সম্মানিত সাহাবী হযরত আমীর মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু ত‘আলা আনহু

সম্মানিত সাহাবী হযরত আমীর মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু ত‘আলা আনহু

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান

‘সাহাবী’ ওই খোশ নসীব মুসলমান, যিনি ঈমানদার অবস্থায় হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে দেখেছেন, তারপর ঈমানের উপর তাঁর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। আর ‘সাহাবী হওয়া’ (সাহাবিয়াত) এমন এক উঁচু মর্যাদা, যা’তে কোন বড় ওলী, গাউস এবং ক্বুত্ববও পৌঁছতে পারেন না। সাহাবীর ফযীলতের প্রসঙ্গে ক্বোরআন মজীদের অনেক আয়াত নাযিল হয়েছে এবং অনেক হাদীস শরীফও বর্ণিত হয়েছে। এ নিবন্ধেও কিছু সংখ্যক আয়াত শরীফ ও হাদীস শরীফ বর্ণনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ্। এতদ্সত্ত্বেও, দুঃখের হলেও সত্য যে, কিছু সংখ্যক হতভাগা ও জঘন্য পাপিষ্ঠ অকাট্যভাবে প্রমাণিত সাহাবীদের শানে জঘন্য বেয়াদবী বা অশালীনতা প্রদর্শন করছে, তাঁদের সাহাবিয়াতকে অস্বীকার করছে। যেমন হযরত আমীর মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু ত‘আলা আনহু। অথচ তিনি একজন অতি সম্মানিত সাহাবী, তাঁর রয়েছে অসংখ্য ফযীলত। ইদানিং তাঁর শানে এক শ্রেণীর বদনসীব লোক জঘন্য বেয়াদবী প্রদর্শন করে চলেছে। তারা কি না জেনে এমনটি করছে, নাকি পার্থিব লোভে নিজেদের আখিরাত বরবাদ করছে সে সম্পর্কে খোঁজ খবর পরে নেওয়া হলেও, প্রথমে আমীর মু‘আভিয়ার সাহাবিয়াত ও ফযীলতের পক্ষে অকাট্য প্রমাণাদি তুলে ধরা সত্যপন্থীদের ঈমানী দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এ নিবন্ধে আমি প্রথমে তাঁর (হযরত মু‘আভিয়া) সাহাবিয়াৎ এবং পরক্ষণে তাঁর ফযীলত সম্পর্কে আলোচনা করবো ইন্শাআল্লাহ্।

