অহংকার পতনের মূল

অহংকার পতনের মূল

অহংকার পতনের মূল

লেখক
অধ্যাপক মাওলানা
সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল-আযহারী
অধ্যাপক, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।

সম্পাদনায়
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান
মহাপরিচালক- আনজুমান রিসার্চ সেন্টার,
আলমগীর খানক্বাহ্ শরীফ, ষোলশহর, চট্টগ্রাম।

প্রকাশকাল

১১ জমাদিউল উলা, ১৪৪২ হিজরি
১১ পৌষ, ১২২৭ বাংলা
২৬ ডিসেম্বর, ২০২০ ইংরেজি

সর্বস্বত্ত্ব প্রকাশকের

বর্ণসাজ : মুহাম্মদ ইকবাল উদ্দিন

হাদিয়া : ৮০/- (আশি) টাকা

প্রকাশনায়
আন্জুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট
[প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগ] ৩২১, দিদার মার্কেট (৩য় তলা) দেওয়ান বাজার, চট্টগ্রাম-৪০০০, বাংলাদেশ। ফোন : ০৩১-২৮৫৫৯৭৬,

সূচি

বিষয় পৃষ্ঠা
 মুখবন্ধ ০৪
 অহংকারের সংজ্ঞা ০৬
 ‘কিবর’-এর আভিধানিক অর্থ ০৭
 ইসলামের পরিভাষায় অহংকার ০৮
 কিবর ও ‘উজবের মধ্যে পার্থক্য ১১
 অহংকার সকল পাপের মূল ১৩
 অহংকারের কারণসমূহ ২১
 অহংকারের আলামতসমূহ ৩৭
 মানুষ যা নিয়ে অহংকার করে ৫০
 অহংকার যাদেরকে হক থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে ৬০
 মানব জীবনে অহংকারের প্রভাব ও পরিণতি ৬৬
 অহংকারীর পরিণতি ও শাস্তি ৭৭
 দুনিয়াতে অহংকারীর শাস্তি ৭৯
 পরকালে অহংকারীর শাস্তি ৮৩
 অহংকার দূরীকরণের উপায়সমূহ ৮৯
 অহংকারের চিকিৎসা ১০৩
 যে অহংকার শোভনীয় ১১৬
 উপসংহার ১১৮

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

অহংকার
কোনো মানুষ যখন নিজকে অন্য কোনো মানুষের তুলনায় উত্তম, উন্নত, ক্ষমতাধর কিংবা বড় মনে করে; অথবা কাউকে কোনোভাবে নিজের তুলনায় ছোট বা হেয় মনে করে; তার এই মানসিকতাকে অহংকার বলে। এটি একটি মানসিক অনুভূতি। তবে মানুষের কাজের মাধ্যমে এটার প্রকাশ ঘটে।
সমাজে আমরা এমন বহু রকমের পেশা ও কাজের লোকজনের সঙ্গে এবং বিচিত্র চরিত্রের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করি, যাদের পারস্পরিক উপলব্ধি বিভিন্ন রকমের। সেজন্য তাদের সম্পর্কে মূল্যায়ন করা খুব সহজ কাজ নয়। ধৈর্য এবং মনোবল ছাড়া এমন মানুষের মাঝে বসবাস করা কঠিন। অহংকারী লোকদের কেউ পছন্দ করে না। সবাই চায়, তাদের আশেপাশের লোকজন মাটির মতো প্রশান্ত মানুষ হোক, মিথ্যা অহংকারমুক্ত ভালোবাসার মানুষ হোক। আর এ কাক্সিক্ষত লক্ষে পৌঁছার পথে প্রতিবন্ধকতা হল অহংকার।
অহংকার এমন এক বদ স্বভাব, যা অন্যদের সঙ্গে পরামর্শ করা কিংবা অন্যের সাহায্য চাওয়ার মানসিকতা পর্যন্ত নষ্ট করে দেয়। এ ছাড়া অহংকারী লোকের আচার-আচরণ, কর্মকান্ড স্বার্থপরতা, ভয় ও ত্রাস সৃষ্টি করে। যার ফলে অন্যদের অধিকার পদদলিত হয়। মঙ্গল ও কল্যাণ অনুভবের পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। এমনকি নিজের যোগ্যতা, সামর্থ্য ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেধার বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যায়। তাই তো জ্ঞানীরা বলেন, ‘মেধা ও প্রতিভা ধ্বংসের সহজতম উপায় হলো- অহমিকা।’
বিনয় যেমন মাটির মানুষকে আকাশের উচ্চতায় উঠিয়ে নেয়, ঠিক এর বিপরীতে যশ-খ্যাতি, সম্মান, অর্থসম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, বিদ্যা-বুদ্ধি ইত্যাদি যে কোনো ক্ষেত্রে কেউ যখন সফলতার চূড়া স্পর্শ করে অহংকার করতে থাকে তখন তা তাকে নিক্ষেপ করে আকাশের উচ্চতা থেকে সাত জমিনের নীচে।
এক আরবী গল্পে অহংকারের উপমা খুব চমৎকার ফুটে উঠেছে। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে কেউ যখন নিচে তাকায়, তখন সবকিছুই তার কাছে ছোট ছোট মনে হয়। নিজের দুই চোখ দিয়ে হাজারো মানুষকে সে ছোট করে দেখে। আবার যারা নিচে আছে তারাও তাকে ছোটই দেখে। তবে দুই চোখের পরিবর্তে এক হাজার মানুষের দুই হাজার চোখ তাকে ছোট করে দেখছে। অর্থাৎ অহংকার করে একজন যখন সবাইকে তুচ্ছ মনে করে তখন এ অহংকারীকেও অন্য সবাই অর্থাৎ হাজারো মানুষ তুচ্ছ মনে করে।
অহংকার পতনের মূল। অহংকার ধ্বংস ডেকে আনে। অহংকারী যে ধ্বংসপ্রাপ্ত, তার উদাহরণ হলো- ইবলিস শয়তান। ইবলিস ছিলো- জিনদের অন্তর্ভুক্ত এবং হাজার হাজার বছর আল্লাহর ইবাদতে মশগুল ছিলো। ফেরেশতাদের কাতারেও তার একটা বিশেষ পদমর্যাদা ছিলো। কিন্তু যখন ইবলিস আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে অহংকার দেখালো, তখনই সে প্রত্যাখ্যাত হয়ে গেলো এবং একেবারে চিরদিনের জন্য বিতাড়িত, পথভ্রষ্ট ও ধিক্কৃত হয়ে গেল।
আল্লাহ তাআ’লা দুনিয়াতে সবাইকে তাঁর নি’মাত তথা ধন-সম্পদ, ক্ষমতা, মেধা ও যোগ্যতা সমানভাবে দেন না। তার এই নি’মাত কাউকে দেন আবার কাউকে দেন না। ক্ষেত্রবিশেষে কমবেশি করে দেন। মানুষের উচিত হলো- আল্লাহ প্রদত্ত নি’মাতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। মানুষ যখন আল্লাহর নি’মাতের কথা ভুলে এটাকে নিজের সম্পদ মনে করে, তখনই অহংকারের সূত্রপাত হয়। আর এই অহংকারের কারণে আল্লাহ তাআ’লার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।
অহংকার থেকে বাঁচতে আল্লাহ প্রদত্ত ধন-সম্পদ, জ্ঞান, যোগ্যতাকে আল্লাহ প্রদত্ত দয়া, রহমত ও নি’মাত ভেবে তাঁর শোকরিয়া আদায় করতে হবে। আর যে ব্যক্তি এসব নি’মাত পাননি তার জন্য মহান রবের দরবারে দোয়া করতে হবে, যাতে আল্লাহ তাকেও এ সব নি’মাত দ্বারা ধন্য করেন।
আর এ মানসিকতাও পোষণ করতে হবে যে, আমি যে ইবাদত-বন্দেগী করছি তা আল্লাহ প্রদত্ত নি’মাতের তুলনায় অতি নগণ্য। কাজেই আমার তৃপ্ত হওয়ার কিছু নেই। আল্লাহ প্রদত্ত এ নি’মাত যেকোনো মুহূর্তে ছিনিয়ে নিতে পারেন, তিনি একজন বাদশাকে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ফকিরে পরিণত করতে পারেন।
আমাদের সব নি’মাত আল্লাহর দান। আর এ নিয়ে গর্ব করার অর্থ দাতার দানের প্রতি অবজ্ঞা করা। অতএব আমাদের সর্বদা সাবধান থাকতে হবে। যাতে কখনো সম্পদ, শক্তি, ক্ষমতা, শিক্ষা, সৌন্দর্য, পেশা বা অন্য কোনো নি’মাতের কারণে অহংকার না করি, অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন না করি।
উপর্যুক্ত আলোচনা দ্বারা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট যে, অহংকার একটি মারাত্মক গুনাহ। যার শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ। তাই তা পরিহার করে বিনয়ী হওয়া অত্যন্ত জরুরী। বিনয় মানুষের মর্যাদাকে বৃদ্ধি করে। পক্ষান্তরে, অহংকার মানুষের মর্যাদাকে বিনষ্ট করে। অহংকারকারী নিজকে নিজের কাছে অনেক বড় মনে করে। কিন্তু আল্লাহর কাছে অহংকারীদের কোনো মূল্য নেই। একই বাক্য উচ্চারিত হয়েছে, হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র কণ্ঠে, তিনি বলেন,
عَنِ الأَعْمَشِ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ، عَنْ عَابِسِ بْنِ رَبِيعَةَ، قَالَ: قَالَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، وَهُوَ عَلَى الْمِنْبَرِ: يَا أَيُّهَا النَّاسُ تَوَاضَعُوا فَإِنِّي سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقُولُ: ” مَنْ تَوَاضَعَ لِلَّهِ رَفَعَهُ اللَّهُ، فَهُوَ فِي نَفْسِه صَغِيرٌ وَفِي أَعْيُنِ النَّاسِ عَظِيمٌ، وَمَنْ تَكَبَّرَ وَضَعَهُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ، فَهُوَ فِي أَعْيُنِ النَّاسِ صَغِيرٌ وَفِي نَفْسِه كَبِيرٌ، وَحَتَّى لَهُوَ أَهْوَنُ عَلَيْهِمْ مِنْ كَلْبٍ أَوْ خِنْزِيرٍ
‘হে মানব সকল! তোমরা বিনয়ী হও। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এরশাদ করতে শুনেছি, যে আল্লাহর জন্যে বিনয়ী হয়, আল্লাহ পাক তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। সে নিজের কাছে তুচ্ছ এবং মানুষের দৃষ্টিতে সম্মানিত। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি অহংকার করে আল্লাহ পাক তাকে হেয় করে দেন। সে মানুষের দৃষ্টিতে অসম্মানিত ব্যক্তিতে পরিণত হয় এবং নিজেকে অনেক বড় মনে করে। পরিশেষে সে মানুষের কাছে কুকুর অথবা শুকরের চেয়েও ঘৃণিত ও তুচ্ছে পরিণত হয়।’( )

الكِبْر (কিবর) বা অহংকারের সংজ্ঞা
মনে রাখতে হবে, অহংকার ও বড়াই মানবাত্মার জন্য খুবই ক্ষতিকর ও মারাত্মক ব্যাধি, যা একজন মানুষের নৈতিক চরিত্রকে শুধু কলুষিতই করে না বরং তা একজন মানুষকে হেদায়াত ও সত্যের পথ থেকে দূরে সরিয়ে ভ্রষ্টতা ও গোমরাহির পথের দিকে নিয়ে যায়। যখন কোন মানুষের অন্তরে অহংকার ও বড়াইর অনুপ্রবেশ ঘটে, তখন তা তার জ্ঞান, বুদ্ধি ও ইচ্ছার উপর প্রাধান্য বিস্তার করে এবং তাকে নানাবিধ প্রলোভন ও প্ররোচনার মাধ্যমে খুব শক্ত হস্তে টেনে নিয়ে যায় ও বাধ্য করে সত্যকে অস্বীকার ও বাস্তবতাকে প্রত্যাখ্যান করতে। আর একজন অংহকারী সবসময় চেষ্টা করে হকের নিদর্শনসমূহকে মিটিয়ে দিতে। অত:পর তার নিকট সজ্জিত ও সৌন্দর্য মন্ডিত হয়ে ওঠে কিছু বাতিল, ভ্রান্ত, ভ্রষ্টতা ও গোমরাহি যার কোন বাস্তবতা নেই। ফলে সে এ সবেরই অনুকরণ করতে থাকে এবং গোমরাহিতে নিপতিত থাকে। এ সবের সাথে আরও যোগ হবে, মানুষ সে যত বড় হোক না কেন, তাকে সে নিকৃষ্ট মনে করবে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তাকে অপমান করবে।
নিজেকে অন্যের তুলনায় উত্তম ও শ্রেষ্ঠ এবং অন্যকে নিজের তুলনায় তুচ্ছ ও ঘৃণ্য মনে করার নাম অহংকার। কুরআন ও হাদিসে এটির ওপর কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। অহংকার একমাত্র আল্লাহ পাকের বৈশিষ্ট্য অভ্যাস। এটি বান্দার জন্যে শোভা পায় না। তাই অহংকার করা বান্দার জন্যে নির্বোধসুলভ আচরণ।

الكِبْر (কিবর) এর আভিধানিক অর্থ
অহংকারের আরবী নাম ‘কিব্র’ (الْكِبْر)। যার অর্থ বড়ত্ব। অন্যের চাইতে নিজেকে বড় মনে করাই এর অন্তর্নিহিত বক্তব্য। এর পারিভাষিক অর্থ, সত্যকে দম্ভভরে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা।
অহংকার ও আত্মম্ভরিতা দু’টিই বড়াই ও বড়ত্বের একক উৎস থেকে উৎসারিত। বস্তুতঃ এ রোগে যে আক্রান্ত হয়, সে নিজেকে নিজে ধ্বংস করে। তার দ্বারা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, সংগঠন, এমনকি রাষ্ট্র ধ্বংস হয়।
আল্লামা ইবনে ফারেস রহমাতুল্লাহি আলইহি বলেন, কিব্র অর্থ: বড়ত্ব, বড়াই, অহংকার ইত্যাদি। অনুরূপভাবে الكبرياء অর্থও বড়ত্ব, বড়াই, অহংকার। প্রবাদে আছে: ورثوا المجد كابرًا عن كابر অর্থাৎ, ইজ্জত সম্মানের দিক দিয়ে যিনি বড়, তিনি তার মত সম্মানীদের থেকে সম্মানের উত্তরসূরি বা উত্তরাধিকারী হয়েছেন।
আর আল্লামা ইবনু মানযূর উল্লেখ করেন, الكِبْر শব্দটিতে ‘কাফ’ যের বিশিষ্ট। এর অর্থ হল, বড়ত্ব, অহংকার ও দাম্ভিকতা।
আবার কেউ কেউ বলেন, تكبر তাকাব্বারা শব্দটি كبر কিব্র হতে নির্গত। আর تَكابَر من السن শব্দটি দ্বারা বার্ধক্য বুঝায়। আর تكبر তাকাব্বুর ও استكبار ইস্তেকবার শব্দটির অর্থ হল, বড়ত্ব, দাম্ভিকতা ও অহমিকা।( )

ইসলামী পরিভাষায় অহংকারের সংজ্ঞা
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই স্বীয় হাদীসে অহংকারের সংজ্ঞা বর্ণনা করেন।
عن عبد الله بن مسعود، عن النبي صلى الله عليه و سلم قال: لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ في قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ قَالَ رَجُلٌ: إِنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ أَنْ يَكُونَ ثَوْبُهُ حَسَناً، ونَعْلُهُ حَسَنَةً، قَالَ: إِنَّ اللَّهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمالَ، الْكِبْرُ: بَطَرُ الْحَقِّ، وَغَمْطُ النَّاسِ.
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাস্‘ঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যার অন্তরে একটি অণু পরিমাণ অহংকার থাকে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা বললে এক লোক দাঁড়িয়ে আরয করল, কোন কোন লোক এমন আছে যে, সে সুন্দর কাপড় পরিধান করতে পছন্দ করে, সুন্দর জুতা পরিধান করতে পছন্দ করে, এসবকে কি অহংকার বলা হবে? উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, আল্লাহ তা‘আলা নিজেই সুন্দর, তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন। [সুন্দর কাপড় পরিধান করা অহংকার নয়] অহংকার হল, সত্যকে গোপন করা এবং মানুষকে নিকৃষ্ট বলে জানা। ( )
এর অর্থ এটা নয় যে, অহংকার করলেই সে জাহান্নামে যাবে। বরং এর অর্থ হ’ল সত্য জেনেও মিথ্যার উপরে যিদ করা এবং নানা অজুহাতে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা। আর ‘অন্যকে তুচ্ছ জ্ঞান করা’ অর্থ হ’ল সর্বদা নিজেকে অন্যের চেয়ে বড় মনে করা এবং অন্যের কাছে সর্বদা নিজের উচ্চ মূল্যায়ন কামনা করা। ফলে তার চাহিদা মতে যথাযথ মূল্যায়ন না পাওয়াতেই সে অন্যকে হেয় জ্ঞান করে।
এ হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি অংশে অহংকারের সংজ্ঞা তুলে ধরেন।
এক: بَطَرُ الْحَقِّ হককে অস্বীকার করা, হককে কবুল না করে তার প্রতি অবজ্ঞা করা এবং হক কবুল করা হতে বিরত থাকা। ( )
হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হযরত আবু মুসা আশয়ারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র নিকট চিঠি লিখেন,
ولا يمنعك قضاءٌ قضيتَه اليومَ فراجعتَ فيه رأيَك فهُديت فيه لرُشدِك أن تراجعَ الحقَّ، فإنَّ الحقَّ قديمٌ، وليس يُبطلُه شيءٌ، ومراجعةُ الحقِّ خيرٌ من التَّمادي في الباطل( )
তুমি গতকাল যে ফায়সালা দিয়েছিলে, তার মধ্যে তুমি চিন্তা-ফিকির করে যখন সঠিক ও সত্য তার বিপরীতে পাও, তাহলে তা থেকে ফিরে আসাতে যেন তোমার নফস তোমাকে বাধা না দেয়। কারণ, সত্য চিরন্তন, সত্যের পথে ফিরে আসা বাতিলের মধ্যে সময় নষ্ট করার চেয়ে অনেক উত্তম।( )
আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী রহমাতুল্লাহি আলইহি বলেন,
كنا في جنازة فيها عبيد الله بن الحسن، وهو على القضاء، فلمَّا وضع السرير؛ جلس، وجلس الناس حوله، قال: فسألته عن مسألة، فغلط فيها، فقلت: أصلحك الله، القول في هذه المسألة كذا وكذا؛ إلا إني لم أرد هذه، إنما أردت أن أرفعك إلى ما هو أكبر منها، فأطرق ساعة، ثم رفع رأسه، فقال: إذاً أرجع وأنا صاغر، إذاً أرجع وأنا صاغر؛ لأن أكون ذَنَباً في الحق أحبُّ إليَّ من أن أكون رأساً في الباطل. ( )
আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী রহমাতুল্লাহি আলইহি বলেন, একদা আমরা একটি জানাজায় উপস্থিত হলাম, তাতে ক্বাযী উবাইদুল্লা ইবনুল হাসান রহমাতুল্লাহি আলইহি হাজির হলেন। আমি তাকে একটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি ভুল উত্তর দেন, আমি তাঁকে বললাম, আল্লাহ আপনাকে সংশোধন করে দিন, এ মাসআলার সঠিক উত্তর এভাবে…। তিনি কিছু সময় মাথা নিচু করে চুপ করে বসে থাকলেন, তারপর মাথা উঠিয়ে বললেন, আমি আমার কথা থেকে ফিরে আসলাম, আমি লজ্জিত। সত্য গ্রহণ করে লেজ হওয়া আমার নিকট মিথ্যার মধ্যে থেকে মাথা হওয়ার চেয়ে অধিক উত্তম।( )
দ্বিতীয়: غَمْطُ النَّاسِ বা মানুষকে নিকৃষ্ট জানা। الغمط বলা হয়, নিকৃষ্ট মনে করা, ছোট মনে করা ও অবজ্ঞা করাকে।
সুতরাং, غَمْطُ النَّاسِ অর্থ, মানুষ কে নিকৃষ্ট মনে করা, অবজ্ঞা করা, তুচ্ছ মনে করা ও মানুষকে ঘৃণা করা। মানুষের গুণের থেকে নিজের গুণকে বড় মনে করা। কারো কোন কর্মকে স্বীকৃতি না দেয়া, কোন ভালো গুণকে মেনে নেয়ার মানসিকতা না থাকা।( )
الكبر (কিব্র) অহংকার ওالعجب
(‘উজব) বা আত্মতৃপ্তি’র মধ্যে পার্থক্য
قال أبو وهب المروزي: سألت ابن المبارك: ما الكبر؟ قال: أنْ تزدري الناس. فسألته عن العجب؟ قال: أنْ ترى أنَّ عندك شيئًا ليس عند غيرك، لا أعلم في المصلين شيئًا شرًا من العجب. ( )
আবু ওহাব আল-মারওয়াযি রহমাতুল্লাহি আলইহি বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারককে জিজ্ঞাসা করলাম কিব্র কি? উত্তরে তিনি বলেন, মানুষকে অবজ্ঞা করা।
তারপর আমি তাঁকে ‘উজব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘উজব কি?’ উত্তরে তিনি বললেন, তুমি তোমাকে মনে করলে যে, তোমার নিকট এমন কিছু আছে, যা অন্যদের মধ্যে নাই। তিনি বলেন, নামাযিদের মধ্যে ‘উজব বা আত্মতৃপ্তির চেয়ে খারাপ আর কোন মারাত্মক ত্রুটি আমি দেখতে পাই না।( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনটি নাজাত দানকারী ও তিনটি ধ্বংসকারী বিষয় থেকে মানুষকে সাবধান করেছেন।
عن أبى هريرة مرفوعًا بلفظ: ثَلَاثٌ مُنْجِّيَاتٌ، و”ثَلَاثٌ مُهْلِكَاتٌ، فَأَمَّا الْمُنْجِيَاتُ: فَالْعَدْلُ فِي الرِّضَى وَالْغَضَبِ، وَالْقَصْدُ فِي الْفَقْرِ وَالْغِنَى، وَخَشْيَةُ اللَّهِ فِي السِّرِّ وَالْعَلَانِيَةِ،، وأَمَّا الْمُهْلِكَاتُ: فَشُحٌّ مُطَاعٌ، وَهَوًى مُتَّبَعٌ، وَإِعْجَابُ الْمَرْءِ بِنَفْسِه وهى أشدهن ( )
তিনটি বস্তু নাজাত দানকারী ও তিনটি ধ্বংসকারী। নাজাত দানকারী তিনটি বস্তু হলঃ (১) খুশীতে ও অখুশীতে সত্য কথা বলা, (২) সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতার মধ্যবর্তী অবস্থা বেছে নেওয়া, (৩) এবং গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহকে ভয় করা। আর ধ্বংসকারী তিনটি বস্তু হ’লঃ (১) লোভের দাস হওয়া, (২) প্রবৃত্তি পূজারী হওয়া এবং (৩) আত্ম অহংকারী হওয়া। তিনি বলেন, এটিই হ’ল সবচেয়ে মারাত্মক।( )
কারও কারও মতে,
التَّكَبُّرُ شَرٌّ مِنَ الشِّرْكِ فَإِنَّ الْمُتَكَبِّرَ يَتَكَبَّرُ عَنْ عِبَادَةِ اللهِ تَعَالَى، وَالْمُشْرِكَ يَعْبُدُ اللهَ وَغَيْرَهُ.
‘অহংকার শিরকের চেয়েও নিকৃষ্ট। কেননা অহংকারী ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদতের বিরুদ্ধে অহংকার করে। আর মুশরিক ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করে এবং সাথে অন্যেরও ইবাদত করে’।( )

—০—

অহংকার সকল পাপের মূল
অহংকার হচ্ছে সকল পাপের মূল। একে আরবীতে বলা হয় ‘উম্মুল আমরাদ্ব-সকল রোগের জননী’। বরং বলা যায়, এ জগতের প্রথম পাপই হচ্ছে অহংকার। হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করার পূর্বে আল্লাহ তা‘আলা যখন ফেরেশতাদেরকে তাঁর মানব-সৃষ্টির ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন তখন তারা বলেছিল, ( )
قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً ۖ قَالُوا أَتَجْعَلُ فِيهَا مَن يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ ۖ قَالَ إِنِّي أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ ০
আর তোমার পালনকর্তা যখন ফেরেশতাদেরকে বললেনঃ আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি বানাব, তখন ফেরেশতাগণ বলল, তুমি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করবে যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরা প্রতিনিয়ত তোমার গুণকীর্তন করছি এবং তোমার পবিত্র সত্তাকে স্মরণ করছি। তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে আমি তা জানি, যা তোমরা জান না। [বাক্বারাহ-৩০] মনে মনে তারা এও ভেবেছিল-আল্লাহ তাআলা কিছুতেই এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন না, যে আমাদের চেয়ে বেশি জানে এবং তাঁর নিকট আমাদের তুলনায় অধিক সম্মানিত হবে। এসবের পরও ফেরেশতাদেরকে যখন আল্লাহ বললেন, তোমরা আদমকে সাজদা কর, সকলেই সাজদায় লুটিয়ে পড়ল। এই তো ফেরেশতাদের পরিচয়। তাদেরকে যা আদেশ করা হয় তারা তা-ই করে। তারা আল্লাহ তা’আলা যা আদেশ করেন, তা অমান্য করে না এবং যা করতে আদেশ করা হয়, তাই করে।( )
কিন্তু ফেরেশতাদের মাঝে বেড়ে ওঠা শয়তান মাটি আর আগুনের যুক্তি হাযির করল। সে আগুনের তৈরি বলে মাটির তৈরি মানুষকে সাজদা করতে অস্বীকৃতি জানাল। আল্লাহ পাক ক্বোরআনে পাকে এরশাদ করেন-
اَبٰی وَ اسْتَكْبَرَ وَ كَانَ مِنَ الْكٰفِرِیْنَ.
সে অস্বীকৃতি জানাল এবং অহংকার করল। আর সে ছিল কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত। [সূরা বাক্বারা: ৩৪] এই হল প্রথম অহংকারের ইতিহাস। ক্বোরআনে কারীমে বর্ণিত প্রথম পাপের বিবরণ। এ পাপের দরুণ শয়তান অভিশপ্ত হল, জান্নাত থেকে বিতাড়িত হল, মানুষের শত্রুতার ঘোষণা দিয়ে পৃথিবীতে এল। কত শক্ত শপথ সেদিন সে করেছিল,
قَالَ فَبِمَاۤ اَغْوَیْتَنِیْ لَاَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِیْمَ ثُمَّ لَاٰتِیَنَّهُمْ مِّنْۢ بَیْنِ اَیْدِیْهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ اَیْمَانِهِمْ وَعَنْ شَمَآىِٕلِهِمْ وَلَا تَجِدُ اَكْثَرَهُمْ شٰكِرِیْنَ ঙ
সে বলল, আপনি যেহেতু আমাকে পথচ্যুত করেছেন তাই আমি অবশ্যই তাদের জন্যে আপনার সরল পথে বসে থাকব। এরপর আমি অবশ্যই তাদের কাছে আসব তাদের সামনের দিক থেকে, তাদের পেছন থেকে, তাদের ডান দিক থেকে এবং তাদের বাম দিক থেকে। আর আপনি তাদের অধিকাংশকেই কৃতজ্ঞ পাবেন না। [সূরা আ‘রাফ: ১৬-১৭] এই যে শয়তানের শপথ এবং এ শপথের শক্তিতে সে বিভ্রান্ত ও পথহারা করে যাচ্ছে বনী আদমকে, এর মূলে তো সেই অহংকার। অহংকার তাই বিবেচিত হয় সবচেয়ে ভয়ংকর আত্মিক রোগ হিসেবে।
বর্তমান সময়ের একটি ভয়ংকর রোগ হচ্ছে ক্যান্সার। এ রোগ কিছুদিন মানুষের শরীরে লুক্বিয়ে থেকে একসময় প্রকাশ পায়। রোগ প্রকাশ পাওয়া, রোগীর শরীরে বিভিন্ন আলামত ফুটে ওঠাও এক প্রকার নি’মাত। কারণ এর মাধ্যমেই রোগীর চিকিৎসার পথ উন্মোচিত হয়। কিন্তু অহংকার রোগটি এমন, মানুষ মনেই করে না যে, তার মধ্যে অহংকার আছে। রোগের অনুভূতিই যখন না থাকে তখন এর চিকিৎসার কথা ভাববে কীভাবে?
অহংকার কি? এ প্রশ্নের সরল উত্তর হচ্ছে, কোনো বিষয়ে নিজেকে বড় মনে করে অন্য মানুষকে তুচ্ছ মনে করার নামই অহংকার। শক্তিতে, সামর্থ্যে, বয়সে, অভিজ্ঞতায় ত্রিশ বছরের যুবক যতটা সমৃদ্ধ, বার বছরের একটি ছেলে তো সবক্ষেত্রেই তার তুলনায় হবে রিক্তহস্ত। তার ছোট হওয়া এবং তাকে ছোট মনে করা এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা। বাস্তবেই যে ছোট তাকে ছোট মনে করা অহংকার নয়। বরং অহংকার হচ্ছে, সে ছোট বলে তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করা। প্রচূর টাকা যার ব্যাংক একাউন্টে সঞ্চিত, সে তো দিনে আনে দিনে খাওয়া ব্যাক্তিকে অর্থবিত্তে ছোট মনে করতেই পারে। এটা অহংকার নয়। অহংকার হচ্ছে তাকে তাচ্ছিল্য করা, গরীব বলে তাকে হেয় করা।
এ অহংকার একটি ঘাতক ব্যাধি। পবিত্র ক্বোরআনে বিভিন্নভাবে এরশাদ হয়েছে এই ঘাতক ব্যাধির কথা। যা মানুষের অন্তর্জগৎকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়। আর এর পরকালীন ক্ষতি তো রয়েছেই। যে অহংকার শয়তানকে ‘শয়তানে’ পরিণত করেছে, অভিশপ্ত করে দিয়েছে, রহমতবঞ্চিত করেছে, সে অহংকারের মন্দ দিক সম্পর্কে আর কিছু না বললেও চলে। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
سَاَصْرِفُ عَنْ اٰیٰتِیَ الَّذِیْنَ یَتَكَبَّرُوْنَ فِی الْاَرْضِ بِغَیْرِ الْحَقِّ.
পৃথিবীতে যারা অন্যায়ভাবে অহংকার প্রকাশ করে তাদেরকে অবশ্যই আমি আমার নিদর্শনাবলি থেকে বিমুখ করে রাখব। (সূরা আ‘রাফ: ১৪৬)
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
اِلٰهُكُمْ اِلٰهٌ وَّاحِدٌۚ-فَالَّذِیْنَ لَا یُؤْمِنُوْنَ بِالْاٰخِرَةِ قُلُوْبُهُمْ مُّنْكِرَةٌ وَّ هُمْ مُّسْتَكْبِرُوْنَ لَا جَرَمَ اَنَّ اللّٰهَ یَعْلَمُ مَا یُسِرُّوْنَ وَ مَا یُعْلِنُوْنَؕ-اِنَّهٗ لَا یُحِبُّ الْمُسْتَكْبِرِیْنَ
তোমাদের মা’বুদ এক মা’বুদ। সুতরাং যারা আখেরাতে ঈমান রাখে না তাদের অন্তরে অবিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গেছে এবং তারা অহংকারে লিপ্ত। স্পষ্ট কথা, তারা যা গোপনে করে তা আল্লাহ জানেন এবং যা প্রকাশ্যে করে তাও আল্লাহ জানেন। নিশ্চয়ই তিনি অহংকারীকে পছন্দ করেন না। (সূরা নাহ্ল: ২২-২৩)

উদ্ধৃত আয়াতগুলো থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই তা এমন
১. অহংকারী ব্যক্তিকে আল্লাহ তাঁর নিদর্শন থেকে বিমুখ করে রাখেন। তার অন্তর ও চোখকে তিনি সত্য অনুধাবন এবং সঠিক পথ অবলম্বন থেকে ‘অন্ধ’ করে দেন। পবিত্র ক্বোরআনের কত জায়গায় আল্লাহ জ্ঞানীদের বলেছেন তার নিদর্শনাবলি নিয়ে চিন্তা করার কথা। এ চিন্তা মানুষের সামনে আল্লাহ পাকের বড়ত্ব, কুদরত এবং আমাদের ওপর তাঁর সীমাহীন অনুগ্রহ ফুটিয়ে তোলে। তখন স্বাভাবিকভাবেই মহান রবের কাছে সে নিজেকে পরিপূর্ণরূপে সঁপে দিতে প্রস্তুত হয়ে ওঠে; কৃতজ্ঞতায় সাজদাবনত হয়। তাই আল্লাহ যদি কাউকে তাঁর ওসব নিদর্শন থেকে বিমুখ করে রাখেন তাহলে সে যে দ্বীনের মূল ও সরল পথ থেকেও ছিটকে পড়বে তা তো নিশ্চিত।
২. আল্লাহ তাআলার প্রতি যার বিশ্বাস নেই, পরকালে বিশ্বাস নেই, অহংকার তো কেবল তারাই করতে পারে।
৩. অহংকারীকে আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন না। কী ইহকাল আর কী পরকাল, একজন মানুষের অশান্তি, লাঞ্ছনা আর সমূহ বঞ্চনার জন্যে এর পরে কি আর কিছু লাগে? ‘আল্লাহ সর্বশক্তিমান’ এ বিশ্বাস যাদের আছে তাদেরকে এ কথা মানতেই হবে যে, প্রকৃত সম্মান পেতে হলে আল্লাহ তা‘আলার প্রিয়ভাজন হতেই হবে।
আলোর দিশারী আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মানবজীবনের কোন্ দিকটি এমন আছে, যেখানে তাঁর কোনো নির্দেশনা পাওয়া যাবে না! অহংকারের ভয়াবহতা তিনি অনেক হাদীসেই স্পষ্ট করে বলেছেন। বিভিন্ন বচনে বলেছেন; বিভিন্ন প্রসঙ্গে বলেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
لاَ يَدْخُلُ الجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِه مِثْقَالُ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ مِنْ كِبْرٍ،
وَلاَ يَدْخُلُ النَّارَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّةٍ مِنْ إِيمَانٍ.
তিল পরিমাণ অহংকার যার অন্তরে আছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না, আর তিল পরিমাণ ঈমান যার অন্তরে ঈমান আছে সে দোযখে যাবে না।( )

