মানবজাতি নিজ অস্তিত্ব, স্থায়িত্ব ও সকল কার্যক্রমে মহান আল্লাহরই মুখাপেক্ষী

মানবজাতি নিজ অস্তিত্ব, স্থায়িত্ব ও সকল কার্যক্রমে মহান আল্লাহরই মুখাপেক্ষী

হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ
وَ كَانُوْا یُصِرُّوْنَ عَلَى الْحِنْثِ الْعَظِیْمِ(৪৬( وَ كَانُوْا یَقُوْلُوْنَ ﳔ اَىٕذَا مِتْنَا وَ كُنَّا تُرَابًا وَّعِظَامًا ءَاِنَّا لَمَبْعُوْثُوْنَ (৪৭) اَوَاٰبَآؤُنَا الْاَوَّلُوْنَ (৪৮( قُلْ اِنَّ الْاَوَّلِیْنَ وَالْاٰخِرِیْنَ (৪৯) لَمَجْمُوْعُوْنَ ﳔ اِلٰى مِیْقَاتِ یَوْمٍ مَّعْلُوْمٍ (৫০) ثُمَّ اِنَّكُمْ اَیُّهَا الضَّآلُّوْنَ الْمُكَذِّبُوْنَ (৫১) لَاٰكِلُوْنَ مِنْ شَجَرٍ مِّنْ زَقُّوْمٍ (৫২) فَمَالِــٴُـوْنَ مِنْهَا الْبُطُوْنَ (৫৩) فَشٰرِبُوْنَ عَلَیْهِ مِنَ الْحَمِیْمِ (৫৪) فَشٰرِبُوْنَ شُرْبَ الْهِیْمِ(৫৫)هٰذَا نُزُلُهُمْ یَوْمَ الدِّیْنِ (৫৬( نَحْنُ خَلَقْنٰكُمْ فَلَوْ لَاتُصَدِّقُوْنَ(৫৭) اَفَرَءَیْتُمْ مَّا تُمْنُوْنَ (৫৮) ءَاَنْتُمْ تَخْلُقُوْنَهٗۤ اَمْ نَحْنُ الْخٰلِقُوْنَ(৫৯) نَحْنُ قَدَّرْنَا بَیْنَكُمُ الْمَوْتَ وَمَا نَحْنُ بِمَسْبُوْقِیْنَ (৬০)عَلٰۤى اَنْ نُّبَدِّلَ اَمْثَالَكُمْ وَنُنْشِئَكُمْ فِیْ مَا لَا تَعْلَمُوْنَ (৬১)

আল্লাহ্র নামে আরম্ভ, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়
তরজমা: এবং তারা (অর্থাৎ কাফির-মুশরিকগণ) ওই মহা পাপের উপর এক গুয়ে হয়ে থাকতো। এবং তারা বলতো, যখন আমরা মরে যাবো এবং মৃত্তিকায় ও অস্থিতে পরিণত হয়ে যাবো। তখনও কি আমরা অবশ্য পুণরুত্থিত হবো? এবং আমাদের পূর্বপুরুষগণও? (ওহে রাসূল (দ.) আপনি বলুন-নিশ্চয় সব পূর্ববর্তী ও পরবর্তীগণকে। অবশ্যই একত্রিত করা হবে একটা পরিজ্ঞাত দিনের মেয়াদকালের উপর। অত:পর নিশ্চয় তোমরা, হে পথভ্রষ্ট, মিথ্যারোপকারীগণ। অবশ্যই তোমরা ‘যাক্কুম’ ব্ক্ষৃ থেকে আহার করবে। অত:পর তা হতে উদর পূর্ণ করবে। অত:পর এর উপর উত্তপ্ত-ফুটন্ত পানি পান করবে। অত:পর এমনভাবে পান করবে যেভাবে অতি পিপাসায় কাতর উট পান করে থাকে। এটা তাদের আতিথ্য বিচারের দিনে। আমি (অর্থাৎ আল্লাহ) তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি। সুতরাং তোমরা কেন সত্য স্বীকার করছো না? তোমরা কি ভেবে দেখেছো? তোমাদের বীর্যপাত সম্পর্কে ? তোমরাই কি সেটা (হতে মানুষ) সৃষ্টি করছো, না আমি (আল্লাহ) সৃষ্টিকারী? আমি তোমাদের মধ্যে মৃত্যু নির্ধারিত করেছি এবং আমি তাতে হেরে যাইনি।
সুরা আল-ওয়াকিয়াহ-৪৬ থেকে ৬০ নং আয়াত