হযরত আমীর মু‘আভিয়ার ইসলাম গ্রহণ
যেহেতু সাহাবী হবার পূর্বশর্ত হচ্ছে ঈমানের সাথে নবী-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে দেখা, সেহেতু হযরত আমীর মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ইসলাম গ্রহণের সময় ও অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা সর্বাগ্রে করা সমীচিন হবে।
হযরত আবূ আবদির রহমান মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর পিতার দিক থেকে বংশীয় ধারা নিম্নরূপ-
মু‘আভিয়া ইবনে আবূ সুফিয়ান সখর ইবনে হারব ইবনে উমাইয়া ইবনে আবদে শামস ইবনে আবদে মান্নাফ। আর মায়ের দিক থেকে তাঁর বংশীয় ধারা নিম্নরূপ-মু‘আভিয়া ইবনে হিন্দ বিনতে ওতবাহ্ ইবনে রাবী‘আহ্ ইবনে আবদে শামস ইবনে আবদে মান্নাফ। বস্তুত: আবদে মান্নাফ হলেন নবী-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর চতুর্থ দাদা। সুতরাং হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বংশীয় ধারা হচ্ছে হযরত মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশেম ইবনে আবদে মান্নাফ। মোট কথা, হযরত আমীর মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বংশীয় ধারা, পিতার দিক থেকে পঞ্চম পূর্ব পুরুষে আর মায়ের দিক থেকেও পঞ্চম পূর্ব পুরুষে হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বংশীয় ধারায় তাঁর চতুর্থ পূর্ব পূরুষ (দাদা) আবদে মান্নাফের সাথে মিলিত হয়েছে। সুতরাং বুঝা গেলো যে, তিনি বংশীয় ধারায় হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ঘনিষ্ট আত্মীয়। আবার আত্মীয়তায় তিনি রসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাক্ষাৎ শ্যালক। কারণ, উম্মুল মু‘মিনীন হযরত উম্মে হাবীবাহ্ বিনতে আবূ সুফিয়ান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা, যিনি হুযূর-ই আকরামের পবিত্র স্ত্রী, হযরত আমীর মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর সহোদরা। এ কারণে, আরিফ বিল্লাহ্ মাওলানা রূমী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর মসনভী শরীফে তাঁকে মু‘মনিদের মামা লিখেছেন। মোটকথা, হযরত আমীর মু‘আভিয়া যে হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ঘনিষ্ট সাক্ষাৎ পেয়েছেন, তা উৎকৃষ্ট ও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলো।
এখন দেখা যাক তিনি কখন ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হয়েছেন? এ সম্পর্কে হযরত মুফতী আহমদ ইয়ার খান ন‘ঈমী আলায়হির রহমাহ্ বলেছেন ৬ষ্ঠ হিজরীতে হুদায়বিয়ার সন্ধির দিনে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তিনি মক্কাবাসীদের ভয়ে নিজের ইসলামের গ্রহণের কথা গোপন করেছিলেন। তারপর ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের দিনে তা প্রকাশ করেছিলেন। যাঁরা বলেছেন যে, তিনি মক্কা বিজয়ের দিনে ইসলাম গ্রহণ করেছেন, তাঁরা তাঁর ঈমানের কথা প্রকাশ করা অনুসারে বলেছেন। যেমন হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু গোপনে বদরের যুদ্ধের দিনেই ঈমান এনেছিলেন, কিন্তু সতর্কতা অবলম্বন করে নিজের ঈমান গোপন রেখেছিলেন; আর মক্কা বিজয়ের দিনে তা প্রকাশ করেছিলেন। সুতরাং লোকেরা তাঁকেও মক্কা বিজয়ের দিনের মু‘মিনদের মধ্যে গণনা করেছেন। অথচ তিনি ‘ক্বাদীমুল ইসলাম’ (একেবারে প্রাথমিক যুগের মু‘মিন) ছিলেন। বরং তিনি বদরেও কাফিরদের সাথে গিয়েছিলেন- বাধ্য হয়ে। এ কারণে নবী-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছিলেন, ‘‘কোন মুসলমান যেন আব্বাসকে হত্যা না করে। তাকে তো বাধ্য করে যুদ্ধে আনা হয়েছে।’’
হযরত আমীর মু‘আভিয়া হুদায়বিয়ায় ঈমান আনার পক্ষে দলীল হচ্ছে ওই হাদীস শরীফ, যা ইমাম আহমদ হযরত বাক্বির ইবনে ইমাম যয়নুল আবেদীন ইবনে ইমাম হোসাঈন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম থেকে বর্ণনা করেছেন। ইমাম বাক্বিরকে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা বলেছেন, তাঁকে হযরত আমীর মু‘আভিয়া বলেছেন, ‘‘আমি হুযূর-ই আকরামের ইহরাম থেকে বের হবার সময় হুযূর-ই আকরামের শির মুবারকের চুল শরীফ মারওয়া পাহাড়ের নিকট কেটেছি।’’
তাছাড়া ওই হাদীস শরীফও এর প্রমাণবহ, যা বোখারী শরীফে হযরত তাঊসের বর্ণনানুসারে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন- হুযূর-ই আকরামের হিজামতকারী (চুল মুবারক কর্তনকারী) হলেন হযরত আমীর মু‘আভিয়া। প্রকাশ থাকে যে, এ হিজামত ‘ওমরাতুল ক্বাযা’য় হয়েছিলো, যা হুদায়বিয়ার সন্ধির এক বছর পর ৭ম হিজরীতে সম্পন্ন হয়েছিলো। কেননা, ঐতিহাসিক বিদায় হজ্জে নবী-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ‘হজ্জে ক্বিরান’ করেছিলেন। আর ক্বিরানকারী মারওয়ায় হিজামত করান না; বরং মিনায় ১০ যিলহজ্জে করান। তাছাড়া, বিদায় হজ্জে হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম চুল শরীফ ছাঁটাননি, বরং মাথা মুবারক মুন্ডন করিয়েছিলেন। মুন্ডনকর্মও সম্পাদন করেছিলেন হযরত আবূ তালহা। সুতরাং নিশ্চয় আমীর মু‘আভিয়া হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মাথা মুবারকের চুল শরীফ কাটার ঘটনা ‘ওমরাতুল ক্বাযায়, মক্কা বিজয়ের পূর্বে সংঘটিত হয়েছে। বুঝা গেলো যে, হযরত আমীর মু‘আভিয়া মক্কা বিজয়ের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