এখানেও দুটি বিষয় লক্ষণীয়
এক. অহংকারী ব্যক্তি জান্নাতে যেতে পারবে না। জান্নাতে যেতে হলে আল্লাহ তা‘আলার কাছে উপস্থিত হতে হবে অহংকারমুক্ত ‘ক্বলবে সালীম’ নিয়ে।
দুই. এই হাদীসে জান্নাতের বিপরীতে দোযখের কথা যেমন বলা হয়েছে, এর পাশাপাশি ঈমানের বিপরীতে উল্লেখিত হয়েছে অহংকারের কথা; অথচ ঈমানের বিপরীত তো কুফর। বোঝাই যাচ্ছে, হাদীসে এত ভয়াবহরূপে অহংকারকে দেখানো হয়েছে যে, বিন্দু পরিমাণ অহংকার নিয়েও কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না!
অহংকার যে মানুষকে কতটা অন্ধ ও বাস্তবতাবিমুখ করে তোলে-সেই দৃষ্টান্তও রয়েছে পাক ক্বোরআনে। মানুষ হিসেবে যে যত পাপ করেছে, ফেরাউন ও নমরূদের সঙ্গে কি কারও কোনো তুলনা চলে! তারা যে অবাধ্যতার সব রকম সীমা লঙ্ঘন করেছিল এর মূলেও এই অহংকার। অহংকারের ফলে যখন নিজেকে বড় আর অন্যদের তুচ্ছ ভাবতে শুরু করল, এরই এক পর্যায়ে নিজেকে ‘খোদা’ দাবি করে বসল! আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে যখন কেউ কোনো কিছুকে শরীক করে, হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী সেটা সবচেয়ে বড় কবিরা গোনাহ। ক্বোরআনে বলা হচ্ছে-এ র্শিকের গোনাহ আল্লাহ ক্ষমা করবেন না!
إِنَّ اللهَ لَا يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذٰلِكَ لِمَن يَشَآءُ ۚ وَمَنْ يُّشْرِكْ بِاللهِ فَقَدِ افْتَرَىٰ إِثْمًا عَظِيمًا ০
নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে লোক তাঁর সাথে শরীক করে। তিনি ক্ষমা করেন এর নিম্ন পর্যায়ের পাপ যার জন্য তিনি ইচ্ছা করেন। আর যে লোক অংশীদার সাব্যস্ত করল আল্লাহর সাথে, সে নিশ্চয় অপবাদ আরোপ করল। [নিসা-৪৮] এ তো অন্যকে আল্লাহর সঙ্গে শরীক করলে। তাহলে কেউ যদি নিজেকেই খোদা বলে দাবি করে, সে অপরাধ কতটা জঘন্য-তা কি বলে বোঝানো যাবে?
মক্কার মুশরিকরা যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসেবে মানতে পারেনি-এর মূলেও তো একই অহংকার। বরং এই অহংকারের কারণেই পূর্ববর্তী নবীগণকেও অস্বীকার করেছিল তাদের স্ব স্ব গোত্রের বিত্তবান লোকেরা। মক্কার মুশরিকদের কথা পবিত্র ক্বোরআনে এভাবে আলোচিত হয়েছে-
وَ قَالُوْا لَوْ لَا نُزِّلَ هٰذَا الْقُرْاٰنُ عَلٰی رَجُلٍ مِّنَ الْقَرْیَتَیْنِ عَظِیْمٍ.
তারা বলে, এই ক্বোরআন কেন দুই এলাকার কোনো মহান (সম্পদশালী) ব্যক্তির ওপর অবতীর্ণ হল না! [সূরা যুখরুফ: ৩১] অহংকার থেকে মুক্ত থাকতে হলে কী করতে হবে সে পথও বাতলে দিয়েছে আমাদের পবিত্র ক্বোরআন। সে পথ শোকর ও কৃতজ্ঞতার পথ। বান্দা যখন শোকর আদায় করবে, কৃতজ্ঞতায় সাজদাবনত হবে, সবকিছুকেই আল্লাহর নি’মাত বলে মনে-প্রাণে স্বীকার করবে তখন তার কাছে অহংকার আসতে পারবেনা। শোকর করার অর্থই তো হল-আমার যা প্রাপ্তি, সবই আল্লাহর নি’মাত ও অনুগ্রহ। এখানে আমার কোনোই কৃতিত্ব নেই। এ ভাবনা যার মনে সদা জাগরুক থাকে, অহংকার তার মনে বাসা বাঁধতে পারে না।
সূরা কাহ্ফে দুই ব্যক্তির উপমা দেয়া হয়েছে এভাবে-
وَ اضْرِبْ لَهُمْ مَّثَلًا رَّجُلَیْنِ جَعَلْنَا لِاَحَدِهِمَا جَنَّتَیْنِ مِنْ اَعْنَابٍ وَّ حَفَفْنٰهُمَا بِنَخْلٍ وَّ جَعَلْنَا بَیْنَهُمَا زَرْعًاؕ (۳۲ (كِلْتَا الْجَنَّتَیْنِ اٰتَتْ اُكُلَهَا وَ لَمْ تَظْلِمْ مِّنْهُ شَیْــٴًـاۙ-وَّ فَجَّرْنَا خِلٰلَهُمَا نَهَرًاۙ (۳۳ (وَّ كَانَ لَهٗ ثَمَرٌۚ-فَقَالَ لِصَاحِبِهٖ وَ هُوَ یُحَاوِرُهٗۤ اَنَا اَكْثَرُ مِنْكَ مَالًا وَّ اَعَزُّ نَفَرًا(۳۴ (وَ دَخَلَ جَنَّتَهٗ وَ هُوَ ظَالِمٌ لِّنَفْسِهٖۚ-قَالَ مَاۤ اَظُنُّ اَنْ تَبِیْدَ هٰذِهٖۤ اَبَدًاۙ (۳۵( وَّ مَاۤ اَظُنُّ السَّاعَةَ قَآىٕمَةًۙ-وَّ لَىٕنْ رُّدِدْتُّ اِلٰى رَبِّیْ لَاَجِدَنَّ خَیْرًا مِّنْهَا مُنْقَلَبًا(۳۶ (قَالَ لَهٗ صَاحِبُهٗ وَ هُوَ یُحَاوِرُهٗۤ اَكَفَرْتَ بِالَّذِیْ خَلَقَكَ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُّطْفَةٍ ثُمَّ سَوّٰىكَ رَجُلًاؕ(۳۷( لٰكِنَّاۡ هُوَ اللّٰهُ رَبِّیْ وَ لَاۤ اُشْرِكُ بِرَبِّیْۤ اَحَدًا(۳۸ (وَ لَوْ لَاۤ اِذْ دَخَلْتَ جَنَّتَكَ قُلْتَ مَا شَآءَ اللّٰهُۙ-لَا قُوَّةَ اِلَّا بِاللّٰهِۚ-اِنْ تَرَنِ اَنَا اَقَلَّ مِنْكَ مَالًا وَّ وَلَدًاۚ (۳۹(
তুমি তাদের সামনে দুই ব্যক্তির উপমা পেশ কর, যাদের একজনকে আমি আঙ্গুরের দুটি বাগান দিয়েছিলাম এবং সে দুটিকে খেজুর গাছ দ্বারা ঘেরাও করে দিয়েছিলাম আর বাগান দুটির মাঝখানকে শস্যক্ষেত্র বানিয়েছিলাম। উভয় বাগান পরিপূর্ণ ফল দান করত এবং কোনোটিই ফলদানে কোনো ত্রুটি করত না। আমি বাগান দুটির মাঝখানে একটি নহর প্রবাহিত করেছিলাম। সেই ব্যক্তির প্রচুর ধনসম্পদ অর্জিত হল। অতঃপর সে কথাচ্ছলে তার সঙ্গীকে বলল: আমার অর্থসম্পদও তোমার চেয়ে বেশি এবং আমার দলবলও তোমার চেয়ে শক্তিশালী। নিজ সত্তার প্রতি সে জুলুম করেছিল আর এ অবস্থায় সে তার বাগানে প্রবেশ করল। সে বলল, আমি মনে করি না যে, এ বাগান কখনো ধ্বংস হবে। আমার ধারণা, ক্বিয়ামত কখনোই হবে না। আর আমাকে আমার প্রতিপালকের কাছে যদি ফিরিয়ে নেয়া হয় তবে আমি নিশ্চিত, আমি এর চেয়েও উৎকৃষ্ট স্থান পাব। তার সঙ্গী কথাচ্ছলে তাকে বলল, ‘তুমি কি সেই সত্তার সঙ্গে কুফরী আচরণ করছ, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে, তারপর শুক্র থেকে এবং তারপর তোমাকে একজন সুস্থসবল মানুষে পরিণত করেছেন? আমার ব্যাপার তো এই যে, আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহই আমার রব এবং আমি আমার রবের সঙ্গে কাউকে শরিক মানি না। তুমি যখন নিজ বাগানে প্রবেশ করছিলে, তখন তুমি কেন বললে না “মা-শা-আল্লাহ, লা ক্বুউওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ” (আল্লাহ যা চান তা-ই হয়, আল্লাহর তৌফিক ছাড়া কারও কোনো ক্ষমতা নেই)? [সূরা কাহফ: ৩২-৩৯] এই তো শোকর ও কৃতজ্ঞতার তালিম-তুমি তোমার বাগান দেখে কেন বললে না, ‘আল্লাহ যা চান তা-ই হয়’!
মুতাররিফ ইবনে আবদুল্লাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন বিখ্যাত এক বুযুর্গ। মুহাল্লাব নামক এক লোক তার পাশ দিয়ে রেশমি কাপড় পরে দম্ভভরে হেঁটে যাচ্ছিল। বুযুর্গ তাকে বললেন: এভাবে হাঁটছ কেন? সে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, আপনি জানেন, আমি কে? মুতাররিফ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি উত্তরে যা বলেছিলেন তা প্রতিটি মানুষের মনে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত। তিনি বলেছিলেন-
أوَّلُكَ نُطْفَةٌ مَذِرَةٌ، وَاٰخِرُكَ جِيْفَةٌ قَذِرَةٌ، وَأَنْتَ فِيْمَا بَيْنَ ذلِكَ تَحْمِلُ الْعَذِرَةَ.
তোমার সূচনা পুঁতিগন্ধময় বীর্যে, সমাপ্তি গলিত লাশে, আর এ দুয়ের মাঝে তুমি এক বিষ্ঠাবাহী দেহ।( )
এ সত্য অস্বীকার করবে কে? এই তো আমাদের হাক্বীক্বত। তাই অহংকারের সুযোগ কোথায়? আপনি প্রচুর অর্থের মালিক? কী নিশ্চয়তা আছে যে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তা আপনার হাতে থাকবে? আজ যিনি ক্ষমতার কুরসিতে আসীন, যার দাপটে পুরো এলাকা কম্পমান, এই ক্ষমতা ও দাপটের স্থায়িত্বের গ্যারান্টি দেবে কে? ‘সকাল বেলার ধনীরে তুই ফকির সন্ধ্যা বেলা’-এ তো আমাদের চারপাশের দেখা বাস্তবতা। যাকে তুচ্ছ করছেন, হেয় মনে করছেন, ভবিষ্যত যে আপনাকে তার অধীন করে দেবে না-এর কী বিশ্বাস?
কে কত বড় আবেদ, আল্লামা, ‘হাতেম তাঈ’ দ্বীনদার তা আল্লাহ তা‘আলার কাছে সবচেয়ে বড় বিবেচ্য বিষয় নয়, বিবেচ্য বিষয় হল, অন্তর।
ক্বোরআনের ভাষায়,
اِنَّ اَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ اَتْقٰىكُمْ
নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত সে-ই, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে মুত্তাক্বী। [সূরা হুজুরাত: ১৩] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
رُبّ أَشْعَثَ مَدْفُوعٍ بِالأَبْوَابِ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللهِ لأَبَرّهُ
কত এলোকেশী এমন, যাকে দরজায় দরজায় তাড়িয়ে দেয়া হয়, অথচ সে যদি আল্লাহর নামে কোনো কসম করে বসে, আল্লাহ তা পূর্ণ করে দেন! ( )
—০—
অহংকারের কারণসমূহ
একজন অহংকারী মনে করে, সে তার সাথী সঙ্গীদের চেয়ে জাতিগত ও সত্তাগতভাবেই বড় এবং সে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র, তার সাথে কারো কোন তুলনা হয় না। ফলে সে কাউকেই কোন প্রকার তোয়াক্কা করে না, কাউকে মূল্যায়ন করতে চায় না এবং কারো আনুগত্য করার মানসিকতা তার মধ্যে থাকে না। যার কারণে সে সমাজে এমনভাবে চলা ফেরা করে যে, মনে হয় তার মত এত বড় আর কেউ নাই। অহংকারের কয়েকটি কারণ নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ

১. অন্যের সম্মানকে মেনে নিতে না পারা
হযরত আদম আলাইহিস সালামের উচ্চ সম্মান দেখে ইবলীস অহংকারী হয়ে ওঠে এবং সে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
وَ اِذْ قُلْنَا لِلْمَلٰٓىٕكَةِ اسْجُدُوْا لِاٰدَمَ فَسَجَدُوْۤا اِلَّاۤ اِبْلِیْسَؕ-اَبٰى وَ اسْتَكْبَرَ ﱪ وَ كَانَ مِنَ الْكٰفِرِیْنَ ০
‘অতঃপর যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম, তোমরা আদমকে সাজদাহ্ কর। তখন তারা সবাই সাজদাহ করল ইবলীস ব্যতীত। সে অস্বীকার করল এবং অহংকার দেখালো। ফলে সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। [বাক্বারাহ ২/৩৪] যুগে যুগে এ ধারা অব্যাহত। নবী-রাসূলগণ ও তাঁদের অনুসারীগণ সর্বদা অহংকারীদের হাতে নির্যাতিত হয়ে আসছেন যুগযুগ ধরে।

২. ধন-সম্পদের আধিক্য
অধিক ধন-সম্পদ মানুষকে অনেক সময় অহংকারী করে তোলে। ধন-সম্পদ ও সন্তান মানুষের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ। কিন্তু মানুষ অনেক সময় এর দ্বারা ফেৎনায় পতিত হয় এবং অহংকারে স্ফীত হয়ে পথভ্রষ্ট হয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ আল্লাহ ক্বারূণের কথা বর্ণনা করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
اِنَّ قَارُوْنَ كَانَ مِنْ قَوْمِ مُوْسٰى فَبَغٰى عَلَیْهِمْ۪-وَ اٰتَیْنٰهُ مِنَ الْكُنُوْزِ مَاۤ اِنَّ مَفَاتِحَهٗ لَتَنُوْٓاُ بِالْعُصْبَةِ اُولِی الْقُوَّةِۗ-اِذْ قَالَ لَهٗ قَوْمُهٗ لَا تَفْرَحْ اِنَّ اللّٰهَ لَا یُحِبُّ الْفَرِحِیْنَ(۷۶ (وَ ابْتَغِ فِیْمَاۤ اٰتٰىكَ اللّٰهُ الدَّارَ الْاٰخِرَةَ وَ لَا تَنْسَ نَصِیْبَكَ مِنَ الدُّنْیَا وَ اَحْسِنْ كَمَاۤ اَحْسَنَ اللّٰهُ اِلَیْكَ وَ لَا تَبْغِ الْفَسَادَ فِی الْاَرْضِؕ-اِنَّ اللّٰهَ لَا یُحِبُّ الْمُفْسِدِیْنَ(۷۷ (قَالَ اِنَّمَاۤ اُوْتِیْتُهٗ عَلٰى عِلْمٍ عِنْدِیْؕ-اَوَ لَمْ یَعْلَمْ اَنَّ اللّٰهَ قَدْ اَهْلَكَ مِنْ قَبْلِهٖ مِنَ الْقُرُوْنِ مَنْ هُوَ اَشَدُّ مِنْهُ قُوَّةً وَّ اَكْثَرُ جَمْعًاؕ-وَ لَا یُسْــٴَـلُ عَنْ ذُنُوْبِهِمُ الْمُجْرِمُوْنَঙ
‘ক্বারূণ ছিল মূসার সম্প্রদায়ভুক্ত। কিন্তু সে তাদের প্রতি ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিল। আমি তাকে এমন ধন-ভান্ডার দান করেছিলাম, যার চাবিসমূহ বহন করা একদল শক্তিশালী লোকের পক্ষে কষ্টসাধ্য ছিল। তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল, দম্ভ করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ দাম্ভিকদের পছন্দ করেন না।’ আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন, তাদ্বারা পরকালের গৃহ অনুসন্ধান কর, এবং ইহকাল থেকে তোমার অংশ ভুলে যেয়ো না। তুমি অনুগ্রহ কর, যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে অনর্থ (ফ্যাসাদ) সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ অনর্থ সৃষ্টিকারীদেরকে পছন্দ করেন না। ‘সে বলল, এ সম্পদ আমি আমার জ্ঞান বলে প্রাপ্ত হয়েছি। অথচ সে কি জানে না যে, আল্লাহ তার পূর্বে বহু মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছেন, যারা তার চাইতে শক্তিতে প্রবল ছিল এবং সম্পদে প্রাচুর্যময় ছিল। আর অপরাধীদেরকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে না (তারা সরাসরি জাহান্নামে যাবে)’ [ক্বাসাস: ৭৬-৭৮] ক্বারূণী ধন মানুষকে অহংকারী করে তোলে। ফলে তা তাকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করে। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
فَخَسَفْنَا بِه وَبِدَارِهِ الْأَرْضَ فَمَا كَانَ لَهٗ مِنْ فِئَةٍ يَنْصُرُونَهُ مِنْ دُونِ اللهِ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُنْتَصِرِينَ
‘অতঃপর আমি ক্বারূণকে ও তার প্রাসাদকে ভূগর্ভে ধ্বসিয়ে দিলাম। ফলে তার পক্ষে এমন কোন দল ছিল না, যে আল্লাহর শাস্তি হতে তাকে সাহায্য করতে পারে এবং সে নিজেও আত্মরক্ষায় সক্ষম ছিল না’। [ক্বাসাস- ৮১]

৩. ইলম
ইলম অনেক সময় আলেমকে অহংকারী বানায়। দু’ধরনের লোকের মধ্যে এটা দেখা যায়। জন্মগতভাবে বদ চরিত্রের লোকেরা যখন ইলম শিখে, তখন ইলমকে তার বদস্বভাবের পক্ষে কাজে লাগায়। এইসব আলেম ক্বোরআন-হাদীসের অপব্যাখ্যা করে এবং নিজেকে অন্যদের তুলনায় বড় আলেম বলে যাহির করে। এদের মধ্যে ইলম থাকলেও সেখানে তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি থাকে না। তাদের সকল কাজে লক্ষ্য থাকে দুনিয়া অর্জন করা ও মানুষের প্রশংসা কুঁড়ানো, যা তাদেরকে অহংকারী করে দেয়। যেমন আববাসীয় যুগের শ্রেষ্ঠ কবি আবুত ত্বাইয়েব আহমাদ ইবনে হুসাইন আল-মুতানাববী (৩০৩-৩৫৪ হিঃ) ( ) বলেন,
مَا مُقامِي بِأَرْضِ نَخْلَةٍ إلاَّ + كمُقامِ الْمَسِيْحِ بَيْنَ الْيَهُودِ
‘নাখলার জনপদে আমার অবস্থান ইহূদীদের মাঝে মসীহ ঈসার অবস্থানের ন্যায়।’
অনুরূপভাবে অন্ধ কবি আবুল ‘আলা আল-মা‘আররী (৩৬৩-৪৪৯ হিঃ) বলেন,
وأنِّي وإنْ كنتُ الأخيرَ زمانُهٗ + لَاٰتٍ بِمَا لَمْ تَسْتَطِعْهُ الْأَوَائِلُ
‘আমি যদিও কালের দিক থেকে শেষে এসেছি। তথাপি আমি এমন কিছু নিয়ে এসেছি, যা পূর্বের লোকেরা আনতে সক্ষম হয়নি’।( )
দ্বিতীয় কারণ হ’ল, অল্প বিদ্যা। যেমন কিছু ইলম শিখেই নিজেকে অন্যের তুলনীয় মনে করা এবং একথা বলা যে, هُمْ رِجَالٌ وَنَحْنُ رِجَالٌ ‘তারাও মানুষ ছিলেন, আমরাও মানুষ’।( ) অর্থাৎ আমরা ও তারা সমান। এটা তাদের অহংকারের পরিচয়। সেজন্যেই প্রবাদ আছে ‘অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী’। নিঃসন্দেহে পূর্ববর্তী বিদ্বানগণের মর্যাদা অনেক বেশী। কেননা তাঁদের ইলমের পথ ধরেই পরবর্তীরা এসেছেন। তাছাড়া সমকালীন প্রত্যেকেই পৃথক গুণ ও মেধার অধিকারী। অতএব কেউ কারুর সমান নন। প্রত্যেকেই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। প্রত্যেকেই পৃথকভাবে সম্মান পাওয়ার যোগ্য।
প্রকৃত ইলম হ’ল সেটাই যা মানুষকে বিনয়ী ও আল্লাহভীরু বানায়। ইমাম মালেক ইবনে আনাস রাহমাতুল্লাহি আলাইহি (৯৩-১৭৯ হিঃ) কে ৪৮ টি প্রশ্ন করা হ’লে তিনি ৩২ টি প্রশ্নের উত্তরে বলেন, لاَ أَدْرِي ‘আমি জানি না’।( )
বহু মাসআলায় তিনি বলতেন, তুমি অন্যকে জিজ্ঞেস কর।’ ‘কাকে জিজ্ঞেস করব? এরূপ প্রশ্নের উত্তরে তিনি কারুর নাম উল্লেখ না করে বলতেন, আলেমদের জিজ্ঞেস কর’। তিনি ওফাতকালে কাঁদতে থাকেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি আমার নিজস্ব অভিমত অনুযায়ী যত ফাৎওয়া দিয়েছি প্রতিটির বদলায় যদি আমাকে চাবুক মারা হ’ত! … হায় যদি আমি কোন ফৎওয়া না দিতাম!। ( )
বহু ইখতেলাফী মাসআলায় ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহমাতুল্লাহি আলাইহি (১৬৪-২৪১ হিঃ) বলতেন, আমি জানি না’।( )
ইমাম আ’যম আবূ হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি (৮০-১৫০ হিঃ) বলতেন,
عِلْمُنَا هَذَا رَأْيٌ وَهُوَ أَحْسَنُ مَا قَدَرْنَا عَلَيْهِ، وَمَنْ جَاءَنَا بِأَحْسَنَ مِنْهُ قَبِلْنَاهُ مِنْهُ
‘আমাদের এই ইলম তথা ক্বিয়াস হল চিন্তা-গবেষণালব্ধ ইলম। আমাদের নিকটে এটাই সর্বোত্তম হিসাবে অনুমিত হয়েছে তাই এটাকে আমরা গ্রহণ করেছি। যে ব্যক্তি এর চেয়ে উত্তম নিয়ে আসবে, আমরা তার কাছ থেকে সেটা গ্রহণ করব।( )
সালাফে সালেহীনের একটা সাধারণ রীতি ছিল, তাঁরা নিজস্ব রায় থেকে কিছু লিখলে শেষে বলতেন, واللهُ أَعْلَمُ بِالصِّدْقِ وَالصَّوَابِ ‘আল্লাহ সত্য ও সঠিক সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত’।
সত্যসন্ধানী আল্লাহভীরু আলেমদের দিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেন,
إِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ
‘বান্দাদের মধ্যে আলেমরাই কেবল আল্লাহকে ভয় করে থাকে’ (ফাত্বির-২৮)।
এখানে ‘আলেম’ বলতে দ্বীনী ইলমের অধিকারীদের বুঝানো হয়েছে। কেননা দুনিয়াবী ইলম কাফের-মুশরিকরাও শিখে থাকে। কিন্তু তারা আল্লাহভীরু নয়। আর দুনিয়াবী ইলম কাউকে আল্লাহভীরু বানায় না আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ব্যতীত।
পক্ষান্তরে যারা ইলমকে দুনিয়া হাসিলের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে, তাদের বিষয়ে হাদীস শরীফে কঠিন হুঁশিয়ারী এসেছে। হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ক্বিয়ামতের দিন প্রথমে বিচার করা হবে শহীদ, আলেম ও দানশীল ব্যক্তিদের। অতঃপর দুনিয়াসর্বস্ব নিয়তের কারণে তাদেরকে উপুড়মুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।( )
কা’ব ইবনে মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
مَنِ ابْتَغَى الْعِلمَ لِيُبَاهِيَ بِهِ الْعُلَمَآءَ، أَوْ يُمَارِيَ بِهِ السُّفَهَآءَ، أو يُقْبِلَ أَفْئِدَةُ النَّاسِ إِلَيْهِ فَالنَّارُ النَّارُ. ( )
যে ব্যক্তি ইলম শিখল আলেমদের সাথে তর্ক করার জন্য এবং মূর্খদের সাথে ঝগড়া করার জন্য অথবা মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন’।( )
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও এরশাদ করেন,
مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغٰى بِه وَجْهُ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ لاَ يَتَعَلَّمُهٗ إِلاَّ لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘যে ব্যক্তি এমন ইলম শিখে যদ্বারা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়, অথচ সে তা শিখে পার্থিব সম্পদ লাভের জন্য, ঐ ব্যক্তি ক্বিয়ামতের দিন জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না’।( )
আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে মানুষকে কল্যাণের পথ দেখানোর উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি ইলম শিক্ষা করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দেন। ফেরেশতারা তার সন্তুষ্টির জন্য তাদের ডানাসমূহ বিছিয়ে দেন। তাছাড়া ফেরেশতামন্ডলী, আসমান ও যমীনবাসীগণ, এমনকি পানির মাছ ও গর্তের পিঁপড়ারাও তার জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ ও ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে। এইসব আলেম হলেন ‘নবীগণের ওয়ারিস’ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ অর্থাৎ তাঁদের ইলমের উত্তরাধিকারী। কেননা নবীগণ কোন দীনার ও দিরহাম ছেড়ে যাননি, কেবল ইলম ব্যতীত। যে ব্যক্তি সে ইলম লাভ করেছে, সে ব্যক্তি পূর্ণভাবেই তা লাভ করেছে’ (অর্থাৎ সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ ইলম সে লাভ করেছে)। ( )
যে ব্যক্তি ক্বোরআন ও হাদীস শরীফের ইলম যথাযথভাবে অন্যের নিকট পৌঁছিয়ে দিবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জন্য দো‘আ করে বলেন,
نَضَّرَ اللهِ اِمْرَأً سَمِعَ مِنَّا شَيْئًا فَبَلَّغَهُ كَمَا سَمِعَ فَرُبَّ مُبَلَّغٍ أَوْعٰى مِنْ سَامِعٍ
আল্লাহ ক্বিয়ামত দিবসে ওই ব্যক্তির চেহারা উজ্জ্বল করুন! যে আমার কাছ থেকে যা শুনেছে তা অন্যের নিকট যথাযথভাবে পৌঁছিয়ে দিয়েছে, কেননা যার কাছে ইলম পৌঁছানো হয়, তিনি অনেক সময় শ্রবণকারীর চাইতে অনেক বেশী হেফাযতকারী বা জ্ঞানী হয়ে থাকেন’।( )
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলতেন,
لَيْسَ الْعِلْمُ بِكَثْرَةِ الرِّوَايَةِ، إِنَّمَا الْعِلْمُ الْخَشْيَةُ
‘অধিক হাদীস বর্ণনা প্রকৃত জ্ঞানার্জন নয়; বরং আল্লাহভীতিই হল প্রকৃত জ্ঞান’।( )
অতএব আল্লাহকে চেনা ও জানা এবং আল্লাহভীতি অর্জন করাই হ’ল ইলম হাসিলের মূল লক্ষ্য। আল্লাহভীতি সৃষ্টি হলেই বাকী সবকিছুর জ্ঞান তার জন্য সহজ হয়ে যায়। ক্বোরআন ও হাদীস হল সকল ইলমের খনি। সেখানে গবেষণা করলে মানবীয় চাহিদার সকল দিক ও বিভাগ পরিচ্ছন্ন হয়ে গবেষকের সামনে ফুটে ওঠে। আল্লাহর রহমতে তার অন্তর জগত খুলে যায়। ফলে সে অহংকারমুক্ত হয়।

৪. পদমর্যাদা
উচ্চ পদমর্যাদা মানুষের মধ্যে অনেক সময় অহংকার সৃষ্টি করে। মূর্খরা এটাকে তাদের হীন স্বার্থে ব্যবহার করে। জ্ঞানীরা এর মাধ্যমে মানব কল্যাণে অবদান রাখেন। পদমর্যাদা একটি কঠিন জওয়াবদিহিতার বিষয়। যিনি যত বড় দায়িত্বের অধিকারী, তাকে তত বড় জওয়াবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
أَلاَ كُلُّكُمْ رَاعٍ، وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، فَالإِمَامُ الَّذِى عَلَى النَّاسِ رَاعٍ وَهْوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ وَهْوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى أَهْلِ بَيْتِ زَوْجِهَا وَوَلَدِهِ وَهِىَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُمْ، وَعَبْدُ الرَّجُلِ رَاعٍ عَلَى مَالِ سَيِّدِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُ، أَلاَ فَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِه
‘মনে রেখ, তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। শাসক তার প্রজাসাধারণের দায়িত্বশীল। তিনি তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। ব্যক্তি তার পরিবারের দায়িত্বশীল। সে তার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী তার স্বামীর গৃহ ও সন্তানাদির দায়িত্বশীল, সে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। চাকর তার মনিবের মাল-সম্পদ বিষয়ে দায়িত্বশীল। সে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব সাবধান! তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’।( )
যে ব্যক্তি পদমর্যাদা বা দায়িত্ব পেয়ে অহংকারী হয় এবং পদের অপব্যবহার করে, তার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
مَا مِنْ عَبْدٍ يَسْتَرْعِيهِ اللهُ رَعِيَّةً يَمُوْتُ يَوْمَ يَمُوْتُ وَهُوَ غَاشٌّ لِرَعِيَّتِهِ إِلاَّ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ
‘আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে লোকদের উপর দায়িত্বশীল নিয়োগ করেন। অতঃপর সে তাদের সাথে খেয়ানতকারী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, আল্লাহ তার উপরে জান্নাতকে হারাম করে দেন’।( )

মূলতঃ যুলুম-খেয়ানত সবকিছুর উৎপত্তি হয় পদমর্যাদার অহংকার থেকে। তাই জান্নাতপিয়াসী বান্দাকে এ বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
لِكُلِّ غَادِرٍ لِوَاءٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرْفَعُ لَهُ بِقَدْرِ غَدْرِه أَلاَ وَلاَ غَادِرَ أَعْظَمُ غَدْرًا مِنْ أَمِيرِ عَامَّةٍ
‘ক্বিয়ামতের দিন প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকের কোমরে একটা করে ঝান্ডা স্থাপন করা হবে। যা তার খেয়ানতের পরিমাণ অনুযায়ী উঁচু হবে। মনে রেখ, সর্বসাধারণের উপর নিয়োগকৃত আমীরের বিশ্বাসঘাতকতা হলো সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা, তাই সেদিন সবচেয়ে উঁচু ঝান্ডা হবে শাসকের খেয়ানতের ঝান্ডা’।( )
অতএব পদমর্যাদা যেন মনের মধ্যে অহংকার সৃষ্টি না করে; বরং যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের বিষয়ে কৈফিয়ত দেয়ার ভয়ে হৃদয় যেন সর্বদা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে, আল্লাহর নিকটে সর্বদা সেই তাওফীক কামনা করতে হবে।

৫. বংশ মর্যাদা
বংশ মর্যাদা মানুষের উচ্চ সম্মানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি মানদন্ড। এই মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকে, যতক্ষণ বংশের লোকেরা বিনয়ী ও চরিত্রবান থাকে। উক্ত দু’টি গুণ যত বৃদ্ধি পায়, বংশের সম্মান ও মর্যাদা তত বৃদ্ধি পায়। কিন্তু যদি সেখানে কথায় ও আচরণে দাম্ভিকতা প্রকাশ পায়, তাহলে উক্ত সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
إِنَّ اللهَ أَوْحٰى إِلَىَّ أَنْ تَوَاضَعُوا حَتّٰى لاَ يَفْخَرَ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ وَلاَ يَبْغِى أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ
‘আল্লাহ আমাকে প্রত্যাদেশ করেছেন যে, তোমরা বিনয়ী হও। তোমাদের কেউ যেন একে অপরের উপর গর্ব না করে এবং একে অপরের উপর ঔদ্ধত্য প্রদর্শন না করে’।( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ قَدْ أَذْهَبَ عَنْكُمْ عُبِّيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ، وَفَخْرَهَا بِالْآبَاءِ مُؤْمِنٌ تَقِيٌّ، وَفَاجِرٌ شَقِيٌّ، أَنْتُمْ بَنُو آدَمَ وَآدَمُ مِنْ تُرَابٍ، لَيَدَعَنَّ رِجَالٌ فَخْرَهُمْ بِأَقْوَامٍ، إِنَّمَا هُمْ فَحْمٌ مِنْ فَحْمِ جَهَنَّمَ، أَوْ لَيَكُونُنَّ أَهْوَنَ عَلَى الهِر مِنَ الْجِعْلَانِ الَّتِي تَدْفَعُ بِأَنْفِهَا النَّتِنَ. ( )ৎ
নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের থেকে জাহেলিয়াতের অহমিকা ও বাপ-দাদার অহংকার দূরীভূত করে দিয়েছেন। তারা হয়তো আল্লাহভীরু মুমিন (مُؤْمِنٌ تَقِيٌّ) অথবা হতভাগ্য পাপী (فَاجِرٌ شَقِيٌّ) মাত্র। মানবজাতি সবাই আদমের সন্তান। আর আদম হলেন মাটির তৈরী’। লোকেরা যেন তাদের (মুশরিক) বাপ-দাদার নামে গর্ব করা হ’তে বিরত থাকে, যারা মরে জাহান্নামের অঙ্গারে পরিণত হয়েছে, বা যারা আল্লাহর নিকট মানুষের নাকনির্গত ময়লার চেয়েও নিকৃষ্ট। (অতএব অহংকার করার মত কিছুই নেই)। ( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের সম্পর্কে এরশাদ করেন,
لاَ تُطْرُونِى كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهٗ، فَقُولُوا عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُهٗ
‘খ্রিস্টানরা মারিয়ামপুত্র ঈসার ব্যাপারে মিথ্যা প্রশংসায় যেভাবে বাড়াবাড়ি করেছে (তারা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহর পুত্র বলেছে) তোমরা আমার প্রশংসায় সেভাবে বাড়াবাড়ি করো না। আমি আল্লাহর একজন বান্দা। অতএব তোমরা বলো, আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও তাঁর রাসূল’।( )
সঙ্গত কারণে বিশেষ অবস্থায় বংশ মর্যাদাকে ইসলাম গুরুত্ব দিয়েছে। যেমন (ক) বৈবাহিক সমতার ক্ষেত্রে।( )
(খ) ইসলামী রাষ্ট্রের বাস্তবতার ক্ষেত্রে। যেমন পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
الأَئِمَّةُ مِنْ قُرَيْشٍ
‘ইমাম তথা খলীফা হবেন কুরায়েশদের মধ্য থেকে’।( )
(গ) যুদ্ধকালীন সময়ে। যেমন হোনায়েন যুদ্ধে শত্রুবেষ্টিত অবস্থায় সৃষ্ট মহা সংকটকালে দৃঢ়চেতা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন বাহনের পিঠ থেকে নেমে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে কাফেরদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,
أَنَا النَّبِىُّ لاَ كَذِبْ، أَنَا ابْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبْ
‘আমি নবীই, মিথ্যা নই। আমি আব্দুল মুত্ত্বালিবের পুত্র।’
রাভী বলেন, সেদিন তাঁর চাইতে দৃঢ় কাউকে দেখা যায়নি’।( )
বংশ মর্যাদার এই তারতম্যকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করলেই সেটা দোষের হয়। অন্যায়ভাবে বংশের গৌরব করাকে তিনি ‘জাহেলিয়াতের অংশ’ (عُبِّيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ) বলে ধিক্কার দিয়েছেন।( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
فَخِيَارُكُمْ فِى الْجَاهِلِيَّةِ خِيَارُكُمْ فِى الإِسْلاَمِ إِذَا فَقِهُوا
তোমাদের মধ্যে যারা জাহেলী যুগে উত্তম ছিলে, তারা ইসলামী যুগেও উত্তম, যদি তারা দ্বীনের জ্ঞানে পারদর্শী হয়’।( )
হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের প্রশংসায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
الْكَرِيمُ ابْنُ الْكَرِيمِ ابْنِ الْكَرِيمِ ابْنِ الْكَرِيمِ يُوسُفُ بْنُ يَعْقُوبَ بْنِ إِسْحَاقَ بْنِ إِبْرَاهِيمَ عَلَيْهِمُ السَّلاَمُ
সম্ভ্রান্তের পুত্র সম্ভ্রান্ত। তাঁর পুত্র সম্ভ্রান্ত ও তাঁর পুত্র সম্ভ্রান্ত। তাঁরা হ’লেন ইবরাহীম, তাঁর পুত্র ইসহাক, তাঁর পুত্র ইয়াকূব এবং তাঁর পুত্র ইউসুফ’।( )
এতে বুঝা যায় যে, বংশমর্যাদা প্রশংসিত। কিন্তু অন্যায়ভাবে তার ব্যবহারটা নিন্দনীয়।
ইসলামে দ্বীনদারী ও আল্লাহভীতিকে সম্মান ও মর্যাদার মানদন্ড হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ
‘তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যে সবচেয়ে আল্লাহভীরু’ (হুজুরাত ৪৯/১৩)।
যেমন দ্বীন ও তাক্বওয়ার কারণেই কৃষ্ণাঙ্গ দাস হযরত বেলাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু উচ্চ সম্মান লাভ করেছিলেন। হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলতেন,
أَبُو بَكْرٍ سَيِّدُنَا، وَأَعْتَقَ سَيِّدَنَا، يَعْنِى بِلاَلاً
‘আবূ বকর আমাদের সরদার এবং তিনি মুক্ত করেছেন আমাদের সরদারকে (অর্থাৎ হযরত বেলাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে)’।( )
মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে কা’বাগৃহের ছাদে দাঁড়িয়ে আযান দিতে বলেন। তার এই উচ্চ সম্মান দেখে ক্বোরাঈশ নেতারা সমালোচনা করেছিল।( )
জান্নাতে হযরত বেলালের অগ্রগামী পদশব্দ মে’রাজ রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুনেছিলেন ও তার উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন।( )
বস্তুতঃ ইসলামের উদার সাম্যের কারণেই ক্বোরাঈশ নেতা হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর পাশাপাশি সালাতে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছেন আবিসিনিয়ার হযরত বেলাল হাবশী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, রোমের হযরত সুহায়ব রূমী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, পারস্যের হযরত সালমান ফারেসী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু প্রমুখ ক্রীতদাসগণ। কোটি কোটি মুসলমান তাঁদের নাম উচ্চারণের সাথে সাথে দো‘আ করে বলেন, ‘রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু’ (আল্লাহ তাঁর/ তাঁদের উপরে সন্তুষ্ট হোন!)। ¯্রফে দ্বীনের কারণে হযরত বেলাল এখানে উচ্চ সম্মানিত। পক্ষান্তরে কুফরীর কারণে তাঁর মনিব উমাইয়া ইবনে খালাফ হল অপমানিত ও লাঞ্ছিত। অথচ সে ছিল অন্যতম ক্বোরাঈশ নেতা এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র চাচা সম্পর্কীয় ও নিকটতম প্রতিবেশী।
অতএব, ইসলামে বংশ মর্যাদা স্বীকৃত ও প্রশংসিত হলেও দ্বীন ও তাক্বওয়া না থাকলে তা নিন্দিত ও মূল্যহীন। এখানে সকলের সম্মান ও মর্যাদার মানদন্ড হল ঈমান ও তাক্বওয়া। মুসলমান সবাই ভাই ভাই। দাস-মুনিবে কোন প্রভেদ নেই। পৃথিবীর কোন সমাজ ব্যবস্থায় এর কোন নযীর নেই।

