১ম পারা, বিষয়: তাঁর নূর ও প্রকাশ প্রসঙ্গে
১ম পারা, বিষয়: فى نوره وظهوره (তাঁর নূর ও প্রকাশ)
গ্রন্থকার আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলায়হি এ পারার শুরুতে যথারীতি চোখ ধাঁ ধাঁনো বহু বিশেষণে তাসমিয়া (বিসমিল্লাহ) উল্লেখ করেছেন এবং বিসমিল্লাহ্’র ওসীলা দিয়ে মহান আল্লাহ’র কাছে প্রার্থনা করেছেন। প্রায় দু’পৃষ্ঠা ব্যাপী এ ধারা বিস্তৃতি পেয়েছে। সূরা ফাতেহা’র উল্লেখও একই অবস্থা। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলার গুণবাচক সুন্দর নাম সমূহ বর্ণিত। পাঠকের হৃদয়ে দোলা লাগাতে এগুলোর জুড়ি নেই। এ খন্ডে আরো উল্লেখ আছে বিভিন্ন বিশেষণে দীর্ঘ তাহলীল তথা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’র যিকর। বিষয়বস্তুর শিরোনামের আলোকে এ সবই বিবৃত হয়েছে। শিরোনাম সর্ম্পকীত একটি দুরূদ নিম্নরূপ :
اللهم صل على سيدنا محمد الذي لانور الاَّ هو ولا ظهور الا هو
“হে আল্লাহ দুরূদ প্রেরণ করুন ! আমাদের সরদার (মুনীব) হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র উপর, যিনি এমন পরিপূর্ণ নূর যে, কোন নূর নেই তবে একমাত্র তিনিই । অর্থাৎ তাঁর আপাদমস্তক নূর ও সকল সৃষ্টির মূল। কারও প্রকাশ নেই। কিন্তু তিনিই প্রকাশ। অর্থাৎ তিনিই সমস্ত সৃষ্টির প্রকাশক।”
এ পারার শিরোনামই বিষয়বস্তু নির্দেশ করে যে, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র নূর বা জ্যোতি ও প্রকাশ সর্ম্পকীত মনোজ্ঞ আলোচনা। তিনি অব্যয়পদ উল্লেখের মাধ্যমে শিরোনাম উল্লেখ করেন এরূপে فى نوره وظهوره এ কারণে এ পারার কোন কিছুই অপ্রাসঙ্গিক নয়।
দু’আ-দুরূদের আদলে এতে উল্লেখ হয়েছে মহানবীর নূরের সৃষ্টি, সংরক্ষন, অবস্থা, নামকরন, স্থানান্তর আর তা এ দুনিয়াতে প্রেরণের আগে ও সমকালে মহান মর্যাদা প্রদানের বিবরণ। এ নূরই সৃষ্টি জগতের মূল ও প্রকাশক। এমনকি সকল কল্যাণ এই নূরের মাধ্যমে প্রকাশিত। এভাবে আসমান-যমীন, আরশ-কুরসী, লওহ-কলম,জান্নাত, ফেরেশতা,চাঁদ-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, আক্বল-ইলম (জ্ঞান-বুদ্ধি)। এক কথায় আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় অস্তিত্ব ছাড়া সবই মহানবীর নূর হতে সৃজন করেছেন। তাঁর নূরই প্রথম সৃষ্টি এবং আল্লাহ’র সৃষ্টি বিকাশে তিনিই প্রথম প্রকাশ।
এখানে পরিবেশিত দু’শত দুরূদ ও সাতচল্লিশটি দু’আতে অপূর্ব ও র্দূলভ বর্ণণা স্থান পেয়েছে এভাবে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পবিত্র সত্তার নূর হতে হযরতের নূরানী সত্তা সৃষ্টি করেছেন। তারপর সেই নূরকে এমন আকৃতিতে এক আলোকবর্তিকার ন্যায় সাজালেন; যেই আকৃতিতে তাঁকে দুনিয়াতে প্রেরণ করা হবে।যখন তিনি স্বীয় উত্তম আকৃতি অবলোকন করলেন, তখন সাথে সাথে পাঁচবার সিজদাবনত হলেন। তৎপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রতি মুহাব্বতের দৃষ্টি নিবন্ধন করলেন এবং তাঁর অবয়বের এক এক অংশ হতে এক এক ধরণের সৃষ্টি সৃজন করলেন। তারপর সমগ্র আত্মা ঐ নূরানী অবয়বকে এক লক্ষ সত্তর হাজার বছর যাবৎ তাওয়াফ করল। পরে অনুমতি প্রাপ্ত হয়ে আত্মাগুলো ঐ নূরানী আকৃতির দিকে দৃষ্টি দিতেই মুগ্ধ হয়ে রইল। এ সময় যার দৃষ্টি যেখানে পড়েছে, সেটার প্রভাবে সে-ই আত্মা বিশেষ পরিচয় ধারণ করেছে। যেমন, যারা মাথা মুবারক দেখেছেন, তাঁরা সুলতান,খলীফা তথা রাজত্বের মালিক হয়েছেন। অতঃপর এই নূরকে আরশের চত্বরে হেফাযতে রাখা হয়। পরে হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালামকে সৃষ্টি করার প্রায় দু’হাজার বছর আগে এই নূরের নাম রেখে সম্মানিত স্থানসমূহে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়। এ সময় হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সিজদাবস্থায় তাসবীহ পাঠরত ছিলেন।