হযরত আমীর মু‘আভিয়ার ফযীলতসমূহ
হযরত আমীর মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবী ও ঘনিষ্ট আত্মীয় হওয়া ছাড়াও তাঁর বহু ফযীলত প্রমাণিত। তন্মধ্যে কয়েকটা এ নিবন্ধে উল্লেখ করার প্রয়াস পাচ্ছি। তাঁর ফযীলতের প্রসঙ্গে অনেক সহীহ হাদীস শরীফ বর্ণিত হয়েছে-
এক. হযরত ইরবাদ্ব ইবনে সারিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত- রসূল-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, اَللّٰهُمَّ عَلِّمْ مُعَاوِيَةَ الْكِتَابَ وَالْحِسَابَ وَقِهِ الْعَذَابَ-
অর্থ: হে আল্লাহ্! মু‘আভিয়াকে কিতাব (ক্বোরআন-ই করীম) এবং অংক শাস্ত্রের জ্ঞান দান করো আর তাঁকে আযাব থেকে রক্ষা করো!
[সূত্র: আন্-নাহিয়া, পৃষ্ঠা ১৪, কৃত আরিফ বিল্লাহ্ হযরত আল্লামা আবদুল আযীয হারভী, প্রণেতা ‘নিবরাস শরহে আক্বাঈদে নাসাফী]

দুই. হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবূ ‘আমীরাহ্ মাদানী সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রসূল-ই কা-ইনাত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর পক্ষে দো‘আ করেছেন- اَللّٰهُمَّ اجْعَلْهُ هَادِيًا مَهدِ يًا وَاهْدِ بِهِ النَّاسَ- অর্থ: হে আল্লাহ্! মু‘আভিয়াকে ‘হাদী’ ও ‘মাহদী’ (যথাক্রমে হিদায়য়তকারী ও হিদায়তপ্রাপ্ত) করে দাও! আর তার মাধ্যমে লোকজনকে হিদায়ত দাও! [সূত্র: তিরমিযী শরীফ, মিশকাত শরীফ: পৃষ্ঠা- ৫৭৯]

তিন. হযরত ইবনে আবী শায়বাহ্ ‘মুসান্নাফ’-এ, তাবরানী ‘মু’জাম-ই কবীর’-এ আবদুল মালিক ইবনে ওমায়র থেকে বর্ণনা করেছেন, হযরত মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেছেন, আমাকে সরকার-ই আক্বদাস এরশাদ করেছেন- يَا مُعَاوِيَةُ اِذَا مَلَكْتَ فَاَحْسِنْ অর্থ: হে মু‘আভিয়া! যখন তুমি বাদশাহ্ হবে, তখন লোকজনের সাথে সুন্দর আচারণ করো। [সূত্র: তারীখুল খোলাফা, পৃষ্ঠা-১৩২]

নোট: জনসাধারণের মধ্যে যা প্রসিদ্ধি আছে যে, একদিন হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দেখলেন, হযরত আমীর মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ইয়াযীদকে কাঁধের উপর বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন, তখন হুযূর-ই আকরাম এরশাদ করলেন, ‘‘জান্নাতী জাহান্নামীকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে।’’ একথা ভুল ও অবস্তাব। কারণ ইয়াযীদ হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাত শরীফের প্রায় ১৫ বছর পর, ২৫ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেছিলো। [সূত্র: সাওয়ানিহ্-ই কারবালা] তাছাড়া,