ছয়: কারো প্রতি নমনীয় না হওয়া
বা আনুগত্য না করার স্পৃহা
একজন অহংকারী কখনোই চায় না সে কারো আনুগত্য করুক বা কারো কোন কথার কর্ণপাত করুক। সে চিন্তা করে আমার কথা মানুষ শোনবে আমি কেন মানুষের কথা শোনবো। আমি মানুষকে উপদেশ দেবো আমাকে কেন মানুষ উপদেশ দেবে। এভাবেই তার দিন অতিবাহিত হয়। দিন যত যায়, অহংকারীর অহংকারের স্পৃহা আরও বাড়তে থাকে এবং তার অহংকারও দিন দিন বৃদ্ধি পায়। ফলে সে দুনিয়াতে আর কাউকেই মানতে বা কারো আনুগত্য করতে রাজি হয় না। তার অহংকার করার স্পৃহাটি ধীরে ধীরে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে, শেষ পর্যন্ত আসমান ও জমিনের কর্তৃত্বাধীকারী আল্লাহর আনুগত্যও সে আর করতে চায় না। তার এ ধরনের স্পৃহার কারণে তার মধ্যে এ অনুভূতি জাগে যে, সে কারো মুখাপেক্ষী নয়, সে নিজেই সর্বেসর্বা, তার কারো প্রতি আনুগত্য করার প্রয়োজন নাই। অহংকারীর এ ধরনের দাম্ভিকতা থেকে সৃষ্টি হয়, হঠকারিতা ও কুফরী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
كَلَّاۤ اِنَّ الْاِنْسَانَ لَیَطْغٰۤىۙ (۶)اَنْ رَّاٰهُ اسْتَغْنٰىؕ (۷) اِنَّ اِلٰى رَبِّكَ الرُّجْعٰىؕ (۸)
কখনো নয়, নিশ্চয় মানুষ সীমালঙ্ঘন করে থাকে। কেননা সে নিজকে মনে করে স্বয়ংসম্পূর্ণ। নিশ্চয় তোমার রবের দিকেই প্রত্যাবর্তন। [সূরা আলাক্ব, আয়াত: ৬-৮] আল্লামা বাগাবী রহমাতুল্লাহি আলইহি বলেন, মানুষ তখনই সীমালঙ্ঘন এবং তার প্রভুর বিরুদ্ধাচরণ করে, যখন সে দেখতে পায়, ‘সে নিজেই স্বয়ংসম্পন্ন।( ) তার আর কারো প্রতি নত হওয়া বা কারো আনুগত্য করার কোন প্রয়োজন নেই।

সাত: অন্যদের উপর প্রাধান্য বিস্তারের জন্য অপ্রতিরোধ্য অভিলাষ
একজন অহংকারী, সে মনে করে, সমাজে তার প্রাধান্য বিস্তার, সবার নিকট প্রসিদ্ধি লাভ ও নেতৃত্ব দেয়ার কোন বিকল্প নেই। তাকে এ লক্ষ্যে সফল হতেই হবে। কিন্তু যদি সমাজ তার কর্তৃত্ব বা প্রাধান্য মেনে না নেয়, তখন সে চিন্তা করে, তাকে যে কোন উপায়ে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। চাই তা বড়াই করে হোক অথবা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তখন সে যা ইচ্ছা তাই করে এবং সমাজে হট্টগোল সৃষ্টি করে।

আট: নিজের দোষকে আড়াল করা
একজন অহংকারী তার স্বীয় কাজ কর্মে নিজের মধ্যে যে সব দুর্বলতা অনুভব করে, তা গোপন রাখতে আগ্রহী হয়। কারণ, তার আসল চরিত্র যদি মানুষ জেনে যায়, তাহলে তারা তাকে আর বড় মনে করবে না ও তাকে সম্মান দেবে না। যেহেতু একজন অহংকারী সব সময় মানুষের চোখে বড় হতে চায়, এ কারণে সে পছন্দ করে, তার মধ্যে যে সব দুর্বলতা আছে, তা যেন কারো নিকট প্রকাশ না পায় এবং কেউ যাতে জানতে না পারে; কিন্তু মূলত: সে তার অহংকার দ্বারা নিজেকে অপমানই করে, মানুষকে সে নিজেই তার গোপনীয় বিষয়ের দিকে পথ দেখায়।( )

নয়: অহংকারী যেভাবে অহংকারের সুযোগ পায়
কতেক লোকের অধিক বিনয়ের কারণে অহংকারীরা অহংকারের সুযোগ পায়। অহংকারীরা যখনই কোন সুযোগ পায়, তা তারা কাজে লাগাতে কার্পণ্য করে না। অনেক সময় দেখা যায় কিছু লোক এমন আছে, যারা বিনয় করতে গিয়ে অধিক বাড়াবাড়ি করে, তারা নিজেদের খুব ছোট মনে করে, নিজেকে যে কোন প্রকার দায়িত্ব আদায়ের অযোগ্য বিবেচনা করে এবং যে কোন ধরনের আমানতদারিতা রক্ষা করতে সে অক্ষম বলে দাবি করে, তখন অহংকারী চিন্তা করে এরা সবাইতো নিজেদের অযোগ্য ও আমাকে যোগ্য মনে করছে, প্রকারান্তরে তারা সবাই আমার মর্যাদাকে স্বীকার করছে, তাহলে আমিই এসব কাজের জন্য একমাত্র যোগ্য ও উপযুক্ত ব্যক্তি। সুতরাং, আমিতো তাদের সবার উপর নেতা। শয়তান তাকে এভাবে প্রলোভন দিতে ও ফুঁসলাতে থাকে, আর লোকটি নিজে নিজে ফুলতে থাকে। ফলে এখন সে অহংকার বশতঃ আর কাউকে পাত্তা দেয় না, সবাইকে নিকৃষ্ট মনে করে। আর নিজেকে যোগ্য মনে করে।

দশ. মানুষকে মূল্যায়ন করতে না জানা
মানুষ শ্রেষ্ঠ হওয়ার মানদন্ড কী এবং মানুষকে কীসের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে, তা আমাদের অবশ্যই জানা থাকা দরকার। অহংকারের অন্যতম কারণ হল, মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মানদন্ড নির্ধারণে ত্রুটি করা। একজন মানুষ শ্রেষ্ঠ হওয়ার মানদন্ড কি তা আমাদের অনেকেরই অজানা। যার কারণে দেখা যায়, যারা ধনী ও পদ মর্যাদার অধিকারী তাদের প্রাধান্য দেয়া হয়ে থাকে, যদিও তারা পাপী বা অপরাধী হয়। অন্যদিকে একজন পরহেজগার, মুত্তাকী ও সৎ লোক তার ধন সম্পদ ও পদমর্যাদা না থাকাতে সমাজে তাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয় না এবং তাকে মূল্যায়ন করা হয় না। ( )
ইসলাম মানুষকে মূল্যায়নের একটি মাপকাঠি ও মানদন্ড নির্ধারণ করে দিয়েছে। বর্তমান সমাজে যদি তা অনুসরণ করা হত, তবে সামাজিক অবক্ষয় অনেকাংশে দূর হয়ে যেত এবং সমাজের এ করুণ পরিণতি হতে মানব জাতি রক্ষা পেত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের একটি সুস্পষ্ট ও বাস্তব দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝিয়ে দেন যে, একজন মানুষকে কিসের ভিত্তিতে মূল্যায়ন ও অগ্রাধিকার দেয়া হবে এবং তাকে কিসের ভিত্তিতে অবমূল্যায়ন ও পেছনে ফেলে রাখা হবে। মানুষের মর্যাদা তার পোষাকে নয়, বরং মানুষের মর্যাদা, তার অন্তর্নিহীত সততা, স্বচ্ছতা ও আল্লাহ-ভীতির উপর নির্ভর করে। যার মধ্যে যতটুকু আল্লাহ-ভীতি থাকবে, সে তত বেশি সৎ ও উত্তম লোক হিসেবে বিবেচিত হবে।
عَنْ سَهْلٍ قَالَ مَرَّ رَجُلٌ عَلٰى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ مَا تَقُوْلُونَ فِيْ هٰذَا قَالُوا حَرِيٌّ إِنْ خَطَبَ أَنْ يُنْكَحَ وَإِنْ شَفَّعَ أَنْ يُشَفَّعَ وَإِنْ قَالَ أَنْ يُسْتَمَعَ قَالَ ثُمَّ سَكَتَ فَمَرَّ رَجُلٌ مِنْ فُقَرَاءِ الْمُسْلِمِيْنَ فَقَالَ مَا تَقُوْلُوْنَ فِي هٰذَا قَالُوا حَرِيٌّ إِنْ خَطَبَ أَنْ لَا يُنْكَحَ وَإِنْ شَفَّعَ أَنْ لَا يُشَفَّعَ وَإِنْ قَالَ أَنْ لَا يُسْتَمَعَ فَقَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هَذَا خَيْرٌ مِنْ مِلْءِ الْأَرْضِ مِثْلَ هٰذَا ( )
হযরত সাহাল ইবনে সা’দ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে দিয়ে এক ব্যক্তি অতিক্রম করে যাচ্ছিল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমবেত লোকদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা এ লোকটি সম্পর্কে কি বল, তাঁরা উত্তরে বললেন, লোকটি যদি কাউকে বিবাহের প্রস্তাব দেয়, তাহলে তাকে বিয়ে দেয়া হয়, যদি কারো বিষয়ে সুপারিশ করে, তাহলে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হয়, আর যদি কোন কথা বলে, তবে তার কথা শোনা হবে বা গ্রহণ করা হবে। তাদের কথা শোনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুপ করে থাকেন।
একটু পর অপর একজন দরিদ্র মুসলিম রাস্তা দিয়ে অতিক্রম করে যাচ্ছিল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখে সাহাবীদের জিজ্ঞাসা করে বলেন, তোমরা এ লোকটি সম্পর্কে মতামত দাও! তাঁরা বললেন, যদি সে বিবাহের প্রস্তাব দেয়, তাহলে তার প্রস্তাবে সাড়া দেয়া হয় না, আর যদি সে কারো বিষয়ে সুপারিশ করে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হয় না, আর যদি সে কোন কথা বলে,তবে তার কথায় কান দেয়া হয় না। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, এ লোকটি যমিনভর যত কিছু আছে, তার সব কিছু হতেও উত্তম।( )

এগার. আল্লাহ প্রদত্ত নি’মাতকে অন্যদের নেয়ামতের
সাথে তুলনা করা ও আল্লাহকে ভুলে যাওয়া
কিব্র বা অহংকারের অন্যতম কারণ হল, একজন মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা যে সব নি’মাত দান করেছেন, সে সব নেয়ামতকে ওই লোকের সাথে তুলনা করা যাকে আল্লাহ তা‘আলা কোন হিকমতের কারণে ওই সব নি’মাত দেননি। তখন সে মনে করে, আমিতো ওই সব নি’মাত লাভের যোগ্য ও উপযুক্ত ব্যক্তি, তাই আল্লাহ তা’আলা আমাকে আমার যোগ্যতার দিক বিবেচনা করেই নি’মাতসমূহ দান করেছেন। ফলে সে নিজেকে সব সময় বড় করে দেখে এবং অন্যদের ছোট করে দেখে ও নিকৃষ্ট মনে করে। অন্যদেরকে সে মনে করে তারা নি’মাত লাভের উপযুক্ত নয়, তাদের যদি যোগ্যতা থাকতো তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবশ্যই নি’মাতসমূহ দান করতেন।

অহংকারের আলামতসমূহ
জীবন ধ্বংসকারী একটি মারাত্মক স্বভাব হলো অহংকার। এই স্বভাবের লোকেরা তাদের উন্নতি ও সফলতা বেশিদিন ধরে রাখতে পারে না। আত্মীয়-স্বজন ও কাছের মানুষদের ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে তারা। তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠান, সমাজ, সংগঠন, রাষ্ট্র এমনকি নিজ পরিবারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখানে অহংকারের কিছু নিদর্শন বর্ণনা করা হলো:

১. দম্ভভরে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা
এটাই হ’ল প্রধান নিদর্শন। যা উপরের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এটি করা হয়ে থাকে মূলতঃ দুনিয়াবী স্বার্থের নিরিখে। কখনো পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে, কখনো ব্যক্তিগত, সামাজিক বা রাজনৈতিক স্বার্থের দোহাই দিয়ে বা অন্য কোন কারণে।
মানুষ কখনো কখনো নিজেকে শ্রেষ্ঠ করে দেখানোর জন্য সত্যকে চাপা দেয়। অন্যের অবদানগুলো নিজের বলে চালিয়ে দেয়। অন্যকে দাবিয়ে রাখতে বিভিন্ন জায়গায় তাকে তুচ্ছ করে দেখায়। এটাও মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:
عن عبد الله بن مسعود، عن النبي صلى الله عليه و سلم قال: لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ في قَلْبِه مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ قَالَ رَجُلٌ: إِنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ أَنْ يَكُونَ ثَوْبُهُ حَسَناً، ونَعْلُهُ حَسَنَةً، قَالَ: إِنَّ اللهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمالَ، الْكِبْرُ: بَطَرُ الْحَقِّ، وَغَمْطُ النَّاسِ.
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাস্‘ঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যার অন্তরে একটি অণু পরিমাণ অহংকার থাকে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা বললে, এক লোক দাঁড়িয়ে আরয করল, কিছু লোক এমন আছে, সে সুন্দর কাপড় পরিধান করতে পছন্দ করে, সুন্দর জুতা পরিধান করতে পছন্দ করে, এসবকে কি অহংকার বলা হবে? উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, আল্লাহর তা‘আলা নিজেই সুন্দর, তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন। (সুন্দুর কাপড় পরিধান করা অহংকার নয়) অহংকার হল, সত্যকে গোপন করা এবং মানুষকে নিকৃষ্ট বলে জানা। ( )

২. শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করা
সবার কাছে নিজেকে শ্রেষ্ঠ করে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা, অন্যকে তুচ্ছ ভাবা ধ্বংসের কারণ। ইবলিস সর্বপ্রথম নিজেকে বড় মনে করেছিল। যার কারণে মহান আল্লাহ তাকে অভিশাপ দিয়েছেন। যেমন ইবলীস হযরত আদম আলাইহিস সালামের চাইতে নিজেকে বড় মনে করেছিল এবং আল্লাহর অবাধ্য হয়েছিল। সে যুক্তি দিয়েছিল,
أَأَسْجُدُ لِمَنْ خَلَقْتَ طِينًا
‘আমি কি তাকে সাজদা করব, যাকে আপনি মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন?
[ইসরা -৬১] এই যুক্তি ও অবাধ্যতার শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ তাকে বলেন,
فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيمٌ
‘বের হয়ে যাও এখান থেকে। কেননা তুমি অভিশপ্ত’। [সোয়াদ ৩৮/৭৬] মানব সমাজেও যারা অনুরূপ অবাধ্য ও শয়তানী চরিত্রের অধিকারী, তারা সমাজে ও মানুষের কাছে এভাবেই ধিক্কৃত ও বহিষ্কৃত হয়। আর যারা আল্লাহর জন্য বিতাড়িত ও নির্যাতিত হন, তাঁরা ইহকালে ও পরকালে পুরস্কৃত হন।

৩. অন্যের আনুগত্য ও সেবা করাকে নিজের জন্য অপমানজনক মনে করা
এই প্রকৃতির লোকেরা সাধারণতঃ উদ্ধত হয়ে থাকে। এরা মনে করে সবাই আমার আনুগত্য ও সেবা করবে, আমি কারও আনুগত্য করব না। এরা ইহকালে অপদস্থ হয় এবং পরকালে জান্নাত থেকে বঞ্চিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
تِلْكَ الدَّارُ الْاٰخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِيْنَ لاَ يُرِيْدُوْنَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلاَ فَسَادًا
‘পরকালের ঐ গৃহ আমি তৈরী করেছি ওইসব লোকের জন্য, যারা এ দুনিয়াতে উদ্ধত হয় না ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করে না’। [ক্বাসাস ২৮/৮৩] উম্মুল হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
عَنْ يَحْيَى بْنِ حُصَيْنٍ، عَنْ جَدَّتِهِ أُمِّ الْحُصَيْنِ، قَالَ سَمِعْتُهَا تَقُولُ، ৃ قَالَتْ – فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَوْلاً كَثِيرًا ثُمَّ سَمِعْتُهٗ يَقُولُ ‏ “‏ إِنْ أُمِّرَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ مُجَدَّعٌ – حَسِبْتُهَا قَالَتْ – أَسْوَدُ يَقُودُكُمْ بِكِتَابِ اللهِ تَعَالَى فَاسْمَعُوا لَهٗ وَأَطِيعُوا ‏”( )
‘যদি তোমাদের উপর একজন নাক-কান কাটা হাবশী ক্রীতদাসও আমীর নিযুক্ত হন, যিনি তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী পরিচালনা করেন, তবে তোমরা তার কথা শোন ও তার আনুগত্য কর’।( )
আল্লাহকে খুশি করার নিয়তে যিনি যত বিনয়ী ও আনুগত্যশীল হন, তিনি তত সম্মানিত হন এবং আখেরাতে পুরস্কৃত হন।

৪. নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অভাবমুক্ত ভাবা
দুনিয়ার প্রত্যেক মানুষ আল্লাহর দয়ায় চলে। কাউকেই আল্লাহ স্বয়ংসম্পূর্ণ করেননি। শক্তিশালী ব্যক্তি, সমাজনেতা, রাষ্ট্রপতি কিংবা যেকোন পর্যায়ের পদাধিকারী ব্যক্তি বা কর্মকর্তা ও ধনিক শ্রেণীর কেউ কেউ অনেক সময় নিজেকে এরূপ ধারণা করে থাকেন। তিনি ভাবতেই পারেন না যে, আল্লাহ যেকোন সময় তাঁর কাছ থেকে উক্ত নি’মাত ছিনিয়ে নিতে পারেন। আবূ জাহ্ল এরূপ অহংকার করেছিল। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার অভিজ্ঞ পারিষদবর্গ ও শক্তিশালী জনবলের ভয় দেখিয়েছিল। জবাবে আল্লাহ বলেছিলেন,
فَلْيَدْعُ نَادِيَهُ، سَنَدْعُ الزَّبَانِيَةَ
‘ডাকুক সে তার পারিষদবর্গকে’। ‘অচিরেই আমি ডাকব আযাবের ফেরেশতাদেরকে। [‘আলাক্ব ৯৬/১৭-১৮] পরিণতি কি হয়েছিল, সবার জানা। উক্ত প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,
كَلاَّ إِنَّ الْإِنْسَانَ لَيَطْغٰى، أَنْ رَاٰهُ اسْتَغْنٰى
‘কখনই না। মানুষ অবশ্যই সীমালংঘন করে’। ‘কারণ সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে’। [‘আলাক্ব ৯৬/৬-৭] তাই যারা নিজেদের স্বয়ংসম্পূর্ণ ভেবে অন্যকে অবজ্ঞা করে তাদের ব্যাপারে রয়েছে কঠোর হুঁশিয়ারি।
আল্লাহ একেক জনকে একেক মেধা, প্রতিভা ও যোগ্যতা দিয়ে দুনিয়াতে সৃষ্টি করেছেন। ফলে প্রত্যেক মানুষই পরস্পরের মুখাপেক্ষী। কেউ অভাবমুক্ত নয়। তাই মানুষের জন্য অহংকার শোভা পায় না। আল্লাহই কেবল ‘মুতাকাব্বির’ (অহংকারের মালিক)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন,
عن أبي هريرة قال: قال رسول الله صلى الله عليه و سلم قَالَ الله عَزَّ وَجَلَّ: الْكِبْرِيَاءُ رِدَائيِ، وَالْعَظَمَةُ إِزَارِيْ، فَمَنْ نَازَعَنِيْ وَاِحِدًا مِنهُمَا قَذَفْتُهٗ فِي النَّارِ
হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, অহংকার হল আমার কুদরতের চাদর আর বড়ত্ব হল আমার কুদরতের পরিধেয়। যে ব্যক্তি আমার এ দু’টির যে কোন একটি নিয়ে টানাটানি করবে আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব।( )
অতএব সকল প্রকার অহঙ্কার ও শ্রেষ্ঠত্বের মালিক তিনি। তাই অহংকার কেবল তাঁরই জন্য শোভা পায়।

৫. লোকদের কাছে বড়ত্ব যাহির করা ও নিজের ত্রুটি ঢেকে রাখা
হযরত মূসা আলাইহিস সালাম যখন ফের‘আউনকে লাঠি ও প্রদীপ্ত হস্ততালুর নিদর্শন দেখালেন, তখন ফের‘আঊন ভীত হ’ল। কিন্তু নিজের দুর্বলতা ঢেকে রেখে সে তার লোকদের জমা করল। অতঃপর তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে বলল,
أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلٰى- فَأَخَذَهُ اللهُ نَكَالَ الْاٰخِرَةِ وَالْأُوْلٰى
‘আমিই তোমাদের সর্বোচ্চ পালনকর্তা’। ‘ফলে আল্লাহ তাকে পরকালের ও ইহকালের শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করলেন’। [নাযে‘আত ৭৯/২৩-২৪] বস্তুতঃ ফের‘আঊনী চরিত্রের লোকের কোন অভাব সমাজে নেই। সমাজ দূষণের জন্য প্রধানতঃ এসব লোকই দায়ী।

৬. হাঁটাচলায় বড়ত্ব প্রকাশ করা
حَدَّثَنَا ابْنُ إِدْرِيسَ، عَنْ هَارُونَ بْنِ عَنْتَرَةَ، عَنْ سُلَيْمِ بْنِ حَنْظَلَةَ، قَالَ: أَتَيْنَا أُبَيَّ بْنَ كَعْبٍ لِنَتَحَدَّثَ عِنْدَهُ، فَلَمَّا قَامَ قُمْنَا نَمْشِي مَعَهٗ، فَلَحِقَهٗ عُمَرُ فَرَفَعَ عَلَيْهِ عُمَرُ الدُّرَّةَ، فَقَالَ: يَا أَمِيْرَ الْمُؤْمِنِينَ، اِعْلَمْ مَا تَصْنَعُ ؟ قَالَ: إِنَّمَا تَرٰى فِتْنَةً لِلْمَتْبُوعِ مَذَلَّةً لِلتَّابِعِ( )
একবার হযরত উবাই ইবনু কা‘ব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর পিছে পিছে একদল লোককে চলতে দেখে খলীফা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁর প্রতি চাবুক উঁচু করলেন। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তাঁকে মারলেন। তখন তিনি এর কারণ জিজ্ঞেস করলে খলীফা বললেন, هَذَا ذِلَّةٌ لِلتَّابِعِ وَفِتْنَةٌ لِلْمَتْبُوْعِ ‘এটা অনুসরণকারীর জন্য লাঞ্ছনাকর এবং অনুসৃত ব্যক্তিকে ফিৎনায় নিক্ষেপকারী’।( )
এরূপ দৃষ্টান্ত হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকেও এসেছে। তিনি তাঁর পিছনে অনুসরণকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন,
لَوْ تَعْلَمُونَ ذُنُوبِي مَا وَطِئَ عَقِبِي رَجُلاَنِ وَلَحَثَيْتُمْ عَلَى رَأْسِي التُّرَابَ، وَلَوَدِدْتُ أَنَّ اللهَ غَفَرَ لِي ذَنْبًا مِنْ ذُنُوبِي
‘আমার যে কত পাপ রয়েছে তা যদি তোমরা জানতে, তাহলে দু’জন লোকও আমার পিছনে হাঁটতে না এবং অবশ্যই তোমরা আমার মাথায় মাটি ছুঁড়ে মারতে। আমি চাই আল্লাহ আমার গোনাহসমূহ মাফ করুন’।( )

৭. অন্যকে নিজের তুলনায় ছোট মনে করা
হযরত মূসা ও হযরত হারূন আলাইহিমাস সালাম ফের‘আঊনের কাছে তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে গেলে সে বলেছিল,
فَقَالُوْا أَنُؤْمِنُ لِبَشَرَيْنِ مِثْلِنَا وَقَوْمُهُمَا لَنَا عَابِدُونَ
‘আমরা কি এমন দু’ব্যক্তির উপরে বিশ্বাস স্থাপন করব যারা আমাদেরই মত মানুষ এবং তাদের সম্প্রদায় আমাদের দাসত্ব করে’? (মুমিনূন ২৩/৪৭)।

৮. কাউকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা
অর্থ-সম্পদ, সৌন্দর্যের কারণে অন্যের প্রতি অন্তরে কোনো তুচ্ছভাবের উদ্রেক হওয়াটা অহংকারের লক্ষণ। মক্কার কাফের নেতারাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নিকট থেকে হযরত বেলাল, খোবায়েব, সুহায়েব, ইবনু মাস‘ঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমসহ দুর্বল শ্রেণীর লোকদের সরিয়ে দিতে বলেছিল, যাতে তারা তাঁর সঙ্গে বসে পৃথকভাবে কথা বলতে পারে। তখন আয়াত নাযিল হয়,
وَلاَ تَطْرُدِ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ مَا عَلَيْكَ مِنْ حِسَابِهِمْ مِنْ شَيْءٍ وَمَا مِنْ حِسَابِكَ عَلَيْهِمْ مِنْ شَيْءٍ فَتَطْرُدَهُمْ فَتَكُونَ مِنَ الظَّالِمِينَ
‘যেসব লোক সকাল-সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালকের ইবাদত করে এবং এর মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে, তাদেরকে তুমি দূরে সরিয়ে দিয়ো না। তাদের কোন আমলের হিসাব তোমার দায়িত্বে নেই এবং তোমার কোন আমলের হিসাব তাদের দায়িত্বে নেই। এরপরেও যদি তুমি তাদের সরিয়ে দাও, তাহ’লে তুমি ইনসাফ বহির্ভুত কাজ করলে। (আন‘আম ৬/৫২)।
ধনে-জনে ও পদমর্যাদায় নিম্নস্তরের লোকদের প্রতি মনের মধ্যে কোন তুচ্ছভাব উদ্রেক হওয়াটা অহংকারের লক্ষণ। অতএব এই স্বভাবগত রোগ কঠিনভাবে দমন করা অবশ্য কর্তব্য।

৯. মানুষের সাথে অসদ্ব্যবহার করা ও তাদের প্রতি কঠোর হওয়া
এটি অহংকারের অন্যতম লক্ষণ। হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন,
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْها أَنَّ رَجُلًا اسْتَأْذَنَ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ ائْذَنُوْا لَهٗ، فَلَبِئْسَ ابْنُ الْعَشِيرَةِ أَوْ بِئْسَ رَجُلُ الْعَشِيرَةِ فَلَمَّا دَخَلَ عَلَيْهِ أَلَانَ لَهُ الْقَوْلَ قَالَتْ عَائِشَةُ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ، قُلْتَ لَهُ الَّذِي قُلْتَ ثُمَّ أَلَنْتَ لَهُ الْقَوْلَ . قَالَ يَا عَائِشَةُ إِنَّ شَرَّ النَّاسِ مَنْزِلَةً عِنْدَ اللَّهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَنْ وَدَعَهُ أَوْ تَرَكَهُ النَّاسُ اتِّقَاءَ فُحْشِهِ( )
একদিন জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাক্ষাৎপ্রার্থী হল। তিনি বললেন, তোমরা ওকে অনুমতি দাও। সে তার গোত্রের কতই না মন্দ ভাই ও কতই মন্দ পুত্র! অতঃপর যখন লোকটি প্রবেশ করল, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে অতীব নম্রভাবে কথা বললেন। পরে আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি লোকটি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করলেন। আবার সুন্দর আচরণ করলেন, ব্যাপারটা কি? জবাবে তিনি বললেন, হে আয়েশা! ‘সবচেয়ে নিকৃষ্ট সেই ব্যক্তি, যাকে লোকেরা পরিত্যাগ করে ও ছেড়ে যায় তার অশ্লীল কথার ভয়ে’।( )

১০. শক্তি ও প্রভাব খাটিয়ে বা বুদ্ধির জোরে অন্যের হক নষ্ট করা
এটি অহংকারের একটি বড় নিদর্শন। এর শাস্তি অত্যন্ত লাঞ্ছনাকর। আল্লাহ কাউকে বড় করলে সে উদ্ধত হয়ে পড়ে এবং যার মাধ্যমে তিনি বড় হয়েছেন ও যিনি তাকে বড় করেছেন সেই বান্দা ও আল্লাহকে সে ভুলে যায়। সে এ কথা ভেবে অহংকারী হয় যে, আমি আমার যোগ্যতা বলেই বড় হয়েছি। ফলে সে আর অন্যকে সম্মান করে না। সে তখন শক্তির জোরে বা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে অন্যের হক নষ্ট করে। এই হক সম্মানের হতে পারে বা মাল-সম্পদের হতে পারে। অন্যায়ভাবে কারো সম্মানের হানি করলে ক্বিয়ামতের দিন অহংকারী ব্যক্তিকে পিঁপড়া সদৃশ করে লাঞ্ছনাকর অবস্থায় হাঁটানো হবে।( )
অথবা তাকে ঐ মাল-সম্পদ ও মাটির বিশাল বোঝা মাথায় বহন করে হাঁটতে বাধ্য করা হবে।( )

১১. অধীনস্তদের প্রতি দুর্ব্যবহার করা ও তাদেরকে নিকৃষ্টভাবে খাটানো
অহংকারী মালিকরা তাদের অধীনস্থ শ্রমিক ও কর্মচারীদের প্রতি এরূপ আচরণ করে থাকে, যা তাদের হতভাগা হবার বাস্তব নিদর্শন। এই স্বভাবের লোকেরা এভাবে প্রতিনিয়ত ‘হাক্কুল ইবাদ’ তথা বান্দার হক্ব নষ্ট করে থাকে। আল্লাহর হক আদায়ের মাধ্যমে কখনোই বান্দার হক বিনষ্টের কাফফারা আদায় হয় না। বান্দা ক্ষমা না করলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
اتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ، فَإِنَّهُ لَيْسَ بَيْنَهُ وَبَيْنَ اللهِ حِجَابٌ
‘তুমি মযলূমের দো‘আ থেকে বেঁচে থাক। কেননা, মযলূমের দো‘আ ও আল্লাহর মধ্যে কোন পর্দা নেই (অর্থাৎ সাথে সাথে কবুল হয়ে যায়)। ( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
الظُّلْمُ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘যুলুম কিয়ামতের দিন ঘন অন্ধকার হয়ে দেখা দেবে’।( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ أَتَدْرُونَ مَا الْمُفْلِسُ قَالُوا: الْمُفْلِسُ فِينَا مَنْ لَا دِرْهَمَ لَهُ وَلَا مَتَاعَ فَقَالَ إِنَّ الْمُفْلِسَ مِنْ أُمَّتِي يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلَاةٍ، وَصِيَامٍ، وَزَكَاةٍ، وَيَأْتِي قَدْ شَتَمَ هَذَا، وَقَذَفَ هٰذَا، وَأَكَلَ مَالَ هَذَا، وَسَفَكَ دَمَ هَذَا، وَضَرَبَ هَذَا، فَيُعْطٰى هٰذَا مِنْ حَسَنَاتِه، وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِه، فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهٗ قَبْلَ أَنْ يُقْضَى مَا عَلَيْهِ أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ، ثُمَّ طُرِحَ فِي النَّارِ.
তোমরা কি জানো নিঃস্ব কে? সবাই বলল, যার কোন ধন-সম্পদ নেই। তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে নিঃস্ব সেই ব্যক্তি, যে ক্বিয়ামতের দিন সালাত, সিয়াম, যাকাত নিয়ে হাযির হবে। অতঃপর লোকেরা এসে অভিযোগ করে বলবে যে, এ লোকটি আমাকে গালি দিয়েছে, মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, তার মাল গ্রাস করেছে, হত্যা করেছে, প্রহার করেছে। অতঃপর তার নেকী থেকে তাদের একে একে বদলা দেওয়া হবে। এভাবে বদলা দেওয়া শেষ হবার আগেই যখন তার নেকী শেষ হয়ে যাবে, তখন বাদীদের পাপ থেকে নিয়ে তার ভাগে নিক্ষেপ করা হবে। অবশেষে ঐ ব্যক্তিকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। ( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: لَتُؤَدُّنَّ الْحُقُوقَ إِلَى أَهْلِهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ، حَتَّى يُقَادَ لِلشَّاةِ الْجَلْحَاءِ، مِنَ الشَّاةِ الْقَرْنَاءِ( )
ক্বিয়ামতের দিন অবশ্যই হকদারকে তার হক আদায় করে দেয়া হবে। এমনকি শিংওয়ালা ছাগল যদি শিংবিহীন ছাগলকে গুঁতো মেরে কষ্ট দিয়ে থাকে, সেটারও বদলা নেওয়া হবে (মানুষকে ন্যায়বিচার দেখানোর জন্য)।( )
তিনি আরও এরশাদ করেন,
ابْغُونِى فِيْ ضُعَفَائِكُمْ فَإِنَّمَا تُرْزَقُونَ وَتُنْصَرُونَ بِضُعَفَائِكُمْ
‘তোমরা আমাকে তোমাদের দুর্বলদের মধ্যে তালাশ কর। কেননা তোমাদেরকে রূযী পৌঁছানো হয় ও সাহায্য করা হয় তোমাদের দুর্বলদের মাধ্যমে।( ) এর অর্থ তোমরা আমার সন্তুষ্টি তালাশ কর দুর্বলদের প্রতি তোমাদের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে।
তিনি আরও এরশাদ করেন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ، قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمَمْلُوْكُ أَخُوْكَ ، فَإِذَا صَنَعَ لَكَ طَعَامًا فَأَجْلِسْهُ مَعَكَ، فَإِنْ أَبٰى فَأَطْعِمْهُ، وَلَا تَضْرِبُوا وُجُوهَهُمْ ” ( )
যখন খাদেম তোমার খাবার নিয়ে আসে, তখন তাকে খাইয়ে তুমি শুরু কর। অথবা তাকে সাথে বসাও বা তাকে এক লোকমা খাইয়ে দাও।( )
আল্লাহ এরশাদ করেন,
وَقُوْلُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا
তোমরা মানুষের সাথে সুন্দরভাবে কথা বলো’ (বাক্বারাহ ২/৮৩)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
اِتَّقِ اللهَ حَيْثُمَا كُنْتَ وأَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الْحسنةَ تَمْحُهَا،
وخَالقِ النَّاسَ بخُلُقٍ حَسَنٍ( )
যেখানেই তুমি থাক, আল্লাহকে ভয় কর। আর মন্দ কাজের পরক্ষণেই উত্তম কাজ কর যা তোমার মন্দকে দূরীভূত করে দেবে, আর মানুষের সাথে ভাল আচরণ কর।( )
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ۚ اِدْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ
ভাল ও মন্দ সমান হতে পারেনা। অতএব তুমি মন্দকে ভাল দ্বারা প্রতিহত কর। তাহলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত হয়ে যাবে’ (হামীম সাজদাহ-৩৪)।

