মীলাদ-ক্বিয়াম

মীলাদ-ক্বিয়াম

মীলাদে পাক-এ ক্বিয়াম..
মাওলানা মুফতি কাজী মুহাম্মদ আব্দুল ওয়াজেদ…
হুযূর-ই করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর তাওয়াল্লুদ শরীফ পাঠের শেষান্তে দাঁড়িয়ে হুযূর-ই করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সালাম পেশ করাকে ‘ক্বিয়াম’ নামে অভিহিত করা হয়। আর এ ক্বিয়াম করা হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র সম্মানের জন্যই। সম্মান প্রদর্শনের অনেক পদ্ধতি রয়েছে। ক্বোরআন-সুন্নাহর মধ্যে সম্মান প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে। যখন যে পরিবেশে যে জিনিষকে সম্মান প্রদর্শনের নিয়ম ধরা হয়, সে পরিবেশে সে পদ্ধতিতে সম্মান প্রদর্শন করা ক্বোরআন-সুন্নাহ সমর্থিত। এর উদ্দেশ্য হল সম্মান প্রদর্শন করা। মীলাদ শরীফের ক্বিয়াম ক্বোরআন, হাদীস ও প্রখ্যাত ইমামগণের উক্তি দ্বারা প্রমাণিত। ক্বিয়ামের বিপক্ষে বিন্দুমাত্র দলীল ইসলামী শরীয়তে নেই; কিন্তু এক শ্রেণীর (ওহাবী) মোল্লারা বলে ও লিখে থাকে যে, কোন ইমাম, মুজতাহিদ, সাহাবী, তাবে‘ঈ নাকি ক্বিয়াম করেননি। আমদের কথা হলো, যারা বলে সাহাবা-ই কেরাম, তাবে‘ঈন, তব‘ই তাবে‘ঈন, সলফে সালেহীন, আ‘ইম্যা-ই মুজতাহিদীন ক্বিয়াম করেননি, তাঁরা কি তাদের যুগে ছিলো? তারা কি তাঁদের সকল কর্মকান্ড স্বচক্ষে দেখেছে? নিশ্চয়ই তারা তখন ছিলো না। তাই তারা দেখেও নি। কিসের উপর ভিত্তি করে ইমামগণ ক্বিয়াম করেননি বলে তারা দাবি করে? মীলাদে ক্বিয়াম নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র তা’যীমের জন্য করা হয়। নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র তা’যীম সকল মু’মিনের উপর সদা সর্বদা অপরিহার্য। তাই সাহাবা-ই কেরাম, তাবে‘ঈন, তব‘ই তাবে‘ঈন, আইম্মা-ই মুজতাহিদীনসহ তরীক্বতের সকল ইমামগণ সদাসর্বদা নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর তা’যীমে সচেষ্ট ছিলেন। শরীয়ত ও তরীক্বতের প্রতিটি কাজ তাঁরা নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর তা’যীমের আলোকে করেছেন। যুগে যুগে তা’যীম ও সম্মানের ধারা ও ধরন পরিবর্তন-পরিমার্জন করা হয়। হুযূর-ই আক্রামের মীলাদে পাকের আয়োজন যেমন তাঁরই সম্মানের বহিঃপ্রকাশ, তেমনিভাবে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রতি সালাম পেশ করাও তা’যীমেরই বহিঃপ্রকাশ। শরীয়তের পরিভাষায়, কোন কাজ এক দিক দিয়ে বৈধ হলে অন্য দিক দিয়ে অন্য কারণে তা অবৈধ হয়ে যায়। যেমন- নামায ভাল ইবাদত। এর মধ্যে ফরয, সুন্নাত, ওয়াজিব ও মুস্তাহাব রয়েছে। আবার নামায অন্য কারণে হারামও হয়। যেমন, اوقات منهية বা নিষিদ্ধ সময়সমূহে- সূর্যোদয়, দ্বি-প্রহর ও সূর্যাস্ত এবং নাপাক অবস্থায় নামায পড়া হারাম।
‘ক্বিয়াম’-এর প্রকারভেদ
জায়েয, ফরয, সুন্নাত, মুস্তাহাব, মাকরূহ ও হারাম-এ কয়েক প্রকারের কিয়াম রয়েছে। প্রত্যেক সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা নি¤œরূপ:
