বৈশ্বিক মহামারী : করোনা ভাইরাস
বৈশ্বিক মহামারী : করোনা ভাইরাস
ডা. এ এস এম শওকতুল ইসলাম শওকত
এমবিবিএস (সিইউ), এমপিএইচ (আমেরিকা)
ডিপিটিআর (ইন্ডিয়া), পিজিটি-মেডিসিন (লন্ডন)
পিএইচডি-ফিজিক্যাল মেডিসিন (ফেলো)
উৎপত্তি
করোনা ভাইরাস এমন এক সংক্রমক ভাইরাস, যা আগে এত ব্যাপকভাবে মানুষের মধ্যে ছড়ায়নি। এ ভাইরাসে বিশ্বব্যাপী প্রাণহানির সংখ্যা আজকের তথ্য মতে, ১৫ লাখ ৪৩ হাজার ছাড়িয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা ৬ কোটি ৭৫ লাখের বেশি। বাংলাদেশে মৃত্যু সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার এবং আক্রান্তের সংখ্যা ৪ লাখ ৮২ হাজার। ভাইরাসটির আরেক নাম ২০১৯-এনসিওভি বা নোভেল করোনা ভাইরাস। করোনা ভাইরাসের অনেক প্রজাতি আছে। এর মধ্যে ছয়টি প্রজাতি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। তবে এটি নতুন ধরনের ভাইরাস। তাই এর সংখ্যা এখন সাতটি।
২০০২ সালে চীনে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া সার্স (সিভিয়ার এ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) ভাইরাসে পৃথিবীতে ৮০৯৮ জন সংক্রমিত হয় এবং ৭৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সেটিও ছিল এক ধরনের করোনা ভাইরাস। নতুন এ রোগকে প্রথমে নানাভাবে নামকরণ করা হয়েছিল। যেমন ‘চায়না ভাইরাস’, করোনা ভাইরাস’, ‘২০১৯ এনকভ’, ‘ফনেটিক ভাইরাস’ ইত্যাদি। চলতি সালের ফ্রেরুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ রোগটির আনুষ্ঠানিক নামকরণ করে ‘করোনা ভাইরাস ডিজিজ ২০১৯’। সংক্ষেপে ‘কোভিড-১৯’।
লক্ষণ
* রেসপিরেটরি লক্ষণ ছাড়াও জ্বর, কাশি, শ্বাস-প্রশ্বাস সমস্যা। * ফুসফুসে আক্রমণ। * সাধারণত শুষ্ক কাশি ও জ্বরে উপসর্গের সূচনা। পরে শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা। * সাধারণত রোগের উপসর্গগুলো প্রকাশে গড়ে পাঁচ দিন সময়।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ভাইরাসটির ইনকিউবেশন পিরিয়ড ১৪ দিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। তবে কোন কোন গবেষকের মতে, এর স্থায়িত্ব ২৪ দিন পর্যন্ত হতে পারে। কারো মধ্যে যখন ভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেবে, তখন তার কাছে অবস্থানকারী মানুষদেরও সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকবে। এমনও ধারণা রয়েছে, সুস্থ থাকার সময়ও দেহে ভাইরাস সংক্রমিত করতে পারে। প্রাথমিক উপসর্গে সাধারণ সর্দি, জ্বর ও ফ্লু’র সাথে সাদৃশপূর্ণ রোগ নির্ণয়ে দ্বিধাগ্রস্থ হওয়া স্বাভাবিক।
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব অনেককে সার্স ভাইরাসের কথা স্মরণ করে দিয়েছে। যা ২০০০ সালের শুরুতে এশিয়ার অনেক দেশে প্রায় ৭৭৪ জনের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। নতুন ভাইরাসটির জেনেটিক কোড বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে,এটি অনেকটাই সার্স ভাইরাসের মত। এডিনবারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মার্ক উলহাউস বলেছিলেন, ‘আমরা যখন নতুন কোন করোনা ভাইরাস দেখি, তখন জানতে চাই এর লক্ষণগুলো কতটা মারাত্মক। এ ভাইরাসটি অনেকটা ফ্লুর মত, তবে সার্স ভাইরাসের চেয়ে মারাত্মক নয়’।
ক্ষতিকর লক্ষণ