১২. মিথ্যা বা ভুলের উপর যিদ করা
এটি অহংকারের অন্যতম নিদর্শন। নবীগণ যখন লোকদেরকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিতেন, তখন তারা বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করত এবং নিজেদের ভুল ও মিথ্যার উপরে যিদ করত।
وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنزَلَ اللهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ الشَّيْطَانُ يَدْعُوهُمْ إِلَى عَذَابِ السَّعِيرِ
তাদেরকে যখন বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তোমরা তার অনুসরণ কর, তখন তারা বলে, বরং আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে যে বিষয়ের উপর পেয়েছি, তারই অনুসরণ করব। শয়তান যদি তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তির দিকে দাওয়াত দেয়, তবুও কি? (লোকমান -২১)
কেবল কাফেরদের মধ্যে নয়, বরং মুসলমানদের মধ্যেও উক্ত দোষ পরিলক্ষিত হয়। যেমন বাতিল আক্বীদার লোকেরা বিভিন্ন অজুহাতে স্বীয় বাতিলের উপর অটল থাকে। অমনিভাবে বিচারক ও শাসক শ্রেণী তাদের ভুল ‘রায়’ থেকে ফিরে আসেন না বরং একটি প্রবাদ চালু আছে যে, ‘হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না’; অথচ মানুষের ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক।
খলীফা হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যখন হযরত আবু মূসা আশ‘আরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে কূফার গভর্ণর করে পাঠান, তখন তাঁকে লিখে দেন যে, তুমি গতকাল কোন সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকলে সেখান থেকে ফিরে আসতে কোন কিছু যেন তোমাকে বাধা না দেয়। কেননা,
اَلرُّجُوعُ إِلىَ الْحَقِّ خَيْرٌ مِنَ التَّمَادِى فِى الْبَاطِلِ
‘মিথ্যার উপরে অটল থাকার চাইতে সত্যের দিকে ফিরে আসা অধিক উত্তম’।( )
খলীফা হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয (৯৯-১০১ হিঃ) বলতেন,
مَا مِنْ كِتَابٍ أَيْسَرُ عَلَىَّ رَدًّا مِنْ كِتَابٍ قَضَيْتُ بِه ثُمَّ أَبْصَرْتُ أَنَّ الْحَقَّ فِى غَيْرِه فَفَسَخْتُهُ
‘আমি সিদ্ধান্ত দিয়েছি এমন কোন বিষয় বাতিল করা আমার নিকটে সবচেয়ে সহজ, যখন আমি দেখি যে তার বিপরীতটাই সত্য।’( )
আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী রহমাতুল্লাহি আলইহি (৩৫-১৯৮ হিঃ) বলেন,
كنا في جنازة فيها عبيد الله بن الحسن، وهو على القضاء، فلمَّا وضع السرير؛ جلس، وجلس الناس حوله، قال: فسألته عن مسألة، فغلط فيها، فقلت: أصلحك الله، القول في هذه المسألة كذا وكذا؛ إلا اَني لم أرد هذه، إنما أردت أن أرفعك إلى ما هو أكبر منها، فأطرق ساعة، ثم رفع رأسه، فقال: إذاً أرجع وأنا صاغر، إذاً أرجع وأنا صاغر؛ لأن أكون ذَنَباً في الحق أحبُّ إليَّ من أن أكون رأساً في الباطل. ( )
একদা আমরা একটি জানাজায় উপস্থিত হলাম, তাতে কাজী উবাইদুল্লা ইবনুল হাসান রহমাতুল্লাহি আলইহি হাযির হলেন। তখন তিনি রাজধানী বাগদাদের বিচারপতির দায়িত্বে ছিলেন। আমি তাঁকে একটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে, তিনি ভুল উত্তর দেন, আমি তাঁকে বললাম, আল্লাহ আপনাকে সংশোধন করে দিন, এ মাসআলার সঠিক উত্তর এভাবে…। তিনি কিছু সময় মাথা নিচু করে চুপ করে বসে থাকলেন, তারপর মাথা উঠিয়ে বললেন, আমি আমার কথা থেকে ফিরে আসলাম, আমি লজ্জিত। সত্য গ্রহণ করে লেজ হওয়া আমার নিকট মিথ্যার মধ্যে থেকে মাথা হওয়ার চেয়ে অধিক উত্তম।( ) অর্থাৎ হক-এর অনুসারী হওয়া বাতিলের নেতা হওয়ার চাইতে অনেক উত্তম।
—০—

মানুষ যা নিয়ে অহংকার করে
মানুষ অনেক কিছু নিয়ে অহংকার করে থাকে। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে বিভিন্ন ধরনের যোগ্যতা ও গুণ দিয়ে সৃষ্টি করেন। কারো সৌন্দর্য আছে কিন্তু ধন সম্পদ নাই, সে সৌন্দর্য নিয়ে অহংকার করে, আবার কেউ আছে তার সম্পদ আছে, কিন্তু সৌন্দর্য নাই, সে তার সম্পদ নিয়ে বড়াই বা অহংকার করে। এভাবে এক একজন মানুষ এক একটি নিয়ে অহংকার করে। নিম্নে মানুষ যে সব নি’মাত নিয়ে অহংকার করে, তার কয়েকটি আলোচনা করা হলঃ

এক. ধন-সম্পদ
মানুষ আল্লাহর দেয়া ধন-সম্পদ নিয়ে অহংকার বা বড়াই করে থাকে। তারা মনে করে ধন-সম্পদ লাভ তাদের যোগ্যতার ফসল, তারা নিজেরা তাদের যোগ্যতা দিয়ে ধন-সম্পদ উপার্জন করে থাকে। সুতরাং, যাদের ধন-সম্পদ থাকে না তারা অযোগ্য ও অক্ষম। আল্লাহ তা‘আলা ক্বোরআন করীমে দুইজন বাগান মালিক সম্পর্কে এরশাদ করেন,
وَّ كَانَ لَهٗ ثَمَرٌۚ-فَقَالَ لِصَاحِبِهٖ وَ هُوَ یُحَاوِرُهٗۤ اَنَا اَكْثَرُ مِنْكَ مَالًا وَّ اَعَزُّ نَفَرًا
আর (এতে) তার ছিল বিপুল ফল-ফলাদি। তাই সে তার সঙ্গীকে কথায় কথায় বলে, ‘সম্পদে আমি তোমার চেয়ে অধিক এবং জনবলেও অনেক শক্তিশালী’।
[সূরা কাহফ, আয়াত: ৩৪] এখানে লোকটি তার ধন-সম্পদ নিয়ে তার অপর ভাইয়ের উপর অহংকার করে থাকে। আল্লাহ তার অহংকারের নিন্দা করেন আর যে ভাই অহংকার করত না তার প্রশংসা করেন।
আল্লাহ তা‘আলা আরও এরশাদ করেন,
اِنَّ قَارُوْنَ كَانَ مِنْ قَوْمِ مُوْسٰى فَبَغٰى عَلَیْهِمْ۪-وَ اٰتَیْنٰهُ مِنَ الْكُنُوْزِ مَاۤ اِنَّ مَفَاتِحَهٗ لَتَنُوْٓاُ بِالْعُصْبَةِ اُولِی الْقُوَّةِۗ-اِذْ قَالَ لَهٗ قَوْمُهٗ لَا تَفْرَحْ اِنَّ اللّٰهَ لَا یُحِبُّ الْفَرِحِیْنَ(۷۶)وَ ابْتَغِ فِیْمَاۤ اٰتٰىكَ اللّٰهُ الدَّارَ الْاٰخِرَةَ وَ لَا تَنْسَ نَصِیْبَكَ مِنَ الدُّنْیَا وَ اَحْسِنْ كَمَاۤ اَحْسَنَ اللّٰهُ اِلَیْكَ وَ لَا تَبْغِ الْفَسَادَ فِی الْاَرْضِؕ-اِنَّ اللّٰهَ لَا یُحِبُّ الْمُفْسِدِیْنَ(۷۷)
নিশ্চয় কারূন ছিল মূসার কওমভুক্ত। অতঃপর সে তাদের উপর ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে। অথচ আমি তাকে এমন ধনভান্ডার দান করেছিলাম যে, নিশ্চয় তার চাবিগুলো একদল শক্তিশালী লোকের উপর ভারী হয়ে যেত। স্মরণ করুন, যখন তার কওম তাকে বলল, ‘দম্ভ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ দাম্ভিকদের ভালবাসেন না’। আর আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন তাতে তুমি আখিরাতের নিবাস অনুসন্ধান কর। তবে তুমি দুনিয়া থেকে তোমার অংশ ভুলে যেয়ো না। তোমার প্রতি আল্লাহ যেরূপ অনুগ্রহ করেছেন তুমিও সেরূপ অনুগ্রহ কর। আর যমীনে ফাসাদ করতে চেয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ ফাসাদকারীদের ভালবাসেন না’।
[সূরা ক্বাসাস, আয়াত: ৭৬,৭৭] আল্লাহ তা‘আলা আরও এরশাদ করেন,
فَإِذَا مَسَّ ٱلۡإِنسٰنَ ضُرٌّ دَعَانَا ثُمَّ إِذَا خَوَّلۡنَٰهُ نِعۡمَةٗ مِّنَّا قَالَ إِنَّمَآ أُوتِيتُهُۥ عَلَىٰ عِلۡمِۢ بَلۡ هِيَ فِتۡنَةٌ وَلٰكِنَّ أَكۡثَرَهُمۡ لَا يَعۡلَمُون
অতঃপর কোন বিপদাপদ মানুষকে স্পর্শ করলে সে আমাকে ডাকে। তারপর যখন আমি আমার পক্ষ থেকে নি‘আমত দিয়ে তাকে অনুগ্রহ করি তখন সে বলে, ‘জ্ঞানের কারণেই কেবল আমাকে তা দেয়া হয়েছে’। বরং এটা এক পরীক্ষা। কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা জানে না। [সূরা যুমার, আয়াত: ৪৯] মানুষ যখন ধন-সম্পদ লাভ করে, তখন সে মনে করে এ তো তার যোগ্যতার ফসল। সে তার বুদ্ধি, বিবেক ও জ্ঞান দিয়েই ধন-সম্পদ লাভ করেছে। কিন্তু আল্লাহ তাআ’লা বলেন, আসলে মানুষের জ্ঞান খুবই সীমিত তারা এও জানে না যে, তাদের ধন-সম্পদ কোথা থেকে আসে।

দুই. ইলম বা জ্ঞান
অহংকারের অন্যতম একটি কারণ হল, ইলম বা জ্ঞান। একটি কথা মনে রাখতে হবে, আলেম, ওলামা, তালেবে ইলম ও তথাকথিত পীর-মাশায়েখ ও বক্তাদের মধ্যে অহংকার খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কারণ, শয়তান তাদের পিছনে লেগে থাকে, চেষ্টা করে কীভাবে তাদের ধোকাঁয় ফেলা যায়। এ কারণেই বর্তমানে আমরা দেখতে পাই, আলেমদের মধ্যে ফিতনা-ফ্যাসাদ, ঝগড়া-বিবাদ ও মতবিরোধ খুব বেশি। একজন আলেম মনে করে, ইলমের দিক দিয়ে সেই হল পরিপূর্ণ ও স্বয়ং সম্পন্ন, তারমত এত বড় জ্ঞানী জগতে আর কেউ নেই। অনেক সময় দেখা যায়, একজন আলেম অন্য আলেমকে একেবারেই মূল্যয়ন করে না এবং নিজেকে মনে করে বড় আলেম, আর অন্যদের সে জাহেল ও নিকৃষ্ট মনে করে। এ ধরনের স্বভাব একজন আলেমের জন্য কত যে জঘন্য তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
ইলম নিয়ে অহংকার কীভাবে করতে পারে? অথচ ইলম হল, আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক কায়েমের মাধ্যম। ফলে যাদের মধ্যে ইলম আছে তারা আল্লাহর একেবারেই কাছের লোক। তারা কখনোই তাদের ইলম দ্বারা গর্ব বা অহংকার করতে পারে না। যে ইলম মানুষের মধ্যে অহংকার সৃষ্টি করে তা হল, তথাকথিত ইলম বা জ্ঞান। এ ধরনের ইলম নিয়ে ব্যস্ত থাকার কোন অর্থ হতে পারে না। কারণ, বাস্তব ও সত্যিকার ইলম হল, যে ইলম বা জ্ঞান দ্বারা বান্দা তার মহান রবকে চিনতে পারে এবং নিজেকে জানতে পারে। সত্যিকার ইলম একজন বান্দার মধ্যে আল্লাহর ভয় ও বিনয় সৃষ্টি করে, অহংকার সৃষ্টি করে না।
একজন মানুষের মধ্যে যখন সত্যিকার ইলম বা জ্ঞান থাকবে, তখন সে সর্বাধিক বিনয়ী হবে এবং আল্লাহকেই ভয় করতে থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
اِنَّمَا یَخْشَى اللّٰهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمٰٓؤُاؕ-اِنَّ اللّٰهَ عَزِیْزٌ غَفُوْرٌ (۲۸)
বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে। নিশ্চয় আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, পরম ক্ষমাশীল। [সূরা ফাতের, আয়াত: ২৮] পাশাপাশি ইলম বা জ্ঞান হল- পবিত্র আমানত, যা পবিত্র পাত্রেই মানায়, অপবিত্র পাত্রে তা কখনোই মানায় না। আর এমন ব্যক্তির ইলম নিয়ে মগ্ন হওয়া, যার অন্তর নাপাকিতে ভরপুর ও চারিত্রিক দিক দিয়ে সে অত্যন্ত নিকৃষ্ট, তা কখনোই শুভ হয় না। এ লোকটি যখন কোন কিছু শিখে, তা নিয়ে সে অহংকার করা আরম্ভ করে এবং যত বেশি শিখে তার অহংকার আরও বাড়তে থাকে। ফলে তার জ্ঞান মানুষের জন্য অশান্তির কারণ হয়। ( )
অহংকারের আরেকটি প্রকার হল, বর্তমানে অনেক ছোট ছোট তালেবে ইলমকে বড় বড় আলেমদের সমকক্ষ বিবেচনা করে বিভিন্ন ধরনের কথা বলতে দেখা যায়। কোন মাসআলাতে বড় আলেমদের মতামতকে উপেক্ষা করে তারা নিজেরা মতামত দেয় এবং বলে, তারাও মানুষ আমরাও মানুষ!! এ ধরনের উক্তি তাদের জন্য কখনোই উচিত নয়।( )

তিন. আমল ও ইবাদত
অনেকেই তাদের ইবাদত ও আমল নিয়ে গর্ব ও অহংকার করে। সে মনে করে মানুষের কর্তব্য হল, তারা তাকে সম্মান করবে, সব কাজে তাকে অগ্রাধিকার দেবে এবং তার তাক্বওয়া, তাহারাত ও বুযুর্গী নিয়ে বিভিন্নভাবে আলোচনা করবে। আর সে মনে করে সব মানুষ ধ্বংসের মধ্যে আছে, শুধু সে একাই নিরাপদ। এমনটি বলা কোন ক্রমেই উচিত নয়।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: إِذَا قَالَ الرَّجُلُ: هَلَكَ النَّاسُ فَهُوَ أَهْلَكُهُمْ قَالَ أَبُو إِسْحَاقَ: لَا أَدْرِي، أَهْلَكَهُمْ بِالنَّصْبِ، أَوْ أَهْلَكُهُمْ بِالرَّفْعِ . ( )
আবু হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যখন কোন লোক বলে মানুষ ধ্বংস হয়ে গেছে, মূলত: সেই তাদের মধ্যে সর্বাধিক ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্যক্তি। বা ‘সে তাদের ধ্বংস করে দিল’
আল্লামা আবু ইসহাক বলেন, আমি জানি না أَهلَكهُمْ শব্দটি কি যবর বিশিষ্ট, যার অর্থ ‘সে তাদের ধ্বংস করল’, নাকি পেশ বিশিষ্ট, যার অর্থ ‘সেই তাদের চেয়ে অধিক ধ্বংসের মধ্যে আছে’।( )
ইবাদত ইসলামের মূল উদ্দেশ্য হলেও তা অনেক সময় মুমিনের মধ্যে অহংকার সৃষ্টি করে। যা তাকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করে। পক্ষান্তরে সালাফে সালেহীনের নীতি ছিল এই যে, তারা সর্বদা নিজেকে অন্যের চাইতে হীন মনে করতেন। আল্লামা ইবনে জাওযী রহমাতুল্লাহি আলইহি বলেন, কতেক অসতর্ক সূফী আছে, যাঁরা তাদের নিজেদের মনে করে, তারা আল্লাহর মাহবূব ও মকবুল বান্দা আর অন্যরা সবাই নিকৃষ্ট ও পাপি বান্দা। তারা আরও ধারণা করে, তার মান-মর্যাদা অতি উচ্চে, তাই সবাই তাকে সম্মান করে, তার মান-মর্যাদা যদি উচ্চে না হত তাহলে তাকে কেউ সম্মান করত না। আবার কখনো কখনো সে এ ধারণা করে, সে যমিনের ক্বুতুব, সে যে মর্যাদায় পৌঁছেছে তার এ আসন পর্যন্ত পৌছার মত আর কেউ দুনিয়াতে নেই।( )
আল্লামা খাত্তাবী রহমাতুল্লাহি আলইহি তার আযলা কিতাবে বর্ণনা করেন, আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক খোরাসানে পৌছলে মানুষের মুখে শুনতে পেলেন, এখানে একজন লোক আছে যিনি তাকওয়া ও পরহেজগারিতে প্রসিদ্ধ ও বিখ্যাত। এ কথা শোনে আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহমাতুল্লাহি আলইহি তাকে দেখতে গেলেন। তিনি তার ঘরে প্রবেশ করেন, কিন্তু লোকটি তার দিকে একটুও তাকাল না এবং তাঁর প্রতি বিন্দু পরিমাণও ভ্রুক্ষেপ করেনি। তাঁর অবস্থা দেখে আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক কাল ক্ষেপণ না করে তার ঘর থেকে বের হয়ে চলে আসেন। তারপর তাঁর সাথীদের থেকে এক লোক তাঁকে বলল, তুমি কি জান এ লোকটি কে? সে বলল, না। তখন সে বলল, এ হল আমীরুল মু’মিনীন আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক, এ কথা শোনে লোকটি হতভম্ব ও নির্বাক হল এবং দৌড়ে আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহমাতুল্লাহি আলইহির নিকট গেল, তাঁর নিকট ক্ষমা চাইল এবং তার আচরণের জন্য দু:খ প্রকাশ করল। তারপর বলল, হে আবু আব্দুর রহমান! তুমি আমাকে ক্ষমা কর এবং উপদেশ দাও! তখন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বললেন,
إِذَا خَرَجْتَ مِنْ مَنْزِلِكَ فَلا يَقَعْ بَصَرُكَ عَلَى أَحَدٍ إِلا أُرِيتَ أَنَّهُ خَيْرٌ مِنْكَ
যখন তুমি ঘর থেকে বের হও, তখন যাকেই দেখ, মনে করবে সে তোমার থেকে উত্তম, আর তুমি তাদের চেয়ে অধম ও নিকৃষ্ট। ( )
তাকে এ উপদেশ দেয়ার কারণ হল, লোকটি নিজেকে বড় মনে করত এবং অহংকার করত। এ ছিল ধোঁকায় নিমজ্জিত একজন অহংকারীর অবস্থা।
সালফে সালেহীন ও আমাদের পূর্বসূরিদের অবস্থা হল এ ধরণের লোকদের হতে সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁরা কখনোই এ ধরনের আচরণ করতেন না। তাঁদের থেকে বকর ইবনে আব্দুল্লাহ মুযানীর (মৃঃ ১০৬ হিঃ) কথা বর্ণিত, তিনি বলেন,
نَظَرْتُ إِلَى أَهْلِ عَرَفَاتٍ ظَنَنْتُ أَنَّهٗ قَدْ غُفِرَ لَهُمْ لَوْلاَ أَنِّي كُنْتُ فِيهِمْ بِه
আমি আরাফায় অবস্থানকারীদের দিকে তাকিয়ে দেখি এবং মনে মনে বলি, আমার মত পাপিষ্ঠ ও গুনাহগার লোক যদি না থাকত, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা সকল আরাফাবাসীকে ক্ষমা করে দিতেন।( )
একজন মুমিন সব সময় নিজেকে ছোট ও নিকৃষ্ট মনে করবে এটাই স্বাভাবিক। তার আমল, ইবাদত ও বন্দেগী যতই বেশি হোক না কেন, সে তার যাবতীয় সব ইবাদতকে খুব কমই বিবেচনা করবে। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম মুজাদ্দিদ খলীফা হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয (৬১-১০১ হিঃ) রহমাতুল্লাহি আলইহিকে বলা হল, যদি আপনি মারা যান তবে আমরা আপনাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাওযা পাকে দাফন করব, তখন তিনি বললেন,
لأن ألقى الله بكل ذنب غير الشرك أحب إلي من أن أرى نفسي أهلاً لذلك
একমাত্র শিরক ছাড়া আর বাকী সব গুনাহ নিয়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করা, আমার নিকট রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাওযা মুবারকে দাফনের যোগ্য মনে করা হতে উত্তম।( )

আব্দুল্লাহ বিন আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বসেছিলাম। এমন সময় তিনি বললেন, ‘আল্লাহর নবী নূহ আলাইহিস সালাম ওফাতকালে স্বীয় পুত্রকে ওসীয়ত করে বলেন, আমি তোমাকে দু’টি বিষয়ে নির্দেশ দিচ্ছি ও দু’টি বিষয়ে নিষেধ করে যাচ্ছি। নির্দেশ দু’টি হ’ল তুমি বলবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। কেননা আসমান ও যমীনের সবকিছু যদি এক হাতে রাখা হয় এবং এটিকে যদি এক হাতে রাখা হয়, তাহলে এটিই ভারি হবে।
দ্বিতীয়টি হ’ল ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী’। কেননা এটি সকল বস্তুর তাসবীহ এবং এর মাধ্যমেই সকল সৃষ্টিকে রূযী দেওয়া হয়। আর আমি তোমাকে নিষেধ করে যাচ্ছি দু’টি বস্তু থেকে: শিরক ও অহংকার। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আরয করা হ’ল, আমরা সুন্দর জুতা পরি, সুন্দর পোষাক পরিধান করি, লোকেরা আমাদের কাছে এসে বসে- এগুলি কি অহংকার হবে? তিনি বললেন, না। বরং অহংকার হ’ল, সত্যকে দম্ভভরে প্রত্যাখ্যান করা ও মানুষকে হেয় জ্ঞান করা।( )
সত্য প্রত্যাখ্যান করা ও নিজের ভুলের উপর যিদ ও হঠকারিতার বিষয়টি বেশী দেখা যায় বাতিলপন্থী লোকদের মধ্যে, কিছু সংখ্যক দল ও রাষ্ট্রের নেতাদের মধ্যে এবং মূর্খ ও অবিবেচক লোকদের মধ্যে। তাদের প্রত্যেকে নিজেকে নিয়েই গর্বিত থাকে। পবিত্র ক্বোরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে নিজেকে সংশোধনের আকাংক্সক্ষা তাদের মধ্যে তেমন দেখা যায় না।

চার. বংশ
কতেক লোক আছে তারা উচ্চ বংশীয় হওয়ার কারণে অন্যদের উপর বংশ নিয়ে গর্ব ও অহংকার করে। সে অহংকার বশতঃ মানুষের সাথে মিশতে চায়না, তাদের সাথে মিশতে অপছন্দ করে এবং মানুষকে ঘৃণা করে। অনেক সময় অবস্থা এমন হয়, তার মুখ দিয়েও অহংকার প্রকাশ পায়। ফলে সে মানুষকে বলতে থাকে, তুমি কে? তোমার পিতা কে? তুমি আমার মত লোকের সাথে কথা বলছ?
ইসলামের আদর্শ হল, বংশ মর্যাদা না থাকার কারণে কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করা যাবে না। একজন লোক সে যে বংশেরই হোক না কেন, তার পরিচয় ঈমান ও আমলের মাধ্যমে। এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাবশী গোলাম হযরত বেলাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র মূল্য মক্কার কাফের সরদার আবূ জাহল হতে বেশি। একমাত্র ঈমানের কারণে হাবশী গোলাম হযরত বেলাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে খলিফাতুল মুসলিমিন হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁর নিজের সরদার বলে আখ্যায়িত করেন। যেমন হাদীসে বর্ণিত,
عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ المُنْكَدِرِ، أَخْبَرَنَا جَابِرُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا، قَالَ: كَانَ عُمَرُ يَقُولُ: أَبُو بَكْرٍ سَيِّدُنَا، وَأَعْتَقَ سَيِّدَنَا يَعْنِي بِلاَلًا( )
হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলতেন, আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আমাদের সরদার এবং তিনি আমাদের সরদার বিলাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কে দাসত্ব ও গোলামী হতে মুক্ত করেন।( )
عَنِ المَعْرُورِ هُوَ اِبْنُ سُوَيْدٍ، عَنْ أَبِي ذَرٍّ، قَالَ: رَأَيْتُ عَلَيْهِ بُرْدًا، وَعَلَى غُلاَمِهِ بُرْدًا، فَقُلْتُ: لَوْ أَخَذْتَ هَذَا فَلَبِسْتَهُ كَانَتْ حُلَّةً، وَأَعْطَيْتَهُ ثَوْبًا اٰخَرَ، فَقَالَ: كَانَ بَيْنِي وَبَيْنَ رَجُلٍ كَلاَمٌ، وَكَانَتْ أُمُّهٗ أَعْجَمِيَّةً، فَنِلْتُ مِنْهَا، فَذَكَرَنِي إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ لِي أَسَابَبْتَ فُلاَنًا قُلْتُ: نَعَمْ، قَالَ أَفَنِلْتَ مِنْ أُمِّهِ قُلْتُ نَعَمْ، قَالَ إِنَّكَ امْرُؤٌ فِيكَ جَاهِلِيَّةٌ قُلْتُ عَلَى حِينِ سَاعَتِي: هٰذِهِ مِنْ كِبَرِ السِّنِّ؟ قَالَ: نَعَمْ، هُمْ إِخْوَانُكُمْ، جَعَلَهُمُ اللهُ تَحْتَ أَيْدِيكُمْ، فَمَنْ جَعَلَ اللهُ أَخَاهُ تَحْتَ يَدِه، فَلْيُطْعِمْهُ مِمَّا يَأْكُلُ، وَلْيُلْبِسْهُ مِمَّا يَلْبَسُ، وَلاَ يُكَلِّفُهٗ مِنَ العَمَلِ مَا يَغْلِبُهٗ، فَإِنْ كَلَّفَهٗ مَا يَغْلِبُهُ فَلْيُعِنْهُ عَلَيْهِ( )
মা’রুর ইবনে সুয়াইদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হযরত আবূ যর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে একটি চাদর পরিহিত অবস্থায় দেখি এবং তাঁর গোলামকেও ঠিক একই চাদর পরিহিত অবস্থায় দেখি। আমি তাঁকে বললাম, ‘‘যদি তুমি এ চাদরটি নিতে এবং তা পরিধান করতে, তাহলে তোমার জন্য একটি সেট হয়ে যেত! আর গোলামকে তুমি অন্য একটি কাপড় পরতে দিতে পারতে।’’ তখন তিনি বললেন, ‘‘আমি ও অপর এক লোকের সাথে আমার তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল। আর লোকটির মা ছিল একজন অনারবীয় মহিলা। ঘটনাক্রমে আমি তার মায়ের সমালোচনা করি ও গালি দিই। তারপর আমার বিষয়টি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আলোচনা হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডেকে বললেন, তুমি কি অমুককে গালি দিয়েছ? আমি উত্তর দিলাম, জ্বী হাঁ। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি কি তার মায়ের সমালোচনা করেছ? আমি বললাম, জ্বী হাঁ। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি এমন এক লোক যে, তোমার মধ্যে এখনও জাহেলিয়াত (অজ্ঞতা) রয়ে গেছে। আমি আরয করলাম, আমি এখন বৃৃদ্ধ হয়ে গেছি, তা সত্ত্বেও আমার মধ্যে জাহেলিয়াত! তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, তারা (খাদেম বা দাস-দাসীরা) তোমাদের ভাইয়ের মত, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। মনে রাখবে, যদি আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের কোন ভাইকে তোমাদের অধীনস্থ করে দেয়, সে যেন নিজে যা খায় তাকেও তা খেতে দেয়, আর সে যা পরিধান করে তাকেও যেন তা পরিধান করতে দেয়। তার উপর এমন কোন কাজ চাপিয়ে দেবে না, যা তার কষ্টের কারণ হয় ও তাকে পরাহত করে। আর যদি এ ধরনের কোন কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়, তাহলে সে যেন তাকে সহযোগিতা করে।( )
ইসলামে কারোর উপর কারো কোন প্রাধান্য নাই একমাত্র প্রাধান্য হল, তাক্বওয়ার ভিত্তিতে। সুতরাং একজন উচ্চ বংশের লোক তার মধ্যে যদি তাক্বওয়া না থাকে, তা হলে তার উচ্চ বংশীয় মর্যাদা কোন কাজে আসবে না। আর একজন লোক সে নিম্ন বংশের, কিন্তু তার মধ্যে তাক্বওয়া আছে, তাহলে সে তার তাক্বওয়ার কারণে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اِنَّا خَلَقْنٰكُمْ مِّنْ ذَكَرٍ وَّ اُنْثٰى وَ جَعَلْنٰكُمْ شُعُوْبًا وَّ قَبَآىٕلَ لِتَعَارَفُوْاؕ -اِنَّ اَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللّٰهِ اَتْقٰىكُمْؕ- اِنَّ اللّٰهَ عَلِیْمٌ خَبِیْرٌ(۱۳)
হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাক্বওয়া সম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত। [সূরা হুজরাত, আয়াত: ১৩] ( )

—০—

অহংকার যাদেরকে হক্ব থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে
এক- ইবলিস
অভিশপ্ত ইবলিসের কুফরি করা ও আল্লাহর আদেশের অবাধ্য হওয়ার একমাত্র কারণ তার অহংকার। আল্লাহ তা‘আলা তার বর্ণনা দিয়ে এরশাদ করেন,
اِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلٰٓىٕكَةِ اِنِّیْ خَالِقٌۢ بَشَرًا مِّنْ طِیْنٍ(۷۱)اِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلٰٓىٕكَةِ اِنِّیْ خَالِقٌۢ بَشَرًا مِّنْ طِیْنٍ(۷۱)فَاِذَا سَوَّیْتُهٗ وَ نَفَخْتُ فِیْهِ مِنْ رُّوْحِیْ فَقَعُوْا لَهٗ سٰجِدِیْنَ(۷۲) فَسَجَدَ الْمَلٰٓىٕكَةُ كُلُّهُمْ اَجْمَعُوْنَۙ (۷۳) اِلَّاۤ اِبْلِیْسَؕ-اِسْتَكْبَرَ وَ كَانَ مِنَ الْكٰفِرِیْنَ(۷۴) قَالَ یٰۤاِبْلِیْسُ مَا مَنَعَكَ اَنْ تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِیَدَیَّؕ-اَسْتَكْبَرْتَ اَمْ كُنْتَ مِنَ الْعَالِیْنَ(۷۵) قَالَ اَنَا خَیْرٌ مِّنْهُؕ-خَلَقْتَنِیْ مِنْ نَّارٍ وَّ خَلَقْتَهٗ مِنْ طِیْنٍ(۷۶) قَالَ فَاخْرُ جْ مِنْهَا فَاِنَّكَ رَجِیْمٌۚۖ (۷۷) وَّ اِنَّ عَلَیْكَ لَعْنَتِیْۤ اِلٰى یَوْمِ الدِّیْنِ(۷۸)قَالَ رَبِّ فَاَنْظِرْنِیْۤ اِلٰى یَوْمِ یُبْعَثُوْنَ(۷۹) قَالَ فَاِنَّكَ مِنَ الْمُنْظَرِیْنَۙ (۸۰) اِلٰى یَوْمِ الْوَقْتِ الْمَعْلُوْمِ(۸۱) قَالَ فَبِعِزَّتِكَ لَاُغْوِیَنَّهُمْ اَجْمَعِیْنَۙ (۸۲) اِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِیْنَ(۸۳) قَالَ فَالْحَقُّ٘-وَالْحَقَّ اَقُوْلُۚ (۸۴) لَاَمْلَــٴَـنَّ جَهَنَّمَ مِنْكَ وَمِمَّنْ تَبِعَكَ مِنْهُمْ اَجْمَعِیْنَ(۸۵) قُلْ مَاۤ اَسْــٴَـلُكُمْ عَلَیْهِ مِنْ اَجْرٍ وَّمَاۤ اَنَا مِنَ الْمُتَكَلِّفِیْنَ(۸۶) اِنْ هُوَ اِلَّا ذِكْرٌ لِّلْعٰلَمِیْنَ(۸۷)
‘স্মরণ কর, যখন তোমার রব ফেরেশতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আমি মাটি হতে মানুষ সৃষ্টি করব। যখন আমি তাকে সুষম করব এবং তার মধ্যে আমার রূহ সঞ্চার করব, তখন তোমরা তার উদ্দেশ্যে সাজদাবনত হয়ে যাও। ফলে ফেরেশতাগণ সকলেই সাজদাবনত হল ইবলীস ছাড়া; সে অহঙ্কার করল এবং কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ল। আল্লাহ বললেন, ‘হে ইবলীস, আমার কুদরতের দু’হাতে আমি যাকে সৃষ্টি করেছি তার প্রতি সাজদাবনত হতে কিসে তোমাকে বাধা দিল? তুমি কি অহঙ্কার করলে, না তুমি অধিকতর উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন? সে বলল, ‘আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন অগ্নি থেকে আর তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে। তিনি বললেন, তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও। কেননা নিশ্চয় তুমি বিতাড়িত। আর নিশ্চয় বিচার দিবস পর্যন্ত তোমার প্রতি আমার লা‘নত বলবৎ থাকবে। সে বলল, ‘হে আমার রব, আমাকে সে দিন পর্যন্ত অবকাশ দিন যেদিন তারা পুনরুত্থিত হবে।’ তিনি বললেন, আচ্ছা তুমি অবকাশপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হলে- ‘নির্ধারিত সময় উপস্থিত হওয়ার দিন পর্যন্ত।’ সে বলল, ‘আপনার ইজ্জতের কসম! আমি তাদের সকলকেই বিপথগামী করে ছাড়ব; তাদের মধ্য থেকে আপনার একনিষ্ঠ বান্দারা ছাড়া।’ আল্লাহ বললেন, ‘এটি সত্য আর সত্য-ই আমি বলি’, তোমাকে দিয়ে এবং তাদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে তাদের দিয়ে নিশ্চয় আমি জাহান্নাম পূর্ণ করব।’ হে হাবীব, বলুন, ‘এর বিনিময়ে আমি তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাই না আর আমি কপট বা বানোয়াটদের অন্তর্ভুক্ত নই। সৃষ্টিকুলের জন্য এ তো উপদেশ ছাড়া আর কিছু নয়। [সূরা সাদ, আয়াত: ৭১-৮৭]

দুই: ফের‘আউন ও তার সম্প্রদায়
অনুরূপভাবে ফের‘আউনের কুফরি করার কারণ ছিল, তার অহংকার। আল্লাহ তা‘আলা তার বর্ণনা দিয়ে এরশাদ করেন,
وَ قَالَ فِرْعَوْنُ یٰۤاَیُّهَا الْمَلَاُ مَا عَلِمْتُ لَكُمْ مِّنْ اِلٰهٍ غَیْرِیْۚ-فَاَوْقِدْ لِیْ یٰهَامٰنُ عَلَى الطِّیْنِ فَاجْعَلْ لِّیْ صَرْحًا لَّعَلِّیْۤ اَطَّلِعُ اِلٰۤى اِلٰهِ مُوْسٰىۙ-وَ اِنِّیْ لَاَظُنُّهٗ مِنَ الْكٰذِبِیْنَ(۳۸(وَ اسْتَكْبَرَ هُوَ وَ جُنُوْدُهٗ فِی الْاَرْضِ بِغَیْرِ الْحَقِّ وَ ظَنُّوْۤا اَنَّهُمْ اِلَیْنَا لَا یُرْجَعُوْنَ(۳۹(فَاَخَذْنٰهُ وَ جُنُوْدَهٗ فَنَبَذْنٰهُمْ فِی الْیَمِّۚ-فَانْظُرْ كَیْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الظّٰلِمِیْنَ(۴۰(وَ جَعَلْنٰهُمْ اَىٕمَّةً یَّدْعُوْنَ اِلَى النَّارِۚ-وَیَوْمَ الْقِیٰمَةِ لَا یُنْصَرُوْنَ(۴۱( وَاَتْبَعْنٰهُمْ فِیْ هٰذِهِ الدُّنْیَا لَعْنَةًۚ- وَیَوْمَ الْقِیٰمَةِ هُمْ مِّنَ الْمَقْبُوْحِیْنَ۠ (۴۲)
আর ফির‘আউন বলল, ‘হে পারিষদবর্গ, আমি ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহ আছে বলে আমি জানি না। অতএব হে হামান, আমার জন্য তুমি ইট পোড়াও, তারপর আমার জন্য একটি প্রাসাদ তৈরী কর। যাতে আমি মূসার ইলাহকে দেখতে পাই। আর নিশ্চয় আমি মনে করি সে মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত’। আর ফির‘আউন ও তার সেনাবাহিনী অন্যায়ভাবে যমীনে অহংকার করেছিল এবং তারা মনে করেছিল যে, তাদেরকে আমার নিকট ফিরিয়ে আনা হবে না। অতঃপর আমি তাকে ও তার সেনাবাহিনীকে পাকড়াও করলাম, তারপর তাদেরকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করলাম। অতএব, দেখ যালিমদের পরিণাম কিরূপ হয়েছিল? আর আমি তাদেরকে নেতা বানিয়েছিলাম, তারা জাহান্নামের দিকে আহ্বান করত এবং কিয়ামতের দিন তাদেরকে কোন প্রকার সাহায্য করা হবে না। এ যমীনে আমি তাদের সাথে অভিসম্পাত লাগিয়ে দিয়েছি আর ক্বিয়ামতের দিন তারা হবে ঘৃণিতদের অন্তর্ভুক্ত। [সূরা কাসাস, আয়াত: ৩৮-৪২]

তিন: হযরত সালেহ আলাইহিস সালামের কওম তথা সামুদ গোত্র
সামুদ গোত্রের কুফরির কারণও একই। অর্থাৎ, তাদের অহংকার। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,
قَالَ الْمَلَاُ الَّذِیْنَ اسْتَكْبَرُوْا مِنْ قَوْمِهٖ لِلَّذِیْنَ اسْتُضْعِفُوْا لِمَنْ اٰمَنَ مِنْهُمْ اَتَعْلَمُوْنَ اَنَّ صٰلِحًا مُّرْسَلٌ مِّنْ رَّبِّهٖؕ-قَالُوْۤا اِنَّا بِمَاۤ اُرْسِلَ بِهٖ مُؤْمِنُوْنَ(۷۵)قَالَ الَّذِیْنَ اسْتَكْبَرُوْۤا اِنَّا بِالَّذِیْۤ اٰمَنْتُمْ بِهٖ كٰفِرُوْنَ(۷۶)
তার কওমের অহঙ্কারী নেতৃবৃন্দ তাদের সেই মুমিনদেরকে বলল যাদেরকে দুর্বল মনে করা হত, ‘তোমরা কি জান যে, সালিহ তার রবের পক্ষ থেকে প্রেরিত’? তারা বলল, ‘নিশ্চয় তিনি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন, আমরা তাতে বিশ্বাসী’। যারা অহংকার করেছিল তারা বলল, ‘নিশ্চয় তোমরা যার প্রতি ঈমান এনেছ, আমরা তাকে অস্বীকারকারী’ [সূরা আরাফ, আয়াত: ৭৫,৭৬]

চার: হযরত হুদ আলাইহিস সালামের কাওম তথা আদ সম্প্রদায়
আল্লাহ তা‘আলা তাদের ঘটনার বিবরণ দিয়ে এরশাদ করেন,
فَاَمَّا عَادٌ فَاسْتَكْبَرُوْا فِی الْاَرْضِ بِغَیْرِ الْحَقِّ وَ قَالُوْا مَنْ اَشَدُّ مِنَّا قُوَّةًؕ-اَوَ لَمْ یَرَوْا اَنَّ اللّٰهَ الَّذِیْ خَلَقَهُمْ هُوَ اَشَدُّ مِنْهُمْ قُوَّةًؕ-وَ كَانُوْا بِاٰیٰتِنَا یَجْحَدُوْنَ(۱۵) فَاَرْسَلْنَا عَلَیْهِمْ رِیْحًا صَرْصَرًا فِیْۤ اَیَّامٍ نَّحِسَاتٍ لِّنُذِیْقَهُمْ عَذَابَ الْخِزْیِ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَاؕ-وَ لَعَذَابُ الْاٰخِرَةِ اَخْزٰى وَ هُمْ لَا یُنْصَرُوْنَ(۱۶)
আর ‘আদ সম্প্রদায়, তারা যমীনে অযথা অহঙ্কার করত এবং বলত, ‘আমাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী কে আছে’? তবে কি তারা লক্ষ্য করেনি যে, নিশ্চয় আল্লাহ যিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী? আর তারা আমার আয়াতগুলোকে অস্বীকার করত। তারপর আমি তাদের উপর অশুভ দিনগুলোতে ঝঞ্ঝাবায়ু পাঠালাম যাতে তাদেরকে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনাদায়ক আযাব আস্বাদন করাতে পারি। আর আখিরাতের আযাব তো অধিকতর লাঞ্ছনাদায়ক এবং তাদেরকে সাহায্য করা হবে না। [সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ১৫-১৬]

পাঁচ: মাদায়েনের অধিবাসী হযরত শুয়াইব আলাইহিস সালামের কওম
আল্লাহ তা‘আলা তাদের ঘটনার বিবরণ দিয়ে এরশাদ করেন,
قَالَ الْمَلَاُ الَّذِیْنَ اسْتَكْبَرُوْا مِنْ قَوْمِهٖ لَنُخْرِجَنَّكَ یٰشُعَیْبُ وَ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا مَعَكَ مِنْ قَرْیَتِنَاۤ اَوْ لَتَعُوْدُنَّ فِیْ مِلَّتِنَاؕ-قَالَ اَوَ لَوْ كُنَّا كٰرِهِیْنَ۫ (۸۸)
তার কওম থেকে যে নেতৃবৃন্দ অহঙ্কার করেছিল তারা বলল, ‘হে শু‘আইব, আমরা তোমাকে ও তোমার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে অবশ্যই আমাদের জনপদ থেকে বের করে দেব অথবা তোমরা আমাদের ধর্মে ফিরে আসবে।’ সে বলল, ‘যদিও আমরা অপছন্দ করি তবুও?’ [সূরা আরাফ, আয়াত: ৮৮]

ছয়: হযরত নূহ আলাইহিস সালামের কওম
আল্লাহ তা‘আলা তাদের ঘটনার বিবরণ দিয়ে এরশাদ করেন,
قَالَ رَبِّ اِنِّیْ دَعَوْتُ قَوْمِیْ لَیْلًا وَّ نَهَارًاۙ (۵) فَلَمْ یَزِدْهُمْ دُعَآءِیْۤ اِلَّا فِرَارًا(۶) وَ اِنِّیْ كُلَّمَا دَعَوْتُهُمْ لِتَغْفِرَ لَهُمْ جَعَلُوْۤا اَصَابِعَهُمْ فِیْۤ اٰذَانِهِمْ وَ اسْتَغْشَوْا ثِیَابَهُمْ وَ اَصَرُّوْا وَ اسْتَكْبَرُوا اسْتِكْبَارًاۚ (۷) ثُمَّ اِنِّیْ دَعَوْتُهُمْ جِهَارًاۙ (۸) ثُمَّ اِنِّیْۤ اَعْلَنْتُ لَهُمْ وَ اَسْرَرْتُ لَهُمْ اِسْرَارًاۙ (۹)
সে বলল, ‘হে আমার রব! আমি তো আমার কওমকে রাত-দিন আহবান করেছি। ‘অতঃপর আমার আহ্বান কেবল তাদের পলায়নই বাড়িয়ে দিয়েছে’। ‘আর যখনই আমি তাদেরকে আহ্বান করেছি ‘যেন আপনি তাদেরকে ক্ষমা করেন’, তারা নিজদের কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়েছে, নিজদেরকে পোশাকে আবৃত করেছে, [অবাধ্যতায়] অনড় থেকেছে এবং দম্ভভরে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছে’। ‘তারপর আমি তাদেরকে প্রকাশ্যে আহবান করেছি’। অতঃপর তাদেরকে আমি প্রকাশ্যে এবং অতি গোপনেও আহ্বান করেছি। [সূরা নুহ, আয়াত: ৫-৯]

সাত. বনী ইসরাঈল
আল্লাহ তা‘আলা তাদের ঘটনার বিবরণ দিয়ে এরশাদ করেন,
وَ لَقَدْ اٰتَیْنَا مُوْسَى الْكِتٰبَ وَ قَفَّیْنَا مِنْۢ بَعْدِهٖ بِالرُّسُلِ٘-وَ اٰتَیْنَا عِیْسَى ابْنَ مَرْیَمَ الْبَیِّنٰتِ وَ اَیَّدْنٰهُ بِرُوْحِ الْقُدُسِؕ-اَفَكُلَّمَا جَآءَكُمْ رَسُوْلٌۢ بِمَا لَا تَهْوٰۤى اَنْفُسُكُمُ اسْتَكْبَرْتُمْۚ-فَفَرِیْقًا كَذَّبْتُمْ٘-وَ فَرِیْقًا تَقْتُلُوْنَ(۸۷) وَ قَالُوْا قُلُوْبُنَا غُلْفٌؕ-بَلْ لَّعَنَهُمُ اللّٰهُ بِكُفْرِهِمْ فَقَلِیْلًا مَّا یُؤْمِنُوْنَ(۸۸)
আর আমি নিশ্চয় মূসাকে কিতাব দিয়েছি এবং তার পরে একের পর এক রাসূল প্রেরণ করেছি এবং মারইয়াম পুত্র ঈসাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ। আর তাকে শক্তিশালী করেছি ‘পবিত্র আত্মা’র মাধ্যমে। তবে কি তোমাদের নিকট যখনই কোন রাসূল এমন কিছু নিয়ে এসেছে, যা তোমাদের মনঃপূত নয়, তখন তোমরা অহঙ্কার করেছ, অতঃপর [নবীদের] একদলকে তোমরা মিথ্যাবাদী বলেছ আর একদলকে হত্যা করেছ। আর তারা বলল, আমাদের অন্তরসমূহ আচ্ছাদিত; বরং তাদের কুফরীর কারণে আল্লাহ তাদেরকে লা‘নত করেছেন। অতঃপর তারা খুব কমই ঈমান আনে। [সূরা বাকারাহ, আয়াত: ৮৭-৮৮]

আট. আরবের মুশরিকরা
আল্লাহ তা‘আলা তাদের ঘটনার বিবরণ দিয়ে এরশাদ করেন,
وَمَاۤ اَرْسَلْنَا قَبْلَكَ مِنَ الْمُرْسَلِیْنَ اِلَّاۤ اِنَّهُمْ لَیَاْكُلُوْنَ الطَّعَامَ وَ یَمْشُوْنَ فِی الْاَسْوَاقِؕ-وَ جَعَلْنَا بَعْضَكُمْ لِبَعْضٍ فِتْنَةًؕ-اَتَصْبِرُوْنَۚ-وَ كَانَ رَبُّكَ بَصِیْرًا۠(۲۰) وَ قَالَ الَّذِیْنَ لَا یَرْجُوْنَ لِقَآءَنَا لَوْ لَاۤ اُنْزِلَ عَلَیْنَا الْمَلٰٓىٕكَةُ اَوْ نَرٰى رَبَّنَاؕ-لَقَدِ اسْتَكْبَرُوْا فِیْۤ اَنْفُسِهِمْ وَ عَتَوْ عُتُوًّا كَبِیْرًا(۲۱)
আর তোমার পূর্বে যত নবী আমি পাঠিয়েছি, তারা সবাই আহার করত এবং হাট-বাজারে চলাফেরা করত। আমি তোমাদের একজনকে অপরজনের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ করেছি। তোমরা কি ধৈর্যধারণ করবে? আর তোমার রব সর্বদ্রষ্টা। আর যারা আমার সাক্ষাৎ প্রত্যাশা করে না, তারা বলে, ‘আমাদের নিকট ফেরেশতা নাযিল হয় না কেন? অথবা আমরা আমাদের রবকে দেখতে পাই না কেন’? অবশ্যই তারা তো তাদের অন্তরে অহঙ্কার পোষণ করেছে এবং তারা গুরুতর সীমালংঘন করেছে। [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ২০-২১]

মানব জীবনে অহংকারের প্রভাব ও পরিণতি
একটি কথা মনে রাখতে হবে, অহংকারের পরিণতি মানবজাতির জন্য খুবই খারাপ ও করুণ। নিম্নে অহংকারের কয়েকটি প্রভাব ও পরিণতি আলোচনা করা হলঃ
এক: ঈমান ও ইবাদতে প্রতিবন্ধকতা
لَنْ یَّسْتَنْكِفَ الْمَسِیْحُ اَنْ یَّكُوْنَ عَبْدًا لِّلّٰهِ وَ لَا الْمَلٰٓىٕكَةُ الْمُقَرَّبُوْنَؕ-وَ مَنْ یَّسْتَنْكِفْ عَنْ عِبَادَتِهٖ وَ یَسْتَكْبِرْ فَسَیَحْشُرُهُمْ اِلَیْهِ جَمِیْعًا(۱۷۲)فَاَمَّا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ فَیُوَفِّیْهِمْ اُجُوْرَهُمْ وَ یَزِیْدُهُمْ مِّنْ فَضْلِهٖۚ-وَ اَمَّا الَّذِیْنَ اسْتَنْكَفُوْا وَ اسْتَكْبَرُوْا فَیُعَذِّبُهُمْ عَذَابًا اَلِیْمًا ﳔ وَّ لَا یَجِدُوْنَ لَهُمْ مِّنْ دُوْنِ اللّٰهِ وَلِیًّا وَّ لَا نَصِیْرًا(۱۷۳)
মাসীহ কখনো আল্লাহর বান্দা হতে [নিজকে] হেয় মনে করে না এবং নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতারাও না। আর যারা তাঁর ইবাদাতকে হেয় জ্ঞান করে এবং অহঙ্কার করে, তবে অচিরেই আল্লাহ তাদের সবাইকে তাঁর নিকট সমবেত করবেন। পক্ষান্তরে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তিনি তাদেরকে তাদের পুরস্কার পরিপূর্ণ দেবেন এবং তাঁর অনুগ্রহে তাদেরকে বাড়িয়ে দেবেন। আর যারা হেয় জ্ঞান করেছে এবং অহঙ্কার করেছে, তিনি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেবেন এবং তারা তাদের জন্য আল্লাহ ছাড়া কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না। [সূরা নিসা, আয়াত: ১৭২, ১৭৩] আল্লাহ তাআলা আরও এরশাদ করেন,
اِنَّ الَّذِیْنَ كَذَّبُوْا بِاٰیٰتِنَا وَ اسْتَكْبَرُوْا عَنْهَا لَا تُفَتَّحُ لَهُمْ اَبْوَابُ السَّمَآءِ وَ لَا یَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ حَتّٰى یَلِجَ الْجَمَلُ فِیْ سَمِّ الْخِیَاطِؕ-وَ كَذٰلِكَ نَجْزِی الْمُجْرِمِیْنَ(۴۰) لَهُمْ مِّنْ جَهَنَّمَ مِهَادٌ وَّ مِنْ فَوْقِهِمْ غَوَاشٍؕ-وَ كَذٰلِكَ نَجْزِی الظّٰلِمِیْنَ(۴۱)
নিশ্চয় যারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে এবং তার ব্যাপারে অহঙ্কার করেছে, তাদের জন্য আসমানের দরজাসমূহ খোলা হবে না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না উট সূঁচের ছিদ্রতে প্রবেশ করে। আর এভাবেই আমি অপরাধীদেরকে প্রতিদান দেই। তাদের জন্য থাকবে জাহান্নামের বিছানা এবং তাদের উপরে থাকবে [আগুনের] আচ্ছাদন। আর এভাবেই আমি যালিমদেরকে প্রতিদান দেই। [সূরা আরাফ, আয়াত: ৪০, ৪১]

দুই: ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করা
লোক্বমান হাকিম তার ছেলেকে যে নসীহত করেন, তা থেকে অহংকারের পরিণতি কী ভয়াবহ তা জানা যায়। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
وَ لَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَ لَا تَمْشِ فِی الْاَرْضِ مَرَحًاؕ-اِنَّ اللّٰهَ لَا یُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُوْرٍۚ(۱۸)
আর তুমি মানুষের দিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। আর যমীনে দম্ভভরে চলাফেরা করো না; নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক, অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না’। [সূরা লোকমান, আয়াত: ১৮] ( )
আল্লাহ তা‘আলা যমিনে বুক ফুলিয়ে হাঁটা ও অহংকার করে চলাচল করা হতে সম্পূর্ণ নিষেধ করেন। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন করীমে এরশাদ করেন,
وَ لَا تَمْشِ فِی الْاَرْضِ مَرَحًاۚ-اِنَّكَ لَنْ تَخْرِقَ الْاَرْضَ وَ لَنْ تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُوْلًا(۳۷)
আর যমীনে বড়াই করে চলো না; তুমি তো কখনো যমিনকে ফাটল ধরাতে পারবে না এবং উচ্চতায় কখনো পাহাড় সমান পৌঁছতে পারবে না।
[সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৩৭] প্রকৃত মুমিনদের গুণ ( )
আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের গুণের বর্ণনা দিয়ে এরশাদ করেন,
وَعِبَادُ الرَّحْمٰنِ الَّذِیْنَ یَمْشُوْنَ عَلَى الْاَرْضِ هَوْنًا وَّ اِذَا خَاطَبَهُمُ الْجٰهِلُوْنَ قَالُوْا سَلٰمًا(۶۳) وَ الَّذِیْنَ یَبِیْتُوْنَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَّ قِیَامًا(۶۴) وَ الَّذِیْنَ یَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا اصْرِفْ عَنَّا عَذَابَ جَهَنَّمَ ﳓ اِنَّ عَذَابَهَا كَانَ غَرَامًاۗۖ(۶۵)
আর দয়াময় আল্লাহর বান্দা তারাই যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং অজ্ঞ লোকেরা যখন তাদেরকে সম্বোধন করে তখন তারা বলে ‘সালাম’। আর যারা তাদের রবের জন্য সাজদারত ও দন্ডায়মান হয়ে রাত্রি যাপন করে। আর যারা বলে, হে আমাদের রব, তুমি আমাদের থেকে জাহান্নামের আযাব ফিরিয়ে নাও। নিশ্চয় এর আযাব হল অবিচ্ছিন্ন’। [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৬৩-৬৫] ( )

তিন: কাপড় পায়ের গোড়ালীর নিচে ঝুলিয়ে পরিধান
অহংকারীদের অভ্যাস হল, তারা তাদের কাপড় পায়ের গোড়ালীর নিচে পরিধান করা। যা থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন।
عَنْ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَا يَنْظُرُ اللهُ إِلَى مَنْ جَرَّ ثَوْبَهُ خُيَلَاءَ.
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তির দিকে তাকাবে না, যে অহংকার করে তার কাপড়কে ঝুলিয়ে পরিধান করে।( )
عن جابر بن سُلَيْمٍ قَال: قُلْتُ اعْهَدْ إِلَيَّ قَالَ لَا تَسُبَّنَّ أَحَدًا قَالَ فَمَا سَبَبْتُ بَعْدَهُ حُرًّا وَلَا عَبْدًا وَلَا بَعِيرًا وَلَا شَاةً قَالَ وَلَا تَحْقِرَنَّ شَيْئًا مِنْ الْمَعْرُوْفِ وَأَنْ تُكَلِّمَ أَخَاكَ وَأَنْتَ مُنْبَسِطٌ إِلَيْهِ وَجْهُكَ إِنَّ ذٰلِكَ مِنْ الْمَعْرُوفِ وَارْفَعْ إِزَارَكَ إِلَى نِصْفِ السَّاقِ فَإِنْ أَبَيْتَ فَإِلَى الْكَعْبَيْنِ وَإِيَّاكَ وَإِسْبَالَ الْإِزَارِ فَإِنَّهَا مِنْ الْمَخِيلَةِ وَإِنَّ اللهَ لَا يُحِبُّ الْمَخِيلَةَ وَإِنْ امْرُؤٌ شَتَمَكَ وَعَيَّرَكَ بِمَا يَعْلَمُ فِيكَ فَلَا تُعَيِّرْهُ بِمَا تَعْلَمُ فِيْهِ فَإِنَّمَا وَبَالُ ذَلِكَ عَلَيْهِ.( )
হযরত জাবের ইবনে সুলাইম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি কি কাজ করবো এবং আমি কি কি কাজ করবো না সে বিষয়ে আপনি আমাকে নসিহত করুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, তুমি কাউকে গালি দিবে না। তিনি বলেন, তারপর থেকে আমি কোন স্বাধীন, গোলাম, উট ও বকরীকে গালি দেইনি। আর কোন ভাল কাজকে তুমি কখনোই ছোট মনে করবে না। তুমি তোমার ভাইয়ের সাথে হাসি মুখে কথা বলবে। মনে রাখবে, এটি অবশ্যই একটি ভালো কাজ। আর তুমি তোমার পরিধেয়কে অর্ধ নলা পর্যন্ত উঠাও, যদি তা সম্ভব না হয়, তবে গোড়ালি পর্যন্ত। পরিধেয়কে গোড়ালির নিচে ঝুলিয়ে পরিধান করা হতে বিরত থাক। কারণ, তা অহংকার। আর আল্লাহ তা‘আলা অহংকারকে পছন্দ করেন না। যদি কোন ব্যক্তি তোমাকে গালি দেয় এমন কোন দোষ উল্লেখ করে যা তোমার মধ্যে আছে, তাহলে তুমি তার মধ্যে বিদ্যমান এমন কোন দোষ যা তুমি জান, তা দিয়ে তাকে দোষারোপ করবে না ও লজ্জা দেবে না। কারণ, তার কর্মের পরিণাম তার উপরই বর্তাবে। ( )

চার: অহংকারীর সম্মানে ছুটাছুটি করা ও দাঁড়িয়ে সম্মান করাকে পছন্দ করা
عَنْ أَبِي مِجْلَزٍ قَالَ خَرَجَ مُعَاوِيَةُ عَلَى ابْنِ الزُّبَيْرِ وَابْنِ عَامِرٍ فَقَامَ ابْنُ عَامِرٍ وَجَلَسَ ابْنُ الزُّبَيْرِ فَقَالَ مُعَاوِيَةُ لِابْنِ عَامِرٍ اجْلِسْ فَإِنِّي سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ مَنْ أَحَبَّ أَنْ يَمْثُلَ لَهُ الرِّجَالُ قِيَامًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنْ النَّارِ( )
আবি মিজলায রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মু‘আবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর ও আব্দুল্লাহ ইবনে আমের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুার দরবারে উপস্থিত হলে আব্দুল্লাহ ইবনে আমের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁর সম্মানে দাঁড়ালেন, আর আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বসা ছিলেন, তিনি দাঁড়াননি। মু‘আবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইবনে আমেরকে বললেন, তুমি বস! আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি পছন্দ করে লোকেরা তাকে দাঁড়িয়ে সম্মান করুক, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে করে নেয়।( )

পাঁচ: অতিরিক্ত কথা বলা
عَنْ جَابِرٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِنَّ مِنْ أَحَبِّكُمْ إِلَيَّ وَأَقْرَبِكُمْ مِنِّي مَجْلِسًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَحَاسِنَكُمْ أَخْلَاقًا، وَإِنَّ أَبْغَضَكُمْ إِلَيَّ وَأَبْعَدَكُمْ مِنِّي مَجْلِسًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ الثَّرْثَارُونَ، وَالْمُتَشَدِّقُونَ، وَالْمُتَفَيْهِقُونَ. ( )
হযরত জাবের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ক্বিয়ামত দিবসে আমার নিকট তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি এবং মজলিসের দিক দিয়ে আমার সর্বাধিক কাছের লোক সে হবে, তোমাদের মধ্যে যার চরিত্র খুব সুন্দর। আর ক্বিয়ামত দিবসে তোমাদের মধ্যে আমার নিকট সর্বাধিক ঘৃণিত ব্যক্তি, মজলিসের দিক দিয়ে আমার থেকে সর্বাধিক দূরের লোক, যে ইচ্ছা করে বেশি কথা বলে, কথার মাধ্যমে মানুষের উপর অহংকার করে এবং যে ব্যক্তি দীর্ঘ কথা বলে অন্যের উপর নিজের ফযিলত বর্ণনা করে। ( )

ছয়: গীবত করা
অহংকারী নিজেকে অনেক বড় করে দেখে, ফলে সে মানুষকে ঘৃণা করে তাদের উপহাস করে এবং তিরস্কার করে। সে এ কথা প্রকাশ করতে চায় যে, নিশ্চয় সে অন্যদের তুলনায় অধিক সম্মানী। আর গীবত, অন্যদের দোষ প্রকাশ, তাদের দুর্বলতা বর্ণনা করা, ঠাট্টা-বিদ্রƒপ, চোগলখোরি করাকে সে তার বড়ত্ব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে।

সাত: গরীব, মিসকিন, অসহায় ও দুর্বল লোকদের সাথে
উঠা বসা করা হতে বিরত থাকা
একজন অহংকারী যাকে ধন-সম্পদ, বংশ মর্যাদা ও সামাজিক অবস্থানের দিক দিয়ে তার থেকে দুর্বল মনে করে, তার সাথে উঠা-বসা করাকে ঘৃণার চোখে দেখে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে অনেক মুশরিকের ইসলামে প্রবেশ না করার কারণও এটি ছিল, তারা যখন দেখত যে, অনেক লোক যারা ইসলামে প্রবেশ করেছে, তারা ধন-সম্পদ, বংশ মর্যাদা ও সামাজিক অবস্থানের দিক দিয়ে তাদের থেকে দুর্বল, তারা যদি ইসলামে প্রবেশ করে তাদেরও তাদের সাথে উঠাবসা করতে হবে, এ আশংকায় তারা ইসলামে প্রবেশ হতে বিরত থাকে।
عَنْ سَعْدٍ قَالَ كُنَّا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سِتَّةَ نَفَرٍ فَقَالَ الْمُشْرِكُونَ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اُطْرُدْ هٰؤُلَاءِ لَا يَجْتَرِئُونَ عَلَيْنَا قَالَ وَكُنْتُ أَنَا وَابْنُ مَسْعُودٍ وَرَجُلٌ مِنْ هُذَيْلٍ وَبِلَالٌ وَرَجُلَانِ لَسْتُ أُسَمِّيْهِمَا فَوَقَعَ فِي نَفْسِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا شَاءَ اللهُ أَنْ يَقَعَ فَحَدَّثَ نَفْسَهٗ فَأَنْزَلَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ وَلَا تَطْرُدْ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ. ( )
হযরত সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা ছয় ব্যক্তি (হযরত সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হযরত সুহাইব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হযরত বিলাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত খাব্বাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এবং তাদের ছাড়াও আরও দুই জন যাদের নাম আমি জানিনা।) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসে উপস্থিত ছিলাম, তখন মুশরিকরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলল, ‘‘তাদেরকে দূরে সরিয়ে দিন, যাতে তারা আমাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার না করে। তাদের কথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্তরে যা জাগার জন্য আল্লাহ চাইলেন, তা জাগল এবং তিনি মনে মনে কী করবেন তা ভাবছিলেন। সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন,
وَلَا تَطْرُدِ الَّذِیْنَ یَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَدٰوةِ وَ الْعَشِیِّ یُرِیْدُوْنَ وَجْهَهٗؕ-مَا عَلَیْكَ مِنْ حِسَابِهِمْ مِّنْ شَیْءٍ وَّمَا مِنْ حِسَابِكَ عَلَیْهِمْ مِّنْ شَیْءٍ فَتَطْرُدَهُمْ فَتَكُوْنَ مِنَ الظّٰلِمِیْنَ(۵۲)
আর আপনি তাড়িয়ে দেবেন না তাদেরকে, যারা নিজ রবকে সকাল সন্ধ্যায় ডাকে, তারা তার সন্তুষ্টি চায়। তাদের কোন হিসাব আপনার উপর নেই এবং আপনার কোন হিসাব তাদের উপর নেই যে, আপনি তাদেরকে তাড়িয়ে দেবেন, এরূপ করলে আপনি ইনসাফবহির্ভূত হবেন। [আল-আন’আম: ৫২] ( )
অতঃপর আল্লাহ এরশাদ করেন,
وَاِذَا جَآءَكَ الَّذِیْنَ یُؤْمِنُوْنَ بِاٰیٰتِنَا فَقُلْ سَلٰمٌ عَلَیْكُمْ كَتَبَ رَبُّكُمْ عَلٰى نَفْسِهِ الرَّحْمَةَۙ-اَنَّهٗ مَنْ عَمِلَ مِنْكُمْ سُوْٓءًۢا بِجَهَالَةٍ ثُمَّ تَابَ مِنْۢ بَعْدِهٖ وَ اَصْلَحَ فَاَنَّهٗ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ(۵۴)
আর যারা আমার আয়াতসমূহের উপর ঈমান আনে, তারা যখন তোমার কাছে আসে, তখন তুমি বল, ‘তোমাদের উপর সালাম’। তোমাদের রব তাঁর নিজের উপর লিখে নিয়েছেন দয়া, নিশ্চয় যে তোমাদের মধ্য থেকে না জেনে খারাপ কাজ করে তারপর তাওবা করে এবং শুধরে নেয়, তবে তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। [সূরা আনআম, আয়াত: ৫৪] ( )
তারপর আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন,
وَ اصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِیْنَ یَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَدٰوةِ وَ الْعَشِیِّ یُرِیْدُوْنَ وَجْهَهٗ وَ لَا تَعْدُ عَیْنٰكَ عَنْهُمْۚ-تُرِیْدُ زِیْنَةَ الْحَیٰوةِ الدُّنْیَاۚ-وَ لَا تُطِعْ مَنْ اَغْفَلْنَا قَلْبَهٗ عَنْ ذِكْرِنَا وَ اتَّبَعَ هَوٰىهُ وَ كَانَ اَمْرُهٗ فُرُطًا(۲۸)
আর তুমি নিজকে ধৈর্যশীল রাখ তাদের সাথে, যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের রবকে ডাকে, তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশে এবং দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তোমার দু’চোখ যেন তাদের থেকে ঘুরে না যায়। আর ওই ব্যক্তির আনুগত্য করো না, যার অন্তরকে আমি আমার যিক্র থেকে গাফেল করে দিয়েছি এবং যে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে এবং যার কর্ম বিনষ্ট হয়েছে। [সূরা কাহাফ, আয়াত: ২৮]( )

আট. নিকৃষ্ট ও দূষণীয় কাজের উপর অটুট থাকা
অহংকারী কখনো তার নিজের সংশোধন ও তার দোষের চিকিৎসা বিষয়ে চিন্তা করে না; কারণ, সে মনে করে তার চেয়ে নির্দোষ, নিরপরাধ ও নির্ভেজাল ব্যক্তি আর কেউ হতেই পারে না এবং সে পরিপূর্ণ ও কামিল ব্যক্তি। ফলে তার মধ্যে কোন দোষ থাকতে পারে, তা কখনো সে চিন্তাও করে না এবং কারো কোন উপদেশও সে শুনে না। যার ফলে সে তার অহংকারের মধ্যে আজীবন ডুবে থাকে। তাকে দূষনীয় গুণ ও কু অভ্যাস নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়। শেষ পর্যন্ত মৃত্যু এসে যায় এবং তার হায়াত শেষ হয়ে যায়। অবশেষে তার অবস্থা তাদের মত হয়, যাদের বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْاَخْسَرِیْنَ اَعْمَالًاؕ (۱۰۳)اَلَّذِیْنَ ضَلَّ سَعْیُهُمْ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ هُمْ یَحْسَبُوْنَ اَنَّهُمْ یُحْسِنُوْنَ صُنْعًا(۱۰۴)
বল, ‘আমি কি তোমাদেরকে এমন লোকদের কথা জানাব, যারা আমলের দিক থেকে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত’? দুনিয়ার জীবনে যাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে, অথচ তারা মনে করছে যে, তারা ভাল কাজই করছে’! [সূরা আল-কাহাফ, আয়াত: ১০৩-১০৪]

নয়: কারো উপদেশ গ্রহণ না করা
অহংকারী ব্যক্তি কখনো কারো উপদেশ গ্রহণ করে না। সে নিজেকে মনে করে আমিতো সবজান্তা ব্যক্তি আমার থেকে বড় আর কে হতে পারে যে, আমাকে উপদেশ দেবে? এছাড়াও সে কিভাবে মানুষের উপদেশ গ্রহণ করবে? সে নিজেই মানুষকে উপদেশ দিয়ে বেড়ায়। এ ধরনের অহংকারীদের বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
وَ اِذَا قِیْلَ لَهُ اتَّقِ اللّٰهَ اَخَذَتْهُ الْعِزَّةُ بِالْاِثْمِ فَحَسْبُهٗ جَهَنَّمُؕ-وَ لَبِئْسَ الْمِهَادُ(۲۰۶)
আর যখন তাকে বলা হয়, ‘আল্লাহকে ভয় কর’ তখন আত্মাভিমান তাকে পাপ করতে উৎসাহ দেয়। সুতরাং জাহান্নাম তার জন্য যথেষ্ট এবং তা কতই না মন্দ ঠিকানা। [সূরা বাকারা, আয়াত: ২০৬]

দশ: জ্ঞান অর্জনে বাধা
অহংকারী ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন হতে বঞ্চিত হয়। সে তার অহংকারের কারণে পড়া লেখা করতে পারে না। সে মনে করে আমিতো সব জানি তাহলে আমাকে আবার পড়তে হবে কেন? আল্লামা মুজাহিদ বলেন, “অহংকারী ও লজ্জিত লোক কখনোই জ্ঞান অর্জন করতে পারে না।” ( )
একজন অহংকারীকে তার অহংকার সব সময় তাকে বড় করে দেখায় ও সে নিজেকে সবার ঊর্ধ্বে মনে করে। ফলে সে অন্যের নিকট থেকে কোন ইলম, জ্ঞান, হিকমত, অভিজ্ঞতা ও উপদেশ শিখতে রাজি না। তাই আজীবন সে অজ্ঞ, অনভিজ্ঞ, মূর্খ ও জাহিল হয়েই বেঁচে থাকে।

এগার. সালাম থেকে বিরত থাকা
একজন অহংকারীকে যখন কেউ সালাম দেয় তখন সে চিন্তা করে, আমিতো অনেক বড় হয়ে গেছি। তার মত কোন লোকই হয় না। তার উপর কারো কোন অধিকার বা পাওনা নাই, সেই শুধু মানুষের নিকট পায়। মানুষ তার কাছে কৃতজ্ঞ সে কারো কাছে কৃতজ্ঞ নয়। কাউকে সে তার চেয়ে উত্তম মনে করে না, বরং সেই সবার থেকে উত্তম। এ ধরনের ধ্যান-ধারণার ফলে সে কারো জন্য নত হয় না, সে প্রতিদিনই আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরতে থাকে। আর মানুষের নিকট ঘৃণার পাত্র ও নিকৃষ্ট মানুষ বলে গণ্য হয়।[ আর-রুহ ২৩৬]

বার: সবার অগ্রভাগে থাকতে চাওয়া
একজন অহংকারী হাঁটার সময় তার সামনে কেউ হাঁটুক তা সে পছন্দ করে না। নিজেই আগে আগে হাঁটতে পছন্দ করে। আর কোন মজলিসে উপস্থিত হলে অহংকারী সব সময় মজলিসের সামনে বসতে পছন্দ করে। সবার পরে এসে সামনে চলে যায়, পিছনে বসে না। মানুষের মধ্যে সুনাম-সুখ্যাতি ও প্রসিদ্ধি অর্জন করতে পছন্দ করে। কিন্তু একজন বিনয়ী কখনোই এ গুলো পছন্দ করে না। সে এসব থেকে পলায়ন করে।
عَنْ عَامِرِ بْنُ سَعْدٍ، قَالَ كَانَ سَعْدُ بْنُ أَبِي وَقَّاصٍ فِي إِبِلِه فَجَاءَهُ ابْنُهٗ عُمَرُ فَلَمَّا رَاٰهُ سَعْدٌ قَالَ أَعُوْذُ بِاللهِ مِنْ شَرِّ هَذَا الرَّاكِبِ فَنَزَلَ فَقَالَ لَهٗ أَنَزَلْتَ فِي إِبِلِكَ وَغَنَمِكَ وَتَرَكْتَ النَّاسَ يَتَنَازَعُوْنَ الْمُلْكَ بَيْنَهُمْ فَضَرَبَ سَعْدٌ فِي صَدْرِه فَقَالَ اسْكُتْ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ‏ “إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْعَبْدَ التَّقِيَّ الْغَنِيَّ الْخَفِيَّ ‏”( )
আমের ইবনে সা’দ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা হযরত সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু স্বীয় উটে সাওয়ার ছিলেন, তাকে দেখে তার ছেলে ওমর সামনে অগ্রসর হল। সা’দ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাকে দেখে বললেন, এ আরোহণকারীর অনিষ্টতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি। তারপর তিনি নিচে অবতরণ করলে তাকে বলা হল, তুমি তোমার উট ও ছাগল নিয়ে ব্যস্ত হলে, অথচ লোকেরা পরস্পর বাদশাহী নিয়ে বিবাদ করছে। এ কথা শোনে হযরত সা’দ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তার বাহুতে আঘাত করে বললেন, তুমি চুপ কর! আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা‘আলা মুত্তাক্বী, দুনিয়া ও জনবিমূখকে অধিক পছন্দ করেন।( )
—০—