এক. ক্বিয়াম-ই জায়েয বা মুবাহ্: দুনিয়াবী কোন কাজের জন্য দাঁড়ানো ‘জায়েয-ক্বিয়াম’। যেমন- দাঁড়িয়ে ঘর নির্মাণ করা, দাঁড়িয়ে চলাফেরা করা ইত্যাদি। ক্বোরআন পাকে এরশাদ হয়েছে- فَاِذَا قُضِيَتِ الصَّلٰوةُ فَانْتَشِرُوْا অর্থাৎ ‘জুমু‘আর নামায শেষে যমীনে ছড়িয়ে পড়ো।’ [১১০:১০] আর এ ছড়িয়ে পড়া দন্ডায়মান হওয়া ব্যতীত হতে পারে না। সুতরাং এ ক্বিয়াম বৈধ বা মুবাহ্।
দুই. ক্বিয়াম-ই ফরয: পাঁচ ওয়াক্ত ফরয ও ওয়াজিব নামাযের মধ্যে ক্বিয়াম করা ফরয। যেমন- ক্বোরআন-ই করীমের এরশাদ- وَقُوْمُوْا لِلهِ قَانِتِيْنَ অর্থাৎ ‘আল্লাহর সম্মুখে আনুগত্য সহকারে দাঁড়িয়ে যাও।’ সুতরাং কেউ দাঁড়ানোর ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যদি বসে নামায পড়ে তাহলে তার নামায বাতিল।
তিন. ক্বিয়াম-ই নফল: নফল নামায দাঁড়িয়ে পড়া মুস্তাহাব। বসে বসে পড়লেও শুদ্ধ হয়ে যাবে; কিন্তু দাঁড়ানোর মধ্যে সাওয়াব দ্বিগুণ।
চার. ক্বিয়াম-ই সুন্নাত: ইসলাম ধর্মের কোন সম্মানিত বস্তুকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য দাঁড়ানো সুন্নাত। যেমন- মক্কা শরীফের ঝমঝমের পানি পান করার সময় দাঁড়ানো। ওযূ করার পর অবশিষ্ট পানি দাঁড়িয়ে পান করা সুন্নাত।
হুযূর-ই করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রওযা-ই পাকে হাযির হয়ে নামাযের মতো হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে সালাম পেশ করা সুন্নাত। যেমন- ‘ফতোয়া-ই আলমগীরী: ১ম খন্ড: কিতাবুল হজ্জঃ আদাবু যিয়ারাতি ক্বাবরিন নবীয়্যি’ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এ উল্লেখ করা হয়েছে-
وَيَقِفُ كَمَا يِقِفُ فِى الصَّلٰوةِ وَيُمَثِّلُ صُوْرَتَهٗ الْكَرِيْمَةَ كَاَنَّه نَآئِمٌ فِىْ لَحْدِهٖ يَعْلَمُ بِهٖ وَيَسْمَعُ كَلاَمَهٗ
অর্থাৎ রওযা-ই আক্বদাসের সামনে নামাযের মতো আদবের সাথে দাঁড়াবে এবং অন্তরে হুযূর-ই আক্রামের আকৃতি মুবারক কল্পনা করবে যেন হুযূর-ই করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁর রওযা-ই আক্বদাসে আরাম করছেন এবং তার সম্পর্কে হুযূর-ই করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম জানেন ও তার কথা শুনেন।
ঈমানদার ব্যক্তিদের কবর যিয়ারতের সময় দাঁড়িয়ে কবরকে সামনে রেখে ফাতেহা পাঠ ও দো‘আ করা সুন্নাত। যেমন, ‘ফাত্ওয়া-ই আলমগীরী: বাবু যিয়ারাতি ক্বুবূরিল আম্বিয়া’য় আছে-
يَخْلَعُ نَعْلَيْهِ ثُمَّ يِقِفُ مُسْتَدْبِرَ اَلْقِبْلَةِ مُسْتَقْبِلاً لِوَجْهِ الْمَيِّتِ
অর্থাৎ ‘‘(প্রথমে) যিয়ারতকারী তার পাদুকা দু’টি খুলবে, তারপর ক্বেবলাকে পিঠ দিয়ে এবং কবরস্থ ব্যক্তির চেহারাকে সামনে রেখে দাঁড়াবে।’’
হুযূর-ই আকরামের রওযা-ই পাক যিয়ারত- ঝমঝমের পানি পান করা, ওযূর অবশিষ্ট পানি পান করা এবং ঈমানদারদের কবর যিয়ারত সবগুলোই ইসলামের দৃষ্টিতে বরকতময় কাজ। ফলে এগুলোর প্রতি সম্মান দেখিয়ে ক্বিয়াম করা বা দাঁড়ানো শরীয়তের বিধান সাব্যস্ত হলো।