জ্বর দিয়ে ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়। এরপর শুকনো কাশি দেখা দিতে পারে। এ অবস্থায় এক সপ্তাহ পর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। তখন রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হয়। এখন পর্যন্ত বৈশ্বিকভাবে শনাক্তের তুলনায় মৃত্যুর হার শতকরা ৩ ভাগের কিছু বেশি।
ইউরোপের কোন কোন অঞ্চলে এখন অধিক মৃত্যুহার দেখা যাচ্ছে। ৫৬ হাজার আক্রান্ত রোগীর উপর চালানো এক জরিপে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে,
* এ রোগে ৬% কঠিনভাবে অসুস্থ হয়। তখন ফুসফুস বিকল, সেপটিক শক, অঙ্গ বৈকল্য এবং মৃত্যুর সম্ভাবনা তৈরি হয়।
* ১৪% এর মধ্যে তীব্র উপসর্গ দেখা দেয়। তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা তৈরি হয়।
* ৮০% এর মধ্যে হালকা উপসর্গ দেখা দেয়। জ্বর কাশি ছাড়াও কারো কারো নিউমোনিয়ার উপসর্গ দেখা যেতে পারে।
বয়স্ক ব্যক্তি এবং যাদের অ্যাজমা, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তাদের মারাত্মক অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চীন থেকে পাওয়া তথ্য গবেষণায় জানা যায়, এ রোগে নারীদের চেয়ে পুরুষদের মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি।
আক্রান্ত ব্যক্তি যেন শ্বাস-প্রশ্বাসে সহায়তা পায় এবং তার দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যেন ভাইরাস মোকাবেলা করতে পারে তা নিশ্চিত করাই চিকিৎসকের দায়িত্ব। একটি ভ্যাকসিনের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়ে উৎপাদন পর্যায়ে রয়েছে। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবিত একটি ভ্যাকসিনও পরীক্ষার চূড়ান্ত ধাপে রয়েছে। এ টিকার উপাদান হল, কোভিড-১৯ ভাইরাসের একটি জেনেটিক কোড। যা আসল ভাইরাস থেকেই নকল করে তৈরি করা হয়। এ কপিটি বিপজ্জনক নয় এবং তা মানবদেহে সংক্রমণ ঘটাতে পারে না। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতিরক্ষামূলক পোশাক ও সার্জিক্যাল মাস্ক বা মুখোশ পরে রোগীদের আলাদা আলাদা করে চিকিৎসা সেবা দিতে হবে। এ অবস্থায় রোগীদের ভাইরাস রয়েছে কিনা তা জানতে এবং রোগীদের সংস্পর্শে আসা লোকদের শনাক্তের জন্য গোয়েন্দা কর্মকা- বা নজরদারি ব্যবস্থা প্রয়োজন।
ভাইরাসের পরিবর্তন
ভাইরাসটি কোন একটা প্রাণী থেকে মানুষের দেহে ঢুকেছে এবং একজন থেকে অন্যজনের দেহে ছড়াতে ছড়াতে পুনরায় নিজের জিনগত গঠনে সবসময় পরিবর্তন আনছে। যাকে মিউটেশন বলা হয়। এখন পর্যন্ত এ ভাইরাস বহু বার নিজের জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়েছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। অনেকের আশঙ্কা এ মিউটেশনের মাধ্যমে ভাইরাসটি দিন দিন আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। এ ভাইরাসের প্রকৃতি এবং কীভাবে তা রোধ করা যেতে পারে এ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা বিশদভাবে জানার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। সার্স বা ইবোলার নানা ধরনের প্রাণঘাতী ভাইরাসের খবর সংবাদ মাধ্যমে আসে। এ করোনা ভাইরাস তার মধ্যে সর্বশেষ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি মানুষের দেহকোষে ইতোমধ্যে ‘মিউটেট’ করছে। অর্থাৎ গঠন পরিবর্তন করে নতুন রূপ নিচ্ছে এবং সংখ্যা বৃদ্ধি করছে। ফলে এটি আরো বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এ ভাইরাস মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে এটি একজনের দেহ থেকে অন্য জনের দেহে ছড়ায়। সাধারণ ফ্লু বা ঠাণ্ডা লাগার মত করেই হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এ ভাইরাস ছড়ায়।