অহংকারীর পরিণতি ও শাস্তি
দুনিয়াতে অহংকারের পরিণতি হ’ল লাঞ্ছনা। আর আখেরাতে এর পরিণতি হ’ল ‘ত্বীনাতুল খাবাল’ অর্থাৎ জাহান্নামীদের পুঁজ-রক্ত পান করা। যার অন্তরে যতটুকু অহংকার সৃষ্টি হবে, তার জ্ঞান ততটুকু হ্রাস পাবে। যদি কারও অন্তরে অহংকার স্থিতি লাভ করে, তবে তার জ্ঞানচক্ষু অন্ধ হয়ে যায়। বোধশক্তি লোপ পায়। সে অন্যের চাইতে নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। কাম্য সম্মান না পেলে সে মনোকষ্টে মরতে বসে। তার চেহারায় ও আচরণে, যবানে ও কর্মে কেবলই অহংকারের দুর্গন্ধ বের হ’তে থাকে। ফলে মানুষ তার নিকট থেকে সরে পড়ে। এক সময় সে নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। একাকীত্বের যন্ত্রণায় সে ছটফট করতে থাকে। কিন্তু বাইরে ঠাট বজায় রাখে। এভাবেই সে দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে যায়। বদরের যুদ্ধে আবু জাহল মরার সময় বলেছিল,
فَقَالَ: وَهَلْ فَوْقَ رَجُلٍ قَتَلْتُمُوهُ – أَو قَالَ: قَتَلَهُ قَوْمُهُ، قَالَ: وَقَالَ أَبُو مِجْلَزٍ: قَالَ أَبُو جَهْلٍ: فَلَوْ غَيْرُ أَكَّارٍ قَتَلَنِي.( )
‘আমার চাইতে বড় কোন মানুষকে তোমরা হত্যা করেছ কি’? অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘মদীনার ঐ চাষীরা ব্যতীত যদি অন্য কেউ আমাকে হত্যা করত’? ( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ الْجَنَّةِ كُلُّ ضَعِيفٍ مُتَضَعِّفٍ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللهِ لَأَبَرَّهُ، أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ النَّارِ كُلُّ عُتُلٍّ جَوَّاظٍ مُسْتَكْبِرٍ.
‘আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতীদের বিষয়ে খবর দেব না? তারা হ’ল দুর্বল এবং যাদেরকে লোকেরা দুর্বল ভাবে। কিন্তু তারা যদি আল্লাহর নামে কসম দিয়ে কিছু বলে, আল্লাহ তা অবশ্যই কবুল ও বাস্তবায়ন করেন। অতঃপর তিনি বলেন, আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামীদের বিষয়ে খবর দেব না? তারা হল বাতিল কথার উপর ঝগড়াকারী, হঠকারী ও অহংকারী’।( )
অর্থাৎ হকপন্থী মু’মিনগণ দুনিয়াবী দৃষ্টিতে দুর্বল হ’লেও আল্লাহর দৃষ্টিতে সবচেয়ে সবল। কেননা তাদের দো‘আ দ্রুত কবুল হয় এবং আল্লাহর গযবে অহংকারী ধ্বংস হয়।
পবিত্র ক্বোরআনে জাহান্নামীদের প্রধান দোষ হিসাবে তাদের অহংকারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ এরশাদ করেন,
وَسِيقَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِلَى جَهَنَّمَ زُمَرًا حَتَّى إِذَا جَاءُوهَا فُتِحَتْ أَبْوَابُهَا وَقَالَ لَهُمْ خَزَنَتُهَا أَلَمْ يَأْتِكُمْ رُسُلٌ مِّنكُمْ يَتْلُونَ عَلَيْكُمْ اٰيَاتِ رَبِّكُمْ وَيُنذِرُونَكُمْ لِقَاءَ يَوْمِكُمْ هَـذَا قَالُوا بَلٰى وَلَـكِنْ حَقَّتْ كَلِمَةُ الْعَذَابِ عَلَى الْكَافِرِينَ ﴿٧١﴾ قِيلَ ادْخُلُوا أَبْوَابَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا فَبِئْسَ مَثْوَى الْمُتَكَبِّرِينَ.
কাফিরদেরকে জাহান্নামের দিকে দলে দলে হাঁকিয়ে নেয়া হবে। তারা যখন সেখানে পৌঁছাবে, তখন সেটার দরজাসমূহ খুলে দেয়া হবে এবং জাহান্নামের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকে পয়গম্বর আসেননি, যাঁরা তোমাদের কাছে তোমাদের পালনকর্তার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করতেন এবং সতর্ক করতেন এ দিনের সাক্ষাতের ব্যাপারে? তারা বলবে, হ্যাঁ, কিন্তু কাফিরদের প্রতি শাস্তির হুকুমই বাস্তবায়িত হয়েছে। বলা হবে, তোমরা জাহান্নামের দরজা দিয়ে প্রবেশ কর, সেখানে চিরকাল অবস্থানের জন্যে। কত নিকৃষ্ট অহংকারীদের আবাসস্থল। (যুমার ৩৯/৭১-৭২)।
এখানে কাফিরদের বাসস্থান না বলে ‘অহংকারীদের বাসস্থান’ বলা হয়েছে। কেননা কাফিরদের কুফরীর মূল কারণ হল তাদের সত্য প্রত্যাখ্যানের দম্ভ ও অহংকার। তাই অহংকারীকে আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই শাস্তি দেবেন। আল্লাহ তা‘আলা তার শাস্তি দুনিয়াতেও দেবেন এবং আখেরাতেও দেবেন।
—০—

দুনিয়াতে অহংকারীর শাস্তি
আল্লাহ তাআ’লা অহংকারের শাস্তি শুধুমাত্র আখেরাতে নয় দুনিয়াতেও দিয়ে থাকেন। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আগেকার অনেক জাতি ধন-সম্পদ ও শাসনক্ষমতা নিয়ে অহংকার ও বাড়াবাড়ি করার কারণে আল্লাহ তাআ’লা দুনিয়াতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করেছেন। এ প্রসঙ্গে কোরআনে ইরশাদ হয়েছে,
وَكَمْ أَهْلَكْنَا مِن قَرْيَةٍ بَطِرَتْ مَعِيشَتَهَا فَتِلْكَ مَسَاكِنُهُمْ لَمْ تُسْكَن مِّن بَعْدِهِمْ إِلاَّ قَلِيلا وَكُنَّا نَحْنُ الْوَارِثِينَ
‘এমন কত জনপদ আমি ধ্বংস করে দিয়েছি, সেখানকার লোকেরা ধন-সম্পদের অহংকার করত। এই যে তাদের বাড়িঘর পড়ে আছে, যেখানে তাদের পর কম লোকই বসবাস করেছে। শেষ পর্যন্ত আমি (এ সবেরই) মালিক হয়েছি।’ [সুরা আল কাসাস: ৫৮] প্রকৃত মু’মিন ব্যক্তি যে কোনো অবস্থায় গর্ব ও অহংকার পরিত্যাগ করবে। তাদের কথা, কাজ ও আচরণে কখনো অহংকার নয় বরং বিনয় প্রকাশ পাবে। মু’মিনদের উদ্দেশে ক্বোরআনুল করীমে আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا ۖ إِنَّكَ لَن تَخْرِقَ الْأَرْضَ وَلَن تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُولًا
‘মাটির বুকে গর্বের সঙ্গে চলবে না। নিশ্চয়ই তুমি কখনো পদচাপে জমিনকে বিদীর্ণ করতে পারবে না। আর পাহাড়ের সমান উঁচুও হতে পারবে না।’
[সুরা বনি ইসরাইল: ৩৭] অতীতে যারাই আল্লাহর জমিনের ওপর দম্ভ করে চলাফেরা করেছে, তাদের সবাই ধ্বংস হয়েছে। ক্বোরআন ও হাদীসে পূর্ববর্তী বিভিন্ন সম্প্রদায় ধ্বংসের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। পূর্ববর্তী অনেক শাসক ও ক্ষমতাধররা অহংকার করায় আল্লাহ তাদের সমুচিত শিক্ষা দিয়েছেন। তাদের এসব করুণ পরিণতির ইতিহাস বিশ্ববাসীর জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। তাইতো ফেরাউন, কারূন ও নমরুদের মতো নামগুলোকে আজও মানুষ ঘৃণাভরে স্মরণ করে। দুনিয়াতে অহংকারীর শাস্তিগুলোর মধ্যে হলঃ

১. ঘৃণা ও অপমান
একজন অহংকারীকে তার চাহিদার বিপরীত দান করার মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হয়। যেমন, সে মানুষের নিকট চায় সম্মান কিন্তু মানুষ তাকে বিপরীতটি উপহার দেয় তথা ঘৃণা। অহংকারীকে লোকেরা নিকৃষ্ট মানুষ মনে করে এবং ঘৃণা করে। এটি হল, একজন অহংকারীর জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে বিশেষ শাস্তি।
দুনিয়ার চিরন্তন নিয়মই হল, অহংকারীকে কেউ ভালো চোখে দেখে না, সবাই তাকে ঘৃণা করে। আর যে ব্যক্তি অহংকার করে, নিজেকে বড় মনে করে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ছোট করে, আর যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য বিনয় ও নম্রতা অবলম্বন করে, আল্লাহ তা‘আলা তার মর্যাদাকে বৃদ্ধি করে। আর যে ব্যক্তি হকের বিপক্ষে বড়াই করে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে অসম্মান ও অপমান করে।

২. উপদেশ উপেক্ষা
চিন্তা-ফিকির, উপদেশ গ্রহণ করা ও আল্লাহর আয়াতসমূহ হতে নছিহত অর্জন করা হতে একজন অহংকারী বঞ্চিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
سَاَصْرِفُ عَنْ اٰیٰتِیَ الَّذِیْنَ یَتَكَبَّرُوْنَ فِی الْاَرْضِ بِغَیْرِ الْحَقِّؕ-وَ اِنْ یَّرَوْا كُلَّ اٰیَةٍ لَّا یُؤْمِنُوْا بِهَاۚ-وَ اِنْ یَّرَوْا سَبِیْلَ الرُّشْدِ لَا یَتَّخِذُوْهُ سَبِیْلًاۚ-وَ اِنْ یَّرَوْا سَبِیْلَ الْغَیِّ یَتَّخِذُوْهُ سَبِیْلًاؕ-ذٰلِكَ بِاَنَّهُمْ كَذَّبُوْا بِاٰیٰتِنَا وَ كَانُوْا عَنْهَا غٰفِلِیْنَ(۱۴۶)
যারা অন্যায়ভাবে যমীনে অহঙ্কার করে আমার আয়াতসমূহ থেকে তাদেরকে আমি অবশ্যই ফিরিয়ে রাখব। আর তারা সকল আয়াত দেখলেও তাতে ঈমান আনবে না এবং তারা সঠিক পথ দেখলেও তাকে পথ হিসাবে গ্রহণ করবে না। আর তারা ভ্রান্ত পথ দেখলে তা পথ হিসাবে গ্রহণ করবে। এটা এ জন্য যে, তারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে এবং সে সম্পর্কে তারা ছিল গাফেল। [সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ১৪৬] ( )

৩. বিপদ আসা
দুনিয়াতে তাদের নানা শাস্তি দেয়া হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অহংকারীদের দুনিয়াতে শাস্তির ঘোষণা দিয়ে এরশাদ করেন,
عن سَلَمَة بنِ الأَكْوع رضيَ الله عنه قَالَ: قَالَ رسُولُ الله صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم: “لاَ يزَالُ الرَّجُلُ يَذْهَبُ بِنفْسِهِ حَتَّى يُكْتَبَ في الجَبَّارينَ، فَيُصِيبُهُ مَا أَصابَهمْ”
একজন মানুষ সর্বদা অহংকার করতে থাকে। অত:পর একটি সময় আসে তখন তার নাম জাব্বারিন তথা অহংকারীদের খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়, তখন তাকে এমন আযাব আক্রান্ত বা গ্রাস করে, যা অহংকারীদের গ্রাস করেছিল। ( )

চার. নি’মাত ছিনিয়ে নেয়া
অহংকার নি’মাতসমূহ ছিনিয়ে নেয়া ও আল্লাহর আযাব অবতীর্ণ হওয়ার কারণ হয়ে থাকে।
عَنْ عِكْرِمَةَ بْنِ عَمَّارٍ، حَدَّثَنِي إِيَاسُ بْنُ سَلَمَةَ بْنِ الْأَكْوَعِ، أَنَّ أَبَاهُ، حَدَّثَهُ أَنَّ رَجُلًا أَكَلَ عِنْدَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِشِمَالِهِ، فَقَالَ: كُلْ بِيَمِينِكَ، قَالَ: لَا أَسْتَطِيعُ، قَالَ: لَا اسْتَطَعْتَ، مَا مَنَعَهُ إِلَّا الْكِبْرُ، قَالَ: فَمَا رَفَعَهَا إِلَى فِيهِ( )
হযরত সালামাহ ইবনুল আক্ওয়া’ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন এক লোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে বাম হাত দিয়ে খাওয়া শুরু করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি ডান হাত দিয়ে খাও। উত্তরে লোকটি বলল, আমি পারছিনা! তার কথার প্রেক্ষাপটে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি পারবেও না? মূলত: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথার অনুকরণ করা হতে তাকে তার অহংকারই বিরত রাখে। বর্ণনাকারী বলেন, লোকটি আর কখনোই তার হাতকে তার মুখ পর্যন্ত উঠাতে পারেনি।( )

৫. অহংকার জমি ধ্বস ও কবর আযাবের কারণ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অহংকারীদের দুনিয়াতে শাস্তির ঘোষণা দিয়ে এরশাদ করেন,
عن أبي هريرة رضيَ اللَّه عنه قَالَ: قَالَ رسُولُ الله صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم: بَيْنَمَا رَجُلٌ مِمنّْ كَانَ قَبْلكُمْ يمْشِي فِي حُلَّةٍ تُعْجُبهُ نَفْسُهُ، مُرَجِّلٌ جُمتَهُ، إذِ خَسَفَ الله بهِ الْأرَض فَهُو يَتَجْلَجُل فيِهَا إلِى يَوم الْقِيَاَمِة
হযরত আবূ হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, তোমাদের পূর্বের যুগের এক লোক একটি কাপড় ও লুঙ্গি পরিধান করে ও তার চুলগুলো তার কাঁধের উপর ঝুলিয়ে অহংকার করে হাঁটছিল। কাপড়দ্বয় লোকটিকে অহংকারের দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহ তাআলার নির্দেশে হঠাৎ ভূমি তাকে গ্রাস করে ফেলল । যমিন তার অভ্যন্তরে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত লোকটিকে পুঁততে থাকবে। আর সে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত এ দিক সেদিক নড়াচড়া করতে থাকবে।( )

পরকালে অহংকারের শাস্তি
অহংকারীর সর্বশেষ পরিণতি হলো জাহান্নাম। কেননা সে অহংকারের মাধ্যমে আল্লাহ তাআ’লার অধীনতা থেকে নিজেকে মুক্ত করে বেপরোয়া হয়ে যায়। নিজকে অনেক বড় ও ক্ষমতাবান এবং শক্তিশালী মনে করে এবং মানুষকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। গর্ব ও অহংকার একমাত্র আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য।

এক. অহংকারী ধ্বংসপ্রাপ্ত লোকদের সাথে ধ্বংস হবে
عن فضالة بن عبيد قال: قال النبي صلى الله عليه و سلم ثلاَثةٌ لا تَسْأل عَنْهُمْ: رَجٌل يُناَزِعُ الله فِي كبِريَاءِهِ، فَإنَ رِدَاءَه الْكبِريَاءُ، وَإزارهُ الِعَّزُة، وَرُجلٌ يَشُك فِي أَمْرِ الله، وَالْقَنُوطُ مِنْ رَحَمةِ الله
হযরত ফাদ্বালা ইবনে উবাইদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, তিন ব্যক্তির পরিণতি সম্পর্কে তোমরা আমাকে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করবে না।
এক, যে ব্যক্তি আল্লাহর বড়ত্ব নিয়ে আল্লাহর সাথে ঝগড়া করে। কারণ, বড়ত্ব হল আল্লাহর কুদরতের চাদর আর তার পরিধেয় হল ইজ্জত।
দুই, যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধানের বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করে।
তিন, যে ব্যক্তি আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়।( )

দুই. অহংকারীরা কিয়ামত দিবসে সবচেয়ে বেশী ঘৃণিত
অহংকারীরা কিয়ামত দিবসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সবচেয়ে ঘৃণিত ও অবস্থানের দিক দিয়ে অনেক দূরে হবে।
عَنْ جَابِرٍ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِنَّ مِنْ أَحَبِّكُمْ إِلَيَّ وَأَقْرَبِكُمْ مِنِّي مَجْلِسًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَحَاسِنَكُمْ أَخْلَاقًا، وَإِنَّ أَبْغَضَكُمْ إِلَيَّ وَأَبْعَدَكُمْ مِنِّي مَجْلِسًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ الثَّرْثَارُونَ، وَالْمُتَشَدِّقُونَ، وَالْمُتَفَيْهِقُونَ( )
হযরত জাবের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ক্বিয়ামত দিবসে আমার নিকট তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি এবং মজলিসের দিক দিয়ে আমার সর্বাধিক কাছের লোক সে হবে, তোমাদের মধ্যে যার চরিত্র খুব সুন্দর। আর কিয়ামত দিবসে তোমাদের মধ্যে আমার নিকট সর্বাধিক ঘৃণিত ব্যক্তি, মজলিসের দিক দিয়ে আমার থেকে সর্বাধিক দুরের লোক, যে ইচ্ছা করে বেশি কথা বলে, কথার মাধ্যমে মানুষের উপর অহংকার করে এবং যে ব্যক্তি দীর্ঘ কথা বলে অন্যের উপর নিজের ফযিলত বর্ণনা করে। ( )

তিন. অহংকারীর উপর আল্লাহ তা‘আলা ক্ষুব্ধ
অহংকারীরা আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে, যে অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা তার উপর ক্ষুব্ধ:
حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ إِسْحَاقَ أَخْبَرَنَا يُونُسُ بْنُ الْقَاسِمِ الْحَنَفِيُّ يَمَامِيٌّ سَمِعْتُ عِكْرِمَةَ بْنَ خَالِدٍ الْمَخْزُومِيَّ يَقُولُ سَمِعْتُ ابْنَ عُمَرَ رضيَ الله عنه يَقُولُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: مَنْ تَعَظَّمَ فِي نَفْسِهِ أَوْ اخْتَالَ فِي مِشْيَتِهِ لَقِيَ اللهَ وَهُوَ عَلَيْهِ غَضْبَانُ( )
অর্থ, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি মনে মনে নিজেকে বড় মনে করে এবং হাঁটার সময় অহংকার করে, সে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে যে অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা তার উপর রাগান্বিত।( )

চার. ক্বিয়ামতের দিন অপমান ও অপদস্থ হবে
অহংকারীদের আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন অত্যন্ত অপমান ও অপদস্ত করে একত্রীত করবেন:
قَالَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يُحْشَرُ المُتَكَبِّرُونَ يَوْمَ القِيَامَةِ أَمْثَالَ الذَّرِّ فِي صُوَرِ الرِّجَالِ يَغْشَاهُمُ الذُّلُّ مِنْ كُلِّ مَكَانٍ، فَيُسَاقُونَ إِلَى سِجْنٍ فِي جَهَنَّمَ يُسَمَّى بُولَسَ تَعْلُوهُمْ نَارُ الأَنْيَارِ يُسْقَوْنَ مِنْ عُصَارَةِ أَهْلِ النَّارِ طِينَةَ الخَبَالِ: هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ( )
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, অহংকারীদের কিয়ামতের দিন মানুষের আকৃতিতে ছোট ছোট পিপড়ার মত করে একত্র করা হবে। অপমান অপদস্থ সব দিক থেকে তাকে গ্রাস করে ফেলবে। তারপর তাকে জাহান্নামের মধ্যে একটি জেলখানা যার নাম ‘বুলাস’ তার দিকে টেনে হেঁচড়ে নেয়া হবে। তাদেরকে জাহান্নামের প্রজ্বলিত আগুন চতুর্দিক থেকে গ্রাস করে ফেলবে। আর জাহান্নামীদের পিত্ত, পুঁজ ও বমি তাদেরকে পানীয় হিসাবে দেয়া হবে।( )

পাঁচ. অহংকার জান্নাতে প্রবেশের প্রতিবন্ধক
عن عبد الله بن مسعود رضيَ الله عنه، عن النبي صلى الله عليه و سلم قال: لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ في قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ قَالَ رَجُلٌ: إِنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ أَنْ يَكُونَ ثَوْبُهُ حَسَناً، ونَعْلُهُ حَسَنَةً، قَالَ: إِنَّ اللهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمالَ، الْكِبْرُ: بَطَرُ الْحَقِّ، وَغَمْطُ النَّاسِ.
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাস্উদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যার অন্তরে একটি অণু পরিমাণ অহংকার থাকে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা বললে, এক লোক দাঁড়িয়ে আরয করল, কোন কোন লোক এমন আছে, সে সুন্দর কাপড় পরিধান করতে পছন্দ করে, সুন্দর জুতা পরিধান করতে পছন্দ করে, এসবকে কি অহংকার বলা হবে? উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ তা‘আলা নিজেই সুন্দর, তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন। [সুন্দর কাপড় পরিধান করা অহংকার নয়] অহংকার হল, সত্যকে গোপন করা এবং মানুষকে নিকৃষ্ট বলে জানা।( )

ছয়. অহংকারীদের জন্য জাহান্নাম
حَدَّثَنَا أَبُو نُعَيْمٍ، حَدَّثَنَا سُفْيَانُ، عَنْ مَعْبَدِ بْنِ خَالِدٍ، قَالَ: سَمِعْتُ حَارِثَةَ بْنَ وَهْبٍ الخُزَاعِيَّ، قَالَ: سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ الجَنَّةِ ؟ كُلُّ ضَعِيفٍ مُتَضَعِّفٍ، لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللهِ لَأَبَرَّهُ، أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ النَّارِ: كُلُّ عُتُلٍّ، جَوَّاظٍ مُسْتَكْبِرٍ( )
হারেসা ইবনে ওহাব আল খুযায়ী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আমি তোমাদের থেকে কারা জান্নাতি তাদের বিষয়ে খবর দিব কি? তারা হল সব দুর্বল ও অসহায় লোকেরা তারা যদি আল্লাহর শপথ করে আল্লাহ তা‘আলা শপথ পূর্ণ করেন এবং তাদের দায় মুক্ত করে। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, আমি কি তোমাদের কারা জাহান্নামে যাবে তাদের বিষয়ে খবর দিব? তারা হল, সব অহংকারী, দাম্ভিক ও হঠকারী লোকেরা।( )
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم:احْتَجَّتِ النَّارُ وَالْجَنَّةُ فَقَالَتْ هَذِهِ يَدْخُلُنِي الْجَبَّارُونَ وَالْمُتَكَبِّرُونَ ‏وَقَالَتْ هَذِهِ يَدْخُلُنِي الضُّعَفَاءُ وَالْمَسَاكِينُ فَقَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ لِهَذِهِ أَنْتِ عَذَابِي أُعَذِّبُ بِكِ مَنْ أَشَاءُ – وَرُبَّمَا قَالَ أُصِيبُ بِكِ مَنْ أَشَاءُ – وَقَالَ لِهَذِهِ أَنْتِ رَحْمَتِي أَرْحَمُ بِكِ مَنْ أَشَاءُ وَلِكُلِّ وَاحِدَةٍ مِنْكُمَا مِلْؤُهَا. ( )
হযরত আবূ হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, জান্নাত ও জাহান্নাম উভয়ে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে বিতর্ক করে, জাহান্নাম বলে, হে আল্লাহ! কেন আমার নিকট বড় বড় দাম্ভিক ও অহংকারীরা প্রবেশ করবে? আর জান্নাত আল্লাহকে বলে, কেন আমার ভিতর শুধু দুর্বল ও মিসকিন লোকেরা প্রবেশ করে?। তখন আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামকে বলেন, তুমি হলে আমার আযাব। আমি তোমার মাধ্যমে যাকে চাই তাকে আযাব দিব। অথবা আল্লাহ বলেন, তোমার মাধ্যমে আমি যাকে চাই তাকে পাকড়াও করবো। আর জান্নাতকে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তুমি আমার রহমত আমি তোমার দ্বারা যাকে চাই তাকে রহম করব। আর তোমাদের উভয়ের জন্য রয়েছে যথাযোগ্য অধিবাসী।( )

সাত. অহংকারীদের অপমান-অপদস্থ করে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে
আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
وَ سِیْقَ الَّذِیْنَ كَفَرُوْۤا اِلٰى جَهَنَّمَ زُمَرًاؕ-حَتّٰۤى اِذَا جَآءُوْهَا فُتِحَتْ اَبْوَابُهَا وَ قَالَ لَهُمْ خَزَنَتُهَاۤ اَلَمْ یَاْتِكُمْ رُسُلٌ مِّنْكُمْ یَتْلُوْنَ عَلَیْكُمْ اٰیٰتِ رَبِّكُمْ وَ یُنْذِرُوْنَكُمْ لِقَآءَ یَوْمِكُمْ هٰذَاؕ-قَالُوْا بَلٰى وَ لٰكِنْ حَقَّتْ كَلِمَةُ الْعَذَابِ عَلَى الْكٰفِرِیْنَ(۷۱)قِیْلَ ادْخُلُوْۤا اَبْوَابَ جَهَنَّمَ خٰلِدِیْنَ فِیْهَاۚ-فَبِئْسَ مَثْوَى الْمُتَكَبِّرِیْنَ(۷۲)
আর কাফিরদেরকে দলে দলে জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। অবশেষে তারা যখন জাহান্নামের কাছে এসে পৌঁছবে তখন তার দরজাগুলো খুলে দেয়া হবে এবং জাহান্নামের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, ‘তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের কাছে কি রাসূলগণ আসেননি, যারা তোমাদের কাছে তোমাদের রবের আয়াতগুলো তিলাওয়াত করতেন এবং এ দিনের সাক্ষাৎ সম্পর্কে তোমাদেরকে সতর্ক করতেন’? তারা বলবে, ‘অবশ্যই এসেছিল’; কিন্তু কাফিরদের উপর আযাবের বাণী সত্যে পরিণত হল। তাদেরকে বলা হবে, তোমরা জাহান্নামের দরজা দিয়ে প্রবেশ কর চিরকাল তোমরা সেখানে অবস্থান করবে। অহংকারীদের বাসস্থান কতই না মন্দ।[সূরা যুমার, আয়াত: ৭১,৭২] আল্লাহ তা‘আলা আরও এরশাদ করেন,
وَ قَالَ رَبُّكُمُ ادْعُوْنِیْۤ اَسْتَجِبْ لَكُمْؕ-اِنَّ الَّذِیْنَ یَسْتَكْبِرُوْنَ عَنْ عِبَادَتِیْ سَیَدْخُلُوْنَ جَهَنَّمَ دٰخِرِیْنَ۠(۶۰)
আর তোমাদের রব বলছেন, ‘তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। নিশ্চয় যারা অহঙ্কার বশতঃ আমার ইবাদত থেকে বিমুখ থাকে, তারা অচিরেই লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ [সূরা গাফের, আয়াত: ৬০] عن أبي هريرة قال: قال رسول الله صلى الله عليه و سلم قَالَ الله عَّز وَجَلَّ: الْكبْريَاءُ رِدَائيِ، وَالَعظَمَةُ إِزَارِي، فَمَنْ نَازَعَنيِ وَاِحًدا مِنهُمَا قَذَفْتُهُ فِي النَّارِ.
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, অহংকার হল আমার কুদরতের চাদর আর বড়ত্ব হল আমার পরিধেয়। যে ব্যক্তি আমার এ দুটির যে কোন একটি নিয়ে টানাটানি করবে আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব।( )
—০—

অহংকার দূরীকরণের উপায়সমূহ
অহংকার মানুষের ভিতরে লুক্কায়িত একটা বিষয়ের নাম। একে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। কিন্তু একে দমিয়ে রাখতে হবে, যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। তাই অহংকার দূরীকরণের জন্য কেবল আকাঙ্খাই যথেষ্ট নয়, বরং এ রোগের রীতিমত চিকিৎসা ও প্রতিষেধক প্রয়োজন। নিম্নে এ বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা হ’ল।

১. নিজের সৃষ্টি ও মৃত্যুর কথা সর্বদা স্মরণ করা
মানুষ তার জন্মের সময় উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না (দাহর ৭৬/১)। মৃত্যুর পর সে লাশে পরিণত হবে। আর মৃত্যুর ঘণ্টা সর্বদা তার মাথার উপর ঝুলে আছে। হুকুম হলেই তা বেজে উঠবে এবং তার রূহ যার হুকুমে তার দেহে এসেছিল তার কাছেই চলে যাবে। তার প্রাণহীন অসাড় দেহটা পড়ে থাকবে দুনিয়ায় পোকা-মকড়ের খোরাক হয়ে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
أَوَلَمْ يَرَ الْإِنْسَانُ أَنَّا خَلَقْنَاهُ مِنْ نُطْفَةٍ فَإِذَا هُوَ خَصِيمٌ مُبِينٌ*وَضَرَبَ لَنَا مَثَلاً وَنَسِيَ خَلْقَهُ قَالَ مَنْ يُحْيِ الْعِظَامَ وَهِيَ رَمِيمٌ* قُلْ يُحْيِيهَا الَّذِي أَنْشَأَهَا أَوَّلَ مَرَّةٍ وَهُوَ بِكُلِّ خَلْقٍ عَلِيمٌ*
‘মানুষ কি দেখে না যে, আমি তাকে সৃষ্টি করেছি একটি শুক্রাণু হ’তে? অথচ সে এখন হয়ে পড়েছে প্রকাশ্যে বিতর্ককারী’। ‘মানুষ আমার সম্পর্কে নানা উপমা দেয়। অথচ সে নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে ভুলে যায়। আর বলে, কে এই পচা-গলা হাড়-হাড্ডিকে পুনর্জীবিত করবে’? ‘তুমি বলে দাও, ওকে পুনর্জীবিত করবেন তিনি, যিনি ওটাকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলেন। বস্তুতঃ তিনি সকল সৃষ্টি সম্পর্কে সম্যক অবহিত’ (ইয়াসীন ৩৬/৭৭-৭৯)।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
أَيْنَمَا تَكُونُوا يُدْرِكْكُمُ الْمَوْتُ وَلَوْ كُنْتُمْ فِي بُرُوجٍ مُشَيَّدَةٍ
‘যেখানেই তোমরা থাক না কেন, মৃত্যু তোমাদেরকে গ্রাস করবেই; যদিও তোমরা সুদৃঢ় দুর্গের মধ্যে অবস্থান কর’ (নিসা ৪/৭৮)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
أَكْثِرُوا ذِكْرَ هَادِمِ اللَّذَّاتِ يَعْنِى الْمَوْتَ
‘তোমরা স্বাদ ধ্বংসকারীকে বেশী বেশী স্মরণ কর’ অর্থাৎ মৃত্যুকে।( )
অতএব মানুষের জন্য অহংকার করার মত কিছু নেই। কেননা সে তার রোগ-শোক, জীবন, যৌবন, বার্ধক্য কিছুকেই প্রতিরোধ করতে পারে না। শতবার ঔষধ খেলেও আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত তার রোগ সারে না। শত চেষ্টাতেও আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত তার বিপদ দূরীভূত হয় না। ফলে সে একজন অসহায় ব্যক্তি ছাড়া কিছুই নয়। সুতরাং তার উচিত সর্বদা নিরহংকার ও বিনয়ী থাকা।

২. আখেরাতে জওয়াবদিহিতার ভয়ে ভীত হওয়া
ক্বিয়ামতের দিন প্রত্যেকের আমলনামা তার হাতে দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলবেন,
اقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا
‘তোমার আমলনামা তুমি পাঠ কর। আজ তোমার হিসাব নেওয়ার জন্য তুমিই যথেষ্ট’ (ইসরা ১৭/১৪)।
অতঃপর যখন তারা স্ব স্ব আমলনামা দেখবে, তখন সে সময়কার অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
وَوُضِعَ الْكِتَابُ فَتَرَى الْمُجْرِمِينَ مُشْفِقِينَ مِمَّا فِيهِ وَيَقُولُونَ يَا وَيْلَتَنَا مَالِ هَذَا الْكِتَابِ لاَ يُغَادِرُ صَغِيرَةً وَلاَ كَبِيرَةً إِلاَّ أَحْصَاهَا وَوَجَدُوا مَا عَمِلُوا حَاضِرًا وَلاَ يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا.
‘সেদিন উপস্থিত করা হবে প্রত্যেকের কিতাব (আমলনামা)। অতঃপর তাতে যা আছে তার কারণে তুমি অপরাধীদের দেখবে আতংকিত। এ সময় তারা বলবে, হায় দুর্ভোগ আমাদের! এটা কেমন আমলনামা যে, ছোট-বড় কিছুই বাদ দেয়নি, সবকিছুই লিখে রেখেছে। তারা তাদের কৃতকর্ম সমূহকে সম্মুখে উপস্থিত দেখতে পাবে। বস্তুতঃ তোমার প্রতিপালক কারও প্রতি যুলুম করেন না’ (কাহফ ১৮/৪৯)।
অর্থাৎ আল্লাহ যাকে যে নে‘মত দিয়েছেন ও দুনিয়াবী দায়িত্ব প্রদান করেছেন, আল্লাহর নিকটে তার যথাযথ জওয়াবদিহিতার কথা সর্বদা স্মরণ করতে হবে এবং কিভাবে সে দায়িত্ব আরও সুন্দরভাবে পালন করা যায়, তার জন্য সর্বদা চেষ্টায় থাকতে হবে। কেননা আল্লাহ মানুষের হায়াত ও মঊত সৃষ্টি করেছেন, কে তাদের মধ্যে সুন্দরতম আমল করে, সেটা পরীক্ষা করার জন্য’
الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا ۚ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ
যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন-কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাময়। [মুলুক ৬৭/২] অতএব এই তীব্র দায়িত্বানুভূতি তাকে অহংকারের পাপ হ’তে মুক্ত রাখবে ইনশাআল্লাহ।
أَحْسَنَ عَمَلاً ‘সুন্দরতম আমল’ অর্থ ‘শরী‘আতের আলোকে সর্বাধিক শুদ্ধ আমল এবং অন্তরের দিক দিয়ে সর্বাধিক বিশুদ্ধ কর্ম। যা স্রেফ আল্লাহর জন্য নিবেদিত এবং সকল প্রকার রিয়া ও শ্রুতি হ’তে মুক্ত’।
উল্লেখ্য যে, এখানে أَكَثَرَ عَمَلاً ‘অধিক আমল’ বলা হয়নি। অতএব কোরআন- সুন্নাহ অনুমোদিত সৎকর্ম সংখ্যায় ও পরিমাণে অল্প হ’লেও তাই-ই ‘সুন্দরতম আমল’ হিসাবে আল্লাহর নিকটে গ্রহণীয় হবে।
(ক) হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু খেলাফতের দায়িত্বে (১৩-২৩/৬৩৪-৬৪৩ খৃঃ) থাকা অবস্থায় বলতেন,
لَوْ مَاتَتْ سَخْلَةٌ عَلَى شَاطِئِ الْفُرَاتِ ضَيْعَةً لَخِفْتُ أَنْ أُسْأَلَ عَنْهَا
‘যদি ফোরাত নদীর কূলে একটি ভেড়ার বাচ্চাও হারানো অবস্থায় মারা যায়, তাতে আমি ভীত হই যে, সেজন্য আমাকে কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হ’তে হবে’। ( )
(খ) খলীফা হারূনুর রশীদ (১৭০-১৯৩ হিঃ), যিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ব্যাপী বিশাল ইসলামী খেলাফতের অধিকারী ছিলেন, তিনি একদিন রাস্তায় চলছিলেন। এমন সময় জনৈক ইহূদী তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করল। সে তাঁকে বলল, ‘হে আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহকে ভয় করুন’। তখন খলীফা ঘোড়া থেকে নামলেন ও মাটিতে সাজদা করলেন। অতঃপর ইহূদীটিকে বললেন, তোমার প্রয়োজন কি বল? সে তার চাহিদা পেশ করল আর তিনি তার প্রয়োজন মিটালেন। অতঃপর যখন তাঁকে বলা হ’ল, আপনি একজন ইহূদীর জন্য সাওয়ারী থেকে নামলেন? জবাবে তিনি বললেন, তার কথা শুনে আমার নিম্নোক্ত আয়াতটি স্মরণ হ’ল, যেখানে আল্লাহ বলেছেন,
وَإِذَا قِيلَ لَهُ اتَّقِ اللهَ أَخَذَتْهُ الْعِزَّةُ بِالْإِثْمِ فَحَسْبُهٗ جَهَنَّمُ وَلَبِئْسَ الْمِهَادُ
‘যখন তাকে বলা হয় ‘আল্লাহকে ভয় কর’ তখন তার আত্মসম্মান তাকে পাপে স্ফীত করে তোলে। অতএব তার জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট। আর অবশ্যই তা নিকৃষ্টতম ঠিকানা’।( )
একজন সাধারণ ইহূদী প্রজার সাথে ক্ষমতাধর খলীফা হারূণ যদি এরূপ নম্র আচরণ করতে পারেন, তাহ’লে অন্যদের সাথে তিনি কেমন নিরহংকার আচরণ করতেন, সেটা সহজে অনুমেয়। এই ঘটনায় ইসলামী খেলাফতে অমুসলিম নাগরিকদের প্রতি সর্বোত্তম সদাচরণের প্রমাণ পাওয়া যায়।

