আল্লামা গাজী শেরে বাংলা ও দীওয়ান-ই আযীয

আল্লামা গাজী শেরে বাংলা ও দীওয়ান-ই আযীয

মাওলানা মুহাম্মদ নেজাম উদ্দীন>

আল্লামা গাজী সৈয়্যদ মুহাম্মদ আজিজুল হক শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর একজন প্রখ্যাত আলিম ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ইসলামী পণ্ডিত। তিনি মাযহাবগত হানাফী, তরীক্বতগত কাদেরী এবং তরীক্বতের একজন শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্ম ব্যক্তিত্ব। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নী মুসলমানদের ঈমান-আক্বীদা, অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে ইসলামের সঠিক রূপরেখা আহলে সুন্নাত ওয়াল জমাতের শিক্ষা ও আদর্শকে তুলে ধরা ও সামাজ জীবনে তা বাস্তবায়নে তাঁর বিপ্লবী ভূমিকা আপরিসীম। তাঁর সংগ্রামী প্রচেষ্টার ফলে এদেশের মুসলিম সমাজ নিজেদের আসল পরিচয় খুঁজে পায় এবং ইসলাম বিকৃতকারী ও বিদ্বেষীদের সকল অপতৎপরতা প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা লাভে সমর্থ হয় এবং এতে সফলও হয়।
আল্লামা গাজী শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি আলায়হির চেষ্টা ও ত্যাগের বিনিময়ে এদেশের সুন্নী মুসলমানদের যে একটি বৃহত্তর ঐক্য ও মিলন গড়ে উঠেছিল, তাঁর ইন্তেকালের পর ক্রমান্বয়ে তা নিস্তেজ হতে চলছে। ফলে সুন্নীয়তের বিরোধী সকল অপশক্তি আজ আবার সক্রিয় হয়ে উঠছে। এ দুঃসময়ে এ দেশের সুন্নী মুসলমানদের আল্লামা শেরে বাংলার আদর্শ ও চেতনায় পুনরায় জাগ্রত হওয়া সময়ের দাবী। তাই এ সময়ে তাঁর জীবনাদর্শ, চিন্তা-চেতনার চর্চা ও গবেষণা অধিক হারে করা উচিত বলে মনে করি।
আল্লামা গাজী সৈয়্যদ মুহাম্মদ আজিজুল হক শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি আলায়হি ১৯০৬ সালে (১৩২৩হিজরী) কোন এক শুভলগ্নে চট্টগ্রাম হাটহাজারী থানার ‘মেখল’ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ আব্দুল হামীদ মেখলী আলকাদেরী ও মাতার নাম সৈয়দ মায়মুনা খাতুন। পিতা-মাতা উভয় সূত্রে তিনি আওলাদে রাসূল ছিলেন।
আল্লামা শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রাথমিক দ্বীনিশিক্ষা তাঁর সম্মানিত পিতার তত্ত্বাবধানে অর্জন করেন। অতঃপর হাটহাজারী ‘মঈনুল ইসলাম’ মাদ্রাসায় ‘দাওরা-এ হাদীস’ পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করেন। উল্লেখ্য, তৎকালীন সময়ে দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বল্পতা হেতু অনেক সুন্নী মতাদর্শী আলেম ও শিক্ষার্থীকে ওহাবী মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষকতা ও পড়াশোনা করতে হতো। আল্লামা শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি আলায়হি উক্ত মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে দেওয়াননগর নিবাসী প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন মাওলানা আব্দুল জলীল রহমাতুল্লাহি আলায়হিকে তাঁর আস্থাভাজন শিক্ষক হিসাবে পান। হাটহাজারী মাদ্রাসায় ‘দাওরা-এ হাদীস’ পর্যন্ত অধ্যয়নের পর উচ্চশিক্ষা লাভের মানসে তিনি ভারতে দিল্লীর অদূরে ফতেহপুর আলীয়া মাদ্রাসায় গমন করেন। এসময় ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল বিষয়ে অসাধারণ প্রজ্ঞা ও পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। হিন্দুস্থান থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর যখন দেখলেন- দেওবন্দী-ওহাবীরা সুপরিকল্পিতভাবে একতাবদ্ধ হয়ে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নী মুসলমানদের ঈমান-আক্বীদাকে বিনষ্টের জন্য মাদ্রাসা-মসজিদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তখন তিনি এদেশের সুন্নী মুসলমানদের ঈমান-আক্বীদা রক্ষার তাগিদে আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জমাতের মতাদর্শ ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এ মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তিনি সর্বপ্রথম ১৯৩২ সালে নিজ গ্রাম মেখল ফকিরহাটে প্রতিষ্ঠা করেন ‘এমদাদুল উলুম আজিজিয়া সুন্নীয়া মাদ্রাসা’। পরবর্তীতে তাঁর সুযোগ্য পৃষ্ঠপোষকতা ও গতিশীল নেতৃত্বে দেশের আনাচে-কানাচে অনেক সুন্নী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে।
আল্লামা গাজী শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন মানবকল্যাণে নিবেদিত এবং ন্যায় ও সাম্যের মূর্তপ্রতীক। গরীব ও দুঃখী মানুষের সুখে-দুঃখে একান্ত আপনজন হিসেবে তিনি সুদীর্ঘ সতের বছর নিজ এলাকা মেখল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও তৎকালীন ফুড কমিটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ন্যায়বিচার ও সততার জন্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি প্রতিবারই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতেন। এমন কি তাঁর বিরুদ্ধ মতবাদী ওহাবীরা পর্যন্ত তাঁকে অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন করতেন। কারণ তাদের মন্তব্য ছিলো ‘তাঁকে চেয়ারম্যান করা হলে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে।’
তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের (আজকের বাংলাদেশের) সকল সুন্নী মুসলমানকে একই প্লাটফরমে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য আল্লামা শেরে বাংলা ‘জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম’ নামক সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া ‘আনজুমানে এশায়েত আহলে সুন্নাত ওয়াল জমাত পূর্ব পাকিস্তান’ নামক অপর একটি সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করেন। এ কথা আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, বর্তমান সুন্নীয়তের আন্দোলনে এ দেশে যে সব সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে তার সত্যিকার রূপকার হচ্ছেন আল্লামা গাজী শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি আলায়হি। যা তাঁর চিন্তা-চেতনার বাস্তব ফসল বলা চলে।
আল্লামা গাজী শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি আলায়হি স্বীয় জীবনে দু’বার মক্কা ও মদীনা শরীফ জিয়ারতের সৌভাগ্য অর্জন করেন। প্রথমবার শাদী মোবারকের পূর্বে আর দ্বিতীয়বার ১৯৫৭ ইংরেজীতে ইন্তেকালের বার বছর পূর্বে। তাঁর দ্বিতীয়বার হজ্জের সময় এ দেশের ওহাবীরা ষড়যন্ত্র করে সৌদি সরকারের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলে-‘এ মাওলানা আজিজুল হক শেরে বাংলা মুসলমানদেরকে কাফির বলে, তাই তাঁর বিচার করা হোক।’ ফলে সৌদি পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে তৎকালীন সৌদি গ্রান্ড মুফতী সৈয়দ আলভী ইবনে আব্বাস মালেকী মক্কী সাহেবের নিকট নিয়ে যায়। তিনি আল্লামা গাজী শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি আলায়হিকে তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সত্য কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন- ‘আমি কোন মু’মিন- মুসলমানকে কাফির বলি না। কিন্তু কিছু কিছু মুসলমান নামধারী লোককে কাফির বলি। উদাহরণস্বরূপ তিনি ওহাবীদের লিখিত গ্রন্থ থেকে তাদের কুফরীমূলক উক্তিগুলো তুলে ধরেন। অতঃপর আল্লামা গাজী শেরে বাংলার সাথে ইসলামী আক্বিদার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উক্ত গ্রান্ড মুফতীর সাথে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়। আল্লামা গাজী শেরে বাংলার জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় মুফতী-ই মক্কা সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ প্রত্যাহারসহ তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় হজ্ব পালন করার অনুমতি দেন। অধিকন্তু মুফতী সাহেব আল্লামা গাজী শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি আলায়হিকে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে অগাধ জ্ঞান ও পা-িত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘শেরে ইসলাম’ ওরফে শেরে বাংলা উপাধিতে ভূষিত করে লিখিত সনদপত্র প্রদান করেন এবং উপহারস্বরূপ একটি মূল্যবান পাগড়ি ও ছড়ি প্রদান করে বিশেষ রাজকীয় মেহমান হিসেবে তাঁকে অভিনন্দন ও সম্মান জানান।
তৎকালীন আন্দরকিল্লাস্থ শাহী জামে মসজিদের প্রাক্তন খতীব গাউসে পাক রহমাতুল্লাহি আলায়হির খাস বংশধর প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক সাধক আল্লামা গাজী সৈয়দ আবদুল হামীদ বোগদাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হির পবিত্র হাতে তিনি কাদেরীয়া তরীক্বার বায়আত গ্রহণ করেন। তাঁর কাছ থেকে উক্ত তরীকার খিলাফত ও ইজাযত লাভে ধন্য হন।
শরীয়ত ও তরীক্বতের মহান খিদমত আনজাম দিয়ে ১৩৮৯ হিজরীর ১২রজব (২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯সালে) ৬৩ বছর বয়সে এ মহান আশেকে রাসূল ইন্তেকাল করেন। আলোচ্য প্রবন্ধে আল্লামা শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি আলায়হির অকৃত্রিম নবীপ্রেম ও বাতিলের প্রতিরোধে তাঁর অবদান-এ দু’টি বিষয়ে সংক্ষেপ আলোচনার প্রয়াস রাখি।
আল্লামা গাজী আজিজুল হক শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি আলায়হির পুরো জীবনটাই ছিলো হুব্বে নবীর মূর্তপ্রতীক। তাঁর মতে ‘নবী প্রেমই আল্লাহর প্রাপ্তির পূর্বশর্ত।’ এশকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা’আলার অগণিত নিয়ামতের মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ, অদ্বিতীয় ও অতুলনীয় অমূল্য রতন। যে ব্যক্তি এ নিয়ামতের অংশ পায়নি সে বড়ই হতভাগা। আর যে এ নিয়ামত লাভে ধন্য হয়েছে, সে বড়ই সৌভাগ্যশালী। নবীপ্রেমের এ শিক্ষাই তিনি আজীবন প্রচার করে যান। তাই তিনি প্রায় সময় বলতেন- ‘মাইতু বিমারে নবী হু’।
এ নবীপ্রেম তাঁর ভেতর সর্বদা জাগরুক ছিলো বলে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মান-মর্যাদায় সামান্যতম বেয়াদবীকেও তিনি সহ্য করতে পারতেন না। এ জন্য তিনি সিংহের মতো হুষ্কার দিয়ে নবী বিদ্বেষীদের সকল ষড়যন্ত্র ধুলায় মিশিয়ে দিতেন। যেমন, প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আল্লাহ প্রদত্ত ইলমে গায়ব বা অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী হওয়া, হাযের-নাজের, প্রিয় রাসূূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মিলাদ পাঠকালে দাঁড়িয়ে সালাম জানানো, মিলাদুন্নবী উদযাপন, ওরস-ফাতিহা ইত্যাদি বিষয়সহ দেওবন্দী মৌলভীদের বিভিন্ন কুফরী উক্তি নিয়ে আল্লামা গাজী শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি আলায়হির সাথে এদেশের দেওবন্দপন্থী ওহাবীদের একাধিকবার সম্মুখ তর্ক বা মোনাজেরা অনুষ্ঠিত হয়। এ সব তর্ক যুদ্ধে ওহাবীদের বড় বড় মৌলভীরা প্রতিবারই আল্লামা শেরে বাংলার জ্ঞানগর্ভ যুক্তি-তর্কের সাথে নিজেদেরকে অসহায় বোধ করতেন। শেষ পর্যন্ত সভাস্থল থেকে ওহাবী মৌলভীদের পলায়ন করা ছাড়া কোন উপায় থাকত না।