হযরত আমীর মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর এসব ফযীলত ও প্রনিধানযোগ্য:
এক. হযরত আমীর মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ওহী লিখক ছিলেন, চিঠিপত্র লিখকও।
ইমাম মুফতী-ই হেরমাঈন আহমদ ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে মুহাম্মদ তাবারী ‘খোলাসাতুস্ সিয়ার’-এ লিখেছেন, নবী-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর তেরজন কাতিব (লিখক) ছিলেন। তাঁরা হলেন, চার খালীফা, ‘আমির ইবনে ফুহায়রা, আবদুল্লাহ্ ইবনে আরক্বাম, উবাই ইবনে কা’ব, সাবিত ইবনে ক্বায়স ইবনে শাম্মাস, খালিদ ইবনে সা‘ঈদ ইবনিল ‘আস, হানযালাহ্ ইবনে রবী’ আসলামী, যায়দ ইবনে সাবিত, শুরাহ্বীল ইবনে হাসানাহ্ এবং মু‘আভিয়া ইবনে আবূ সুফিয়ান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম। কিন্তু তাঁদের মধ্যে হযরত আমীর মু‘আভিয়া এবং হযরত যায়দ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা এ খিদমত বেশী আন্জাম দিতেন। আল্লামা ক্বাস্তলানী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বোখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থে লিখেছেন, হযরত আমীর মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হুযূর-ই আক্বদাস সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ওহী লিখিক ছিলেন।
[সূত্র: আন-নাহিয়াহ্, পৃষ্ঠা-১৬]

দুই. হযরত মোল্লা আলী ক্বারী ‘মিরক্বাত শরহে মিশকাত’-এ লিখেছেন, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মুবারক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু (যিনি হযরত ইমাম-ই আ’যম আবূ হানীফাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর খাস শাগরিদ ছিলেন)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয উত্তম, নাকি হযরত মু‘আভিয়া উত্তম? (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা) তদুত্তরে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মুবারক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন-غُبَارٌ دَخَلَ فىْ اَنْفِ فَرَسِ مُعَاوِيَةَ حِيْنَ غَزَا فِىْ رِكَابِ رَسُوْلِ اللهِ صَلّى اللهُ تَعَالٰى عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَفْضَلُ مِنْ كَذَا عُمَرَ بْنِ عَبْدِ الْعَزِيْزِ- অর্থ: হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে জিহাদ করার সময় হযরত আমীর মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ঘোড়ার নাকের ভিতর যেই ধূলি-বালি প্রবেশ করেছিলো তা এমন ওমর ইবনে আবদুল আযীয অপেক্ষো উত্তম। [সূত্র: আন্-নাহিয়াহ্, পৃষ্ঠা- ১৬] সুবহানাল্লাহ্: হযরত আমীর মু‘আভিয়ার এ কেমন মহা মর্যাদা!

তিন. হযরত আল্লামা ক্বাযী আয়ায রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি লিখেছেন, আল্লামা মু‘আফী ইবনে ইমরান আলায়হির রাহমাহ্ ওয়ার রিদ্বওয়ানকে এক ব্যক্তি বললো, ‘‘হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয হযরত মু‘আভিয়া থেকে উত্তম।’’ একথা শুনামাত্র আল্লামা ইবনে ইমরান রাগান্বিত হয়ে বললেন-
لَايُقَاسُ اَحَدٌ بِاَصْحَابِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- অর্থ: নবী-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণের সাথে কাউকে তুলনা করা যাবে না। তিনি আরো বলেন-مُعَاوِيَةُ صَاحِبُه وَصَهْرُه وَكَاتِبُه وَاَمِيْنُه عَلى وَحْىِ اللهِ عَزَّوَجَلَّ-অর্থ: হযরত মু‘আভিয়া নবী-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবী, তাঁর শ্যালক, তাঁর কাতিব এবং মহামহিম খোদার ওহীর উপর নবী-ই আকরামের আমানতদার। [সূত্র: প্রাগুক্ত]