৩. নিজেকে জানা ও আল্লাহকে জানা
প্রথমেই নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে জানতে হবে যে, প্রাণহীন শুক্রাণু থেকে সে জীবন পেয়েছে। আবার সে মারা যাবে। অতএব তার কোন অহংকার নেই। অতঃপর আল্লাহ সম্পর্কে জানবে যে, তিনিই তাকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এনেছেন। তিনিই তাকে শক্তি দিয়ে মেধা দিয়ে পূর্ণ-পরিণত মানুষে পরিণত করেছেন। তাঁর দয়ায় তার সবকিছু। অতএব প্রতি পদে পদে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ ব্যতীত তার কিছুই করার নেই। আল্লাহ এরশাদ করেন,
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلاَّ لِيَعْبُدُونِ
‘আমি জিন ও ইনসান সৃষ্টি করেছি কেবলমাত্র আমার ইবাদতের জন্য’
(যারিয়াত ৫১/৫৬)।
অতএব নিজেকে সর্বদা আল্লাহর বান্দা মনে করার মধ্যেই লুকিয়ে আছে অহংকার দূর করার প্রধান ঔষধ।

৪. যে সব বিষয় মনের মধ্যে অহংকার সৃষ্টি করে, সেগুলিকে তুচ্ছ মনে করা
যেমন বংশের অহংকার, ধন-সম্পদের অহংকার, পদমর্যাদার অহংকার, বিশেষ কোন নে‘মতের অহংকার। এগুলি সবই আল্লাহর দান। তিনি যেকোন সময় এগুলি ফিরিয়ে নিতে পারেন। আমরা হর-হামেশা এগুলো দেখতে পাচ্ছি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
انْظُرُوا إِلٰى مَنْ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَلاَ تَنْظُرُوا إِلَى مَنْ هُوَ فَوْقَكُمْ فَهُوَ أَجْدَرُ أَنْ لاَ تَزْدَرُوا نِعْمَةَ اللهِ عَلَيْكُمْ
(যদি তুমি সুখী হতে চাও), তাহ’লে যে ব্যক্তি (দুনিয়াবী দিক থেকে) তোমার চেয়ে নীচু, তার দিকে তাকাও। কখনো উপরের দিকে তাকিয়ো না। তাহ’লে তোমাকে দেওয়া আল্লাহর নে‘মত সমূহকে তুমি হীন মনে করবে না’।( ) অহংকার দূরীকরণে এটি একটি মহৌষধ।

৫. ইচ্ছাকৃতভাবে হীনকর কাজ করা
হযরত আয়েশা সিদ্দিক্বাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন,
كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَخْصِفُ نَعْلَهُ وَيَخِيطُ ثَوْبَهُ وَيَعْمَلُ فِى بَيْتِهِ كَمَا يَعْمَلُ أَحَدُكُمْ فِى بَيْتِهِ وقالت: كَانَ بَشَراً مِنَ الْبَشَرِ يَفْلِى ثَوْبَهُ وَيَحْلُبُ شَاتَهُ وَيَخْدُمُ نَفْسَهُ.
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের জুতা মুবারক নিজে ছাফ করতেন, কাপড় মুবারক সেলাই করতেন ও বাড়ির নানাবিধ কাজ করতেন, যেমন তোমরা করে থাক। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাল-চলনে অন্যান্য মানুষের ন্যায় একজন মানুষ। তিনি কাপড়ের উকুন বাছতেন, ছাগী থেকে দুধ দোহন করতেন এবং নিজের অন্যান্য কাজ করতেন।( )
মসজিদে নববী শরীফ নির্মাণের সময়, খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খননের সময় তিনি নিজে মাটি কেটেছেন ও পাথর বহন করেছেন। বিভিন্ন সফরে তিনি ছাহাবীদের সঙ্গে বিভিন্ন কাজে অংশ নিয়েছেন।
তাঁর অনুসরণে ছাহাবায়ে কেরামও এরূপ করতেন। যেমন আব্দুল্লাহ বিন সালাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু একদিন কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে বাজার অতিক্রম করছিলেন। এ দৃশ্য দেখে জনৈক ব্যক্তি বললেন, হে আব্দুল্লাহ! আল্লাহ কি আপনাকে এ কাজ করা থেকে মুখাপেক্ষীহীন করেননি? (অর্থাৎ আপনার তো যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ রয়েছে! আপনি কেন একাজ করছেন?) জবাবে তিনি বললেন,
بَلٰي، وَلَكِن أَرَدْتُ أَنْ أَدْفَعَ الْكِبْرَ
‘হ্যাঁ! কিন্তু আমি এ কাজের মাধ্যমে আমার অহংকার দূর করতে চাই। কেননা আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার রয়েছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।( )

৬. আল্লাহ সবকিছু দেখছেন ও শুনছেন, সবসময় একথা মনে রাখা
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
إِذْ يَتَلَقَّى الْمُتَلَقِّيَانِ عَنِ الْيَمِينِ وَعَنِ الشِّمَالِ قَعِيدٌ. مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلاَّ لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ.
‘মনে রেখ দু’জন গ্রহণকারী ফেরেশতা মানুষের ডানে ও বামে বসে সর্বদা তার কর্ম লিপিবদ্ধ করে’। ‘সে মুখে যে কথাই উচ্চারণ করে তা লিপিবদ্ধ করার জন্য সদা তৎপর প্রহরী তার নিকটেই অবস্থান করে’ (ক্বাফ ৫০/১৭-১৮)।
হাদীছে জিব্রীলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ
তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত কর, যেন তুমি তাঁকে দেখছ। যদি তুমি তাঁকে দেখতে নাও পাও, তবে নিশ্চিত বিশ্বাস রাখ যে, তিনি তোমাকে দেখছেন’।( )

৭. গরীব ও ইয়াতীমদের সঙ্গে থাকা ও রোগীর সেবা করা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, তোমরা আমাকে দুর্বলদের মধ্যে তালাশ কর’।( ) অর্থাৎ তাদের প্রতি সদাচরণের মাধ্যমে আমার সন্তুষ্টি অন্বেষণ কর।
জনৈক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার অন্তর কঠিন হওয়ার অভিযোগ পেশ করলে তিনি তাকে বললেন,
امْسَحْ رَأْسَ الْيَتِيمِ وَأَطْعِمِ الْمِسْكِينَ
‘তুমি ইয়াতীমের মাথায় হাত বুলাও এবং অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান কর।( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
إِنَّ الْمُسْلِمَ إِذَا عَادَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ لَمْ يَزَلْ فِى خُرْفَةِ الْجَنَّةِ حَتَّى يَرْجِعَ
একজন মুসলমান যখন অন্য একজন মুসলমান রোগীর সেবা বা সাক্ষাত করে, তখন সে জান্নাতের বাগিচায় অবস্থান করে, যতক্ষণ না সে ফিরে আসে’।( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
عَنْ أبي هريرة رضي الله عنه أنَّ رَسُول اللَّه صلى الله عليه وسلم قَالَ: إنَّ اللهَ عزَّ وجلَّ يقولُ يَومَ القِيامَةِ: يا ابْنَ آدَمَ مَرِضْتُ فَلَمْ تَعُدْنِي، قالَ: يا رَبِّ كيفَ أعُودُكَ؟ وأَنْتَ رَبُّ العالَمِينَ، قالَ: أما عَلِمْتَ أنَّ عَبْدِي فُلانًا مَرِضَ فَلَمْ تَعُدْهُ، أما عَلِمْتَ أنَّكَ لو عُدْتَهُ لَوَجَدْتَنِي عِنْدَهُ؟ يا ابْنَ آدَمَ اسْتَطْعَمْتُكَ فَلَمْ تُطْعِمْنِي، قالَ: يا رَبِّ وكيفَ أُطْعِمُكَ؟ وأَنْتَ رَبُّ العالَمِينَ، قالَ: أما عَلِمْتَ أنَّه اسْتَطْعَمَكَ عَبْدِي فُلانٌ، فَلَمْ تُطْعِمْهُ؟ أما عَلِمْتَ أنَّكَ لو أطْعَمْتَهُ لَوَجَدْتَ ذلكَ عِندِي، يا ابْنَ آدَمَ اسْتَسْقَيْتُكَ، فَلَمْ تَسْقِنِي، قالَ: يا رَبِّ كيفَ أسْقِيكَ؟ وأَنْتَ رَبُّ العالَمِينَ، قالَ: اسْتَسْقاكَ عَبْدِي فُلانٌ فَلَمْ تَسْقِهِ، أما إنَّكَ لو سَقَيْتَهُ وجَدْتَ ذلكَ عِندِي. ( )
হযরত আবূ হুরায়রাহ্ হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন বলবেন, হে বনী আদম! আমি অসুস্থ ছিলাম। তুমি আমাকে দেখতে আসোনি। সে বলবে, হে আমার রব! আমি তোমাকে কিভাবে দেখতে যাব? তুমি তো বিশ্বজাহানের রব! আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ ছিল? তুমি তাকে দেখতে যাওনি। তুমি কি জানতে না যে, তুমি যদি তাকে দেখতে যেতে, আমাকে অবশ্যই তার কাছে পেতে। হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম। তুমি আমাকে খাবার দাওনি। সে বলবে, হে আমার রব! আমি তোমাকে কিভাবে খাবার দিতাম? তুমি তো বিশ্বজাহানের রব। আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানো না, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল? তুমি তাকে খাবার দাওনি। তুমি কি জানতে না যে, সে সময় যদি তুমি তাকে খাবার দিতে তাহলে তা এখন আমার কাছে পেতে? হে বানী আদম! আমি তোমার কাছে পিপাসা নিবারণের জন্য পানি চেয়েছিলাম। তুমি পানি দিয়ে তখন আমার পিপাসা নিবারণ করোনি। সে বলবে, হে আমার রব! আমি কিভাবে তোমার পিপাসা নিবারণ করতাম? তুমি তো বিশ্বজাহানের রব। আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি চেয়েছিল, তুমি তখন তাকে পানি দাওনি। যদি তুমি সে সময় তাকে পানি দিতে, তাহলে তা এখন আমার কাছে পেতে। ( )
যেকোন সেবামূলক কাজ যদি নিঃস্বার্থ হয় এবং পরকালীন লক্ষ্যে হয়, তবে সেগুলি অহংকার চূর্ণ করার মহৌষধ হিসাবে আল্লাহর নিকটে গৃহীত হয় এবং বান্দা জাহান্নাম থেকে বেঁচে যায়। যেমন হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
عَنْ أبي هريرة رضي الله عنه أنَّ رَسُول الله صلى الله عليه وسلم قَالَ: بَيْنمَا رَجُلٌ يَمْشِي بطَريقٍ اشْتَدَّ علَيْهِ الْعَطشُ، فَوجد بِئراً فَنزَلَ فِيهَا فَشَربَ، ثُمَّ خَرَجَ فإِذا كلْبٌ يلهثُ يَأْكُلُ الثَّرَى مِنَ الْعَطَشِ، فَقَالَ الرَّجُلُ: لَقَدْ بلَغَ هَذَا الْكَلْبُ مِنَ العطشِ مِثْلَ الَّذِي كَانَ قَدْ بَلَغَ مِنِّي، فَنَزَلَ الْبِئْرَ فَملأَ خُفَّه مَاءً ثُمَّ أَمْسَكَه بِفيهِ، حتَّى رقِيَ فَسَقَى الْكَلْبَ، فَشَكَرَ اللهُ لَه فَغَفَرَ لَه. قَالُوا: يَا رسولَ الله إِنَّ لَنَا في الْبَهَائِم أَجْراً؟ فَقَالَ: “في كُلِّ كَبِدٍ رَطْبةٍ أَجْرٌ متفقٌ عليه.
وفي رواية للبخاري: فَشَكَر الله لهُ فَغَفَرَ لَه، فَأدْخَلَه الْجنَّةَ. وفي رواية لَهُما: بَيْنَما كَلْبٌ يُطيف بِركِيَّةٍ قَدْ كَادَ يقْتُلُه الْعطَشُ إِذْ رأتْه بغِيٌّ مِنْ بَغَايا بَنِي إِسْرَائيلَ، فَنَزَعَتْ مُوقَهَا فاسْتَقت لَهُ بِهِ، فَسَقَتْهُ فَغُفِر لَهَا بِهِ.
জনৈক তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি মরুভূমিতে একটি কূয়ায় নেমে পানি পান শেষে উঠে দেখেন যে, একটি তৃষ্ণার্ত কুকুর পিপাসায় মরণাপন্ন হয়ে জিভ বের করে মাটিতে মুখ ঘষছে। তখন লোকটি পুনরায় কূয়ায় নেমে নিজের চামড়ার মোযা ভরে পানি এনে কুকুরটিকে পান করান এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। ফলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করান’।
অন্য বর্ণনায় এসেছে বনী ই¯্রাঈলের জনৈকা বেশ্যা মহিলা একটি কুকুরকে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় কূয়ার চারপাশে ঘুরতে দেখে নিজের ওড়নায় মোযা বেঁধে কূয়া থেকে পানি তুলে তাকে পান করায়। ফলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন’।( )

৮. সৎকর্মগুলি আল্লাহর নিকট কবুল হচ্ছে
কি-না সেই ভয়ে সর্বদা ভীত থাকা
হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিম্নোক্ত আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম,
وَالَّذِينَ يُؤْتُونَ مَا آتَوْا وَقُلُوبُهُمْ وَجِلَةٌ أَنَّهُمْ إِلَى رَبِّهِمْ رَاجِعُونَ. أُولَئِكَ يُسَارِعُونَ فِي الْخَيْرَاتِ وَهُمْ لَهَا سَابِقُونَ
‘আর যারা তাদের যা দান করার তা দান করে ভীত-কম্পিত অন্তরে। এজন্য যে, তারা তাদের প্রতিপালকের কাছে ফিরে যাবে’। ‘তারা দ্রুত সম্পাদন করে তাদের সৎকর্ম সমূহ এবং তারা সেদিকে অগ্রগামী হয়’ (মুমিনূন ২৩/৬০-৬১)
আমি বললাম, এরা কি তারাই যারা মদ্যপান করে ও চুরি করে? তিনি বললেন,
لاَ يَا بِنْتَ الصِّدِّيقِ وَلَكِنَّهُمُ الَّذِينَ يَصُومُونَ وَيُصَلُّونَ وَيَتَصَدَّقُونَ وَهُمْ يَخَافُونَ أَنْ لاَ يُقْبَلَ مِنْهُمْ. أُولَئِكَ الَّذِينَ يُسَارِعُونَ فِى الْخَيْرَاتِ وَهُمْ لَهَا سَابِقُونَ
‘না হে ছিদ্দীকের কন্যা! বরং এরা হ’ল তারাই যারা রোযা রাখে, নামায আদায় করে ও ছাদাক্বা করে এবং তারা সর্বদা ভীত থাকে এ ব্যাপারে যে, তাদের উক্ত নেক আমলগুলি কবুল হচ্ছে কি-না। তারাই সৎকর্ম সমূহের প্রতি দ্রুত ধাবমান হয়’।( )

৯. ভুলক্রমে বা উত্তেজনা বশে অহংকার প্রকাশ পেলে সাথে সাথে
বান্দার কাছে, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
مَنْ كَانَتْ لَهُ مَظْلَمَةٌ لأَحَدٍ مِنْ عِرْضِهِ أَوْ شَىْءٍ فَلْيَتَحَلَّلْهُ مِنْهُ الْيَوْمَ، قَبْلَ أَنْ لاَ يَكُونَ دِينَارٌ وَلاَ دِرْهَمٌ.
‘যদি কেউ তার ভাইয়ের সম্মানহানি করে বা অন্য কোন বস্তুর ব্যাপারে তার প্রতি যুলুম করে, তবে সে যেন তা আজই মিটিয়ে নেয়। সেদিন আসার আগে, যেদিন কোন দীনার ও দিরহাম তার সঙ্গে থাকবে না…। ( )
অন্যতম জ্যেষ্ঠ তাবেঈ মুত্বার্রিফ বিন আব্দুল্লাহ (মৃঃ ৯৫ হিঃ) হাজ্জাজ বিন ইউসুফের পক্ষ হ’তে নিযুক্ত খোরাসানের গভর্ণর মুহাল্লাব বিন আবূ ছুফরাকে একদিন দেখলেন রাস্তা দিয়ে খুব জাঁক-জমকের সাথে যেতে। তিনি সামনে গিয়ে বললেন, হে আল্লাহর বান্দা! কিভাবে তুমি রাস্তায় চলছ, যা আল্লাহকে ক্রুদ্ধ করে? একথা শুনে মুহাল্লাব বললেন, আপনি কি আমাকে চিনেন? তাবেঈ বিদ্বান বললেন,
نعم، أَوَّلُكَ نُطْفَةٌ مَذِرَةٌ، وَآخِرُكَ جِيفَةٌ قَذِرَةٌ، وَأَنْتَ فِيمَا بَيْنَ ذَلِكَ تَحْمِلُ الْعَذِرَةَ
‘অবশ্যই চিনি। তোমার শুরু হ’ল একটি নিকৃষ্ট শুক্রাণু থেকে এবং শেষ হ’ল একটি মরা লাশ হিসাবে। আর তুমি এর মধ্যবর্তী সময়ে বহন করে চলেছ পায়খানার ময়লা’। একথা শুনে মুহাল্লাব জাঁক-জমক ছেড়ে সাধারণভাবে চলে গেলেন।( )

১০. অহংকারী পোষাক ও চাল-চলন পরিহার করা
পোষাক স্বাভাবিক ও সুন্দর এবং পরিচ্ছন্ন হ’তে হবে। কেননা আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন’( ) এবং তিনি বান্দার উপর তাঁর নে‘মতের নিদর্শন দেখতে ভালবাসেন’।( )
কিন্তু স্বাভাবিক পোষাকের বাইরে অপ্রয়োজনে আড়ম্বরপূর্ণ কোন পোষাক পরিধান করা ‘রিয়া’র পর্যায়ে পড়ে যাবে। যা কবীরা গোনাহের অন্তর্ভুক্ত। যাতে অনেকে ফেৎনায় পড়েন ও তার মধ্যে অহংকার সৃষ্টি হয়।

১১. গোপন আমল করা
নিরহংকার ও রিয়ামুক্ত হওয়ার অন্যতম পন্থা হ’ল গোপন আমল করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
عَن أَبي هُرَيرَةَ رضي الله عنه، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم:্র سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللهُ في ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إلاَّ ظِلُّهُ: إمَامٌ عَادِلٌ، وَشَابٌّ نَشَأ في عِبَادَةِ الله تَعَالَى، وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ بِالمَسَاجِدِ، وَرَجُلاَنِ تَحَابّا في اللهِ اجْتَمَعَا عَلَيهِ وتَفَرَّقَا عَلَيهِ، وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأةٌ ذَاتُ مَنصَبٍ وَجَمَالٍ، فَقَالَ: إنِّي أخَافُ الله، وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ، فَأخْفَاهَا حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ الله خَالِياً فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ. مُتَّفَقٌ عَلَيهِ .
হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা সাত ব্যক্তিকে সেই দিনে তাঁর (আরশের) ছায়া দান করবেন যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না; (তারা হল,)
১. ন্যায় পরায়ণ বাদশাহ (রাষ্ট্রনেতা),
২. সেই যুবক যার যৌবন আল্লাহ তাআলার ইবাদতে অতিবাহিত হয়,
৩. সেই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদসমূহের সাথে ঝুলন্ত থাকে (মসজিদের প্রতি তার মন সদা আকৃষ্ট থাকে।)
৪. সেই দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব ও ভালবাসা স্থাপন করে; যারা এই ভালবাসার উপর মিলিত হয় এবং এই ভালবাসার উপরেই চিরবিচ্ছিন্ন (তাদের মৃত্যু) হয়।
৫. সেই ব্যক্তি যাকে কোন কুলকামিনী সুন্দরী (ব্যভিচারের উদ্দেশ্যে) আহবান করে, কিন্তু সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি।’
৬. সেই ব্যক্তি যে দান করে গোপন করে; এমনকি তার ডান হাত যা প্রদান করে, তা তার বাম হাত পর্যন্তও জানতে পারে না।
৭. আর সেই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে; ফলে তার উভয় চোখে পানি বয়ে যায়।’’ ( )

১২. আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করা
যদি কেউ আল্লাহর ভয়ে কাঁদতে পারে, তবে তার চোখের পানিতে অহংকার ধুয়ে-মুছে ছাফ হয়ে যাবে। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
لاَ يَلِجُ النَّارَ رَجُلٌ بَكٰى مِنْ خَشْيَةِ اللهِ حَتَّى يَعُوْدَ اللَّبَنُ فِى الضَّرْعِ
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে কাঁদে, সে ব্যক্তি জাহান্নামে যাবে না। যেমন দুধ পুনরায় স্তনে প্রবেশ করে না’।( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
لَوْ تَعْلَمُونَ مَا أَعْلَمُ لَضَحِكْتُمْ قَلِيلًا وَلبَكَيْتُمْ كَثِيرًا( )
যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, আমি যা জানি তোমরা যদি তা জানতে, তাহ’লে তোমরা কাঁদতে বেশী, হাসতে কম।( )
হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
عَنْ أَنَسٍ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ إِنَّكُمْ لَتَعْمَلُونَ أَعْمَالاً هِيَ أَدَقُّ فِي أَعْيُنِكُمْ مِنَ الشَّعَرِ، إِنْ كُنَّا نَعُدُّهَا عَلَى عَهْدِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم الْمُوبِقَاتِ‏.‏ قَالَ أَبُو عَبْدِ اللهِ يَعْنِي بِذَلِكَ الْمُهْلِكَاتِ‏.
তোমরা তোমাদের অনেক পাপকে চুলের চাইতে সূক্ষ্ম মনে কর। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় আমরা সেগুলিকে ধ্বংসকারী মনে করতাম’।( )
তাহলে, অহংকারের মত মহাপাপ হৃদয়ে জাগ্রত হ’লে সেটাকে দ্রুত দমন করতে হবে, যা সহজেই অনুমেয়।

১৩. মানুষকে ক্ষমা করা ও সর্বদা নম্রতা অবলম্বন করা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
مَا زَادَ اللهُ عَبْدًا بِعَفْوٍ إِلاَّ عِزًّا وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلّٰهِ إِلاَّ رَفَعَهُ اللهُ
‘বান্দা কাউকে ক্ষমা করলে আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। আর যখন কেউ কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিনয় অবলম্বন করে, তখন তিনি তার মর্যাদাকে সমুন্নত করেন’।( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
إِنَّ الرِّفْقَ لاَ يَكُونُ فِى شَىْءٍ إِلاَّ زَانَهُ وَلاَ يُنْزَعُ مِنْ شَىْءٍ إِلاَّ شَانَهُ
‘কোন বস্তুতে নম্রতা থাকলে সেটি তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং তা প্রত্যাহার করা হ’লে সেটি দোষযুক্ত হয়ে পড়ে’।( )
এর দ্বারা বুঝা যায় যে, বিনয় ও আনুগত্য মানুষকে উঁচু ও সম্মানিত করে। পক্ষান্তরে অহংকার ও আত্মগর্ব মানুষকে নীচু ও লাঞ্ছিত করে।

১৪. নিরহংকার হওয়ার জন্য আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা
অহংকার থেকে মুক্ত থাকার জন্য নিম্নের দো‘আটি পাঠ করা যেতে পারে
اللهُ أَكْبَرُ كَبِيراً وَالْحَمْدُ لِلَّهِ كَثِيراً وَسَبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ بُكْرَةً وَأَصِيلاً. اللّٰهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ مِنْ هَمْزِهِ وَنَفْخِهِ وَنَفْثِهِ
আল্লাহ সর্বোচ্চ মহান, আল্লাহর জন্য যাবতীয় প্রশংসা, সকালে ও সন্ধ্যায় তাঁর প্রশংসাসহ আল্লাহর জন্য সকল পবিত্রতা। আমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি বিতাড়িত শয়তান হ’তে এবং তার প্ররোচনা, তার ফুঁক ও তার কুমন্ত্রণা হ’তে।
উক্ত হাদীছে نَفْخُهُ বা ‘শয়তানের ফুঁক’-এর অর্থ সম্পর্কে রাবী ‘আমর বিন মুর্রা বলেন, সেটা হ’ল الْكِبْرُ অর্থাৎ ‘অহংকার’।( )
এছাড়াও সূরা ফালাক্ব ও নাস পড়া উচিৎ। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
وَأَخْرَجَ ابْنُ أَبِي شَيْبَةَ، وَابْنُ مَرْدُويَهَ عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا سَأَلَ سَائِلٌ وَلَا اسْتَعَاذَ مُسْتَعِيذٌ بِمِثْلِهِمَا يَعْنِي الْمُعَوِّذَتَيْنِ . ( )
‘কোন প্রার্থনাকারী প্রার্থনা করতে পারে না এবং কোন আশ্রয়প্রার্থী আশ্রয় চাইতে পারে না এ দু’টি সূরার তুলনায় অন্য কিছুর মাধ্যমে’।( )

অহংকারের চিকিৎসা
একটি কথা মনে রাখতে হবে, কিব্র তথা অহংকার এমন একটি কবীরা গুনাহ ও মারাত্মক ব্যাধি যা মানুষকে ধ্বংস করে দেয় এবং একজন মানুষের দুনিয়া ও আখিরাতকে নষ্ট করে দেয়। এ কারণেই একজন মানুষের জন্য অহংকার থেকে দুরে থাকা বা তার জীবন থেকে তা দূর করা ফরয। আর এ কথাও সত্য যে, যার মধ্যে অহংকার থাকে সে শুধু আশা করলে বা ইচ্ছা করলেই অহংকারকে দূর করতে বা অহংকার হতে বাঁচতে পারবে না। তাকে অবশ্যই এ মারাত্মক ব্যাধির চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। নিম্মে অহংকারের কিছু চিকিৎসাব্যবস্থা উল্লেখ করা হল:
এক. অন্তর থেকে অহংকারের মূলোৎপাটন করা
প্রথমে অহংকারী নিজেকে চিনতে হবে, তারপর তাকে তার প্রভুকে চিনতে হবে। একজন মানুষ যখন নিজেকে ভালোভাবে চিনতে পারবে এবং আল্লাহ তা‘আলা বড়ত্ব ও মহত্বকে সঠিকভাবে বুঝতে পারবে তখন তার মধ্যে বিনয় ও নম্রতা ছাড়া আর কিছুই থাকতে পারে না, অহংকার তার থেকে এমনিতেই দুর হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআ’লাকে যখন ভালোভাবে চিনবে, তখন সে অবশ্যই জানতে পারবে বড়ত্ব ও মহত্ব একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্য প্রযোজ্য নয়।
মানুষ তাকে চেনার জন্য প্রথমে তাকে তার নিজের সৃষ্টির মধ্যে চিন্তা করতে হবে। সে নিজে প্রথমে কি ছিল, তারপর দুনিয়াতে আসার পর মাঝখানে তার অবস্থা কেমন ছিল এবং তার পরিণতি কি হবে?
এসব নিয়ে চিন্তা করলে তার মধ্যে অহংকার থাকতেই পারে না। কিভাবে অহংকার করবে? আল্লাহ তা‘আলা তাকে প্রথমে এক ফোটা নিকৃষ্ট পানি থেকে বীর্য হিসেবে তৈরি করেন তারপর তিনি বীর্যকে আলাক্বাহ তথা জমাট রক্তে রূপান্তরিত করেন তারপর আলাক্বাহকে গোশতের টুকরা তারপর গোশতের টুকরাকে হাঁড়ে পরিণত করেন। তারপর আবার হাঁড়কে গোশতের আবরণ দিয়ে সাজান।
এ ছিল তার সৃষ্টির সূচনা আল্লাহ তা‘আলা তাকে প্রথমেই পরিপূর্ণ মাখলুক রূপে সৃষ্টি করেননি, বরং আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে তার হায়াতের পূর্বে মৃত্যু দিয়েই শুরু করেন। অনুরূপভাবে শক্তির পূর্বে দুর্বলতা, ইলমের পূর্বে অজ্ঞতা, হেদায়েতের পূর্বে গোমরাহি এবং সম্পদশালী হওয়ার পূর্বে অভাব ও দরিদ্রতা দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করেন। এতদসত্ত্বেও তার কিসের অহংকার, বড়াই, গৌরব ও অহমিকা?!
তারপর যখন লোকটি দুনিয়াতে বসবাস করতে থাকে তখন সে তার নিজের ইচ্ছায় বেঁচে থাকতে পারে না, সে যে রকম চায় সবকিছু তার মনের মত হয় না। সে চায় সুস্থ থাকতে কিন্তু পারে না, চায় ধনী ও অভাব মুক্ত থাকতে কিন্তু তা হয় না। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার উপর বিপদ-আপদ আসতেই থাকে। সে পিপাসিত, ক্ষুধার্ত ও অসুস্থ হতে বাধ্য হয়, কোন কিছু তাকে বিরত রাখতে পারে না। কোন কিছু মনে রাখতে চাইলে সে পারে না, ভুলে যায়। আবার কোন কিছু ভুলতে চাইলে তা ভুলতে পারে না এবং কোন কিছু শিখতে চাইলে তা শিখতে পারে না।
মোট কথা, সে একজন অধীনস্থ গোলাম, সে তার নিজের কোন উপকার করতে পারে না, আবার কোন ক্ষতিকে সে নিজের থেকে প্রতিহত করতে পারে না। নিজের কোন কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না এবং কোন অকল্যাণ বা ক্ষতিকে ঠেকাতে পারে না। এর চেয়ে অপমানকর আর কি হতে পারে, যদি সে নিজেকে চিনতে পারে!
তারপর সর্বশেষ অবস্থা ও পরিণতি হল, মৃত্যু। মৃত্যু তার জীবন, শ্রবণ শক্তি ও দৃষ্টিকে কেড়ে নেবে। আর কোন কিছু দেখতে পারবে না, শুনতে পারবে না। তার জ্ঞান, বুদ্ধি শক্তি ও অনুভূতি আর অবশিষ্ট থাকবে না। বন্ধ হয়ে যাবে তার দেহের নড়াচড়া ও অনুভূতি, সে একেবারেই নিস্তেজ ও জড় পদার্থে রূপান্তরিত হবে, যেমনটি সৃষ্টির প্রথমে ছিল। তারপর তাকে মাটিতে পুঁতে রাখা হবে।
তারপরও যদি এই হত তার শেষ পরিণতি এবং এ অবস্থার উপর যদি শেষ হত সব কিছু!! আর যদি জীবিত করা না হত! কিন্তু না, এতো শেষ নয় বরং শুরু। চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়ার পর তাকে আবারো জীবিত করা হবে, যাতে তাকে কঠিন বিচারের সম্মুখীন করা হয়। তাকে তার কবর থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হবে কিয়ামতের ভয়াবহতায় ও উত্তপ্ত মাঠে। তারপর তার কর্মের দফতর তার সম্মুখে খুলে দেয়া হবে আর তাকে বলা হবে, তুমি তোমার কর্মের দফতর পড়। আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা দিয়ে বলেন,
وَ كُلَّ اِنْسَانٍ اَلْزَمْنٰهُ طٰٓىٕرَهٗ فِیْ عُنُقِهٖؕ-وَ نُخْرِ جُ لَهٗ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ كِتٰبًا یَّلْقٰىهُ مَنْشُوْرًا(۱۳) اِقْرَاْ كِتٰبَكَؕ-كَفٰى بِنَفْسِكَ الْیَوْمَ عَلَیْكَ حَسِیْبًاؕ(۱۴)
আর আমি প্রত্যেক মানুষের কর্মকে তার ঘাড়ে সংযুক্ত করে দিয়েছি এবং কিয়ামতের দিন তার জন্য আমি বের করব একটি কিতাব, যা সে পাবে উন্মুক্ত। (তাকে বলা হবে) পাঠ কর তোমার কিতাব, আজ তুমি নিজেই তোমার হিসাব-নিকাশকারী হিসেবে যথেষ্ট। [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: -১৩১৪] যখন সে তার আমল নামা প্রত্যক্ষ করবে, তখন বলবে,
وَ وُضِعَ الْكِتٰبُ فَتَرَى الْمُجْرِمِیْنَ مُشْفِقِیْنَ مِمَّا فِیْهِ وَ یَقُوْلُوْنَ یٰوَیْلَتَنَا مَالِ هٰذَا الْكِتٰبِ لَا یُغَادِرُ صَغِیْرَةً وَّ لَا كَبِیْرَةً اِلَّاۤ اَحْصٰىهَاۚ-وَ وَجَدُوْا مَا عَمِلُوْا حَاضِرًاؕ-وَ لَا یَظْلِمُ رَبُّكَ اَحَدًا۠(۴۹)
আর আমলনামা রাখা হবে। তখন তুমি অপরাধীদেরকে দেখতে পাবে ভীত, তাতে যা রয়েছে তার কারণে। আর তারা বলবে, ‘হায় ধ্বংস আমাদের! কী হল এ কিতাবের! তা ছোট-বড় কিছুই ছাড়ে না, শুধু সংরক্ষণ করে’ এবং তারা যা করেছে, তা হাযির পাবে। আর তোমার রব কারো প্রতি যুলম করেন না।
[সূরা কাহাফ, আয়াত: ৪৯]

আল্লামা আহনাফ রহমাতুল্লাহি আলইহি বলেন,
قال الأحنف بن قيس: عجبًا لابن آدم يتكبر وقد خرج من مجرى البول مرتين( )
আমি আশ্চর্য হই বনী আদমকে নিয়ে, যে প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে দুইবার আগমন করল, সে কিভাবে অহংকার করে।
হযরত মালেক ইবন দীনার রহমাতুল্লাহি বলেন,
لْأَصْمَعِيُّ عَنْ أَبِيهِ ، قَالَ : مَرَّ الْمُهْلَّبُ عَلَى مَالِكِ بْنِ دِينَارٍ مُتَبَخْتِرًا ، فَقَالَ : أَمَا عَلِمْتَ أَنَّهَا مِشْيَةٌ يَكْرَهُهَا اللهُ إِلَّا بَيْنَ الصَّفَّيْنِ ؟ ! فَقَالَ الْمُهَلَّبُ : أَمَا تَعْرِفُنِي ؟ قَالَ : بَلَى ، أَوَّلُكَ نُطْفَةٌ مَذِرَةٌ ، وَآخِرُكَ جِيفَةٌ قَذِرَةٌ ، وَأَنْتَ فِيمَا بَيْنَ ذَلِكَ تَحْمِلُ الْعَذِرَةَ . فَانْكَسَرَ ، وَقَالَ : الْآنَ عَرَفْتَنِي حَقَّ الْمَعْرِفَةِ ..( )
হযরত মালেক ইবন দীনার রহমাতুল্লাহি আলইহি ইয়াযিদ ইবনে মাহলাবকে দেখলেন, সে তার পরিধেয় নিয়ে অহংকার করছে। তখন হযরত মালেক ইবন দীনার রহমাতুল্লাহি আলায়হি বললেন, তোমার এ হাঁটাকে আল্লাহ তা‘আলা অপছন্দ করে। এ কথা শুনে মাহলাব বলল, তুমি কি আমাকে চিন না? তখন তিনি বললেন, হাঁ আমি তোমাকে চিনি, তোমার শুরু হল, এক ফোটা নাপাক বীর্য, আর তোমার শেষ হল, দুর্গন্ধময় লাশ, আর এ দুটির মাঝে তুমি একজন পায়খানা ও ময়লা বহনকারী।( )