শরীরের ক্ষতিকর দিক
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে করোনাভাইরাস সম্পর্কে প্রথম জানা গেলেও ইতোমধ্যে এ ভাইরাস এবং এর ফলে সৃষ্ট রোগ ‘কোভিড-১৯’ এর মহামারি সামাল দিতে হচ্ছে বিশ্ববাসীকে। অধিকাংশ মানুষের জন্য এ রোগটি খুব ভয়াবহ নয়, কিন্তু অনেকেই মারা যায় এ রোগে। ভাইরাসটি কীভাবে দেহে আক্রান্ত করে, কেন করে, কেনই বা মানুষ এই রোগে মারা যায়? ভাইরাসটি নিজেকে মানব দেহে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত করে। ভাইরাসটি শরীরের কোষগুলোর ভেতরে প্রবেশ করে সেগুলো নিয়ন্ত্রণে নেয়ার মাধ্যমে কাজ শুরু করে। করোনা ভাইরাস-এর আনুষ্ঠানিক নাম সার্স সিওভি-২। যা আক্রান্ত মানুষের হাঁচি বা কাশি ও নিশ্বাসের সাথে সুস্থ মানুষের দেহে প্রবেশ করতে পারে। অথবা ভাইরাস সংক্রমিত কোনো জায়গায় হাত দেয়ার পর মুখে হাত দিলে শুরুতে তা গলা, শ্বাসনালী ও ফুসফুসের কোষে আঘাত করে। এরপর সে সব জায়গায় কারোনার কারখানা তৈরি করে। প্রাথমিক পর্যায়ে অসুস্থবোধ হয় না এবং কিছু মানুষের মধ্যে হয়তো উপসর্গও দেখা দেবে না। ইনকিউবেশনের প্রথম সংক্রমণ এবং উপসর্গ দেখা দেয়ার মধ্যবর্তী সময় স্থায়িত্ব একেক জনের জন্য একেক রকম হয়, যা গড়ে তা পাঁচ দিন।
অধিকাংশ মানুষের অভিজ্ঞতায় করোনা ভাইরাস নিরীহ অসুখই মনে হবে। দশ জনের মধ্যে আট জন মানুষের জন্যই কোভিড-১৯ নিরীহ সংক্রমণ এবং এর প্রধান উপসর্গ কাশি ও জ্বর। এ ছাড়া শরীর ব্যথা, গলা ব্যথা এবং মাথা ব্যথাও হতে পারে। কারো কারো তা নাও হতে পারে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসটিকে শক্রভাবাপন্ন হওয়ায় প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করার ফলে গায়ে জ্বর আসে। প্রাথমিকভাবে করোনা ভাইরাসের কারণে শুষ্ক কাশি হয়। কোষগুলো ভাইরাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়ায় অস্বস্তিতে পড়ার কারণে সম্ভবত শুকনো কাশি হয়ে থাকে। তবে অনেকের কাশির সাথে থুতু বা কফ বের হওয়া শুরু করবে। যার মধ্যে ভাইরাসের প্রভাবে মৃত ফুসফুসের কোষগুলোও থাকবে। এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে পরিপূর্ণ বিশ্রাম, প্রচুর তরল পান করা এবং প্যারাসিটামল খাওয়ার উপদেশ দেয়া হয়ে থাকে। তখন হাসপাতাল বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়ার প্রয়োজন হয় না। এ ধাপটি এক সপ্তাহ স্থায়ী হয়। অধিকাংশ মানুষ এ ধাপের মধ্যে আরোগ্য লাভ করে। কারণ ততদিনে তাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসের সাথে লড়াই করে সেটিকে প্রতিহত করে ফেলে। তবে কিছু মানুষের মধ্যে কোভিড-১৯ এর আরো ক্ষতিকর একটি সংস্করণ তৈরি হয়। এ রোগ সম্পর্কে নতুন গবেষণায় ধারণা প্রকাশ করা হয়েছে, রোগটির এ ধাপে আক্রান্তদের সর্দিও লাগতে পারে।
ভয়াবহতা
