অনুবাদ : হযরত আমর ইবনে আখতাব রদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ্র রসূল সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম একদিন আমাদেরকে নিয়ে ফজরের নামায পড়লেন। অতঃপর মিম্বরে আরোহন করলেন এবং আমাদের উদ্দেশে দীর্ঘ বক্তব্য প্রদান করলেন; এমনকি যোহরের নামাযের সময় হয়ে গেল; সুতরাং তিনি মিম্বর হতে নেমে এসে যোহরের নামায পড়ালেন। অতঃপর আবারো আরোহন করলেন মিম্বরে, আর বক্তব্য দেয়া শুরু করলেন, এমনকি আসরের নামাযের সময় উপস্থিত হল। অতঃপর মিম্বর হতে নেমে আসরও পড়লেন, পুণরায় মিম্বরে আরোহন করে বক্তব্য দিতে দিতে সূর্য অস্তমিত হয়ে গেল। সেদিন নবী করীম অতীতে যা কিছু ছিল এবং ভবিষ্যতে যা কিছু হবে সকল বিষয়ে আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন। আমাদের মধ্যে যাঁদের স্মরণশক্তি অধিক তাঁরা সেসব (অদৃশ্য) সংবাদ বেশি মনে রাখতে পেরেছেন।
মহান রব্বুল আলামীন পৃথিবীর বুকে মানবজাতির হিদায়াতের জন্য যত নবী-রসূল পাঠিয়েছেন সবাইকে তাঁদের নুবূয়তের দলিল হিসেবে কতিপয় মু’জিযাও দান করেছেন।
অন্যান্য নবীগণের ক্ষেত্রে ওইসব মু’জিযার সংখ্যা সীমিত থাকলেও আমাদের প্রিয় রসূল সায়্যিদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র ব্যাপারটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। অন্য নবীগণের যাবতীয় মু’জিযা একত্রিত করলে যা হয়, তার সবক’টি তো বটে; বরং এরপরেও আরো কত মু’জিযা দান করেছেন তা গণনা করা যাবে এমন হিসেবের খাতা নীল আকাশের নিচে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। গণনার বাইরে যেসব মু’জিযা রয়েছে এর একটি হল ইলমে গায়্ব বা অদৃশ্যজ্ঞান। এই ইল্মে গায়্ব মহানবীর অতুলনীয় বৈশিষ্ট্যাবলীর অন্যতম আর মহান আল্লাহর অনুগ্রহ। যেমন- কোরআনে পাকে আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেছেন-
অর্থাৎ: আপনার যা জানা ছিল না তিনি আপনাকে সবই শিক্ষা দিয়েছেন এবং তা ছিল আপনার উপর আল্লাহর মহা অনুগ্রহ।
পবিত্র ক্বোরআনের ভাষায় বলা যায়- নবীপাক সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র জন্য মহান আল্লাহ্ অজানা কিছুই রাখেননি; হোকনা তা অতীত কিংবা ভবিষ্যত। ক্বিয়ামত পরবর্তী বেহেশ্ত-দোযখের সংবাদ পর্যন্ত যেখানে লুকিয়ে থাকতে পারেনি। তাইতো তিনি উপস্থিত অনেক লোকের মনের খবর বলে দিয়েছেন, মুনাফিক্বদের অন্তরে আবৃত অন্ধকার কুঠুরিতে লালিত কপটতা প্রকাশ করে মসজিদ থেকে তাদের অনেককে বের করে দিয়েছেন। এমন কি অনেক সাহাবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের বংশ তালিকা নিখুঁতভাবে বলে দিয়েছেন এগুলো কি প্রমাণ করেনা নবীপাকের ইলমে গায়্ব বিতর্কের ঊর্ধ্বে একটি স্বীকৃত বিষয়?