চার. আল্লামা শিহাব উদ্দীন খাফ্ফাজী ‘নসীমুর রিয়াদ্ব শরহে শেফা-ই ক্বাদ্বী আয়াদ্ব’-এ লিখেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি হযরত আমীর মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বিপক্ষে সমালোচনা করে সে জাহান্নামী কুকুরগুলো থেকে একটি কুকুর।’’ [সূত্র: আহ্কাম-ই শরীয়ত, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ১০৩]

পাঁচ. বোখারী শরীফের হাদীস, হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমাকে এক ব্যক্তি বললো, ‘‘হযরত আমীর মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সম্পর্কে আপনি কি বলেন, অথচ অমুক মাসআলায় তিনি এমন বলেছেন?’’ তদুত্তরে তিনি বলেন-اَصَابَ اِنَّه فَقِيْهٌ অর্থাৎ হযরত আমীর মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু (ঠিক বলেছেন, তিনি নিশ্চয় ফকীহ্) মুজতাহিদ। [সূত্র: মিশকাত শরীফ] তিনি সাওয়াব পাবেন, যদিও ভুল করেন। [সূত্র: মিরক্বাত শরহে মিশকাত: পৃষ্ঠা- ১৬০, ২য় খণ্ড]

ছয়. হযরত আল্লামা ক্বাস্তলানী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বোখারী শরীফের ব্যাখ্যায় লিখেছেন- হযরত আমীর মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বড় গুণী ও বড় প্রশংসনীয়। [সূত্র: আন-নাহিয়াহ, পৃষ্ঠা-১৭]

কারামত
হযরত আমীর মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু কারামত বিশিষ্ট সাহাবী:
এক. ‘তাত্বহীরুল জিনান’ নামক কিতাবে সহীহ্ সনদ সহকারে বর্ণিত, যখন হযরত আমীর মু‘আভিয়া যহরত ওসমান গণী রাদ্বিল্লাহু তা‘আলা আনহুর শাহাদাতের খবর শুনলেন, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘‘মক্কাবাসীরা হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে মক্কা শরীফ থেকে হিজরত করতে বাধ্য করেছিলো। সুতরাং সেখান থেকে আর খিলাফত পরিচালিত হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। আর মদীনা মুনাওয়ারায় খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত ওসমান গণীকে শহীদ করা হয়েছে।
সুতরাং সেখান থেকেও খিলাফাতের রাজধানী বের হয়ে গেছে। আর এটা হযরত আমীর মু‘আভিয়ার কারামত।
[সূত্র: আমীর মু‘আভিয়ার পর এক নযর, পৃষ্ঠা- ৭২]

দুই. যখন ইয়াযীদকে নিজের ‘যুবরাজ’ (وليعهد) নিয়োগ করেছিলেন, তখন তিনি দো‘আ করেছিলেন, ‘‘হে আল্লাহ্! যদি সে এর উপযুক্ত না হয়, তবে তার সালতানাতকে পরিপূর্ণ করবেন না।’’ সুতরাং তেমনি হয়েছে, হযরত আমীর মু‘আভিয়ার ওফাতের পর মাত্র তিন বছর কয়েক মাস ইয়াযীদ জীবিত ছিলো; কিন্তু তার সালতানাৎ পূর্ণতায় পৌঁছতে পারেনি। [প্রাগুক্ত]