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা যখন তাঁর বন্ধুর এই নূরানী সত্তাকে মানব দেহরূপ সৃষ্টি করতে ইচ্ছা করলেন, জিব্রাঈলকে নির্দেশ দিলেন। জিব্রাঈল সৃষ্টির সর্বোৎকৃষ্ট সাদা টুকরা নিয়ে আসমান-যমীনের প্রত্যেক স্তরে প্রদক্ষিন পূর্বক জান্নাতের ‘তাসনীম’ ঝর্ণার সুবাসিত পানিতে সিক্ত করেন এবং সর্বোৎকৃষ্ট স্থান তথা তাঁর রওযা শরীফের উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন মিম্বরে সংরক্ষণে রাখেন। তারপর আল্লাহ তা’আলা যখন তাঁর বন্ধুর এই নূরানী সত্তাকে মানবরূপে পৃথিবীতে প্রেরণের ইচ্ছা করলেন আর হযরত আদম আলায়হিস্ সালামকে সৃষ্টি করে সেই নূরটি তাঁর চেহারায় স্থাপন করলেন তখন সকল ফিরিশ্তা হযরত আদম আলায়হিস্ সালামকে সিজদা করল। পরে সেই নূরটি তাঁর অধঃস্তন পুরুষদের পবিত্র পৃষ্ঠদেশ হতে নারীদের পবিত্র উদরে স্থানান্তর করতে করতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিবের চেহারায় স্থাপন করেন। এ সময় সেই নূরের বদৌলতে তাঁর পিতা আবদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী হন, অনেক অলৌকিকত্ব প্রকাশ পেতে থাকে। তারপর যখন সেই নূর হযরত আমিনা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা’র পবিত্র উদরে পর্দাপন করল, তাঁর মা স্বপ্নে দেখলেন যে- হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম থেকে শুরু করে অনেক নবী একে একে তাঁকে অভিবাদন জ্ঞাপন করতে লাগল।
এরপর হস্তী বছর এই নূর মানবরূপে দুনিয়াতে আগমনের সময় যখন উপনীত হল তখন তাঁর মা দেখতে পেলেন যে, বনী আবদুল মানাফের নারীদের মত আসীয়া বিনতে মাজাহিম ও মারয়াম বিনতে ইমরান গৃহে উপস্থিত হলেন, ফিরিশতাগণ আসমান-যমীন ও সমুদ্রের অধিবাসীদের নিকট হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র আগমন র্বাতা প্রচার করতে লাগল, এক নূর উদ্ভাসিত হয়ে চারিদিকে আলোকিত করল, সে-ই আলোতে দেখা গেল যে, পারস্যের অগ্নিকুন্ড নিভে গেল, কিসরার রাজপ্রাসাদ প্রকম্পিত হল, আসমানের দরজা খুলে গেল, তিনটি পতাকা; একটি পূর্ব প্রান্তে, আরেকটি পশ্চিম প্রান্তে, অন্যটি বায়তুল্লাহ’তে উড়ছে, চারিদিকে বেহেশতের সমীরণ বয়ে যাচ্ছে, হুরগণ সুসংবাদ দিতে লাগল, জিব্রাঈল; মিকাঈল ও ইস্রাফীল আলায়হিস্ সালাম খিদমতে হাজির হল, চারিদিকে পাখা দিয়ে হিফাযতে ঘিরে রাখল, সৃষ্টিজগত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে স্বাগত জানাতে লাগল আর তিনি সবুজ রেশমী কাপড় জড়ানো অবস্থায় আসমানের দিকে ইশারা করতে করতে আর্বিভূত হলেন এবং সিজদায় উপনীত হলেন। এ সময় বায়তুল্লাহ ঝুঁকে পড়ে, সেখানকার মূর্তিগুলোর মাথা কাত হয়ে রইল। তাঁর এ জন্ম সাধারণ শিশুর মত ছিল না, অসংখ্য অলৌকিক বিষয় প্রকাশ পেল, তাঁর মাও কোন প্রকার কষ্ট অনুভব করেন নি; যা সাধারণত মহিলাগণ র্গভপাতের সময় পেয়ে থাকেন। এভাবে সেই নূরটি মানব বেশে এ ধরাতে প্রকাশিত হল।
এছাড়াও এ পারায় উল্লেখ করা হয়েছে- রাসূল-ই করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ১২ বছর বয়সে উপনীত হওয়া সময় পর্যন্ত কি কি ঘটেছে এবং মা-বাবা ও দাদা আবদুল মুত্তালিবকে হারানোর কথা।