যখন কোন ধর্মীয় পেশ্ওয়ার আগমন হয়, তখন তাঁর জন্য দাঁড়ানো সুন্নাত। এভাবে ওই দ্বীনী পেশ্ওয়ার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্নাত; বসে থাকা বেয়াদবী। যেমন হুযূর-ই করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাহাবা-ই কেরামকে হযরত সা’দ ইবনে মু‘আয রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর আগমনে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়ে বলেন, قُوْمُوْا اِلٰى سَىيِّدِكُمْ (তোমরা উঠো, তোমাদের সরদারের দিকে এগিয়ে যাও।) এ ক্বিয়ামটা তা’যীমি ক্বিয়াম। যেহেতু, এখানে سَيِّدِكُمْ (তোমাদের সরদার) বলে তা’যীমের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। অন্য কোন ওযরের কারণে যদি দাঁড়ানোর কথা আসত তাহলে- سَيِّدِكُمْ বলতেন না; ঘোড়া থেকে তাকে নামিয়ে আনার জন্য দু’/একজন সাহাবী যথেষ্ট হতো। সবাইকে যখন হুকুম দিলেন দাঁড়ানোর জন্য এবং سَيِّدِكُمْও বলেছেন, তখন বুঝা গেল যে, এ ক্বিয়াম ‘তা’যীমী ক্বিয়াম। সুতরাং এ ক্বিয়াম এমদাদ বা সাহায্য করার ক্বিয়াম নয়। আর যদি امداد বা সাহায্য করার জন্য ক্বিয়াম হতো তাহলে اِذَا قُمْتُمْ اِلٰى الصَّلٰوةِ -এর মধ্যে যে ক্বিয়ামটার কথা এরশাদ হয়েছে, তা নামাযের সাহায্যের জন্য হতো; কিন্তু নামাযের সাহায্যের প্রয়োজন নেই; যেহেতু, নামায রোগী নয়; বরং নামাযের সম্মানের জন্য কথাটা বলা হয়েছে।
তাছাড়া, ‘মিশকাত শরীফ, বাবুল ক্বিয়াম’-এ আছে হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত-
فَاِذَا قَامَ قُمْنَا قِيَامًا حَتّى نَرَاهُ قَدْ دَخَلَ بَعْضَ بُيُوْتِ اَزْوَاجِهٖ
অর্থাৎ হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম যখন কোন মজলিসে দাঁড়াতেন, তখন আমরাও তাঁর সম্মানার্থে দাঁড়াতাম, যতক্ষণ না তিনি কোন বিবি সাহেবার হুজুরায় প্রবেশ করতেন।
র্দুরে মুখতার ৫ম খন্ড, বাবুল ইসতেবরায় বর্ণিত আছে-
يَجُوْزُ بَلْ يَنْدُبُ الْقِيَامُ تَعْظِيْمًا لِلْقَادِمِ يَجُوْزُ الْقِيَامُ وَلَوْلِلْقَارِىْ بَيْنَ يَدَىِ الْعَالِمِ
অর্থাৎ কোন আগমনকারীর সম্মানার্থে দাঁড়ানো মুস্তাহাব। এমনকি কোন ক্বোরআন তেলওয়াতকারীর সম্মুখে কোন সঠিক সুন্নি আক্বিদাসম্পন্ন আলেমে দ্বীন আসলে তাঁর সম্মানার্থে দাঁড়ানো জায়েয তথা মুস্তাহাব।
‘রদ্দুল মুহতার’ (ফতাওয়া-ই শামী), ১ম খন্ড, বাবুল ইমামত-এ আছে, যদি কেউ মসজিদের প্রথম সারিতে বসে জামা‘আতের অপেক্ষা করে, এমতাবস্থায় যদি কোন সুন্নী আলেম আসেন, তবে তাঁর জন্য স্থান ত্যাগ করে পেছনে চলে আসা মুস্তাহাব। কেননা, তাঁর জন্য প্রথম সারিতে নামায পড়ার চেয়ে এ সুন্নী আলিমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন উত্তম। যেমন হযরত আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নামাযরত অবস্থায় জায়নামায হতে ইমামতি ত্যাগ করে হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মানার্থে পেছনে সরে আসেন। ‘মুসলিম শরীফ, ২য় খন্ড’ বাবূ হাদীসি তাওবাতি ইবনে মালেক’-এর মধ্যে আছে-