তিন. তাঁর আরেকটি কারামত আরিফ বিল্লাহ্ মাওলানা জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ রূমী ক্বুদ্দিসা সিররুহু তাঁর মসনভী শরীফে বর্ণনা করেন-
হাদীস শরীফে এসেছে যে, মু‘মিনদের মামা অর্থাৎ হযরত আমীর মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু রাতে আপন মহলে ঘুমাচ্ছিলেন। হঠাৎ এক ব্যক্তি এসে তাঁকে জাগ্রত করলো। যখন তাঁর চোখ দু’টি খুললো, তখন সে আত্মগোপন করলো। তিনি যখন পূর্ণ কামরায় গভীরভাবে দেখলেন তখন দেখতে পেলেন কেউ পর্দার আড়ালে নিজেকে গোপন করার চেষ্টা করছে। তিনি বললেন, ‘‘তুমি কে? তোমার নাম কি?’’ সে বললো, ‘‘আমার প্রকাশ্য নাম হতভাগা ইবলীস।’’ তিনি বললেন, ‘‘তুমি আমাকে জাগালে কেন?’’ ইবলীস বললো, ‘‘আপনি নবী-ই আকরামের পেছনে নামায জমা‘আত সহকারে সম্পন্ন করে থাকেন। আজও গিয়ে নামায সম্পন্ন করুন! যদি আপনি এ জমা‘আত সহকারে নামায পড়তে না পারেন, তাহলে আপনি আন্তরিকভাবে দুঃখিত হয়ে আল্লাহ্র দরবারে কান্নাকাটি করবেন। এতে দু’শ রাক‘আতের সাওয়াব পেতে দেখলে আমি খুব দুঃখ পাবো। এ জন্য আমি আপনাকে জাগ্রত করে দিলাম।’’
আমি হিংসাপরায়ণ। হিংসার কারণে আমি একাজটি করলাম, যাতে আপনি বেশী সাওয়াব না পান। আমি আপনার দুশমন; প্রতারণা আমার কাজ।’’ তিনি বললেন, এখন তুমি সত্য বলেছো। তোমার বর্ণনায় তুমি সত্যবাদী। তোমার দ্বারা তো এমন কাজই সম্পন্ন হয়, এরই উপযোগী তুমি।’’ ইবলীস কারো পাকড়াও-এ না আসলেও হযরত আমীর মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর পাকড়াও থেকে বাঁচতে পারেনি। তাঁকে সে ধোঁকা দিতে পারেনি। এটা তাঁর অনন্য কারামত।
উপরিউক্ত বর্ণনা থেকে একথা প্রমাণিত হলো যে, হযরত আমীর মু‘আভিয়া অতি মর্যাদাবান সাহাবী। তিনি নবী-ই দু’জাহানের অতি প্রিয় সাহাবী। তাঁর জন্য নবী-ই আকরামের দো‘আগুলো আল্লাহ্র মহান দরবারে কবূল হয়েছে। কারণ, নবীগণ আলায়হিমুস্ সালাম-এর দো‘আ নিঃসন্দেহে মাকবূল। হযরত আমীর মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর জন্য দো‘আ করেছেন নবীকুল সরদার, আমাদের আক্বা ও মাওলা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। সুতরাং এমন মহান মর্যাদাবান সাহাবীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাই ঈমানের দাবী। তাঁর প্রতি শত্রুতা করা মুনাফিক্বী বৈ-কিছুই নয়। নিম্নে সাহাবী-ই রসূলের মর্যাদায় কয়েকটা আয়াত শরীফ ও সহীহ হাদীস পেশ করার প্রয়াস পেলাম, যাতে তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অপরিহার্যতা ও অশালীনতা প্রদর্শনকারীর ভয়াবহ পরিণতির বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট হয়-

পবিত্র ক্বোরআনে সাহাবীর ফযীলত
এক. আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমান- وَكُلاًّ وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنٰى- তরজমা: আল্লাহ্ তা‘আলা সমস্ত সাহাবীর সাথে কল্যাণ অর্থাৎ জান্নাতের ওয়াদা করেছেন। [সূরা নিসা: আয়াত ৯৫, কানযুল ঈমান]

দুই. رَّضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُواْ عَنْهُ ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ- তরজমা: আল্লাহ্ তাঁদের উপর সন্তুষ্ট এবং তাঁরাও আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট। এটাই হচ্ছে বড় সাফল্য। [সূরা মা-ইদাহ্: আয়াত-১১৯: কান্যুল ঈমান]

তিন. أَعَدَّ اللَّهُ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا ذٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ- তরজমা: আল্লাহ্ তাদের জন্য তৈরী করে রেখেছেন বেহেশ্তসমূহ, সেগুলোর নিম্ন দেশে নদীসমূহ প্রবাহিত; তারা সর্বাদা তাতেই অবস্থান করবে। এটাই মহান সাফল্য। [সূরা তাওবা: আয়াত-৮৯; কান্যুল ঈমান]