আল্লামা শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি আলায়হির জ্ঞানগর্ভ ও মর্মস্পর্শী বক্তব্য ও তর্কযুদ্ধের সাথে এঁটে উঠতে না পেরে ওহাবীদের শীর্ষস্থানীয় মৌলভী-মুফতীদের পরামর্শক্রমে আল্লামা শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি আলায়হিকে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে সরিয়ে দেয়ার জন্য পরিকল্পনা করা হয়। এ অসৎ উদ্দেশ্যে তারা কয়েকজন মুনাফিক চক্রের মারফতে তাঁকে বাহ্যিক ভক্তির বেশে হাটহাজারী থানার খন্দকিয়া গ্রামে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যায়। বাদে এশা যথারীতি আল্লামা শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি আলায়হি মাহফিল তশরীফ আনেন। যখন তিনি ইন্নাল্লাহা ওয়া মালাইকাতহু———বলে তকরীর শুরু করলেন ঠিক সেই মুহূর্তে ওহাবীরা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী হঠাৎ মাহফিলে বাতি ও মাইক বন্ধ করে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দেয়। অতঃপর এজিদী কায়দায় তাঁর উপর পেছন থেকে অতর্কিত হামলা করে বসে। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। মাথা ফেটে তীব্র বেগে রক্ত প্রবাহিত হয়। এভাবে আঘাতের পর আঘাত করে মৃত্যুবরণ করেছে মনে করে পার্শ্বের কাঁটা ঝাড়ের মধ্যে তাঁকে ফেলে দেয়। পরে এ ঘটনা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে সুন্নীজনগণ তাঁকে ওহাবীদের কবল থেকে উদ্ধার করে হাটহাজারী হাসপাতালে নিয়ে যান। এ ঘটনা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে সুন্নী জনতার মধ্যে প্রতিশোধের দাবানল জ্বলে উঠে। এরূপ বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতিতে তৎকালীন দেশের বিশিষ্ট নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী ও দেশের অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানে এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়। উক্ত সভায় ফজলুল কাদের চৌধুর সুন্নীজনগণকে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে শান্ত হতে বলেন এবং ওহাবীদের হীন আচরণে দুঃখ প্রকাশ করে তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করতঃ দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করেন। অবশেষে তিনি আল্লামা শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি আলায়হির চিকিৎসাধীন শয্যা থেকে প্রদত্ত ‘অনুরোধ বাণী’ পাঠ করে শুনান। আল্লামা শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর প্রদত্ত বাণীতে সুন্নীজনতাকে শান্ত হওয়ার আহবান জানান। এবং এ ঘটনার কোন প্রতিশোধ না নেয়ার এবং সকলকে ধৈর্যধারণ করার আহবান জানান। তাঁর এ আহবানের পর তেজোদীপ্ত সুন্নীজনতার হৃদয়ে শান্তির পরশ নেমে আসে। মাসাধিককাল চিকিৎসার পর অবশেষে তিনি আরোগ্য লাভ করেন।