فَقَامَ طَلْحَةُ بْنُ عُبَيْدِ اللهِ يُهَرَوِلُ حَتّى صَافَحَنِىْ وَهَنَّأَنِىْ
অর্থাৎ হযরত তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ্ দাঁড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে মুসাফাহা করলেন এবং আমাকে মুবারকবাদ দিলেন। ইমাম নববী বলেন,
فِيْهِ اِسْتِحْبَابُ مُصَافَحَةِ الْقَادِمِ وَالْقِيَامِ لَه اِكْرَامًا اِلى لِقَآئِه
অর্থাৎ আগমনকারীর জন্য মুসাফাহা করা তাঁর সম্মানার্থে দাঁড়ানো এবং সাক্ষাতের জন্য একটু দ্রুত যাওয়া মুস্তাহাব।
মিরক্বাত শরহে মিশকাত بَابُ الْمَشْىِ بِالْجَنَازَةِ -এর মধ্যে ২য় অধ্যায়ে বর্ণিত আছে যে, وَفِيْهِ اِيْمَاءٌ اِلى نُدُبِ الْقِيَامِ لِتَعْظِىْمِ الْفُضَلآءِ الْكُبَرَآءِ অর্থাৎ এতে এদিকে ইঙ্গিত রয়েছে যে, কোন সম্মানিত ব্যক্তির জন্য তা’যীমী ক্বিয়াম মুস্তাহাব।
সাহাবা-ই কেরাম তথা সলফে সালেহীন থেকে এ সুন্নাত বা প্রথা চালু আছে যে, কোন সুসংবাদ শুনলে তাঁরা দাঁড়িয়ে যেতেন। হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, ‘আমাকে হযরত আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু একটি সুসংবাদ শুনালেন, তখন- فَقُمْتُ اِلَيْهِ وَقُلْتُ بِاَبِىْ اَنْتَ وَاُمِّىْ اَنْتَ اَحَقُّ بِهَا অর্থাৎ আমি তাঁর প্রতি দাঁড়িয়ে গিয়ে বললাম, ‘‘আপনার উপর আমার পিতামাতা ক্বোরবান! এ সুসংবাদের আপনিই উপযুক্ত।’’
পাঁচ. ক্বিয়াম-ই মাকরূহ: তা হলো ঝমঝম শরীফের ও ওযূর অবশিষ্ট পানি ব্যতীত অন্য কোন পানি দাঁড়িয়ে পান করা এবং কোন দুনিয়াবী সম্মানের জন্য দন্ডায়মান হওয়া (দুনিয়ার লালসায় দাঁড়ানো) মাকরূহ। হ্যাঁ, যদি কোন ওযর থাকে তখন মাকরূহ হবে না। যেমন, ফাতাওয়া-ই আলমগীরী: كِتَابُ الْكَرَاهِيَّةِ (কিতাবুল কারাহিয়্যাহ)-এর মধ্যে আছে- وَاِنْ قَامَ لَه مِنْ غَيْرِ اَنْ يَّنْوِىَ شَيْئًا مِمَّا ذَكَرْنَا اَوْ قَامَ طَمْعًا لِغِنِاهُ অর্থাৎ আর যদি কেউ আমাদের উল্লিখিত বিষয়াদি থেকে কোন একটার নিয়্যত করা ছাড়া অথবা তার ধনী হবার কারণে দাঁড়ানো মাকরূহ।
ছয়. ক্বিয়াম-ই হারাম: আর তা হলো- যে ব্যক্তি চায় যে, তাকে সম্মান করা হোক, তার জন্য দাঁড়ানো হারাম। তাছাড়া, মূর্তির তা’যীমের জন্য দন্ডায়মান হওয়াও হারাম।
পর্যালোচনা
উপরোল্লিখিত ক্বিয়ামসমূহের মধ্যে চতুর্থ প্রকারের ক্বিয়াম সাহাবা-ই কেরাম ও সলফে সালেহীনের সুন্নাত হিসেবে সাব্যস্ত। অর্থাৎ কোন সুসংবাদ পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দন্ডায়মান হওয়া সাহাবা-ই কেরাম ও সলফে সালেহীনের সুন্নাত সাব্যস্ত হয়েছে। সে অনুপাতে মিলাদ শরীফে হুযূর-ই আক্রামের বেলাদতে পাকের আলোচনা করার পর এ সুসংবাদ শুনার সাথে সাথে ক্বিয়াম করা সাহাবা ও সলফে সালেহীনের সুন্নাত হিসাবে সাব্যস্ত হয়েছে। কেননা, হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র বেলাদত শরীফের