দুই. অহংকারের বস্তুসমূহ নিয়ে চিন্তা করা
যে সব বস্তু নিয়ে অহংকার করে তা নিয়ে চিন্তা ফিকির করা এবং মেনে নেয়া যে তার জন্য এসব বস্তু নিয়ে অহংকার করা উচিত নয়। কেউ যদি তার বংশ মর্যাদা নিয়ে অহংকার করে, তখন তাকে বুঝতে হবে যে এটি একটি মূর্খতা বৈ কিছুই হতে পারে না। কারণ, সে তো তার নিজের ভিতরের কোন যোগ্যতা নিয়ে অহংকার করছে না। সে অহংকার করছে অন্যদের যোগ্যতা নিয়ে, যা একেবারেই বিবেক ও বুদ্ধিহীন কাজ।
عن أبي بن كعب قال: انتَسَب رجلانِ على عهدِ رسولِ اللهِ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم فقال أحدُهما أنا فلانُ بنُ فلانٍ فمَن أنتَ لا أمَّ لك فقال رسولُ اللهِ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم انْتَسَب رجلان عَلى عَهْدِ مُوَسى عَلَيْهِ السَّلام فَقَالَ أَحَدهَما: أَنَا فُلَانُ بنُ فُلَانٍ حَتى عَدَّ تسعَةً فَمَنْ أَنْتَ لَا أُمَّ لَكَ، قَالَ: أَنَا فُلَانُ بنُ فُلَانٍ ابْنُ الْإِسْلَامِ، قَالَ: فَأْوحَى الله إلَى مُوَسى عَلَيْهِ السَّلَام أَنَّ هَذَيْنِ المُنْتَسَبيْن أَمَّا أَنْتَ أَيُّهَا المُنْتَمِي أَوْ المُنْتَسِبُ إلِى تسْعَة فِي النَّارِ فَأَنْتَ عَاشُرهمْ، وَأمَّا أَنْتَ يَا هَذَا المُنْتَسِبُ إِلَى اثْنيَن في الجَنَّةِ فَأنتَ ثَالثِهُمَا فِي الجَنَّةِ( )
উবাই ইবনে কা’ব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে দুই লোক বংশ নিয়ে বিবাদ করে। অতঃপর তাদের একজন বলল, আমি অমুকের ছেলে অমুক তুমি কে? তোমার কোন মূল বা আসল তথা বংশীয় পরিচিতি নেই। তাদের বিবাদ শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হযরত মুসা আলাইহিস সালামের যুগে দুই ব্যক্তি বংশ নিয়ে ঝগড়া করে। তখন তাদের একজন অপর জনকে বলে, আমি অমুকের ছেলে অমুক, অমুকের ছেলে অমুক, এভাবে সে তার নয় পুরুষ পর্যন্ত গণনা করে, আর বলে তুমি কে? তোমার কোন মূল বা আসল তথা বংশীয় পরিচিতি নেই। তখন সে বলল, আমি অমুকের ছেলে অমুক, আর অমুক হল ইসলামের ছেলে। তিনি বলেন, তাদের বিতর্কের কারণে আল্লাহ তা‘আলা হযরত মুসা আলাইহিস সালামকে ওহী দিয়ে পাঠান যে, আপনি এ দুই ব্যক্তি যারা বংশ নিয়ে বিবাদ করছে তাদের বলুন, হে নয় পর্যন্ত গণনাকারী! তুমি যে নয় জনের নাম উল্লেখ করেছ, তারা সবাই জাহান্নামে, আর তুমি হলে তাদের দশম ব্যক্তি। আর অপর ব্যক্তিকে বলুন, হে দুই পুরুষ পর্যন্ত গণনাকারী তুমি যে দুইজনের নাম নিলে তারা উভয়ে জান্নাতী আর তুমি হলে তৃতীয় ব্যক্তি।( )
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ قَدْ أَذْهَبَ عَنْكُمْ عُبِّيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ، وَفَخْرَهَا بِالْآبَاءِ مُؤْمِنٌ تَقِيٌّ، وَفَاجِرٌ شَقِيٌّ، أَنْتُمْ بَنُو آدَمَ وَآدَمُ مِنْ تُرَابٍ، لَيَدَعَنَّ رِجَالٌ فَخْرَهُمْ بِأَقْوَامٍ، إِنَّمَا هُمْ فَحْمٌ مِنْ فَحْمِ جَهَنَّمَ، أَوْ لَيَكُونُنَّ أَهْوَنَ عَلَى اللهِ مِنَ الْجِعْلَانِ الَّتِي تَدْفَعُ بِأَنْفِهَا النَّتِنَ( )
হযরত আবু হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের থেকে জাহিলি যুগের কুসংস্কার ও বাপ-দাদাদের নিয়ে অহংকার করাকে দূর করে দিয়েছেন। মানুষ দু’ধরনের: একজন ঈমানদার মুত্তাকী ব্যক্তি, আর অন্যজন দূরাচার দুর্ভাগা ব্যক্তি। সমগ্র মানুষ আদম আলাইহিস সালামের সন্তান, আর আদম আলাইহিস সালাম হলেন, মাটির তৈরি। আল্লাহর শপথ করে বলছি, এমন এক সম্প্রদায়ের আগমন ঘটবে যারা তাদের বংশের লোকদের নিয়ে অহংকার করবে। অথচ তারা জাহান্নামের কয়লা হতে একরকম কয়লা অথবা তারা আল্লাহ তা‘আলার নিকট নাক পরিস্কার করার ছেঁড়া কাপড়ের চেয়েও আরও অধিক নিকৃষ্ট। ( )
যে ব্যক্তি ইলমের কারণে অহংকার করে, তাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, যারা আহলে ইলম তাদের উপর আল্লাহ তা‘আলার পাকড়াও আরও অধিক কঠিন। আর যে ব্যক্তি ইলম থাকা সত্বেও আল্লাহর নাফরমানি করে তাকে মনে রাখতে হবে তার অপরাধ খুবই মারাত্মক।
আর একজন অহংকারীকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, অহংকার কেবল আল্লাহ তা‘আলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর কারো জন্য অহংকার প্রযোজ্য নয়। যখন কোন ব্যক্তি অহংকার করে, তখন সে আল্লাহর নিকট ঘৃণিত ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হবে। এসব চিন্তা যদি একজন মানুষ করে তাহলে তার মধ্যে অহংকার থাকতে পারে না। তাকে বিনয়ের দিকে টেনে নিয়ে যাবে।
একটি কথা মনে রাখতে হবে, ইবাদত বন্দেগী ও নেক আমল নিয়ে অহংকার করা মানুষের জন্য একটি বড় ধরনের ফিতনা। এ বিষয়ে হাদিসে একটি ঘটনা বর্ণিত,
عَنْ عِكْرِمَةَ بْنِ عَمَّارٍ قَالَ حَدَّثَنِي ضَمْضَمُ بْنُ جَوْسٍ قَالَ قَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ كَانَ رَجُلَانِ فِي بَنِي إِسْرَائِيلَ مُتَوَاخِيَيْنِ فَكَانَ أَحَدُهُمَا يُذْنِبُ وَالْآخَرُ مُجْتَهِدٌ فِي الْعِبَادَةِ فَكَانَ لَا يَزَالُ الْمُجْتَهِدُ يَرَى الْآخَرَ عَلَى الذَّنْبِ فَيَقُولُ أَقْصِرْ فَوَجَدَهُ يَوْمًا عَلَى ذَنْبٍ فَقَالَ لَهُ أَقْصِرْ فَقَالَ خَلِّنِي وَرَبِّي أَبُعِثْتَ عَلَيَّ رَقِيبًا فَقَالَ وَاللهِ لَا يَغْفِرُ اللهُ لَكَ أَوْ لَا يُدْخِلُكَ اللهُ الْجَنَّةَ فَقَبَضَ أَرْوَاحَهُمَا فَاجْتَمَعَا عِنْدَ رَبِّ الْعَالَمِينَ فَقَالَ لِهَذَا الْمُجْتَهِدِ أَكُنْتَ بِي عَالِمًا أَوْ كُنْتَ عَلَى مَا فِي يَدِي قَادِرًا وَقَالَ لِلْمُذْنِبِ اذْهَبْ فَادْخُلْ الْجَنَّةَ بِرَحْمَتِي وَقَالَ لِلْآخَرِ اذْهَبُوا بِهِ إِلَى النَّارِ قَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَتَكَلَّمَ بِكَلِمَةٍ أَوْبَقَتْ دُنْيَاهُ وَآخِرَتَهُ( )
হযরত আবু হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি বলেন, বনী ইসরাইলের মধ্যে দুইজন লোক ছিল, তারা একে অপরের বন্ধু। তাদের একজন গুনাহ করত আর অপরজন ইবাদতে লিপ্ত থাকত। যে লোকটি ইবাদতে লিপ্ত থাকতো সে সব সময় দেখত তার অপর ভাই গুনাহে মগ্ন। তখন সে তাকে বলত, তুমি গুনাহের কাজ ছেড়ে দাও! কিন্তু সে তার কথা শুনত না। তারপর একদিন তাকে গুনাহ করতে দেখে বলল, তুমি গুনাহ করো না গুনাহ হতে বিরত থাক! সে তার কথায় কোন ভ্রুক্ষেপ করল না এবং বলল, তুমি আমাকে আমার মত করে চলতে দাও। আমি এবং আমার রবের মাঝে আমাকে ছেড়ে দাও। তুমি কি আমার দায়িত্বশীল হিসেবে দুনিয়াতে প্রেরিত? তখন সে রাগ হয়ে তাকে বলল, আল্লাহর শপথ করে বলছি আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে ক্ষমা করবে না। অথবা বলল, আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে না। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের উভয়ের রুহকে কবজ করল, তারা উভয়ে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে একত্র হল, আল্লাহ তা‘আলা ইবাদতে যে লোকটি লিপ্ত থাকতো তাকে বললেন, তুমি কি আমার সম্পর্কে জান? অথবা বললেন, তুমি কি আমার হাতে কি আছে তা করার ক্ষমতা রাখ? আর অপরাধীকে বললেন, তুমি আমার রহমতের বদৌলতে জান্নাতে প্রবেশ কর! আর অপরজনের বিষয়ে ফেরেশতাদের ডেকে বললেন, তোমরা তাকে জাহান্নামে নিয়ে যাও এবং তাতে তাকে নিক্ষেপ কর। হযরত আবু হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি ঐ সত্ত্বার কসম করে বলছি, সে এমন একটি কথা বলল, যার দ্বারা দুনিয়া ও আখিরাতকে বরবাদ করে দিল।( )
আর আল্লাহ তা‘আলা যারা কল্যাণের প্রতি অগ্রগামী তাদের বিষয়ে বলেন, তারা হলেন, যারা ইবাদত ও আমলে সালেহ করেন আর ভয় করেন যে, তা তাদের থেকে কবুল করা হবে না। আল্লাহ তা‘আলা তাদের বিষয়ে এরশাদ করেন,
وَ الَّذِیْنَ یُؤْتُوْنَ مَاۤ اٰتَوْا وَّ قُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ اَنَّهُمْ اِلٰى رَبِّهِمْ رٰجِعُوْنَۙ(۶۰) اُولٰٓىٕكَ یُسٰرِعُوْنَ فِی الْخَیْرٰتِ وَ هُمْ لَهَا سٰبِقُوْنَ(۶۱)
আর যারা যা দান করে তা ভীত-কম্পিত হৃদয়ে করে থাকে এজন্য যে, তারা তাদের রবের দিকে প্রত্যাবর্তনশীল। তারাই কল্যাণসমূহের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে এবং তাতে তারা অগ্রগামী। [মু’মিনূন: ৬০-৬১] عن عائشة رضي الله عنها قالت: سَأَلْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ هَذِهِ الْآيَةِ: وَالَّذِينَ يُؤْتُونَ مَا آتَوْا وَقُلُوبُهُمْ وَجِلَةٌ قَالَتْ عَائِشَةُ: أَهُمْ الَّذِينَ يَشْرَبُونَ الْخَمْرَ وَيَسْرِقُونَ ؟ قَالَ: لَا يَا بِنْتَ الصِّدِّيقِ. وَلَكِنَّهُمْ الَّذِينَ يَصُومُونَ وَيُصَلُّونَ وَيَتَصَدَّقُونَ وَهُمْ يَخَافُونَ أَنْ لَا يُقْبَلَ مِنْهُمْ أُولَئِكَ الَّذِينَ يُسَارِعُونَ فِي الْخَيْرَاتِ ( )
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে وَالَّذِينَ يُؤْتُونَ مَا آتَوْا وَقُلُوبُهُمْ وَجِلَةٌ এ আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে বলি তারা কী ঐ সব লোক যারা মদ পান করে এবং চুরি করে? তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, না, হে সিদ্দিক কন্যা! তারা হল, যারা রোযা রাখে, সালাত আদায় করে এবং সদকা করে তবে তারা আশংকা করে যে, তাদের আমল আল্লাহ তা‘আলা কবুল করবে না। এরা তারাই যারা কল্যাণকর কাজে অগ্রসর।( )

তিন. দো‘আ করা ও আল্লাহর নিকট সাহায্য চাওয়া
দো‘আ ও আল্লাহর নিকট সাহায্য চাওয়া হল, অহংকার থেকে বাঁচার জন্য সব চেয়ে উপকারী ও কার্যকর ঔষধ। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা যাদের হেফাযত করেন, তারাই অহংকার থেকে বাঁচতে পারে। আর আল্লাহর সাহায্য ছাড়া বাঁচার কোন উপায় নাই। এ কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতদের দো‘আ শিখিয়ে দেন এবং তিনি নিজেও নামায শেষে বেশি বেশি করে আল্লাহর নিকট দো‘আ-মুনাজাত করেন।
عَنِ ابْنِ جُبَيْرِ بْنِ مُطْعِمٍ، عَنْ أَبِيهِ، أَنَّهُ رَأَى رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يُصَلِّي صَلاَةً قَالَ عَمْرٌو لاَ أَدْرِي أَىَّ صَلاَةٍ هِيَ فَقَالَ ‏”‏ اللهُ أَكْبَرُ كَبِيرًا اللهُ أَكْبَرُ كَبِيرًا اللهُ أَكْبَرُ كَبِيرًا وَالْحَمْدُ لِلّٰهِ كَثِيرًا وَالْحَمْدُ لِلّٰهِ كَثِيرًا وَالْحَمْدُ لِلّٰهِ كَثِيرًا وَسُبْحَانَ اللهِ بُكْرَةً وَأَصِيلاً ‏”‏ ‏.‏ ثَلاَثًا ‏”‏ أَعُوذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ مِنْ نَفْخِهِ وَنَفْثِهِ وَهَمْزِهِ ‏”‏ ( )
হযরত যুবাইর ইবনে মুতয়েম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একবার সালাত আদায় করতে দেখেন, তখন তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাতে এ কথাগুলো বলতে শোনেন।
اللهُ أَكْبَرُ كَبِيرًا اللهُ أَكْبَرُ كَبِيرًا اللهُ أَكْبَرُ كَبِيرًا وَالْحَمْدُ لِلّٰهِ كَثِيرًا وَالْحَمْدُ لِلّٰهِ كَثِيرًا وَالْحَمْدُ لِلّٰهِ كَثِيرًا وَسُبْحَانَ اللهِ بُكْرَةً وَأَصِيلاً ‏”‏ ‏.‏ ثَلاَثًا ‏”‏ أَعُوذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ مِنْ نَفْخِهِ وَنَفْثِهِ وَهَمْزِهِ ‏
“আল্লাহ তা‘আলা মহান সব কিছু হতে বড়, আল্লাহ তা‘আলা মহান সব কিছু হতে বড়, আল্লাহ তা‘আলা মহান সব কিছু হতে বড়। আর সর্বাধিক প্রশংসা কেবলই আল্লাহর, সর্বাধিক প্রশংসা কেবলই আল্লাহর, সর্বাধিক প্রশংসা কেবলই আল্লাহর। আমি বিতাড়িত শয়তান হতে তোমার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি, আমি আরও আশ্রয় চাচ্ছি তার অহংকার থেকে তার প্ররোচনা থেকে ও ষড়যন্ত্র থেকে”।( )

চার. বিনয় অবলম্বন করা
عن أنس رضي الله عنه أنه قَالَ: ” إِنْ كَانَتِ الأَمَةُ مِنْ إِمَاءِ أَهْلِ المَدِينَةِ، لَتَأْخُذُ بِيَدِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَتَنْطَلِقُ بِهِ حَيْثُ شَاءَتْ( ) ” .
হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মদিনার অনেক কৃতদাস-দাসীদের দেখা যেত, যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাত ধরে তাঁকে তাদের ইচ্ছামত এদিক সেদিক নিয়ে যেত।(
عَنْ إِبْرَاهِيمَ، عَنِ الأَسْوَدِ، قَالَ: سَأَلْتُ عَائِشَةَ مَا كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصْنَعُ فِي بَيْتِهِ ؟ قَالَتْ: كَانَ يَكُونُ فِي مِهْنَةِ أَهْلِهِ – تَعْنِي خِدْمَةَ أَهْلِهِ – فَإِذَا حَضَرَتِ الصَّلاَةُ خَرَجَ إِلَى الصَّلاَةِ ( )
হযরত আসওয়াদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞাসা করি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে কি কাজ করতেন? তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরের মধ্যে তাঁর পরিবারের কাজে সহযোগীতা করতেন, যখন সালাতের সময় হত, তখন তিনি সালাতের জন্য বের হয়ে যেতেন।( )
একই অর্থের অপর একটি হাদিস ইমাম তিরমিযি আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে নকল করেন। আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন,
وقد سئلت عَائِشَة رضي الله عنها: ” مَا كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعْمَلُ فِي بَيْتِهِ؟ فقَالَتْ: كَانَ بَشَرًا مِنَ الْبَشَرِ يَفْلِي ثَوْبَهُ، وَيَحْلُبُ شَاتَهُ، وَيَخْدُمُ نَفْسَهُ ” ( )
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যান্য সাধারণ মানুষের মত একজন মানুষ হিসেবে জীবনযাপন করতেন, তিনি নিজের কাপড় মুবারক নিজেই সিলাই করতেন, বকরীর দুধ দোহন করতেন এবং নিজের কাজ নিজে করতেন, ।( )
আর আহমদ ও ইবনে হাব্বান ওরওয়া হতে এবং ওরওয়া আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেন,
كَانَ يَخِيطُ ثَوْبَهُ، وَيَخْصِفُ نَعْلَهُ، وَيَعْمَلُ مَا يَعْمَلُ الرِّجَالُ فِي بُيُوتِهِمْ “( )
তিনি নিজে নিজের কাপড় মুবারক সিলাই করতেন এবং নিজ বরকতময় জুতায় তালি লাগাতেন এবং পুরুষলোকেরা ঘরে যা যা করে থাকে তিনিও তাই করতেন।
হাদিসে অহংকার ছেড়ে দেয়া, বিনয় অবলম্বন করা ও পরিবারের খেদমত করার প্রতি বিশেষ উৎসাহ দেয়া হয়।
عَنِ الْقَاسِمِ بْنِ عَبَّاسٍ، عَنْ نَافِعِ بْنِ جُبَيْرِ بْنِ مُطْعِمٍ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ تَقُولُونَ لِي فِيَّ التِّيهُ وَقَدْ رَكِبْتُ الْحِمَارَ وَلَبِسْتُ الشَّمْلَةَ وَقَدْ حَلَبْتُ الشَّاةَ وَقَدْ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ مَنْ فَعَلَ هَذَا فَلَيْسَ فِيهِ مِنَ الْكِبْرِ شَيْءٌ ‏”‏ ( )
হযরত যুবাইর ইবনে মুতয়েম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, তোমরা বল, আমার মধ্যে অহংকার আছে! অথচ আমি গাধায় আরোহণ করেছি, বস্তা পরিধান করেছি এবং বকরীর দুধ দোহন করেছি। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি এ ধরনের কাজ করে তার মধ্যে কোন অহংকার থাকতেই পারেনা।( )
অহংকারী এ ধরনের কোন কাজ করতে পছন্দ করে না। তারা এ ধরনের কাজ হতে নাক ছিটকায়। সুতরাং, যে এ ধরনের কাজগুলো করে তার মধ্যে অহংকার না থাকাই বাঞ্ছনীয়।
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ سَلَامٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّهُ مَرَّ فِي السُّوقِ ، وَعَلَيْهِ حُزْمَةٌ مِنْ حَطَبٍ ، فَقِيلَ لَهُ : مَا يَحْمِلُك عَلَى هَذَا ، وَقَدْ أَغْنَاك اللهُ عَنْ هَذَا ؟ قَالَ : أَرَدْت أَنْ أَدْفَعَ الْكِبْرَ سَمِعْت رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ خَرْدَلَةٍ مِنْ كِبْرٍ
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম হতে বর্ণিত, তিনি একদিন বাজার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন আর তার মাথার উপর একটি লাকড়ির বোঝা। তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, তুমি কি কারণে মাথায় বোঝা বহন করছ? অথচ আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে এসব করার প্রতি মুখাপেক্ষী রাখেননি বরং তোমাকে এসব হতে মুক্ত করেছেন! তিনি বললেন, আমি আমার অন্তর থেকে অহংকারকে দুর করতে চাই। আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি বলেন, ঐ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার অন্তরে একবিন্দু পরিমাণও অহংকার থাকে।( )

যে অহংকার শোভনীয়
যখন মানুষ মিথ্যা ছেড়ে সত্যের অনুসারী হয়, তখন সে তার জন্য অহংকার করতে পারে। যেমন ,

কুফর ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করা
যখন কোন ব্যক্তি বাতিল ফিরক্বাহ ছেড়ে দিয়ে আহলে সুন্নাত ওয়া জামাতের অন্তর্ভুক্ত হয়, তখন সে ঐ জামা‘আতের উপর গর্ব করতে পারে। যেমন হযরত ছওবান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
لاَ تَزَالُ طَائِـفَةٌ مِنْ أُمَّتِى ظَاهِرِيْنَ عَلَى الْحَقِّ لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى يَأْتِىَ أَمْرُ اللهِ وَ هُمْ كَذَالِكَ.
‘চিরদিন আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল হক্বের উপরে বিজয়ী থাকবে। পরিত্যাগকারীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এমতাবস্থায় ক্বিয়ামত এসে যাবে, অথচ তারা ঐভাবে থাকবে’।( )
আর ক্বিয়ামত পর্যন্ত ঐ হকপন্থী জামা‘আত হ’ল ‘আহলে সুন্নাত ওয়া জামাতের’।( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
عَلَيْكُمْ بِالجَمَاعَةِ وَإِيَّاكُمْ وَالفُرْقَةَ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ مَعَ الوَاحِدِ وَهُوَ مِنَ الِاثْنَيْنِ أَبْعَدُ، مَنْ أَرَادَ بُحْبُوحَةَ الجَنَّةِ فَلْيَلْزَمُ الجَمَاعَةَ،
তোমরা জামা‘আত (‘আহলে সুন্নাত ওয়া জামাত)কে আঁকড়ে ধর, বিচ্ছিন্ন হয়ো না, কেনন শয়তান একা তথা বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির সাথে থাকে কিন্তু সে দু’জন থেখে অনেক দুরে থাকে। যে ব্যক্তি জান্নাতের মধ্যস্থলে থাকতে চায়, সে যেন জামা‘আতবদ্ধ জীবনকে অপরিহার্য করে নেয়’।( )

হকপন্থী দলের নামে অহংকার
যেমন হোনায়েনের যুদ্ধের দিন বিপর্যয়কর অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হুকুমে উচ্চ কণ্ঠের অধিকারী হযরত আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হোদায়বিয়ার বৃক্ষতলে মৃত্যুর উপরে বায়‘আত গ্রহণকারী ছাহাবীদের ডেকে বলেন,
أَيْنَ أَصْحَابُ السَّمُرَةِ ‘সামুরা বৃক্ষের সাথীরা কোথায়? يَا مَعْشَرَ الأَنْصَارِ ‘হে আনছারগণ!
একইভাবে বাতিলের অন্ধকারে আহলে সুন্নাত ওয়া জামাতের পরিচয় নিঃসন্দেহে সত্যের অহংকার। যা কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ।

উচ্চ বংশের অহংকার:
যেমন একই যুদ্ধে একই অবস্থায় নিজ বাহনের পিঠ থেকে অবতরণ করে তেজস্বী কণ্ঠে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে ওঠেন,
أَنَا النَّبِىُّ لاَ كَذِبْ + أَنَا ابْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبْ
‘আমি নবী, মিথ্যা নই। আমি আব্দুল মুত্ত্বালিবের পুত্র’।( )
খ্রিষ্টানদের সাথে সন্ধির জন্য তাদের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী সেখানে খলীফাকে উপস্থিত হওয়ার জন্য বায়তুল মুক্বাদ্দাস সফরকালে খলীফা হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যখন একাকী খালি পায়ে উটের লাগাম ধরে হাঁটতে শুরু করেন, তখন সাথী হযরত আবু ওবায়দাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এতে আপত্তি করেন। জবাবে হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
إِنَّا كُنَّا أَذَلَّ قَوْمٍ فَأَعَزَّنَا اللهُ بِالْإِسْلاَمِ فَمَهْمَا نَطْلُبُ الْعِزَّةَ بِغَيْرِ مَا أَعَزَّنَا اللهُ بِهِ أَذَلَّنَا اللهُ
‘আমরা ছিলাম নিকৃষ্ট জাতি। অতঃপর আল্লাহ আমাদেরকে ইসলামের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। অতএব যে কারণে আল্লাহ আমাদের মর্যাদা দান করেছেন, তা ছেড়ে অন্য কিছুর মাধ্যমে সম্মান তালাশ করলে আল্লাহ আমাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন।’
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
إِناَّ قَوْمٌ أَعَزَّنَا اللهُ بِالْإِسْلاَمِ، فَلَنْ نَبْتَغِيْ الْعِزَّ بِغَيْرِهِ
‘আমরা সেই জাতি যাদেরকে আল্লাহ ইসলামের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। এর বাইরে অন্য কিছুর মাধ্যমে আমরা সম্মান চাই না’।( )
উপসংহার
মানুষকে তুচ্ছ মনে করা, হেয় প্রতিপন্ন করা, মানুষের ওপর ধন-দৌলত ও বংশ-মর্যাদার দাম্ভিকতা এবং সত্যকে গ্রহণ না করে অন্যায়ভাবে বিতর্ক করা অহংকারেরই নানান রূপ। নিজেকে অন্যের চাইতে শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাবান এবং অন্যকে ছোট ও তুচ্ছ মনে করার নাম তাকাব্বুরি বা অহংকার।
অহংকার শয়তানের বৈশিষ্ট্য। সেই অভিশপ্ত ইবলিস শয়তান, যে সর্বপ্রথম আল্লাহ তাআ’লা ও তাঁর সৃষ্টির সাথে অহংকার করেছিল। অহংকার এমন বিষয়, যা আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্য কারও জন্য শোভা পায় না।
গর্ব-অহংকার দুনিয়ার মধ্যে একটি নিকৃষ্ট স্বভাব, যা মানুষের সকল পুণ্য কাজ ধ্বংস করে দেয়। শয়তান কম ইবাদত করেনি কিন্তু তার ইবাদতসমূহ অহংকারের কারণেই ধ্বংস হয়ে যায় এবং শয়তান হয়ে গেল সর্বকালের সর্বাধিক অভিশপ্ত ব্যক্তি। শয়তানের মত অহংকার অনেক কুস্বভাবের জন্ম দেয়। অহংকার জ্ঞানী ব্যক্তির জ্ঞান ধ্বংস করে। কত রাজা-বাদশাহর রাজত্ব অহংকারের কারণে মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে ভিখারী হয়ে গেছে তার কোন ইয়াত্তা নেই।
অহংকার একটি খারাপ গুণ। এটি ইবলিস ও দুনিয়ায় তার সৈনিকদের বৈশিষ্ট্য; আল্লাহ যাদের অন্তর আলোহীন করে দিয়েছেন তারাই অহংকার করে। তাই অহংকার ইবলিসি চরিত্র। যে ব্যক্তি অহংকার করতে চায় সে জেনে রাখুক সে শয়তানের চরিত্র গ্রহণ করেছে। সে সম্মানিত ফেরেশতাদের চরিত্র গ্রহণ করেনি, যারা আল্লাহর আনুগত্য করে সেজদায় লুটিয়ে পড়েছিল।
অহংকার যা শুধু আল্লাহর জন্যই প্রযোজ্য। যে ব্যক্তি এ গুণ নিয়ে আল্লাহর সাথে টানাটানি করে আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দেন, তার প্রতাপ নস্যাৎ করে দেন ও তার জীবনকে সংকুচিত করে দেন। যে ব্যক্তি মানুষের উপর অহংকার করে কিয়ামতের দিন তাকে মানুষের পায়ের নীচে মাড়ানো হবে।
কোন তাক্ওয়াবান ব্যক্তি অহংকার করতে পারে না। অহংকার তারাই করে যারা আহমক। অহংকারকারী যদি জানতো অহংকারের মধ্যে ধ্বংস লুকিয়ে রয়েছে তাহলে সে কোনদিন অহংকার করতো না। অহংকার যেমন মানুষের দ্বীন-ধর্ম বরবাদ করে তেমনি বুদ্ধি-চিন্তা, মানসম্মান বিদায় করে। নিম্ন চিন্তার মানুষের কাছে অহংকার থাকে। অভিজাত তারাই যাদের কাছে বিনয় আছে। যাঁর যত জ্ঞান সে তত বিনয়ী। দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘এ পৃথিবীতে সবাই বোকা, আমিও বোকা, কিন্তু আমি যে বোকা তা আমি বুঝি, ওরা যে বোকা ওরা তো বুঝে না, ওরা ও আমার মধ্যে এই পার্থক্য।’
হাফেয যাহাবী বলেন, অহংকারের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম প্রকার হ’ল ইলমের অহংকার। কেননা তার ইলম তার কোন কাজে আসেনা। যে ব্যক্তি আখেরাতের জন্য জ্ঞানার্জন করে, জ্ঞান তার অহংকারকে চূর্ণ করে দেয় এবং তার অন্তর আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকে। যে নিজেকে হীন মনে করে এবং সর্বদা নিজের হিসাব নিয়ে সন্ত্রস্ত থাকে। একটু উদাসীন হ’লেই ভাবে এই বুঝি ছিরাতে মুস্তাক্বীম থেকে বিচ্যুত হ’লাম ও ধ্বংস হয়ে গেলাম। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইলম শিখে গর্ব করার জন্য ও নেতৃত্ব লাভের জন্য, সে অন্যের উপর অহংকার করে ও তাদেরকে হীন মনে করে। আর এটিই হ’ল সবচেয়ে বড় অহংকার । আর ঐ ব্যক্তি কখনই জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার রয়েছে। লা হাওলা অলা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।
পরিশেষে বলব, জাত-পাত, দল-মত ও যাবতীয় মিথ্যার অহংকার ছেড়ে আল্লাহ প্রেরিত মহাসত্যের দিকে ফিরে আসা এবং কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ করা আল্লাহর সৃষ্টি হিসাবে প্রত্যেক মানুষের জন্য অবশ্য কর্তব্য। বান্দার কোন অহংকার থাকলে তা হবে কেবল সত্যের অহংকার। অন্য কিছুর জন্য নয়। আল্লাহ এরশাদ করেন,
إِنَّمَا يُؤْمِنُ بِآيَاتِنَا الَّذِينَ إِذَا ذُكِّرُوا بِهَا خَرُّوا سُجَّداً وَسَبَّحُوا بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُونَ.
‘আমাদের আয়াত সমূহে কেবল তারাই (প্রকৃত) ঈমান আনে, যখন তারা উক্ত আয়াত সমূহ দ্বারা উপদেশপ্রাপ্ত হয়, তখন তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের প্রতিপালকের প্রশংসা জ্ঞাপন করে এমন অবস্থায় যে, তারা কোনরূপ অহংকার প্রদর্শন করে না’ [সাজদাহ ৩২/১৫] ( )
মহান আল্লাহ তাআ’লা অহংকারীকে পছন্দ করেন না। অহংকারের পরিণাম ধ্বংস এবং জাহান্নাম। ইলম-আমল, জ্ঞান-গরিমা, অর্থ-সম্পদ, ইজ্জত-সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি, বংশ-মর্যাদা, ইবাদত-উপাসনা ইত্যাদি যে কোনো বিষয়ে নিজেকে বড় মনে করা এবং অন্যকে তুচ্ছ ও নগণ্য মনে করাকে অহংকার বলা হয়।
সমাজের শান্তি, সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধির বড় অন্তরায় হলো অহংকার, যা মানুষের ইহকাল-পরকালকে ধ্বংস করে। ধ্বংস করে মানুষের মনুষ্যত্ব, জাগিয়ে তোলে হিংস্রতা। সর্বোপরি অহংকার মানুষের পতন ত্বরান্বিত করে। তাই তো বলা হয়, অহংকার পতনের মূল। আল্লাহ তাআ’লা আমাদের অহংকার নামক ধ্বংসব্যাধি থেকে হেফাজত করুন।
আমরা আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি যে, তিনি যেন আমাদের ঐ সব লোকদের অন্তর্ভুক্ত করেন যারা আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আওলিয়ায়ে কেরাম, বুযুর্গানে দীন ও মাখলুকের প্রতি বিনয়ী। আর আমাদের যেন অহংকার ও অহংকারীদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে হেফাযত করেন।
এভাবে আল্লাহ তাআলা অহংকারের কারণে তাকে লাঞ্ছিত করবেন।
যে ব্যক্তি অহংকার করতে চায় ও বড়ত্ব দেখাতে চায় আল্লাহ তাকে নীচে ছুড়ে ফেলে দেন ও বেইজ্জত করেন। যেহেতু সে তার মূলপরিচয়ের বিপরীতে গিয়ে কিছু করার চেষ্টা করেছে তাই আল্লাহ তাকে তার ইচ্ছার বিপরীতে শাস্তি দিয়ে দেন।
বংশের নেতারা বড়াই করেন তাদের আভিজাত্য নিয়ে। নারীরা অহংকার করে তাদের সৌন্দর্য নিয়ে, ধনীরা অহংকার করে তাদের ধন নিয়ে, আলেমরা অহংকার করেন তাদের ইলম ও অনুসারী দল নিয়ে, দলনেতারা অহংকার করেন তাদের দল নিয়ে, রাষ্ট্রনেতারা অহংকার করেন তাদের শক্তি ও ক্ষমতা নিয়ে। অথচ সব অহংকারই ধূলায় মিশে যাবে আল্লাহর একটি ‘কুন’ শব্দে।
অতএব হে মানুষ! অহংকারী হয়ো না, বিনয়ী হও। উদ্ধ্যত হয়ো না, কৃতজ্ঞ হও। অতীত ভুলো না, সামনে তাকাও। জন্মের আগে তুমি কিছুই ছিলে না, আবার হতে পারে তুমি হিসাবযোগ্য কিছুই থাকবে না। অতএব অহংকার করো না।
নিজেকে অন্য দশজন মানুষের মত মনে করা। অন্যসব লোককে নিজের সমতুল্য মনে করা। তারাও এক বাপ-মা থেকে জন্মগ্রহণ করেছে। যেভাবে আমিও এক বাপ-মা এর ঘরে জন্মগ্রহণ করেছি তখনই আপনি কিছুটা হলেও অহংকার ত্যাগে অভ্যস্ত হবেন।
আল্লাহ আমাদেরকে মিথ্যা অহমিকা ও তার কুফল হ’তে রক্ষা করুন- আমীন!

تمت باالخير
—সমাপ্ত —

অহংকার পতনের মূল

Share:

1 Comment

  1. Md. Joynal Abedin

    Says Rabi Al Thani 12, 1444 at 1:13 am

    Alhamdulillah

Leave Your Comment