বিংশ শতাব্দীতে এ দেশে ফার্সী-উর্দু চর্চার ইতিহাসে চট্টগ্রামের যে সব ফার্সী-উর্দু কবি-সাহিত্যিক ও আলিমগণের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন তাঁদের মধ্যে আল্লামা গাযী আযীযুল হক শেরে বাংলা আলকাদেরী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ১৯০৬-১৯৬৯) অন্যতম। ফার্সী ভাষায় লিখিত তার ‘দীওয়ান’ ফার্সী সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। এ কাব্যের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় এ দেশের সুন্নী আলিম-ওলাম, পীর-মাশাইখ ও সূফীয়া-ই কিরামের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধার অর্ঘ্য পেশ করা। তিনি তাঁর এ গ্রন্থে বাংলাদেশ, বিশেষত চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এমন বিদগ্ধ আলিম-ওলামা ও পীর-দরবেশদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরেন, যাঁদের অবদানের কথা এমনকি নাম পর্যন্ত এ দেশের মানুষ ভুলে যাচ্ছিল। অথচ আমাদের ধর্ম ও সমাজ জীবনে ওই সব মহামনীষীর অবদান অপরিসীম। তাই আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি আলায়হি রচিত এ ‘দীওয়ান’ আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক অমূল্য সম্পদ। বাংলার পীর-আউলিয়া, সূফী-দরবেশ ও বিদগ্ধ আলিম-ওলামা ও জ্ঞানী-গুণী সমাজের ইতিহাস রচনায় ইতিহাসবিদগণ তাঁর এ গ্রন্থে অনেক মূল্যবান তথ্য ও উপাত্ত খুঁজে পাবেন বলে আমার বিশ্বাস।
এ দেশের মুসলমানদের কোরআন-সুন্নাহ্সম্মত হাজার বছরের লালিত আদর্শ ও ঐতিহ্যকে যখন এক শ্রেণীর দুরাচার আলিমগণ কুফর ও শিরক বলে ফতোয়াবাজিতে লিপ্ত হয়, তখন আল্লামা শেরেবাংলা রহমাতুল্লাহি আলায়হি সম্মুখতর্ক, ওয়াজ-নসীহত সর্বোপরি লেখনিতে তা তুলে ধরে এ দেশের মুসলমানদের ঈমান-আকীদা সংরক্ষণে এক বিপ্লবী ভূমিকা পালন করেন। আল্লাহ্র হাম্দ, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলঅইহি ওয়াসাল্লাম’র না’ত এবং প্রায় ২৭০ জনের মত আল্লাহ্র পুণ্যাত্মা বান্দা আউলিয়া-ই কিরাম, পীর-মাশাইখ, আলিম-ওলামা, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবীদের শানে রচিত ২১৫ পৃষ্ঠার এ বিশাল কাব্যগ্রন্থের শব্দের চয়ন, বিন্যাসের নিপুণতা, ভাষার প্রাঞ্জলতা ও সাবলীলতায় ফার্সী সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ বলা চলে। বিশেষতঃ আমাদের পূর্বসূরিদের জীবন ইতিহাস সম্পর্কে জানার এক অনন্য মাধ্যম।
উপরিউক্ত এ নানা বৈশিষ্ট্যের কারণে তাঁর ‘দীওয়ান’ গ্রন্থটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত’র অনুসারীদের কাছে এক অমূল্য সম্পদ বলে বিবেচিত। পাকিস্তানের বিশিষ্ট উর্দু-ফার্সী সাহিত্য সমালোচক, জনপ্রিয় গবেষণা পত্রিকা মাসিক ‘মা‘আরিফ-ই রেজা’র সম্পাদক আল্লামা সৈয়দ ওয়াজাহাত রসূল কাদেরী ‘দীওয়ান-ইআযীয’র ভাষা, ছন্দ ও নানা বৈশিষ্ট্যের উপর আলোকপাত করতে গিয়ে লিখেছেন- “ভাষা ও বর্ণনাশৈলী, উপমা-উৎপ্রেক্ষা এবং পরিভাষার যথাযথ ব্যবহার ফার্সী ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর গভীর দক্ষতা এবং কবিতা ও কাব্যে তাঁর গভীর সম্পর্কের পরিচয় বহন করে। ভাষার সরল প্রবহমানতা দেখে এমন মনে হয়, এটা কোন ফার্সী ভাষাভাষী কবির কবিতা। তাঁর কবিতায় ইসলামী বিদ্যাসমূহ ছাড়াও সমাজ-বিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও তাঁর সুগভীর চিত্তাকর্ষের ইঙ্গিত বহন করে। বস্তুত ‘দীওয়ান-ই আযীয’ বিষয়বস্তু ও কবিত্বের বৈশিষ্ট্য ছাড়াও ঐতিহাসিক বরং ইতিহাস সৃষ্টিকারী গুরুত্ববহ ‘দীওয়ান’।
[সূত্র: আল্লামা সৈয়দ ওয়াজাহাত রসূল কাদেরী, আপনে দেশ: বাংলাদেশ মে, মা’আরিফ-ই রেজা, জানুয়ারি ২০০৫ (পাকিস্তান, করাচি) পৃষ্ঠা-২৮]