আনুষঙ্গিক আলোচনা

قُلْ إِنَّ الْأَوَّلِينَ وَالْآخِرِينَ
উদ্ধৃত আল্লাহর মহান বাণীর ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন-সাইয়্যেদুনা হযরত আদম ছফিউল্লাহ আলায়হিস সালাম থেকে আরম্ভ করে আল্লাহর সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠতম নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শুভাগমনের পূর্ব পর্যন্ত আগমন কারীরা হলেন পূর্ববর্তী। আর হাবীবে খোদা আশারাফে আম্বিয়ার শুভার্বিভাব হতে শুরু করে কেয়ামত পর্যন্ত আগমনকারীরা হলেন পরবর্তী। অতএব আয়াতের মর্মবাণীর আলোকে প্রতীয়মান হয় যে, পৃথিবী পৃষ্ঠে ক্ষনিকের জন্য হলেও আগমনকারী পূর্বে ও পরবর্তী সকলকে হাশরের ময়দানে কেয়ামতের দিনে জমায়েত করা হবে। যেমন, সূরা আলে ইমরানে এরশাদ হয়েছে-ربنا إنك جامع الناس ليوم لا ريب فيه

অর্থাৎ ওহে আমাদের প্রতিপালক! অবশ্যই আপনি সকল মানবকে জমায়েত করবেন এমন দিনে যার আগমনে কোনরূপ সংশয় সন্দেহ নেই।
সাইয়্যেদুনা হযরত ইস্রাফিল আলায়হিস সালামের ফুৎকারে প্রথমত: পূর্ব ও পরবর্তী, মুমিন ও মুশরিক নির্বিশেষে সকল কে কেয়ামতের ময়দানে জমায়েত করা হবে। এ অর্থে এটা হাশরের ময়দান। সকলের জমায়েত স্থান। আবার মুমিন-মুসলিম কে কাফির-মুশরিকদের থেকে আলাদা করে ফেলা হবে। এ অর্থে এটা يوم الفصل অর্থাৎ মুমিন-মুশরিক পৃথক হওয়ার দিন। জাগতিক জীবনে যদিও সকলে একই দেশে একই সমাজে পরষ্পর মিলেমিশে ছিল। আজ উভয়ের মধ্যে চিরতরে পার্থক্য রেখা নিরুপন করা হলো। যেমন, এরশাদ হয়েছে- وامتازوا اليوم أيها المجرمون অর্থাৎ আজ তোমরা পৃথক হয়ে যাও হে অপরাধীরা।