সুসংবাদ হতে বড় সুসংবাদ আর কি হতে পারে? পাশাপাশি কোন দ্বীনি সম্মানিত বস্তুর সম্মানের জন্য ক্বিয়াম করার কথাও উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন ঝমঝম শরীফের পানি, ওযূর অবশিষ্ট পানি পান করার সময় দন্ডায়মান হয়ে পান করা। অনুরূপ, হুযূর-ই করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মীলাদে পাকের আলোচনা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর চেয়ে বেশি খুশির খবর আর কি হতে পারে? আর খুশির সংবাদ শুনার সাথে সাথে ক্বিয়াম করা সুন্নাত। হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হতে মুসলমানের নিকট অধিকতর প্রিয় কি হতে পারে? তাঁর শুভ বেলাদতের সময় ফেরেশতারা দন্ডায়মান ছিলেন। সেই ফেরেশতাদের সম্মানসূচক ক্বিয়ামের মতো আমরাও বেলাদতে পাকের কথা স্মরণ করে ক্বিয়াম করি এবং ফেরেশতাদের সুন্নাতটুকু পালন করি। উপরন্তু হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজের গুণাবলী ও বংশের বিবরণ (যা মীলাদ শরীফে বর্ণনা করা হয়), মিম্বর শরীফের উপর দাঁড়িয়ে বর্ণনা করেছেন। [মিশকাত, বাবু ফাযা-ইলি সাইয়্যিদিল মুরসালীন]
ইসলামী শরীয়তের মধ্যেও এ ক্বিয়ামের বিপক্ষে কোন বর্ণনা নেই। পৃথিবীর সকল দেশের সুন্নী মুসলমানরা সাওয়াব মনে করে ক্বিয়াম করেন, হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মানার্থে।
হাদীসে পাকে রয়েছে-
مَارَاهُ الْمُسْلِمُوْنَ حَسَنًا فَهُوَ عِنْدَ اللهِ حَسَنٌ وَلاَ تَجْتَمِعُ اُمَّتِىْ عَلَى الضَّلاَلَةِ
অর্থাৎ (সুন্নী) মুসলমানেরা, যা উত্তম মনে করে তা আল্লাহর নিকটও উত্তম হিসেবে সাব্যস্ত এবং আমার উম্মত কোন গোমরাহীর উপর একমত হবে না। [মিরক্বাত, বাবুল ই’তিসাম]
এখানে মুসলমান ও উম্মত বলতে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত-এর অনুসারী সুন্নী মুসলমানদের কথা বুঝানো হয়েছে। র্দুরুল মুখতার, ২য় খন্ড, কিতাবুল ওয়াক্বফ অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-
لِاَنَّ التَّعَامُلَ يُتْرَكُ بِهِ الْقِيَاسُ لِحَدِيْثِ مَا رَاهُ الْمُسْلِمُوْنَ حَسَنًا فَهُوَ عِنْدَ اللهِ حَسَنٌ
অর্থাৎ মুসলমানের কর্মকান্ড যদি শরীয়ত বিরোধী না হয়, তবে প্রচলনটা শরীয়তের অংশ হিসেবে গণ্য হবে এবং এটা দ্বারা قيَاس (ক্বিয়াস)কে বর্জন করা যাবে উক্ত হাদীসের আলোকে। তাই সাধারণ সুন্নী মুসলমানরা যখন ‘মীলাদের ক্বিয়াম’কে জায়েয এবং মুস্তাহাব মনে করছেন, তখন উক্ত হাদীসের আলোকে এটাও মুস্তাহাব হিসেবে স্যাবস্ত হয়েছে। আর হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর তা’যীমের ব্যাপারে- تُعَزِّرُوْهُ وَتُوَقِّرُوْهُ বলে স্বয়ং আল্লাহর নির্দেশ আছে। যেখানে কোন সময় বা স্থানের নির্দিষ্টতা নেই, তখন সাধারণ ব্যাপকতার মাধ্যমে হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর তা’যীমের জন্য যত পদ্ধতি হতে পারে সব ক’টিই উক্ত আয়াতাংশে শামিল আছে। এ অনুপাতে ‘এ ‘মীলাদের ক্বিয়াম’ সম্পর্কে বিশ্বের বিজ্ঞ ওলামা-ই কেরাম জায়েয এবং মুস্তাহ্সান হওয়ার ফাত্ওয়া দিয়েছেন।
