত এবং তাঁরা নামায পড়েন।’
উল্লেখিত দলীলাদির আলোকে যেখানে প্রমাণিত হল যে, সমস্ত নবী আপন আপন রওযা শরীফে জীবিত, সেক্ষেত্রে নবীকুল সর্দার, যাঁর ওসীলায় কুল কা-ইনাত সৃষ্টি করা হয়েছে, ওই মহান রসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যে স্বীয় রওযা মুবারকে সশরীরে জীবিত, তা প্রশ্নের অবকাশ রাখে না। একজন ঈমানদারের আক্বীদা-বিশ্বাস থাকতে হবে নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম রওযা মুবারকে শুধু জীবিতই নন; বরং সমগ্র জগত তাঁর ওসীলায় এখনও জীবিত, চলমান ও সক্রিয়। যেমন পবিত্র ক্বোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে-
وَمَآ اَرْسَلْنٰ کَ اِلاَّ رَحْمَۃً لِّلْعٰلَمِیْن   ۷۰۱
অর্থাৎ: আমি আপনাকে জগতসমূহের জন্য রহমত করেই প্রেরণ করেছি।  -[সূরা আম্বিয়া-১০৭ আয়াত]
মূলতঃ হুযূর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হলেন সমগ্র জগতের প্রাণ ও চালিকাশক্তি। তিনি যদি মৃত হতেন তাহলে জগতের অস্তিত্ব নিমিষেই বিলীন হয়ে যেত। এ আলোচনায় উল্লিখিত কয়েকটা দলীল ছাড়াও হায়াতুন্নবী বিষয়ে আরো অসংখ্য দলীল রয়েছে এমনকি এ বিষয়ে বহু প্রামাণ্য কিতাবও রচিত হয়েছে।
প্রসিদ্ধ কয়েকটি কিতাবের নাম উল্লেখ করা গেল:
১. জামে’উল ওয়াসা-ইল, ২. আম্বাউল আযকিয়া বি হায়াতিল আম্বিয়া, কৃত ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী ৩. ফুয়ূজুল হারামাঈন, কৃত হযরত শাহ্‌ ওয়ালিউল্লাহ্‌ দেহ্‌লভী, ৪. আল্‌ মাওয়াহেবুল লাদুন্নিয়া, ৫. তাফসীরে মাযহারী, কৃত. আল্লামা কাযী সানাউল্লাহ্‌ পানিপথী, ৬. যারক্বানী আলাল মাওয়াহিব, ৭. আখ্‌বারুল আখ্‌য়ার, কৃত আল্লামা শায়খ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিস দেহলভী ৮. তাফসীরে রূহুল বায়ান, কৃত আল্লামা ইসমাঈল হক্বি ৯. মসনবী শরীফ, কৃত মাওলানা জালালুদ্দীন রূমী, ১০. হাদাইক্বে বখশিশ, কৃত. আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা এবং ১১. মাক্বালাতে কাযেমী কৃত গায্‌যালিয়ে যামান আল্লামা আহমদ সাঈদ কাযেমী রহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হিম।
—><—