আল্লাহর রসূলের বাল্যবন্ধু নয় কেবল সারাজীবনের একান্ত সঙ্গী ইসলামের প্রথম খলীফা এবং নবীগণের পর যিনি শ্রেষ্ঠ মানুষ, সিদ্দীক্ব-ই আকবর হযরত আবূ বকর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণের প্রাক্কালে নবী করীমের কাছে তাঁর নুবূয়তের পক্ষে দলীল কী আছে জানতে চাইলে নবী করীম উত্তর দিতে গিয়ে ভ্রূ কুঁচকে ফেলেন নি বরং দু’শ ভাগ দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে বলে দিয়েছিলেন কেন গত রাতে তুমি যে স্বপ্ন দেখেছ, আকাশের চন্দ্র-সূর্য তোমার কোলে এসে হাজির। আর সিরিয়া যাত্রাপথের সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যাকারী তোমাকে যা কিছু বলেছে তাইতো আমার নুবূয়তের পক্ষে দলীল। এমন আশ্চর্যজনক তথ্য প্রদানের অবস্থা হচ্ছে সিদ্দীক্ব-ই আকবর একেবারে স্তম্ভিত! তিনি শতভাগ নিশ্চিত হলেন যে, এই অদৃশ্য জ্ঞানের সংবাদদাতা (নবী) কষ্মিণকালেও মিথ্যুক হতে হতে পারেন না। তিনিই মহান আল্লাহর সত্য নবী। সন্দেহাতীতভাবে তাঁর নবূয়ত প্রমাণিত।
তদ্রূপ হযরত আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কথা শোনা যাক। বদরের যুদ্ধের বন্দীদেরকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ হলে অন্য বন্দীরা যথারীতি মুক্তিপণ আদায়ে ব্যস্ত। এদিকে হুযূরের চাচা হযরত আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহুও ওই যুদ্ধবন্দীদের একজন। তিনি ভাতিজার কাছে এসে আবেদন করলেন, বাবা! আমিতো গরীব মানুষ। মুক্তিপণ দেয়ার মত আমার কাছে কোন সম্পদ নেই। উত্তরে নবী করীম বললেন, ‘‘কেন চাচা! আপনি যুদ্ধে আসার পূর্বে আমার চাচীর কাছে যে স্বর্ণালঙ্কার লুকিয়ে রেখে এসেছেন সেগুলো কোথায়? হযরত আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সে গোপন সংবাদ তো দুনিয়ার বুকে অন্য কেউ জানার কথা নয়। কিন্তু তাঁর ভাতিজা কীভাবে সুস্পষ্টভাবে বলে দিলেন, তা রীতিমত বিষ্ময়ের! না! এ ধরনের অদৃশ্য সংবাদদাতা কোনদিন মিথ্যুক হতে পারেন না। তাঁর কপালও চমকে উঠল। নবীজির হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে বলে উঠলেন হে আল্লাহর রসূল! আমাকে ইসলামের কালেমা শরীফ পড়িয়ে মুসলমান বানিয়ে দিন। আমি এতদিন ছিলাম গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত। এবার আলোতে আসতে চাই। নবীজি তাঁকে কালেমা পড়িয়ে মুসলমান বানালেন। এভাবে একজন জাহান্নামী মুহূর্তে বেহেশতী হয়ে গেলেন। শুধু কি তাই? নবীর পরশে শ্রেষ্ঠ সোনার মানুষে রূপান্তরিত হলেন।
এভাবে হাজারো দৃষ্টান্ত রয়েছে যদ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়- মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীবকে ইলমে গায়্ব দান করেছেন।
এখন আমরা আরো কয়েকটি সহীহ হাদীসের উদ্ধৃতি পেশ করব যাতে সহীহ হাদীস ছাড়া অন্য কিছু মানিনা বলে যারা গলার পানি শুকিয়ে ফেলে তারাও বিষয়টি সহজে বুঝতে পেরে হিদায়াত লাভ করে।
অর্থাৎ হযরত ওমর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা হুযূর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদের সামনে দণ্ডায়মান হলেন অতঃপর সৃষ্টিজগতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তথা বেহেশ্তবাসীরা বেহেশ্তে এবং দোযখবাসীরা দোযখে প্রবেশ করা পর্যন্ত সবকিছু আমাদের সামনে বলে দিলেন। আমাদের মধ্যে যারা মুখস্থ রাখতে পেরেছে তারা মুখস্থ রেখেছে; আর যারা ভুলে যাবার তারা ভুলে গেছে। [বুখারী: হা.নং ৩০২০ : কিতাবু বাদয়িল খালক্ব]