লণ্ডনের কিংস্ কলেজের ড. নাথালি ম্যাকডরমেট বলেন, ‘ভাইরাসটি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। ফলে শরীর অতিরিক্ত মাত্রায় ফুলে যায়। কীভাবে এটি ঘটছে, তা আমরা এখনো নিশ্চিতভাবে জানি না’। ফুসফুসের প্রদাহ তৈরি হওয়াকে নিউমোনিয়া বলে। মুখ দিয়ে প্রবেশ করে শ্বাসনালী দিয়ে ফুসফুসের ছোট টিউবগুলোয় যদি যাওয়া যেত, তাহলে হয়ত শেষ পর্যন্ত ক্ষুদ্র আকারের বায়ুথলিতে গিয়ে পৌঁছত। এ থলিগুলোর মাধ্যমে রক্তে অক্সিজেন যায় এবং কার্বনডাই অক্সাইড বের হয়। কিন্তু নিউমোনিয়া ক্ষেত্রে এ ক্ষুদ্র থলিগুলো পানি দিয়ে ভর্তি হতে শুরু করে। ফলে শ্বাস নিতে অস্বস্তিবোধ হয়। শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যার মত উপসর্গ তৈরি করে। কিছু মানুষের শ্বাস নিতে ভেন্টিলেটর প্রয়োজন হয়। চীন থেকে পাওয়া তথ্য উপাত্ত অনুযায়ী এ ধাপে ১৪% মানুষ আক্রান্ত হয়।
এখন পর্যন্ত ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় ৬% করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ অতি জটিল পর্যায়ে রয়েছে। এ ধাপে শরীর স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে সক্ষম হয় না এবং মৃত্যুর সম্ভাবনা তৈরি হয়। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সারা শরীরে বিভিন্ন রকম ক্ষয়ক্ষতি তৈরি করে। রক্তচাপ যখন অস্বাভাবিকভাবে কমে যায় তখন এ ধাপে আক্রান্ত ব্যক্তি সেপটিক শক পেতে পারেন। তখন তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ফুসফুসে প্রদাহ ছড়িয়ে পড়লে শ্বাস-প্রশ্বাসে তীব্র সমস্যার উপসর্গ দেখা দেয়। কারণ তখন শরীরকে টিকিয়ে রাখাতে পুরো শরীরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন প্রবাহিত হতে পারে না। ফলে কিডনির রক্ত পরিশোধন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে এবং অন্ত্রের দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ডা. বি. পঙ্খানিয়া বলেন, ‘ভাইরাসটি এত বড় পরিসরে প্রদাহ তৈরি করে, যাতে পুরো শরীর ভেঙ্গে পড়ে, একসাথে একাধিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অবশ করে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যদি ভাইরাসের সাথে পেরে না ওঠে তখন তা শরীরের সব প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং আরো বড় ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা তৈরি করে। এ অবস্থায় আক্রান্তকে চিকিৎসা দিতে ইসিএমও বা এক্সট্রা-কোর্পোরেয়াল মেমব্রেন অক্সিজেনেশন পদ্ধতি ব্যবহার করা হতে পারে’।
প্রথম মৃত্যু
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও কোন কোন সময় রোগীর মৃত্যু ঘটে। চীনের উহান শহরের জিনইনতান হাসপাতালে মারা যাওয়া দুজনই স্বাস্থ্যবান ব্যক্তি ছিলেন, যদিও তারা ধূমপান করতেন। প্রথমে ৬১ বছর বয়সের পুরুষটি মারা যায়। হাসপাতালে ভর্তির সময় তার তীব্র নিউমোনিয়া ছিল। তার শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা ছিল। তাকে ভেন্টিলেটরে রাখা হলেও তার ফুসফুস বিকল হয়ে যায় এবং হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়। হাসপাতালে ১১ দিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। দ্বিতীয় রোগীর বষয় ৬৯ বছর। তারও শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যাপক সমস্যা ছিল। তাকেও ইসিএমও মেশিনের সহায়তা দেয়া হয়, তবুও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। রক্তচাপ কমে যাওয়ার পর তিনি তীব্র নিউমোনিয়া ও সেপটিক শকে মারা যান।