এছাড়া, পাক-ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম হযরত শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ্ মুহাদ্দিস দেহলভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি-এর পিতা শাহ্ আবদুর রহিম দেহলভী (ওফাত ১২৮৮হি.) তাঁর কিতাব- رَوْضَةُ النَّعِيْمِ فِىْ ذِكْرِ النَّبِىِّ الْكَرِيْمِ (রাওদ্বাতিন না‘ঈম ফী- যিক্রিন নাবিয়্যিল করীম)-এর মধ্যে মক্কা মুকাররমার ৪২ জন মুফতীর ফতোয়া, মদীনা মুনাওয়ারার ৩০ জন, জিদ্দার ২০ জন, হাদীদার ১২ জন মুফতীর ফতোয়াসমূহ উদ্ধৃত করেছেন। সেখানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়া হল যে, যারা মীলাদে পাক ও ক্বিয়াম-ই তা’যীমী অস্বীকার করবে তারা মূলত বদ-আক্বিদা তথা খারেজী। সেখানে শরীয়তের হাকিমদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যেন এ ক্বিয়াম বিরোধী বিদ‘আতীদের শাস্তি প্রদান করা হয় নবীর তা’যীমের বিরুদ্ধাচরণ করার কারণে। [আন্ওয়ার-ই আফতাবে সাদক্বাত, পৃ.৩৩৮]
উপরোল্লিখিত বিশ্ব বরেণ্য ওলামা-ই কেরামের ফাত্ওয়ার মাধ্যমে মীলাদে পাকের মধ্যে ক্বিয়াম ‘মুস্তাহসান’ ও ‘মুস্তাহাব’ সাব্যস্ত হল, বিদ‘আত নয়। আর যদি বিদ‘আত বলে ইনকার করে, তখন এ বিদ‘আতীদের বিদ্‘আতের খন্ডনে সুন্নী মুসলমানদের উপর ‘মীলাদ-ক্বিয়াম’ করা ওয়াজিব হয়ে যাবে। যেমন শায়খ মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহ্ইয়াহ্ মুফতী হাম্বলী (মক্কা মুকাররমা) বলেন-
يَجِبُ الْقِيَامُ عِنْدَ ذِكْرِ وِلاَدَتِهٖ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا اِسْتَحْسَنَ عُلَمَآءُ الْعَالَمِ وَقُدْوَةُ الدِّيْنِ وَالْاِسْلاَمِ فَذَكَرُوْا عِنْدَ وِلاَدَتِه يَجِبُ الْقِيَامِ لِلتَّعْظِيْمِ
অর্থাৎ হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বেলাদত শরীফের আলোচনার সময় ক্বিয়াম করা ওয়াজিব, যখন বিশ্বের আলিমগণ, দ্বীন ইসলামের পেশওয়াগণ সেটাকে ‘মুস্তাহ্সান’ তথা উত্তম ও সাওয়াবের কাজ বলেছেন। সুতরাং হুযূর-ই আক্রামের মীলাদের আলোচনার সময় ক্বিয়াম করাকে তারা তা’যীমের জন্য ওয়াজিব বলে উল্লেখ করেছেন।
সুতরাং সাধারণত সুন্নী মুসলমানগণ মীলাদ পাঠান্তে হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মানার্থে ক্বিয়ামের মাধ্যমে সালাম পেশ করে। এটাই মুস্তাহ্সান। আর যখন ওই পরিবেশে ক্বিয়ামের কোন বিরুদ্ধাচরণকারী বিরোধিতা ও অস্বীকার করবে এবং বিদ্‘আত বলে ফাত্ওয়া দেবে, তখনই ওই অবস্থায় সুন্নী মুসলমানের জন্য ক্বিয়াম করা ওয়াজিব। যেমন কোন মুস্তাহাব কাজকে যদি অস্বীকার করা হয়, তখন তা ওয়াজিবে পরিণত হয়। যথা উসূলে ফিক্বহ্র একটি নীতিমালা ও ধারা আছে যে, يَتَبَدَّلُ الْحُكْمُ بِتَبَدُّلِ الزَّمَانِ অর্থাৎ স্থান ও কালের পরিবর্তনের ফলে হুকুমের ধারারও পরিবর্তন হয়।

মিলাদ-কিয়ামের দলীল