‎‏ نَحْنُ خَلَقْنَاكُمْ فَلَوْلَا تُصَدِّقُونَ ‎﴿٥٧﴾‏ أَفَرَأَيْتُم مَّا تُمْنُونَ
উপরোক্ত আয়াত সমূহের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন-এই বিশ^চরাচরে যা কিছু বিদ্যমান আছে অথবা হচ্ছে অথবা ভবিষ্যতে হবে, এগুলোকে সৃষ্টি করা, স্থায়ী রাখা এবং মানুষের বিভিন্ন উপকারে নিয়োজিত করা প্রকৃতপক্ষে মহান আল্লাহর শক্তি ও রহস্যের লীলা। যদি কারণাদির যবণিকা মাঝখানে না থাকে এবং মানুষ এসব বস্তুর সৃষ্টি প্রত্যক্ষভাবে অবলোকন করে তবে সে আল্লাহর প্রতি বিশ^াস স্থাপন করতে বাধ্য হয়ে যাবে। কিন্তু মহান আল্লাহ এ জগতকে পরীক্ষাগার করেছেন। তাই এখানে যা কিছু অস্তিত্ব ও বিকাশ লাভ করে সব কারণাদির অন্তরালে বিকাশ লাভ করে।
মহান আল্লাহ পাক স্বীয় অপার শক্তি ও রহস্যের বলে কারণাদি ও ঘটনাবলীর মধ্যে এমন এক যোগসূত্র স্থাপন করে রেখেছেন যে, কারণ অস্তিত্ব লাভ করার সাথে সাথে ঘটনা অস্তিত্ব লাভ করে। কারণ ও ঘটনা যেন একটি অপরটির সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। বাহ্যদর্শন মানুষ কারণাদির এই বেড়াজালে আটকে যায় এবং সৃষ্টকর্ম কে কারণাদিও সাথে সম্বন্ধযুক্ত মনে করতে থাকে। যবনিকার অন্তরাল থেকে যে আসল শক্তি কারণ ও ঘটনাবালীকে সক্রিয় করে , তার দিকে বাহ্যদর্শী মানুষের দৃষ্টি যায় না। উদ্ধৃত প্রথম আয়াতে ‎‏ نَحْنُ خَلَقْنَاكُمْ বলে স্বয়ং মানবসৃষ্টি সম্পর্কে একটি প্রশ্ন করা হয়েছে। কারণ বেখবর মানুষ দেখে যে, পুরুষ ও নারীর যৌনমিলনের ফলে গর্ভসঞ্চার হয়। এরপর তা জননীর গর্ভাশয়ে আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং নয়মাস পর একটি পরিপূর্ণ মানবরূপে ভুমিষ্ট হয়ে যায়। এই দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার কারণে বাহ্যদর্শী মানুষের দৃষ্টি এতেই নিবদ্ধ থেকে যায় যে, পুরুষ ও নারীর পারস্পরিক মিলনই মানব সৃষ্টির প্রকৃত কারণ। তাই প্রশ্ন করা হয়েছে-أَفَرَأَيْتُم مَّا تُمْنُونَ ‎﴿٥٨﴾‏ أَأَنتُمْ تَخْلُقُونَهُ أَمْ نَحْنُ الْخَالِقُونَ
অর্থাৎ হে মানব মন্ডলী! একটু ভেবে দেখ, সন্তান জন্মলাভ করার মধ্যে তোমার হাত এতটুকুই তো যে, তুমি এক ফোটা বীর্য বিশেষ স্থানে পৌছিয়ে দিয়েছ। এরপর তোমার জানা আছে কি যে. বীর্যের উপর স্তরে কি কি পরিবর্তন আসে? কিকি ভাবে এতে অস্থি ও রক্ত-মাংস সৃষ্টি হয়? এই ক্ষুদ্র জগতের অস্তিত্বের মধ্যে খাদ্য আহরণ করায়, রক্ত তৈরী করায় ও জীবাত্মা সৃষ্টি করার কেমন যন্ত্রপাতি কি কি ভাবে স্থাপন করা হয়। এবং শ্রবণ, দর্শন, কথন, আস্বাদন ও অনুধাবন শক্তি নিহিত করা হয়, যার ফলে একটি মানুষের অস্তিত্ব একটি চলমান কারখানাতে পরিণত হয়? পিতা ও কোন খবর রাখে না যে জননীর উদরে এসব হচ্ছে সেও জানেনা। জ্ঞান বুদ্ধি বলে কোন বস্তু দুনিয়াতে থেকে থাকলে সে কেন বুঝে না যে, কোন ¯্রষ্টা ব্যতীত মানুষের অত্যাশ্চর্য ও অভাবনীয় সত্ত্বা আপনা-আপনি তৈরী হয়ে যায়নি। কে সেই ¯্রষ্টা? পিতা মাতা জানেও না যে, কি তৈরী হল। কিভাবে হল? প্রসবের পূর্ব পর্যন্ত তারা অনুমান ও করতে পারেনা যে, গর্ভ, ভ্রুণ ছেলে না মেয়ে? তবে কে সেই শক্তি, যিনি উদর, গর্ভাশয় ও ভ্রুণের উপরস্থ ঝিল্লি- এই তিন অন্ধকার প্রকোষ্টে এমন সুন্দর, সুশ্রী, শ্রবণকারী, দর্শনকারী ও অনুধাবনকারী সত্ত্বা তৈরী করে দিয়েছেন? এরূপ স্থলে যে ব্যক্তি বলে উঠে فتبارک الله احسن الخالقین অর্থাৎ (সুন্দরতম ¯্রষ্টা আল্লাহ মহান) সে জ্ঞান-বুদ্ধির শত্রু।