সংক্রমণ প্রশমনে করণীয়
* গণপরিবহন: গণপরিবহন এড়িয়ে চলা কিংবা সর্তকতার বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাস, ট্রেন, স্টিমার ও অন্য যে কোন পরিবহনের হাতল বা আসনে করোনা ভাইরাস থাকতে পারে। সেজন্য পরিবহনে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করা এবং সেখান থেকে নেমে ভালোভাবে হাত পরিস্কারে গুরুত্ব দিচ্ছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা।
* কর্মক্ষেত্র : অফিসে এক ব্যক্তি একই ডেস্ক এবং কম্পিউটার ব্যবহার করলেও ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাঁচি কাশি থেকে করোনা ভাইরাস ছড়ায়। যে কোন জায়গায় করোনা ভাইরাস কয়েক ঘন্টা এমনকি কয়েকদিন পর্যন্ত থাকতে পারে। অফিসের ডেস্কে বসার আগে কম্পিউটার, কীবোর্ড এবং মাউস পরিস্কার করে নিতে হবে।
* জনসমাগম স্থল : যে সব জায়গায় মানুষ বেশি জড়ো হয় সে সব স্থান এড়িয়ে চলা কিংবা বাড়তি সর্তকতার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে খেলাধুলার স্থান, সিনেমা হল, ইত্যাদি রয়েছে।
* ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান : ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকদের অনেকে একটি কলমই ব্যবহার করেন। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি যদি সে কলম ব্যবহার করে, তাতে পরবর্তী ব্যবহারকারীদের করোনা সংক্রমনের ঝুঁকি থাকে। সে জন্য নিজের কলম নিজেকে ব্যবহার করতে হবে। টাকা উত্তোলনে এটিএম বুথ থেকেও সংক্রমণ হতে পারে। কারণ এর বাটন ব্যবহারকারীদের মধ্যে করোনা আক্রান্ত থাকতে পারে।
* লিফ্ট : বাড়ি ও অফিসের লিফ্ট থেকেও ভাইরাস সংক্রমণ হতে পারে। লিফ্টে উঠা-নামার সময় করোনা ভাইরাস আক্রান্ত কেউ লিফ্টের বাটন ব্যবহার করলে তাতে অন্যদেরও সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে। তাই লিফ্ট থেকে নেমে হাত পরিষ্কার করে নিতে হবে।
* টাকা-পয়সা : ব্যাংক নোট বা টাকা-পয়সায় নানা ধরনের জীবাণুর উপস্থিতি বহুবার শনাক্ত হয়েছে। ব্যাংক নোটের মাধ্যমেও নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশংকা করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের কিছু গবেষক ২০১৯ সালের অগাস্ট মাসে বলেছিলেন, দেশীয় কাগুজে নোট ও ধাতব মুদ্রায় ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পেয়েছেন, যা সাধারণত মলমূত্রে থাকে। সম্প্রতি ভাইরাসের উপস্থিতি নিয়ে চীনে টাকা জীবাণুমুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশটিতে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর ভাইরাসটির বিস্তার ঠেকাতে বাজার থেকে ব্যাংক নোট সংগ্রহ করে তা জীবাণুমুক্ত করে সরবরাহ করা হয়েছে।
* শুভেচ্ছা বিনিময় : করমর্ধন ও কোলাকুলির মাধ্যমেও করোনা ভাইরাস ছড়াতে পারে। তাই করমর্দন এবং কোলাকুলি না করার পরামর্শ দিচ্ছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সবকিছুর মূল হচ্ছে নিজে এবং পরিবেশকে সর্বদা পরিচ্ছন্ন রাখা। হাত ধুয়েই মুখম-ল স্পর্শ করা। এটি করা হলে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে না। সংক্রমণ ঠেকাতে নিয়মিত ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা।