অর্থাৎ: হযরত হুযাইফা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তাজ্ঞআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদের সামনে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করলেন- সেদিন থেকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে তার কোন বিষয়ই তাঁর বক্তব্যে বাদ দেননি। শ্রোতাদের মধ্যে যে মুখস্থ রাখার সে মুখস্থ রেখেছে, আর যে ভুলে যাবার সে ভুলে গেছে। [সূত্র: বুখারী শরীফ হাদীস নং ৬২৩০ কিতাবুল কদর, মুসলিম শরীফ হাদীস নং ২৮৯১ কিতাবুল ফিতন]
হযরত আনাস বিন মালিক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত অপর এক হাদীস শরীফে দেখা যায়, তিনি বলেন- একদা নবীপাক সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদের মাঝে তাশরীফ আনলেন তখন সূর্য পশ্চিমাকাশের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল (অর্থাৎ যোহরের নামাযের সময় হয়ে গিয়েছিল), অতঃপর নবী করীম যোহরের নামায পড়লেন আর সালাম ফিরানোর পর মিম্বরে আরোহন করে ক্বিয়ামতের আলোচনা রাখলেন এবং ক্বিয়ামতের পূর্বেকার কতিপয় বড় বড় ঘটনার বর্ণনা দিলেন আর উপস্থিত সাহাবীদেরকে সম্বোধন করে বললেন- কারো কোন বিষয়ে জানার আগ্রহ থাকলে সে যেন প্রশ্ন করে। তিনি আরো বলেন, খোদার কসম! তোমরা আমার কাছে যা কিছু জানতে চাইবে আমি এই মজলিসেই সব প্রশ্নের উত্তর দেব।
হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, হুযূরের বাণীর এমন দৃঢ়তা দেখে আনসারী সাহাবীদের মধ্যে আনন্দের কান্নার রোল বয়ে গেলো। আর নবীপাক বারবার বলে যাচ্ছেন- তোমরা আমাকে প্রশ্ন কর, প্রশ্ন কর। অতঃপর এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল- হে আল্লাহর রসূল! পরকালে আমার ঠিকানা কোথায় হবে? নবীপাক বললেন, জাহান্নাম। অতঃপর আবদুল্লাহ্ ইবনে হুযাফা বললেন- এয়া রসূলাল্লাহ্! আমার পিতা কে? নবী করীম বললেন- তোমার পিতা হুযাফা। নবীপাক আবারও জোর তাকীদ দিয়ে বললেন, তোমরা প্রশ্ন কর, প্রশ্ন কর। অতঃপর ওমর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু নবী করীম বরাবর সামনে গিয়ে বসলেন আর বললেন- আমরা সন্তুষ্ট আল্লাহ্কে রব হিসেবে পেয়ে, ইসলামকে দ্বীন হিসেবে আর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে রসূল হিসেবে পেয়ে। তিনি এসব কথা বলার সময় নবী করীম চুপ রইলেন। অতঃপর বললেন- সেই সত্তার কসম! যার হাতে আমার প্রাণ, আমার এ দেয়ালের সামনে এইমাত্র বেহেশ্ত ও দোযখ হাজির করা হয়েছে, যখন আমি নামায পড়ছিলাম, আজকের মত কোন ভাল-মন্দকেও দেখিনি। [সূত্র: বুখারী শরীফ: হাদীস নং ৬৮৬৪: কিতাবুল ইঞ্চতিসাম্ বিল কিতাব ওয়াস্ সুন্নাহ্, মুসলিম শরীফ : হাদীস নং ২৩৫৯]
এভাবে অসংখ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়, রসূলে আকরম সাল্লাল্লাহু তাজ্ঞআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইলমে গায়্বঞ্চর অধিকারী ছিলেন। অবশ্যই তা আল্লাহ্ প্রদত্ত। আর সত্তাগত আলিমুল গায়্ব হলেন একমাত্র আল্লাহ্। আর আল্লাহ্র রসূলের ইল্মে গায়্ব আল্লাহ্প্রদত্ত। যেমন এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে-
অর্থাৎ: হে সাধারণ লোকগণ! আল্লাহ্ তাআলার শান নয় যে, তিনি তোমাদেরকে ইল্মে গায়্ব দান করবেন, তবে হ্যাঁ রসূলগণের মধ্য হতে তিনি যাকে চান তাকে অদৃশ্যজ্ঞানের জন্য মনোনীত করেন।
রসূলগণের মধ্য হতে যদি আল্লাহ্ পাক কাউকে নির্বাচিত করেন, তাহলে সর্বপ্রথমে কাকে নির্বাচিত করবেন তা সহজেই অনুমেয়।
মূলত গবেষণা করলে দেখা যায়, নবীজীর বরকতময় জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে রয়েছে বিশ্বমানবতার জন্য শিক্ষণীয় বিষয়। আর অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিতে দেখা যায়, ইলমে গায়বের প্রভাব। পবিত্র ক্বোরআন-হাদীসের আলোতে সংক্ষেপে এতটুকু আলোচনা করলাম। বিস্তারিত জানার জন্য দেখতে পারেন জা-ঞ্চআল হক্ব : প্রথম খণ্ড।