نَحْنُ قَدَّرْنَا بَيْنَكُمُ الْمَوْتَ وَمَا نَحْنُ بِمَسْبُوقِينَ ‎﴿٦٠﴾
আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম বর্ণনা করেছেন মানব জাতির জন্ম গ্রহণ ও বিচরণশীল কর্মঠ মানুষ হয়ে যাওয়ার পরও নিজেদের অস্তিত্ব, স্থায়িত্ব ও সকল কার্যক্রমে মানব মহান আল্লাহরই মুখাপেক্ষী। তাই উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন-আমি আল্লাহ তোমাদের মৃত্যুর ও একটি সময় নির্দিষ্ট করে রেখেছি। এই নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে তোমাদের যে আয়ুষ্কাল রয়েছে, তাতে তোমরা নিজেদেরকে স্বাধীন ও স্বাবলম্বীরূপে পেয়ে থাক। এটাতে তোমাদের বিভ্রান্ত বৈ নয়। কেননা, আমি আল্লাহ ইচ্ছে করলে এই মূহুর্তেই তোমাদেরকে নাস্তা-নাবুদ করে তোমাদের স্থলে অন্য জাতি, স্থলাভিষিক্ত করতে সক্ষম। যেমন, কুরআনে করীমে এরশাদ হয়েছে-إن يشأ يذهبكم ويأت بخلق جديد وما ذلك على الله بعزيز
অর্থাৎ মহান আল্লাহ চাইলে তোমাদেরকে ধ্বংস করে তোমাদের স্থলে নতুন সৃষ্টি আনয়ণ করবেন। আর এটা আল্লাহর জন্য কষ্টসাধ্য নয়। (সুবাহনাল্লাহ) অথবা তোমাদেরকে ধ্বংস না করে অন্য কোন জীবের কিংবা জড় পদার্থের আকারে পরিবর্তিত করে দিতেও সক্ষম। নির্ধারিত সময়ে মৃত্যু আসার মধ্যে এ দিকেও ইঙ্গিত রয়েছে যে, তোমরা নিজেদের স্থায়িত্বের ব্যাপারে স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী নও। বরং তোমাদের স্থায়িত্ব একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। মহান আল্লাহ তোমাদেরকে এক বিশেষ শক্তি, সামর্থ ও জ্ঞান-বুদ্ধির বাহক করেছেন। এগুলোকে ব্যবহার করে তোমরা অনেক কিছু করতে পার। আল্লাহর পবিত্র বাণী نَحْنُ بِمَسْبُوقِينَ এর সারমর্ম এই যে, কেউ আমি আল্লাহর ইচ্ছাকে ডিঙ্গিয়ে যেতে পারে না। আমি আল্লাহ এই মুহুর্তেও যা চাই তাই করতে পারি। তোমাদের স্থলে তোমাদেরই মত অন্য কোন জাতি নিয়ে আসতে পারি। অথবা তোমাদের এমন আকৃতি করে দিতে পারি যা তোমরা জান না। অর্থাৎ মৃত্যুর পর মাটি হয়ে যেতে পার। যেমন বিগত উম্মতের মধ্যে আকৃতি পরিবর্তিত হয়ে বানর ও শুকর হওয়ার আযাব এসে গেছে। তোমাদেরকে প্রস্তর ও জড়পদার্থের আকারেও পরিণত করে দেয়া যেতে পারে। কেননা, মহান আল্লাহ তো সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান।

ان الله على كل شيء قدير
উপরোক্ত আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হলো এমন পথভ্রষ্ট মানব কে সতর্ক ও সচেতন করা। যারা মূলত: কেয়ামত সংঘঠিত হওয়ার এবং পুনরুজ্জীবনেই বিশ্বাসী নয়। অথবা মহান আল্লাহর ইবাদত আনুগত্যে অপরকে অংশীদার সাব্যস্ত করে। উদ্দেশ্য মানুষের সেই উদাসীনতা ও মূর্খতার মুখোশ উম্মোচন করা যে, তাকে বিভ্রান্তিতে লিপ্ত করে রেখেছে।
পরিশেষে মহান আল্লাহর আলীশান দরবারে কায়মনোবাক্যে ফরিয়াদ জানাই তিনি যেন সকল কে উপরোক্ত দরছে কুরআনের উপর আমল করে উভয় জাহানে সফলকাম হওয়ার সৌভাগ্য নসীব করেন। আমিন।

লেখক: অধ্যক্ষ, কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা, মুহাম্মদপুর, এফ ব্লক, ঢাকা।

 

Share:

Leave Your Comment