* স্থায়িত্ব : করোনা ভাইরাস বিভিন্ন জিনিসে থাকার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, সাধারণ জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করা হলে এগুলো খুব সহজে নষ্ট হয়ে যায়। গবেষণায় জানা গেছে, এ ভাইরাস স্টীল বা প্লাস্টিকের ওপরে ৭২ ঘন্টা, পিতলের ওপর ৪ ঘন্টা এবং কার্ডবোর্ডের ওপর ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়
শিশুরা মানসিক চাপের মুখে নানাভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। যেমন মায়ের গায়ের সাথে বেশি লেপ্টে থাকা, কথা না বলা, বিনাকারণে রেগে যাওয়া বা উত্তেজিত হওয়া, বিছানা ভিঝিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। সন্তানের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় সহানুভূতি দেখাতে হবে। তারা কী বলতে চায় শুনতে হবে এবং তাদের বেশি আদর করতে হবে। কঠিন সময়ে শিশুদের প্রতি ভালোবাসা, মনোযোগ ও সময় দিতে হবে। তাদের সাথে সুন্দর করে কথা বলতে হবে এবং তাদের দাবি বা আবদার পূরণে আশ্বস্ত করতে হবে।
শিশুদের খেলার, ছবি আঁকার এবং আরাম করার সুযোগ দিতে হবে। তাদেরকে মা বাবা ও পরিবারের কাছাকাছি রাখার চেষ্টা করতে হবে। যতটা সম্ভব তাদের দেখাশুনার লোক থেকে আলাদা করা যাবে না। প্রতিদিন স্কুল বা মাদ্রাসায় যাওয়া, লেখাপড়া শিখা, খেলাধুলা করা ও আরাম আয়েশ ইত্যাদিতে রুটিন অনুসরণ করাতে হবে। প্রতিদিন যা ঘটে থাকে এর ভালো কিছু তাদের জানাতে হবে।
গর্ভবতীর করণীয়
কোভিড-১৯ সংক্রমণ সনাক্ত হোক বা না হোক, গর্ভবতী নারী এবং নবজাতক ও ছোট শিশুর মায়েদেরকে বুকের দুধ খাওয়ানো বিষয়ক পরামর্শ, সেবা, মৌলিক মনোসামাজিক সহায়তা এবং বুকের দুধ খাওয়ানো বিষয়ক ব্যবহারিক সহায়তা দিতে হবে। গর্ভবর্তী মায়ের করোনা ভাইরাসের উপসর্গ দেখা দিলে শিশুর জন্ম পরবর্তী সময়ে হাসপাতালে না যাওয়াই ভাল, যতক্ষণ আইসোলেশন কাল শেষ না হয়। যদি গর্ভবতী মায়ের এপয়েন্টমেন্ট বাতিল হয়ে য্য়া তবে প্রসূতি ইউনিটের সাথে কথা বলে পুনরায় এপয়েন্টমেন্ট নিশ্চিত করে নিতে হবে। বাচ্চার করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সন্দেহ থাকলে তাকে সারাক্ষণ পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।
করোনা ভাইরাস হল বৈশ্বিক মহামারী ও মহাদুর্যোগ। এতে বিশ্বের বহু মানুষ মারা যায়। এখনো প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে। চিকিৎসাসেবায় সুস্থও হচ্ছে। তবে সুস্থের তুলনায় মৃতের সংখ্যা অধিক। প্রাণঘাতি এ রোগের কারণে ইতোমধ্যে বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধরনের মন্দা ও সংকটে পতিত হতে শুরু করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষার্জন ও জ্ঞান র্চ্চায় চরম ব্যাঘাত হয়েছে এবং হচ্ছেও।