চার. أُوْلٰۤئِكَ هُمُ الصَّادِقُونَ- তরজমা: তারাই সত্যবাদী। [সূরা হুজুরাত: আয়াত-১৫: কান্যুল ঈমান]

পাঁচ. فَأُولٰۤئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ- তরজমা: সুতরাং তারাই সফলকাম। [সূরা হাশর: আয়াত- ৯: কান্যুল ঈমান]

ছয়. أُوْلٰۤئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا لَّهُمْ دَرَجَاتٌ عِندَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ- তরজমা: এরাই প্রকৃত মুসলমান। তাদের জন্য মর্যাদা সমূহ রয়েছে। তাদের রবের নিকট, আর ক্ষমা রয়েছে এবং সম্মানের জীবিকা। [সূরা আন্ফাল: আয়াত-৪; কান্যুল ঈমান] এসব ফযীলত সাহাবা-ই কেরামের জন্য ক্বোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে। এগুলো যেমন প্রত্যেক সাহাবী, তেমনি হযরত আমীর মু‘আভিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আনহুরও।

সাহাবা-ই কেরাম ও হাদীসসমূহ
সাহাবা-ই ক্বেরামের ফযীলত অনেক সহীহ হাদীসেও বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকট নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

এক. হুযূর-ই আকরাম এরশাদ করেছেন- اَكْرِمُوْا اَصْحَابِىْ فَاِنَّهُمْ خِيَارُكُمْ- অর্থ: তোমরা আমার সাহাবীদেরকে সম্মান করো। কারণ তারা তোমাদের সবার চেয়ে উত্তম। [সূত্র: মিশকাত শরীফ:পৃষ্ঠা- ৫৫৪]

দুই.
اَصْحَابِىْ كَالنُّجُوْمِ فَبِاَيِّهِمْ اِقْتَدَيْتُمْ اِهْتَدَيْتُمْ- অর্থ: আমার সাহাবীগণ তারাগুলোর মতো; তাদের মধ্য থেকে তোমরা যারই অনুসরণ করবে হিদায়ত পেয়ে যাবে। [সূত্র: মিশকাত শরীফ: পৃষ্ঠা- ৫৫৪]

তিন. فَمَنْ سَبَّهُمْ فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللهِ وَالْمَلٰئِكَةِ وَالنَّاسِ اَجْمَعِيْنَ لَا يَقْبَلُ اللهُ مِنْهُ صَرْفًا وَلَاعَدْلًا (رَوَاهُ الطَّبَرَانِىْ)-
অর্থ: যে ব্যক্তি তাঁদেরকে (সাহাবীগণ) গালি দেবে এবং মন্দ বলে, তার উপর আল্লাহ্ তা‘আলা, সকল ফেরেশতা এবং সমস্ত মানুষের লা’নত (অভিসম্পাত), আল্লাহ্ তা‘আলা তার না ফরয কবূল করেন, না নফল। [তাবরানী] চার. হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-اِذَا رَأَيْتُمُ الَّذِيْنَ يَسُبُّوْنَ اَصْحَابِىْ فَقُوْلُوْا لَعْنَةُ اللهِ عَلٰى شَرِّكُمْ-
অর্থ: যখন তোমরা ওইসব লোককে দেখবে, যারা আমার সাহাবীদেরকে গালি দিচ্ছে এবং তাঁদেরকে মন্দ বলছে, তখন তোমরা বলো, ‘‘তোমাদের এ মন্দ কাজের উপর খোদার লা’নত হোক। [সূত্র: মিশকাত: পৃষ্ঠা ৫৫৪] পরিশেষে, হযরত আমীর মু‘আভিয়াকে যেসব হতভাগা গালি দেয়, তারা যে কত নিকৃষ্ট ও অভিশপ্ত তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলো। তাই বর্তমানকার শিয়া সম্প্রদায় ও তাদের দোসরদের সম্পর্কে সতর্ক হোন এবং তাদেরকে ঘৃণা সহকারে বর্জন করুন!
(চলবে)

লেখক: মহাপরিচালক আন্জুমান রিচার্স সেন্টার।