করোনা ভাইরাসের প্রথম ধাক্কা শেষ না হতেই বর্তমানে এর দ্বিতীয় ঢেউ চরমভাবে আঘাত হানতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেকে- ওয়েব শুরু হওয়ায় নতুন করে লক-ডাউন, শার্ট-ডাউনসহ সামাজিক, অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নানামুখী সর্তকতা ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। শীতপ্রধান দেশগুলোতে কারোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণ উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশেও দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। জুলাই মাসে চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ সংক্রমণের পর অক্টোবরে অনেকটা শূন্যের কোটায় নেমে আস্লেও নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে তা বাড়তে থাকে। নমুনা পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ শনাক্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
উদ্বেগের সাথে লক্ষ্যণীয়, সংক্রমণ বাড়লেও মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। গণপরিবহণ ও জনসমাগমে মাস্ক না পরে অবাধে চলাফেরা করছে মানুষ। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশন মাস্ক ব্যবহারে সচেতনতা কর্মসূচির পাশাপাশি অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিতেও দেখা যায়। মাস্কবিহীন ব্যক্তিদের জেল-জরিমানাও করা হচ্ছে। ফলে চলাচলের মানুষ কিছুটা সচেতন হলেও বাজারে ও গণপরিবহণে শারীরিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না। এটি নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে করোনার প্রকোপ কমানো সম্ভব হবে না।
করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় ভ্যাকসিন গবেষণা উদ্ভাবন, উৎপাদন, পরীক্ষণ ও বিক্রয়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়। তবে ভ্যাকসিন প্রাপ্তিতে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার বাস্তবতাও অস্বীকার করা য়ায় না। সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সফল ভ্যাকসিনের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এর মোকাবেলায় সকলের মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে সতকর্তা বাড়াতে হবে।
করোনার দ্বিতীয় ধাপে সংক্রমণ মারাত্মক ও ব্যাপক প্রাণঘাতি হয়ে ওঠার আগেই তা প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ দিতে হবে। জনসমাগম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে আইনী ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। করোনা হটলাইন ও ভার্চুয়াল স্বাস্থ্যসেবা বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট অধিদফ্তর ও সংস্থাগুলোকে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে হবে।
প্রবন্ধটি ১০ ডিসেম্বর ২০২০ বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা রাঙ্গুনিয়া উপজেলা শাখা আয়োজিত সেমিনারে উপস্থাপন করা হয়।
তথ্য সূত্র :
১. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বুলেটিন ২০২০
২. নোভেল করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) সুরক্ষা বিষয়ক ইশতেহার :বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা রাঙ্গুনিয়া উপজেলা মডেল শাখা, চট্টগ্রাম। ২৫ মার্চ ২০২০
৩. সম্পাদকীয় : দৈনিক পূর্বদেশ, চট্টগ্রাম। ২৫ নভেম্বর ২০২০
৪. সম্পাদকীয় : দৈনিক পূর্বকোণ, চট্টগ্রাম। ২৮ নভেম্বর ২০২
লেখক – বিশিষ্ট চিকিৎসক